যিলকদ ১৪৩১   ||   নভেম্বর - ২০১০

দীর্ঘ হচ্ছে শিক্ষিত বেকারের মিছিল : প্রয়োজন শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল সংস্কার

ইসহাক ওবায়দী

জাতীয় উন্নতি-অগ্রগতির জন্য সঠিক শিক্ষার বিকল্প নেই। জাতির    চিন্তাশীল ও অভিভাবক শ্রেণী যদি সময়ের ভাষা বুঝতে ব্যর্থ হন তাহলে জাতীয় জীবনে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসা অবশ্যম্ভাবী। উদ্বেগের বিষয় এই যে, আমাদের দেশে এই বিপর্যয় শুরু হয়ে গেছে। দেশের সিংহভাগ শিক্ষার্থী আধুনিক শিক্ষা-ব্যবস্থার  সাথে যুক্ত, কিন্তু  এর প্রচলিত কাঠামো শিক্ষার্থীকে সময়ের সাথে পাল্লা দিতে সাহায্য করছে না। উপরন' আদর্শ ও নৈতিকতা এবং সহজ-সরল জীবনযাপনের মানসিকতাও তৈরি করছে না। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই তা শিক্ষার্থীর জন্য অভিশাপ হয়ে দেখা দিচ্ছে।

দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান এবং সম্ভবত তা বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। আর এর পিছনে আমাদের প্রচলিত শিক্ষা-ব্যবস্থার অবদান মোটেই কম নয়। সাপ্তাহিক ২০০০-এর একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে, ‘পশ্চিম যখন প্রযুক্তিদক্ষ জনশক্তি তৈরি করছে আমরা তখন তৈরি করছি সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত বেকার। আমরা হাঁটছি উল্টো দিকে, আমাদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে উঠেছে বেকার তৈরির কারখানা। জনশক্তিভাণ্ডারে প্রতিবছর এখন ২২ লাখ বেকার যোগ হচ্ছে। প্রতি বছর ৩৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৪০ হাজার শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার সনদ পাচ্ছে, যার সিংহভাগই থেকে যাচ্ছে বেকার। কাঙ্খিত চাকরি না পেয়ে ভুগছে হতাশায়। হতাশাগ্রস্ত উচ্চশিক্ষিতদের কর্মসংস্থান করতে পারছে না     সরকার। তবুও থেমে নেই উচ্চ শিক্ষার স্রোত।’ (সাপ্তাহিক ২০০০, বর্ষ ১২, সংখ্যা ৩৯)

আতঙ্কের বিষয় এই যে, ‘বেকার তৈরির কারখানাও প্রতিদিনই বাড়ছে। ব্যাঙের ছাতার মতো ছড়িয়ে পড়েছে সমাজের ওপর-নিচ সর্বত্র। বর্তমানে দেশে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৪টি। মার্কেটের কোণায়, শপিং মলের ছাদের ওপর বসে পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়। ভিমরি খাওয়ার দশা! শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ই বাড়ছে না, বাড়ছে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও। এই ক্রমবর্ধমান সংখ্যাকে কম করে হলেও বিস্ফোরণ বলা উচিত।

সাপ্তাহিক ২০০০ থেকেই আরেকটি উদ্ধৃতি দেই-

১৯৯৮ সালে দেশের ৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৬৭ হাজার ১৪৫ জন। ২০০১ সালে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫ আর শিক্ষার্থীদের সংখ্যা দাঁড়ায় ৯২ হাজার ৫ শ ৬২ জন। ২০০৮ সালে দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৯ আর শিক্ষার্থীসংখ্যা উন্নীত হয় ১১ লাখ ৭৬ হাজার ৯ শ ৬৯ জনে। যার মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যাই ৯ লাখ ৩৯ হাজার ৭ শ ৩০ জন। (পাস) পর্যায়ের পরীক্ষায় ৫০ হাজার ৩ শ ৩০ জন, স্নাতক (সম্মান) পর্যায়ে ৫৭ হাজার ৫ শ ৯ জন, কারিগরী স্নাতক পর্যায়ে ৬ হাজার ৮ শ ৯৮ জন, স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ৩২ হাজার ৯ শ ৬৭ জন, কারিগরী স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ১ হাজার ৫ শ ১৪ জন শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়। এছাড়া এমএস, এমফিল ও পিএইচডি পর্যায়ে ৮ শ ২৪ জন এবং সার্টিফিকেট ও ডিপ্লোমা পর্যায়ে ২ হাজার ৪ শ ৬০ জন উত্তীর্ণ হয়। একই বছর বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৩২ হাজার ৭ শ ১ জন। সর্বমোট ১ লাখ ৫৮ হাজার ২ শ ৩ জন উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে বেরিয়ে আসছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতি বছরে।

শিক্ষা-ব্যবস্থার পিছনে খরচ হয় বিপুল রাষ্ট্রীয় অর্থ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর আবাসন, যাতায়াত ফি ও খাওয়ার খরচ বাবদ অভিভাবককে অন্তত অর্ধলক্ষ টাকা ব্যয় করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে ব্যয়টা আরো বেশি। কিন্তু সরকারকে ব্যয় করতে হয় এর চেয়েও বড় অংকের টাকা। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের হিসাব মতে ২০০৮ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পেছনে সরকারের মাথাপিছু ব্যয় ছিল ২ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পেছনে মাথাপিছু ব্যয় ছিল ১ লাখ ৬৩ হাজার টাকা। চট্টগ্রাম ভেটেরিনারী ও অ্যানিম্যাল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩১৫ জন শিক্ষার্থীর মাথাপিছু ব্যয় ছিল ১ লাখ ১৫ হাজার ৫৫৫ টাকা। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর মাথাপিছু ব্যয় ছিল ১ লাখ ১১ হাজার টাকা। বুয়েটের শিক্ষার্থীপ্রতি সরকারের ব্যয় ছিল ৬৭ হাজার টাকা। একই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮ হাজার ৭ শ ৭২ জন ছাত্রের মাথাপিছু সরকারের ব্যয় ছিল ৫৪ হাজার ১৫৩ টাকা।  এই বিশাল অংকের খরচ পার করে যারা শিক্ষিত এবং সবিশেষ উচ্চশিক্ষিত হয়ে বের হচ্ছে তাদের ভাগ্যে অবশেষে কী জুটছে-এটাই হল এই উদ্ধৃতির       মূল কথা।

একটি জরিপে দেখা গেছে, পৃথিবীর

১২ টি দেশে বেকারত্ব উদ্বেগজনক

হারে বাড়ছে। বাংলাদেশ এই ১২টি দেশের অন্যতম। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে এই বৃদ্ধির হার ছিল ১.৯ শতাংশ। অপর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশে প্রতি বছর ২৭ লাখ জনগোষ্ঠী চাকরির যোগ্য হচ্ছে। এর বিপরীতে চাকরি পাচ্ছে মাত্র ৫ লাখ লোক। অর্থাৎ প্রতি বছর অন্তত ২২ লাখ লোক যোগ হচ্ছে বেকার-তালিকায়। আর বেকারত্বের শিকার জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশই হচ্ছে উচ্চ শিক্ষিত। আর তার নমুনা এমন-২০০৬ সালে সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর ৪০ হাজার শূন্য পদের বিপরীতে কয়েক লাখ উচ্চ শিক্ষিত প্রার্থী ছিল। ক্রমাগত এই তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতরই হচ্ছে। (সাপ্তাহিক ২০০০)

এই শিক্ষিত বেকাররা চাকরি খুঁজছে না তা নয়, কিন্তু খুঁজলেই কি চাকরি পাওয়া যায়?

দৈনিক কালের কণ্ঠ (২৬/২/১০) লিখেছে, ‘দেশের অন্যতম বৃহৎ অনলাইন জবসাইট বিডি জবস ডটকম’-এর হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ১৫ হাজার চাকরিপ্রার্থী তাদের সাইটে ১৫ লাখ বার ভিজিট করেন। প্রতি মাসে এই সাইটে ঢুকে চাকরি খোঁজে ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ। ওয়েব সাইটটিতে ২ লাখেরও বেশি বায়োডাটা জমা পড়েছে। প্রসঙ্গত, ইন্টারনেট-সংযোগসহ কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগধারী শিক্ষিতরাই কেবল অনলাইনে চাকরি খুঁজতে পারেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, অনেক বিজ্ঞাপনেই লেখা থাকে-অভিজ্ঞদের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিলযোগ্য, কিন্তু উচ্চ শিক্ষিতদের জন্য অভিজ্ঞতার শর্ত শিথিল করা হচ্ছে না। এভাবে শিক্ষিত এবং উচ্চশিক্ষিত যুবকরাই বেকার হয়ে দেশ ও জাতির জন্য মহা অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আলোচনা দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে,

তবে একটি প্রয়োজনীয় কথা, যা দেশের    চিন্তাশীল আলেমগণ সবসময় বলে যাচ্ছেন, কিন্তু আমাদের চিন্তাবিদ বুদ্ধিজীবীগণ তাতে কর্ণপাত করছেন না তা বলেই শেষ করছি। পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা তাকেই বলা যায় যা শিক্ষার্থীকে দুটো জিনিস দান করে : ১. দক্ষতা ২. আদর্শ। পক্ষান্তরে যে শিক্ষা নসানিয়াত ও মানবতা দান করে না এবং অল্পেতুষ্টি ও সহজ-সরল জীবনের প্রেরণা সৃষ্টি করে না তা শিক্ষার্থীর জন্য আশির্বাদ নয়, অভিশাপ। ভেবে দেখা উচিত, আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থায় এই দুই বিষয়ের কোনটি কতটুকু আছে। 

 

advertisement