যিলহজ্ব ১৪২৭   ||   জানুয়ারি ২০০৭

বড় হুজুর হযরত মাওলানা সিরাজুল ইসলাম রহ. -এর ইন্তেকাল
একজন অভিভাবকের চির বিদায়

মাওলানা যুবায়ের হোসাইন

গত ১৬ই সেপ্টেম্বর শনিবার সকাল ৯.৩০ মিনিটে এদেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় মুরব্বি বি. বাড়িয়ার বড় হুজুর হযরত মাওলানা সিরাজুল ইসলাম সাহেব এদেশের লক্ষ কোটি মানুষকে এতিম করে তাঁর প্রিয় রবের সান্নিধ্যে চলে গেছেন। পৌনে এক শতাব্দীকালব্যাপী বাংলাদেশে মুসলমান ও ইসলামের বহুমুখী খেদমত আঞ্জাম দিয়ে একজন নিঃশব্দ নিরব বিপ্লবী সংস্কারক হিসেবে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে আল্লাহর সন্তুষ্টির নিমিত্তে ব্যয় করে গেছেন।

একজন উপযুক্ত বিচক্ষণ অভিভাবক হিসেবে তার কোন তুলনা নেই। আজ তার ইন্তেকালের পর বি. বাড়িয়া ও কুমিল্লাসহ দেশের কোটি কোটি মানুষ তীব্রভাবে অনুভব করছে, কেমন একটি ছায়া তাদের মাথার উপর থেকে সরে গেছে। একজন অভিভাবকের উপযুক্ত অভিভাবকত্ব কতভাবে আমাদেরকে রক্ষা করে চলেছিল, আর আজ তা না থাকার কারণে আমরা কত অসহায় তা মুহূর্তে মুহূর্তে অনুভূত হচ্ছে।

শতাব্দীকালব্যাপী তার বর্ণাঢ্য জীবনের বহুমুখী দ্বীনী খেদমতের কিছু ছিটেফেঁাটা, কিছু নমুনা তুলে ধরা  এ নিবন্ধের আলোচ্য বিষয়।

জন্ম : হযরত বড় হুজুর রহ. বর্তমান বি. বাড়িয়া জেলার অন্তর্গত বাঞ্ছারামপুর থানার দশদোনা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মসনের ব্যাপারে বিভিন্ন মত রয়েছে। ১৮৬৮ থেকে ১৮৯৪ পর্যন্ত বিভিন্ন বর্ণনাই রয়েছে। হযরতের বড় সাহেবজাদা মাওলানা মুনিরুযযামান সিরাজী সাহেব ইংরেজি সন হিসেবে তার জন্ম তারিখ লিখেছেন ১৮৯৪ ঈ.। এ হিসেবে মৃত্যুকালে তার বয়স হয় ১১২ থেকে ১১৩ বছর, যা হিজরী সন হিসেবে ১১৭ বছরের কাছাকাছি হয়ে যাবে।

হযরতের বয়স সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বি. বাড়িয়ার টানবাজার মসজিদের ইমাম মাওলানা ইউনুস সাহেব দামাত বারাকাতুহুম বলেন, আমি একদিন হযরত বড় হুজুরের সাথে তার জন্মতারিখ নিয়ে আলোচনা করছিলাম। তখন তিনি বললেন, ‘আমার দাদা মুন্সি ফয়জুদ্দীন রহ. একবার এক তুফানের ঘটনা এবং আমার জন্মের ঘটনা শুনিয়েছিলেন। সে তুফানের ঘটনার সাথে মিলিয়ে দেখলে আমার জন্ম বাংলা ১২৮০ সনে হয়। হযরতের মুখের এ ভাষ্য হিসেবে মৃত্যুকালে তার বয়স হবে একশ তেত্রিশ বছর।

টান বাজারের ইমাম সাহেব হুজুর একদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন, হযরত আপনি আগে দাওরা পড়েছিলেন নাকি হযরত হাফেজ্জী হুজুর আগে পড়েছিলেন? এর জবাবে বড় হুজুর বলেছিলেন, ‘এ প্রশ্ন করে তুমি কী করবে! বয়সে উনি আমার অনেক ছোট।উল্লেখ্য, হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. ১৪০৭ হি. মোতাবেক ১৯৮৭ ঈ. সনে ইন্তেকাল করেন এবং তখন তার বয়স ছিল প্রায় ৯৩ বছর। এ থেকেও বুঝা যায় মৃত্যুকালে হযরত বড় হুজুরের বয়স ১১২ বছরের বেশি ছিল।

এই লেখক ১৯৯৯ ঈ. সনে সর্বপ্রথম বড় হুজুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিল। অন্যান্য কথার ফাঁকে তাঁর জন্ম তারিখটা জানতে চাইলে, বড় হুজুর এ প্রশ্নটি এড়িয়ে গিয়েছিলেন। আসলে ছোট বয়সেই পিতা-মাতা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে যাওয়ার কারণে তাঁর জন্মতারিখটা যথাযথভাবে সংরক্ষিত হয়নি। তবে বিভিন্ন দিক বিবেচনা করলে ১৮৯৪ খৃস্টাব্দে জন্মের বর্ণনাটিই বেশি যুক্তিযুক্ত বলে সাব্যস্ত হয়, যা হযরতের বড় সাহেবজাদা মাওলানা মুনীরুযযামান সাহেব লিখেছেন। হিজরী সন হিসেবে জন্ম তারিখ ১৩১১ হি. হয়। এ থেকেও এর সমর্থন মিলে যে, তার বড় মেয়ে সালেহা বেগমের বর্তমান বয়স হচ্ছে ৮২ বছর। আর যে সময়ে বড় হুজুরের বিবাহের উল্লেখ পাওয়া যায় তখন তার বয়স ছিল ৩০/৩২-এর মত। এহিসেবে ১৮৯৪ তার জন্ম হওয়া বেশি সঠিক বলে সাব্যস্ত হয়। তাছাড়া ১৮৯৪ খৃস্টাব্দে  জন্মের তারিখ কীভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে, এব্যাপারে ভাদুঘর মাদরাসার মাওলানা মুফতী আরেফ বিল্লাহ সাহেবের কাছে জানতে চেয়েছিলাম। তিনি বলেছেন, হযরত বড় হুজুর মেশকাত শরীফের যে শরাহ লিখেছেন তার শুরুতে কিতাবটি লেখার তারিখ, মেশকাত শরীফ পড়ার সন এবং নিজের ছাত্রজীবনের সে সংকল্প উল্লেখ করেছেন তা থেকে ১৮৯৪ খৃস্টাব্দে জন্ম হওয়াই সাব্যস্ত হয়। তিনি বলেন, মাওলানা মুনিরুযযামান সাহেবের সাথে আমরা এব্যাপরে মতবিনিময় করেছি এবং সবশেষে একথাটিই সাব্যস্ত হয়েছে।

আর ১২৮০ বাংলা সনে জন্মের যে বর্ণনা পাওয়া যায় তা যদিও হযরত বড় হুজুরের বিজের মুখেরই, কিন্তু তিনি তা বলেছিলেন অন্য এক ঘটনার উপর অনুমান করে। তাই ১৩১১ হিজরী মোতাবেক ১৮৯৪ খৃস্টাব্দের বর্ণনাটিই গ্রহণযোগ্য। সে হিসেবে মৃত্যুকালে তার বয়স হয় ১১২ থেকে ১১৩ বছর। হিজরী সন হিসেবে যা ১১৬ থেকে ১১৭ বছর।

যাই হোক সর্বোপরি একথাই সাব্যস্ত হয় যে, ইদানীং কালে তার মত দীর্ঘ হায়াতে তাইয়েবা আল্লাহ তাআলা তার সমসাময়িক কাউকে দান করেননি। আল্লাহ তাআলার এ ফজল ও অনুগ্রহ একমাত্র তার উপরই ছিল, যা শেষ হতে বাধ্য বলেই শেষ হয়ে গেছে। যদিও তা মেনে নিতে আমাদের কষ্ট হচ্ছে।

ছেলেবেলা ও প্রাথমিক শিক্ষা

হযরত বড় হুজুর রহ. অনেক ছোট বয়সেই মাকে হারিয়েছেন। বাবা ও দাদার তত্ত্বাবধানে তার শৈশবকাল কাটে। প্রাথমিক শিক্ষা হিসেবে কায়দা আমপারা ইত্যাদি তার পিতা মুন্সী আব্দুল মাজিদের কাছে পড়েন। পিতার কাছে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করার পাশাপাশি বাড়ির কাছাকাছি এক বোর্ড স্কুলেও পড়াশোনা করেন। স্কুলে পড়াকালীন যখন তার বয়স আনুমানিক ছয় বা সাত বছর তখন তার পিতা মারা যান। মাতা-পিতাহারা সিরাজুল ইসলামের তখন একমাত্র অভিভাবক ছিলেন তার দাদা ফয়জুদ্দীন।

দাদার আশা ছিল নাতিকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত বানাবেন, কিন্তু গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক লেখাপড়া শেষ করার পর উপযু্ক্ত কোন প্রতিষ্ঠান খুঁজে পেলেন না। এভাবে কয়েক বছর কেটে যাওয়ার পর দাদা লোক মারফত খবর পেয়ে তাদের গ্রাম থেকে চার-পাঁচ মাইল দূরে বাঁশগাড়ি গ্রামের মৌলভী  ইয়াকুব সাহেবের বাড়ি বালক সিরাজুল ইসলামকে আরবী ও ফার্সর্ী শেখার জন্য পাঠিয়ে দিলেন। তিনি সেখানে প্রায় চার-পাঁচ বছর ছিলেন। এখানকার পড়াশোনা শেষ করে বাড়িতে ফিরে এলেন এবং আরো শেখার অদম্য স্পৃহা তাকে পেরেশান করে তুলল। এবারও তার জীবনের মূল্যবান কিছু সময় নষ্ট হয়ে গেল। ইতিমধ্যে খবর পেলেন তাদের বাড়ি থেকে সাত আট মাইল দূরে আরবী-ফার্সী কিতাব পড়ার মত একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মাদরাসাটি ছিল কানাই নগর গ্রামে। দুবছরের মত সেখানে পড়াশোনা করলেন। কানাই নগর গ্রামে পড়ার সময় বালক সিরাজুল ইসলামের শেষ আশ্রয় দাদাজান মুন্সী ফয়জুদ্দীনও মারা যান। দাদাজানের ইন্তেকালে তিনি অনেকটা ভেঙ্গে পড়েন। অসহায় নিরাশ্রয়ভাবে এবার আরো কয়েকটি বছর তার নষ্ট হয়ে যায়।

উচ্চ শিক্ষা

পড়ালেখার ক্ষেত্রে হযরত বড় হুজুর রহ. বার বার কঠিন কঠিন বাধার সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও দমে যাননি। অপ্রতিরোধ্য স্পৃহা সম্মুখে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিই তাকে উৎসাহ দিয়েছে। এক পর্যায়ে বহু খেঁাজখবর ও চেষ্টা প্রচেষ্টা ব্যয় করে ঢাকার নবাববাড়ি ওল্ড স্কীমের একটি মাদরাসায় এসে পৌঁছেন। এখানে তিনি কৃতিত্বের সাথে জামাতে পাঞ্জম থেকে ছুয়াম পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। তৎকালীন বোর্ডের বিভিন্ন পরীক্ষায় মেধা তালিকায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে মেডেলও লাভ করেন।

ঢাকায় যাদের কাছে পড়েছেন তাদের কারো নাম খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। এখানে পড়া শেষ করে তিনি বাড়িতে চলে যান। কিন্তু আরো উচ্চতর শিক্ষার আগ্রহ তাকে অস্থির করে তোলে। কোন উপযু্ক্ত অভিভাবক না থাকার কারণে যথা সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে বড় হুজুরকে বড়ই বেগ পেতে হয়েছে। আর সে কারণে সিদ্ধান্তহীনভাবে আরো কয়েকটি বছর তাকে নষ্ট করতে হয়েছে। কিন্তু ইলমের পিপাসা তাকে বসে থাকতে দেয়নি।

দারুল উলূম দেওবন্দ সফর

শেষ পর্যন্ত তাদের গ্রামের এক যুবকের সঙ্গে ইলমে দ্বীনের উচ্চতর শিক্ষা লাভের আশায় তিনি ভারতের দিকে পাড়ি জমানপ্রথমত রামপুর মাদরাসায় অবস্থান করেন। তারপর সেখান থেকে মাদারে ইলমী দারুল উলূম দেওবন্দ চলে যান।

মাওলানা মুনিরুযযামান সিরাজী সাহেব লিখেছেন, হযরত বড় হুজুর পাঁচ বছর দেওবন্দে অবস্থান করেছেন। আর মাওলানা মাহমুদ সাহেব বলেন, বড় হুজুর দেওবন্দে অবস্থান করেছেন সাত বছর । এব্যাপারে হযরত বড় হুজুরের ভাষ্য হচ্ছে দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী রাহ.-এর চলে যাওয়া এবং সদরুল মুদাররিসীন হিসেবে শায়খুল ইসলাম হযরত মাদানী রাহ.-এর আগমনের সময়ে তিনি দারুল উলূম দেওবন্দে ছিলেন। বি. বাড়িয়া টান বাজার জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা ইউনুস সাহেব হযরত বড় হুজুরের মুখ থেকে সরাসরি শুনেছেন, তিনি একদিন বলেছিলেন, “আল্লামা কাশ্মীরী রহ. দেওবন্দ থেকে চলে যাওয়ার পর তার স্থানে একজন সদরুল মুদাররিসীন ঠিক করা নিয়ে মজলিশে শূরা দীর্ঘদিন যাবৎ খুবই পেরেশান ছিল। অবশেষে মজলিস সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে, হুসাইন আহমাদ মাদানী রাহ. ব্যতীত এ মসনদের মান কেউ রক্ষা করতে পারবে না। তারপর হযরত মাদানী রাহ. প্রথম দিন এসেই দারুল উলূম দেওবন্দের আনাচকানাচ দেখতে লাগলেন, বাথরুম পাক ঘর ইত্যাদি কীভাবে আছে চেক করতে লাগলেন। তখন আমরা তার এ আকস্মিক অভিযান দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।

উল্লেখ্য, আল্লামা কাশ্মীরী রাহ.-এর চলে যাওয়া এবং হযরত  মাদানী রাহ.-এর আসার ঘটনাগুলো ঘটেছিল ১৩৪৫-১৩৪৬ হিজরীতে।

মাওলানা ইউনুস সাহেব আরো বলেন, ফেনুয়ার হযরত মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন রাহ. বলেছেন, তিনি ১৩৫১ হিজরীতে দাওরা পড়েছেন। আর হযরত বড় হুজুর তার এক বছর আগে দাওরা পড়েছেন। ফেনুয়ার হযরত দাওরা পড়ার পর বড় হুজুরসহ একসাথে হযরত মাদানী রাহ.-এর হাতে বায়আত হন। যা ১৩৫১ হিজরীর শেষে বা এর পরে বলে বুঝা যায়। এ হিসেবে ছয় বছর বা এর চেয়ে কিছু বেশি সময় তিনি দারুল উলূম দেওবন্দে ছিলেন বলে বুঝা যায়।

আল্লামা কাশ্মীরী রাহ.-এর কাছে কোন কিতাব পড়েছেন বলে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। ১৩৫০ হিজরীতে দাওরা পাশ করার পর তাফসীর বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন এবং এ বিষয়ে তিনি বিশেষ প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। মাওলানা মাহমুদ সাহেব বলেন, দেওবন্দে থাকাকালেই তিনি একজন তাফসীর বিশারদ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। তবে তার কোন্ উস্তাদের মুখে তিনি মুফাসসির উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন তা পাওয়া যায়নি।

দারুল উলূম দেওবন্দে তিনি যেসব মহামনীষীর সাহচর্য পেয়েছেন এবং যাদের ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা হোসাইন আহমাদ মাদানী রাহ., শায়খুল আদব আল্লামা ইযায আলী রাহ., হযরত গোলাম রাসূল রাহ., আল্লামা ইবরাহীম বলয়াভী রাহ., মাওলানা আব্দুস সামী রহ.।

দারুল উলূম দেওবন্দে থাকাকালে ইলমের প্রতি তার একাগ্রতা এবং নিরলস অধ্যাবসায়ের ঘটনা খুবই শিক্ষণীয়। হযরত বড় হুজুর রহ.-এর বড় মেয়ের ঘরের নাতি মাওলানা মাহমুদ সাহেব ও মাওলানা ইউনুস সাহেব বর্ণনা করেন, দেওবন্দে থাকাকালে তার যত চিঠি পেঁৗছেছে তার কোনটাই তিনি খুলে দেখেননি; বরং সবগুলো হেফাজত করে রেখে দিয়েছেন। বাড়িতে ফেরার পথে যখন তিনি নৌকায় চড়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছেন তখন সে নৌকায় বসে সব কটি চিঠি খুলে খুলে পড়েছেন। সেসব চিঠি পড়ে কত আত্মীয় স্বজনের মৃত্যুর খবর জেনেছেন, আরো কত নবজাতকের আগমন বার্তা পেয়েছেন। বর্ণিত আছে, নৌকাটি যখন তার শ^শুরালয়ের ঘাটে পেঁৗছে তখন বাড়ির মানুষ তার কান্নার শব্দ শুনে ঘাটের দিকে দৌড়ে আসে। তথায় দেখতে পায় হযরত সিরাজুল ইসলাম সাহেব কেঁদে কেঁদে চলে যাওয়া সব মুরব্বি ও আত্মীয় স্বজনের জন্য দুআ করছেন। এভাবে তার শিক্ষাজীবনের ইতি ঘটে, তখন তার বয়স প্রায় চল্লিশ।

তাদরীস

বড় হুজুর হযরত মাওলানা সিরাজুল ইসলাম রাহ.-এর শিক্ষাদান জীবনের শুরু এবং শেষ হচ্ছে জামিয়া ইউনুসিয়া বি. বাড়িয়ায়। প্রচলিত ধারার মাদরাসার ইতিহাসে এমন ঘটনা খুঁজে পাওয়া বিরল। প্রায় পঁচাত্তর থেকে সাতাত্তর বছর একই মাদরাসায় কুরআন হাদীসসহ সব ধরনের ইলমের খেদমত করতে করতে জীবনসায়ােহ্ন এসে পেঁৗছেছিলেন। ভারতের উত্তর প্রদেশের অধিবাসী হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ.-এর সমসাময়িক এবং হযরত হুসাসইন আহমাদ মাদানী রাহ.-এর এলাকার এক বুজুর্গ আলেম হযরত মাওলানা ইউনুস রাহ. কতৃর্ক প্রতিষ্ঠিত জামেয়া ইউনুসিয়া ছিল হযরত বড় হুজুরের প্রতিভা বিকাশের প্রধান কেন্দ্র।

হযরত মাওলানা ইউনুস রাহ. বি. বাড়িয়া শহরের এক পরিত্যক্ত জায়গায় তার ইলমের মারকায শুরু করেছিলেন। বাংলাদেশের মানুষের সর্বজন শ্রদ্ধেয় তিন মহামনীষীকে দিয়ে। হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. হযরত সদর সাহেব রহ. ও হযরত পীরজী হুজুর রহ., তখন হযরত থানভী রহ.-এর দরবারে ছিলেন। হযরত সদর সাহেব রাহ. হযরত  মাদানী রহ.-এর শাগরেদ ছিলেন, সে সুবাদে ইউনুস রাহ. মাদানী রাহ.-এর কাছে অনুরোধ করেন- শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.-কে শিক্ষক হিসেবে দেওয়ার জন্য। হযরত মাদানী তাকে জামেয়া ইউনুসিয়ায় যেতে আদেশ করেন। সদর সাহেব হুজুর এব্যাপারে হযরত আশরাফ আলী থানভী রাহ.-এর কাছে পরামর্শ চাইলে তিনি বলেন, তোমার ওস্তাদ যেতে বলেছেন এখানে আর পরামর্শের কী আছে? তখন উভয় হযরতের সম্মতিক্রমে সদর সাহেব রাহ. জামেয়া ইউনুসিয়ায় যোগদান করেন। প্রায় ছয় মাসের মত অতিক্রান্ত হওয়ার পর সদর সাহেব হুজুর হযরত হাফেজ্জী হুজুর ও হযরত পীরজী হুজুরের নামে চিঠি লিখে তাদেরকে জামেয়া ইউনুসিয়ায় আসতে আহ্বান জানান। তারা তখন থানভী রাহ.-এর দরবারে ছিলেন। তারা দুজন শায়খের সাথে পরামর্শ করে জামেয়া ইউনুসিয়ায় চলে আসেন এবং ধারাবাহিক চার বছর তারা এখানে একসাথে কাজ করতে থাকেন।

কিছুকাল পর কোন এক ঘটনার প্রেক্ষিতে এ তিন মহামনীষী বি. বাড়িয়া ছেড়ে চলে আসলে জামিয়া ইউনুসিয়ায় সাময়িক শূন্যতা দেখা দেয়। সে সময়েই বড় হুজুর রহ. দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে দেশে ফিরে  আসেন এবং তার গ্রামের বাড়ি বাঞ্ছারামপুর থানার দশদোনা গ্রামে অবস্থান করেন। তখন জামেয়া ইউনুসিয়ার নাযেমে তালিমাত ছিলেন হযরত মাওলানা মুতিউর রহমান সাহেব রহ.। মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা ও মুহতামিম মাওলানা ইউনুস সাহেব তখন নাযেমে তালীমাত মাওলানা মুতিউর রহমান সাহেবকে দশদোনা পাঠান বড় হুজুরকে নিয়ে আসার জন্য। তিনি মাওলানা সিরাজুল ইসলাম সাহেবকে সাথে নিয়ে বি. বাড়িয়া পেঁৗছেন এবং সে থেকে জামেয়া ইউনুসিয়ায় বড় হুজুরের শিক্ষকতার জীবন শুরু হয়।  

সে সময়েই ফখরে বাঙ্গাল হযরত মাওলানা তাজুল ইসলাম রহ.-কে জামিয়া ইউনুসিয়ায় নিয়ে আসা হয়। তখন তিনি কুমিল্লা জামেয়া মিল্লিয়া মাদরাসায় ইলমে দ্বীনের খেদমতে রত ছিলেন।

এ দুই মনীষী এবং আরো অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরামের আগমনে জামিয়া ইউনুসিয়া আবার সরগরম হয়ে উঠে। হযরত বড় হুজুর রহ. পর্যায়ক্রমে সব ধরনের কিতাবেরই পাঠদান করেছেন। তবে এর মধ্যে যেগুলো সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং দীর্ঘদিন যাবৎ যেগুলোর দরস তিনি দিয়েছেন সেগুলো হচ্ছে- বুখারী শরীফ উভয় খণ্ড, মুসলিম শরীফ উভয় খণ্ড, মেশকাত শরীফ উভয় খণ্ড জালালাইন শরীফ, উভয় খণ্ড, হেদায়া ও কালয়ূবী ইত্যাদি।

ফখরে বাঙ্গাল তাজুল ইসলাম সাহেব যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন তিনিই বুখারীর দরস দিয়েছেন। তাঁর ইন্তেকালের পর থেকে শুরু করে একাধারে প্রায় চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর যাবৎ বড় হুজুর রহ. বুখারী শরীফের উভয় খণ্ডের দরস দিয়েছেন। তিনি শায়খুল হাদীস হওয়ার পাশাপাশি মাদরাসার মুহতামিমের দায়িত্বও পালন করেছেন। ইন্তেকালের দুই বছর আগ পর্যন্ত তিনি তার দায়িত্বগুলো যথাযথভাবে আদায় করে আসছিলেন। শতোর্দ্ধ বছরের একজন মানুষ যেভাবে দায়িত্বশীলতার সাথে তার উপর অর্পিত কাজগুলো যথাযথভাবে আঞ্জাম দিয়ে আসছিলেন এমনটি আজকের এ সময়ে খুবই বিরল। ইন্তেকালের দুই বছর আগে শারীরিক অক্ষমতার প্রতি লক্ষ রেখে মাদরাসার দায়িত্ব অন্যদেরকে বুঝিয়ে দেন। এর পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৪২৪-১৪২৫ হিজরীতে দায়িত্ব পালন বা দরস দেওয়া সম্ভব না হলেও মাদরাসায় আসা যাওয়া অব্যাহত ছিল। মাদরাসায় শুধু তার উপস্থিতি শিক্ষার্থী ও উস্তাদদের মাঝে প্রাণের সঞ্চার করত এবং তাদের কাজকে গতিময় করে তুলত। বড় হুজুর রহ. তার সবচেয়ে প্রিয় কিতাব জালালাইন শরীফের সর্বশেষ দরস দেন ১৯৮৫ হিজরীতে। তেলিনগর গ্রামের মুফতী ফযলুল হক সাহেবদের জামাতই শেষ বারের মত হযরতের কাছে জালালাইন শরীফ পড়েন।

প্রসিদ্ধ শাগরেদবৃন্দ

তাঁর শিক্ষকতা জীবনের প্রথম দিকে যারা তার কাছে পড়েছেন, তাদের অনেকেই এখন বেঁচে নেই। বড় হুজুরের অনেক আগেই তারা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে গেছেন। তার শাগরেদদের মাঝে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন, লালবাগ মাদরাসার সাবেক মুহতামিম হযরত মাওলানা হেদায়াতুল্লাহ  রহ., শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক দামাত বারাকাতুহুম, হযরত মাওলানা মুফতী রিয়াযাতুল্লাহ রহ., হযরত মাওলানা আব্দুল লতীফ রাহ., তাবলীগ জামাতের সাবেক মুরব্বি হযরত মাওলানা আলী আকবার রাহ. এছাড়া কুমিল্লা, বি. বাড়িয়ার হাজার হাজার প্রবীণ আলেমের প্রায় অধিকাংশই বড় হুজুরের শাগরেদদের অন্তভুর্ক্ত।

বড় হুজুর রাহ.-এর কাছে পড়া সম্পর্কে হযরত শাইখুল হাদীস দামাত বারাকাতুহুমের কাছে এই লেখক বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, ‘আমি যখন বড় কাটারা মাদরাসায় মেশকাত জামাতে পড়ি তখন বছরের শেষ হতে দুমাস বাকি থাকতেই দেশে যুদ্ধ লেগে গিয়েছিল। সে পরিস্থিতিতে ঢাকা থাকা সম্ভব হয়নি, আমার ভাইবেরাদারেরা তখন বি. বাড়িয়াতে থাকতেন। আমি সেখানে চলে গেলাম। বড় হুজুর তখন জামেয়া ইউনুসিয়ায় মেশকাতের দরস দিতেন। সে সময় আমি দুমাস বড় হুজুরের কাছে মেশকাত  পড়েছি।

রচনাবলি

হযরত বড় হুজুর রহ.-এর রচিত কিতাবের সংখ্যা বেশি নয়। তবে যে কয়েকটি রচনা তার রয়েছে তা গুরুত্বপূর্ণ। বড় হুজুর রহ. মেশকাত পড়েছিলেন হযরত মাওলানা আব্দুস সামী রহ.-এর নিকট, সে দরস তিনি পুরোপুরি নোট করেছিলেন। পরবর্তীতে সংযোজন বিয়োজন করে আত তাকরীরুল ফাসীহ লি হল্লি মিশকাতিল মাসাবীহনামে দুই খণ্ডের একটি কিতাব লিখেছেন।

এছাড়া হযরতের মাওয়ায়েয সংকলন করেছেন তার নাতিজামাই মাওলানা ইকবাল সাহেব। এ কিতাবের নাম হচ্ছে মাওয়ায়েজে সিরাজী

হযরতের মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ক বয়ানের উপর আরো দুটি কিতাব সংকলন করেছেন তার অপর নাতিজামাই মাওলানা আনোয়ার হোসাইন সাহেব। এদুটির নাম হচ্ছে মালফুযাতে সিরাজীমাজালেসে সিরাজী

এ কিতাবগুলোর  প্রত্যেকটিই মুদ্রিত অবস্থায় বাজারে চালু রয়েছে এবং অসংখ্য মানুষ তা থেকে উপকৃত হচ্ছে।

তাজকিয়া ও সুলূক

বড় হুজুর রহ. শাইখুল ইসলাম হযরত হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ.-এর হাতে বাইয়াত ছিলেন। মাওলানা ইউনুস সাহেব বলেছেন, ফেনুয়ার হযরত মাওলানা দেলোয়ার হুসাইন রহ. একদিন বলেছেন, আমি যে বছর দাওরা হাদীস শেষ করেছি সে বছর হযরত মাদানী রহ.-এর হাতে বাইয়াত হওয়ার নিয়তে তার দরবারে হাজির হলাম। সেখানে গিয়ে দেখি, বড় হুজুর হযরত মাওলানা সিরাজুল ইসলাম সাহেব হযরত মাদানী রহ.-এর দরবারে বসে আছেন এবং একই নিয়তে সেখানে হাজির হয়েছেন। একপর্যায়ে হযরত মাদানী রহ. আমাদের দুজনের চারটি হাতকে তার মুবারক দুই হাতের মাঝখানে রেখে আমাদের দুজনকে একসাথে বাইয়াত করেন।

হযরত বড় হুজুরের ইসলাহী তাআল্লুক সবসময় হযরত মাদানী রহ.-এর সাথেই ছিল। তবে তিনি কার খলিফা ছিলেন এ প্রসঙ্গে তার বড় সাহেবজাদা মাওলানা মুনিরুযযামান সিরাজী বলেছেন, ‘তিনি মূলত খলিফা ছিলেন ফেনুয়ার হযরত মাওলানা দেলোয়ার হুসাইন রহ.-এর। এছাড়া চট্টগ্রামের এক বুজুর্গ থেকেও তিনি খেলাফতপ্রাপ্ত হয়েছেন, যিনি হযরত গাঙ্গুহী রহ.-এর খলিফা ছিলেন।

ফেনুয়ার হযরতের এক খলিফা আখতারুযযামান সাহেব বলেন, বি. বাড়িয়ার রাসূলপুর গ্রামের এক ইসলাহী মাহফিলে ফেনুয়ার হযরত রহ. হযরত বড় হুজুরকে খেলাফত দিয়েছিলেন।

বড় হুজুর রহ. তার সারা জীবন ইসলাহ ও তাযকিয়ার কাজ চালু রেখেছেন। ব্যাপক হারে মানুষদেরকে মুরিদ না করলেও এধারা একেবারে বন্ধ ছিল না। মুরিদদেরকে ওযিফা সবক ইত্যাদি দিতেন। কিন্তু অনেক খেঁাজখবর নিয়েও তিনি কাউকে খেলাফত দিয়ে গেছেন কি না তা জানা যায়নি। বি. বাড়িয়ার কোন কোন আলেম ও মুরব্বী বলেছেন, বড় হুজুর তার বড় সাহেবজাদা হযরত মাওলানা মুনিরুযযামান সিরাজী সাহেবকে খেলাফত দিয়ে গেছেন। কিন্তু এব্যাপারে তাকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি তা এড়িয়ে যান। এছাড়া অন্য কাউকে খেলাফত দিয়েছেন বলে তথ্য পাওয়া যায়নি।

প্রচলিত ধারার খেলাফত তিনি কাউকে না দিয়ে গেলেও তার আদর্শের বিভিন্ন দিক উজ্জীবিত রাখার জন্য বহু উত্তরাধিকারী রেখে গেছেন, যারা তার সংস্কারমূলক আদর্শগুলোকে সমাজে বাস্তবায়িত করার জন্য আজীবন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার মত উৎসাহ রাখেন।

বড় হুজুরমুফাস্সির হুজুরহিসেবে প্রসিদ্ধি

আগেই বলা হয়েছে, হযরত বড় হুজুর রহ. দারুল উলূম দেওবন্দ থাকাকালেই ইলমে তাফসীরের সাথে তার বিশেষ সম্পর্ক এবং এবিষয়ে তার মুমতাজ প্রতিভার কারণে সেখানেই মুফাসসির উপাধীতে ভূষিত হন। পরবর্তীতে দেশে ফিরে আসার পর তাফসীরুল কুরআনের সাথে তার সম্পর্ক আরো গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে। জামেয়া ইউনুসিয়ার সাথে সম্পর্ক হওয়ার কিছুকাল পর থেকেই হযরত রহ. মাদরাসার প্রাঙ্গণে পবিত্র কুরআনের তাফসীর আরম্ভ করেন। এর পর থেকে বি. বাড়িয়া জেলার বিভিন্ন প্রান্তে পাঁচ দিন, সাত দিন, দশ দিন, পনের দিনব্যাপী ব্যাপক আকারে কুরআন তাফসীরের প্রোগ্রাম চালু করেন। আজকাল মহাসমাবেশগুলোর  জন্য যেভাবে বিশালাকারে প্যান্ডেল করে আয়োজন করা হয় সেভাবে হযরত মুফাসসির হুজুরের তাফসীর মাহফিলের জন্য বিশালাকারে আয়োজন করা হত।

তাফসীরের এধারাবাহিকতা কোন সময় বন্ধ হয়নি। আর এভাবে তিনি এই মুবারক উপাধীর অধিকারী হন।  তার মুখে তাফসীর যারা শুনেছেন তাদের মন্তব্য হল, কুরআনের অনেকগুলো রহস্য তিনি এত সহজভাবে বলে দিতেন যে, সাধারণ মানুষের তা বুঝাতে কোন কষ্ট হত না। একজন আলেম যেমনিভাবে তার তাফসীর থেকে অঞ্জলী ভর্তি করে নিতে পারত তেমনিভাবে একজন সাধারণ মানুষও তার বয়ানে পরিতৃপ্ত হতে পারত। হযরত বড় হুজুরের ব্যাপক দাওয়াতী প্রোগ্রামের এক বড় মাধ্যম ছিল তার তাফসীর মাহফিল। অযথা কিসসা কাহিনীর পরিবর্তে কুরআনের নসীহত ও দাওয়াতের কথাগুলো মানুষের হৃদয়ঙ্গম করানোর চেষ্টা করতেন। ফলে শত শত হিন্দু, কাদিয়ানী ও খৃস্টান স¤প্রদায়ের লোক এসব মাহফিলে উপস্থিত হওয়ার পর তার হাতে তাওবা করে মুসলমান হয়েছে।

ফখরে বাঙ্গাল হযরত তাজুল ইসলাম রহ. যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন বড় হুজুর রহ. মুফাসসির হুজুর হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। তখন ফখরে বাঙ্গাল রহ.-কে বলা হত, সদর সাহেব হুজুর। হযরত ফখরে বাঙ্গালের ইন্তেকালের পর থেকে মুফাসসির হুজুর হযরত সিরাজুল ইসলাম সাহেব বড় হুজুর হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন এবং বড় হুজুর ও মুফাসসির হুজুর এদুটি উপাধী সারা জীবন সমানে সমানেই চলতে থাকে। কারণ তখন তিনি জামেয়া ইউনুসিয়ার সবার মুরব্বি ছিলেন। মুহতামিম ও শাইখুল হাদীস হওয়ার পাশাপাশি তিনি বয়সের দিক থেকেও সহকর্মী ও সমকালীন ওলামায়ে কেরামের অনেক বড় ছিলেন।

হযরত মুফাসসির হুজুরের  তাফসীর মাহফিলে এত পরিমাণে লোক হত যে, মাহফিলের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত আওয়াজ পেঁৗছানো সম্ভব হত না। বি. বাড়িয়া এলাকায় তখনো মাইকের প্রচলন শুরু হয়নি। তাছাড়া এত বড় সমাবেশও কখনো হয়নি যেখানে মাইকের প্রয়োজন হতে পারে। পরিস্থিতি দেখে তাফসীর মাহফিলের আয়োজকরা ঢাকা থেকে মাইকের ব্যবস্থা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তখন থেকে এলাকায় মাইকের প্রচলন শুরু হয়, আর তা শুরু হয় একটি মুবারক কাজের উসিলায়।

দ্বীনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান 

হযরত বড় হুজুর রহ. তার দীর্ঘ জীবনে দ্বীনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে  একজন জিম্মাদার হিসেবে তার জিম্মাদারী আদায়ের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। একজন সফল শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার লাইনে এমন আদর্শ রেখে গেছেন, যা অনুকরণের কোন বিকল্প নেই। ইসলাহে নফসের ক্ষেত্রে এমন অবদান রেখে গেছেন, যার সুফল বি. বাড়িয়ার মানুষ এখনো ভোগ করছে এবং ভবিষ্যতেও ভোগ করে যাবে। সমাজ থেকে বেহায়াপনা ও অপসংস্কৃতির মূলোৎপাটনে তার ভূমিকা ছিল সর্বজনস্বীকৃত। কুফর, বিদআত ও শিরকের বিরুদ্ধে তার দাওয়াতী প্রোগ্রাম সর্বদা সক্রিয় ছিল। যা তার দৈনন্দিন রুটিনেরই অন্তভুর্ক্ত ছিল। তিনি প্রতি রাতে এশার নামায পড়ার পর একেক দিন একেক মহল্লায় চলে যেতেন, বেদআতীদের এলাকায় গিয়ে তাদেরকে বেদআতের কুফল বুঝাতেন। হিন্দুদের এলাকায় গিয়ে তাদের ধর্মের অসারতা সম্পর্কে বুঝাতেন। খৃস্টানদের এলাকায় গিয়ে তাদের যুক্তি বহিভূর্ত বাড়াবাড়িগুলো ধরিয়ে দিতেন। বিভিন্ন হেকমত ও কৌশলে তাদের সামনে সত্য তুলে ধরতেন। এভাবে গোমরাহ মানুষদেরকে সত্যের পথে ডেকে আনতে নিরলস সাধনা করে  গেছেন। একদিন তিনি তার অসতর্ক কর্মী বাহিনীর উপর অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমি তিলে তিলে মেহনত করে এলাকাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছি, আর তোমরা এখন এসব কী করছ? তোমরা আমার তৈরি ঘর চুরমার করে দিচ্ছ।

কাদিয়ানীদের সব ধরনের অপকর্মের বিরুদ্ধে যে সক্রিয় ভূমিকা হযরত বড় হুজুর রহ. রেখে গেছেন তা স্বতন্ত্র একটি ইতিহাস। এবিষয়ের উপর আমরা কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। এরপর নাস্তিক্যবাদী এনজিওর বিরুদ্ধে তিনি যে অবদান রেখে গেছেন তা এ বাংলাদেশের মাটিতে কেউ কোথাও দেখেনি। মোটকথা বি. বাড়িয়ায় তার সময়ে সব ধরনের অনৈসলামিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে যত ধরনের প্রতিবাদ প্রতিরোধ হয়েছে সবকিছুর মূল চালিকাশক্তি ছিলেন হযরত বড় হুজুর রহ.।

এমনিভাবে বি. বাড়িয়ার বিভিন্ন মসজিদ মাদরাসার সাপ্তাহিক বা মাসিক ইজতেমার মাধ্যমে সাধারণ সমাজের দ্বীনী অবক্ষয়গুলোর তদারকিও তিনি করতেন। এজন্য তার সুনির্দিষ্ট ধারাবাহিক প্রোগ্রাম ছিল। এভাবে দ্বীনের খেদমতের যত ক্ষেত্র হতে পারে সবগুলোতেই তিনি কমবেশি অবদান রেখে গেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁকে উত্তম প্রতিদান দিন এবং আমাদেরকে তার অনুকরণ করার তাওফীক দান করুন।

কাদিয়ানীদের প্রতিরোধে হযরত বড় হুজুর রহ.

ইসলাম বিরোধী সব ধরনের মতবাদের প্রচার প্রসারের মোকাবেলায় হযরত বড় হুজুর রহ. বড় ধরনের ভূমিকা রেখে গেছেন। তবে কাদিয়ানী মতবাদের প্রতিরোধ ছিল সবচাইতে উল্লেখযোগ্য। বড় হুজুর রহ. যখন বি. বাড়িয়াতে আসেন, তখন বি. বাড়িয়া এলাকার প্রায় সর্বত্র কাদিয়ানীদের পদচারণা ছিল। বি. বাড়িয়া শহরের মৌলভীপাড়ার বাসিন্দা আব্দুল আহাদ নামের এক ব্যক্তি সর্বপ্রথম এলাকায় কাদিয়ানী মতবাদের প্রচার করে। বি. বাড়িয়ার এক জামে মসজিদের খতিব ছিল সে। তবে সে জামে মসজিদ বর্তমানে কোনটি তা জানা যায়নি। এ ব্যক্তি ১৯০২ খৃস্টাব্দ থেকে তাদের বিভিন্ন বইপত্র পড়ে প্রভাবিত হয়। গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী বেঁচে থাকতে তার সাথে সরাসরি যোগযোগও  ছিল। পরবর্তীতে ১৯১২ খৃস্টাব্দে কাদিয়ানী ধর্মের দ্বিতীয় খতিব হাকীম নুরুদ্দীনের হাতে বাইয়াত হয় এবং দেশে ফিরে এসে এর প্রচার প্রচারণা চালাতে থাকে।

জামেয়া ইউনুসিয়া প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে কাদিয়ানী স¤প্রদায়ের প্রচার প্রসার অনেক বেড়ে গিয়েছিল। প্রেক্ষাপট  আলোচনা করলে দেখা যায়, কাদিয়ানীদের সাথে বাহাস মোবাহাসা এবং তাদের প্রতিরোধ প্রোগ্রামের ধারাবাহিকতার সূত্র ধরেই জামেয়া ইউনুসিয়া অস্তিত্ব লাভ করে। সে ইতিহাস অনেক দীর্ঘ।

হযরত বড় হুজুর রহ. ১৯৩০/৩১ খৃস্টাব্দে যখন জামেয়া ইউনুসিয়ায় আসেন, তখন কাদিয়ানী মতবাদের অস্তিত্ব ছিল অপ্রতিরোধ্য। ফখরে বাঙ্গাল তাজুল ইসলাম রহ. যিনি ইতিপূর্বে কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে আসছিলেন, তিনিও তখন জামেয়া ইউনুসিয়ায় ছিলেন। ফখরে বাঙ্গাল তাজুল ইসলাম রহ. এবং মুফাসসির হুজুর এই দুজনের জীবনের একটি স্বতন্ত্র মিশন ছিল কাদিয়ানীদের প্রতিরোধ। বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে কাদিয়ানী ধর্মমতের অসারতা প্রমাণ করে এবং ইসলামের হক্কানিয়াত তুলে ধরে সাধারণ মানুষকে হেদায়াতের পথে আনার জন্য নিরলস মেহনত করে গেছেন।

বিভিন্ন সময়ে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার কারণে তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়নি। তাই দীর্ঘকাল যাবৎ ওয়াজ-নসীহত মোনাযারা ও মোবাহাসার মাধ্যমেই তাদের শক্তি এবং জনসমর্থন কমিয়ে আনার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন এবং এ প্রচেষ্টায় তাঁরা সফলও হয়েছেন আশাতীতভাবে। একপর্যায়ে তাদেরকে সমূলে উৎপাটনের লক্ষ্যে ১৯৭৯ খৃস্টাব্দে খতমে নবুওয়াত যুবসংঘ গঠন করা হয়। হযরত বড় হুজুর রহ. পূর্ণ দায়িত্বসচেতনতার সাথে একটি মহান লক্ষ্যকে সামনে রেখে এ সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকতা করেন এবং সুশৃঙ্খল ও সুচারুরূপে  সংগঠনের কাজ এগিয়ে নিয়ে যান।

সংগঠন তার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে বি. বাড়িয়া শহরকে মসজিদভিত্তিক অনেকগুলো ইউনিটে ভাগ করে নেয় এবং কাদিয়ানী বিরোধী কর্মতৎপরতা চালিয়ে যেতে থাকে। সর্বক্ষেত্রে হযরত বড় হুজুর রহ.-এর সরাসরি তত্ত্বাবধান ও পরামর্শ গ্রহণ করে চলতে থাকে। সংগঠনের পক্ষ থেকে কাদিয়ানীদের মসজিদুল মুবারাকের পাশে রেলওয়ের একটি খালি ঘাটে হযরত বড় হুজুর রহ. তাফসীর মাহফিলের আয়োজন করেন। এরপর তাফসীর মাহফিলকে শিরোনাম বানিয়ে কাদিয়ানীদেরকে মুসলমান বানানোর একটি ধারাবাহিক প্রোগ্রাম সেখানে শুরু হয়।

বিভিন্ন ধরনের ঘাতপ্রতিঘাত এবং চড়াই উৎরাই পেরিয়ে কাদিয়ানীদেরকে সীমিত গণ্ডিতে আবদ্ধ করার দিকে সংগঠন এগুতে থাকে। প্রথমত তাদের প্রকাশ্য দাওয়াতী কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর তাদের উপাসনালয় থেকে মাইকে আযান দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। এধরনের প্রতিটি পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করিয়ে নিতে তাদের অনেক ঘাম ঝরাতে হয়েছে। সর্বক্ষেত্রে হযরত বড় হুজুর রহ.-এর তত্ত্বাবধান এবং পৃষ্ঠপোষকতা সংগঠনকে এগিয়ে যেতে দিকনির্দেশ করেছে। সকল কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় কান্দিপাড়ার কাদিয়ানী উপাসনালয়টি, যাকে তারা মসজিদুল মুবারাক নাম দিয়েছিল এবং যা কাদিয়ানীদের মূল কেন্দ্র ছিল ১৯৮৭ খৃস্টাব্দে হযরত বড় হুজুরের নেতৃত্বে মসজিদে রূপান্তরিত করা হয় এবং নাম দেওয়া হয় মসজিদুল ফাতহ। পরে এ মসজিদকেন্দ্রিক খতমে নবুওয়াত মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। যেখান থেকে সর্বদা খতমে নবুওয়াতের আক্বীদা বিশ্বাস ধ্বংস করার পাঁয়তারা চলত, সেখানেই এখন খতমে নবুওয়াতের আক্বীদা প্রতিষ্ঠার মেহনত দিনরাত চলছে।

এই সংগ্রামের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। আমরা সেদিকে যাচ্ছি না। মসজিদে রূপান্তরিত করার পর কোন কোন সরকারি আমলার পৃষ্ঠপোষকতার কারণে আন্দোলনকারীরা কিছু হয়রানির শিকার হলেও হযরত বড় হুজুরের বলিষ্ঠ অবস্থানের কারণে তারা কিছু করতে পারেনি। সরকারি পর্যায়ে মসজিদের বিষয়টি মিমাংসা করতে গিয়ে প্রশাসন ব্যর্থ হওয়ার পর তারা বড় হুজুর রহ.-এরই শরণাপন্ন হয়েছে। কাদিয়ানীদেরকে তাদের মসজিদ ফিরিয়ে দেওয়ার দাবির বিপক্ষে হযরত বড় হুজুর রহ. বারবার একটি বিষয়ের উপর জোর দিয়ে গেছেন যে, কার ঘর কাকে ফিরিয়ে দেব? মসজিদ হচ্ছে মুসলমানদের ইবাদতের ঘর। এটা তাদের জন্যই নির্ধারিত। এ ঘর, এ মসজিদ অমুসলিমদের দিয়ে দেওয়ার কোন যৌক্তিকতা নেই। হযরত বড় হুজুর রহ.-এর এই এক যুক্তির কোন জবাব ছিল না। আর এভাবে কাদিয়ানীদের মূল কেন্দ্র মুসলমানদের হস্তগত হয়। এরপর তাদের আরো গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি কেন্দ্রও দখলে আনা হয়। সেগুলো হচ্ছে- ঘাটোর, খড়মপুর, ভাদুঘর, শালগাঁও ও বাসুদেব। এ কেন্দ্রগুলো দখলে এনে এগুলোকে মুসলমানদের মসজিদ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। প্রায় পৌনে এক শতাব্দীকাল পূর্বে উত্তর প্রদেশের হযরত মাওলানা ইউনুস সাহেব ফয়যাবাদী রহ. কাদিয়ানীদের প্রতিরোধে আন্দোলনের যে বীজ বপন করে গিয়েছিলেন তার সার্থক বিজয় সূচিত হয়েছে আমাদের হযরত বড় হুজুর রহ.-এর হাতে। কাদিয়ানীদের তাওরার কেন্দ্রটি এখনো উদ্ধার হয়নি। হযরত বড় হুজুর রহ. আমাদের থেকে বিদায় নিয়ে গেছেন। কিন্তু বাতিল প্রতিরোধের যে নমুনা রেখে গেছেন, সে আদর্শ অনুসরণ করলে তাঁর উত্তরসূরীদের দ্বারা সে বিজয়ের ধারাবাহিকতা এখনো অব্যাহত রাখা সম্ভব। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।

এ তথ্যগুলো লেখককে সরবরাহ করেছেন বি. বাড়িয়া খতমে নবুওয়তের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা মাওলানা ইদরীস সাহেব, যিনি হযরত বড় হুজুরের পরামর্শে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

একজন নিরব বিপ্লবী ব্যক্তিত্ব

প্রচলিত ধারার কোন জাতীয় নেতা ছিলেন না আমাদের বড় হুজুর। বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরের কোন বক্তাও ছিলেন না। প্রচলিত ধারার কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও তিনি ছিলেন না। কিন্তু কার্যত বড় হুজুর রহ. এসব কিছুই আঞ্জাম দিয়েছেন ইসলাম বিরোধী সমাজ বিরোধী যখন যে কোন কার্যকলাপ দেখা দিয়েছে তখনই বড় হুজুর রহ. বলিষ্ঠ হাতে তা প্রতিহত করতেন। বি. বাড়িয়া ও কুমিল্লার হাজার হাজার তাওহীদী জনতাকে নিয়ে মুসলমানদের যে কোন দাবি, সমাজের যে কোন দাবি, জাতীয় পর্যায়ের যে কোন স্বার্থ তিনি উদ্ধার করে ছেড়েছেন। হাজার হাজার মানুষ তার আঙ্গুলের ইশারায় উঠত এবং বসত। জীবনসায়ােহ্ন যখন বড় হুজুর শারীরিকভাবে একেবারেই দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন, তখনও দ্বীনের যে কোন আহ্বানে টগবগে যুবকের মত উথলে উঠতেন।

একবার অনৈসলামিক ও অসামাজিক একটি বিষয় নিয়ে প্রশাসনের সাথে সাধারণ মুসলমানের গণ্ডগোল হওয়ার পর প্রশাসন তাদেরকে কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিল না। তখন বাধ্য হয়ে তারা হযরত বড় হুজুরকে ডেকে আনেন এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য অনুরোধ করেন, হযরত বড় হুজুর উপস্থিত হওয়ার পরও সাধারণ জনগণ প্রশাসনের বিরুদ্ধে মুহুর্মুহু শ্লোগান দিয়ে যাচ্ছিল। পুলিশ, বিডিআরের উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা হযরত বড় হুজুরকে বার বার অনুরেধ করার পর হুজুর দাঁড়িয়ে মাইক হাতে নিয়ে উপস্থিত লোকদের সম্বোধন করে বারবার বললেন খামোশ! খামোশ! মুহূর্তের মধ্যে বিশাল জামাত পিনপতন নিরবতায় পরিণত হয়ে গেল।

হযরত বড় হুজুর আঙ্গুলের ইশারায় মাইকে বললেন বসুন, সবাই বসে পড়ল। আবার ইশারা করে বললেন দাঁড়ান, সবাই দাঁড়িয়ে পড়ল।

এভাবে আঙ্গুলের ইশারায় লক্ষ জনতাকে কয়েকবার উঠবস করানোর পর হযরত বড় হুজুর প্রশাসনের লোকদেরকে সম্বোধন করে দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, আপনারা হয়ত লক্ষ করেছেন, বি. বাড়িয়ার মানুষ আমার আঙ্গুলের ইশারায় উঠে এবং বসে। আমি যদি বলি বি. বাড়িয়া শহর থেকে এক এক মুষ্ঠি করে মাটি নিয়ে অন্য জায়গায় রেখে দাও, তাহলে একদিনেই এ শহর এখান থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হয়ে যাবে। তাই আমি আপনাদেরকে সতর্ক করে দিচ্ছি, এ এলাকায় যেন কোন ধরনের  অনৈসলামিক ও অসামাজিক কার্যকলাপ না হয়। যদি আপনারা কোন অন্যায় কাজে প্রশ্রয় দেন তাহলে জনগণ আপনাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে তার দায় দায়িত্ব আপনাদের উপরই বর্তাবে। তাই সতর্ক হয়ে যান। এরপর হুজুর সবাইকে শান্ত হয়ে যেতে বলেন। হুজুরের আদেশে সেদিনের মত সবাই ঘরে ফিরে যায়। এভাবেই হযরত বড় হুজুর বি. বাড়িয়ার মানুষকে পরিচালিত করেছেন এবং দ্বীন ও সমাজ রক্ষার মহান খেদমত আঞ্জাম দিয়ে গেছেন।

বি. বাড়িয়ার সর্বস্তরের মানুষের সাথে কথা বললে খুব সহজেই অনুমিত হয় যে, হযরত বড় হুজুরের উপস্থিতি ছিল তাদের প্রাণের খোরাক। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যখন তখন চাইলেই সে এলাকায় ইসলাম বিরোধী কিছু করতে পারত না। এত দীর্ঘজীবী একজন মানুষের জীবনের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র একটি অংশ নিয়েও সমালোচনা করার মত মানুষ খঁুজে পাওয়া যায় না। ভাবতেই অবাক লাগে হযরত বড় হুজুর অত্র এলাকাকে নিঃশব্দে নিরবে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছিলেন, যার দ্বিতীয় নজির খঁুজে পাওয়া দুষ্কর। মানুষ তাঁকে অন্তর্জগতের প্রেসিডেন্ট হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছিল। সে অভিভাবক আজ আর নেই। মানুষগুলো সত্যিই যেন এতীম হয়ে গেছে।

শক্তিশালী এনজিওর বিরুদ্ধে আন্দোলন করে হযরত বড় হুজুর সফল হয়েছেন। সরকারি মদদপুষ্ট হওয়া সত্ত্বেও তারা আজো পর্যন্ত বি. বাড়িয়ার জমিনে পা জমিয়ে বসতে পারেনি। তাদের আরামের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। এমনিভাবে কাদিয়ানীদের শতবর্ষের পুরাতন ঘাঁটিও মূলোৎপাটিত হয়ে গেছে হযরত বড় হুজুরের তত্ত্বাবধানে। মওদূদিবাদের বিরুদ্ধে হযরতের ভূমিকা ছিল খুবই বলিষ্ঠ। এছাড়া সব ধরনের অনৈসলামিক ও অসামাজিক শক্তির বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সর্বদা সোচ্চার। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তার নীতি ও আদর্শ অনুসরণ করার তাওফীক দান করুন।

ভাদুঘর মাদরাসা প্রতিষ্ঠা

জামেয়া সিরাজিয়া দারুল উলূম নামে যে মাদরাসাটি হযরতের বাড়ির সামনে রয়েছে, এটি মূলত জামেয়া ইউনুসিয়ার ছাত্রদের দারুল মুতালাআ বা পাঠাগার ছিল। তালিবে ইলমরা বিভিন্ন জায়গায় জায়গির থাকত আর পড়ার সময় এখানে এসে পড়াশোনা ও মুতালাআ করত। হযরত তাদের জন্য এ ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ১৪০৭ হিজরীতে এটি পূর্ণাঙ্গ মাদরাসার রূপ নিয়েছে। এটি বর্তমানে দাওরা হাদীস পর্যন্ত মাদরাসা। হযরত বড় হুজুর এ মাদরাসায় কোন দরস দিতেন না। তবে সকাল বিকাল এখানে ইসলাহী মজলিস হত। রমযান ব্যতীত অন্য সময় ফজরের পর থেকে চাশত পর্যন্ত তরবিয়তি আলোচনা করতেন। রমযানে এ মজলিস হত যোহরের পর।

বিবাহশাদী

দেওবন্দ সফরের আগেই হযরত বড় হুজুর বিবাহের কাজ সম্পন্ন করেন। তাদের গ্রামের বাড়ি থেকে তিন চার মাইল দূরের ছয়ানি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জনাব মুন্সী জয়নুদ্দীনের প্রথম কন্যা মুসাম্মাৎ সুফিয়া খাতুনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। দেওবন্দ সফরের আগেই তার প্রথম সন্তান জন্মগ্রহণ করে। এ প্রথম সন্তান হচ্ছে নাদিয়াতুল কুরআন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা আব্দুল ওয়াহহাব রহ.-এর স্ত্রী মুসাম্মাৎ সালেহা বেগম। তিনি দেওবন্দ থেকে দেশে ফেরার পর আরো চার ছেলে দুই মেয়ে জন্মগ্রহণ করে। তারা হচ্ছেন, হযরত মাওলানা মুনিরুযযামান সাহেব, মাওলানা আব্দুস সালাম সাহেব রহ., মাওলানা আব্দুল হাই সাহেব ও মাওলানা আব্দুল কাইয়ুম সাহেব। আর দুই মেয়ে হলেন আয়েশা বেগম ও নূরজাহান বেগম।

বসবাস

হযরত বড় হুজুর রহ. দেওবন্দ থেকে ফিরে এসে জন্মস্থান দশদোনাতেই অবস্থান করেছেন। জামেয়া ইউনুসিয়ায় খেদমত শুরু করার পর বি. বাড়িয়া থাকা শুরু করেন। এরপর সস্ত্রীক এসে সর্বপ্রথম রেল স্টেশনের উত্তর পাশে চানমিয়া পেশকারের বাসায় ভাড়া থাকা শুরু করেন। হযরত বড় হুজুর বি. বাড়িয়া থাকা শুরু করার আগে তার বড় ছেলে মাওলানা মুনিরুযযামান সাহেব জন্মগ্রহণ করেন।

কিছুদিন পর তিনি ভাদুঘর ফাটা পুকুরের পূর্ব পাড়ে থাকতে শুরু করেন। এখানেও তিনি ভাড়ায় ছিলেন। এরপর ভাদুঘর ভূঁইয়া বাড়ির কাছে একটি খালি জায়গা খরিদ করে নিজে বাড়ি করেন। এই বাড়িতেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, যা এখন মাদরাসার উত্তর পাশে অবস্থিত।

মেযাজ ও আখলাক

সহজ সরল জীবন ছিল তার কাছে সবচেয়ে পছন্দনীয়। জীবনের কোন অংশেই তিনি আড়ম্বরকে স্থান দেননি। পোশাক পরিচ্ছদ, কথাবার্তা, চলাফেরা, সর্বক্ষেত্রে সহজ সরল একটি পদ্ধতি গ্রহণ করে এ দীর্ঘ জীবন পার করে দিয়েছেন।

অনেকগুলো নববী সিফাতের সমাহার ছিল তার মাঝে। তার ব্যাপারে একটি কথা অনেকের মুখে শোনা যায় যে, তার মজলিসের প্রত্যেকটি মানুষ মনে করত হুজুর আমার সাথেই কথা বলছেন। এছাড়া তার সাথে যাদেরই সম্পর্ক ছিল তারা প্রায় সবাই মনে করতেন হুজুর আমাকেই বেশি আদর করেন। এ গুণটি রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি বিশেষ গুণ হিসেবে হাদীসে পাওয়া যায়।

বি. বাড়িয়ার হযরত মাওলানা মুজিবুর রহমান সাহেব বলেন, বড় হুজুরের একটি গুণ আমি দেখেছি, তার সঙ্গে কেউ মুসাফাহা করলে যতক্ষণ পর্যন্ত অপর ব্যক্তি নিজে হাত ছাড়িয়ে না নিত হুজুর ততক্ষণ নিজের হাত ছাড়াতেন নাতিনি আরো বলেছেন, অসুস্থ অবস্থায়ও তার সাথে কেউ সাক্ষাৎ করতে এলে দীর্ঘক্ষণ তার সঙ্গে কথা বলতে থাকতেন, অসুস্থতা বা কষ্টের ওজর দেখাতেন না। এভাবে তিনি মানুষের মনরক্ষা করে চলতেন।

যখন নিজে চলতে পারতেন না, তখনও অন্যের সহায়তা ছাড়া কষ্ট করে মসজিদে গিয়ে নামায পড়তেন। দাঁড়িয়ে কষ্ট হত তবুও দাঁড়িয়েই নামাযগুলো আদায় করতেন। মাওলানা মুজিবুর রহমান সাহেব বলেন, এত অসুস্থতার মাঝেও তাঁকে দাঁড়িয়ে নামায পড়তে দেখে আমরা আবাক হয়ে যেতাম। পরিবারের লোকদের খেদমত নেওয়ার ব্যাপারে তার খুব আপত্তি ছিল। পারতপক্ষে তিনি কারো খেদমত নিতে চাইতেন না। শেষ জীবনে মাদরাসায় আসা যাওয়ার সময় সাথে কাউকে নিয়ে যেতেও রাজি হতেন না। মোটকথা কোন ধরনের আড়ম্বরের ছেঁায়া লাগতে পারে এমন সবকিছুই পরিহার করে চলতেন।

মেযাজ মুবারক ছিল নিরব ও চাপা। কারো সাথে উচ্চবাচ্য করতেন না। কেউ কোন খারাপ ব্যবহার করলে কখনো বিতর্কে তো জড়াতেনই না; বরং তাকে কিছু বলতেনও না। কিন্তু কোন বিষয়ে মনে কষ্ট পেয়ে গেলে তার প্রভাব পড়ত খুব ভয়াবহ। হযরত বড় হুজুরের বড় মেয়ের জামাতা হযরত মাওলানা আব্দুল ওয়াহহাব রহ. তার ছেলেদেরকে প্রায়ই একথা বলে সতর্ক করতেন যে, খবরদার! তোমরা তোমার নানার সাথে দুষ্টুমি করবে না, বেয়াদবি করবে না, তোমার নানা কিন্তু আগুন।

বড় হুজুরের সাথে কোন বেয়াদবি মূলক আচরণ বা অসতর্ক কোন আচরণের কারণে অনেকের জীবনে ভয়াবহ বিপদ নেমে এসেছে, এরকম ঘটনা বহু। মাওলানা মাহমুদ সাহেব এ লেখককে সে ধরনের অনেকগুলো ঘটনা শুনিয়েছেন, কিন্তু সেগুলো বিবৃত করতে নিষেধ করায় উল্লেখ করা হল না। সেসব ঘটনা থেকে  শেখার বিষয় হচ্ছে, একজন আল্লাহ ওয়ালার সঙ্গে অসদাচরণ করলে আল্লাহ কীভাবে এবং কত ভয়াবহভাবে তার বদলা নেন তা শেখা এবং সতর্ক থাকা।

বিশেষ নসীহত

হযরত বড় হুজুর রহ.-এর সারাটি জীবন একটি নসীহতের প্রতিচ্ছবি, একটি আদর্শ। তারপরও দুটি নসীহত এখানে উল্লেখ করছি। হযরত বলতেন, ‘এত উপরে লাফ দিতে নেই যতটুকু ধরতে না পারলে পড়ে পা ভেঙ্গে যাবে, ফলে পরে আর হাটতেই পারবে না।হাজ্বীদেরকে লক্ষ করে বলতেন, ‘হজ্ব করা সহজ কিন্তু তা রক্ষা করা কঠিন। হজ্ব করলে মানুষ মাসূম-নিষ্পাপ হয়ে যায়। এরপর গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে পারলে সে হজ্বকে রক্ষা করা যায়, নচেৎ রক্ষা করা যায় না।এধরনের  অসংখ্য নসীহত তার জীবনে খুঁজে পাওয়া যায়। সাক্ষাৎপ্রার্থীদেরকে  তাদের কর্মক্ষেত্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেন এবং সে যে অবস্থায় আছে সে অবস্থার উপযোগী নসীহত তাকে করতেন।

ইন্তেকাল ও জানাযার নামায

একজন পরিপূর্ণ মানুষের সকল গুণের সমাহার, আল্লাহর একজন মুমিন বান্দা বিগত ১৬ সেপ্টেম্বর শনিবার সকাল ৯:৩০ মিনিটে ইহজগত ছেড়ে তার প্রেমাষ্পদের একান্ত সান্নিধ্যে গিয়ে মিলিত হন। ইহজগতের মায়া কখনো তার মনে ঢুকেছে এমন আলামত পাওয়া যায়নি। তাই মহান রবের সান্নিধ্যই  ছিল তার একমাত্র কাম্য। পরম পাওয়া। আমরা হয়তো নিজেকে বুঝাতে পারি না, মুরব্বিহারা এতীম সন্তানের মত ফিরছি, কিন্তু তিনি আছেন মহা সুখে। আল্লাহ আমাদেরকে তার পথের পথিক হওয়ার তারফীক দান করুন।

ইন্তেকালের দিনই বিকেল ৫:৩০ মিনিটে কাজিপাড়া জেলা ঈদগাহ ময়দানে তার জানাযার নামায অনুষ্ঠিত হয়েছে। নামাযে যারা শরিক হয়েছেন তাঁদের ধারণা, নামাযে উপস্থিতিদের সংখ্যা প্রায় তিন লক্ষ ছাড়িয়ে যাবে। একটি জানাযার নামাযই সাক্ষ্য দেয় হযরত বড় হুজুর রহ. কীভাবে তিলে তিলে মানুষের অন্তরগুলো জয় করেছেন। অথচ পার্থিব কোন কিছুই তাদেরকে দেননি। হাঁ, দিয়েছেন আসল বস্তুটি, যার কারণে অত্র অঞ্চলের মানুষ সারা জীবন তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে বাধ্য। নামাযের কাতার কত দূর পর্যন্ত গিয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। এক পর্যায়ে নিয়মতান্ত্রিক কাতার করারও কোন অবস্থা ছিল না। যে যেখানে ছিল সে সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়েছে। সামনের দিকের কাতারগুলো কিছু ফাঁক ফাঁক হয়ে পড়লেও পেছনের দিকের প্রায় সব কাতারই বুকে-পিঠে মিলে গেছে। এভাবে পুরো এলাকা একটি নামাযে জানাযার জামাতে পরিণত হয়েছে। হযরতের বড় ছেলে মাওলানা মুনিরুযযামান সাহেব জানাযার নামাযের ইমামতি করেছেন।

মাকবারা

গত ১২ নভেম্বর যখন যেয়ারতের উদ্দেশ্যে হযরতের কবরের পাশে দাঁড়িয়েছি তখন অন্যান্য দুআর মাঝে এ কামনা বারবার করেছি যে, হে আল্লাহ এমন আরেকজন মুরব্বি আমাদেরকে দান কর। এমন আরেকটি আদর্শ আমাদের দাও। তার আদর্শ মোতাবেক চলার তাওফীক আমাদেরকে দান কর। বারবার মনে জাগছিল, সামান্য মাটির এত শক্তি যে, সে এত বড় একজন মানুষ, এতগুলো মানুষের হৃদয়ের ভালবাসার ফুলকে এভাবে লুকিয়ে রেখেছে । এ মাটি যেন জানেই না, তার মাঝে কে সমাহিত? হযরতের বাড়ির উত্তর পাশে যে পুকুর রয়েছে তার উত্তর পশ্চিম কোণের একটি সংক্ষিপ্ত কবরস্থানে চির নিদ্রায় শুয়ে আছেন এদেশের কোটি মানুষের চোখের মনি, হৃদয়ের ভালবাসা, সবার মুরব্বি এবং অভিভাবক আমাদের বড় হুজুর, মুফাসসির হুজুর, হযরত সিরাজুল ইসলাম রহ.।

 

 

advertisement