ফিদায়ে মিল্লাত হযরত মাদানী রহ. ও কিছু স্মৃতিকথা
ফিদায়ে মিল্লাত আমীরুল হিন্দ হযরত সায়্যিদ আসআদ মাদানী রহ. ছিলেন এক অসাধারণ ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ। মুসলিম মিল্লাতের উন্নতি, অগ্রগতির জন্য যিনি সর্বদা থাকতেন মহাব্যস্ত। মানুষের বিপদাপদে দুঃখ-দুর্দশায় সর্বদা তাদের পাশে এসে দাঁড়াতেন। উম্মাহর যে কোনো বড় সমস্যায় প্রয়োজনে দেশ থেকে দেশান্তরে ছুটে যেতেন। হযরতের বড় ছেলে মাওলানা মাহমুদ মাদানী বলেছেন, ছোট বেলায় আমরা আব্বাজানকে আমাদের ঘরে মেহমানের মতই ভাবতাম। মেহমান যেমন মাসে দু’মাসে এক দু’দিনের জন্য বেড়াতে আসেন, তিনিও তাই করতেন।
হযরতকে সর্বপ্রথম দেখার সুযোগ হয়েছিল উত্তরবঙ্গে সৈয়দপুর দারুল উলুমের এক বিশাল সম্মেলনে প্রধান অতিথিরূপে। সম্ভবত একাশি সালে। উক্ত সম্মেলনে জনৈক উর্দূভাষী তাঁর শুভাগমন উপলক্ষে স্বরচিত কবিতা শুনিয়েছিলেন। বয়সের স্বল্পতার দরুন কবিতার মর্ম বুঝতে পারিনি। তবে কবির ভাব-ভঙ্গি, আবেগ-উচ্ছাস ও হযরতের প্রতি বারবার তাকানোর কথা আজও হৃদয়ে গেঁথে আছে। হামদ ও ছানার পর হযরতের প্রথম কথা ছিল আমি এ প্রশংসার যোগ্য নই। এ মঞ্চে যদি মাটি থাকত তবে নবীজীর হুকুম অনুযায়ী আমি প্রশংসাকারীর মুখে তা নিক্ষেপ করতাম।
২য় বার হযরতকে দেখেছিলাম সিলেট কাজির বাজার মাদরাসার সম্মেলনে। মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবীবুর রহমান সাহেব মাদানী খান্দানের ভক্ত হিসাবে খ্যাত ছিলেন। এ সময় আমি সিলেট হযরত শাহজালাল রহ.-এর দরগার পার্শ্বস্থ কাসিমুল উলুম সংক্ষেপে দরগাহ মাদরাসার ছাত্র। সম্মেলনের শুরুর দিকে জনৈক ছাত্রভাই মাদরাসার পক্ষ থেকে প্রশংসাগাথা গজল গেয়ে হযরতকে শুভেচ্ছা জানায়। গজলটির প্রথম দু’লাইন যতটুকু মনে পড়ে এমন ছিল-
হে আসআদ মাদানী মারহাবা!
হে পূর্বসূরীদের প্রতিচ্ছবি মারহাবা!
হে হুসাইন আহমদের সন্তান মারহাবা!
হে উত্তরসূরীদের নেতা মারহাবা!
এরপর ঢাকা মালিবাগ মাদরাসায় অধ্যয়নকালে অনেকবার কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। দাওরায়ে হাদীসের বছর হুজুরদের উৎসাহ প্রদানে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর হাতে বাইআত হলাম।
হযরতকে আমরা খুব ভয় পেতাম। এর কারণ এক তো তার চেহারার ভাব গম্ভীর্য, দ্বিতীয়ত বড়দেরকে দেখেছি তাকে খুব ভয় করতেন। আমাদের শায়খুল হাদীস উস্তাদে মুহতারাম হযরত মাওলানা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ (দামাত বারাকাতুহুম) বলতেন, আমি ওনার শাগরিদ বা মুরিদ কিছুই নই। এতদসত্ত্বেও ওনাকে দেখে আমার রক্ত যেন পানি হয়ে যায়।
দারুল উলূম দেওবন্দে অবস্থানকালে ওই ভীতিই কাজ করেছিল। ফলে হযরত কখনো দেওবন্দে ফিরে আসলেও খুব একটা কাছে ভিড়তাম না। এ ভয় অনেক কেটেছিল চৌধুরী পাড়া দারুল কুরআন মাদরাসায় হযরতের ইতিকাফের সময়। এ সময় এ সত্যও উপলব্ধি করি যে, বুযর্গদের রাগ খুবই সময়োপযোগী হয়ে থাকে। রমযানের শেষ দশ দিন ইতিকাফের সময় হযরত তার খাস কামরায় যা তখন পর্দা দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল, মুরিদ-মুতাআল্লিকীনদেরকে সবক দিতেন। সেখানে সবক নিতে গিয়ে দেখলাম ঠিক বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের মত নম্রতা ও কোমলতা নিয়ে সবক দিচ্ছেন। পরবর্তীতে আরও চার রমযান দেওবন্দে ইতিকাফ করার সৌভাগ্য হয়েছে। ইতিকাফকালে সেই উপলব্ধি আরও তীব্র হয়েছিল।
এই চার রমযানে অনেক সময়ই হযরতের দস্তরখানে একই সঙ্গে খানা খাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। আমি তো গোগ্রাসে গিলেছি। কিন্তু সব সময় লক্ষ রেখেছি হযরত একটি রুটির চারভাগের একভাগ কিংবা হঠাৎ বড়জোর অর্ধেক রুটি খেতেন। অথচ সকলেই দেখেছেন রমযানে তার চেহারার নুরানিয়্যাত অনেক গুণ বৃদ্ধি পেত। আমরা আশ্চর্য হতাম যে, এই পানাহার আর এত নুরানিয়্যাত! পরে জনৈক বন্ধুর নিকট শুনলাম, হযরত নাকি তাদের সামনে একদিন বলে ফেলেছিলেন,
‘রমযানকে আমি পানাহারের জন্য রাখিনি।’
একদিন মেহমানের এত ভিড় হল যে, স্থান সংকুলান হওয়াই মুশকিল ছিল। হযরত তার পিতার মতো মেহমানদের সঙ্গেই খানা খেতেন। খানা খেতে এসে মেহমানের আধিক্য দেখে মুচকি হাসি দিলেন এবং দস্তরখানে বসার পর বললেন,
হযরত (শাইখুল ইসলাম হযরত হুসাইন আহমাদ মাদানী) রহ. এর এখানে মেহমান যত বেশি হত ততই তিনি খুশি হতেন। আলহামদুলিল্লাহ আমারও একই অবস্থা।
মেহমানদারিতে হযরতের জুড়ি ছিল না বললে মনে হয় অত্যুক্তি হবে না। রমযানে যারা ইতিকাফে তাঁর সঙ্গে থেকেছেন তারা দেখেছেন রোজার শুরু থেকে ঈদের দিন পর্যন্ত গড়ে প্রায় এক হাজার লোক খানায় শরিক হত। এর পুরো ব্যয়ভার তিনি নিজেই বহন করতেন। একবার দেখলাম ইফতারে তিনি দেওবন্দবাসীকে দাওয়াত করেছেন। সেদিন তো লোকে লোকারণ্য। অনেক সময় আমি মনে মনে ভাবতাম, এঁরাই প্রকৃত বুযর্গ, গোটা রমযানে দিবারাতে সর্বোচ্চ মেহনত করে নিজেরা যা কামানোর তা তো কামাচ্ছেনই তদুপরি প্রতিদিন শুধু ইফতার করিয়েই প্রায় একহাজার লোকের একহাজার রোযার সওয়াব কামাচ্ছেন।
হযরতের মেহমানদারির আরেকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করেছি, বিভিন্ন দেশের লোকদের রুচির প্রতি লক্ষ রেখে তাদের পছন্দের খানা পরিবেশন করতেন। বর্তমানে লন্ডন ও দক্ষিণ আফ্রিকার সিটিজেন অনেকে ইতিকাফের উদ্দেশ্যে দেওবন্দে আসতেন। তারা মূলত গুজরাটি। একবার দেখলাম তাদের জন্য গুজরাটি বিরিয়ানি পাকিয়ে আনা হল। আমি একটু খেয়ে দেখলাম সে কি অপূর্ব স্বাদ।
হযরতের গুণাবলি সম্পর্কে আমার সংক্ষিপ্ত জরিপ হল তিনি তার পিতা শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ.-এর প্রতিবিম্ব ছিলেন। তাসাওউফের ভাষায় পিতার সঙ্গে ছিল তাঁর নিসবতে ইত্তেহাদী। তাঁর নামায ছিল পিতার নামাযের মতো। মেহমানদারিও ছিল পিতার মতো। জীবনে শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও যখন তিনি নামাযে দাঁড়াতেন তখন নিশ্চল পাহাড়সম হয়ে যেতেন। তাঁর নামাযের মতো নামায শুধু আমি দেখিনি তা নয়; যাদের সঙ্গেই এ ব্যাপারে আলাপ হয়েছে তাদের সেই একই অভিব্যক্তি পেয়েছি।
আমলের খুব পাবন্দী করতেন তিনি। রুহবানুল লাইল ও ফুরসানুন নাহার (রাতে ইবাদতে মগ্ন আর দিনে অশ্বারোহী যোদ্ধা) এর মূর্ত প্রতীক ছিলেন। রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত খেদমতে খালক বা জনসেবার কাজে মহাব্যস্ত থাকার কারণে প্রতিদিন শত মাইল সফর করেও জামাতে নামায, ফরজের পূর্বের ও পরের সুন্নতের নিয়মিত পাবন্দী করতেন। আর এত ক্লান্তির পরও রাতে যে সময় ওঠার ঠিক সে সময়ই উঠে পড়তেন তাহাজ্জুদ নামাযের জন্য। বাসায় রাত কাটান বা ট্রেনে, নিয়মের কখনও কোনো ব্যতিক্রম ঘটত না। এ যেন আল্লাহর হুকুম “সুতরাং যখন আপনি অবসর হবেন তখন (ইবাদত বন্দেগীতে) পরিশ্রম করুন এবং আপনার রবের প্রতি অনুরাগী হোন” তামিলের চেষ্টা। আমার মতে এটি ছিল হযরতের বড় একটি কারামত। বুযর্গরা বলেছেন, ‘আমলের উপর অটল অবিচল থাকতে পারা হাজার কারামতের চেয়ে উত্তম।’
(চলবে)