রজব ১৪৪৩   ||   ফেব্রুয়ারি ২০২২

কুরআন মাজীদের নাম-পরিচয় ‘আততানযীল’ নামের তাৎপর্য

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মাজীদ

التنزيل (আততানযীল) : এটিও কুরআনে কারীমের প্রসিদ্ধ নাম, যা কুরআনে কারীমের বিভিন্ন আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। আরবী কিতাবপত্রে এবং আরবের আলিমগণের লেখায় এই নামটি বেশি ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। এই শব্দকাঠামোটি মূলত মাসদার (ক্রিয়াবিশেষ্য) যার  অর্থ, উপর থেকে অবতারণ করা। তবে তানযীল শব্দটি যেহেতু এখানে আল্লাহর কালাম ও কিতাবের নামরূপে ব্যবহৃত হয়েছে তাই এর উদ্দিষ্ট অর্থ হচ্ছে- ‘অবতীর্ণ কালাম বা অবতীর্ণ কিতাব

আততানযীল নামের তাৎপর্য

১. তানযীলনামটি শোনামাত্র একজন আরবীভাষী বুঝে থাকেন, এই কুরআন মাজীদ কোনো মানুষের রচিত বাণী নয়; বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ পবিত্র কালাম। কুরআন যে স্বয়ং আল্লাহ পাকের কালাম, অন্য কারো রচনা নয়-একথা হৃদয়ঙ্গম করানোর জন্যই তানযীল শব্দটি কুরআন মাজীদের বহু আয়াতে কুরআনের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। কিছু আয়াত এখানে উল্লেখ করছি।

সূরা হা-মীম সাজদার ২ নং আয়াত-

تَنْزِيلٌ مِنَ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ.

এ বাণী সেই সত্তার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ, যিনি সকলের প্রতি দয়াবান, পরম দয়ালু।

সূরা হা-মীম সাজদার ৪২ নং আয়াত-

تَنْزِيلٌ مِنْ حَكِيمٍ حَمِيدٍ.

এটা সেই সত্তার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ, যিনি হেকমতের মালিক, সমস্ত প্রশংসা যার দিকে ফেরে।

সূরা ওয়াকিআর ৮০ নং আয়াত-

تَنْزِيلٌ مِنْ رَبِّ الْعَالَمِينَ .

রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ

কুরআন মাজীদকে আল্লাহ তাআলা কীভাবে নাযিল করেছেন সেকথাও কুরআন মাজীদে বর্ণিত হয়েছে। সূরা শুআরার ১৯২-১৯৪ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

وَ اِنَّهٗ لَتَنْزِیْلُ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَ،  نَزَلَ بِهِ الرُّوْحُ الْاَمِیْنُ، عَلٰی قَلْبِكَ لِتَكُوْنَ مِنَ الْمُنْذِرِیْنَ.

নিশ্চয়ই এ কুরআন রাব্বুল আলামীনের পক্ষ হতে অবতারিত। বিশ্বস্ত ফেরেশতা তা নিয়ে অবতরণ করেছে। (হে নবী!) তোমার অন্তরে অবতারিত হয়েছে, যাতে তুমি সতর্ককারীদের (অর্থাৎ নবীদের) অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও।

সূরা বাকারার ৯৭ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

قُلْ مَنْ كَانَ عَدُوًّا لِّجِبْرِیْلَ فَاِنَّهٗ نَزَّلَهٗ عَلٰی قَلْبِكَ بِاِذْنِ اللهِ مُصَدِّقًا لِّمَا بَیْنَ یَدَیْهِ وَ هُدًی وَّ بُشْرٰی لِلْمُؤْمِنِیْنَ

(হে নবী) বলে দিন। কোনো ব্যক্তি যদি জিরবীল-এর শত্রু হয় তবে (হোক না) সে তো আল্লাহর অনুমতিক্রমেই এ কালাম তোমার অন্তরে নাযিল করেছে, যা তার পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সমর্থন করে এবং যা ঈমানদারদের জন্য সাক্ষাৎ হেদায়েত ও সুসংবাদ।

সুতরাং কুরআন মাজীদ কোনো মানুষের আবিষ্কার নয়, কোনো কবি বা জ্যোতিষীর বাণী নয়, কোনো মুনি-ঋষিরও বাণী নয়। এমনকি ফিরিশতার কিংবা রাসূলেরও নিজস্ব বাণী নয়; বরং কুরআনে কারীম হল স্বয়ং আল্লাহ তাআলার পাক কালাম, যা তিনি তাঁর প্রিয় রাসূলের উপর ফেরেশতা জিবরীল আ.-এর মাধ্যমে ওহী আকারে আসমান থেকে নাযিল করেছেন। একথা অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভাষায় সূরা আলহাক্কাহ-এর ৩৮-৫২ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে-

فَلَاۤ اُقْسِمُ بِمَا تُبْصِرُوْنَ، وَ مَا لَا تُبْصِرُوْنَ،اِنَّهٗ لَقَوْلُ رَسُوْلٍ كَرِیْمٍ،وَّ مَا هُوَ بِقَوْلِ شَاعِرٍ قَلِیْلًا مَّا تُؤْمِنُوْنَ،وَ لَا بِقَوْلِ كَاهِنٍ قَلِیْلًا مَّا تَذَكَّرُوْنَ، تَنْزِیْلٌ مِّنْ رَّبِّ الْعٰلَمِیْنَ،وَ لَوْ تَقَوَّلَ عَلَیْنَا بَعْضَ الْاَقَاوِیْلِ، لَاَخَذْنَا مِنْهُ بِالْیَمِیْنِ، ثُمَّ لَقَطَعْنَا مِنْهُ الْوَتِیْنَ، فَمَا مِنْكُمْ مِّنْ اَحَدٍ عَنْهُ حٰجِزِیْنَ، وَ اِنَّهٗ لَتَذْكِرَةٌ لِّلْمُتَّقِیْنَ،وَ اِنَّا لَنَعْلَمُ اَنَّ مِنْكُمْ مُّكَذِّبِیْنَ، وَ اِنَّهٗ لَحَسْرَةٌ عَلَی الْكٰفِرِیْنَ،وَ اِنَّهٗ لَحَقُّ الْیَقِیْنِ، فَسَبِّحْ بِاسْمِ رَبِّكَ الْعَظِیْمِ.

আমি কসম করছি, তোমরা যা দেখছ তারও এবং তোমরা যা দেখছ না তারও। এটা (অর্থাৎ কুরআন) এক সম্মানিত বার্তা বাহকের আনীত বাণী। এটা কোনো কবির বাণী নয়, কিন্তু তোমরা অল্পই ঈমান আন এবং কোনো গণকের বাণী নয়, কিন্তু তোমরা খুব অল্পই বুঝ। এ বাণী অবতারণ করা হচ্ছে জগৎসমূহের প্রতিপালকের পক্ষ হতে। আর যদি সে কোনো বাণী রচনা করে আমার প্রতি আরোপ করত তবে আমি অবশ্যই তার ডান হাত ধরে ফেলতাম। তারপর তার জীবন-ধমনী কেটে দিতাম। তখন তোমাদের কেউ তাকে রক্ষা করার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারত না। নিশ্চিতভাবে জেনে রাখ, এটা মুত্তাকীদের জন্য এক উপদেশবাণী। আমি ভালো করে জানি, তোমাদের মধ্যে কিছু লোক অবিশ^াসীও আছে। এবং এটা (অর্থাৎ কুরআন) এরকম কাফিরদের জন্য আক্ষেপের কারণ। এটাই সেই নিশ্চিত বাণী, যা পরিপূর্ণ সত্য। সুতরাং তুমি তোমার মহান প্রতিপালকের নামের পবিত্রতা ঘোষণা কর।

২. আমরা শুরুতেই উল্লেখ করেছি, তানযীল অর্থ উপর থেকে অবতারণ করা। তাই তানযীলনামের মধ্যে একথা নিহিত রয়েছে যে, কুরআন কারীম পার্থিব কোনো সাধারণ গ্রন্থ নয়, বরং ঊর্ধ্বজগৎ থেকে অবতীর্ণ এক মহাগ্রন্থ। আমরা সকলেই জানি, ইসলাম হল আল্লাহ প্রদত্ত দ্বীন। এ দ্বীন কোনো মানুষের চিন্তা-গবেষণার ফসল নয়; বরং স্বংয় আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ হতে ঊর্ধ্বজগতৎ থেকে ওহী মারফত খাতামুন নাবিয়্যীন হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর নাযিল হয়েছে। একথা দ্বীনুল ইসলামে একটি সর্বজনবিদিত বিষয়।

বস্তুত কুরআন মাজীদ হল আল্লাহ তাআলার পাক কালাম, যা বহু কাল আগে থেকেই ঊর্ধ্বজগতের লওহে মাহফূজে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এ সম্বন্ধে কুরআন মাজীদের কিছু আয়াত পাঠ করুন-

সূরা বুরূজের ২১-২২ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

بَلْ هُوَ قُرْاٰنٌ مَّجِیْدٌ، فِیْ لَوْحٍ مَّحْفُوْظٍ.

বরং এটা অতি সম্মানিত কুরআন, যা লিপিবদ্ধ আছে লওহে মাহফূজে। -সূরা বুরূজ (৮৫) : ২১-২২

সূরা যুখরুফের ১-৪ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

حٰمٓ، وَ الْكِتٰبِ الْمُبِیْنِ،اِنَّا جَعَلْنٰهُ قُرْءٰنًا عَرَبِیًّا لَّعَلَّكُمْ تَعْقِلُوْنَ، وَ اِنَّهٗ فِیْۤ اُمِّ الْكِتٰبِ لَدَیْنَا لَعَلِیٌّ حَكِیْمٌ.

হা-মীম। শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের। নিশ্চয়ই একে আমি আরবী কুরআন বানিয়েছি, যাতে তোমরা বুঝতে পার। প্রকৃতপক্ষে এটা আমার নিকট উম্মুল কিতাবে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন, হেকমতপূর্ণ কিতাব।

উল্লেখ্য, উপরোক্ত আয়াতে উম্মুল কিতাবদ্বারা লওহে মাহফূজ বোঝানো হয়েছে।

সূরা আবাসার ১৩-১৬ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে-

فِیْ صُحُفٍ مُّكَرَّمَةٍ،مَّرْفُوْعَةٍ مُّطَهَّرَةٍۭ،بِاَیْدِیْ سَفَرَةٍ،كِرَامٍۭ بَرَرَةٍ.

এটা লিপিবদ্ধ আছে এমন সহীফাসমূহে, যা অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ, উচ্চ স্তরের, পবিত্র। এমন লিপিকরদের হাতে লিপিবদ্ধ, যারা অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন, পুণ্যবান।

৩. কুরআন মাজীদ যেহেতু অসীম জ্ঞানের অধিকারী এবং অসীম ক্ষমতার অধিকারী মহান আল্লাহ তাআলার তানযীল বা তাঁর নাযিল করা কালাম তাই তা সবধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে মুক্ত এবং অন্য কারো হস্তক্ষেপ, রদবদল ও বিকৃতি থেকে সুরক্ষিত। আমরা দেখি, ‘তানযীলশব্দটি যেখানে কুরআনের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে সেখানে কুরআন মাজীদ সুরক্ষিত থাকার কথাও বর্ণিত হয়েছে। যেমন সূরা হা-মীম সাজদার ৪১-৪২ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

وَ اِنَّهٗ لَكِتٰبٌ عَزِیْزٌ، لَّا یَاْتِیْهِ الْبَاطِلُ مِنْۢ بَیْنِ یَدَیْهِ وَ لَا مِنْ خَلْفِهٖ  تَنْزِیْلٌ مِّنْ حَكِیْمٍ حَمِیْدٍ.

এটি অতি মর্যদাপূর্ণ কিতাব। কোনো মিথ্যা এর পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না; না এর সম্মুখ দিক থেকে এবং না এর পেছন থেকে। এটা সেই সত্তার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ, যিনি হেকমতের মালিক, সমস্ত প্রশংসা যার দিকে ফেরে।

সূরা ওয়াকিআর ৭৭-৮০ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

اِنَّهٗ لَقُرْاٰنٌ كَرِیْمٌ، فِیْ كِتٰبٍ مَّكْنُوْنٍ، لَّا یَمَسُّهٗۤ اِلَّا الْمُطَهَّرُوْنَ، تَنْزِیْلٌ مِّنْ رَّبِّ الْعٰلَمِیْنَ.

নিশ্চয়ই এটা অতি সম্মানিত কুরআন, যা এক সুরক্ষিত কিতাবে (পূর্ব থেকেই) লিপিবদ্ধ আছে। একে স্পর্শ করে কেবল তারাই, যারা অত্যন্ত পবিত্র। এটা জগৎসমূহের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ।

কাফিরগণ প্রশ্ন করত, আমরা কীভাবে বিশ্বাস করব, এ কুরআন কোনোরূপ রদ বদল ছাড়া তার প্রকৃত রূপেই আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে, মাঝখানে শয়তান বা অন্য কেউ এতে কোনোরকম হস্তক্ষেপ করেনি? উপরে উল্লিখিত আয়াতগুলো দ্বারা তার উত্তর দেয়া হয়েছে যে, কুরআন মাজীদ লওহে মাহফুজে লিপিবদ্ধ আছে এবং তা পবিত্র ফেরেশতাগণ ছাড়া অন্য কেউ স্পর্শ করতে পারে না।

এছাড়াও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর কুরআন নাযিলের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতার গুণ সম্বন্ধে এক আয়াতে বর্ণিত হয়েছে-

نَزَلَ بِهِ الرُّوْحُ الْاَمِیْنُ.

এক বিশ্বস্ত ফেরেশতা তা নিয়ে অবতরণ করেছে।

অন্য এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

عَلَّمَهُ شَدِيدُ الْقُوَى، ذُو مِرَّةٍ.

তাকে শিক্ষা দিয়েছে এমন এক প্রচণ্ড শক্তিশালী (ফেরেশতা), যে প্রবল ক্ষমতার অধিকারী। -সূরা নাজম (৫৩) : ৪-

এখানে প্রচণ্ড শক্তিশালী বলে হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে বোঝানো হয়েছে, যিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসল্লামের কাছে ওহী নিয়ে আসতেন। বিশেষভাবে শক্তির কথা উল্লেখ করে কাফেরদের মনের এই সম্ভাব্য ধারণাকে খণ্ডন করা হয়েছে যে, কোনো  ফেরেশতা যদি তাঁর কাছে ওহী নিয়ে এসেও থাকেন, তবে মাঝপথে যে কোনো শয়তানী কারসাজী হয়নি- তার কী নিশ্চয়তা আছে? এ আয়াত জানাচ্ছে, ওহীর বাহক ফেরেশতা এমনই শক্তিশালী যে, অন্য কারো পক্ষে তাকে বিভ্রান্ত করা বা তার মিশন থেকে নিরস্ত করা সম্ভব নয়।

তাছাড়া যখন ওহী নাযিল হয় তখন ফেরেশতাগণকে সেই ওহীর পাহারাদার করে পাঠানো হয়, যাতে শয়তান তাতে কোনো রকমের হস্তক্ষেপ করতে না পারে। এ সম্বন্ধে কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-

عٰلِمُ الْغَیْبِ فَلَا یُظْهِرُ عَلٰی غَیْبِهٖۤ اَحَدًا، اِلَّا مَنِ ارْتَضٰی مِنْ رَّسُوْلٍ فَاِنَّهٗ یَسْلُكُ مِنْۢ بَیْنِ یَدَیْهِ وَ مِنْ خَلْفِهٖ رَصَدًا، لِّیَعْلَمَ اَنْ قَدْ اَبْلَغُوْا رِسٰلٰتِ رَبِّهِمْ وَ اَحَاطَ بِمَا لَدَیْهِمْ وَ اَحْصٰی كُلَّ شَیْءٍ عَدَدًا.

তিনিই সকল গুপ্ত বিষয় জানেন। তিনি তাঁর গুপ্ত জ্ঞান সম্পর্কে কাউকে অবহিত করেন না। তবে তিনি যাকে (এ কাজের জন্য) মনোনীত করেছেন সেই রাসূল ছাড়া। এরূপ ক্ষেত্রে তিনি সেই রাসূলের সামনে ও পেছনে কিছু প্রহরী নিযুক্ত করেন। তারা (অর্থাৎ রাসূলগণ) তাদের প্রতিপালকের বাণী যে ঠিক পৌঁছিয়ে দিয়েছে তা জানার জন্য। আর তিনি তাদের যাবতীয় অবস্থা পরিবেষ্টন করে আছেন এবং তিনি সমস্ত কিছু পুরোপুরি হিসাব করে রেখেছেন। -সূরা জিন (৭২) : ২৬-২৮

এভাবে পূর্ণ সুরক্ষা ও নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাঝে ওহী নাযিল হত। সর্বোপরি আল্লাহ তাআলা যেমন পূর্ণ সুরক্ষার সাথে কুরআন মাজীদ নাযিল করেছেন, তেমনি তা কিয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষণের দায়িত্বও নিজে গ্রহণ করেছেন। তাই তো আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

اِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَ اِنَّا لَهٗ لَحٰفِظُوْنَ.

বস্তুত এই উপদেশ বাণী (কুরআন) আমিই অবতারণ করেছি এবং আমিই এর রক্ষাকর্তা। -সূরা হিজর (১৫) : ৯

এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, যদিও কুরআন মাজীদের আগেও বহু আসমানী কিতাব নাযিল করা হয়েছিল, কিন্তু তা ছিল বিশেষ-বিশেষ সম্প্রদায়ের জন্য এবং নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য। তাই আল্লাহ তাআলা সেগুলোকে কিয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষণ করার গ্যরান্টি দেননি। সেগুলো হেফাজত করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের উপরই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, যেমন সূরা মায়েদায় (৫ : ৪৪) বলা হয়েছে। কিন্তু কুরআন মাজীদ সর্বশেষ আসমানী কিতাব। কিয়ামতকাল পর্যন্ত এর কার্যকারিতা বলবৎ থাকবে। তাই আল্লাহ তাআলা এর সংরক্ষণের দায়িত্ব নিজেই নিয়েছেন। সুতরাং কিয়ামত পর্যন্ত এর কোনো রদবদলের সম্ভাবনা নেই। আল্লাহ তাআলা এমনভাবে এ গ্রন্থ সংরক্ষণ করেছেন যে, ছোট-ছোট বাচ্চারা পর্যন্ত পূর্ণ কিতাব মুখস্থ করে  নিজেদের বক্ষদেশে সুরক্ষিত করে। কথার কথা যদি শত্রুগণ কুরআন মাজীদের সমস্ত কপি খতম করে ফেলে (নাউযুবিল্লাহ) তবুও  ছোট-ছোট শিশুরাও এ কুরআন পুনরায় লিপিবদ্ধ করাতে পারবে এবং তাতে হরফেরও হেরফের হবে না। এটা কুরআন মাজীদের এক জীবন্ত মুজিযা।

ইতিহাস সাক্ষী, কুরআন যখন নাযিল হয়েছে তখন থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চৌদ্দ শ বছর হল কুরআন সব সময় সুরক্ষিত রয়েছে। এর বড় একটি প্রমাণ হল, এই পৃথিবীতে মুসলমানদের হাতে যত দেশে যত মুসহাফ রয়েছে সব এক অভিন্ন; এতে আয়াত ও সূরার কোনো গরমিল নেই।

৪. কুরআনের তানযীল নাম থেকে প্রমাণীত হয়, কুরআনের বাণী কোনো মাখলূক নয়, বরং আল্লাহ তাআলার পবিত্র কালাম ও বাণী, যা তিনি ওহী মারফত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর নাযিল করেছেন। মাখলূক তো হল সেই বস্তু, যাকে আল্লাহ তাআলা কুন’ (হও) নির্দেশের মাধ্যমে সৃষ্টি করেন। কিন্তু কুরআন তো কুননির্দেশ দ্বারা সৃষ্ট নয়, বরং কুরআন হল আল্লাহ তাআলার কালাম ও নির্দেশসমগ্র, যা তিনি ওহী মারফত নাযিল করেছেন। 

তাছাড়া কুরআন মাজীদের নুযূল ও তানযীলকে আল্লাহ তাআলা বিশেষভাবে নিজ সত্তার দিকে সম্বন্ধিত করে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু আল্লাহ তাআলা অন্য যেসব নিআমত আসমান থেকে নাযিল করেছেন সেগুলোকে তিনি কুরআনের মতো নিজ সত্তার দিকে বিশেষভাবে সম্বন্ধিত করেননি। এ থেকে বোঝা যায়, আসমান থেকে অবতীর্ণ কুরআন মাজীদ কোনো মাখলূক নয়, বরং আল্লাহ তাআলার কালাম গুণের প্রকাশ। বোঝার জন্য উভয় প্রকারের কিছু আয়াত উল্লেখ করছি।

কুরআনের অবতারণ সংক্রান্ত কিছু আয়াত

সূরা সাজদার ২ নং আয়াত-

تَنْزِیْلُ الْكِتٰبِ لَا رَیْبَ فِیْهِ مِنْ رَّبِّ الْعٰلَمِیْنَ.

রাব্বুল আলামীনের পক্ষ হতে এমন এক কিতাব নাযিল করা হচ্ছে, যাতে কোনো সন্দেহপূর্ণ কথা নেই।

সূরা যুমারের ১-২ নং আয়াত-

تَنْزِیْلُ الْكِتٰبِ مِنَ اللهِ الْعَزِیْزِ الْحَكِیْمِ، اِنَّاۤ اَنْزَلْنَاۤ اِلَیْكَ الْكِتٰبَ بِالْحَقِّ .

এ কিতাব নাযিল করা হয়েছে আল্লাহর পক্ষ হতে, যিনি মহা ক্ষমতাবান, হেকমতওয়ালা। (হে রাসূল) নিশ্চয়ই আমিই এ কিতাব তোমার প্রতি নাযিল করেছি সত্যসহ।

সূরা আনআমের ১১৪-১১৫ নং আয়াত-

اَفَغَیْرَ اللهِ اَبْتَغِیْ حَكَمًا وَّ هُوَ الَّذِیْۤ اَنْزَلَ اِلَیْكُمُ الْكِتٰبَ مُفَصَّلًا وَ الَّذِیْنَ اٰتَیْنٰهُمُ الْكِتٰبَ یَعْلَمُوْنَ اَنَّهٗ مُنَزَّلٌ مِّنْ رَّبِّكَ بِالْحَقِّ فَلَا تَكُوْنَنَّ مِنَ الْمُمْتَرِیْنَ، وَ تَمَّتْ كَلِمَتُ رَبِّكَ صِدْقًا وَّ عَدْلًا  لَا مُبَدِّلَ لِكَلِمٰتِهٖ وَ هُوَ السَّمِیْعُ الْعَلِیْمُ.

(হে নবী! তাদেরকে বল,) আমি কি আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সালিস বানাব, অথচ তিনিই তোমাদের প্রতি এ কিতাব নাযিল করেছেন, যার ভেতর যাবতীয় (বিতর্ক) বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে? পূর্বে যাদেরকে কিতাব দিয়েছিলাম, তারা নিশ্চিতভাবে জানত, এটা তোমার প্রতিপালকের নিকট থেকে সত্য নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তুমি কিছুতেই সন্দিহানদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। তোমার প্রতিপালকের বাণী সত্য ও ন্যায়ের দিক থেকে পরিপূর্ণ। তাঁর কথার কোনো পরিবর্তনকারী নেই। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।

আসমান থেকে অবতীর্ণ বিভিন্ন বস্তু সংক্রান্ত কিছু আয়াত

সূরা বাকারার ২২ নং আয়াত-

وَّ اَنْزَلَ مِنَ السَّمَآءِ مَآءً فَاَخْرَجَ بِهٖ مِنَ الثَّمَرٰتِ رِزْقًا لَّكُمْ .

আর তিনি আকাশ থেকে বৃষ্টি নাযিল করেছেন, তারপর তার মাধ্যমে তোমাদের জীবিকারূপে ফল-ফলাদি উদ্গত করেছেন।

সূরা বাকারার ৫৭ নং আয়াত-

وَ اَنْزَلْنَا عَلَیْكُمُ الْمَنَّ وَ السَّلْوٰی.

এবং তোমাদের প্রতি মান্ন ও সালওয়া নাযিল করলাম।

সূরা আলে ইমরানের ১৫৪ নং আয়াত-

ثُمَّ اَنْزَلَ عَلَیْكُمْ مِّنْۢ بَعْدِ الْغَمِّ اَمَنَةً نُّعَاسًا یَّغْشٰی طَآىِٕفَةً مِّنْكُمْ.

তারপর আল্লাহ তোমাদের প্রতি দুঃখের পর প্রশান্তি নাযিল করলেন তন্দ্রারূপে, যা তোমাদের মধ্যে কতক লোককে অচ্ছন্ন করেছিল।

আমাদের প্রতি আততানযীল নামের দাবি

১. কুরআন মাজীদ যেহেতু মহান আল্লাহ তাআলার কালাম তাই এর সত্যতার ব্যাপারে অন্তরে কোনরূপ সন্দেহ-সংশয় থাকা উচিত নয়। বরং অটল-অবিচল ঈমান থাকা জরুরি যে, কুরআন মাজীদের প্রতিটি কথা সন্দেহাতীতভাবে সত্য।

২. কুরআন মাজীদ যেহেতু আল্লাহ তাআলার কালাম, তাই এই কালাম থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের খায়ের ও বরকত অর্জনে সচেষ্ট হওয়া উচিত এবং এর প্রতি যথাযথ তাযীম ও সম্মান প্রদর্শন করা উচিত।

৩. বেশি বেশি তিলাওয়াতের মাধ্যমে আল্লাহর পবিত্র কালামের অপার্থিব লয্যত ও স্বাদ অনুভব করা উচিত।

৪. কুরআন মাজীদের হেদায়েত ও বিধান অনুসারে নিজেদের জীবন গড়া জরুরি।

কেননা কুরআন মাজীদই হল ঈমানদারদের জন্য শেফা ও রহমতস্বরূপ। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

وَ نُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْاٰنِ مَا هُوَ شِفَآءٌ وَّ رَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِیْنَ وَ لَا یَزِیْدُ الظّٰلِمِیْنَ اِلَّا خَسَارًا.

আমি নাযিল করেছি এমন কুরআন, যা মুমিনদের পক্ষে শেফা ও রহমতের ব্যবস্থা। তবে জালিমদের ক্ষেত্রে এর দ্বারা ক্ষতি ছাড়া অন্য কিছু বৃদ্ধি হয় না। -সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ৮২ হ

 

 

advertisement