যিলকদ ১৪৪৩   ||   জুন ২০২২

বাবাকে যেমন দেখেছি

মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মাজীদ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

তাঁর পছন্দের কয়েকটি আমল

ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নতে মুআক্কাদার পর তিনি তালীম-তাআল্লুমের খেদমতকেই প্রধান শোগল-ব্যস্ততা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। পাশাপাশি তাঁর পছন্দের আরো কয়েকটি আমল ছিল : 

১. কুরআন কারীমের প্রতি তাঁর সীমাহীন আগ্রহ ছিল। মাদরাসা পরিচালনার শত ব্যস্ততার মাঝেও প্রতিদিন দেখে দেখে কিছু না কিছু কুরআন তিলাওয়াত তার অভ্যাস ছিল। শক্তিহীন হয়ে শয্যাশায়ী হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি এ অভ্যাস ধরে রেখেছিলেন। এমনকি সফরেও তাঁর এই আমল কাযা হতো না। একবার ঢাকার মোহাম্মদপুরের একটি অনুষ্ঠানে তিনি বিশেষ অতিথি ছিলেন। আমি ছিলাম তাঁর খাদেম। প্রোগ্রামটি হচ্ছিল একটি কমিউনিটি সেন্টারে। বাবাকে নিয়ে হল রুমের বাইরে অবস্থান করছিলাম। তখন মাইকে শোনা যাচ্ছিল সুমধুর কণ্ঠে হামদ, নাত, গজল ইত্যাদি। তিনি আমাকে বললেন, এগুলো কী? তিলাওয়াত করে না কেন?

আমি বোকার মতো তাঁকে এগুলোর ফযীলত বোঝাতে লাগলাম। আমার কথা শুনে তাঁর চেহারায় বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠল। মুখে কিছুই বললেন না। বারবার শুধু একটি কথা বললেন, কুরআন তিলাওয়াত করবে। কুরআন! কুরআন! কুরআনে কি মজা নাই?

২. কুরআন তিলাওয়াতের পাশাপাশি কোনো কোনো সময় শায়খুল ইসলাম শাব্বির আহমাদ ওসমানী রাহ. রচিত তাফসীরে ওসমানী মুতালাআরও অভ্যাস ছিল তাঁর। ছোটবেলা থেকেই এই মূল্যবান তাফসীরটি সবসময় তার মাথার পাশে রাখা দেখেছি। তাকে বলতে শুনেছি, ‘ওসমানী সাহেব অল্প শব্দে দামি দামি কথা বলেন। অনেক লম্বা বিষয় মুখতাসার-সংক্ষিপ্ত করে জামে-সমৃদ্ধ ইবারতে পেশ করেন।

৩. ইখফায়ে আমল বা আমলে গোপনীয়তা রক্ষা করা। এটি ছিল তার জীবনের অনন্য এক মহৎ গুণ। দূর থেকে মনে হতো তিনি শুয়ে আছেন। কাছে গিয়ে দেখতাম, তিনি খুব নীরবে দরূদ শরীফ পড়ছেন বা ইস্তেগফার করছেন। সাত বা আট বছর বয়সে যখন আমি হিফজ পড়তাম তখনকার ঘটনা : দূর থেকে দেখছিলাম বাবা অন্ধকারে মুনাজাত করছেন। দৌড়ে গিয়ে প্রবেশ করা মাত্রই তিনি মুনাজাত বন্ধ করে দিলেন।

৪. ইখফায়ে সদাকাহ বা গোপনে দান করা। এটি তার এতই গোপন আমল ছিল যে, তার ওফাতের পরই কেবল আমরা জানতে পারলাম, তিনি বিভিন্ন জনকে বিভিন্ন উপলক্ষে দান করতেন। কোনো ছাত্রকে নাস্তার খরচ, কাউকে ভর্তির খরচ, কাউকে কিতাব ক্রয়ের জন্য অর্থ প্রদান কিংবা বিপদগ্রস্তদেরকে প্রয়োজনে করযে হাসানাহ প্রদান ইত্যাদি।

তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি উপদেশ

১. দিন-তারিখ মনে নেই। বেশ আগের কথা। তখন আমার খুব ইচ্ছা জাগল, ওয়াজের লাইনে দ্বীনের খেদমত করব। ইতিমধ্যে কিছু কিছু প্রোগ্রামও শুরু করলাম। একবার যাওয়া হল চাঁদপুরের এক এলাকায়। রাত আনুমানিক একটা অথবা দেড়টা বাজে। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। তাকিয়ে দেখি বাবার ফোন। আমি অবাক হয়ে গেলাম। কারণ সাধারণ সময়ে ফোন করার অভ্যাসও তাঁর ছিল না। সেখানে এত গভীর রাতে ফোন! ফোন রিসিভ করে সালাম দিতেই তিনি বললেন, ‘তুমি নাকি ওয়াজ করতে শুরু করছো? ওয়াজ করার অনেক মানুষ আছে। তুমি ওয়াজ করবা না। ছাত্র গড়বা। আলেম বানাইবা। কারণ এ লাইনে মানুষ কম।

গভীর রাতের দরদমাখা সেই কণ্ঠ যেন এখনও আমার কানে বাজে।

২. রিযিক নষ্ট করা খুব অপছন্দ করতেন। তিনি বলতেন, রিযিক অপচয় করলে বেবরকতী আসে। খাওয়ার সময় ভাত বা খাবারের কোনো অংশ পড়লে উঠিয়ে প্রয়োজনে ধুয়ে খেয়ে নিতেন। আমরা তার সাথে খাবার খেলে আমাদের প্লেটের ভাত পড়লে আমরা না খেলেও তিনি উঠিয়ে খেয়ে ফেলতেন। খেড়িহর মাদরাসায় যোহরের পর মাঝেমধ্যে ছাত্রদের নসীহত করলে তিনি এ ব্যাপারে খুব গুরুত্ব দিতেন। খাবার শেষে বেঁচে যাওয়া ভাত-তরকারি যারা ফেলে দিত কিংবা প্লেট বা বাটিতে রেখে নষ্ট করত তাদের তিনি খুব তিরস্কার করতেন; বলতেন, এদেশের মানুষ বিদেশ গিয়েও খাবার নষ্ট করে। এটা খুব খারাপ অভ্যাস।

৩. আনুমানিক ২৭/২৮ বছর পূর্বে খেড়িহর মাদরাসার কোনো এক রমযানের বিরতির পূর্বে ছাত্রদের নসীহতকালে তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা রমযানে যেকোনো এক বিষয়ে মেহনত করবা। একাধিক বিষয়ে মেহনত করলে কোনোটিই হয় না। যেমন, হয়তো কুরআন শিখবা অথবা লেখা সুন্দর করবা অথবা দরসের যে কিতাবগুলোতে দুর্বলতা আছে সেগুলোর যেকোনো একটির উপর মেহনত করবা।

একবার তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি রমযানের বিরতিতে ছাত্রদেরকে আদইয়ায়ে মাছুরার তারকীব শিখিয়েছি। এতে দুটি লাভ : দুআও শেখা হয় এবং ইলমও পাকা হয়। তুমিও এ ধরনের খেদমত করবা।

৪. জুমার দিনটি তার কাছে ছিল সাপ্তাহিক তাকরারের দিন। এ দিন তাকরারের ব্যাপারে খুব গুরুত্ব দিতেন। তাঁর যতদিন শক্তি ছিল মাদরাসায় এই নিয়ম প্রয়োগের সার্বিক তদারকি একাই আঞ্জাম দিয়েছেন। তিনি শুক্রবার সকালে তিলাওয়াতের পর থেকে ৯টা পর্যন্ত এবং জুমার পর থেকে আসর পর্যন্ত পূর্ণ সপ্তাহের পেছনের সকল সবক তাকরার করার ব্যাপারে অনেক তাকিদ করতেন।

৫. একটি বাসায় দৈনিক পত্রিকা দেখে আমাকে বললেন, ছবিওয়ালা পত্রিকা রাখা ঠিক না। কারণ বেখেয়ালিতে যদি নামাযের সময় ছবি ঢাকতে স্মরণ না থাকে তখন তো নামাযের ক্ষতি হবে। আর এটা হওয়াই স্বাভাবিক।

৬. নিয়মিত শরীর চর্চা, ব্যায়াম, প্রতিদিন রুটিন মাফিক হাঁটাহাঁটি করার ব্যাপারে তিনি খুব তাকিদ দিতেন। রাতে খাবার খেয়ে সাথে সাথে শুয়ে পড়ার ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি বলতেন, রাতে খেয়ে কিছুক্ষণ হাঁটতে হয়।

খেড়িহরে তার সান্নিধ্যে যতদিন ছিলাম ততদিন দেখেছি, প্রতিদিন ফজরের পর হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে যেতেন। হাঁটা শেষ করে বেশিরভাগ সময় তাকে ইশরাক পড়তে দেখতাম। পরে অন্য আমল করতেন। আমি না হাঁটলে আমার সাথে রাগ করে বলতেন, ‘তুই হাঁটছ না, মুহাদ্দিস সাবও হাঁটে।এর দ্বারা তিনি যাঁকে বুঝিয়েছেন তিনি হলেন, হযরত মাদানী রাহ.-এর ছাত্র, দারুল উলূম করাচির একসময়ের উস্তায, ফরিদাবাদ মাদরাসার মুহাদ্দিস, খেড়িহরের বাসিন্দা হযরত মাওলানা আবদুল হাফিজ রাহ.। তিনি আরো বলতেন, নিয়মিত হাঁটলে বড় বড় রোগ-ব্যাধি হয় না।

৭. আমার কোনো রোগ হলে তিনি আমাকে বলতেন, ‘নিয়মিত সাত বার সূরা ফাতেহা পড়ে শরীরে দম করবা এবং সূরা ইখলাস, ফালাক ও নাসের আমল গুরুত্বের সাথে আদায় করবা।এর দ্বারা অনেক ধরনের রোগ-ব্যাধি চলে যাবে। আরেকদিন তিনি আমাকে বললেন, ‘এ আমলগুলো লাগাতার অনেকদিন করার কারণে আমার শারীরিক অনেক ফায়দাও হয়েছে।

আরেকদিন তিনি আমাকে বলেছেন, ‘নোয়াখালীর চৌমুহনী অঞ্চলের এক প্রবীণ হিন্দু চিকিৎসক বাবাকে বলেছেন, কুরআনের অমুক অমুক সূরাগুলো নিয়মিত পড়ে শরীরে দম করলে এই এই রোগ থাকার কথা নয়।বাবার কথার বিস্তারিত বিবরণ আমার মনে নেই।

৮. একাধিকবার তাঁকে বলতে শুনেছি, তিনি খুব জালালী কণ্ঠে বলছেন, ‘মাদরাসা ও তালেবে ইলমদের হক নষ্ট করলে একসময় এর ক্ষতি নিজেকে ভুগতেই হবে। অনেকসময় এই ক্ষতির প্রভাব নিজ সন্তানের উপরও বর্তায়।’ 

৯. সাধারণত স্বেচ্ছায় কারো কাছে ফোন করার অভ্যাস তাঁর ছিল না। কিন্তু ওফাতের আগের বছর বাবা আমাকে অসংখ্যবার নিজ থেকেই ফোন করে গুরুত্বপূর্ণ একটি নসীহত করেছেন। বলেছেন, ‘বুনিয়াদী কিতাবাদি মজবুতীর সাথে পড়ানোর জন্য মাদরাসা বানাও। নতুবা তোমাদের সন্তানরা কোথায় পড়বে?’ এই বলে কখনো কখনো কয়েকটি কিতাবের নামও বলতেন। তিনি মনে করতেন, মাদরাসার উপরের জামাতগুলো খোলা হলে নিচের জামাতগুলোর পড়ালেখার মান থাকে না। ফলে ছাত্রদের ইস্তেদাদ দুর্বল থেকে যায়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা দেখি, তার কথাই সত্য।

যে কারণে খেড়িহর মাদরাসায় দাওরায়ে হাদীসহল না

মাদরাসার মুতাওয়াল্লী আলহাজ¦ আবদুল ওয়াদুদ খান সাহেব প্রচুর অর্থ-সম্পদের মালিক ছিলেন। মনও ছিল তাঁর অনেক বড়। সে সময়ের বড় বড় মনীষীদের সাথে তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। সবার মনের ইচ্ছা ছিল খেড়িহরে দাওরা হোক। কিন্তু বাবা রাজি হননি। খান সাহেবকেও তিনি অসম্মতির কথা জানালেন। শেষ পর্যন্ত আর দাওরা হলই না। বাবা আমাকে বহুবার বলেছেন, ‘আজকে দাওরা হলে কালকে আর নিচের জামাতের বুনিয়াদী কিতাব পড়ার গুরুত্ব থাকবে না। তাছাড়া এখানেই সব পড়তে হবে কেন? শেষের একটি বছর দেশের বড় কোনো মাদরাসায় পড়বে- এতে অনেক ফায়দা হবে। মনও বড় হবে।

আরেকদিন তিনি আমাকে বলেছেন, ‘মাদরাসা দাওরা হলে এখান থেকে আবদুল মালেক, দিলাওয়ার অমুক অমুক পয়দা হত না।

আরেকদিন আমাকে বললেন, ‘বেশি ভালো হয়, মাদরাসায় সর্বোচ্চ কাফিয়া/শরহে জামী পর্যন্ত থাকবে। এরপর বড় কোনো মাদরাসায় চলে যাবে। কারণ এই কয়েক জামাতের পড়াশোনাই আসল। যখন মাদরাসায় শুধু এই জামাতগুলো থাকবে তখন সবার সম্মিলিত মেহনতে পড়ালেখার মান ভালো থাকবে। তখন ইস্তেদাদওয়ালা আলেমের কমতি হবে না। মাদরাসা বড় হয়ে গেলে হুজুরদের নজর থাকে উপরের দিকে, নিচের ছেলেরা বঞ্চিত হয়।

এরপর বাবা বলেন, ‘দেখো মেখল মাদরাসায় মুফতী সাহেব রাহ. উপরের জামাত রাখেন নাই। এজন্য সেখানে বুনিয়াদী পড়ালেখার মান হাটহাজারীর চেয়ে ভালো।

কারামত

একেক বুর্জুগের কারামত একেক ধরনের হয়। আমার দৃষ্টিতে বাবার জীবনের উল্লেখযোগ্য কারামত এই :        

১. তাঁর জানাযা পরিপূর্ণ সুন্নত তরীকায় সম্পাদিত হয়েছে। কারণ আজকাল জানাযার পূর্বে মায়্যিতকে সামনে নিয়ে ওয়াজ-বক্তৃতা করার এ মন্দ রসম মহামারির রূপ ধারণ করেছে। বড় বড় এমন আলেমদের জানাযায়ও এই তরীকা চলমান, যাঁরা পুরো জীবন সুন্নতের জন্য ওয়াকফ করে দিয়েছেন। নিঃসন্দেহে এই অবহেলা পরবর্তী ওয়ারিশদের গাফলতির কারণেই হয়। কারণ, তাঁরা তো মৃত্যুর আগে এগুলো করতে বলেন না। অনেকে বিভিন্ন ধরনের অজুহাত দাঁড় করিয়ে এই পদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ করে যে, এই সময়টুকু মানুষ অপেক্ষমাণ থেকে কী করবে?... আরো অনেক কথা! কিন্তু আলহামদু লিল্লাহ, এ ধরনের খোঁড়া যুক্তির জবাব পেয়ে গেলাম বাবার জানাযায়। তার জানাযার পূর্বে যোহরের নামায আদায় করার পর যখন মাদরাসার মাঠে মানুষ জমায়েত হতে লাগল তখন আমার উস্তায মাওলানা আবদুর রহীম সাহেব (বরলার হুজুর) বাবার নামে আরবীতে কিছু কবিতা পড়ে তাঁকে নিয়ে কিছু বলতে শুরু করলেন। মেঝো ভাইজান দূর থেকে এসেই মাইক নিয়ে নিলেন এবং বললেন, ‘আমি হুজুরের কথা বন্ধ করে তার থেকে মাইক চেয়ে নিলাম। কেননা মায়্যিতকে সামনে নিয়ে এই তরীকায় বয়ান-বক্তৃতা করা একটি ভুল রেওয়াজ। তাহলে প্রশ্ন হবে, জানাযার পূর্বে ঘোষিত সময়ের আগ পর্যন্ত অপেক্ষার এই সময়টুকুতে আমরা কী করব? ব্যস! আমরা সময়টা যিকিরে-ফিকিরে থাকব।

এরপর তিনি জানাযা দাঁড়ানো পর্যন্ত কাউকে কোনো ওয়াজ বা বক্তৃতা করতে দেননি। শুধু এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে একজন এবং পরিবারের পক্ষ থেকে একজন একেবারে সংক্ষিপ্ত কথা বলেছেন।

২. তাঁর জানাযা যথাসময়ে হয়েছে। আমি বলব, এই যুগে এটিও একটি কারামত। দেশের প্রথম সারির অন্যতম প্রখ্যাত বুজুর্গ হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ. ও হারদূঈ হযরত রাহ.-এর খলীফা প্রফেসর হযরত দা. বা. জানাযায় অংশগ্রহণের জন্য আসছেন। হযরতের পৌঁছা পর্যন্ত অপেক্ষা করলে জানাযা আরো দেরি হয়। ফোনে হযরতের সাথে মশওয়ারা করা হলে হযরতও বললেন জানাযা যেন ঠিক সময়ে হয়ে যায়। বিভিন্ন অজুহাতে জানাযা বিলম্বিত করার রেওয়াজ ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। বাবার ওফাত হয়েছে রাত পৌনে বারটায়। মেঝো ভাইজান চেয়েছিলেন জানাযা সকাল ১০ থেকে ১১ টার মধ্যে হয়ে যাক। কিন্তু তখন খেড়িহর মাদরাসা ছুটি ছিল। যে কারণে মাদরাসায় কেউ ছিল না। আমরা হাসপাতাল থেকে বাবাকে নিয়ে মাদরাসায় পৌঁছতে পৌঁছতে সকাল হয়ে যায়। কবর খননসহ সকল কাজ গোছাতে স্বাভাবিকভাবেই ১২টা বেজে গেছে। সে কারণে এই জানাযা বাদ যোহর নির্ধারিত হয়। তাতেও মেঝো ভাইজান নারায ছিলেন।

এই দুটি বিষয় কারামতের অধ্যায়ে উল্লেখ করার কারণ হল, কারামত কেবলই অলৌকিক কিছু ঘটার সাথে খাস নয়, বরং সুন্নতি জীবনের উপর অবিচলতা এবং মৃত্যুর পর কবর পর্যন্ত সুন্নতি যিন্দেগীর সকল ব্যবস্থাপনা কুদরতিভাবে ইন্তেযাম হয়ে যাওয়াও কারামতের একটি প্রকার। জুনাইদ বাগদাদী রাহ. ও হাকীমুল উম্মত থানভী রাহ.-এর বিভিন্ন মালফুজ থেকে এটি বোঝা যায়। আমার এখন মনে পড়ছে, বাবা আমাকে একদিন বলেছেন, মুফতী ফয়জুল্লাহ রাহ. মৃত্যুর আগে অসিয়ত করেছিলেন, তাঁর জানাযা যেন বিলম্বিত না করা হয়। এমনকি (মেখলের সবচেয়ে কাছাকাছি জায়গা) হাটহাজারী মাদরাসার হুজুর এবং ছাত্রদের আসার জন্যও যেন অপেক্ষা না করা হয়। বাবার ইচ্ছা ছিল তার জানাযাও এমন হবে।

৩. আরেকটি কারামত হল, সাধারণত দেখা যায় মুহতামিমদের ওফাতের পর মাদরাসায় বিভিন্ন ধরনের ফেতনা সৃষ্টি হয়। কিন্তু তিনি বড়ই সৌভাগ্যবান মুহতামিম। তাঁর জীবদ্দশায়ই আল্লাহ তাআলা তাঁকে একজন যোগ্য নায়েব মিলিয়ে দিয়েছিলেন, যিনি তাঁরই ছাত্র। দীর্ঘ ২২ বছর বাবার অধীনে তিনি নায়েবে মুহতামিম ছিলেন। ইতিপূর্বে আরো ১০ বছর শিক্ষক ছিলেন। ছাত্রজীবনের কথা না-ই বললাম। সবমিলিয়ে কমপক্ষে ৩৫ বছর তিনি বাবার সোহবত লাভে ধন্য হয়েছেন। জীবদ্দশায়ই নায়েব সাহেবকে তিনি সবকিছু বুঝিয়ে দিয়েছেন। শুধু মৌখিকভাবে তাঁকে মুহতামিম ঘোষণা দেননি। এছাড়া আমলী কোনো ইশারা আর বাকি রাখেননি। যেমন সর্বশেষ হাসপাতালে যাওয়ার সময় তাঁকে ডেকে ইশারার মাধ্যমে মুনাজাত করার নির্দেশ দিলেন। নিজের চাবিগুচ্ছ তার হাতে সোপর্দ করলেন। আমি বলব, বাবার জীবদ্দশায় এমন একজন নায়েবের বন্দোবস্ত হওয়া নিঃসন্দেহে তার কারামত। কারণ যোগ্য নায়েব না হলে পরবর্তী কার্যক্রম বেবরকত হয়ে যায়। ফলে ইলমের প্রচার-প্রসার, যা একটি মহান সদকায়ে জারিয়া- এর কার্যক্রম দারুণভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। তখন আর সদকায়ে জারিয়া চলমান থাকে না। বাবা যেহেতু ইলম ও মাদরাসাকে দিল থেকে আল্লাহর ওয়াস্তে মহব্বত করতেন এজন্য আল্লাহ তাআলা তার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত অর্ধ শতাব্দীকালের সদকায়ে জারিয়ার মহান এই ব্যবস্থাপনা তার ওফাতের পরও সুশৃঙ্খলভাবে চলমান রাখার জন্য তাঁর হায়াতেই গায়েবীভাবে ইন্তেযাম করে দিয়েছেন।

শুভ স্বপ্ন

১. দিন-তারিখ মনে নেই। বাবার ওফাতের পর তাঁকে স্বপ্নে দেখলাম। বললাম, বাবা আমি আপনার জন্য নামায পড়ে ঈসালে সওয়াব করেছি।

তিনি বললেন, তোমরা নিয়ত করার সাথে সাথেই আমাদের কাছে সওয়াব পৌঁছে যায়।

২. আরেকদিন স্বপ্নে দেখি। খেড়িহর মাদরাসার পুরোনো ভবনের পশ্চিম পাশে ৯/১০ নং কামরায় একটি চেয়ারে বসে নিচের দিকে তাকিয়ে তিনি কুরআন হাতে নিয়ে বসে আছেন। একজন কম বয়সের ছাত্র দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকে কুরআন শোনাচ্ছে। স্বপ্নে আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে বাবা মারা গেছেন। শুধু এতটুকু মনে ছিল, তিনি অসুস্থ। সে কারণে তাকে দেখতে গিয়েছি। এজন্য আশপাশের লোকদেরকে বললাম, আমি তার সাথে দেখা করতে এসেছি, তিনি কথা বলেন না কেন?

তারা বলল, তিনি এখন শুধু কুরআন তিলাওয়াত শুনতে পারেন। এছাড়া তিনি অন্য কথা বলেন না।

তখন আমার মনে হল, তিনি তো মারা গেছেন। মেঝো ভাইজানকে (হযরত মাওলানা আবদুল মালেক ছাহেব দা. বা.) মোবাইলে স্বপ্নের কথা জানালাম।

তিনি বললেন, এটি খুব ভালো স্বপ্ন।

৩. বাবার ওফাতের কয়েক মাস পর সৌভাগ্যবশত আমার দীর্ঘদিনের কাক্সিক্ষত পবিত্র ওমরার সফর নসীব হল। সেখানে তাওয়াফ করে বাবার জন্য ঈসালে সওয়াব করলাম। হোটেলে এসে ঘুমালাম। স্বপ্নে দেখি, তিনি সাদা সুন্নতী লেবাস পরে স্বভাবজাত মুচকি হাসি দিয়ে মায়াবী চেহারায় আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।

সর্বশেষ সাক্ষাৎ ও অন্তিম সময়ের কিছু হালাত

১. বাবার ওফাতের কয়েক মাস পূর্বের কথা। সম্ভবত মুহাররম মাসের শুরুর দিক হবে। আম্মা ফোনে বললেন, তোমার বাবার খবর নিয়ো। তিনি শাহরাস্তি হাসপাতালে ভর্তি।

বড় ভাইজান তখন ওমরায়। আমি খুব দ্রুত চলে গেলাম। গিয়ে দেখি, তিনি কিছুটা স্বস্তিতে আছেন। এত দূর থেকে আমি তাঁকে দেখতে গিয়েছি বলে সীমাহীন খুশি হলেন। অনেক খোশ আলাপ করলেন। কিছুক্ষণ আমাকে ধরে ধরে কথা বললেন। অতীত জীবনের কোনো কোনো দুঃখ-বেদনার কথাও বললেন। এভাবে বিকাল হয়ে গেল। আমি বিদায় চেয়ে দুআর জন্য মাথা বাড়িয়ে দিলাম। তিনি বললেন, রাখ! এই বলে আমাকে ধরে ধরে হেঁটে হেঁটে মাদরাসার বড় গেইট পর্যন্ত চলে এলেন। এসে আমাকে খুব দুআ দিলেন। পরে বললেন, গাড়িতে ওঠ।

যতক্ষণ গাড়ি দেখা যাচ্ছিল, পুরো সময় দাঁড়িয়ে ছিলেন। বাবার আজকের দিনের এ আচরণগুলো ছিল তার সাধারণ অভ্যাসের খেলাফ। তাঁর মধ্যে জালাল প্রবল থাকায় তিনি সাধারণত এমন আচরণ কারো সাথে করতেন না। এ কারণে আমার মনে খটকা লাগল, বোধহয় এটাই তাঁর সাথে আমার শেষ দেখা! পরে তো হলও তাই। এরপর আরো দুইবার দেখা হলেও তা না দেখার মতই। এই সফরে তিনি আমাকে এ-ও বলেছেন, এত টাকায় গাড়ি ভাড়া করে ময়মনসিংহ থেকে কেন এসেছ? তোমার অনেক কষ্ট হয়েছে।

আমি বললাম, কুমিল্লার হাফেজ মাওলানা রাশেদের বাবা এই গাড়ি ভাড়া করে দিয়েছেন। এটা শুনে  তাঁদের জন্য খুব দুআ করলেন।

২. ওফাতের দিন জবানে কিছুটা জড়তা এসে গিয়েছিল। কথা বলতে পারতেন কিন্তু বোঝা যেত না। বাবা যখন বুঝলেন আমরা তার কথা বুঝি না তখন তিনি কথা বলা বন্ধ করে নীরব হয়ে গেলেন। শ্বাস-প্রশ্বাসে খুব কষ্ট হচ্ছিল। এই অবস্থায়ও বিছানায় স্থির থাকতেন। বারবার উপরের দিকে দেখাতেন। আবার কখনো মাদরাসার দিকে দেখাতেন। কোনোভাবেই চাচ্ছিলেন না যে তিনি হাসপাতালে থাকবেন আর এই অবস্থায় তার মৃত্যু হবে। মাগরিবের কিছুক্ষণ পর তার শেখানো কিছু দুআ পড়ে আমি তাকে দম করলাম। তিনি তাকিয়ে রইলেন। চেহারায় হাসি হাসি ভাব। মাঝে তার যবানের কাছে কান লাগিয়ে মনে হল তিনি খুব ক্ষীণ আওয়াজে বলছেন, আল্লাহ আমাকে মাফ করে দেন। এর কিছুক্ষণ পর থেকে বারবারই হাত দিয়ে নিজের পরিহিত লুঙ্গিটি ঠিক করছিলেন। যেমনটা কোনো মেহমান দেখলে কেউ নিজের শরীর ঠিকঠাক করে থাকে। আমি তখন বলতাম, বাবা আপনার লুঙ্গি ঠিক আছে। তখন হাত স্বাভাবিক করে নিতেন।

কিন্তু তখনও একটু পর পর কাপড় দুরস্ত করার আমলটি চলছিল। আর আমরা বলছিলাম, না আপনার কাপড় ঠিক আছে।

এরমধ্যে একবার উপরের দিকে হাত উঠিয়ে কী যেন বললেন। আমরা বললাম, কেউ নেই। আসলে আমরা ব্যাপারটা কেউই বুঝতে পারিনি। তখনই তার চলছিল পরজগতে যাওয়ার প্রারম্ভিক অবস্থা। সর্ব হালতেই তার যবান ছিল নীরব, দেহ খুব শান্ত ও স্থির। তবে কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস নিতে হচ্ছিল, শুধু সে কষ্টটাই কেবল তার জন্য অসম্ভব পীড়াদায়ক ছিল। তিনি আজীবন যেমন ছিলেন গম্ভীর প্রকৃতির, ওফাতের সময়ও তেমনই ছিলেন। এভাবে একপর্যায়ে তিনি তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন। কিছুক্ষণ পর তার শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। পৃথিবী থেকে বিদায় নিল শতাব্দীকালের কাছাকাছি সময় দ্বীনের জন্য নিজেকে বিলীন করা এক সহজ সরল সাদামাটা মুখলিস মানুষ।

বাবার আশা পূর্ণ হয়েছে

এখন মনে পড়ে, অনেক আগে একদিন দেখি, বাবা অস্থির হয়ে শুয়ে আছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোনো সমস্যা বাবা!

তিনি বললেন, মরার পর কবর দুই দিক থেকে মানুষকে চাপ দেয়। একদিকের হাড় আরেক দিকে চলে যায়।

আমি বললাম, আমলওয়ালা ঈমানদারদেরও এই অবস্থা হবে?

তিনি বললেন, ‘বেকেরে (সকলকে) চাপ দিব, কাউরে জোরে কাউরে আস্তে। পাক সাফ করব।

আমি বললাম, মরার আগে জোরে জোরে কালেমা পড়লে আল্লাহ মানুষকে জান্নাত দেবেন না?

তিনি বললেন, জোরে জোরে কালিমা পড়ার দরকার কী? সারা জীবন ঈমানের উপর চলে, দিলের ভেতর ঈমান পোষণ করে আল্লাহর কাছে চলে যেতে পারলেই তো ভালো।

বাবার উদ্দেশ্য ছিল, সারা জীবন ঈমানের উপর থাকলে মৃত্যুর আগে শব্দ করে কালিমা পড়া সম্ভব না হলেও কোনো সমস্যা নেই। ভেতরটা ঈমান দ্বারা পরিপূর্ণ থাকা আসল কথা। আমি বলব, তিনি যেমন চাইতেন তেমনই তাঁর মৃত্যু হয়েছে।

তিনি ছিলেন আমলী মুত্তাকী। আমলী তাকওয়ার উপরই তার মৃত্যু হয়েছে।

গোসল ও জানাযা প্রসঙ্গে

রাত প্রায় বারোটা। আম্মাকে আমরা ফোন করিনি। কিন্তু তাঁর মনে খবর হয়ে গেছে। তিনি নিজেই ফোন করলেনতোমার বাবাকে বাড়িতে আনার প্রয়োজন নাই। আমার দেখতে হবে না। সরাসরি মাদরাসায় নিয়ে গোসল-কাফনের ইন্তেযাম করে তাড়াতাড়ি জানাযার ব্যবস্থা করো।

কমপক্ষে এই যুগে এমন কথা অনেক উঁচু ঈমানের আলামত। এদিকে বড় ভাইজান কাঁদতে কাঁদতে অস্থির। কথা বলার শক্তি নেই। আমার ভাতিজা আইয়ূবী জড়িয়ে ধরে তাকে সামলে রাখার চেষ্টা করছিলেন। আর কাঁদবেন না কেন? কাঁদার হক তিনিই রাখেন। পুরো জীবন বাবার সবচেয়ে বেশি খেদমত তিনিই করেছেন। তিনি ছিলেন যেমন সংসারের বড়, তাঁর খেদমতও ছিল বড়।

মেঝো ভাইজানকে আমি ফোন করলাম। তিনি বললেন, এখনই গোসলের কাজ সেরে ফেল।

আমি বললাম, কে গোসল দেবে?

তিনি জানতে চাইলেন, কারা কারা আছে? আমি নাম বললাম।

তিনি কয়েকজনের নাম বলে দিলেন। বিশেষ করে মারকাযের মাওলানা আনোয়ার ছাহেবের নাম বললেন। সাথে আমার নামও যুক্ত করলেন। পরে বললেন, জানাযা কখন দিতে চাও?

আমি বললাম, খেড়িহরের নায়েব সাহেব চাচ্ছেন যোহরের পর জানাযা হোক।

তিনি খুব বিরক্তির সাথে বললেন, দেরি হয়ে যায়, আরো আগে জানাযা হোক।

ব্যস! আমরা গোসলের পরিকল্পনা শুরু করলাম। খিদমাহ হসপিটালেই তারা গোসলের ইন্তেযাম করে দিল। মাওলানা আনোয়ার ভাই গোসল সম্পাদনকারীদের নেগরানের ভূমিকা পালন করেছেন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফিকহি কিতাবের নুসুস শুনাচ্ছিলেন আর সুন্নত তরীকায় গোসলের নিয়ম সবার সামনে বারবার মুজাকারা করছিলেন।

গোসলের কাজ শুরু হয়ে গেল। যারা আঞ্জাম দিচ্ছিল তারা হল আমার প্রিয় ভাতিজা নূরুল্লাহ, প্রিয় শাগরেদ মাসউদ, তাদের সাথে নামে মাত্র আমিসহ আরো কয়েকজন। এরপর যথারীতি কাফন পরানো হল। সাথে সাথেই খেড়িহর রওয়ানা। পৌঁছতে পৌঁছতে ফজরের সময় হয়ে গেল। বাবাকে রাখা হল মাদরাসার বারান্দায়। আনুমানিক সকাল ১১টার দিকে ঢাকা থেকে এসে হাজির হল আমার প্রিয় ভাগিনা হাফেজ মাওলানা আবদুর রাকীব। সে বাবাকে দেখে এসে খুব কাঁদছিল। আমি বাবাকে দেখতে গেলাম। গিয়ে দেখি রাতের চেহারা আর এখনকার চেহারায় কোনো মিল নেই। চোয়াল ভাঙ্গা চেহারা এখন পরিপূর্ণ। মুখে এখন ফুটন্ত হাসি। মনে হচ্ছিল কোনো আপনজনকে দেখে মুচকি হাসছেন।

লাশ যখন কবরে রাখা হচ্ছিল তখন অসতর্কতায় তার চেহারা থেকে কাপড় সরে গেল, দেখা গেল চেহারার হাসি বেড়েই চলেছে। মাদরাসার নায়েব সাহেব বলেন, আমি তখন কবরে মাত্র নামলাম, চেহারার এমন নূরানিয়্যাত দেখে আমার হাত আর কাজ করছিল না। আমি কিছুক্ষণ নীরব হয়ে গেলাম। এসময় আম্মা অবস্থান করছিলেন বাড়িতে। দাফনস্থল থেকে আট-দশ কিলোমিটার দূরে। আম্মা বলেন, সেসময় আমার কানে তোমার বাবার কণ্ঠে একটি আওয়াজ ভেসে এল, তিনি বলছেন, আমার রব আল্লাহ, আমার দ্বীন ইসলাম, আমার নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

গায়েবের মালিক আল্লাহ। স্বপ্ন ও কাশফে গায়েবী আওয়াজ কোনো কিছুই শরীয়তের দলীল নয়। আমরা শুধু আল্লাহর রহমতের আশাই করতে পারি। মেহেরবান আল্লাহ মরহুমকে পূর্ণ মাগফিরাত দান করেন। তাঁর কবরকে জান্নাতের বাগিচা বানিয়ে দেন- আমীন।

 

 

advertisement