জান্নাতে প্রিয়নবীর সান্নিধ্য লাভ
কোনো মুমিনকে যদি প্রশ্ন করা হয়, তোমার কাছে এই পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় মানুষ কে? নির্দ্বিধায় তার উত্তর হবে- প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
মুমিনের কাছে যদি জানতে চাওয়া হয়, জান্নাতে তোমার সবচেয়ে বড় চাওয়া কী? সকল মুমিনের একই জবাব হবে- নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গলাভ।
মুমিন-হৃদয়ের তামান্না- জীবনে-মরণে প্রিয় নবীর সান্নিধ্য। জীবনভর প্রিয় নবীর আদর্শে উজ্জীবিত হবে এবং মৃত্যুর পর জান্নাতে তাঁর সান্নিধ্য লাভ করবে- ঈমানদারের জন্য এর চেয়ে বড় কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। সাহাবায়ে কেরামের জীবন থেকে আমরা এ শিক্ষাই পাই। রবীআ ইবনে কা‘ব আসলামী রা. ঐসব খোশনসীব সাহাবীদের একজন, যারা ছিলেন ‘আসহাবে সুফফা’র অন্তভুর্ক্ত। দ্বীন শেখার জন্য সারা দুনিয়ার সবকিছু ছেড়ে পড়ে থাকতেন নবীজীর দুয়ারে। একবার তার জন্য উন্মোচিত হয়ে গেল সৌভাগ্যের আলোক-দিগন্ত। সেই বিবরণ দিয়েছেন রবীআ রা. নিজেই। তিনি বলেন-
আমি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে রাত্রি যাপন করতাম। তাঁর জন্য অযুর পানি এনে দিতাম এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য খেদমত আঞ্জাম দিতাম। এক রাতে তাঁর ওযুর পানি এনে দিলাম। হঠাৎ আমার কানে প্রবেশ করল এক মধুর আওয়ায; নবীজী বললেন-
سَلْنِي.
তোমার কী চাওয়ার আছে, আমার কাছে চাও রবীআ!
তখন সবিনয়ে আমি আরয করলাম-
أَسْأَلُكَ مُرَافَقَتَكَ فِي الْجَنّةِ.
আল্লাহর রাসূল! আপনার কাছে আমার চাওয়া হল, জান্নাতে আপনার সান্নিধ্য।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
أَو غَيْرَ ذلِكَ.
এটা, না অন্য কিছু চাও?
আমি বললাম-
هُوَ ذاكَ
(আল্লাহর রাসূল!) এটা ছাড়া আমার আর কোনো চাওয়া নেই।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু সালাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
فَأَعِنِّي عَلَى نَفْسِكَ بِكَثْرَةِ السّجُودِ.
তাহলে অধিক পরিমাণে সিজদা করার মাধ্যমে এ বিষয়ে তুমি আমাকে সাহায্য করো। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪৮৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৩২০
জান্নাতে নবীজীর সঙ্গলাভ! পরকালে প্রিয়নবীর সান্নিধ্য! এরচেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কী হতে পারে! এর চেয়ে বড় খোশকিসমত আর কী থাকতে পারে? চাইতে হলে এভাবেই চাইতে হয়। এটাই মুমিন-হৃদয়ের অব্যক্ত বাসনা। এটাই মুমিনের পরম ও চূড়ান্ত প্রত্যাশা। মুমিনের হৃদয়-রাজ্য দখল করে আছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রেম-ভালবাসা এবং জান্নাতে তাঁর সঙ্গলাভের পবিত্র তামান্না। হাদীস ও ইতিহাস-গ্রন্থে জ্বলজ্বল করছে এ ধরনের অনেক ঘটনা।
এরকমই আরেকটি ঘটনা রয়েছে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর। শুনুন, তাঁরই যবানে। তিনি বলেন-
এক রাতে আমি কয়েক রাকাত নফল নামায পড়লাম। নামাযের শেষে আল্লাহ তাআলার হামদ-ছানা আদায় করলাম। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি দরূদ পাঠ করলাম। এরপর দুআ করতে শুরু করলাম। তখন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (আমার অগোচরে) বলতে থাকেন-
سَلْ تُعْطَهْ، سَلْ تُعْطَهْ.
তুমি (আল্লাহর কাছে) চাও, তোমাকে দেওয়া হবে। তুমি দুআ করো, তোমার দুআ কবুল করা হবে।
ইবনে মাসউদ রা. বলেন, আমি দুআ করলাম। এরপর মসজিদ থেকে বাড়িতে চলে এলাম। ভোর হলে আবু বকর সিদ্দীক রা. আমার বাড়িতে আসেন এবং জিজ্ঞেস করেন, আপনি আজ রাতে কী দুআ করেছেন?
বললাম, আমি এই দুআ করেছি-
اللّهُمّ إِنِّي أَسْأَلُكَ إِيمَانًا لَا يَرْتَدّ، وَنَعِيمًا لَا يَنْفَدُ، وَمُرَافَقَةَ نَبِيِّنَا مُحَمّدٍ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ فِي أَعَلَى جَنّةِ الْخُلْدِ.
হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট এমন ঈমান চাই, যার পর কুফরের দিকে প্রত্যাবর্তন হবে না। এমন নিআমত চাই, যা কখনো ফুরাবে না। আর আমার (পরম) চাওয়া, চিরস্থায়ী জান্নাতে প্রিয়নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সঙ্গলাভ। -মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস ১৬, ১৭; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৭০৬৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৪৩৪০
জান্নাতে কারা লাভ করবে প্রিয়নবীর সান্নিধ্য-পরশ
সাহাবায়ে কেরাম দুনিয়াতে নবীজীর সোহবত-ধন্য হয়েছেন। তাঁর পবিত্র দর্শনে লাভ করেছেন নয়নের শীতলতা, হৃদয়ের প্রশান্তি। আমাদের তো আল্লাহ তাআলার কুদরতী ব্যবস্থাপনার কারণে দুনিয়াতে নবীজীর দর্শন ও সোহবত লাভের সৌভাগ্য হয়নি। কিন্তু তাই বলে কি আখেরাতেও প্রিয় নবীর সঙ্গে থাকতে পারব না? জান্নাতেও নবীজীর সোহবত লাভের সুযোগ হবে না? না, নিরাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমাদের নবী আমাদেরকে নিরাশ করে যাননি। আমাদের জন্য অবারিত আছে জান্নাতে তাঁর সঙ্গ লাভের নূরানী সুযোগ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানতেন, তাঁর অনাগত উম্মত তাঁর সোহবত পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকবে, তাঁর সান্নিধ্য পরশ লাভের জন্য জীবন উৎসর্গ করবে। তাই তিনি এমন কিছু আমল উপহার দিয়ে গেছেন, যা গ্রহণ করলে সহজেই অর্জিত হবে আমাদের কাক্সিক্ষত সৌভাগ্য। আসুন, সে নূরানী আমলসমূহ জানি এবং আমলের মাধ্যমে লাভ করি জান্নাতে প্রিয়নবীর সান্নিধ্য!
১. বেশি বেশি সিজদা করা
আমরা রবীআ ইবনে কা‘ব আসলামী রা.-এর ঘটনা পড়ে এসেছি। সেখানে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দুইবার বলেছেন, তোমার যা ইচ্ছা আমার কাছে চাও। রবীআ রা. উত্তর দিয়েছেন, আমার প্রথম ও শেষ চাওয়া একটাই- জান্নাতে আপনার সান্নিধ্য। তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু সালাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
فَأَعِنِّي عَلَى نَفْسِكَ بِكَثْرَةِ السّجُودِ.
তাহলে অধিক পরিমাণ সিজদা দ্বারা আমাকে সাহায্য কর। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪৮৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৩২০
তো জান্নাতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সান্নিধ্য লাভের একটি উপায় হল- বেশি বেশি আল্লাহ তাআলাকে সিজদা করা। ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নতে মুআক্কাদার পরিমাণ নির্ধারিত। এসবের মধ্যে তো হ্রাস-বৃদ্ধি করা যাবে না। তাই আমাদের কর্তব্য হচ্ছে, অধিক পরিমাণে নফল নামায পড়া।
২. এতীমের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করা
সাহল ইবনে সা‘দ রা. বর্ণনা করেন, একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মধ্যমা ও শাহাদাত অঙ্গুলীর মাঝে সামান্য ফাঁক করলেন। এরপর এ দুই আঙ্গুলের দিকে ইশারা করে বললেন-
أَنَا وَكَافِلُ الْيَتِيمِ كَهَاتَيْنِ فِي الْجَنّةِ.
আমি এবং এতীমের দায়িত্ব গ্রহণকারী জান্নাতে এভাবে (পাশাপাশি) থাকব। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৩০৪, ৬০০৫; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫১৫০; জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯১৮
হাদীসের ব্যাখ্যাকারগণ বলেন-
এতীমের দায়িত্ব গ্রহণের অর্থ হচ্ছে, তার অন্য-বস্ত্রের ব্যবস্থা করা। তাকে আদব-আখলাক ও ধর্মীয় বিধি-বিধান শিক্ষা দেওয়া। তথা দ্বীন ও দুনিয়ার যাবতীয় বিষয়ে এতীমের প্রতিপালন করা। -দলীলুল ফালিহীন ২/৮০
যারা এতীমের ভরণ-পোষণ করবে তারা নবীজীর সঙ্গে জান্নাতে থাকবে দুই আঙ্গুলের মতো। ‘দুই আঙ্গুলের মতো’ এ কথার মর্ম কী? কুরতুবী রাহ. বলেন-
এর অর্থ হল, যারা এতীমের তত্ত্বাবধান করবে তারা জান্নাতে নবীজীর সঙ্গে থাকবে। -আলমুফহিম ৬/৬১৪
৩. কন্যাসন্তানের লালনপালন করা
আনাস ইবনে মালেক রা. বর্ণনা করেন, একদিন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
مَنْ عَالَ جَارِيَتَيْنِ دَخَلْتُ أَنَا وَهُوَ الجَنّةَ كَهَاتَيْنِ.
যে ব্যক্তি দুটি কন্যাসন্তানের ভরণ-পোষণ করবে আমি এবং সে এভাবে জান্নাতে থাকব। (অর্থাৎ মধ্যমা ও শাহাদাত আঙ্গুল যেমন পাশাপাশি থাকে।) -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯১৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৩১; আলআদাবুল মুফরাদ, বুখারী, হাদীস ৮৯৪
৪. বোনদের লালনপালনের দায়িত্ব গ্রহণ করা
আনাস ইবনে মালেক রা. বর্ণনা করেন, একবার রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মধ্যমা ও শাহাদাত অঙ্গুলীর দিকে ইশারা করে বলেন-
مَنْ عَالَ ابنتين أَوْ أُخْتَيْنِ أَوْ ثَلَاثًا حَتّى يَبِنّ أَوْ يَمُوتَ عَنْهُنّ كُنْتُ أَنَا وَهُوَ فِي الْجَنّةِ كهاتين.
যে ব্যক্তি দুই কন্যা বা দুই বোনের ভরণ-পোষণ করবে কিংবা তিন কন্যা বা তিন বোনের ভরণ-পোষণ করবে, যতক্ষণ না তাদের বিয়ে হবে কিংবা সে মৃত্যুবরণ করবে, আমি এবং সে জান্নাতে এভাবে (পাশাপাশি) থাকব। -সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৪৪৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১২৪৯৮
৫. উত্তম চরিত্রের অধিকারী হওয়া
আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. বলেন, একদা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু সালাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
أَلَا أُخْبِرُكُمْ بِأَحَبِّكُمْ إِلَيّ وَأَقْرَبِكُمْ مِنِّي مَجْلِسًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ؟ فَسَكَتَ الْقَوْمُ، فَأَعَادَهَا مَرّتَيْنِ أَوْ ثَلَاثًا، قَالَ الْقَوْمُ: نَعَمْ يَا رَسُولَ اللهِ، قَالَ: أَحْسَنُكُمْ خُلُقًا.
আমি কি তোমাদেরকে ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে অবগত করব না, যে কিয়ামতের দিন আমার সবচেয়ে প্রিয় এবং সর্বাধিক নিকটবর্তী হবে?
সাহাবায়ে কেরাম চুপ রইলেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একই প্রশ্ন করলেন দুই বা তিনবার। তখন তারা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! অবশ্যই বলুন। তিনি বললেন, সে হল ঐ ব্যক্তি, যার আখলাক সবচেয়ে সুন্দর। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৬৭৩৫; আলআদাবুল মুফরাদ, হাদীস ২৭২
৬. নবীজীকে মহব্বত করা
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, জনৈক ব্যক্তি রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে আপনি কী বলেন, যে কোনো সম্প্রদায়কে ভালবাসে, কিন্তু তাদের সাথে মিলিত হতে পারেনি (অর্থাৎ তাদের পর্যায়ের নয়)। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন-
المَرْءُ مَعَ مَنْ أَحَبّ.
(দুনিয়াতে) যে যাদের ভালবাসে (আখেরাতে) সে তাদের সাথে থাকবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬১৬৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৪০
আনাস ইবনে মালেক রা. বলেন, এক ব্যক্তি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করল, কিয়ামত কবে সংঘটিত হবে?
তিনি বললেন, কিয়ামতের জন্য তুমি কী প্রস্তুতি নিয়েছ?
লোকটি বলল, আমি এর জন্য তেমন কোনো প্রস্তুতি নিতে পারিনি; তবে, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসি।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
أَنْتَ مَعَ مَنْ أَحْبَبْتَ.
(ইহকালে) তুমি যাকে মহব্বত করবে (পরকালে) তুমি তার সঙ্গে থাকবে।
আনাস রা. বলেন, নবীজীর এই কথা শুনে আমরা এত খুশি হয়েছি যে, দুনিয়ার অন্য কিছুতে এমন খুশি হইনি।
আনাস রা. আরো বলেন, আমি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং আবু বকর ও উমর রা.-কে মহব্বত করি। তাই আশা করি, জান্নাতে আমি তাঁদের সাথেই থাকব, যদিও তাদের মতো আমল করতে পারিনি। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৬৮৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৩৯
মহব্বতের দাবি কী?
যে যাকে মহব্বত করে সে তার সবকিছু ভালবাসে এবং সব বিষয়ে তার অনুসরণ-অনুকরণ করার চেষ্টা করে। প্রিয়জনের চিন্তা-চেতনার অনুসরণ করে। তার আচার-ব্যবহার, রীতি-নীতির অনুকরণ করে। সাহাবায়ে কেরাম নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মহব্বত করতেন প্রাণের চেয়েও বেশি। তাই তাঁরা নবীজীকে পরিপূর্ণ অনুসরণ করতেন। তাঁর আনীত দ্বীন ও আদর্শের পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুকরণ করতেন। এটাই মহব্বতের দাবি। এ ছাড়া মহব্বতের দাবি অনর্থক আত্মতৃপ্তি বৈ কিছু নয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
قُلْ اِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّوْنَ اللهَ فَاتَّبِعُوْنِیْ یُحْبِبْكُمُ اللهُ وَ یَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوْبَكُمْ وَ اللهُ غَفُوْرٌ رَّحِیْمٌ.
(হে নবী! মানুষকে) বলে দাও, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালবেসে থাক, তবে আমার অনুসরণ কর, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালবাসবেন এবং তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করে দেবেন। আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ৩১
আনাস ইবনে মালেক রা. বলেন, একদিন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন-
يَا بُنَيّ، إِنْ قَدَرْتَ أَنْ تُصْبِحَ وَتُمْسِيَ لَيْسَ فِي قَلْبِكَ غِشّ لِأَحَدٍ فَافْعَلْ. ثُمّ قَالَ لِي: يَا بُنَيّ وَذَلِكَ مِنْ سُنّتِي، وَمَنْ أَحْيَا سُنّتِي فَقَدْ أَحَبّنِي، وَمَنْ أَحَبّنِي كَانَ مَعِي فِي الجَنّةِ.
(قال الترمذي: هذا حديث حسن غريب)
হে বৎস! তুমি যদি এমন অবস্থায় সকাল ও সন্ধ্যা যাপন করতে পার যে, দিলে কারো প্রতি হিংসা নেই, তাহলে এমনই কর। এটা আমার সুন্নত।
আর যে আমার সুন্নত যিন্দা করল সে আমাকে মহব্বত করল। আর যে আমাকে মহব্বত করল সে আমার সাথে জান্নাতে থাকবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৬৭৮; তাযীমু কাদরিস সালাহ, হাদীস ৭১৪; মুজামে আওসাত, তবারানী, হাদীস ৫৯৯১
৭. বেশি বেশি দরূদ পাঠ করা
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বর্ণনা করেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু সালাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
أَلَا إِنّ أَوْلَى النّاسِ بِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَكْثَرُهُمْ عَلَيّ صَلَاةً.
শুনে রাখো, যে আমার উপর বেশি পরিমাণে দরূদ পাঠ করবে নিশ্চয় কিয়ামতের দিন সে আমার সর্বাধিক নৈকট্যপ্রাপ্ত হবে। -মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস ৫০১১; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস ৩২৪৪৭; জামে তিরমিযী, হাদীস ৪৮৪; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৯১১
সুতরাং জান্নাতে নবীজীর নৈকট্য লাভের জন্য আমরা গোনাহমুক্ত জীবন গড়ব, ফরয-ওয়াজিব আমলগুলো গুরুত্বের সাথে আদায় করব এবং অধিক পরিমাণে দরূদ শরীফ পাঠ করতে থাকব।
৮. তাকওয়ার জীবন অবলম্বন করা
মুআয ইবনে জাবাল রা. বলেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাকে ইয়ামানে পাঠান তখন তিনি তাকে এগিয়ে দিতে বের হন। মুআয রা. সওয়ারীতে চলছেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু সালাইহি ওয়াসাল্লাম পায়ে হাঁটছেন আর অসিয়ত করছেন। অসিয়ত করা শেষ হলে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
يَا مُعَاذُ إِنّكَ عَسَى أَنْ لَا تَلْقَانِي بَعْدَ عَامِي هَذَا وَلَعَلّكَ أنَ تَمُرّ بِمَسْجِدِي هَذَا، وَقَبْرِي.
হে মুআয! সম্ভবত এ বছরের পর আমার সাথে তোমার আর দেখা হবে না। হয়ত তুমি আমার মসজিদের পাশ দিয়ে হাঁটবে, আমার কবরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করবে! (কিন্তু আমার দেখা পাবে না।)
এ কথা শুনে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আসন্ন বিচ্ছেদ-বিরহে মুআয রা. অঝোরে কাঁদতে শুরু করলেন।
...এরপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনার দিকে ফিরে তাকালেন এবং বললেন-
إِنّ أَهْلَ بَيْتِي هَؤُلَاءِ يَرَوْنَ أَنّهُمْ أَوْلَى النّاسِ بِي وَلَيْسَ كَذَلِكَ. إِنّ أَوْلَى النّاسِ بِي الْمُتّقُونَ مَنْ كَانُوا حَيْثُ كَانُوا.
আমার পরিবারের এই লোকেরা মনে করে, তারা আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ। অথচ বিষয়টা এমন না; আমার সর্বাধিক নৈকট্যপ্রাপ্ত হল ঐ ব্যক্তি, যে তাকওয়ার যিন্দেগি অবলম্বন করে। সে যে কেউই হোক এবং যেখানেই অবস্থান করুক। [দ্র. মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২০৫২, ২২০৫৪; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৬৪৭; আসসুন্নাহ, ইবনে আবু আসেম, হাদীস ২১২; মুজামে কাবীর, তবারানী ২০/ ১২০-১২১ (২৪১)]
একটি দুআ
নিবন্ধের শুরুতে উদ্ধৃত হয়েছে যে, এক রাতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ আজ যে দুআ করবে সে দুআই আল্লাহ তাআলা কবুল করবেন। পরদিন তাকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, ঐ রাতে তিনি ঈমান, জান্নাত ও জান্নাতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্যে থাকার দুআ করেছিলেন। এটা শুধু তাঁর ঐ রাতের দুআ নয়; বরং সবসময় তিনি এই দুআ করতেন। তাঁর পুত্র আবু উবায়দা রাহ. বলেন, আব্বাজী একদিন বলেছেন-
إن لي دعاء ما أكاد أن أدعه.
আমার একটা দুআ আছে, যা কখনো বাদ দিই না।
এরপর তিনি এই দুআটি উল্লেখ করেছেন-
اللّهُمّ إِنِّي أَسْأَلُكَ إِيمَانًا لَا يَرْتَدُّ، وَنَعِيمًا لَا يَنْفَدُ، وَمُرَافَقَةَ نَبِيِّنَا مُحَمّدٍ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ فِي أَعَلَى جَنّةِ الْخُلْدِ.
হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট এমন ঈমান চাই, যার পর কুফরের দিকে প্রত্যাবর্তন হবে না। এমন নিআমত চাই, যা কখনো ফুরাবে না এবং আমার শেষ চাওয়া সুউচ্চ জান্নাতে আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গলাভ। -মুসনাদে আবু দাউদ তয়ালিসী, হাদীস ৩৩৮; মারিফাতুস সাহাবা, আবু নুআইম ৩/২৩২-২৩৩, হাদীস ৪৫০১; হিলইয়াতুল আউলিয়া ১/১২৭
আসুন, জান্নাতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু সালাইহি ওয়াসাল্লামের সান্নিধ্য লাভের আশায় উল্লিখিত আমলগুলো করতে থাকি। পাশাপাশি এই দুআটিও জারি রাখি।