শাওয়ালের ছয় রোযা
রমযানের পরের মাস শাওয়াল। আর রমযানের আগের মাস হল শাবান। শাওয়াল ও শাবান হল রমযান সংশ্লিষ্ট ও রমযানের আগে-পরের মাস। তাই রমযানের সম্মানার্থে শাবান ও শাওয়াল মাস এবং এ দুই মাসে রোযা রাখার প্রতি যত্নবান হওয়া উচিত। বিশেষত শাওয়াল মাসে ছয়টি রোযা রাখার ব্যাপারে যত্নবান হওয়া চাই। কেননা হাদীস শরীফে এর প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। আবু আইয়ূব আনছারী রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَنْ صَامَ رَمَضَانَ ثُمّ أَتْبَعَهُ سِتّا مِنْ شَوّالٍ، كَانَ كَصِيَامِ الدّهْرِ.
যে মাহে রমযানের রোযা রাখল এরপর শাওয়ালে ছয়টি রোযা রাখল এটি তার জন্য সারা বছর রোযা রাখার সমতুল্য হবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬৪; জামে তিরমিযী, হাদীস ৭৫৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৪৩৩
রমযান মাস ও শাওয়ালের ছয় দিন রোযা রাখলে কীভাবে পুরো বছর রোযা রাখার সওয়াব হবে- এর বিবরণ এসেছে আরেক হাদীসে। ছাওবান রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
صِيَامُ شَهْرِ رَمَضَانَ بِعَشَرَةِ أَشْهُرٍ وَصِيَامُ سِتّةِ أَيّامٍ مِنْ شَوّالٍ بِشَهْرَيْنِ فَذَلِكَ صِيَامُ سَنَةٍ.
রমযান মাসে রোযা রাখা দশ মাস রোযা রাখার সমান এবং শাওয়ালে ছয় দিন রোযা রাখা দুই মাস রোযা রাখার সমান। সুতরাং রমযান ও ছয় রোযা মিলে এক বছরের রোযার সমান। -সুনানে কুবরা, নাসাঈ, হাদীস ২৮৭৩; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস ২১১৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২৪১২; সুনানে কুবরা, বায়হাকী ৪/২৯৩
হাদীসটির আরেক বর্ণনায় এসেছে-
جَعَلَ اللهُ الْحَسَنَةَ بِعَشْرٍ فَشَهْرٌ بِعَشَرَةِ أَشْهُرٍ وَسِتّةُ أَيَّامٍ بَعْدَ الْفِطْرِ تَمَامُ السّنَةِ.
আল্লাহ তাআলা এক নেকীকে দশ নেকির সমান করেছেন। সুতরাং (রমযানের) এক মাস (রোযা রাখা) দশ মাসের সমান। আর সাথে ঈদুল ফিতরের পরে ছয় দিন রোযা রাখা সারা বছর রোযা রাখার সমান। -সুনানে নাসাঈ, হাদীস ২৮৭৪
আল্লাহ এক নেকীতে দশ নেকীর সওয়াব দান করেন। এক দিনের রোযা দশ দিনের সমান, তিন দিনের রোযা এক মাসের সমান। ছয় দিনের রোযা দুই মাসের সমান। আর এক মাসের রোযা দশ মাসের সমান। সুতরাং যে রমযানের এক মাস ও শাওয়ালের ছয় দিন রোযা রাখবে সে এক বছরের সমান সওয়াব পাবে।
রমযানের রোযা কবুল হওয়ার আলামত
শাওয়ালের রোযার একটি ফযীলত হল, এই রোযা রমযানের রোযা কবুল হওয়ার একটি আলামত। রমযান মাসের রোযা রাখার পর শাওয়াল মাসে কিছু রোযা রাখা একথার আলামত যে, আল্লাহ তাআলার দরবারে রমযানের রোযা কবুল হয়েছে। কেননা আল্লাহ তাআলা যখন বান্দার কোনো আমল কবুল করেন তখন অন্য একটি নেক আমলের তাওফীক দান করেন।
قَالَ مَنْ قَالَ مِنْ السّلَفِ كَسَعِيدِ بْنِ جُبَيْرٍ: إنّ مِنْ ثَوَابِ الْحَسَنَةِ الْحَسَنَةُ بَعْدَهَا وَإِنّ مِنْ عُقُوبَةِ السّيِّئَةِ السّيِّئَةُ بَعْدَهَا.
সাঈদ ইবনে জুবায়ের রাহ. ও আরো কোনো কোনো সালাফের বক্তব্য হল, নেক আমলের প্রতিদান হচ্ছে, এর পর আরো নেক আমলের তাওফীক পাওয়া। আর গোনাহের শাস্তি হল, এর পর আরো গোনাহে লিপ্ত হওয়া। -মাজমূউল ফাতাওয়া, ইবনে তাইমিয়া ১০/১১
সালাফের এই কথার সমর্থন কুরআন মাজীদেই বিদ্যমান। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَ الَّذِیْنَ اهْتَدَوْا زَادَهُمْ هُدًی وَّ اٰتٰىهُمْ تَقْوٰىهُمْ.
যারা হেদায়েতের পথ অবলম্বন করেছে, আল্লাহ তাদেরকে হেদায়েতে উৎকর্ষ দিয়েছেন এবং তাদেরকে দান করেছেন তাদের (প্রয়োজনীয়) তাকওয়া। -সূরা মুহাম্মাদ (৪৭) : ১৭
আয়াতে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, হেদায়েত ও নেক আমলের পথে চললে আল্লাহ তাআলা তাকে আরো বেশি তাকওয়া ও হেদায়েতের তাওফীক দান করেন।
হাদীস শরীফেও অনুরূপ এসেছে। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
عَلَيْكُمْ بِالصِّدْقِ، فَإِنّ الصِّدْقَ يَهْدِي إِلَى الْبِرِّ، وَإِنّ الْبِرّ يَهْدِي إِلَى الْجَنّةِ، وَمَا يَزَالُ الرّجُلُ يَصْدُقُ وَيَتَحَرّى الصِّدْقَ حَتّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللهِ صِدِّيقًا، وَإِيّاكُمْ وَالْكَذِبَ، فَإِنّ الْكَذِبَ يَهْدِي إِلَى الْفُجُورِ، وَإِنّ الْفُجُورَ يَهْدِي إِلَى النّارِ، وَمَا يَزَالُ الرّجُلُ يَكْذِبُ وَيَتَحَرّى الْكَذِبَ حَتّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللهِ كَذّابًا.
তোমরা সত্যকে আঁকড়ে ধর। কেননা সত্য আনুগত্যের দিকে নিয়ে যায়। আর আনুগত্য জান্নাত পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। মানুষ সত্য বলতে থাকে এবং সত্যের জন্য চেষ্টা করতে। এক পর্যায়ে আল্লাহর নিকট তার নাম লেখা হয় ‘ছিদ্দীক’।
তোমরা মিথ্যা থেকে দূরে থাক। কেননা, মিথ্যা পাপের পথে নিয়ে যায়। আর পাপ জাহান্নাম পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। মানুষ মিথ্যা বলতে থাকে এবং মিথ্যার জন্য চেষ্টা করতে থাকে। একসময় আল্লাহর নিকট তার নাম লেখা হয় ‘কায্যাব’। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬০৭; সহীহ বুখারী, হাদীস ৬০৯৪
হাদীসের মধ্যে এসেছে, সত্য বলার আমল আরো অনেক নেক আমলের মাধ্যম হয়। যেমনভাবে মিথ্যা আরো গোনাহের দিকে নিয়ে চলে।
উল্লিখিত আয়াত ও হাদীস থেকে জানা যায়, মানুষ যখন কোনো ভালো আমল করে তার জন্য আরো অনেক ভালো আমল করা সহজ হয়ে যায়। সুতরাং একটি ভালো আমলের পর আরেকটি ভালো আমলের তাওফীক হওয়া একথার অলামত যে, পূর্বের ভালো আমলটি আল্লাহ কবুল করেছেন। তাই তাকে আরো কিছু আমলের তাওফীক দান করেছেন। অতএব রমযান মাসের পর শাওয়াল মাসে রোযা রাখা এ কথার একটি দলীল যে, তার রমযানের রোযা আল্লাহ তাআলা কবুল করেছেন।
রমযানের রোযার শুকরিয়া
আল্লাহ তাআলা যখন কোনো নিআমত দান করেন, এর দাবি হল আল্লাহর জন্য কিছু ইবাদত করা। বিশেষ করে গোনাহমাফের শোকরস্বরূপ ইবাদত-বন্দেগি বাড়িয়ে দেওয়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমল দ্বারা প্রমাণিত। তিনি রাতের বেলা নামাযের মধ্যে এত দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেন যে, তাঁর পা মোবারক ফুলে যেত। আয়েশা রা. জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কেন এত কষ্ট করেন, আপনার তো আগে-পরের সব গোনাহ আল্লাহ মাফ করে দিয়েছেন?
তিনি উত্তর দিয়েছেন-
أَفَلاَ أُحِبّ أَنْ أَكُونَ عَبْدًا شَكُورًا.
আমার কি মন চায় না, আমি শোকরগুযার বান্দা হব? -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৮৩৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৮২০
রমযানের রোযা, রমযানের তারাবী ও অন্যান্য আমল মুমিন বান্দার গোনাহ মিটিয়ে দিয়েছে সুতরাং গোনাহমাফ ও অন্যান্য নিআমতের দাবি হল রমযানের রোযার পর আরো কিছু রোযা রাখা। এটাই হল, এসব নিআমতের শুকরিয়া। সুতরাং আসুন, রমযানের রোযা ও অন্যান্য ইবাদতের শোকরস্বরূপ শাওয়াল মাসে কিছু রোযা রাখি। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন।