মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব
বিতর্কিত শাসক নাকি বিতর্কিত ইতিহাস?
ভারত উপমাহাদেশ একটি দীর্ঘ সময় (৭১৮ খৃ. থেকে ১৮৫৭ খৃ.) মোঘল শাসনাধীন ছিল। ধারাবাহিকভাবে প্রচুর মোঘল ক্ষমতার মসনদে আসীন হয়েছেন এবং পরবর্তীতে নন্দিত হয়েছেন কিংবা নিন্দা কুড়িয়েছেন। কিন্তু সমস্ত মোঘল শাসকের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি হিন্দু কিংবা পশ্চিমা লেখকদের সমালোচনার শিকার হয়েছেন সম্রাট আওরঙ্গজেব। যাকে কিনা চরম হিন্দু বিদ্বেষী, অন্যায় করারোপকারী, ধর্মান্তরে বলপ্রয়োগকারী, হিন্দুদের প্রাপ্য সুবিধা হতে বঞ্চিত করার ক্ষেত্রে সিদ্ধহস্ত এবং হিন্দু ধর্মের বিষয়ে অনধিকার চর্চাকারী একজন চরমপন্থী মুসলিম আখ্যা দেওয়া হয়েছে। আর তার ব্যাপারে এ সমস্ত মতামত স্বাধীনতার পর ভারতের স্কুল কলেজের সরকার নির্ধারিত এবং স্বীকৃত পাঠ্য বইয়ের একটি অংশ দখল করে আছে, যা ভারত উপমহাদেশের অন্যতম একজন ধার্মিক, বিজ্ঞ, উদার, নিরপেক্ষ, সহিষ্ণু, দূরদর্শী ও সফল শাসকের ক্ষেত্রে অতিরঞ্জন ছাড়া কিছুই নয়। সৌভাগ্যবসত, বিগত কয়েক বছর যাবৎ হিন্দু ঐতিহাসিক এসমস্ত বিতর্কিত বিষয়ের অবসান কল্পে এগিয়ে আসছেন। যেমন ঐতিহাসিক বাবু নগেন্দ্রনাথ ব্যনার্জী মুসলিম শাসকদের তথাকথিত জোরপূর্বক ধর্মান্তরের প্রচেষ্টার অভিযোগ এই বলে বাতিল কারেছেন যে, যদি তাই হত তাহলে প্রায় হাজার বছর মুসলিম শাসিত হওয়ার পরও এখন ভারতের মুসলিমদের প্রায় চার গুণের বেশি হিন্দু জনসংখ্যা থাকে কীভাবে। ব্যনার্জী হিন্দুদের তথাকথিত ‘হাইপোথিসিস’কে এই বলে চ্যালেঞ্জ করেছেন যে, তিনি যদি সত্যিই গোড়ামির দায়ে দায়ী হয়ে থাকেন তাহলে তিনি কীভাবে একজন হিন্দুকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিযু্ক্ত করেছিলেন? তিনি তো একজন মুসলিমকেও এই পদে নিযুক্ত করতে পারতেন। ব্যনার্জী আরও বলেছেন আওরঙ্গজেবকে ধর্মীয় গোঁড়ামির অভিযোগ করার প্রশ্নই আসে না। তার শাসনকালীন সম্পূর্ণ সময় রাষ্ট্র-নীতির প্রণালী ছিল হিন্দুদের প্রণীত। দুইজন হিন্দুকে তিনি রাষ্ট্রীয় কোষাগারের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। উপরন্তু কিছু কুসংস্কারাচ্ছন্ন মুসলিম তার এই নিয়োগদানের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছিল। আওরঙ্গজেব এই বলে তাদের ক্ষান্ত করেন যে, তিনি শরীয়তের দিক নির্দেশনা অনুসরণ করছেন। শরীয়ত যোগ্য লোককে যোগ্য পদে অসীন করার ব্যাপারে জোর দিয়েছে। আওরঙ্গজেবের শাসনামলে প্রচুর হিন্দু বিশেষ করে যশবন্তু সিং, রাজারাজরূপ, কবির সিং, অর্ঘনাথ সিং, প্রমদেব সিং, দিলীপ রায় এবং রসিকলাল ক্রোরী প্রমুখ রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে নিযুক্ত ছিলেন। তাছাড়া উদয়পুরের রাজা ভীম সিং, ইন্দা সিং, আচালাজী এবং আরজুজী- এদের প্রত্যেকের আওতায় ছিল দুই থেকে পাঁচ হাজার সেনা বিশিষ্ট আস্ত এক একটি গ্যারিসন। আওরঙ্গজেবের প্রশাসনের দুইজন সর্বোচ্চ জেনারেল ছিল যশবন্তু সিং এবং জায়া সিং। বিস্ময়ের বিষয়, যদি আওরঙ্গজেব সত্যিই হিন্দুদের প্রতি হিংসাত্মক মনোভাবের অধিকারী হতেন তাহলে কীভাবে তিনি হিন্দুদের এসব বড় বড় প্রশাসনিক পদে নিযুক্ত করলেন। বিশেষ করে সেনা বাহিনীতে, যারা বিদ্রোহ করে অনায়াসে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে।
অধিকাংশ হিন্দুই আওরঙ্গজেব-এর তুলনায় আকবরকেই পছন্দ করে, তার বহু সাংস্কৃতিক আদালতের জন্য, যেখানে হিন্দুরা তুলনামূলক বেশি সুবিধা পেত। ঐতিহাসিক শ্রী শমার্ বলেন, সম্রাট আকবরের আদালতে উচ্চ পদস্থ ১৪ জন ছিল হিন্দু। আর আওরঙ্গজেবের আদালতে ছিল ১৪৮ জন হিন্দু। Mughal Government) কিন্তু কয়জনই এই বাস্তবতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল।
কিছু হিন্দু ঐতিহাসিক আওরঙ্গজেবের উপর মন্দির ধ্বংসের অভিযোগ এনে থাকেন। ইসলামের একজন পরিপূর্ণ অনুসারী এবং একজন সাধু পুরুষের বিরুদ্ধে এরূপ অভিযোগ কীভাবে আনা যেতে পারে? কুরআন শরীফের সূরা বাকারার ২৫৬ নং আয়াতে আছে, দ্বীনের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি নেই। একজন শিক্ষিত মুসলিম দ্বারা কুরআন বিরোধী কোন কাজ কীভাবে হতে পারে?
কাকতালীয়ভাবে বাংলা প্রদেশের ৫ম ও ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ইতিহাস বিষয়ের পাঠ্য বই ‘ইতিহাস পরিচয়’-এর ১৯৪৬ সালের সংস্করণে আছে, “যদি আওরঙ্গজেব মসজিদ বানাবার জন্য মন্দির ধ্বংসের ইচ্ছা করতেন তাহলে তখন সারা ভারতে একটি মন্দিরও পাওয়া যেত না; বরং আওরঙ্গজেব মন্দির নির্মাণকল্পে কেবল সমর্থন করেননি, তিনি অনুদান হিসেবে যথাযথ অর্থ এবং জায়গার ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন। বেনারস, কাশ্মীর এবং আরও বিভিন্ন স্থানের বিভিন্ন মন্দির এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বৃটিশ ঐতিহাসিক আলেকজান্ডার হ্যামিলটন আওরঙ্গজেবের শাসনামলের শেষভাগে ভারতবর্ষে আসেন এবং লক্ষ করেন যে, প্রত্যেক ধর্মের অনুসারীরা তাদের ধর্মীয় অনুশাসন স্বাধীনভাবেই পালন করছে।
এবার আসা যাক ‘কর’ প্রসঙ্গে। এই প্রসঙ্গে প্রচুর ইতিহাসবেত্তা আওরঙ্গজেবের সমালোচনা করেছেন। এ কথা ঠিক যে, করপ্রথা আকবর এবং জাহাঙ্গীর মুলতবি রেখেছেন যা আওরঙ্গজেব পুনরায় চালু করেছেন। আসলে কর এক ধরনের যুদ্ধকর বৈ কিছু নয়। যা কি না একটি মুসলিম রাষ্ট্রে বসবাসকারী একজন অমুসলিম পুরুষ যখন যুদ্ধে যেতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন তখন একটি নির্দিষ্ট অংকের অর্থ কর হিসেবে ধার্য্য করা হয়। যুদ্ধে অংশগ্রণকারী কোন অমুসলিম থেকে এ ধরনের কোন কর নেওয়া হয় না। কর কোন নারী, শিশু, অসুস্থ পুরুষ কিংবা কোন বৃদ্ধ থেকেও নেওয়া হয় না। আর এই কর গ্রহণের ফলে করদাতা অমুসলিম নাগরিকের সমস্ত জান, মাল, রক্ষণাবেক্ষণের দায় বর্তায় করগ্রহীতা মুসলিম প্রশাসকের উপর। তাই যদি কোন কারণে মুসলিম প্রশাসকরা যুদ্ধকালীন সময় বা অন্য কোন সময়ে যথাযথ নিরাপত্তা দিতে ব্যার্থ হত তখন কর হিসেবে আদায়কৃত সমুদয় অর্থ ফেরত দেওয়া হত।
প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখা ভাল, যাকাত ও উশর সমস্ত নিসাবধারী মুসলিম থেকেই গ্রহণ করা হয়। এছাড়া সদকা, ফিতরা ও খুমুস তো আছেই, যা কি না কোন অমুসলিম থেকেই নেওয়া হয় না। বাস্তবতা হল, মুলিমদের থেকে আদায়কৃত এরূপ অর্থ অমুসলিমদের থেকে আদায়কৃত করের কয়েকগুণ বেশি। তাছাড়া আওরঙ্গজেব তার শাসনামলে অনেক ধরনের কর রহিত করেছেন, যার আলোচনা খুব কমই করা হয়। মোঘল শাসনামলের উপর প্রবাদতুল্য ঐতিহাসিক স্যার যদুনাথ সরকার তার বই Mughal Administration -এ উল্লেখ করেন, আওরঙ্গজেবের শাসনামলে ৬৫ ধরনের কর প্রত্যাহার করা হয়, যার কারণে রাষ্ট্রীয় কোষাগার বার্ষিক তৎকালীন ৫ কোটি রূপি হতে বঞ্চিত হত।
যেহেতু কিছু হিন্দু ঐতিহাসিক আওরঙ্গজেব সম্বন্ধে প্রচলিত ভুল ধারণা প্রত্যাহার করা শুরু করেছেন তাই পশ্চিমা জগতের পাঠ্যবই এবং ইতিহাসভিত্তিক বইসমূহে যেসব ভুল রয়েছে সেগুলো শুদ্ধ করে সঠিক তথ্য তুলে ধরার প্রক্রিয়া শুরু করাটাই সময়ের দাবি।
ইংরেজী থেকে অনুবাদ : আহমাদ হারুন (আছিম)