যিলহজ্ব ১৪২৭   ||   জানুয়ারি ২০০৭

শপিং : লক্ষ্যভ্রান্ত মানুষের নতুন বিনোদন

আলো ঝলমলে অসংখ্য শপিংমল এখন নগরজীবনের উজ্জ্বলতম অঙ্গ। দিনের সূর্য অস্তমিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই শপিংমলগুলো স্বমহিমায় আবিভূর্ত হয়। নানা রংয়ের উজ্জ্বল আলোর ঝলকানিতে গোটা শহরই যেন বিয়েবাড়ির রূপ ধারণ করে। শুধু কি বাইরের আলোকসজ্জা, ভিতরের আধুনিক থেকে আধুনিকতম ফ্যাসিলিটিজে সমৃদ্ধ হয়ে প্রতিদিন চোখ মেলছে নতুন নতুন শপিং সেন্টার। ব্যস্ততম নগরীর ধোঁয়া, গাড়ির হর্ণ ও যানজটের মরুভূমিতে এই সেন্টারগুলো যেন এক একটি শ্যামল মরুদ্যান। নগরীর মরুচারী বেদুইনদের যে এই মরুদ্যানগুলো ভালই আকৃষ্ট করছে তা এগুলোর ক্রমবর্ধমান সংখ্যা থেকেই অনুমান করা যায়। এসব সেন্টারে কি মানুষ শুধু বেচা-কেনার জন্য আসে। মোটেই না। এখানে মানুষ আসে একটু বিশেষ ধরনের আনন্দ লাভের জন্য। ৩০০ টাকার পণ্য যদি ৩০০০ টাকায় কেনা হয় তাহলে এটা কি বেচা-কেনার সংজ্ঞায় পড়ে। পণ্যের মূল্য ৩০০ টাকা আর বাকি ২৭০০ টাকা কীসের জন্য! হ্যঁা, পণ্যমূল্যের নয় গুণ বেশি অর্থ খরচ করা হল অমুক সেন্টার থেকে কিনেছি- এই সিলটির জন্য। কী কিনেছি তার চেয়ে বড় হল কোত্থেকে কিনেছি এই প্রশ্ন। অতএব একে বেচা-কেনা বলা যায় না। মানুষ কেনে তার প্রয়োজন মেটানোর জন্য। আর শপিং করে কিছু সময় আনন্দপুরীতে সময় কাটিয়ে বে-হিসাব টাকা পয়সার কিছু অংশ ফঁুকে দেওয়ার জন্য। ফেরার সময় সঙ্গে থাকে কিছু প্যাকেট। হয়তো সেসব প্যাকেটে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস থাকে কিংবা থাকে না।

সম্পদের  এহেন অপচয় যেহেতু একশ্রেণীর মানুষের জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়। তাই সম্পদ ব্যবহারের অবশিষ্ট খাতগুলো সেখানে হয়ে যাচ্ছে গুরুত্বহীন। একটি ছোট দৃষ্টান্ত দেই, কিছুদিন আগে বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে যে, বিপুল অংকের ফোনবিল বকেয়া রাখার কারণে বেশ কজন প্রাক্তন মন্ত্রী-এমপির নামে আদালতে মামলা হয়েছে। তো যারা তাদের বিদ্যুৎবিল, গ্যাসবিল, ফোনবিল ইত্যাদি নিয়মিত পরিশোধ করেন না তারা সামাজিক কাজ-কর্মে কতটুকু অর্থসম্পদ ব্যয় করবেন তা সহজেই অনুমেয়। ব্যক্তিগত উপার্জন দ্বারা সমাজসেবা তো অনেক উর্দ্ধের ব্যাপার, সমাজের অর্থ দ্বারাও যদি সমাজের নেতৃবৃন্দ সমাজসেবা করতেন তবেও সমাজের চিত্র অন্যরকম হত।

এখন প্রচণ্ড শীত পড়ছে। দেশের নিম্নবিত্ত মানুষের একটি বিশাল অংশ এই শীতে মানবেতর জীবন যাপন করছে। আমি যখন শুধু পছন্দের সোয়েটারটি কেনার জন্য কিংবা চলতি ফ্যাশনের শীতবস্ত্রটি ক্রয় করার জন্য তিনগুণ মূল্য পরিশোধ করি তখন আমার পাশের দরিদ্র অসহায় ছেলেটি বা মেয়েটির কথা কি মনে পড়ে? যদি না পড়ে তবে তা আমার দুর্ভাগ্য। এই শীতবস্ত্রটিই আমি যদি সেইসব শপিংমল থেকে না কিনে কোন দোকান থেকে কিনতাম তাহলে যে টাকা সাশ্রয় হত তা দিয়ে অন্তত পাঁচ জন মানুষকে এই শীতে শীতবস্ত্র প্রদান করা সম্ভব হত। আর এ কাজটি সম্ভব হলে তা হত সেই আনন্দপুরীতে ঘুরে বেড়ানোর ক্ষণিক আনন্দের চেয়ে ঢের বেশি আনন্দেরকিন্তু দুর্ভাগ্য, আমাদের মধ্যে অনেকেই এই আনন্দ লাভের সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত।

যাক মূল কথায় ফিরে আসি। বলছিলাম ক্রম-বিকাশমান শপিংসংস্কৃতির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে। এ সংস্কৃতির একটি ক্ষতির দিক হল অপচয়।

ইসলামে অর্থ সম্পদের প্রচুর গুরুত্ব রয়েছে। তাই উপার্জিত অর্থ অপচয় করাকে ইসলাম কখনো সমর্থন করে না। ইসলামের দৃষ্টিতে এটা হারাম। একজন মুসলিমের জন্য সম্পদ অপচয়ের কোন অবকাশ নেই। কেননা, মুসলিমের অর্থসম্পদ হালাল পন্থায় উপার্জিত হয়। হালাল পন্থায় যে সম্পদ উপার্জিত হয় তই স্বোপার্জিত সম্পদ। অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ হস্তগত করা হলে সেটা হয় চৌর্যবৃত্তি। একে কি যথার্থ উপার্জন বলা যায়? এখানে তো ব্যক্তির মালিকানাই  প্রতিত হয়নি। অতএব এ সম্পদ তার প্রকৃত মালিককে ফিরিয়ে দিতে হবে। ব্যক্তির যথার্থ উপার্জন সে সম্পদকে বলা যায় যা হালালভাবে উপার্জিত হয়। ইসলামে এই হালাল সম্পদের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। তাই এই মূল্যবান সম্পদ কোথায় কীভাবে ব্যয় করতে হবে তার সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া আছে।  বলাবাহুল্য, সেই নির্দেশনায় অপচয়ের কোন সুযোগ নেই। সেখানে আছে নিজের ও পরিবারের প্রয়োজন পুরণের কথা, শরীয়তের সীমারেখার মধ্যে থেকে সাধ্যমত তাদের শান্তি ও আরামের ব্যবস্থা গ্রহণের কথা, পিতা-মাতা, আত্মীয় স্বজনের খেঁাজখবর নেওয়ার কথা, সমাজের দুস্থ অসহায় মানুষের প্রতি সহমর্মিতার কথা, সামাজিক প্রয়োজনে ব্যয় করার কথা, দ্বীনী ইলমের প্রচার-প্রসারে এবং দ্বীনের বিভিন্ন প্রয়োজনে অর্থব্যয় তথা ইনফাক ফী সাবীলিল্লাহর কথা ইত্যাদি।

এরপর সম্পদ ব্যয়ের খাত অনেক হলেও সবগুলো যে একই সূত্রে গাঁথা সেই কথাও ইসলামে নির্দেশিত হয়েছে। সেই অভিন্ন সূত্রটি হল, সম্পদের প্রকৃত মালিক মহান রাব্বুল আলামীনের আনুগত্যের মানসিকতা নিয়ে সকল কাজ সম্পন্ন করা। এই নীতি অনুসারে পার্থিব প্রয়োজনে সম্পদ ব্যয় করা হলেও তা যুক্ত হবে পুণ্যের খাতায়। কী আনন্দের ব্যাপার! খরচ করা হচ্ছে নিজের প্রয়োজনে, সংসারের প্রয়োজনে কিন্তু তা গৃহীত হচ্ছে পুণ্য হিসেবে এবং মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম হিসেবে। কারণ এভাবে খরচ করতে পারাও একেবারে সহজ নয়। নিজের ইচ্ছামত খরচ না করে ইসলামের গণ্ডির ভিতরে থেকে খরচ করা- এটা যথেষ্ট মুজাহাদার কাজ। এই মুজাহাদার বিনিময়টিই পুণ্যের খাতায় লিপিবদ্ধ হবে। তাহলে মুমিন তার সম্পদ ব্যয় করে দুটি আনন্দ লাভ করে। একটি প্রয়োজন পূরণের স্বাভাবিক আনন্দ অপরটি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ছওয়াব লাভের আনন্দ। এই নির্মল আনন্দের উপকরণ যাদের রয়েছে তাদের জন্য কি অবকাশ থাকে কলুষিত আনন্দের শুলুকসন্ধান করার?

এটা ঠিক যে, বর্তমানে কলুষিত ও অতি স্থূল আনন্দের অভিলাষীদের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু আমরা সবাই একথাটি জানি যে, শুধু সংখ্যাধিক্য কিংবা রেওয়াজের  কারণেই রাত দিন হয়ে যায় না। কিংবা কালো সাদা হয়ে যায় না। অতএব বিভ্রান্ত হওয়ার বা হীনম্মন্যতায় ভোগার কিছু নেই। এহেন শপিংসংস্কৃতির ছোবল থেকে এখনও আল্লাহ যাদেরকে মুক্ত  রেখেছেন তাদের আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতা জানানো প্রয়োজন। আর যারা শপিংসংস্কৃতির কেবল বাইরের  ঝলকানিটুকু দেখেছেন তাদেরকে এর ভিতরের আবিলতাগুলোও একটু দেখার আহ্বান জানাই। সেক্ষেত্রে এর বাহ্যিক আভরণও আর অতোটা আকর্ষণীয় বোধ হবে না- একথা বিনা দ্বিধায় বলা যায়।

 

 

advertisement