রজব ১৪৪৩   ||   ফেব্রুয়ারি ২০২২

সুবহে সাদিক কখন শুরু?
প্রসঙ্গ : আহসানুল ফাতাওয়ার উদ্ধৃতিগুলোর পর্যালোচনা-২

মাওলানা মুহাম্মাদ ফয়যুল্লাহ

আমাদের আলোচনা চলছিল আহসানুল ফাতাওয়ার উল্লেখকৃত উদ্ধৃতিগুলো নিয়ে। তাতে تحقیقات قدیمہ শিরোনামের অধীনে শাস্ত্রজ্ঞদের যে দুটি উদ্ধৃতি ছিল সে দুটি উদ্ধৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা-পর্যালোচনা বিগত সংখ্যাতে তুলে ধরা হয়েছে আলহামদু লিল্লাহ। শাস্ত্রজ্ঞদের ঐকমত্য-পরিপন্থী ভুল দাবির সপক্ষে দুজন শাস্ত্রজ্ঞ থেকেই উদ্ধৃত বক্তব্যগুলোর সঠিক অর্থ-মর্ম আমরা পেশ করেছি। যাতে আমরা দেখতে পেলাম, এই উদ্ধৃতিদুটি মূলত ১৮°-এর ভেতর সুবহে সাদিক হওয়ার সপক্ষের প্রমাণ; আহসানুল ফাতাওয়ার কোনো প্রমাণ তাতে নেই।

এখন বাকি থাকল অবশিষ্ট উদ্ধৃতিগুলোর প্রসঙ্গ। আমরা আগেই বলে এসেছি, বাকি যেসব উদ্ধৃতি আছে এর কোনোটিই শাস্ত্রজ্ঞ কারো বক্তব্য নয়। ফলে এই বক্তব্যগুলোতে শাস্ত্রীয় দিক থেকে অনেক অসংগতি বিদ্যমান। যার কারণে এই উদ্ধৃতিগুলো প্রমাণযোগ্যই নয়। সামনে আমরা সেগুলোর বিবরণ তুলে ধরছি ইনশাআল্লাহ।

খলীল কামেলী রাহ.-এর উদ্ধৃতি

تحقیقات قدیمہ শিরোনামের অধীনে  আহসানুল ফাতাওয়াতে (২/১৬৬) নিজ দাবির দলীল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে রদ্দুল মুহতারের বরাতে খলীল কামেলী রাহ. (১২০৭ হি.)-এর একটি বক্তব্য। সেটি হচ্ছে-

ذكر العلامة المرحوم الشيخ خليل الكاملي في حاشيته على رسالة الأسطرلاب لشيخ مشايخنا العلامة المحقق علي أفندي الداغستاني أن التفاوت بين الفجرين وكذا بين الشفقين الأحمر والأبيض إنما هو بثلاث درج.

এখানে বলা হয়েছে, এ্যাস্ট্রল্যাব বিষয়ে আল্লামা আলী আফেন্দি দাগিস্তানী রাহ.-এর একটি পুস্তিকার টীকায় শায়েখ খলীল কামেলী রাহ. বলেছেন, সুবহে কাযিব ও সুবহে সাদিক এবং শাফাকে আবয়ায ও শাফাকে আহমারের মাঝে তিন ডিগ্রি ব্যবধান।

১৮°-এ সুবহে কাযিব এবং ১৫°-এ সুবহে সাদিক হওয়ার সপক্ষে এ বক্তব্যটিও নাকি আহসানুল ফাতাওয়ার স্বতন্ত্র একটি দলীল! কেমন আশ্চর্যের কথা! বলুন, এখানে ১৮° বা ১৫°-এর কথা কোথায় আছে?!

এই বক্তব্যটিকে উক্ত দাবির সপক্ষে স্বতন্ত্র দলীল হিসেবে উল্লেখ করার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, সুবহে সাদিক ও সুবহে কাযিবের মধ্যে যেহেতু তিন ডিগ্রি ব্যবধান, তাই সুবহে কাযিব হবে ১৮°-এ এবং সুবহে সাদিক ১৫°-এ। কিন্তু এটি যে সম্পূর্ণ অসংলগ্ন কথা তা কি বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে?!

সোজা কথা হল, যদি এ দাবি ঠিক হয়েও থাকে যে, সুবহে কাযিব ও সুবহে সাদিকের মাঝে শুধু তিন ডিগ্রি ব্যবধান, তাহলে বলতে হবে, সুবহে সাদিক হয় ১৮°-এ এবং সুবহে কাযিব হয় এর তিন ডিগ্রি আগে। তা না বলে ১৮°-এ সুবহে কাযিব হওয়ার অমূলক ধারণার উপর ভিত্তি করে উক্ত কথার ব্যাখ্যা দেওয়া, উপরন্তু এটিকে আবার নিজের স্বতন্ত্র দলীলও মনে করা একেবারেই অবান্তর। সামনে পাঠক দেখতে পাবেন, আসলে খলীল কামেলীর উক্ত কথাটি গোড়া থেকেই ভুল এবং সেটি আহসানুল ফাতাওয়ার দলীল তো নয়ই; রবং অন্য দুটি ভুল দাবির ফসল।

সুবহে সাদিক সম্পর্কে আল্লামা ইবনে আবেদীন রাহ.-এর বক্তব্য

দ্বিতীয়ত, রদ্দুল মুহতার থেকে উদ্ধৃত এই কথাটি আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী রাহ.-এর নিজস্ব বক্তব্য নয়। আরেকজনের কথা তিনি উদ্ধৃত করেছেন কেবল। কিন্তু আহসানুল ফাতাওয়াতে একে আল্লামা ইবনে আবেদীন রাহ.-এর বক্তব্য হিসেবে পেশ করা হয়েছে। তাতে এক জায়গায় বলা হয়েছে-

علامہ شامی رحمہ اللہ تعالیٰ نے بھی کتاب الصلوۃ اور کتاب الصوم میں دو جگہ تحریر فرمایا ہے کہ صبح  کاذب اور صبح صادق کے درمیان تین درجہ کا فرق ہوتا ہے۔

অর্থাৎ আল্লামা শামী রাহ. তার কিতাবের দুই জায়গায় লিখেছেন, সুবহে কাযিব ও সুবহে সাদিকের মাঝে তিন ডিগ্রি ব্যবধান। (আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৬২)

অন্যত্র বলা হয়েছে-

فقہ اور فلکیات میں یہ وضاحت بھی ہے کہ صبح صادق سے صرف تین درجہ پہلے صبح  کاذب نظر آتی ہے۔

ফিক্হ ও ফালাকিয়াত উভয় শাস্ত্রের কিতাবে এ কথা স্পষ্টভাবে আছে যে, সুবহে সাদিকের শুধু তিন ডিগ্রি আগে সুবহে কাযিব দেখা যায়। (আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৬০)

এভাবে তিন ডিগ্রি ব্যবধানের এই কথাটিকে ফিকহের কিতাবের বক্তব্যও বানিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং একে আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী রাহ.-এর দিকেই সরাসরি সম্বন্ধ করা হচ্ছে। আর এই কথাগুলো বারবার উল্লেখ করা হচ্ছে ১৫°-এ সুবহে সাদিক ও ১৮°-এ সুবহে কাযিবের দাবির সপক্ষে। অর্থাৎ এগুলো বলে বলে এ কথা বোঝানো হচ্ছে যে, আল্লামা ইবনে আবেদীন রাহ.-এর বক্তব্য দ্বারাও ১৫°-এ সুবহে সাদিক ও ১৮°-এ সুবহে কাযিব প্রমাণিত হয়। কিন্তু এই বক্তব্যে এমন কোনো কথা যে নেই তা তো পরিষ্কার। সুবহে সাদিক কত ডিগ্রিতে হয় বা সুবহে কাযিব কত ডিগ্রিতে হয় কোনোটিই নেই এই কথায়। হাঁ, সুবহে সাদিক কত ডিগ্রিতে শুরু হয় তা আল্লামা ইবনে আবেদীন রাহ.-এর অন্য দুই বক্তব্যে রয়েছে। আমাদের এই লেখাটির প্রথম কিস্তিতে [এপ্রিল-মে ১৯ ঈ.] আল্লামা ইবনে আবেদীন রাহ.-এর সেই দুটি বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে। এই দুই বক্তব্যে তিনি শাম (যা তার নিজ এলাকা) ও মিশরের ফজরের পুরো ওয়াক্তের যে হিসাব দিয়েছেন সে অনুযায়ী সুবহে সাদিক হয় ১৮°-এর ভেতর। আহসানুল ফাতাওয়াতেও এ কথা স্বীকার করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত আল্লামা ইবনে আবেদীন রাহ.-এর একটি বক্তব্য তুলে ধরার পর আহসানুল ফাতাওয়াতে বলা হয়েছে-

بظاہر اس عبارت سے معلوم ہوتا ہے کہ مصر میں صبح صادق کا زیادہ سے زیادہ وقت ایک گھنٹہ ৪৪ منٹ اور شام میں زیادہ سے زیادہ  ایک گھنٹہ ৫৬ منٹ ہے، حالانکہ یہ حساب ১৫ زیر افق کی بجائے ১৮ زیر افق پر منطبق ہوتا ہے۔ ... بہرکیف اشکال یہ ہے کہ اس عبارت میں ১৮ زیر افق کوصبح صادق قرار دیاگیا ہے۔

আল্লামা ইবনে আবেদীন রাহ.-এর এই এবারত থেকে বোঝা যায়, মিশরে সুবহে সাদিকের মোট সময় সর্বোচ্চ হয় এক ঘণ্টা ৪৪ মিনিট এবং শামে এক ঘণ্টা ৫৬ মিনিট। অথচ এই হিসাব ১৫°-এর পরিবর্তে ১৮°-এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়। ... যাই হোক, সমস্যা হল, এই এবারতে ১৮°-এ সুবহে সাদিক গণ্য করা হয়েছে। (আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৮৫)

কিন্তু সীমাহীন আশ্চর্যের বিষয়, ইবনে আবেদীর রাহ.-এর ফজরের এই হিসাব ১৮°-এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়ার কথা স্বীকার করে নেওয়ার পরও একে এই বলে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে যে, তাঁর এই হিসাব তাঁরই থেকে উদ্ধৃত সুবহে কাযিব ও সুবহে সাদিকের মাঝে তিন ডিগ্রি ব্যবধানের কথাটির সাথে সাংঘর্ষিক। আহসানুল ফাতাওয়াতে বলা হয়েছে-

بہر کیف مصر وشام کے مذکورہ اوقات صبح صادق کا نہیں بلکہ صبح کاذب کے ہیں، جب علامہ شامی رحمہ الله تعالی خودکتاب الصلوة  میں  دو جگہ اس کی تصریح نقل کر چکے ہیں کہ صبح  کاذب وصادق میں تین درجات  کا  فرق ہے تو  یہ کیسے باور کیا جاسکتا ہے  کہ یہاں اسکے خلاف نقل لاکر وجہ تطبیق یا ترجیح ذکر نہ کریں۔

এ কথার সারমর্ম হল, মিশর ও শামের উক্ত সময় সুবহে সাদিকের নয়; বরং সুবহে কাযিবের। কেননা ইবনে আবেদীন রাহ. দুই জায়গায় এ কথা বলেছেন যে, সুবহে কাযিব ও সাদিকের মাঝে তিন ডিগ্রি ব্যবধান। কিন্তু মিশর ও শামের ফজরের যে ওয়াক্ত তিনি উল্লেখ করেছেন তা যদি সুবহে সাদিক থেকে হিসাব করা হয় তবে তার এ বক্তব্যটি সুবহে কাযিব ও সাদিকের মধ্যে তিন ডিগ্রি ব্যবধানের বক্তব্যের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে যায়। আর এটা কীভাবে সম্ভব যে, তিনি এই পরস্পর সাংঘর্ষিক বক্তব্য এর কোনো ব্যাখ্যা বা কোনো একটি প্রাধান্য দেওয়া ছাড়াই উল্লেখ করে চলে যাবেন? (আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৮৫)

অথচ সবাই খুব সহজেই অনুধাবন করতে পারছেন, এই দুই বক্তব্য পরস্পর সাংঘর্ষিক হওয়ার প্রশ্নই আসে না। এই বক্তব্য দুটিকে পরস্পর সাংঘর্ষিক মনে করার মানে তো এই দাঁড়ায়, সুবহে সাদিক ও সুবহে কাযিবের মধ্যে যেহেতু তিন ডিগ্রি ব্যবধান, তাই সুবহে কাযিব হবে ১৮°-এ এবং সুবহে সাদিক ১৫°-এ। কিন্তু এটি যে সম্পূর্ণ অনর্থক তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

সহজ কথা, এই দুই বক্তব্যে কোনো সংঘর্ষ নেই। বক্তব্যদুটিকে মিলিয়ে সুবহে কাযিব ও সুবহে সাদিকের হিসাব সহজেই বের করা যায়। তা এভাবে যে, ইবনে আবেদীন শামী রাহ.-এর বক্তব্য দ্বারা প্রমাণিত, সুবহে সাদিক হয় ১৮°-এর ভেতর। আর তাঁর উদ্ধৃত অপর এই বক্তব্যে আছে, সুবহে কাযিব ও সুবহে সাদিকের মাঝে ৩ ডিগ্রি ব্যবধান। এই দুই কথাকে মিলালে নতিজা এই দাঁড়ায় যে, সুবহে সাদিক হয় ১৮°-এর ভেতর, আর সুবহে কাযিব হয় এর তিন ডিগ্রি আগে। অর্থাৎ ২১°-এ। ইবনে আবেদীন রাহ. থেকে উদ্ধৃত এই উভয় কথাকে মিলালে সুবহে সাদিক ও সুবহে কাযিবের এই হিসাব বেরিয়ে আসে। এতে সংঘর্ষের কিছু নেই।

কিন্তু বড় আফসোসের কথা, ১৮°-এর ভেতর ফজরের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার ব্যাপারে ইবনে আবেদীন রাহ.-এর সুস্পষ্ট সুদৃঢ় বক্তব্য থাকা সত্ত্বেও আহসানুল ফাতাওয়াতে খোঁড়া অজুহাতে সেটিকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। আর তাঁর উদ্ধৃত তিন ডিগ্রি ব্যবধানের কথাটি দ্বারা নিজ দাবির কোনো কিছু প্রমাণিত না হলেও একে নিজ দাবির স্বতন্ত্র দলীল হিসেবে গ্রহণ করে নেওয়া হয়েছে। আর বাস্তবে যেহেতু এই কথা দ্বারা সরাসরি নিজের দাবি প্রমাণিত হয় না তাই এর সাথে ১৮°-এ সুবহে কাযিব শুরু হওয়া বিষয়ে অন্যের ভুল বক্তব্যকে জোড়া লাগিয়ে ১৫°-এ সুবহে সাদিকের হিসাব দাঁড় করানো হয়েছে! আর অযথাই বলা হচ্ছে, ১৮°-এ সুবহে সাদিক হওয়ার বক্তব্যের সাথে এই কথাটি সাংঘর্ষিক! এ তো ফিকহের দৃষ্টিতে নাজায়েয তালফীক’-এর অন্তর্ভুক্ত।

কত আশ্চর্যের বিষয়, যে বক্তব্যটি সম্পূর্ণ অস্পষ্ট; সুবহে কাযিব কত ডিগ্রিতে হয় কিংবা সুবহে সাদিক কত ডিগ্রিতে শুরু হয়- এর কোনোটিই যে বক্তব্য দ্বারা প্রমাণিত হয় না, এরকম একটি  কথার অজুহাত দিয়ে এমন একটি বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করে দেওয়া হল, যার দ্বারা সুবহে সাদিক কখন শুরু হয় তা দৃঢ় ও দ্ব্যর্থহীনভাবেই প্রমাণিত!

আচ্ছা, আহসানুল ফাতাওয়ার দাবি অনুযায়ী কিছুক্ষণের জন্য যদি ধরেও নেওয়া হয়, উভয় বক্তব্য পরস্পর সাংঘর্ষিক (যদিও বিষয়টি কখনো এমন নয়) তাহলে এক্ষেত্রে আমাদের প্রশ্ন হল, এই দুই বক্তব্যের মাঝে তিন ডিগ্রি ব্যবধানের কথাকে গ্রহণ করা হল কোন্ দলীলে, আর অপরটিকে প্রত্যাখ্যান করা হল কোন্ দলীলের ভিত্তিতে? তিন ডিগ্রি ব্যবধানের কথাকে গ্রহণ না করে যে বক্তব্য দ্বারা ১৮°-এ সুবহে সাদিক প্রমাণিত হয় তা গ্রহণ করার কি কোনো সুযোগ ছিল না?! তাছাড়া রদ্দুল মুহতারে সওম অধ্যায়ে তাঁরই উল্লেখিত সুবহে সাদিকের সময়কে যে জবরদস্তিমূলক সুবহে কাযিব বানিয়ে দেওয়া হল, এর নতীজা ও ফলাফল কী দাঁড়ায় এবং কতটুকু পর্যন্ত গড়ায় তা কি ভেবে দেখার প্রয়োজন ছিল না? এই বক্তব্যটিকে সুবহে কাযিব বানিয়ে দিলে এর কী কী ভয়ঙ্কর ও মারাত্মক ধরনের ফলাফল দাঁড়ায়- সামনের আলোচনা থেকে পাঠক তা বুঝতে পারবেন ইনশাআল্লাহ।

আল্লামা ইবনে আবেদীন রাহ.-এর এই বক্তব্যের গলদ তাবীল ও এর জবাব

বড় দুঃখজনক হল, সুবহে সাদিক কখন হয় এ সম্পর্কে ইবনে আবেদীন রাহ.-এর যেটি সুস্পষ্ট বক্তব্য, সেটিকে গ্রহণ না করে উল্টো বিভিন্নভাবে এর অপব্যাখ্যা করা হয়েছে। সামনে আমরা এর খণ্ডন ও বিস্তারিত জবাব পেশ করছি ইনশাআল্লাহ। এর আগে আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী রাহ.-এর মূল বক্তব্যটি আবার পডড়ুন। তিনি বলেছেন-

[تنبيه] قد علمت أن النهار الشرعي من طلوع الفجر إلى الغروب، واعلم أن كل قطر نصف نهاره قبل زواله بنصف حصة فجره، فمتى كان الباقي للزوال أكثر من هذا النصف صح وإلا فلا، فتصح النية في مصر والشام قبل الزوال بخمس عشرة درجة لوجود النية في أكثر النهار؛ لأن نصف حصة الفجر لا تزيد على ثلاث عشرة درجة في مصر وأربع عشرة ونصف في الشام، فإذا كان الباقي إلى الزوال أكثر من نصف هذه الحصة ولو بنصف درجة صح الصوم، كذا حرره شيخ مشايخنا السائحاني رحمه الله تعالى.

এখানে তিনি কথা শুরুই করেছেন এই বলে যে-

قد علمت أن النهار الشرعي  من طلوع الفجر إلى الغروب.

অর্থাৎ শরীয়তের দৃষ্টিতে দিন হল ফজরের উদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত।

এখানে তিনি শুধু ফজরশব্দ উল্লেখ করেছেন। যার দ্বারা উদ্দেশ্য সুবহে সাদিক। কারণ, শরীয়তের দৃষ্টিতে সুবহে সাদিক থেকে দিন শুরু হওয়ার বিষয়টি মুজমা আলাইহি ও ঐকমত্যপূর্ণ মাসআলা। আর সুবহে কাযিব রাতের অংশ। শরীয়তের দৃষ্টিতে (এবং সাধারণ হিসেবেও) তা দিনের অংশ নয়। তাই এখানে ফজরশব্দকে সুবহে কাযিব আখ্যা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাহলে এখানে তিনি কথার শুরুতেই ফজরশব্দ উল্লেখ করেছেন। যার দ্বারা সুবহে সাদিক উদ্দেশ্য হওয়া চূড়ান্ত। এরপর তিনি نصف النهار الشرعي অর্থাৎ শরয়ী অর্ধদিবসনির্ধারণের একটি মূলনীতি উল্লেখ করেন। সেটি হল, প্রত্যেক এলাকার ফজরের ওয়াক্তের পুরো সময়কে অর্ধেক করলে যে পরিমাণ সময় হয়, ওই দিন যাওয়ালের (সূর্য ঢলার) আগে এ পরিমাণ সময় যোগ করলে যে সময় বের হয় সেটিই ওই দিনের অর্ধদিন। সুতরাং এর আগ পর্যন্ত (নফল ও রমযানের) রোযার নিয়ত করা সহীহ আছে। অতএব মিশর ও শামে যাওয়ালের এক ঘণ্টা আগে রোযার নিয়ত করা সহীহ হবে। কেননা ফজরের পুরো ওয়াক্তের অর্ধেক মিশরে ৫২ মিনিট এবং শামে ৫৮ মিনিট-এর বেশি হয় না।

দেখুন-

রদ্দুল মুহতার ৬/২০৩-২০৪; দারুস সাকাফাতি ওয়াত তুরাস, তাহক্বীক : ড. হুসামুদ্দীন ফরফূর

ইবনে আবেদীন রাহ.-এর এ কথার অর্থ দাঁড়ায়, ফজরের মোট সময় মিশরে হয়ে থাকে সর্বোচ্চ ১ ঘণ্টা ৪৪ মিনিট। (৫২ মিনিটের দ্বিগুণ) এবং শামে ১ ঘণ্টা ৫৬ মিনিট (৫৮ মিনিটের দ্বিগুণ)। আর মিশরের অক্ষাংশ হচ্ছে সবোর্চ্চ ৩১.৬০°সেখানে বছরের সবচে বড় দিন ২১ জুন ১৮°-এর সময় হয় ৩:১১ মিনিট ১৮ সেকেন্ডে, আর সূযোর্দয় হয় ৪:৫১ মিনিটে। আর ৩:১১ মিনিট থেকে ৪:৫১ পর্যন্ত মোট সময় হয় ১০০ মিনিট, অর্থাৎ এক ঘণ্টা ৪০ মিনিট। অথচ ইবনে আবেদীন রাহ. ১ ঘণ্টা ৪৪ মিনিটের কথা বলেছেন। এর মানে তাঁর প্রদত্ত এই সময় ১৮°-এরও চার মিনিট আগের। এবার সেখানের ১৫° অনুযায়ী হিসাবও দেখা যাক। সেখানে ২১ জুন ১৫°-এর সময় হয়ে থাকে ৩:৩০ মিনিটে এবং সূর্যোদয় হয়ে থাকে ৪:৫১ মিনিটে। আর ৩:৩০ থেকে ৪:৫১ পর্যন্ত মোট সময় হয় ৮১ মিনিট তথা এ ঘণ্টা ২১ মিনিটইবনে আবেদীন রাহ. এখানে ফজরের যে ওয়াক্ত বর্ণনা করেছেন এর থেকে ২৩ মিনিট পর এই সময় হয়ে থাকে। অতএব ইবনে আবেদীন রাহ. কর্তৃক প্রদত্ত ফজরের এই হিসাবের সাথে ১৫°-এর সময়ের কোনো মিল নেই। শামের ফজরের ওয়াক্তের হিসাবও এমনই। ১৫°-এর সময়ের সাথে এর কোনো মিল নেই; বরং ১৮° অনুযায়ীই তা হয়ে থাকে।

আবার লক্ষ্য করে দেখুন, ইবনে আবেদীন রাহ.-এর এই বক্তব্যটি কত পরিষ্কার। বক্তব্যটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যত জায়গায় ফজর শব্দ এসেছে সবগুলো দ্বারাই সুবহে সাদিক উদ্দেশ্য হওয়াটা চূড়ান্ত বিষয়। এখানে তিনি মিশর ও শামের نصف النهار الشرعيশরয়ী অর্ধদিবসএবং ফজরের ওয়াক্তের মোট সময়ের হিসাব তুলে ধরেছেন এবং কতক্ষণ পর্যন্ত নফল ও রমযানের রোযার নিয়ত সহীহ সেই মাসআলা উল্লেখ করেছেন।

স্পষ্টত উভয় দেশের মুসলিমদের নিকট ফজরের ওয়াক্তের মোট সময় এ পরিমাণই ছিল। এ অনুযায়ীই তারা আমল করতেন। নামায-রোযা আদায় করতেন। ফুকাহায়ে কেরাম ও উলামায়ে উম্মত এই অনুসারেই মাসআলা বর্ণনা করতেন। অতএব এখানে তিনি মুসলিম উম্মাহর তাআমুল এবং ফুকাহা ও উলামায়ে উম্মতের বক্তব্যের বিবরণ দিয়েছেন এবং সেই ভিত্তিতেই উভয় অঞ্চলের ফজরের ওয়াক্তের এই হিসাব দিয়েছেন। আর সে সময়টি ১৮°-এ সুবহে সদিক হওয়ার হিসাবের সাথেই মিলে যাচ্ছে; ১৫°-এর হিসাবের সাথে এর কোনো মিল নেই।

আল্লামা ইবনে আবেদীন রাহ.-এর এই বক্তব্যটি ১৮°-এর ভেতর সুবহে সাদিক হওয়ার সপক্ষে অনেক বড় দলীল। কিন্তু আহসানুল ফাতাওয়ার দাবি তো ১৫°-এর আগে সুবহে সাদিক হয়ই না। এর আগে হচ্ছে সুবহে কাযিবের সময়। কিন্তু আমাদের মাযহাবের প্রসিদ্ধ একজন ফকীহের বক্তব্য দ্বারা ১৮°-এ সুবহে সাদিক হওয়া প্রমাণিত হয়ে যাচ্ছে। ১৫°-এর দাবিকে সঠিক রাখতে হলে একে তো খণ্ডন করা জরুরি। এখন একে খণ্ডন করা হচ্ছে এই বলে যে-

ماہرین فلکیات کا دستور رہا ہے کہ وہ صبح کاذب کو مطلق صبح سے تعبیر کرتے ہیں، اس سے بعض حضرات کو اشتباہ ہو گیا اور وہ اسے صبح صادق سمجھنے لگے۔

ফালাকিয়াতের বিশেষজ্ঞগণের রীতি হল, তারা সুবহে কাযিবকে শুধু সুবহশব্দ দ্বারা ব্যক্ত করেন। এর থেকে কারো বিভ্রান্তি হয়েছে এবং তারা এটিকে সুবহে সাদিক বুঝে নিয়েছেন। (আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৮৫)

কথা হল, কারো বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হলেও এর তো কোনো প্রাসঙ্গিকতা থাকতে হয়। কারো কোনো কথার খণ্ডন করা হলে এর সাথে নিজের কথার অন্তত কোনো যোগসূত্র তো থাকা জরুরি। যে কথা বলে খণ্ডন করা হল সেটি সঠিক না বেঠিক, তা ভুল না শুদ্ধ এই প্রসঙ্গ তো পরের বিষয়। এখন ইবনে আবেদীন রাহ.-এর বক্তব্যের কোথাও কোনো ফালাকীর বক্তব্যের দিকে কোনো ইঙ্গিতই নেই। আহসানুল ফাতাওয়াতে যে কথা বলা হয়েছে এর কোনো প্রসঙ্গ বা ইঙ্গিত কিছুই নেই এই বক্তব্যটিতে। ফালাকীগণের বক্তব্য ভুল বোঝার কোনো প্রসঙ্গই নেই তাতে। তাহলে এখানে কেন কোনো প্রাসঙ্গিকতা ছাড়া এই কথাগুলো বলা হল?

ইবনে আবেদীন শামী রাহ. এখানে না সময়সূচি লিখতে বসেছেন, না ফালাকীদের পরিভাষায় ফজরের ওয়াক্ত বলেছেন। যার কারণে তাঁর উপর সুবহে কাযিবকে সুবহে সাদিক বানানোর আপত্তি উত্থাপন করা যায়। বরং তিনি তো খালিস শরয়ী মাসআলা বর্ণনা করছেন যে, শরয়ী অর্ধ দিবসের সময় কোন্টি? কতক্ষণ পর্যন্ত ফরয ও নফল রোযার নিয়ত গ্রহণযোগ্য? তিনি তো এখানে মিশর ও শামবাসীর তাআমুলের বিবরণ দিচ্ছেন যে, তাদের ওখানে ফজরের নামাযের সময় ঘড়ি অনুযায়ী কখন শুরু হয় এবং কখন শেষ হয়। আলোচনার এই প্রসঙ্গে আল্লামা ইবনে আবেদীন রাহ.-এর মত ফকীহের উপর এই অপবাদ আরোপ করা যে, তাঁর বিভ্রান্তি হয়েছে। তিনি সুবহে কাযিবকে সুবহে সাদিক বুঝেছেন এবং এরই ভিত্তিতে তিনি উক্ত সময় লিখে দিয়েছেন। এটি কত মারাত্মক অপবাদ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সামনে গিয়ে তো পরিষ্কারভাবেই দাবি করে দেওয়া হয়েছে-

بہر کیف مصر وشام کے مذکورہ اوقات صبح صادق کا نہیں بلکہ صبح کاذب کے ہیں۔

যাই হোক, মিশর ও শামের উক্ত সময় (যা আল্লামা ইবনে আবেদীন রাহ.-এর বক্তব্যে এসেছে) সুবহে সাদিকের নয়; বরং সুবহে কাযিবের সময়। (আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৮৫)

আল্লামা ইবনে আবেদীন রাহ. স্পষ্টতই এখানে সুবহে সাদিক থেকে ফজরের এই মোট সময়ের হিসাব দিয়েছেন। যা তাঁর বক্তব্য থেকেই চূড়ান্ত। কিন্তু আহসানুল ফাতাওয়াতে বলা হচ্ছে, এই সময় সুবহে কাযিবের; সুবহে সাদিক থেকে নয়। তার মানে, আল্লামা ইবনে আবেদীন রাহ.-কে ভুল আখ্যায়িত করা হচ্ছে। তিনি না বুঝে বিভ্রান্তিবশতঃ সুবহে কাযিব থেকে ফজরের ওয়াক্তের হিসাব দিয়েছেন; সুবহে সাদিক থেকে নয়। তাই তিনি النهار الشرعي শরয়ী দিনের হিসাব দিয়েছেন যে ফজর থেকে এর দ্বারা উদ্দেশ্য মূলত সুবহে কাযিব; সুবহে সাদিক নয়। তিনি এতে ফজরের নামাযের ওয়াক্তের উল্লেখ করেছেন সুবহে কাযিব থেকে!! রমযানের ফরয ও নফল রোযার নিয়ত কতক্ষণ পর্যন্ত করা যায় এর হিসাবও তিনি বের করেছেন শরয়ী দিনের শুরু সুবহে কাযিব থেকে ধরে!! শাম ও মিশরের মুসলিম উম্মাহর আমলও এ অনুসারেই ছিল!! তারা নামায-রোযার ওয়াক্তের এই হিসাবগুলো সুবহে কাযিব অনুযায়ী করতেন!! ইবনে আবেদীন রাহ.-বর্ণিত মিশর ও শামের এই সময়কে সুবহে কাযিবের সময় আখ্যা দেওয়ার ফলাফল তো এই দাঁড়ায়! এটা যে ইবনে আবেদীন রাহ.-এর বক্তব্যের কত মারাত্মক ধরনের বিকৃতি এবং তাঁর উপর কত বড় অপবাদ- ভাবা যায়!!

আরো ভেবে দেখার বিষয়, ‘ফালাকিয়াতের বিশেষজ্ঞগণের রীতি হল, তারা সুবহে কাযিবকে শুধু সুবহশব্দ দ্বারা ব্যক্ত করেনএটি আহসানুল ফাতাওয়ার কত ভয়ঙ্কর দাবি! কেনো দলীল-প্রমাণবিহীন বরং দলীলের সম্পূর্ণ বিপরীত এই দাবিটি দ্বারা একবার বিশেষজ্ঞ ফালাকীগণের সুবহে সাদিকের বক্তব্যকে সুবহে কাযিব বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে! আরেকবার ফুকাহায়ে কেরামের সুবহে সাদিক সংক্রান্ত সুস্পষ্ট বক্তব্যকে সুবহে কাযিব আখ্যা দেওয়া হচ্ছে!! ১৮°-এর সপক্ষে যার উদ্ধৃতিই আসুক না কেন, তা যে শাস্ত্রের উদ্ধৃতিই হোক না কেন, তাকেই জোর-জবরদস্তি সুবহে কাযিব বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটি আহসানুল ফাতাওয়ার এমন এক মারাত্মক আবিষ্কৃত দাবি, যার দ্বারা যে কোনো বাস্তবতাকে বিকৃত করে দেওয়া যায়! যে কাউকে ভুল আখ্যায়িত করা যায়! যদিও তিনি সঠিক কথাই বলে থাকেন। চাই তিনি নিজের যুগের অনুসরণীয় কোনো ব্যক্তিত্ব হোন বা আগের যুগের বড় কোনো কোনো আলেম-ফকীহ। যার থেকেই ১৫°-এর সাথে সাংঘর্ষিক কোনো কথা পাওয়া যাবে কোনো দলীল-প্রমাণ ছাড়াই বলা হবে, তার কথা ভুল; না বুঝতে পেরে সুবহে কাযিবকে সুবহে সাদিক বুঝে বসেছেন!

এই হল সুবহে সাদিক বিষয়ে আহসানুল ফাতাওয়ার তাহকীকের অভিনব রীতি! যার জন্য ব্যথিত হওয়া ছাড়া আর কী করতে পারি আমরা!!

যাই হোক, আল্লমা ইবনে আবেদীন রাহ. এখানে সুবহে সাদিকের সময় উল্লেখ করেছেন। এটিই চূড়ান্ত কথা। একে কাযিব আখ্যা দেওয়ার কোনো সুযোগ-সম্ভাবনা নেই। একে সুবহে কাযিব বানানোর জন্য যত ব্যাখ্যাই খাড়া করা হবে এই বক্তব্যের ততই বিকৃতি হতে থাকবে এবং নিজেদের ভুলের পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পেতে থাকবে।

আর আল্লামা ইবনে অবেদীন রাহ. এখানে ফজরের ওয়াক্তের মোট সময়ের যে হিসাব দিয়েছে, এটি শুধু তিনি একাই বলেননি। তাঁর আগের অনেক ফকীহও এই হিসাব দিয়ে গেছেন। যার কিছু উদ্ধৃতি এপ্রিল-মে ১৯ -এর সংখ্যায় পেশ করা হয়েছে। তাছাড়া ইবনে আবেদীন রাহ.-এর অনেক যুগ আগে থেকেই উভয় দেশে মুসলিম বিজ্ঞানীগণও এ কথা বলে গেছেন। শাম ও মিশরের মুসলিম বিজ্ঞানীগণ শত শত বছর আগ থেকেই বলে গেছেন, সুবহে সাদিক হয় ১৮°-এর ভেতর। এবং তারা এ-ও বলেছেন যে, এই অঞ্চলগুলোতে মুসলিম উম্মাহর তাআমুল এই অনুযায়ীই চলে আসছে। শামের শামসুদ্দীন মিযযী ও ইবনে শাতের এবং মিশরের জামালুদ্দিন মারদানী ও সিবত আলমারিদীনী রাহ.-সহ আগের যুগের অনেক মুসলিম ফালাকীর বক্তব্য আমরা পূর্বে তুলে ধরেছি। প্রয়োজনে সেগুলো আবার দেখে নেওয়া যেতে পারে।

সবোর্পরি কথা হল, এটি কেবল এই দুই অঞ্চলের ফালাকীগণের বক্তব্যই নয়; সব যুগের সকল শাস্ত্রজ্ঞ মুসলিম ফালাকীগণের বক্তব্য। এবং সেই প্রাচীন যুগ থেকে আজ অবধি পুরো মুসলিম বিশ্বে এ অনুযায়ীই আমল চলে আসছে। অতএব ফজরের যে হিসাব ফালাকীগণের ইজমাসম্মত, মুসলিম উম্মাহর তাআমুল মাফিক, আল্লামা ইবনে আবেদীন রাহ. এর হিসাবই দিয়েছেন তার এই বক্তব্যে।

সুতরাং ইবনে আবেদীন রাহ.-এর এই বক্তব্যটির উপর আহসানুল ফাতাওয়ার এই আপত্তি উত্থাপন তাঁর বক্তব্যের বড় ধরনের বিকৃতি ছাড়া আর কিছু নয়।

দ্বিতীয় আপত্তি ও জবাব

মিসর ও শামের ওয়াক্ত সংক্রান্ত ইবনে আবেদীন রাহ.-এর বক্তব্যটি সম্পর্কে আহসানুল ফাতাওয়াতে তারপর বলা হয়েছে-

نیز انتہاء سحر کے باب میں احتیاط کے پیش نظر عمدابھی صبح کاذب کے اوقات لکھنے کا دستور رہا ہے، ہم گذشتہ مضمون میں اسکی چاند مثالیں بھی پیش کر چکے ہیں، بہر کیف مصر وشام کے مذکورہ اوقات صبح صادق کا نہیں بلکہ صبح کاذب کے ہیں۔

এখানে আরো দাবি করা হয়েছে, সেহরির শেষ সময়ের প্রতি খেয়াল করে (সময়সূচিতে) সতর্কতামূলক সুবহে কাযিবের সময় লেখার ব্যাপক রীতি ছিল। আগের আলোচনায় এর কিছু দৃষ্টান্তও আমরা পেশ করেছি। যা হোক, মিশর ও শামের উক্ত সময় সুবহে সাদিকের নয়; বরং সুবহে কাযিবের সময়। (আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৮৫)

এখানেও একই রকম কাণ্ড! ইবনে আবেদীন রাহ.-এর উপর আরেক অপবাদ! তাঁর এই বক্তব্যে নামাযের সময়সূচির কোনো প্রসঙ্গ নেই। তারপরও কোনো প্রাসঙ্গিকতা ছাড়া আগের মতই একটি কথা বলে দেওয়া হল। আর কথাটিও যে কত মারাত্মক ধরনের ভুল ও বাস্তবতা বিরোধী দাবি সে তো আরেক বিষয়।

আহসানুল ফাতাওয়াতে এর আগের পৃষ্ঠার যে দৃষ্টান্তগুলোর কথা এসেছে সেখানে বলা হয়েছে-

اہل فن علماء دین نے جب اوقات نماز کے نقشے مرتب کئے تو ان میں بھی احتیاط ومصلحت مذکورہ کی بنا پرصبح صادق کی بجائے عمدا صبح کاذب کے اوقات لکھے ...۔

অর্থাৎ শাস্ত্রজ্ঞ উলামায়ে দ্বীন যখন নামাযের সময়সূচি তৈরি করেছেন, সতর্কতা ও মাসলাহাতের কারণে তারা সুবহে সাদিকের পরিবর্তে ইচ্ছাকৃতভাবেই সুবহে কাযিবের সময় লিখেছেন। (আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৮৪)

আহসানুল ফাতাওয়ার এ দুটি বক্তব্যে অনেকগুলো অন্যায় দাবি ও বড় বড় অসঙ্গতি রয়েছে।

সবচে বড় অন্যায় ও বাস্তবতা বিরোধী দাবি হল, শাস্ত্রজ্ঞদের তৈরি সময়সূচিগুলোতে সুবহে কাযিবের সময় দেওয়া থাকে; ইচ্ছা করেই তারা সুবহে সাদিকের সময় উল্লেখ করেন না। এবং এটিই নাকি তাদের রীতি! আসতাগফিরুল্লাহ!!

সেহরির শেষ হোক বা ফজরের শুরু উভয়টিরই সম্পর্ক সুবহে সাদিকের সাথে। সুবহে সাদিক হয়ে গেলে সেহরির সময় শেষ হয়ে যায় এবং ফজরের ওয়াক্ত শুরু হয়ে যায়। সুবহে কাযিবের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। তার পরও শাস্ত্রজ্ঞগণ সুবহে সাদিকের সময় উল্লেখ না করে সুবহে কাযিবের সময় উল্লেখ করবেন- এ কেমন অদ্ভুত কথা! তাহলে মানুষ এমন সময়সূচি দিয়ে ফজরের নামাযের ওয়াক্ত জানবে কীভাবে?

আর সেহরির জন্যও তো সুবহে সাদিকের সময়ই জানা জরুরি; সুবহে কাযিবের সময় জানার কোনো প্রয়োজন নেইকেননা কেউ যদি সুবহে কাযিব শুরু হওয়ার পরও সুবহে সাদিকের আগে কিছু খায় তবেও তার রোযা সহীহ। কারণ, সেহরি তো সুবহে সাদিক পর্যন্ত খাওয়া জায়েয। কিন্তু সুবহে সাদিকের সময় যদি জানা না থাকে তাহলে কতক্ষণ পর্যন্ত সেহরি খেলে রোযা হবে, আর কোন্ সময়ের পর খেলে রোযা সহীহ হবে না- তা জানাই তো সম্ভব হবে না এমন সময়সূচি দিয়ে।

আর এখানে বলা হয়েছে সতর্কতার কথা। কিন্তু এ কেমন অদ্ভুত সতর্কতা যে, শরীয়তের বিধানের সম্পর্ক সুবহে সাদিকের সাথে, কিন্তু এর সময়ই উল্লেখ থাকবে না! মানুষ তা জানতেই পারবে না! কুরআন-হাদীস ও ফিকহ্ ফতোয়ার কোথাও এই সতর্কতার কথা নেই। আহসানুল ফাতাওয়াতেও এর কোনো উদ্ধৃতি নেই। এটি তো বরং শরীয়ত বিরোধী সতর্কতা। যার কারণে শরীয়তের বিধান জানাই অসম্ভব হয়ে পড়ে।

তারপর দেখুন, এই সতর্কতটা কীসের জন্য? এবং এর কী উদ্দেশ্য? সতর্কতামূলক সুবহে কাযিব থেকে সেহরি খাওয়া বন্ধ করে দিবে- -ই কি উদ্দেশ্য এ সতর্কতার? কিন্তু সুবহে কাযিব থেকে মানুষকে পানাহার বন্ধের কথা বলা তো শরীয়তের স্পষ্ট খেলাফ। কেননা হাদীস শরীফে সুবহে কাযিবের কারণে পানাহার বন্ধ করতে নিষেধ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

لَا يَمْنَعَنّكُمْ مِنْ سُحُورِكُمْ أَذَانُ بِلَالٍ، وَلَا الفَجْرُ المُسْتَطِيلُ، وَلَكِنِ الفَجْرُ المُسْتَطِيرُ فِي الأُفُقِ.

অর্থাৎ দিগন্তের দৈর্ঘ্যে প্রকাশিত আলো (সুবহে কাযিব) তোমাদের যেন সেহরী থেকে বাধা না দেয়; বরং (সেহরী থেকে বাধাদানকারী হল) দিগন্তের উভয়দিকে বিস্তৃত ফজরের আলো (অথার্ৎ সুবহে সাদিক)। (জামে তিরমিযী, হাদীস ৭০৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৯৪)

তাহলে দেখা গেল, সুবহে কাযিব থেকে সেহরী খাওয়া বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলা মানে হাদীস শরীফে যেটিকে নিষেধ করা হয়েছে ঠিক সেটিই করতে বলা। যা স্পষ্ট শরীয়ত বিরোধী। এটিও প্রমাণ যে, শাস্ত্রজ্ঞ উলামায়ে দ্বীন কর্তৃক প্রণিত সময়সূচিগুলোতে ১৮°-এ যে সুবহএর সময় দেওয়া আছে তা দ্বারা উদ্দেশ্য সুবহে সাদিক; সুবহে কাযিব নয়। কেননা কোনো বিজ্ঞ আলেমেদ্বীন এভাবে স্পষ্ট হাদীসের নিষেধাজ্ঞা বিরোধী কাজ করতে পারেন না।

তাছাড়া যেটি সেহরির শেষ সময় তখন থেকেই ফজরের নামাযের ওয়াক্ত শুরু। তাই যদি সুবহে কাযিবের সময় সেহরি খাওয়া যদি নাজায়েয বলা হয় তাহলে এর অর্থ এই হবে যে, তখন ফজরের নামায পড়ার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কোনো আলেম বা নামাযের ওয়াক্ত সম্পর্কে অবগত কোনো ফালাকী এমন সময়সূচি বানাবেন, যার নতীজা এই দাঁড়ায়- তা কী সম্ভব?!

আরো লক্ষণীয় হল, যেসব সময়সূচিতে ১৮°-এ সুবহের সময় লেখা থাকে সেগুলোতে শাফাক বা এশার সময়ও ১৮°-এ লেখা থাকে। আর ফজরের ক্ষেত্রে এটিকে যদি সুবহে কাযিবের সময় ধরা হয় তাহলে এশার ক্ষেত্রে এটি হবে শাফাকে কাযিবের সময়। অথচ এটা কীভাবে সম্ভব?! এক্ষেত্রে শাফাকে আহমার বা শাফাকে আবইয়ায কোনোটিরই সময় না লিখে শাফাকে কাযিবের সময় লেখাতে কী সতর্কতা বা মাসলাহাত রয়েছে?! তখন মাগরিবের সময় কখন শেষ হল এবং এশার সময় কখন শুরু হল- এর কোনোটিই তো জানা যাবে না।

সর্বোপরি কথা হল, এমন সময়সূচির প্রয়োজনটা কী, যার দ্বারা সেহরির সময় কখন শেষ হল তা জানা যাবে না, ফজরের ওয়াক্ত কখন শুরু তা বোঝা সম্ভব হবে না, এবং মাগরিবের ওয়াক্ত কখন শেষ হল এবং এশার ওয়াক্ত কখন শুরু হল তা জানারই সুযোগ থাকবে না!

এই একটি কথায় এত সব অসঙ্গতি ও আপত্তিকর দিকের পাশাপাশি এ দাবিটি যে গোড়া থেকেই ভুল তা তো আমরা পূর্বেই পড়ে এসেছি। আমাদের এই লেখাটিতে পেছনে (যিলহজ¦ ১৪৪১ হি./আগস্ট ২০২০ ঈ.-এর সংখ্যায়) দালীলিক আলোচনা তুলে ধরা হয়েছে যে, সুবহে কাযিবের শুরুকে সুনির্ধারিত ডিগ্রি বা সময়ের মাধ্যমে নির্ধারণ করাটাই ভুল। কোনো শাস্ত্রজ্ঞ সুবহে কাযিব কখন শুরু হয় এমন কোনো কথা বলেনইনি। সুতরাং বাস্তবতা হল, সুবহে কাযিব শুরু হওয়ার নির্ধারিত কোনো সময়ই নেই। অতএব তাদের তৈরিকৃত সময়সূচিতে সুবহে কাযিবের সময় দেওয়া থাকে’- এ দাবি সব দিক থেকে বাস্তবতা বিরোধী।

মুনাজ্জিম খাইরুল্লাহর সময়সূচির দৃষ্টান্ত ও বাস্তবতা

দাবি করা হয়েছে, সময়সূচিতে ইচ্ছাকৃতভাবেই সুবহে সদিকের সময় না লিখে সুবহে কাযিবের সময় লেখার ব্যাপক রীতি ছিল। এ দাবির পক্ষে আহসানুল ফাতাওয়াতে দুটি সময়সূচিকে দৃষ্টান্ত ও প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এক হল, মুনাজ্জিম খাইরুল্লাহকৃত সময়সূচি। অপরটি, হায়দারাবাদের প্রকশিত মিয়ারুল আওকাত

এখন আমাদের বোঝার বিষয়, এই দুটি দৃষ্টান্ত কীসের। কোন্ বিষয়টি প্রমাণের জন্য এবং কোন্ উদ্দেশ্যে এই দুই দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ এই দুই সময়সূচিতে স্পষ্ট ভাষায় সুবহে কাযিবের শব্দ উল্লেখ করে ১৮°-এর সময় দেওয়া হয়েছে- এজন্য এ দুটিকে এই দাবির সপক্ষে পেশ করা হয়েছে? নাকি এগুলোতে পরিষ্কারভাবে সুবহে কাযিব শব্দ আছে- এ কথা বলা উদ্দেশ্য নয়; শুধু সুবহশব্দ বলেই ১৮°-এর সময় উল্লেখ করা হয়েছে। আর আহসানুল ফাতাওয়ার দাবি অনুযায়ী যেখানেই শুধু সুবহশব্দ থাকবে এর দ্বারা উদ্দেশ্য সুবহে কাযিব। তাই স্পষ্টভাবে সুবহে কাযিবের কথা না থাকলেও শুধু সুবহশব্দ আছে তাই বলে এগুলোকে উক্ত দাবির দৃষ্টান্ত ও প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আহসানুল ফাতাওয়ার এই কথাগুলো দ্বারা বাস্তবে উদ্দেশ্য কোনটি?

স্বভাবতঃ আহসানুল ফাতাওয়ার বক্তব্য থেকে প্রথম উদ্দেশ্যটিই বুঝে আসে। অর্থাৎ এই দুটি সময়সূচিতে ১৮°-এর সময়কে স্পষ্ট ভাষায় সুবহে কাযিব শব্দ বলেই উল্লেখ করা হয়েছে। তাই এ দুটি সময়সূচিকে এই দাবির দৃষ্টান্ত ও প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হচ্ছে যে, সময়সূচিগুলোতে ১৮°-এর যে সময় লেখা থাকে তা সুবহে কাযিবের সময়; সুবহে সাদিকের নয়। চাই সেখানে সুবহে কাযিব শব্দ স্পষ্টভাবে লেখা থাকুক বা না থাকুক। আহসানুল ফাতাওয়ার উক্ত বক্তব্যদুটি থেকে বিষয়টি প্রাথমকিভাবে এমনই বুঝে আসে। কথাটি এভাবে বলার পর এমন দৃষ্টান্ত পেশ করাই জরুরি, যাতে স্পষ্টভাবে সুবহে কাযিব বলে ১৮°-এর সময় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আহসানুল ফাতাওয়াতে এখানে এমন কোনো দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়নি। আহসানুল ফাতাওয়াতে বলা হয়েছে-

اہل فن علماء دین نے جب اوقات نماز کے نقشے مرتب کئے تو ان میں بھی احتیاط ومصلحت مذکورہ کی بنا پرصبح صادق کی بجائے عمدا صبح کاذب کے اوقات لکھے۔ چنانچہ نقشۂ منجم خیر اللہ مندرجہ مظاهرالحق شرح مشکوة میں مطلق صبح  کے عنوان کے تحت ১৮ درجہ  زیر افق کے اوقات لکھے،  جو بالاجماع صبح کاذب ہے۔

অর্থাৎ শাস্ত্রজ্ঞ উলামায়ে দ্বীন যখন নামাযের সময়সূচি তৈরি করেছেন, সতর্কতা ও মাসলাহাতের কারণে তারা সুবহে সাদিকের পরিবর্তে ইচ্ছাকৃতভাবেই সুবহে কাযিবের সময় লিখেছেন। যেমন মুনাজ্জিম খাইরুল্লাহকৃত সময়সূচিতে শুধু সুবহবলে ১৮°-এর সময় লেখা হয়েছে। যা সর্বসম্মতভাবে সুবহে কাযিবের সময়। (আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৮৪)

তাহলে তাঁর পেশ করা সময়সূচিতে স্পষ্টভাবে সুবহে কাযিব শব্দ যে লিখা নেই তা তিনি নিজেই বলে দিলেন। তার পরও সময়সূচিতে ইচ্ছাকৃতভাবেই সুবহে সাদিকের পরিবর্তে সুবহে কাযিবের সময় দেওয়া থাকেবারবার এ কথা বলার পর এই সময়সূচিকে এর দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করাটা কতটুকু সঙ্গত হয়েছ! বারবার একটি দাবি করা হল। কিন্তু এর প্রথম যে দৃষ্টান্ত বা প্রমাণ দেখানো হল এতেই সেই দাবি ও তার দলীল কোনো কিছু নেই।

তারপর দেখুন, এই সময়সূচিতে স্পষ্টভাবে যখন সুবহে কাযিব শব্দ নেই; বরং শুধু সুবহশব্দ আছে। তাই যেহেতু উক্ত দাবির পক্ষে এটিকে সরাসরি দৃষ্টান্ত  বা দলীল  হিসেবে উল্লেখ করা যাচ্ছে না, এজন্য এটিকে নিজের দাবির পক্ষে দৃষ্টান্ত ও দলীল বানানোর জন্য এর সাথে নিজ থেকে ভুল একটি দাবি জুড়ে দেওয়া হল যে, ‘১৮° তো সবার ঐক্যমতে সুবহে কাযিবের সময়অতএব এতে যেহেতু ১৮°-এর সময় লেখা হয়েছে তাই তা সুবহে কাযিবের সময়! অথচ এই দাবির পক্ষে ইজমা থাকা তো দূরের কথা, এটি কোনো একজন মুহাক্কিক আলেমের বক্তব্যও নয়। তা যাই হোক, কিন্তু মুনাজ্জিম খাইরুল্লাহ এখানে সুবহে কাযিব উদ্দেশ্য নিয়েছেন- তা কীভাবে জানলেন আহসানুল ফাতাওয়ার লেখক? তর্কের খাতিরে যদি মেনে নেওয়া হয়, তিনি এমনটি উদ্দেশ্য নিয়েছেন, তাও তো এটিকে দৃষ্টান্ত বানানো ঠিক হয়নি। কারণ, দৃষ্টান্ত যদি কোনো কিছু মুকাদ্দার মেনে (নিজ থেকে জোড়া দিয়ে) প্রতিষ্ঠিত করতে হয় তবে তা দৃষ্টান্ত হয় কীভাবে?

মোটকথা, আহসানুল ফাতাওয়াতে যে দাবি করা হয়েছে এই সময়সূচি দ্বারা তা কিছুতেই প্রমাণিত হয় না। এতে সুবহে কাযিব শব্দ নেই। যা আহসানুল ফাতাওয়ার কথা থেকেই পরিষ্কার।

আর যদি বলা হয় আহসানুল ফাতাওয়ার এই কথার উদ্দেশ্য দ্বিতীয়টি। অর্থাৎ এখানে এই কথা বোঝানো হয়নি যে, এই সময়সূচিগুলোতে স্পষ্ট ভাষায় সুবহে কাযিব বলেই ১৮°-এর সময় উল্লেখ করা হয়েছে; বরং শুধু সুবহশব্দ বলেই ১৮°-এর সময় উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু আহসানুল ফাতাওয়ার (ভুল) ধারণা যেহতু সুবহবললেই সুবহে কাযিব বোঝায়, তাই এই সময়সূচিগুলোতে শুধু সুবহশব্দ থাকা সত্ত্বেও একে এই দাবির পক্ষে দলীল হিসেবে পেশ করা হয়েছে। যদি বিষয়টি এমন হয় তাহলে তো কথাগুলো এভাবে বলাই ঠিক হয়নি। কারণ, আহসানুল ফাতাওয়াতে বলা হয়েছে-

نیز انتہاء سحر کے باب میں احتیاط کے پیش نظر عمدابھی صبح کاذب کے اوقات لکھنے کا دستور رہا ہے، ہم گذشتہ مضمون میں اسکی چاند مثالیں بھی پیش کر چکے ہیں۔

অর্থাৎ সেহরির শেষ সময়ের প্রতি লক্ষ্য করে সময়সূচিতে সতর্কতামূলক সুবহে কাযিবের সময় লেখার ব্যাপক রীতি ছিল। আগে আমরা এর কিছু দৃষ্টান্তও পেশ করেছি। (আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৮৫)

অন্যত্র আরো স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে-

اہل فن علماء دین نے جب اوقات نماز کے نقشے مرتب کئے تو ان میں بھی احتیاط ومصلحت مذکور ہ کی  بنا   پرصبح صادق کی بجائے عمدا صبح کاذب کے اوقات لکھے۔

অর্থাৎ, শাস্ত্রজ্ঞ উলামায়ে দ্বীন যখন নামাযের সময়সূচি তৈরি করেছেন, সতর্কতা ও মাসলাহাতের কারণে তারা সুবহে সাদিকের পরিবর্তে ইচ্ছাকৃতভাবেই সুবহে কাযিবের সময় লিখেছেন। (আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৮৪)

এভাবে কথাগুলো বলার পর যখন এর পক্ষে তার পরপরই দুটি দৃষ্টান্ত দেওয়া হল তখন এর থেকে তো স্বাভাবিকভাবে এটিই বুঝে আসে যে, এগুলোতে সুবহে কাযিব শব্দেই এই সময় দেওয়া হয়েছে। তাই এগুলো এই দাবির দৃষ্টান্ত ও প্রমাণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। এমনটি না হলে কথাটি ওভাবে না বলে এভাবে বলার দরকার ছিল যে, ‘নামাযের সময়সূচি তৈরিকারীগণ সতর্কতামূলক সুবহে সাদিকের পরিবর্তে ইচ্ছাকৃতভাবেই শুধু সুবহ শব্দ বলে ১৮°-এর সময় উল্লেখ করেছেন। যার দ্বারা তাদের উদ্দেশ্য সুবহে কাযিবের সময়; সুবহে সাদিক নয়।কথাটি যদি এভাবে বলা হত তাহলে দাবিটি ভুল ও বাস্তবতা বিরোধী হলেও যে উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে তার প্রকাশটা সঠিক হত। যদিও তখনো মুনাজ্জিম খাইরুল্লাহকৃত এই সময়সূচিকে এর দৃষ্টান্ত ও প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করা সহীহ হত না। কারণ, এই দাবির উদ্দেশ্যই যদি হয়, সময়সূচিগুলোতে শুধু সুবহবলেই ১৮°-এর সময় দেওয়া থাকে। আর তা যেহেতু (তাঁর নিকট) সুবহে কাযিবের সময়, তাই এই সময়সূচিতে সুবহবলে সুবহে কাযিবই উদ্দেশ্য করা হয়েছে। তালেবে ইলম ভাইয়েরা বুঝতে পারছেন যে, একে دور বলা হয়। যা প্রমাণ পেশ করার একটি বাতিল পদ্ধতি। এ কথা কে না বোঝে যে, তাঁর উক্ত দাবির পর এর পক্ষে এমন সময়সূচির দৃষ্টান্ত টানার কোনোই অর্থ হতে পারে না, যাতে শুধু সুবহবলেই ১৮°-এর সময় উল্লেখ করা হয়েছে; স্পষ্ট সুবহে কাযিব উল্লেখ নেই, এবং এই সুবহদ্বারা এই সময়সূচি প্রণয়নকারী সুবহে কাযিব উদ্দেশ্য নিয়েছেন- এরও কোনো প্রমাণ নেই। এমন সময়সূচিকে এই দাবির দৃষ্টান্ত ও প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করা মানে যেটি দাবি সেটিকেই দলীল হিসেবে পেশ করা।

মুনাজ্জিম খাইরুল্লাহর সময়সূচিতে বিদ্যমান সুবহশব্দ দ্বারা উদ্দেশ্য

এখন কথা হল, মুনাজ্জিম খাইরুল্লাহকৃত এই সময়সূচিটিতে বিদ্যমান সুবহশব্দ দ্বারা বাস্তবে কী উদ্দেশ্য? জবাব স্পষ্ট। এর দ্বারা সুবহে কাযিব উদ্দেশ্য হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সুবহে সাদিক উদ্দেশ্য হওয়াটাই সুস্পষ্ট ও নির্ধারিত বিষয়। উক্ত সময়সূচি থেকেই বিষয়টি পরিষ্কার।

এই সময়সূচিটি মিশকাতের শরহ মাযাহিরে হকে রয়েছে। এই সময়সূচিটিতে উক্ত সময়ের বিবরণে লেখা হয়েছে-

زمانہ درمیان طلوع صبح کے وطلوع آفتاب کے اور چھپنے آفتاب کے اور غائب ہونے شفق کے۔

অর্থাৎ সুবহএর উদয় থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত মোট সময়ের পরিমাণ এবং সূর্যাস্ত থেকে শাফাকশেষ হওয়া পর্যন্ত মোট সময়ের পরিমাণ। (মাযাহিরে হক ১/১৯৯)

তারপর নিসফুন নাহারছায়ায়ে আছলীর সময় দেওয়া হয়েছে। যার পর থেকেই যোহরের ওয়াক্ত শুরু। এরপর আসরে শাফেয়ীআসরে হানাফীবলে আসরের ওয়াক্ত উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ফজর মাগরিব এশা নামে অন্য কোনো সময় তাতে নেই। এটিই প্রমাণ যে, এর প্রথম ঘরে সুবহশফকশব্দ দ্বারা উদ্দেশ্য সুবহে সাদিক ও শাফাকে আবইয়ায। অর্থাৎ এতে সুবহ’-এর উদয় থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত মোট সময়ের পরিমাণ দ্বারা উদ্দেশ্য ফজরের নামাযের ওয়াক্তের মোট সময়ের পরিমাণ। এবং সূর্যাস্ত থেকে শাফাকশেষ হওয়া পর্যন্ত মোট সময়ের পরিমাণদ্বারা উদ্দেশ্য মাগরিবের ওয়াক্ত শুরু থেকে এশার নামাযের ওয়াক্ত হওয়া পর্যন্ত মোট সময়ের পরিমাণ। যদি এমনটি না হয় তাহলে এই সময়সূচিতে ফজর ও এশার নামাযের ওয়াক্তই থাকছে না। অথচ এটি নামাযেরই সময়সূচি। তাতে বাকি সব নামাযের ওয়াক্ত রয়েছে। তো ফজর ও এশার সময় কেন থাকবে না?

অপরদিকে এই সুবহশাফাকদ্বারা যদি উদ্দেশ্য হয় সুবহে কাযিব ও শাফাকে কাযিব তাহলে এটি অনর্থক একটি সময় হয়ে যায়। কারণ, সুবহে সাদিকের সময় না দিয়ে সুবহে কাযিবের সময় দেওয়া একটি অনর্থক কাজ। এই বিষয় তো আছেই। কিন্তু শাফাকে আহমার বা শাফাকে আবইয়ায কোনোটির সময় না দিয়ে শাফাকে কাযিবের সময় দেওয়া তো এমন অনর্থক, যার ভুল কোনো ব্যাখ্যাও নেই। তাই এটি স্বাভাবিক ও সহজবোধ্য কথা যে, এখানে সুবহশাফাকদ্বারা উদ্দেশ্য সুবহে সাদিক ও শাফাকে আবইয়ায। একে সুবহে কাযিব ও শাফাকে কাযিব মনে করা নিতান্তই ভুল।

তাছাড়া আকাবির উলামায়ে হিন্দও মুনাজ্জিম খাইরুল্লাহর এই সময়সূচির সুবহদ্বারা সুবহে সাদিকই বুঝেছেন। তাঁদের কাছে এটি স্বীকৃত বিষয় ছিল। এর কয়েকটি দৃষ্টান্ত সামনে তুলে ধরা হল।

১. স্বয়ং মাযাহিরে হক কিতাবের গ্রন্থাকার উপমহাদেশের বিশিষ্ট মুহাদ্দিস মাওলানা কুতুবুদ্দীন রাহ.-ও (১২৮৯ হি.), যিনি মুনাজ্জিম খাইরুল্লাহর এই নকশাটি উল্লেখ করেছেন, তিনিও উক্ত নকশাতে বিদ্যমান সুবহশব্দ দ্বারা সুবহে সাদিকই বুঝেছেন। সময়সূচির এই নকশাটি উল্লেখের আগে তিনি বলেছেন-

یہ جدول لکھی جاتی ہے کہ مناسب اس مقام کے ہے، اس میں مقدار ہر مہینے کے سایہ اصلی کی اور اوقات نماز کی اور مقدار شفق وصبح صادق کی لکھی ہے۔ ... یہ جدول مرزا خیر اللہ منجم نے بحسب افق دار الخلافۃ شاہ جہان آباد کے لکھی ہے اور حضرت شاہ ولی اللہ محدث دہلوی نے پسند کی ہے۔

অর্থাৎ এই নকশাটি এখানে উল্লেখ করা হল। যাতে প্রত্যেক মাসের ছায়ায়ে আছলী’-এর পরিমাণ এবং নামাযের সময়সমূহ এবং শাফাক ও সুবহে সাদিকের সময়ের পরিমাণ লেখা আছে। এই নকশাটি মিরযা খাইরুল্লাহ মুনাজ্জিম তৈরি করেছেন শাহজাহানাবাদ দারুল খিলাফার জন্য। এবং হযরত শাহ ওলিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী রাহ. তা পছন্দ করেছেন। (মাযাহিরে হক ১/১৯৮)

২. হযরত মাওলানা আবদুল কাদির রায়পুরী রাহ.-এর পছন্দকৃত رحيمى دوامی جنترى নামক নামাযের একটি চিরস্থায়ী ক্যালেন্ডার রয়েছে। উক্ত সময়সূচিটিতে মাযাহিরে হকে উদ্ধৃত এই সময়সূচিটিও উল্লেখ করা হয়েছেতবে মাযাহিরে হকে এর সময়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে ইলমে তানজীমের পরিভাষায়। رحيمى دوامی جنترى তে এই সময়গুলো ঘণ্টা, মিনিট ও সেকেন্ডে রূপান্তর করে তুলে ধরা হয়েছে। এই সময়সূচিটিতে মাযাহিরে হকে উল্লেখিত সুবহশব্দের স্থলে স্পষ্ট ভাষায় সুবহে সাদিক শব্দ লেখা হয়েছে। উক্ত ক্যালেন্ডারটিতে ১৮°-এর এই সময়টির বিবরণ এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে-

صبح صادق سے طلوع آفتاب اور غروب سے غیبوبت شفق تک کے اوقات۔

অর্থাৎ সুবহে সাদিক থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত মোট সময় এবং সূর্যাস্ত থেকে শাফাক শেষ হওয়া পর্যন্ত মোট সময়।

(দেখুন : প্রফেসর আবদুল লতীফকৃত সুবহে সাদিক ওয়া সুবহে কাযিব’, পৃ. ১১৭)

৩. ১৩১৩ হি. মোতাবেক ১৮৯৬ ঈ. সালে ভারতের রামপুর রাজ্যের মুফতী মাওলানা লুতফুল্লাহ রাহ. حل الدقائق في تحقيق الصبح الصادق নামে নামাযের সময়সূচি সংক্রান্ত একটি পুস্তিকা সংকলন করেন। এতেও তিনি মুনাজ্জিম খাইরুল্লাহকৃত সময়সূচিটি উল্লেখ করেছেন। এর শুরুতে তিনি লিখেছেন-

یہ نقشہ خیر اللہ منجم متعلق صبح صادق ہے

অর্থাৎ খাইরুল্লাহ মুনাজ্জিমকৃত এই নকশা যা সুবহে সাদিক সম্পর্কে।

অতঃপর সুবহের উক্ত সময়ের ঘরটির উপরে তিনি লিখেছেন-

مقدار صبح صادق

অর্থাৎ সুবহে সাদিকের পুরো সময়ের পরিমাণ। (হাল্লুদ দাকাইক, পৃ. ২৮)

৪. এই পুস্তিকাটির শেষে মাওলানা লুতফুল্লাহ রাহ. হাফিজ মুহাম্মাদ আলা মিরাঠী রাহ.-এর একটি প্রশ্ন ও আকাবির উলামায়ে হিন্দের জবাব তুলে ধরেছেন। এর মধ্যে একটি জবাব হল শাইখুল হিন্দ হযরত মাওলানা মাহমুদ হাসান রাহ. (১৩৩৯ হি.)-এর। এতে হযরত শাইখুল হিন্দ রাহ. বলেছেন-

مطابق نقشہ مجوزہ خیر اللہ منجم جس کو شاہ صاحب نے پسند فرمایا مقدار صبح صادق ایک گہنٹہ 22 منٹ کسرے زائد ہونا چاہیے، تو اس کے موافق آپ نے جو ایک گہنٹہ 24 منٹ کی مقدار معین کی ہے تو گویا دو منٹ احتیاط کی سمجھنی چاہیے، اور اس وقت اکل وشرب سے احتیاطا روک دیا ہے، جو نہایت مناسب ہے، پرتال کے بعد یہ نقشہ صحیح معلوم ہوتا ہے، جزاکم اللہ۔ محمود حسن عفی عنہ

হযরত শাইখুল হিন্দ রাহ.-এর এই জবাব থেকেও প্রমাণিত যে, তাঁর নিকট মুনাজ্জিম খাইরুল্লাহর এই সময়সূচির সুবহশব্দ দ্বারা উদ্দেশ্য সুবহে সাদিক; সুবহে কাযিব নয়। সাথে সাথে তিনি এ কথাও বলেছেন যে, শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবী রাহ. এই সময়সূচিটি পছন্দ করেছেন। (হাল্লুদ দাকাইক, পৃ. ৩৮)

৫. হাফিজ মুহাম্মাদ আলা মিরাঠীও তার صبح صادق নামক পুস্তিকার একাধিক জায়গায় মুনাজ্জিম খাইরুল্লাহর এই সময়সূচির কথা উল্লেখ করেছেন এবং এটিকে সুবহে সাদিকের সময় হিসেবেই তুলে ধরেছেন। আর তখনকার আকাবির উলামায়ে দেওবন্দের মধ্যে শাইখুল হিন্দ হযরত মাওলানা মাহমুদ হাসান রাহ., মাওলানা মানফাআত আলী রাহ., মুফতী আযীযুর রহমান রাহ., মাওলানা আহমদ ইবনে মুহাম্মাদ কাসেম নানুতুবি রাহ., মাওলানা হাবীবুর রহমান উসমানী রাহ. ও মাওলানা নাযির হাসান রাহ.-সহ আরো বিভিন্ন উলামায়ে কেরাম এই পুস্তিকাটি সত্যায়ন করেছেন। (দেখুন : সুবহে সাদিক, মুহাম্মাদ আলা মিরাঠী, পৃ. ২৮-৩০)

৬. এই পুস্তিকাটিতে মুহাম্মাদ আলা মিরাঠী রাহ. কাযী মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রাহমান নামের একজন আলেমের বক্তব্য তুলে ধরেছেন। এই আলেমের পরিচয়ে তাতে বলা হয়েছে, তিনি ইলমে নুজুম, ইলমুল হাইআহ ও রিয়াযিরও মাহের ছিলেন। তাঁর এই বক্তব্যে আছে-

کیونکہ بقول ان کے بجائے 18 درجہ کے جو مختار خیر اللہ منجم ہے 15 درجہ پر صبح صادق ہوتی ہے جیساکہ حاشیہ مالابد منہ پر ہے، جن کتب مالابد منہ وغیرہ میں نقشہ خیر اللہ منجم منقول ہے انمیں یہ مقدار صبح صادق سے طلوع آفتاب تک بیان کی گئی ہے۔ ... میں نے مکہ معظمہ کے ایک نقشہ رمضان المبارک بابت 1308 ہجری اور انگلستان ایران مصر قسطنطنیہ کی جنتریوں کو منگوا کر دیکھا، ان میں اوقات صبح صادق اسی قاعدہ کے رو سے درج ہے جو مختار خیر اللہ منجم اور پسندیدہ حضرت شاہ ولی اللہ صاحب محدث دہلوی ودیگر اکابر دین ہے۔

এখানে স্পষ্ট ভাষায় তিনিও বলেছেন, মুনাজ্জিম খাইরুল্লাহর নিকট সুবহে সাদিক হয় ১৮°-এ। যত কিতাবে মুনাজ্জিম খাইরুল্লাহর সময়সূচিটি উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোতে এই পরিমাণটি উল্লেখ করা হয়েছে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত মোট সময়ের। ...মক্কা মুকাররামা, ইংল্যান্ড, ইরান, মিসর ও কনস্ট্যান্টিনোপল-এর ক্যালেন্ডার সংগ্রহ করে দেখেছি। এগুলোতেও মুনাজ্জিম খাইরুল্লাহর নিয়ম অনুযায়ী সুবহে সাদিকের সময় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। যেটি হযরত শাহ ওলিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী ও অন্যান্য আকাবিরে দ্বীনের নিকট পছন্দনীয়। (সুবহে সাদিক, মুহাম্মাদ আলা মিরাঠী, পৃ. ৫৩)

৭. ইমদাদুল আহকামে একটি প্রশ্নের জবাব থেকেও স্পষ্ট যে, মাযাহিরে হকের এই সময়টি সুবহে সাদিকের; সুবহে কাযিবের নয়। ইমদাদুল আহকামে আছে-

سوال: آیا جناب کے علم میں گھڑی کے حساب سے کچھ وقت مقرر ہے کہ آجکل رمضان میں غروب شمس سے کتنی دیر کے بعد وقت عشاء کا شروع ہوجاتا ہو اور مختلف فیہ کب سے اور متفق علیہ کب سے اور ایسے ہی صبح صادق سے طلوع شمس تک کتنا وقت ہے؟

الجواب: ہر موسم میں تقریباً ڈیڑھ گھنٹہ ہوتا ہے مابین غروب ووقت عشاء اور مابین فجر وطلوع بھی، اور ہر زمانہ میں جو قدرے تفاوت ہوتا ہے وہ مظاہر حق سے یا  اسلامی جنتری سے جو سہارنپور میں ملتی ہے معلوم کریں۔

এখানে সুবহে সাদিক থেকে সূযোর্দয় পর্যন্ত মোট সময়ের পরিমাণ কতটুকু হয় প্রশ্নকারীকে তা মাযিহিরে  হক্বের মাধ্যমে জেনে নিতে বলা হয়েছে। (ইমদাদুল আহকাম ১/৪০৯)

অতএব মুনাজ্জিম খাইরুল্লাহকৃত সময়সূচির নকশাটিতে সুবহবলে যে সময় দেওয়া আছে এর দ্বারা সুবহে সাদিক উদ্দেশ্য হওয়ার বিষয়টি আকাবির উলামায়ে হিন্দের নিকট একটি স্বীকৃত বিষয়। মাওলানা কুতুবুদ্দীন রাহ. (১২৮৯ হি.) ও শাইখুল হিন্দ হযরত মাওলানা মাহমুদ হাসান রাহ. (১৩৩৯ হি.)-এর বক্তব্য থেকে এটিও বোঝা যায় যে, হযরত মাওলানা শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবী রাহ. (১১৭৬ হি.)-ও এটিকে সুবহে সাদিকের সময়ই মনে করতেন এবং নামাযের সময় জানার জন্য মানুষকে এই নকশা অনুসরণের নির্দেশনা দিতেন ।

মোটকথা, মুনাজ্জিম খাইরুল্লাহকৃত এ সময়সূচিটিতে সুবহে কাযিবের সময় লেখা নেই। যা স্বয়ং আহসানুল ফাতাওয়ার কথা থেকেই সুস্পষ্ট। এবং শুধু সুবহশব্দ বলে এতে যে সময়টি দেওয়া হয়েছে এর দ্বারা উদ্দেশ্য সুবহে সাদিক। একে সুবহে কাযিব আখ্যা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যা উক্ত সময়সূচি থেকেই সহজেই বোধগম্য। আকাবির উলামায়ে হিন্দও ব্যাপকভাবে এটিকে সুবহে সাদিকের সময় হিসেবেই গ্রহণ করেছেন এবং নামাযের সময় জানার জন্য মানুষকে এই নকশা অনুসরণের নির্দেশনা দিতেন।

তাছাড়া আমরা পূর্বে বিভিন্ন দলীল-প্রমাণ দিয়ে দেখিয়ে এসেছি, শুধু সুবহশব্দ বলে কোথাও সুবহে কাযিব উদ্দেশ্য নেওয়া হয় না; বরং সুবহে সাদিকই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। মুনাজ্জিম খাইরুল্লাহকৃত এই সময়সূচিও এর একটি দৃষ্টান্ত। সবার স্বাভাবিক রীতি অনুযায়ীই তাতে শুধু সুবহশব্দ বলে সুবহে সাদিক উদ্দেশ্য নেওয়া হয়েছে।

সর্বোপরি, এই সময়সূচিতে শুধু সুবহবলে যেহেতু ১৮°-এর সময় দেওয়া হয়েছে তাই এটি সুবহে সাদিক ছাড়া অন্য কিছু হওয়ার সুযোগই নেই। কেননা ইজমা ও মুশাহাদা দ্বারা প্রমাণিত, সুবহে সাদিক ১৮°-এর ভেতর হয়ে যায়। আর সুবহে কাযিব এর আগেই শেষ হয়ে যায়।

সুতরাং এই সময়সূচিকে আহসানুল ফাতাওয়ার উক্ত বাস্তবতা বিরোধী দাবির সপক্ষে উল্লেখ করাটা সম্পূর্ণ অনর্থক।

মিয়ারুল আওকাত’-এর দৃষ্টান্ত ও বাস্তবতা

বাকি থাকল মিয়ারুল আওকাতপ্রসঙ্গ; আহসানুল ফাতাওয়াতে যাকে উক্ত দাবির দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে পেশ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রথম কথা হল, ফজর ও এশার ওয়াক্তের হিসাব প্রদানের ক্ষেত্রে এই সময়সূচিটি (মিয়ারুল আওকাত) এতই ভুল ও অসঙ্গতিপূর্ণ, যা এই বিষয়ে আহসানুল ফাতাওয়ার ভুলগুলোকেও ছাড়িয়ে গেছে। তাতে এমন ভুলও আছে, যা আহসানুল ফাতাওয়ার দৃষ্টিতেও সঠিক নয়। তাই এই সময়সূচিটি মূলত নির্ভরযোগ্যই নয়। এর উদ্ধৃতি দেওয়াই সঠিক নয়। تحقیقات جدیدہ -এর পর্যালোচনাশিরোনামের অধীনে সামনে এর উপর বিস্তারিত আলোচনা তুলে ধরা হবে ইনশাআল্লাহ। এখানে এই প্রসঙ্গের সাথে সংশ্লিষ্ট শুধু একটি কথা বলা হচ্ছে। তা হল, এই সময়সূচি সঠিক আর বেঠিক যেমনটিই হোক, সে আরেক বিষয়; কিন্তু যে দাবির সপক্ষে আহসানুল ফাতাওয়াতে একে দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, তাতেও বিষয়টি এভাবে নেই। একেও  আহসানুল ফাতাওয়ার এই দাবির দৃষ্টান্ত হিসেবে পেশ করা সঠিক নয়। কারণ, আহসানুল ফাতাওয়ার দাবি হল, ‘শাস্ত্রজ্ঞ উলামায়ে দ্বীন ইচ্ছাকৃতভাবেই নামাযের সময়সূচিতে সুবহে সাদিকের পরিবর্তে সুবহে কাযিবের সময় লিখেতেনঅথচ মিয়ারুল আওকাতে সুবহে সাদিকের সময় উল্লেখ করা হয়েছে। انتہائے وقت سحر (সেহরির শেষ সময়) বলে তাতে একটি সময় দেওয়া আছে। আরেকটি সময় দেওয়া আছে ابتداء وقت فجر (ফজরের ওয়াক্ত শুরু) নামে। মিয়ারুল আওকাতে এই ابتداء وقت فجر (ফজরের ওয়াক্ত শুরু) দ্বারা উদ্দেশ্য সুবহে সাদিকের সময়। মিয়ারুল আওকাতে এই সময়টির বিবরণে বলা হয়েছে-

اس میں ابتداء وقت نماز فجر تاریخوار درج ہے۔

অর্থাৎ ابتداء وقت فجر -এর ঘরে প্রত্যেক তারিখে ফজরের নামাযের ওয়াক্ত কখন শুরু হয় তা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। (মিয়ারুল আওকাত ১/২৫)

অথচ আহসানুল ফাতাওয়াতে সময়সূচিতে সুবহে সাদিকের সময় উল্লেখ না থাকার প্রমাণ বা দৃষ্টান্ত হিসেবে এটিকে উল্লেখ করা হয়েছে। তাহলে এখানেও আহসানুল ফাতাওয়ার দাবি ও দলীলে মিল থাকল না।

অপরদিকে তাতে انتہائے وقت سحر (সেহরির শেষ সময়) বলে যে সময়টি দেওয়া হয়েছে সেটিও ১৮°-এর সময় নয়। মিয়ারুল আওকাতেই স্পষ্টভাবে আছে যে, انتہائے وقت سحر (সেহরির শেষ সময়) বলে তাতে সতর্কতামূলক ১৮°-এরও দশ মিনিট আগের সময় লেখা হয়েছে। (মিয়ারুল আওকাত ১/২৫) অথচ আহসানুল ফাতাওয়ার দাবি হল-

نیز انتہاء سحر کے باب میں احتیاط کے پیش نظر عمدابھی صبح کاذب کے اوقات لکھنے کا دستور رہا ہے، ہم گذشتہ مضمون میں اسکی چاند مثالیں بھی پیش کر چکے ہیں۔

অর্থাৎ انتہائے سحر (সেহরির শেষ সময়) -এর ক্ষেত্রে সতর্কতামূলক ইচ্ছাকৃতভাবেই সুবহে কাযিবের সময় লেখার ব্যাপক প্রচলন ছিল। যার কয়েকটি দৃষ্টান্ত (অর্থাৎ মুনাজ্জিম খাইরুল্লাহকৃত সময়সূচি ও মিয়ারুল আওকাত) পেছনে আমরা তুলে ধরেছি। (আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৮৫)

তাহলে দেখা গেল, মিয়ারুল আওকাতের সাথে আহসানুল ফাতাওয়ার এই দাবিটির কোনো অংশেরই মিল থাকল না।

এখন দেখুন, আহসানুল ফাতাওয়াতে এক্ষেত্রে একটি ব্যাপক রীতির দাবি করা হল। অনেকবারই তাতে দাবিটি উল্লেখ করা হল। কিন্তু এর ভিত্তি? কিছুই নেই! দাবি তো করা হল অনেকবার। দাবির উপস্থাপনা-ভাষাও খুব জোরালো; কিন্তু প্রমাণ? প্রমাণ হল, শুধু দুইটি সময়সূচি। যে দুই সময়সূচিতেও এই দাবির সপক্ষে কোনো কিছু তো নেই-, আছে বরং দবিটির উল্টো তথ্য। এভাবে দলীল-প্রমাণবিহীন শুধু বারবার মজবুত ভাষায় দাবি করাটাই আহসানুল ফাতাওয়ার সুবহে সাদিক পুস্তিকাটির ব্যাপক রীতি!

***

এ তো গেল আহসানুল ফাতাওয়ার এই বক্তব্যদুটির ভেতর কী কী অসঙ্গতি ও আপত্তিকর দিক আছে এর বিবরণ। এখন আমরা ফিরে আসি মূল প্রসঙ্গে। এখানে মূল প্রসঙ্গ ছিল, ইবনে আবেদীন রাহ. প্রদত্ত মিশর ও শামের ফজরের মোট সময়ের হিসাব সম্পর্কিত আলোচনা। ইবনে আবেদীন রাহ.-এর এই বক্তব্য দ্বারা ১৮°-এ সুবহে সাদিক প্রমাণিত হয়। এখন দেখার বিষয়, ইবনে আবেদীন রাহ.-এর এই বক্তব্যের উপর আহসানুল ফাতাওয়ার একথা বলার কী উদ্দেশ্য যে, ‘শাস্ত্রজ্ঞ উলামায়ে দ্বীন ইচ্ছাকৃতভাবেই নামাযের সময়সূচিতে সুবহে সাদিকের পরিবর্তে সুবহে কাযিবের সময় লিখতেন’? তার মানে কি ইবনে আবেদীন রাহ. মিশর ও শামের এই সময় কোনো সময়সূচি দেখে বলেছেন, আর সেই সময়সূচিতে সুবহে কাযিবের সময় দেওয়া ছিল, কিন্তু তিনি তা না বুঝে এটিকে সুবহে সাদিকের সময় মনে করেছেন এবং এর ভিত্তিতেই এই হিসাব দিয়েছেন? এই যদি উদ্দেশ্য হয় তাহলে এটি ইবনে আবেদীন রাহ.-এর উপর আরেক অপবাদ। সাথে সাথে তার বক্তব্যের বড় ধরনের আরেক বিকৃতিও বটে। যা আমাদের আগের আলোচনা থেকেই পরিষ্কার।

তার মানে, আল্লামা ইবনে আবেদীন রাহ. ফালাকীগণের বক্তব্যও ভুল বুঝেছেন এবং শাস্ত্রজ্ঞ উলামায়ে দ্বীন কতৃর্ক প্রণিত সময়সূচি বুঝতেও ভুল করেছেন! ইবনে আবেদীন রাহ.-এর এই বক্তব্যটি উভয় রকম বিভ্রান্তি নির্ভর!! আল্লামা ইবনে আবেদীন রাহ.-এর মত মুহাক্কিক আলেম ও ফকীহ নামায-রোযার ওয়াক্তের মত ফরয বিষয়ে আহসানুল ফাতাওয়ার দৃষ্টি অনুযায়ী যদি এত বিভ্রান্তিনির্ভর ভুল মাসআলা বর্ণনা করে থাকেন তাহলে আমাদের আর কী বলার থাকতে পারে!

খলীল কমেলী রাহ.-এর বক্তব্য ও পর্যালোচনা

পূর্বে আমরা আলোচনা করেছি যে, সুবহে সাদিক ও সুবহে কাযিবের মাঝে তিন ডিগ্রি ব্যবধানের বক্তব্যটি সঠিক-বেঠিক যেমনই হোক এ কথা দ্বারা আহসানুল ফাতাওয়ার কোনো দাবি প্রমাণিত হয় না। এতএব এটিকে ১৮°-এ সুবহে কাযিব এবং ১৫°-এ সুবহে সাদিকের পক্ষে দলীল হিসেবে পেশ করাটাই ঠিক নয়। এ তো গেল এক বিষয়। এখন আমরা দেখাতে চাচ্ছিতিন ডিগ্রি ব্যবধানের এই বক্তব্যটিই শাস্ত্রীয় বিচারে কতটুকু সঠিক। বাস্তবতা হল, স্বয়ং এ বক্তব্যটিই ঠিক নয়। শাস্ত্রীয় বিচারে এতে অনেক অসঙ্গতি ও স্থূল ভুল রয়েছে।

১. পূর্বে আমরা আলোচনা করে এসেছি, সুবহে কাযিবকে নিধার্রিত কোনো ডিগ্রি বা সময়ের মাধ্যমে নির্ণয় করাটাই ঠিক নয়। কেননা তা প্রতি দিন নির্ধারিত এক সময়ে দেখা যায় না। এ কারণেই হয়ত শাস্ত্রজ্ঞ কেউই, চাই প্রাচীন মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানী হোন বা আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানী, কারো থেকে একথা প্রমাণিত নেই যে, সুবহে কাযিব (জোডিয়াকাল লাইট) শুরু হয় এত ডিগ্রিতে। সুবহে কাযিব (জোডিয়াকাল লাইট) কখন বা কত ডিগ্রিতে শুরু হয় এমন কথা তাদের কারো থেকে পাওয়া যায় না।

খলীল কামেলী রাহ.-এর বক্তব্য অনুযায়ী সুবহে সাদিক ও সুবহে কাযিবের মাঝে তিন ডিগ্রি ব্যবধান। আর শাস্ত্রজ্ঞগণের নিকট সুবহে সাদিক শুরু হয় ১৮°-এর ভেতর । সে অনুযায়ী সুবহে কাযিব শুরু হওয়ার কথা ২১ ডিগ্রিতে। কিন্তু শাস্ত্রজ্ঞ কারো থেকে আপনি এমন একটি কথাও পাবেন না। উপরন্তু মুশাহাদা দ্বারা সুবহে সাদিকের ১০° আগেও সুবহে কাযিব শুরু হওয়া প্রমাণিত। যার বিবরণ পূর্বে তুলে ধরা হয়েছে।

অতএব শাস্ত্রীয় বক্তব্য ও বাস্তব মুশাহাদা উভয় দিক থেকে সুবহে সাদিক ও সুবহে কাযিবের মাঝে তিন ডিগ্রি ব্যবধানের বক্তব্যটি গোড়া থেকেই ভিত্তিহীন।

২. বাস্তবতা হল, এ কথার ভিত্তিও বিরজান্দী রাহ.-ই। খলীল কামেলী রাহ. (১২০৭ হি.)-এর এই কথাটি এসেছে মূলত বিরজান্দী রাহ.-এর বক্তব্য থেকেই। বিরজান্দী রাহ. বলেছেন, সুবহে কাযিব হয় ১৮°-আর সুবহে সাদিকের ক্ষেত্রে বলেছেন, তা কখন শুরু হয় সেটি তাহকীকের সাথে জানা যায় না। তবে বলা হয়েছে, তা শুরু হয় ১৫°-এ। এ কথা থেকেই খলীল কামেলী রাহ. এই নিয়ম বানিয়েছেন যে, সুবহে সাদিক ও সুবহে কাযিবের মাঝে তিন ডিগ্রি ব্যবধান। এ ছাড়া এ কথাটির আর কোনো সূত্র নেই। হতে পারে, তিনি সরাসরি বিরজান্দীর বক্তব্য না পড়ে অন্য কারো বক্তব্য থেকে বিরজান্দীর কথাটি গ্রহণ করেছেন। আর বিরজান্দী রাহ.-এর বক্তব্যটি যে শাস্ত্রজ্ঞগণের ইজমা পরিপন্থী শায ও বিচ্ছিন্ন কথা তা তো পূর্বের আলোচনা থেকেই স্পষ্ট। অতএব এর উপর ভিত্তিকৃত খলীল কামেলী রাহ.-এর এ কথাটিও যে শাস্ত্রীয় বিচারে সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

৩. খলীল কামেলী রাহ.-এর এ বক্তব্যে আছে, শাফাকে আবইয়ায ও শাফাকে আহমারের মাঝে তিন ডিগ্রি ব্যবধান। আর আহসানুল ফাতাওয়ার মতে সুবহে সাদিক যেমন শুরু হয় ১৫°-, তেমনি শাফাকে আবইয়ায শেষ হয় ১৫°-এ। এ হিসেবে আহসানুল ফাতাওয়াতে বলা হয়েছে, শাফাকে আহমার শেষ হয় ১২°-এ। (আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৮৬) অথচ এ কথা কোনোভাবেই সঠিক নয়। ১২°-এ শাফাকে আহমার শেষ হয়ে যাওয়ার কোনো প্রমাণ নেই। এটিও শাস্ত্রজ্ঞগণের ইজমা পরিপন্থী কথা। ১৬°-এর আগে শাফাকে আহমার শেষ হওয়ার কোনো প্রমাণ নেই। বরং  শাস্ত্রজ্ঞগণের কেউ কেউ ১৬°-এ শাফাকে আহমার শেষ হওয়ার কথা বললেও তাঁদের নিকট গ্রহণযোগ্য মত অনুযায়ী শাফাকে আহমার শেষ হয় ১৭°-এ। জগদ্বিখ্যাত মুসলিম ফালাকী ইবনে শাতির রাহ. [৭০৪-৭৭৭ হি./১৩০৪-১৩৭৫ ঈ.] বলেন-

الباب السادس والسبعون من المائة الثانية في معرفة أول وقت العشاء: وهو يدخل بغيبوبة الشفق الأحمر، وهي الحمرة التي دون البياض والصفرة، وقد رصدت ارتفاع النظير وانحطاط الشمس عند أول وقتها، فكان 16 درجة، وهو على ما ذكره المراكشي، وعليه عمل أهل مصر قاطبة في زماننا هذا. وقال ابن العديم أنه حرره فوجده 14 درجة، وهو بعيد عن الصحيح، والعمل على ما ذكره أبو علي (المراكشي)، يجب تمكين درجة واحدة ارتفاعية، وهو رأي البوزجاني والبيروني والنصير الطوسي والمؤيد العرضي.

এখানে তিনি বলেছেন, আমি শাফাকে আহমার কখন শেষ হয় তা মুশাহাদা করেছি। দেখেছি তা শেষ হয় ১৬°-এ। আবু আলী আলমার্রাকুশী এমনটিই বলেছেন। আমাদের এ যুগে মিসরবাসীর আমল এ আনুযায়ীই চলছে। আর ইবনুল আদীম ১৪°-এর কথা লিখেছেন। কিন্তু তা সহীহের সীমানা থেকে দূরবতীর্। বরং আবু আলী আলমার্রাকুশী যেমনটি বলেছেন (১৬°) এ অনুযায়ীই বর্তমানে আমল হচ্ছে। আর বুযজানী, আলবেরুনী, নাসীরুদ্দীন তূসী ও মুআইয়িদ আলউরযির মতে শাফাকে আহমার শেষ হয় এর আরো এক ডিগ্রি পর (অর্থাৎ ১৭°-এ)।

দেখুন-

আননাফউল আম্ ফিল আমালি বিররুবুইত তাম, ইবনে শাতির রাহ. (তাহকীক : উসামা ফাতহী ইমাম, দারুল কুতুব ওয়াল ওয়াসাইকিল কাওমিয়্যা, মিসর), পৃ. ২৪৬-২৪৭

লক্ষ্য করুন, ইবনে শাতির রাহ. এখানে বলেছেন, শাফাকে আহমার ১৪°-এ শেষ হয়ে যাওয়ার কথাটিই সঠিক নয়। এটি সঠিক মত থেকে অনেক দূরবতীর্ কথা। বরং শাফাকে আহমার শেষ হয় ১৬°/১৭°-এ। এখন ভেবে দেখুন, যেখানে তারা ১৪°-এ শাফাকে আহমার শেষ হয়ে যাওয়ার কথাটিকেই ভুল বলছেন, সেখানে ১২ ডিগ্রিতেই শাফাকে আহমার শেষ হয়ে যাওয়ার কথাটি কী পরিমাণ বাস্তবতা বিরোধী এবং শাস্ত্রজ্ঞগণের অভিমত থেকে কত দূরবতীর্ ভুল কথা!!

ইলমুল ফালাক ও ইলমুত তাওকীতের আরেক বিশেষজ্ঞ আলেম জামালুদ্দীন আলমারদানী রাহ. (মুত্যু ৮০৯ হি./১৪০৬ ঈ.) বলেন-

الثامن والعشرين في معرفة حصتي الشفق والفجر: الشفق هو  الحمرة التي تبقى في أفق المغرب بعد مغيب الشمس وحصته قوس من مدار الجزء ما بين الأفق والمقنطرة المنحطة تحته سبع عشرة درجة. ... وقال بعض المتأخرين في الشفق ستة عشر وفي الفجر عشرين، وهو ضعيف لقلة من قال به من الرصاد ... والذي اعتمد عليه محققو هذا العلم من الرصاد وغيره سبعة عشر في الشفق وتسعة عشر في الفجر.

এখানে তিনি বলেছেন, এই শাস্ত্রের মুহাক্কিকগণের নিকট শাফাকে আহমার শেষ হয় ১৭°-এ। মুতাআখখিরীনের কেউ কেউ ১৬°-এর কথা বললেও তা দুর্বল অভিমত।

দেখুন-

আদ্দুররুল মানসূর ফিল আমালি বিরুবুইদ দুসতূর, মাখতুত: আলমাকতাবাতুল আযহারিয়্যা মিসর, মাখতুত নম্বর ৭৬৬০, পাতা ৫১

এখানে তিনি ১৬°-এর অভিমতকেই দুর্বল আখ্যা দিয়েছেন এবং বলেছেন, শাস্ত্রের মুহাক্কিকগণের অভিমতে শাফাকে আহমার শেষ হয় এরও এক ডিগ্রি পর ১৭°-এ।

আমাদের লেখাটির প্রথম কিস্তি, যা এপ্রিল-মে ২০১৯-এর সংখ্যায় ছেপেছিল, তাতে আমরা আলহামদু লিল্লাহ অনেক মুসলিম ফালাকী ও মুওয়াক্কিতের বক্তব্য তুলে ধরেছি। তাঁদের বক্তব্যেও শাফাকে আহমার ১৭°-এ শেষ হওয়ার কথাই আছে।

তাছাড়া ১৫° এমনকি ১৬°-এর পরও শাফাকে আহমার দেখা যাওয়ার বিষয়টি বর্তমান যুগের মুশাহাদা দ্বারাও প্রমাণিত। পাকিস্তান সেন্ট্রাল হেলাল কমিটির সাবেক সদস্য জনাব শাব্বীর আহমাদ কাকাখিল সাহেব ১৯৮৩ সালে সুবহে সাদিক ও শাফাক উভয়টি মুশাহাদা করেন। তখন তিনি দুই বার ১৫°-এর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত শাফাকে আহমার দেখেছেন। আর একবার ১৫.৫° ও আরেক বার ১৬.৫° পর্যন্তও শাফাকে আহমার মুশাহাদা করেছেন।

দেখুন-

صبح صادق اور صبح کاذب کے بارے میں ایک علمی اور تحقیقی جائزہ،  سید شبیر احمد کاکاخیل ص6۔

মোটকথা, মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ যেখানে ১৬°-এর অভিমতকেই দুর্বল বলেছেন এবং ১৪°-এর বক্তব্যকে সম্পূর্ণ ভুল আখ্যা দিয়েছেন সেখানে ১২ ডিগ্রিতেই শাফাকে আহমার শেষ হয়ে যাওয়ার কথা বলা কত বড় ভুল তা নিজেই ভেবে দেখুন!

খলীল কামেলী রাহ.-এর পূর্ণ বক্তব্য ও এর পর্যালোচনা

৪. রদ্দুল মুহতারে খলীল কামেলী রাহ.-এর বক্তব্য শুধু এতটুকু উল্লেখ করা হয়েছে-

إن التفاوت بين الفجرين وكذا بين الشفقين الأحمر والأبيض إنما هو بثلاث درج.

অর্থাৎ সুবহে সাদিক ও সুবহে কাযিব এবং শাফাকে আহমার ও শাফাকে আবইয়াযের মাঝে তিন ডিগ্রি ব্যবধান।

স্পষ্টত এ বক্তব্যটিতে সুবহে সাদিক ও সুবহে কাযিব এবং শাফাকে আহমার ও শাফাকে আবইয়ায কোন্টি কত ডিগ্রিতে শুরু হয় বা শেষ হয় এর কোনো বিবরণ নেই। তা সত্ত্বেও আহসানুল ফাতাওয়াতে এটিকে ১৫° সুবহে সাদিক ও শাফাকে আবইয়াযের সপক্ষে দলীল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যার উপর পর্যালোচনা পূর্বে তুলে ধরা হয়েছে।

সামনে খলীল কামেলী রাহ.-এর পূর্ণ বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। তাতে যেমন খলীল কামেলী রহ.-এর উক্ত দাবির ভ্রান্তি ফুটে উঠে, তেমনি এর উপর ভিত্তি করে আহসানুল ফাতাওয়াতে যা বলা হয়েছে তার অসারতাও স্পষ্ট হয়ে যায়।

খলীল কামেলী রাহ. (১২০৭ হি.) এ কথাটি বলেছেন আলী আফেন্দী দাগিস্তানী রাহ. (১১৯৯ হি.)কৃত কাইফিয়্যাতুল আমালি বিলআসতারলাবপুস্তিকার টীকায়। অর্থাৎ মূল পুস্তিকাটি দাগিস্তানী রাহ.-এর লেখা। এই পুস্তিকাটির পূর্ণ বক্তব্য প্রথমে তুলে ধরা হল-

الباب الخامس عشر في معرفة طلوع الفجر الكاذب والصادق وغروب الشفق الأحمر والأبيض: خذ ارتفاع كوكب من الكواكب المثبته في العنكبوت، ثم ضع شظيته على مقنطرة ذلك الارتفاع، وانظر إلى نظير درجة الشمس في تلك الحالة على أي مقنطرة وقع، فما كان فهو مقدار ارتفاع ظل الأرض، فإن كان غربيا زائدا على ثمانية عشر لم يطلع الفجر الكاذب، وإن كان أقل فقد طلع، وإن كان ثمانية عشر يكون أول طلوع الفجر الكاذب. وإن كان شرقيا أقل من ثمانية عشر لم يغرب الشفق الأبيض، وإن كان ثمانية عشر يكون انتهاء غروبه، وإن كان أكثر يكون غاربا. وإن استعملت خمسة عشر مكان ثمانية عشر في هذه الأعمال يكون الحاصل الفجر الصادق والشفق الأحمر، والأحوط أن يعمل في الفجر بأربعة عشر وفي الشفق بستة عشر كما لا يخفى.

দেখুন-

কাইফিয়্যাতুল আমালি বিলআসতারলাব, আলী আফেন্দী দাগিস্তানী, মাখতুত (১) : মাজলিসে শূরা, মিল্লী, ইরান, মাখতুত নং ১৬০৮৭, পাতা ১০; মাখতুত (২) : চ্যাস্টার বিতি আয়ারল্যান্ড, মাখতুত নং ৫৪৯৬

এখানে আলী আফেন্দী দাগিস্তানী (১১৯৯ হি.) রাহ. বলেছেন, সুবহে কাযিব হয় ১৮°-এ এবং সুবহে সাদিক হয় ১৫°-এ। আর শাফাকের ক্ষেত্রে বলেছেন, শাফাকে আহমার শেষ হয় ১৫°-এ এবং শাফাকে আবইয়ায শেষ হয় ১৮°-এ।

এখানে লক্ষণীয় যে, আলী আফেন্দী দাগিস্তানী রাহ. দ্বাদশ হিজরী শতাব্দীর জনৈক আলেম। তার ওফাত ১১৯৯ হিজরীতে। আর বিরজান্দী রাহ. হলেন দশম হিজরী শতাব্দীর। অতএব দাগিস্তানী রাহ.-এর কথাটি যে বিরজান্দী রাহ.-এর বক্তব্য নির্ভর তা-ই স্বাভাবিক।

দাগিস্তানী রাহ. (১১৯৯ হি.)-এর এই বক্তব্যটির টীকায় খলীল কামেলী রাহ. বলেছেন-

قوله: (في معرفة طلوع الفجر الكاذب والصادق) اعلم أن الفجر الكاذب يكون من تكيف خط مواز لسمت الرأس وبما وصل إليه حال كونه مستطيلا ممتدا الضوء من تكيف جزء من كرة البخار بالضوء المكتسب من الشمس، وكونه مستطيلا، لأن كرة البخار يكون المتكيف منها بالضوء جزءا موازيا للشمس لا كلها، وبمقابلة هذا الجزء يتكيف خط من الهوى مواز لهذا الجزء على الاستقامة، فلذا يكون مستطيلا. وأما الفجر الصادق فتتكيف به كرة البخار من جهة الشرق بحيث ينتشر ضوء الشمس عليها مستطيرا، فلهذا يتكيف الهواء المقابل لكرة البخار تكيفا مستطيرا بحيث يستضيئ جميع أفق المشرق بسبب ما ذكرنا.

واعتبار الانحطاط في الشمس يط (19) في الفجر و يح (18) أو يز (17) في الشفق؛ زوال زمان جميع الظلمة وانتشار جيمع الضوء اذ زوال جميع الضوء في الأول يتأتى بانحطاط يز (17) بخلاف زوال جيمع الظلمة، فإنه لا يكون إلا بمجاوزة يط (19) ، فافهم ذلك.

قوله (فهو مقدار ظل الأرض) ... قوله (والأحوط أن يعمل في الفجر الخ) لأنه إذا كان نظير الشمس على مقنطرة ستة عشرة في جانب المشرق وعلى مقنطرة أربعة عشر في جانب المغرب ينبغي أن لا تصلى المغرب إذ ذلك، أي لا تؤخر إلى ذلك الوقت في الأول، فيحطاط في فعلها قبل ذلك، وإن لم يكن خرج وقتها ودخل وقت العشاء، وفي الثاني ينبغي أن لا تصلى الصبح وإن كان قد دخل وقتها قبل ذلك، لكن هذا يناسب اعتباره لأجل صلاة الصبح، وأما الإمساك فينبغي أن عند وصوله إلى مقنطرة عشرين في جانب المغرب، وكذا يحطاط في صلاة العشاء بعد ارتفاع النظير في جانب المشرق بمقدار ثمانية عشر، إذ في ذلك الوقت يتحقق غيبوبة الشفق الأحمر، وإنما اعتبر يح (18) في الحصتين وإن كان هذا مخالفا لما يقتضيه التحقيق المستنبط من الأرصاد المعتبرة من أنه في الفجر يط (19) وفي الشفق يز (17) بناء على قول أبي حنيفة رضي الله عنه أن الحصتين متساويتان على أنه قد قال به بعض الرصاد، وإن كان ما عليه عامة الرصاد أصوب.

هذا، واعلم أن التفاوت بين الصادق والكاذب وبين الشفقين الأحمر والأبيض إنما هو بثلاث درج.

...قوله ضع نظير درجة على مقنطرة ثمانية عشر الخ لأنه إذا كان النظير على مقنطرة ثمانية عشر في جانب الغروب يكون انحطاط جزء الشمس في جانب الشروق بهذا المقدار، وذلك وقت ظهور الفجر الكاذب، وكذلك إذا كان ارتفاع النظير على مقنطرات الشروق ثمانية عشر يكون جزء الشمس منحطا في جانب المغرب ثمانية عشر درجة عن الأفق الغربي، وذلك وقت غروب الشفق الأبيض... .

দেখুন-

হাশিয়াতু রিসালাতিল আসতারলাব আদ্দাগিস্তানিয়া, মাখতুত (১) : মাজলিসে শূরা, মিল্লী, ইরান, মাখতুত নং ১৬০৮৭, পাতা ৪৪; মাখতুত (২) : চ্যাস্টার বিতি আয়ারল্যান্ড, মাখতুত নং ৫৪৯৬

লক্ষ্য করুন, আহসানুল ফাতাওয়াতে খলীল কামেলী রাহ.-এর কথার উপর ভিত্তি করেই শাফাকে আহমার ১২°-এ শেষ হওয়ার কথা বলা হয়েছে। আহসানুল ফাতাওয়াতে আছে-

اور یہ بھی ثابت کیا جا چکا ہے کہ شفق ابیض مستطیل غروب ہونے کے وقت آفتاب 18 زیر افق ہوتا ہے، اور شفق ابیض مستطیر غروب ہونے کے وقت 15 درجہ زیر افق، غروب شفق احمر کے وقت آفتاب 12 درجہ زیر افق ہوتا ہے، اس کی تعیین علامہ شامی رحمہ اللہ تعالیٰ کی اس عبارت سے ہوتی ہے ذكر المرحوم الشيخ خليل الكاملي في ... أن التفاوت بين الفجرين وكذا بين الشفقين الأحمر والأبيض إنما هو بثلاث درج.

এখানে স্পষ্টতই খলীল কামেলীর বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে দাবি করা হয়েছে যে, শাফাকে আহমার শেষ হয় ১২°-এ। অথচ খলীল কামেলী ও আলী দাগিস্তানী এমন কথা বলেননিতাদের উভয়ের বক্তব্যে বরং আছে, শাফাকে আহমার শেষ হয় ১৫°-এ বা এরও কিছুক্ষণ পর। তাহলে আহসানুল ফাতাওয়াতে যে উদ্ধৃতির উপর ভিত্তি করে শাফাকে আহমার ১২°-এ শেষ হওয়ার কথা বলা হয়েছে সে অনুযায়ীই আহসানুল ফাতাওয়ার এ দাবি ভুল প্রমাণিত হয়।

৫. তারপর খলীল কামেলী রাহ.-এর উক্ত কথাটি যে শাস্ত্রজ্ঞগণের ইজমা পরিপন্থী- এর বিবরণ তো পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছেই। কিন্তু এ বক্তব্যটির ব্যাপারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হল, সুবহে কাযিব ও সুবহে সাদিকের মধ্যকার ব্যবধানের সঙ্গে শাফাকে আহমার ও শাফাকে আবইয়াযের মধ্যকার ব্যবধানকে তুলনা করা শাস্ত্রীয় বিচারে অনেক বড় স্থূল ভুল।

লক্ষ্য করুন, ভোরে যে ধরনের আলোর নাম সুবহে সাদিক, সন্ধ্যার পর সেই প্রকারের আলোটিরই নাম শাফাকে আবইয়ায। পক্ষান্তরে ভোরের আগে যে ধরনের আলোর নাম সুবহে কাযিব, সন্ধ্যার পর ঠিক সেইরকম আলোটিই শাফাকে কাযিব। এটি শাস্ত্রের প্রথম সবক পর্যায়ের কথা। অতএব কেউ যদি বলতে চান, সুবহে কাযিব ও সুবহে সাদিকের মাঝে তিন ডিগ্রি ব্যবধান তাহলে এর সাথে মিলিয়ে তাকে বলতে হবে, শাফাকে কাযিব ও শাফাকে আবইয়াযের মাঝে তিন ডিগ্রি ব্যবধান। কিন্তু সুবহে কাযিব ও সুবহে সাদিকের সাথে মিলিয়ে শাফাকে আহমার ও শাফাকে আবইয়াযের কথা বলা সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যহীন ও স্থূল ভুল।

দাগিস্তানী ও খলীল কামেলী রাহ.-এর পুরো বক্তব্য আমরা তুলে ধরেছি। সেটি পড়ে দেখুন। উভয়ের আলোচনায় আছে যে, সুবহে কাযিব হয় ১৮°-এ। কিন্তু শাফাকের ক্ষেত্রে এসে এটিকে শাফাকে কাযিব না বলে বলছেন শাফাকে আবইয়ায। অর্থাৎ তাদের বক্তব্যে আছে যে, শাফাকে আবইয়ায শুরু হয় ১৮°-এ। পক্ষান্তরে ১৫°-এ সুবহে সাদিক হওয়ার কথা বললেও ১৫°-এ শাফাকে আবইয়ায শেষ হওয়ার কথা বলেননি; বরং ১৫°-এ শাফাকে আহমারের কথা বলেছেন। অতএব তাদের উভয়ের আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট যে, তাদের মতে সুবহে কাযিব ও শাফাকে আবইয়ায এবং সুবহে সাদিক ও শাফাকে আহমার একই পর্যায়ের।

অথচ এরকম কঁঁাচা ভুল বিরজান্দী রাহ. থেকেও হয়নি। বিভ্রান্তি বশত তিনি ১৮°-এর সুবহে সাদিকের সময়কে সুবহে কাযিবের খাতে দিয়ে দিলেও তিনি সুবহে কাযিব এবং শাফাকে আবইয়াযকে এক বানিয়ে দেওয়ার মত কাঁচা ভুল করেননি। নাসীরুদ্দীন তূসীর আততাযকিরা কিতাবের শরহে তিনি বলেছেন-

ثم هما متشابهان شكلا ومتقابلان وضعا، فإن أول الصبح بياض مستدق مستطيل ثم بياض عريض منبسط ثم حمرة، وأول الشفق حمرة ثم بياض عريض منبسط ثم بياض مستدق مستطيل.

দেখুন-

شرح التذكرة للبرجندي، مكتبة قطر الرقمية، رقم المخطوط 81055، الورق 334.

তিনি আরো বলেছেন-

(والشفق يكون بعكس الصبح) فيظهر أولا الحمرة، ثم البياض العريض، ثم البياض المستدق المستطيل إلى أن يخفى ... (وقد عرف بالتجربة أن انحطاط الشمس عند أول طلوع الصبح) وهو البياض المستطيل المسمى بالكاذب (وآخر غروب الشفق) وهو البياض المستطيل الذي قلما يدرك لخفائه (يكون ثمانية عشر جزءا).

দেখুন-

شرح التذكرة للبرجندي، مكتبة قطر الرقمية، رقم المخطوط 81055، الورق 332.

এখানে তিনি তাসামুহ বশত ১৮°-এ সুবহে কাযিব হওয়ার কথা বললেও শাফাকের ক্ষেত্রে বলেনি এটি শাফাকে আবইয়ায; বরং এটিকেও শাফাকে কাযিবই বলেছেন। ১৮°-এ সুবহে কাযিব শুরু হওয়া এবং শাফাকে কাযিব শেষ হওয়ার কথা সঠিক না হলেও ১৮ ডিগ্রিকে সুবহে কাযিব বানিয়ে আবার ১৮ ডিগ্রিকে শাফাকে আবইয়ায শেষ হওয়ার সময় বলার মত স্পষ্ট কাঁচা ভুল বিরজান্দী রাহ. থেকেও ঘটেনি।

এমনকি আহসানুল ফাতাওয়াতেও আছে যে, সুবহে কাযিব যত ডিগ্রিতে শুরু হয় শাফাকে কাযিবও তত ডিগ্রিতে শেষ হয়। তেমনিভাবে সুবহে সাদিক যত ডিগ্রিতে শুরু হয় শাফাকে আবইয়াযও তত ডিগ্রিতে শেষ হয়। (দেখুন : আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৬৩, ১৮২, ১৮৬)

অতএব দাগিস্তানী ও খলীল কামিলী রাহ.-এর এই বক্তব্যটি বিরজান্দী রাহ.-এর বক্তব্য অনুযায়ী, এমনকি আহসানুল ফাতাওয়ার কথা অনুযায়ীও সঠিক নয়। বরং শাফাকে আবইয়ায ও শাফাকে আহমারের ক্ষেত্রে তাদের উভয়ের বক্তব্য এবং আহসানুল ফাতাওয়ার দাবি পরস্পর বিরোধী। যার একটি সঠিক মানা হলে অপরটিকে সঠিক মানা অসম্ভব।

অতএব তিন ডিগ্রি ব্যবধানের এই কথাটি আহসানুল ফাতাওয়ার নিজ দাবির পক্ষে দলীল হিসেবে পেশ করলেও এর দ্বারা উল্টো এই দাবি ভুল প্রমাণিত হবে।

৬. আমরা যে পূর্বে বলেছি, আহসানুল ফাতাওয়াতে ১৮°-এ সুবহে কাযিব ও ১৫°-এ সুবহে সাদিক হওয়া পক্ষে যেসব কিতাবের উদ্ধৃতি উল্লেখ করা হয়েছে তাদের কেউ বাস্তবিক অর্থে তো ফালাকী ছিলেনই না, এমনকি ফালাকিয়্যাতের কিতাবভিত্তিক যথাযথ ইলমও তাদের অনেকের ছিল না- দাগিস্তানী ও খলীল কামিলী রাহ.-এর এই কথাগুলোও এর জ্বলন্ত প্রমাণ। কেননা ফালাকিয়্যাতের কিতাবভিত্তিক যথাযথ ইলম থাকলেও কেউ এমন কথা বলতে পারেন না। খলীল কামিলী রাহ.-এর পুরো বক্তব্যে শাস্ত্রীয় বিচারে আর কী ভুল ও বিভ্রান্তি রয়েছে তার পর্যালোচনা আমরা শাস্ত্রজ্ঞদের জন্য ছেড়ে দিলাম।

খুলাসা কথা হল, খলীল কামিলী রাহ.-এর এই বক্তব্যটি শাস্ত্রীয় দিক থেকে মারাত্মক স্থূল ভুল। একে তো কথাটি মূলত উদ্ধৃতিযোগ্যই নয়, উপরন্তু আহসানুল ফাতাওয়ার দাবিও এর দ্বারা প্রমাণিত হয় না। তাই একে আহসানুল ফাতাওয়ার দাবির পক্ষে উল্লেখ করা সম্পূর্ণ অনর্থক।

***

এখানে এ কথা বলে দেওয়াও সমীচীন যে, দাগিস্তানী ও খলীল কামেলী রহ.-এর পূর্ণ বক্তব্যে যদিও সুবহে কাযিব ও সুবহে সাদিকের সময়ও উল্লেখ করা হয়েছে (যা সম্পূর্ণ বাস্তবতা বিরোধী)। তা সত্ত্বেও আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী রাহ. এদিকে একদম ভ্রম্নক্ষেপ করেননি, এবং নিজের কিতাবে এর দিকে ইঙ্গিতও করেননি। আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া, আল্লাহ তাআলা তাঁকে এবং তাঁর কিতাবকে এই ভুল থেকে মুক্ত রেখেছেন। উভয় প্রকারের সুবহএবং উভয় প্রকারের শাফাকের মাঝে কত ডিগ্রি ব্যবধান- এটির শরীয়তের কোনো মাসআলার সাথে সম্পৃক্ত নয়। তাই এ বিষয়ে দাগিস্তানী ও খলীল কামেলীর বাস্তবতা বিরোধী ভুল কথা যদিও তিনি উদ্ধৃত করে দিয়েছেন, কিন্তু আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া, নামাযের ওয়াক্ত ও সেহরির সময় বর্ণনায় তা কোনো প্রভাব ফেলেনি। আহকাম ও বিধিবিধান রদ্দুল মুহতারে সঠিকভাবেই বর্ণনা করা হয়েছে। আদিল্লায়ে শরীয়ত, মুসলিম উম্মাহর তাআমুল ও শাস্ত্রজ্ঞ ফালাকীগণের বক্তব্যের সাথে যার পরিপূর্ণ মিল রয়েছে। কত ভালো হত যদি আহসানুল ফাতাওয়াতেও এই ধারা অবলম্বন করা হত! আহকাম ও বিধিবিধান সঠিকভাবেই উল্লেখ করা হত এবং খলীল কামেলীর কথাকে উপেক্ষা করার তাওফীক না হলেও অন্তত একে লতীফাহিসেবেই রেখে দেওয়া হত! যেমনটি রদ্দুল মুহতারে করা হয়েছে!!

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

1.قال الراقم عفا الله عنه : كُتِب في مخطوطة إيران هنا بجنب هذا البيان ما نصه : تأمل في هذا التقرير؛ فإنه بعيد من التحرير.

 

 

advertisement