কুরবানী আদায়ে যেসব ভুল-ত্রুটি হতে দেখা যায়
ইবাদত সহীহ ও কবুল হওয়ার জন্য দুটি শর্ত রয়েছে। একটি হল, সহীহ-শুদ্ধভাবে ইখলাসের সাথে নিয়ত করা এবং দ্বিতীয়টি হল, শরীয়তে নিধার্রিত নিয়মনীতি অনুযায়ী করা। কুরবানীর ক্ষেত্রেও এ দুটি শর্ত সমানভাবে প্রযোজ্য। সুতরাং কেউ যদি নিয়ত সহীহভাবে করল কিন্তু শরয়ী তরীকা ও বিধান অনুযায়ী কাজটি সম্পাদন করল না তাহলে সেটি ইবাদত বলে গণ্য হবে না। যেমনিভাবে নিয়ত উল্টো হলেও তা ইবাদত গণ্য হয় না।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, (তরজমা) “এগুলোর গোস্ত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না। তাঁর কাছে পৌঁছায় তোমাদের মনের তাকওয়া” -সূরা হজ্ব ৩৭
এখানে প্রথম শর্তের বর্ণনা এসেছে। আর দ্বিতীয় শর্তটির বর্ণনা রয়েছে হাদীস গ্রন্থসমূহের কুরবানী অধ্যায়ে এবং কুরআন-সুন্নাহর আলোকে রচিত ফিকহের গ্রন্থাদিতে।
শর্তদুটির প্রথমটি যেহেতু অন্তরের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাই সেটির ভুলত্রুটি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। দ্বিতীয় শর্তটি কর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ায় প্রয়োগের ক্ষেত্রে এর অনিয়ম ও ভুলত্রুটিগুলো সহজেই ধরা পড়ে।
আমাদের সমাজে সাধারণত কুরবানী আদায়ে যেসকল ভুলত্রুটি বেশি বেশি ঘটে থাকে নিম্নে সেগুলোর উপর কিছু আলোকপাত করতে চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। যেন আসন্ন কুরবানীসহ পরবতীর্তে ওইসকল ভুলের শিকার আমরা না হই। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশনা অনুযায়ী এই ইবাদতটি পালন করে আমরা সকলেই যেন এর ফযীলত ও উত্তম প্রতিদান পেয়ে ধন্য হই- আমীন।
কুরবানী ওয়াজিব হওয়া না-হওয়া বিষয়ক ভ্রান্তি
কুরবানীর নেসাব
অনেকে মনে করেন, যাকাত ফরয হওয়ার জন্য যে ধরনের সম্পদ জরুরি যেমন, টাকা-পয়সা, সোনা-রুপা, ব্যবসায়িক সম্পদ, তেমনি কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার জন্যও একই শর্ত। ফলে কোন কোন সচ্ছল পরিবারের লোকজনকেও কুরবানী দিতে দেখা যায় না। এটি ভুল ধারণা। সঠিক মাসআলা হল, যে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির নিকট কুরবানীর দিনগুলোতে সাড়ে ৫২ তোলা রুপার মূল্য পরিমাণ প্রয়োজনের অতিরিক্ত যেকোন ধরনের সম্পদ থাকবে তার উপরই কুরবানী ওয়াজিব। প্রয়োজনের অতিরিক্ত জমি, সৌখিন বা অপ্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, তা ব্যবহৃত হোক বা না হোক, এসব কিছুও কুরবানীর নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য। কিন্তু যাকাতের বেলায় এগুলো ধর্তব্য হয় না। তাই টাকা-পয়সা, সোনা-চাঁদি ও ব্যবসায়িক সম্পদ না থাকলেও প্রয়োজনের অতিরিক্ত ধনসম্পদ, আসবাবপত্রের মূল্য নেসাব পরিমাণ হলেই কুরবানী ওয়াজিব হবে। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৬; রদ্দুল মুহতার ৬/৩১২; আলমগীরী ৫/২৯২
কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার সময়
শুধু যিলহজ্বের ১০ তারিখে কুরবানীর নেসাব পরিমাণ সম্পদ না থাকলে কুরবানী ওয়াজিব হবে না বলে ধারণা করা হয়। ফলে যিলহজ্বের ১১ বা ১২ তারিখে কারো কাছে হঠাৎ কোনভাবে নেসাব পরিমাণ সম্পদ আসলে সে আর কুরবানী করে না। যেমন, যে অবিবাহিত মেয়ের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয় কুরবানীর পরদিন তথা যিলহজ্বের ১১ তারিখে তার বিয়ে হল, সেদিন স্বামী তাকে স্বর্ণ, টাকা-পয়সা ইত্যাদি দিলে, যা সাড়ে ৫২ তোলা রুপার সমপরিমাণ বা তার চেয়েও বেশি। তখন সে এই ভেবে কুরবানী করে না যে, কুরবানীর দিন তো অতিবাহিত হয়ে গেছে। এধারণা ভুল। মাসআলা হল, যিলহজ্বের ১০ তারিখ সুবহে সাদিক থেকে ১২ তারিখ সূযার্স্ত পর্যন্ত মোট তিন দিন কুরবানী করা যায়। এ তিন দিনের মধ্যে যেকোন সময় কেউ নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে তাকেই কুরবানী দিতে হবে। -নসবুররায়া ৪/২১২-২১৩; বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৮; আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৮; আলমগীরী ৫/২৯৫
নিজের ওয়াজিব কুরবানী না দিয়ে মা-বাবার কুরবানী দেওয়া
ছেলে প্রতিষ্ঠিত হলে যখন মা-বাবা বার্ধক্যে পৌঁছে যায় এবং তাদের উপার্জন বন্ধ হয়ে যায় তখন ছেলে কেবল তাদের পক্ষ থেকে কুরবানী দেয়। অথচ তার নিজের উপরও কুরবানী ওয়াজিব। সে নিজের ওয়াজিব কুরবানী আদায় না করে মা-বাবার কুরবানী দেয় এবং মনে করে, এর দ্বারা তার দায়িত্ব আদায় হয়ে গেছে। এটি ভুল। ছেলের উপর কুরবানী ওয়াজিব হয়ে থাকলে নিজের কুরবানী অবশ্যই দিতে হবে। এরপর যদি সামর্থ্যে কুলায় তাহলে ইচ্ছা হলে মা-বাবার পক্ষ থেকেও ভিন্ন কুরবানী দিতে পারবে। অবশ্য কেউ নিজের ওয়াজিব কুরবানী আদায়ের ক্ষেত্রে মা-বাবাকে সওয়াব পৌঁছানোর নিয়ত করলে তার ওয়াজিব কুরবানী আদায় হয়ে যাবে এবং মা-বাবাও সওয়াব পেয়ে যাবেন।
যৌথ পরিবারে শুধু কর্তার কুরবানী
যৌথ পরিবারে অনেক ক্ষেত্রে একাধিক উপার্জনকারী ব্যক্তি থাকে। যাদের প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন মালিকানাধীন সম্পদ রয়েছে। কিন্তু যৌথ পরিবার বিধায় শুধু পরিবারের কর্তার কুরবানীই দেওয়া হয়। প্রত্যেক উপার্জনকারীর কুরবানী দেওয়া হয় না। এটা ভুল। যৌথ পরিবার হোক বা ভিন্ন পরিবার হোক প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলেই তার উপর কুরবানী ওয়াজিব। যৌথ পরিবারের কর্তার কুরবানী দিলে তা পরিবারস্থ সকলের জন্য যথেষ্ট হবে না।
কুরবানীর পশু ক্রয় ও শরিক নিয়ে বিভ্রান্তি
অধিক মূল্যের বা সবচেয়ে বড় পশু ক্রয়ের প্রতিযোগিতা
আজকাল বিত্তবান লোকদের মধ্যে কে কত বেশি মূল্যের পশু কিনতে পারে কিংবা কার কুরবানীর পশু কত বড় এ নিয়ে প্রতিযোগিতা হয়। এমনকি পার্শ্ববতীর্ দেশ থেকে উট কেনার প্রতিযোগিতা এবং পত্রপত্রিকায় ফলাও করে নাম ছাপা হতেও দেখা যায়। কোন কোন সময় এধরনের নজরকাড়া পশু এলাকায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে প্রদর্শন করা হয়। এসব হল চরম মুর্খতা। কুরবানী কোন আনুষ্ঠানিকতা নয়; বরং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। ইবাদতের জন্য প্রথম শর্ত হল ‘এখলাস’ তথা একমাত্র আল্লাহ তাআলার জন্য করা। নিজের বড়ত্ব প্রকাশ, লোকের বাহবা পাওয়া, লোকদেখানো মনোভাব ইত্যাদি থাকলে ওই ইবাদত কবুল হবে না।
অবশ্য একথা কারো অজানা নয় যে, কুরবানীর পশু যত বড় হবে এবং যত ভাল হবে তত বেশি নেকী হবে। যদি তা হয় কেবল আল্লাহ তাআলাকে রাজিখুশি করার নিয়তে।
কুরবানী দেওয়ার নিয়তে পশু কিনে পরে শরিক নেওয়া
যদি শরিকে কুরবানী করতে হয়, তাহলে পশু ক্রয় করার আগেই শরিক নির্ধারণ করে নেওয়া উত্তম। যদি এটা সম্ভব না হয় তাহলে অন্তত ক্রয়ের সময় অন্য শরিক অন্তভুর্ক্তির নিয়ত করে নিবে। পরে কোনো শরিক পাওয়া গেলে তাকে অন্তর্ভুক্ত করে নিতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু অনেক সময় এমন হয় যে, ক্রয়ের সময় একা কুরবানী করার জন্য পশু ক্রয় করে, অতপর কোনো কারণে অন্যকে শরিক করতে হয় এ অবস্থায় মাসআলা কী হবে তা অনেকেরই জানা নেই। তাই মাসআলাটি বিস্তারিত লেখা হল।
ক. পশু ক্রয়কারী ব্যক্তি যদি এমন হয় যার উপর কুরবানী ওয়াজিব, তো যদিও তার জন্য পরবতীর্তে কাউকে শরিক করার সুযোগ আছে, কিন্তু এমনটি না করাই উত্তম। করলে অন্যান্য শরিকদের অংশ পরিমাণ মূল্য সদকা করে দেওয়া উত্তম।
খ. যদি একা কুরবানী করার উদ্দেশ্যে পশু ক্রয়কারী ব্যক্তি এমন হয়, যার উপর কুরবানী ওয়াজিব ছিল না তো তার জন্য অন্য কাউকে ওই পশুর মধ্যে শরিক করা জায়েয নেই। কেননা যার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব নয় সে যদি কুরবানীর পশু ক্রয় করে এবং ক্রয়ের সময় অন্য কাউকে শরিক করার নিয়ত না থাকে তাহলে তার পুরো পশুটিই কুরবানী করা জরুরি। যদি মাসআলা না জানার কারণে বা অন্য কোনো কারণে দ্বিতীয় কাউকে শরিক করে নেয় তাহলে সে পরিমাণ মূল্য সদকা করে দেওয়া জরুরি। -কাযীখান ৩/৩৫০—৩৫১; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১০; রদ্দুল মুহতার ৬/৩১৭; তাহতাবী আলাদ্দুর ৪/১৬২
শরিক নির্বাচনে অসর্তকতা
শরিকে কুরবানী দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেককেই যাচাইবাছাই ছাড়া শরিক নিতে দেখা যায়। অধিকাংশ উপার্জন হারাম- এধরনের ব্যক্তিকেও শরিক নিয়ে নেওয়া হয়। অথচ এমন ব্যক্তিকে শরিক নিলে শরিকদের কারো কুরবানীই সহীহ হবে না। সুতরাং এ ব্যাপারে সর্তকতা অবলম্বন করা উচিত।
সাতের কম সংখ্যক শরিক
অনেকে মনে করেন সাতজনের কমে শরিক নেওয়া যায় না। মনে করা হয়, হয় একা কুরবানী করতে হবে। নতুবা শরিক নিতে হলে অবশ্যই সাতজন পূর্ণ করতে হবে। এ ধারণা ভুল। এমনিভাবে কেউ কেউ শরিক সংখ্যা বেজোড় হওয়া জরুরি মনে করে। এটিও ভুল। সাত বা সাতের কমে যেকোন সংখ্যক শরিক নেওয়া যেতে পারে।
ক্রটিযুক্ত কুরবানীর পশু
পশুর শিং ভাঙ্গা থাকা বা একেবারেই না থাকা
অনেকে মনে করেন, পশুর শিং অল্পস্বল্প ভাঙ্গা থাকলেই ওই পশু দ্বারা কুরবানী সহীহ হবে না। তদ্রূপ যে পশুর শিং উঠেনি সে পশু দ্বারাও কুরবানী হবে না। এ ধারণা ঠিক নয়। সহীহ মাসআলা হল, যে পশুর শিং একেবারেই গোড়া থেকে ভেঙ্গে গেছে যে কারণে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে পশুর কুরবানী জায়েয নেই। পক্ষান্তরে যে পশুর শিং আংশিক ভেঙ্গে গেছে বা শিং একেবারেই উঠেনি সে পশু দ্বারা কুরবানী করা জায়েয। -জামে তিরমিযী ১/২৭৬; সুনানে আবু দাউদ ৩৮৮; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৬; রদ্দুল মুহ্তার ৬/৩২৪; আলমগীরী ৫/২৯৭
অন্তঃসত্ত্বা পশুর কুরবানী
অনেকে অন্তঃসত্ত্বা পশুর কুরবানী না জায়েয মনে করে থাকে। অথচ এধারণা সহীহ নয়। এধরনের পশুর কুরবানী জায়েয। তবে বাচ্চা দেওয়ার সময় আসন্ন হলে সেটা কুরবানী করা মাকরূহ। -কাযী খান ৩/৩৫০; আলমগীরী ৫/৩০২
কুরবানীর পশু জবাই সম্পকীর্য় ভ্রান্তিসমূহ
হুজুরকে দিয়ে যবাই করানো জরুরি মনে করা
অনেকেই কুরবানীর পশু মসজিদের ইমাম বা হুজুরকে দিয়ে জবাই করানো জরুরি মনে করে। অথচ এটি ভুল ধারণা। কুরবানীদাতা জবাই করতে জানলে নিজেই জবাই করা উত্তম। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২৬৫৭; আলমগীরী ৫/৩০০; ইলাউস্ সুনান ১৭/২৭১-২৭৪; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২২
কুরবানীর আগে শরিকদের নাম পড়া
সাধারণত কুরবানীর আগে সকল শরিকের নাম বাপের নামসহ পড়াকে জরুরি মনে করে। ফলে অধিকাংশ জায়গায় পশুকে শুইয়ে বেঁধে জবাইয়ের জন্য পূর্ণ প্রস্তুত করার পরও জবাইকারীকে ওই নামের তালিকা পড়তে দেখা যায়। এ কাজটি নিতান্তই ভুল। শরিকদের নাম পড়া জরুরি নয়। এমনকি জবাইকারী শরিকদের কথা না জেনে জবাই করলেও সকল শরিকের কুরবানী আদায় হয়ে যাবে। কেননা কাদের কুরবানী করা হচ্ছে তা তো নির্দিষ্টই আছে। এখন জবাইয়ের মুহূর্তে নামের তালিকা উচ্চারণ করার কোন প্রয়োজন নেই। জবাইয়ের আগে এভাবে নাম উচ্চারণ করাটা সালাফ থেকে প্রমাণিত নয়। আর এমন অপ্রয়োজনীয় একটি কাজের জন্য পশুকে জবাইয়ের পূর্বে কতইনা কষ্ট দেওয়া হয়।
কসাই বা দ্বিতীয় ব্যক্তির জবাইয়ে সহযোগিতা করা
অনেক ক্ষেত্রে জবাইকারী জবাই করতে গিয়ে সমস্যায় পড়লে কসাই বা অন্য কেউ এসে ছুরি ধরে এবং বাকি জবাই পূর্ণ করে। কিন্তু এক্ষেত্রে দ্বিতীয় ব্যক্তিকে বিসমিল্লাহ বলতে শোনা যায় না। যদি প্রথম ব্যক্তির জবাই সম্পন্ন না হয় (অর্থাৎ দুই শাহ রগ, শ্বাস নালী ও খাদ্য নালী এ চারটির কমপক্ষে তিনটি কাটা না হয়) তাহলে দ্বিতীয় জনকে অবশ্যই বিসমিল্লাহ বলতে হবে। অন্যথায় জবাই অশুদ্ধ হয়ে যাব। ওই পশুর গোস্ত খাওয়া হালাল হবে না। -রদ্দুল মুহ্তার ৬/৩৩৪
ওজর ছাড়া ১১ বা ১২ তারিখে কুরবানী করা
সাধারণত যাদের একাধিক কুরবানী থাকে তাদেরকে ১০ তারিখে একটি এবং ১১ বা ১২ তারিখে অন্যটি কুরবানী করতে দেখা যায়। বিনা ওজরে এমন করা ঠিক নয়। বিনা ওজরে প্রথম দিন কুরবানী না করে পরে কুরবানী দেওয়া অনুত্তম। -মুআত্তা মালেক ১৮৮; বাদায়ে উস্সানায়ে ৪/১৯৮; আলমগীরী ৫/২৯৫
পশু ঠাণ্ডা হওয়ার আগে চামড়া ছিলা
অনেকেই পশু ঠাণ্ডা হওয়ার আগেই পায়ের রগ কাটা এবং চামড়া ছিলা শুরু করে। এতে পশু কষ্ট পায়। এটি মাকরূহ। পশুকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কষ্ট দেওয়াই গুনাহ্। -বাদায়েউসসানায়ে ৪/২২৩; আলমগীরী ৫/২৮৭
গোস্ত বণ্টন ও দান
গোস্ত ওজন না করা
অনেকে শরিকে কুরবানী দিলেও গোস্ত অনুমান করে বণ্টন করে থাকে। অথচ শুধু অনুমান করে গোস্ত বণ্টন করা নাজায়েয। -কাযী খান ৩/৩৫১; আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৭
গোস্ত ওজন করাকে সংকীর্ণতা ভাবা
অনেকে ওজন করে বণ্টন করাকে খুব অপছন্দ করে। এটাকে সংকীর্ণতা, বাড়াবাড়ি ইত্যাদি বলে কটাক্ষ করে। অথচ এটি শরীয়তের হুকুম। না জেনে এমন মন্তব্য করা ঠিক নয়।
তিন ভাগ করা জরুরি ভাবা
অনেকে কুরবানীর গোস্ত তিন ভাগ করে এক ভাগ নিজে রেখে, এক ভাগ আত্নীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও এক ভাগ ফকীর মিসকীনকে দেওয়া জরুরি মনে করেন। অথচ এভাবে বণ্টন করা জরুরি নয়, তবে উত্তম। কেউ এতে ত্রুটি করলে কোন গুনাহ হবে না এবং কুরবানীরও কোন ক্ষতি হবে না। কেউ কেউ পুরো পশুই ফ্রীজে ঢুকিয়ে রাখে, কিছুই দান করে না। এটাও ঠিক নয়, অনুত্তম। -সূরা হজ্ব ৩৬; বাদায়েউস্ সানায়ে ৪/২২৪; আলমগীরী ৫/৩০০
কুরবানীর গোস্ত বিধমীর্দের দেওয়া
অনেকে মনে করে, কুরবানীর গোস্ত হিন্দু বা বিধমীর্দেরকে দেওয়া জায়েয নেই। এধারণা ভুল। বিধমীর্দেরকেও কুরবানীর গোস্ত দান করা জায়েয। -ইলাউস্ সুনান ১৭/২৮৩; আলমগীরী ৫/৩০০
ভৃত্য ও কাজের লোকদেরকে কুরবানীর গোস্ত দেওয়া
অনেকে কর্মচারী ও কাজের লোকদেরকে কুরবানীর গোস্ত দেওয়া ও খাওয়ানোকে নাজায়েয মনে করে। অথচ তাদেরকে পারিশ্রমিক হিসাবে না দিয়ে হাদিয়া দিলে কোন অসুবিধা নেই এবং অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের মত এদেরকেও কুরবানীর গোস্ত দেওয়া উচিত। তবে তার নির্ধারিত পারিশ্রমিক থেকে ভিন্নভাবে দিতে হবে।
চর্বি বিক্রি
কুরবানীর পর ঢাকাসহ পুরো দেশে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কুরবানীর পশুর চর্বি কেনাবেচা হয়। অথচ কুরবানীর গোস্ত, চর্বি ইত্যাদি বিক্রি করা নাজায়েয। কেউ বিক্রি করলে পুরো টাকা মিসকীনদেরকে সদকা করে দেওয়া জরুরি। -ইলাউস্ সুনান ১৭/২৫৯; বাদায়েউস্ সানায়ে ৪/২২৫; কাযী খান ৩/৩৫৪; আলমগীরী ৫/৩০১
কুরবানী নিয়ে আরো কিছু ভ্রান্তি
কুরবানীর দিনগুলোতে অন্য পশু জবাই করা
অনেকের ধারণা, কুরবানীর তিন দিন কুরবানীর পশু ছাড়া অন্য কোন পশু জবাই করা যাবে না। এমনকি হাঁস-মুরগী বা গরু-ছাগলও নয়। এটি ভুল ধারণা। তবে কুরবানীর নিয়তে হাস, মুরগী ইত্যাদি (যেগুলো দ্বারা কুরবানী সহীহ নয়) জবাই করা ধনী-গরিব সকলের জন্যই নাজায়েয। গোস্তের প্রয়োজনে জবাই করতে কোন সমস্যা নেই। খুলাসাতুল ফাতওয়া ৪/৩১৪; বায্যাযিয়া ৬/২৯০; আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৩; আলমগীরী ৫/৩০০
আকীকা না দিলে কুরবানী
অনেকের ধারণা, আকীকা না দিলে কুরবানী দেওয়া যায় না। তাই অনেকে কুরবানীই করে না। আবার অনেকের উপর কুরবানী ওয়াজিব হওয়া সত্ত্বেও কুরবানী না দিয়ে আকীকা দেয়। অথচ এটি একেবারেই অমূলক। একটির সঙ্গে অপরটি শর্তযুক্ত নয়। তাই কোন কারণে আকীকা দেওয়া না হলেও ওয়াজিব কুরবানী অবশ্যই দিতে হবে।
অনাদায়ী কুরবানী
বিগত বছরের কুরবানী অনাদায়ী থাকলে অনেকেই পরবতীর্ বছর কুরবানী দিয়ে থাকে। অথচ এভাবে বিগত বছরের কুবানীর কাযা আদায় হয় না। এক্ষেত্রে নিয়ম হল, প্রতি বছরের কুরবানীর জন্য অন্তত কুরবানীর উপযুক্ত একটি ছাগলের মূল্য সাদকা করা। -খুলাসাতুল ফাতাওয়া ৪/৩১১; মাবসুতে সারাখসী ১২/১৪; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০২; আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩২০-৩২৯; ফাতহুল কাদীর ৮/৪৩২; মুলতাকাল আবহুর ৪/১৭০
হাজ্বী সাহেবের নামে কুরবানী
অনেক হাজ্বী সাহেব দেশে তার কুরবানীর ব্যবস্থা করে যান। এটাকে তারা জরুরি মনে করেন। অথচ হাজী সাহেব হজ্বের সফরে থাকার কারণে তার উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়। হাঁ এরপরও যদি কেউ নফল কুরবানী দিতে চায় তবে সেটার অবকাশ আছে। -....কাযী খান ৩/৩৪৪; বাদায়ে উস্ সানায়ে ৪/১৯৫; আদ্দুরূল মুখতার ৬/৩১৫
জবাইয়ের আগে চামড়া বিক্রি
অনেক সময় চামড়াক্রেতাদের পীড়াপীড়িতে পশু জবাইয়ের আগেই চামড়া বিক্রি করে ফেলে। এমনকি মূল্যও নিয়ে নেয়। এমনটি করা নাজায়েয। চামড়া ছিলার আগে বিক্রি করা জায়েয নয়। তাই প্রয়োজনে যবাইয়ের আগে বিক্রির ওয়াদা করা যেতে পারে, বিক্রি করা যাবে না। -আলমগীরী ৩/১২৮; আদ্দুররুল মুখতার ৫/৬৩