ঈদ ও কুরবানী
ইসলামের সকল ইবাদতের মতো ঈদও আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে নির্দেশিত। ঈদুল আযহা সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. থেকে বর্ণিত এক হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
أمرت بيوم الأضحى عيدا جعله الله لهذه الأمة قال له رجل : يا رسول الله! أن لم أجد إلا منيحة أنثى أفأضحي بها؟ قال : لا، ولكن خذ من شعرك وأظفارك ونقص شاربك وتحلق عانتك فذلك تمام أضحيتك عند الله.
‘আমাকে কুরবানীর দিবসে ঈদ (উদযাপনের) আদেশ করা হয়েছে। আল্লাহ তা এ উম্মতের জন্য নির্ধারণ করেছেন।’ এক সাহাবী আরজ করলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! যদি আমার কাছে শুধু একটি ‘মানীহা’ থাকে (অর্থাৎ যা আমাকে শুধু দুধ পানের জন্য দেওয়া হয়েছে) আমি কি তা কুরবানী করতে পারি? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘না। তবে তুমি চুল, নখ ও মোঁচ কাটবে এবং নাভীর নিচের পশম পরিষ্কার করবে। এটাই আল্লাহর দরবারে তোমার পূর্ণ কুরবানী বলে গণ্য হবে।-সুনানে আবু দাউদ ২/৩৮৫; সুনানে নাসায়ী ২/১৭৯
‘মানীহা’ হচ্ছে, যে পশু কাউকে দুধ পান করার জন্য বা অন্য কোনো কাজে ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়।
কুরবানীর পশু
আনাস ইবনে মালিক রা. বলেন-
ضى رسول الله صلى ا لله عليه وسلم بكبشين أملحين فرأيته واضعا قدمه على صفاحهما، يسمي ويكبر، فذبحهما بيده.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু’টি সাদা-কালো বর্ণের (বড় শিং বিশিষ্ট) নর দুম্বা কুরবানী করেছেন। আমি দেখেছি, তিনি দুম্বা দু’টির গর্দানে পা রেখে বিসমিল্লাহি ওয়াল্লাহু আকবার বললেন। অতঃপর নিজ হাতে যবেহ করলেন।-সহীহ বুখারী ২/৮৩৪; সহীহ মুসলিম ২/১৫৫-১৫৬
عن جابر رضي الله عنه في حديث طويل ... ثم انصرف (النبي صلى الله عليه وسلم) إلى المنحر فنحر ثلثا وستين بدنة بيده.
হযরত জাবির রা. থেকে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদীসে আছে, ‘অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর স্থানে এলেন এবং নিজ হাতে তেষট্টিটি উট নাহর করলেন।-সহীহ মুসলিম ১/৩৯৪; সুনানে আবু দাউদ ১/২৬২
হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত-
وضحى رسول الله صلى الله عليه وسلم عن نساءه بالبقر
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর স্ত্রীদের পক্ষ হতে গরু দ্বারা কুরবানী করেছেন।-সহীহ বুখারী ২/৮৩৪; ১/২৩১
গরু দ্বারা কুরবানীর বিষয়টি হযরত জাবির রা.-এর সূত্রেও বর্ণিত হয়েছে। দেখুন : সহীহ মুসলিম ১/৪২৪
গরু ও উটে সাত শরীক হতে পারে
জাবির রা. বলেন-
خرجنا مع رسول الله صلى الله عليه وسلم مهلين بالحج، فأمرنا رسول الله صلى الله عليه وسلم أن نشترك في الإبل والبقر، كل سبعة منا في بدنة.
আমরা হজ্বের ইহরাম বেঁধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে বের হলাম। তিনি আমাদেরকে আদেশ করলেন যেন প্রতিটি উট ও গরুতে সাতজন করে শরীক হয়ে কুরবানী করি।-সহীহ মুসলিম ১/৪২৪
অন্য বর্ণনায় আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
البقر عن سبعة والجزور عن سبعة.
(একটি) গরু সাতজনের পক্ষ হতে এবং (একটি) উট সাত জনের পক্ষ হতে (কুরবানী করা যায়)।-আবু দাউদ ২/৩৮৮
কুরবানীর পশুর বয়স
জাবির রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
لا تذبحوا إلا مسنة، إلا أن يعسر عليكم فتذبحوا جذعة من الضأن.
তোমরা (কুরবানীতে) ‘মুছিন্না’ ছাড়া যবেহ করবে না। তবে সংকটের অবস্থায় ছ’মাস বয়সী ভেড়া-দুম্বা যবেহ করতে পারবে।’-সহীহ মুসলিম ২/১৫৫
কুরবানীর উট অন-ত পাঁচ বছর বয়সী হতে হবে। গরু, মহিষ দুই বছর এবং ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা এক বছর হতে হবে। ভেড়া ও দুম্বার ক্ষেত্রে উপরোক্ত হাদীস থেকে জানা গেল যে, তা ছয় মাসের হলেও চলবে।
যে ধরনের পশু দ্বারা কুরবানী হয় না
হযরত বারা ইবনে আযিব রা. কুরবানীর পশু সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন-
أشار رسول الله صلى الله عليه وسلم بيده ويدي قصر من يده، أربع لا يضحى بهن : العوراء البين عورها والمريضة البين مرضها، والعرجاء البين ظلعها، والعجماء التي لا تنقي، فقالوا للبراء : فإنما نكره النقص في السن والأذن والذنب، قال : فاكرهوا ما شئتم ولا تحرموا على الناس.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাত দিয়ে ইশারা করেছেন-আমার হাত তো তাঁর হাত থেকে ছোট-এবং বলেছেন, ‘চার ধরনের পশু দ্বারা কুরবানী করা যায় না : যে পশুর এক চোখের দৃষ্টিহীনতা স্পষ্ট, যে পশু অতি রুগ্ন, যে পশু সম্পূর্ণ খোড়া এবং যে পশু এত শীর্ণ যে, তার হাড়ে মগজ নেই।’ লোকেরা বলল, আমরা তো দাঁত, কান ও লেজে ত্রুটিযুক্ত প্রাণী (দ্বারা কুরবানী করা)ও অপছন্দ করি? তিনি বললেন, যা ইচ্ছা অপছন্দ করতে পার। তবে তা অন্যের জন্য হারাম করো না।’-সহীহ ইবনে হিব্বান ৫৯১৯ আরো দেখুন : সুনানে আবু দাউদ ২/৩৮৭; সুনানে নাসায়ী ২/২০২; জামে তিরমিযী ১/২৭৫
হযরত আলী রা. বলেন-
أمرنا رسول الله صلى الله عليه وسلم أن نستشرف العين والأذن، وأن لا نضحي بمقابلة ولا مدابرة ولا شرقاء ولا خرقاء
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের আদেশ করেছেন, আমরা যেন (কুরবানীর পশুর) চোখ ও কান ভালোভাবে লক্ষ করি এবং ওই পশু দ্বারা কুরবানী না করি, যার কানের অগ্রভাগ বা পশ্চাদভাগ কর্তিত। তদ্রূপ যে পশুর কান ফাড়া বা কানে গোলাকার ছিদ্রযুক্ত।-সুনানে আবু দাউদ ২/৩৮৮; সুনানে নাসায়ী ২/১৮০; সুনানে তিরমিযী ১/২৭৫; সুনানে ইবনে মাজাহ পৃ. ২২৭
হযরত আলী রা. বলেন-
نهى رسول الله صلى الله عليه وسلم أن يضي بأعضب القرن والأذن
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের শিং-ভাঙ্গা বা কান-কাটা পশু দ্বারা কুরবানী করতে নিষেধ করেছেন।-সুনানে ইবনে মাজাহ পৃ. ২২৭
কুরবানীর সময়
বারা ইবনে আযীব রা. বলেন-
كنا عند سارية المسجد، فلو كنت ثم لأخبرتكم بموضعها قال : خطبنا رسول الله صلى عليه وسلم فقال : إن أول ما نبدأ به في يومنا هذا أن نصلي، ثم نرجع فننحر، فمن فعل ذلك فقد أصاب سنتنا، ومن ذبح قبل ذلك، فإنما هو لحم قدمه لأهله، ليس من النسك في شيء.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের উদ্দেশে খুতবা দিলেন। তাতে বললেন, আমাদের এই দিবসে প্রথম কাজ নামায আদায় করা, এরপর কুরবানী করা। সুতরাং যে এভাবে করবে তার কাজ আমাদের তরীকামতো হবে। আর যে আগেই যবেহ করেছে (তার কাজ তরীকামতো হয়নি) অতএব তা পরিবারের জন্য প্রস্তুতকৃত গোশত, (আল্লাহর জন্য উৎসর্গিত) কুরবানী নয়।-সহীহ বুখারী ২/৮৩২; সহীহ মুসলিম ২/১৫৪; সহীহ ইবনে হিব্বান ৫৯০৭
হাদীসে আছে যে, কোনো কোনো সাহাবী ভুলক্রমে ঈদের নামাযের আগে কুরবানী করেছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে পুনরায় কুরবানী করার আদেশ করেন। দেখুন : সহীহ বুখারী ২/৮২৭; সহীহ মুসলিম ২/১৫৩; সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস : ৫৯১২, ৫৯১৩; সুনানে ইবনে মাজাহ পৃ. ২২৭; সুনানে নাসায়ী ২/১৭৯
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে কুরবানী করেছেন
জাবির রা. থেকে বর্ণিত-
ذبح النبي صلى ا لله عليه وسلم يوم الذبح كبشين أقربين أملحين موجوئين، فلما وجههما قال : إني وجهت وجهي للذي فطر السموات والأرض على ملة إبراهيم حنيفا وما أنا من المشركين، إن صلاتي ونسكي ومحياي ومماتي لله رب العالمين لا شريك له وبذلك أمرت وأنا من المسلمين، اللهم منك ولك عن محمد وأمته، بسم الله والله أكبر، ثم ذبح.
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর দিন দু’টি সাদা-কালো, বড় শিং বিশিষ্ট, খাসি দুম্বা যবেহ করেছেন। যখন তিনি তাদের শায়িত করলেন তখন বললেন-
إني وجههت وجهي للذي فطر ...
এরপর যবেহ করলেন।-মুসনাদে আহমদ ৩/৩৭৫; সুনানে আবু দাউদ ৩৮৬; সুনানে ইবনে মাজাহ পৃ. ২২৫
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন-
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يذبح وينحر بالمصلى
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদগাহে যবেহ করতেন এবং নহর করতেন।-সহীহ বুখারী ২/৮৩৩
নিয়ম হল গরু, ছাগল, দুম্বা যবেহ করা হবে এবং উট নহর করা হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনই করেছেন।
হযরত শাদ্দাদ ইবনে আওছ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
إن الله تبارك وتعالى كتب الإحسان على كل شيء، فإذا قتلتم فأحسنوا القتلة، وإذا ذبحتم فأحسنوا الذبح، وليحد أحدكم شفرته وليرح ذبيحته.
আল্লাহ তাআলা সকল কিছুর উপর অনুগ্রহকে অপরিহার্য করেছেন। অতএব যখন তোমরা হত্যা করবে তো উত্তম পদ্ধতিতে হত্যা কর। যখন যবেহ করবে তো উত্তম পদ্ধতিতে যবেহ কর। প্রত্যেকে তার ছুরিতে শান দিবে এবং তার পশুকে শান্তি দিবে।-সহীহ মুসলিম ২/১৫২; সুনানে আবু দাউদ ২/৩৮৯; সুনানে নাসায়ী ২/১৮২; সুনানে তিরমিযী ১/২৬০; সুনানে ইবনে মাজাহ ২/২২৯
কুরবানীর পশুর গোশত
জাবির রা. থেকে বর্ণিত-
عن النبي صلى الله عليه وسلم : أنه نهى عن أكل لحوم الضحايا بعد ثلاث، ثم قال بعد : كلوا وتزودوا وادخروا.
وفي رواية عائشة عنده : فكلوا وادخروا وتصدقوا.
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন রাত পর কুরবানীর গোশত খেতে নিষেধ করেছিলেন। এরপর (অবকাশ দিয়ে) বলেন, ‘খাও, পাথেয় হিসাবে সঙ্গে নাও এবং সংরক্ষণ করে রাখ’।-মুসলিম ২/১৫৮
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা.-এর এক বর্ণনায় আছে যে, ‘খাও, সংরক্ষণ কর এবং ছদকা কর।’-মুসলিম ২/১৫৮ ষ
[আলকাউসার ডিসেম্বর ’০৯ সংখ্যা থেকে পুনর্মুদ্রিত]