মাতৃভাষার গুরুত্ব
আমাদের প্রতিমুহূর্তের জীবনে ভাষা এক অনিবার্য অবলম্বন। জীবনের সকল কর্মপ্রবাহে বাহ্যত ভাষাই আমাদের প্রধান নির্ভরতা। পৃথিবীতে সবকিছুর বর্ণনার বাহন এ ভাষাই। তাই ভাষা পৃথিবীতে মহান আল্লাহর প্রদত্ত নিয়ামতগুলির অন্যতম। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের সূরা আররহমানে মানবতার প্রতি প্রদত্ত তাঁর শ্রেষ্ঠ নিয়ামতগুলির উল্লেখ প্রসঙ্গে বর্ণনা শিক্ষা দেওয়ার কথাটি উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, “করুণাময় আল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন, সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তাকে শিখিয়েছেন বর্ণনা।” -সূরা আররহমান, ১-৪
দেখা যাচ্ছে যে, প্রধান প্রধান নিয়ামতগুলির উল্লেখ প্রসঙ্গে তৃতীয় নম্বরে রয়েছে বর্ণনা শিক্ষা দেওয়ার কথাটি। এ বর্ণনার বাহনই হচ্ছে ভাষা। ভাষা পৃথিবীতে একটি দু’টি নয়, বিচিত্র ভাষার এই পৃথিবী। ভাষার এ বৈচিত্র্যও মহান আল্লাহর কুদরতের একটি নিদর্শন। ইরশাদ হয়েছে, “এবং তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে তোমাদের বর্ণ ও ভাষার বৈচিত্র্য ।” এ বিচিত্র ভাষার মধ্যে আবার মাতৃভাষাই প্রত্যেকের স্বচ্ছন্দ অভিব্যক্তির বাহন এবং সবচে প্রিয় ভাষা। আমাদের বাংলা ভাষার আদর্শ কবি ফররুখ আহমদ তো মাতৃভাষাকে খোদার সেরা দান বলেই উল্লেখ করেছেন। তিনি তার একটি কবিতায় বলেছেন,
মাতৃভাষা বাংলা ভাষা
খোদার সেরা দান
বিশ্ব ভাষার সভায় তোমার
রূপ যে অনির্বাণ॥
পৃথিবীতে বিভিন্ন জাতির কাছে মহান আল্লাহর বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য নবী-রাসূলদেরকেও নিজ নিজ মাতৃ ভাষায়ই প্রেরণ করা হয়েছিল। এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনের একটি আয়াত আমাদের সুপরিচিত। আয়াতটির অর্থ হল, “আমি প্রত্যেক নবী-রাসূলকেই স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি। এ আয়াত থেকে বোঝা যায়, কোনো জাতির কাছে বোধগম্যরূপে দ্বীনের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য মাতৃভাষা অপরিহার্য। সে কারণেই মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। শুধু তাই নয় মূসা আ.-এর বেলায় তো আমরা আরও স্পষ্ট একটি ব্যাপার লক্ষ করি। হযরত মূসাকে যখন ফেরআউনের কাছে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছানোর আদেশ দেওয়া হল তখন তিনি মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বললেন “হে আল্লাহ, আমার বক্ষ আড়ষ্ট হয়ে আসছে এবং আমার কণ্ঠ সাবলীল নয়, অতএব আপনি হারুনের কাছেও ওহী প্রেরণ করুন। কারণ সে আমার চেয়ে স্পষ্টভাষী”। -সূরা শুআরা ১৩এ আয়াত থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, রিসালাতের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সাবলীল ভাষা একটি বড় সহায়ক শক্তি। কোনো আদর্শের প্রতিষ্ঠার জন্য কোনো বার্তা মানব হৃদয়ে যথার্থরূপে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সাবলীল ভাষার গুরুত্ব কতটুকু তা এ আয়াত থেকেই অনুমিত হয়। সে কারণেই আখেরী নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মহান আল্লাহ আরব অনারবের সর্বোত্তম সাহিত্যমাধুর্য দিয়ে প্রেরণ করেছিলেন। নবীজী স্পষ্ট ভাষায় সে কথা জানিয়েও দিয়েছিলেন। তাই বলা যায়, মাতৃভাষা আমাদের জীবনে যতটা পুষ্পিত হয়ে উঠবে ইসলামের আলোকময় বাণী আমরা তত সুন্দরভাবে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারব।
পূর্বের বক্তব্যে একথা প্রতীয়মান হয়েছে যে, নবী-রাসূলগণকে তাঁদের নিজ নিজ মাতৃভাষায় শুধু কথা বলার যোগ্যতাই দেওয়া হয়নি; বরং বিশেষ ব্যুৎপত্তি দিয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। যাতে তাঁরা দ্বীনের বার্তাগুলি যথাযথভাবে মানুষকে বুঝিয়ে দিতে পারেন। বুঝা যায় যে, নবীগণ স্পষ্ট সাবলীল ও হৃদয়গ্রাহী ভাষায় মানুষের কাছে দ্বীনের বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। প্রিয় নবীর হাদীসসমগ্রই আমাদের এ বক্তব্যের স্পষ্ট প্রমাণ দেয়। হাদীসের ভাষা, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, ভাব-সুষমা ও বাক্যের ছন্দময়তা এই আধুনিক কালেও আরবী সাহিত্যের এক প্রামাণ্য উৎস হয়ে আছে। যা সাহিত্যামোদীদেরও এক চমৎকার কৌতুহলের উৎস।
নবীদেরকে স্বজাতির ভাষায় প্রেরণ সম্পর্কিত আয়াতটি উল্লেখ করে বিগত শতাব্দীর মহান চিন্তাবিদ আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী রহ. এ প্রসঙ্গে বলেন, “চিন্তাশীলগণ বুঝতে পারেন যে, স্বজাতির ভাষা বলতে শুধু স্বজাতির ভাষা বুঝতে পারা এবং তা অপরকে বোঝাতে পারার যোগ্যতা উদ্দেশ্য নয়; বরং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে আপন যুগের ভাষা ও সাহিত্যের উচ্চতর মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হওয়া এবং তাতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা। মহান আল্লাহর উল্লেখিত বাণীর পরেই ‘যাতে আপনি তা তাঁদের জন্য সুস্পষ্টরূপে বিবৃত করতে পারেন’ কথাটিই আমাদের একথার সত্যায়ন করে। আপনারা জানেন যে, ইসলামের ইতিহাসে যে ব্যক্তিবর্গ বড় কোনো অবদান রেখেছেন এবং মুসলমানদের চিন্তা চেতনা ও ধ্যান ধারণার উপর গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছেন তারা সাধারণত বাক ও লিখনি শক্তির অধিকারী ছিলেন এবং তাঁদের রচনা ও বক্তৃতায় বিশুদ্ধ সাহিত্য ও অলংকার বিদ্যমান।” আলী মিয়া রহ. এর মূল্যবান বিশ্লেষণের পর এ প্রসঙ্গে আর কোনো বিশ্লেষণের প্রয়োজন বোধ করি না। তাহলে এ পর্যালোচনায় যে বার্তাটি আমরা পাই তা হল- ভাষার মধ্যে যদি বিশুদ্ধতা প্রাঞ্জলতা ও মাধুর্য না থাকে তাহলে তা যথাযথভাবে শ্রোতার হৃদয়ে রেখাপাত করে না। আমাদের পূর্বসূরী মহান সন্তানদের জীবন ইতিহাস মন্থন করে মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী রহ. দেখিয়েছেন যে, তাঁরা নিজ নিজ মাতৃভাষায় কতটা দক্ষতা ও সচেতনতার অধিকারী ছিলেন। এখানে তার সুদীর্ঘ উদ্ধৃতি দেওয়া সম্ভব নয়। অনুরাগী পাঠক মনে চাইলে নদভীর রহ. “পা জা ছুরাগে যিন্দেগী”র স্বদেশী ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে সংযোগ বিষয়ক ভাষণটুকু পড়ে দেখতে পারেন, যা আমাদের জন্য পথ ও পাথেয় হয়ে আছে।