যিলহজ্ব ১৪২৭   ||   জানুয়ারি ২০০৭

দশদিক

এ অত্যাচার কঠোরহস্তে দমন করা উচিত

পুঁজিবাদী মানসিকতায় নাকি মানবিকতার স্থান থাকতে নেই। নৈতিকতা ও মানবিকতার সমাধির উপরই গড়ে ওঠে পুঁজিবাদের সমুন্নত সৌধ। কথাগুলো কোনো সমাজতান্ত্রিক কোন নেতা বা কোন দার্শনিক বলেছেন কি না তা আমার জানা নেই। তবে বর্তমান সময়ের আবহাওয়া থেকেই এই বাণী আহরণ করা যাচ্ছে। আমাদের বাংলাদেশের মত একটি দেশে পুঁজিবাদী মানসিকতার হাওয়া যাদের গায়ে লেগেছে দেখা যাচ্ছে তাদের মধ্যে এই প্রতিক্রিয়াই হচ্ছে। তাদের কর্মকাণ্ড দৃষ্টে মানুষের লাভ-লোকসানের কোন তোয়াক্কা তারা করেন বলে মনে হয় না।

গত ৭ ডিসেম্বর দৈনিক আমার দেশে প্রকাশিত একটি রিপোর্টের শিরোনাম ছিল শ্রীপুরে কল-কারখানার বর্জে্য শতাধিক বিঘার ফসল নষ্ট।সংবাদটির সারসংক্ষেপ হল, শ্রীপুরের মাওনা পাথারের, অর্থাৎ ধানের নিচু জমির অর্ধশতধিক কৃষকের শতাধিক বিঘার ধান স্থানীয় কয়েকটি কল-কারখানার বর্জে্য বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যেখানে অন্য সময় তারা বিঘাপ্রতি ২৫ থোকে ৩০ মন ধান পেতেন সেখানে এবার ধান পেয়েছে গড়ে ৩ থেকে ৮ মন মাত্র। এরপর এসব জমিতে উৎপাদিত ধানের ভাত খেতে তেতো লাগে। অর্থাৎ রাসায়নিক ক্রিয়ায় চালের স্বাদ পর্যন্ত নষ্ট হয়ে গেছে। এ চালের ভাত যে স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

খবরে আরো বলা হয়েছে, প্রায় পাঁচ-ছয় মাস আগে সেসব কল-কারখানার কতৃর্পক্ষ কারখানার বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য মাওনা পাথার পর্যন্ত পাইপ লাইন স্থাপন করেছে। স্থানীয় জনগণ এবং কৃষকদের আপত্তি স্বত্ত্বেও  কারখানা কর্তৃপক্ষ সেই পাইপ লাইন দিয়ে বর্জ্য নিষ্কাশন আরম্ভ করে। বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জে্য গোটা এলাকার পানি বিষাক্ত হয়ে গেছে। আশপাশের গ্রামের অনেকেই বিভিন্ন চর্ম রোগে আক্রান্ত হয়েছে। সবোর্পরি কৃষকদের চরম লোকসান তো রয়েছেই।

এ ধরনের অমানবিক কাজে কোনভাবেই ছাড় দেওয়া যায় না। পরিবেশ দূষণ এবং পরিশ্রমী কৃষকদের ক্ষতিগ্রস্ত করার এই ধারা বন্ধ করার জন্য অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

 

লেবাননে গুচ্ছ বোমা থেকে শিশুদের আত্মরক্ষার ট্রেনিং

তিন মাসেরও বেশি হল হিযবুল্লাহ গেরিলাদের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধ শেষ হয়েছে। কিন্তু সেই যুদ্ধের গোলাবারুদের বিস্ফোরণ এখনও বন্ধ হয়নি। প্রতিদিন দু-একজন করে শিশু-কিশোর সাধারণ মানুষ এই বিস্ফোরণের আঘাতে আহত বা নিহত হচ্ছেন। হিযবুল্লাহ যোদ্ধাদের পরাস্ত করার নামে ইসরায়েল লেবাননের সর্বত্র ক্লাস্টার বোমা গুচ্ছ বোমা নিক্ষেপ করে। একটি বোমা থেকে অনেক গুলো ছোট বোমা বের হয়ে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে বলে একে ক্লাস্টার বোমা বা গুচ্ছ বোমা বলা হয়।

ইসরায়েলী দৈনিক হারেৎজ-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী  ইসরায়েল হিযবুল্লাহ গেরিলাদের বিরুদ্ধে যে ক্লাস্টার বোমা হামলা চালায় তাতে ১২ লাখেরও বেশি ক্ষুদ্র বোমা নিক্ষেপ  করা হয়েছে। এসব বোমার অধিকাংশই রয়ে গেছে অবিস্ফোরিত অবস্থায়। এভাবে লেবাননে একটি দীর্ঘস্থায়ী মরণফাঁদ পেতে রেখে গেছে ইসরায়েল বাহিনী। অবশ্য ইহুদীদের জাতীয় চরিত্রে এ ধরনের নিচুতা ও অমানবিকতার দৃষ্টান্ত আরো অনেক রয়েছে।

বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, লেবাননী শিশুদেরকে এইসব অবিস্ফোরিত বোমার ব্যাপারে সচেতন করার চেষ্টা চলছে। কেননা, অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিশুরাই এসব বোমর আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ইউনিসেফ ও লেবাননের শিক্ষা মন্ত্রণালয় যৌথভাবে এই স্কুলভিত্তিক সচেতনতা-কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আমরা আশ্চর্য হই যখন দেখি, মানবতার ধ্বজাধারীরা এ মানবতাবিরোধী কাজ-কর্মে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করে না। নাকি এ ধরনের প্রাণহানীকর ঘৃণ্য কর্ম তাদের সংজ্ঞায়িত সন্ত্রাসের আওতায় আসে না?

এরাই যখন পৃথিবীর দেশে দেশে দু-চারটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে মানবতার সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখে, তখন একে গোটা মানবজাতির সঙ্গে বিদ্রূপ বলেই মনে হয়। বলতে ইচ্ছে করে, আপনার ডান হাতের ওই অস্ত্রটি ফেলে দিন, তারপর বাম হাতের ব্যান্ডেজ নিয়ে অগ্রসর হোন। এক হাতে গুলি করে অন্য হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা মানবতার ভালো উদাহরণ নয়।

 

বিজ্ঞানের যুগে অবৈজ্ঞানিক রীতি

বর্তমান যুগটি বিজ্ঞানের যুগ হিসেবে পরিচিত। জীবনের সকল অঙ্গনে এমনকি সাহিত্য-সংস্কৃতিতেও বিজ্ঞান মনষ্কতার ছাপ এ সময়ের একটি নন্দিত ও গ্রহণযোগ্য বিষয়। বক্তৃতা-বিবৃতি এবং প্রবন্ধ-নিবন্ধে বিষয়টি বেশ আলোচিত। কিন্তু ট্রাজেডি হল, এ প্রসঙ্গে যারা বেশ সোচ্চার তারাই আবার কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন অবৈজ্ঞানিক ও অযৌক্তিক রীতি-নীতির দ্বারা আবদ্ধ হয়ে পড়েন। গত ৯ ডিসেম্বর বিভিন্ন দৈনিকে একটি ছোট সংবাদ দেখা গেল। সাংবাদটির শিরোনাম ছিল মোমের শিখায় মুক্তিযুদ্ধে হারানো স্বজনদের স্মরণঅদ্ভূত শিরোনাম! একটি বিশেষ সংস্কারে আবদ্ধ না থকলে মোমের শিখার সঙ্গে মৃতের স্মরণের যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

অশান্তির সঙ্গে আগুনের একটি সম্পর্ক কল্পনা করা হয়। এজন্য অনেক সময় পরিবারে, সমাজে কিংবা রাষ্ট্রে অশান্তির আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। আবার বঞ্চিত মানুষের বুকে জ্বলে ধিকি ধিকি তুষের আগুন। তাহলে মৃত স্বজনের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা যেখানে উদ্দেশ্য সেখানে আগুনের অনুপ্রবেশ বিস্ময়কর নয় কি?

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যারা প্রাণ দিয়েছেন তাদের শান্তি কামনা উদ্দেশ্য হলে সেজন্য ইসলামে অত্যন্ত সুন্দর ও যৌক্তিক পদ্ধতি বিদ্যমান রয়েছে। পদ্ধতিটি হল, মানুষের জীবন-মৃত্যু, কল্যাণ-অকল্যাণ যে সত্তার হাতে তাঁর কাছে মৃতের জন্য মাগফিরাত কামনা করা এবং শরীয়ত-নির্দেশিত পন্থায় কিুছু নেক আমল করে ঈসালে সাওয়াব করা। যেহেতু এই পদ্ধতিটি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কতৃর্ক নির্দেশিত, তাই এর যথার্থতার ব্যাপারে এবং ফলদায়ক হওয়ার ব্যাপারে আস্থাশীল হওয়া খুবই যৌক্তিক। এই যৌক্তিক পদ্ধতি ছেড়ে ভিত্তিহীন রীতি-নীতিতে আস্থাশীল হওয়া কতখানি বিজ্ঞানসম্মত তা আমাদের ভেবে দেখতে হবে।

 

এ আবেদনে সাড়া দেওয়া উচিত

আমাদের দেশের দৈনিক প্রত্রিকাগুলো মাঝেমধ্যে কিছু মানবিক কাজ করে থাকে। প্রায় সকল দৈনিকেই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের খবরাখবর নিয়ে ভেতরের পাতায় একটি আয়োজন থাকে। এখানে মাঝে মাঝে দুঃখী মানুষের দুঃখ-বেদনার উপর রিপোর্টিং হয়। এই রিপোর্টিং-এর ফলে দেশের হৃদয়বান মানুষ দুঃখী মানুষের অবস্থা জানতে পারেন এবং সহযোগীতার হাত বাড়ান। এ ধরনের একটি সংবাদ গত ১৩ই ডিসেম্বর বুধবারের দৈনিক আমার দেশে প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদের শিরোনাম ছিল, “রামগঞ্জের সেই শতবর্ষী হরেক রকমএখন শয্যাশায়ী। রিপোর্টটিতে রামগঞ্জের একজন বৃদ্ধের জীবন সংগ্রামের সংক্ষিপ্ত বিবরণ রয়েছে। শতবর্ষী বৃদ্ধ মানুষটি শুধু জীবিকার অন্বেষায় হরেক রকম দ্রব্য-সামগ্রী কাঁধে বয়ে গ্রামের বাড়ি বাড়ি ফেরি করে বেড়াতেন। এ কারণেই বাবা মায়ের রাখা নাম হরে কৃষ্ণ দাশ হয়ে যায় হরেক রকম। কিন্তু বৃদ্ধ ব্যক্তিটি এখন আর ফেরি করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারছেন না। রোগে-শোকে জর্জরিত হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন। দারিদে্র্যর কারণে তার যথাযথ চিকিৎসাও সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় তিনি দেশের হৃদয়বান মানুষের কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন।

আমরা মনে করি, এই দুঃস্থ মানুষটির সাহায্যে এগিয়ে আসা উচিত। একটি মুসলিম দেশে একজন মানুষ এতটা কঠিন অবস্থায় নিপতিত হবেন তা সত্যিই লজ্জাজনক । দুঃস্থ-পীড়িতের সাহায্যের ব্যাপারে ইসলামে  জাতি-ভেদ নেই। মুসলিম-অমুসলিম সবার প্রতি প্রয়োজনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া ইসলামের শিক্ষা।

ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘প্রত্যেক তাজা কলিজার কারণেই পূণ্য লাভ হয়।এজন্য নফল দান সাদকা বিধর্মীকেও করা যায় এবং প্রয়োজনের মুহূর্তে এটি করণীয় বটে।

প্রতিবেশীর সাহায্য-সহযোগীতা এবং তাদের খোঁজ-খবর নেওয়ার প্রতিও ইসলাম সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। এমনকি প্রতিবেশী বিধর্মী হলেও  তার খোঁজ-খবর নেওয়া কর্তব্য। এটি ইসলামের ধর্মীয় নির্দেশনা। তাই এই দায়িত্ব পালন করা হলে তা ইসলামে একটি পুণ্যের কাজ হিসাবে বিবেচিত হবে এবং বিনিময়ে সওয়াব পাওয়া যাবে।

মুসলিম জনগণের উচিত জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে দুঃস্থ-অসহায়দের সাহায্য-সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসা। এতে একদিকে যেমন পুণ্য লাভ হবে অন্যদিকে ইসলামের উদারতা ও মানবিকতা দৃষ্টে কোন অর্গলবদ্ধ হৃদয়কুঠরিতে হেদায়াতের আলোর উন্মেষও ঘটতে পারে।

 

 

advertisement