হাদীসের আলোকে সেরা দান
‘দানে ধন বাড়ে’, ‘দান করে কেউ দরিদ্র হয় না’-আমাদের সমাজে এসব কথা খুবই পরিচিত। ধার্মিক-অধার্মিক কিংবা মুসলিম-অমুসলিমের কোনো ফারাক এখানে নেই। আমাদের চারপাশের দেখা বাস্তবতা হল, স্বতঃস্ফূর্ত দানের মানসিকতা যাদের আছে, ধর্মীয় ও সামাজিক কল্যাণমূলক যে কোনো ইস্যুতে যারা বরাবর এগিয়ে আসেন, কোনো অভাবী-অসহায়-বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি কখনোই যাদের কাছ থেকে খালি হাতে ফেরে না, কখনোই তাদের কণ্ঠে এ অনুযোগও শোনা যায় না-দান করে আমি শেষ হয়ে গেছি! এ দান বরং তাদের সম্পদকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলে। তারাও উদার হাতেই বিলিয়ে যান তাদের দান।
দান-সদকা মুমিন জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষঙ্গ। পবিত্র কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে দান-সদকার অনেক ফযীলতের কথা। দান করলে বিপদাপদ দূর হয়। দান আল্লাহ তাআলার ক্রোধকে নিভিয়ে দেয়। দানের প্রতিদানকে আল্লাহ তায়ালা সাতশ গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেন, এমনকি কাউকে আরও বেশি পরিমাণে নেকি দিয়ে থাকেন-কুরআন ও হাদীস থেকে আহরিত এসব কথা আমাদের মুখে মুখে বেশ প্রচলিত। বলার কথা হল, এ দান-সদকা কেবল একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত-বিষয়টি এমনই নয়। বরং পবিত্র কুরআনে কারীমে খাঁটি ও যথার্থ মুমিনের পরিচয় দিতে গিয়ে মহান রাব্বুল আলামীন এ দান-সদকার কথাও বলেছেন। পড়ুন-
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ، الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَ، أُولَئِكَ هُمُ الْمُؤْمِنُونَ حَقًّا لَهُمْ دَرَجَاتٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَمَغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيمٌ .
সন্দেহ নেই, মুমিন তো তারাই, আল্লাহর নাম উচ্চারিত হলে যাদের অন্তর ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে, যখন তাদের নিকট তাঁর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করা হয় তখন তা তাদের ঈমানকে বাড়িয়ে দেয় এবং তারা তাদের প্রভূর ওপর ভরসা করে; যারা যথারীতি নামায আদায় করে এবং আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে তারা ব্যয় করে। এরাই হচ্ছে প্রকৃত মুমিন। তাদের জন্য তাদের প্রভুর নিকট রয়েছে সুউচ্চ মর্যাদা, ক্ষমা ও সম্মানজনক রিযিক। -সূরা আনফাল (৮) : ২-৪
আল্লাহকে ভয় করা, পবিত্র কুরআনের তিলাওয়াত শুনে ঈমান বৃদ্ধি পাওয়া, আল্লাহ তাআলার ওপর ভরসা করা এবং নিয়ম মেনে নামায আদায় করা-একজন মুসলমানের জন্য তো এসবের কোনো বিকল্প নেই। তবে এখানে যে বিষয়টি লক্ষণীয়-এসবের পাশাপাশি আল্লাহ তাআলা প্রকৃত মুমিনের পরিচয় হিসেবে দান-সদকার কথাও উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন- (তরজমা) ‘আমি তাদেরকে যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে তারা ব্যয় করে।’ এ ব্যয় করার মধ্যে ফরয দান যাকাত যেমন রয়েছে, তেমনি নফল দান-সদকাও এর অন্তর্ভুক্ত। দান-সদকা নিয়ে, তা ফরয-নফল যাই হোক, পবিত্র কুরআনে তো কত কথাই বলা হয়েছে। কিন্তু উপরোক্ত কথাটি, মাত্র তিনটি আরবী শব্দে-
وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَ.
যেভাবে বারবার উল্লেখিত হয়েছে পবিত্র কুরআনে, তাও সবিশেষ লক্ষণীয়।
ফরয দান তথা যাকাতের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পরিমাণ রয়েছে। কারও কাছে যদি যাকাত আদায়যোগ্য নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে, তবে শতকরা আড়াই টাকা হারে তাকে যাকাত আদায় করতে হয়। যাকাত যদি ফরয হয়, তবে একজন মুসলমানের জন্যে এ যাকাত আদায় থেকে বিরত থাকার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু নফল দানের ক্ষেত্রে এমন কোনো সীমা নির্ধারিত নেই। নেই বাধ্যবাধকতাও। ধনী-গরীব যে কেউ যখন ইচ্ছা দান করতে পারে। কম-বেশি যে কোনো পরিমাণই দান করতে পারে। দান প্রকাশ্যে হতে পারে, হতে পারে গোপনেও। প্রশ্ন হল, কোথায় কখন কীভাবে দান করলে নেকী পাওয়া যাবে বেশি? কোন্ দানটি আল্লাহ তাআলার নিকট সেরা দান হিসেবে বিবেচিত হবে? এ প্রশ্নের উত্তর আমরা সরাসরি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখ-নিঃসৃত হাদীসেই খুঁজে পাই। কখনো বিশেষ কোনো পরিস্থিতিতে তিনি নিজেই সেরা দানের পরিচয় তুলে ধরেছেন। কখনো কোনো সাহাবীর প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছেন সেরা দান কোন্টি। কয়েকটি হাদীস লক্ষ করুন-
এক. হযরত হাকীম ইবনে হিযাম রা. থেকে বণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
أَفْضَلُ الصّدَقَةِ - أَوْ خَيْرُ الصّدَقَةِ - عَنْ ظَهْرِ غِنًى وَالْيَدُ الْعُلْيَا خَيْرٌ مِنَ الْيَدِ السّفْلَى وَابْدَأْ بِمَنْ تَعُولُ.
সর্বোত্তম সদকা সেটাই, যা নিজের সচ্ছলতা বজায় রেখে করা হয়। দাতার হাত গ্রহীতার হাতের তুলনায় উত্তম। আর (যখন অর্থব্যয় করবে তখন) তোমার পোষ্য ও অধীনস্তদের দিয়ে শুরু করবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৩৪
এ হাদীসের প্রথমাংশে সেরা দানের একটি পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। দ্বিতীয়াংশে বলা হয়েছে দানের শ্রেষ্ঠত্বের কথা। আর শেষ বাক্যটিতে রয়েছে অর্থব্যয় ও দান-সদকা বিষয়ক একটি বিশেষ নির্দেশনা। বলা হয়েছে-যাদের প্রতিপালনের ভার তোমার ওপর ন্যস্ত, তোমার অর্থব্যয়টা তাদেরকে দিয়েই শুরু করো। তাদের প্রয়োজনটা আগে মেটাও। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে-নিজের প্রতিপাল্য ও অধীনস্ত পরিবার-পরিজনের ভরণপোষণে যে অর্থ আমরা ব্যয় করি, তাও কি সদকা বলে বিবেচিত হবে? তাতেও কি সওয়াব পাওয়া যাবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এভাবে-
مَهْمَا أَنْفَقْتَ فَهُوَ لَكَ صَدَقَةٌ حَتّى اللّقْمَةَ تَرْفَعُهَا فِي فِي امْرَأَتِكَ.
তুমি যা কিছুই ব্যয় কর, সেটাই তোমার জন্যে সদকা, এমনকি তোমার স্ত্রীর মুখে যে নলাটি তুমি তুলে দাও সেটাও। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৩৫৪
বলাবাহুল্য, আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে অনুগ্রহস্বরূপ প্রাপ্ত অর্থ-সম্পদ একজন আল্লাহবিশ্বাসী মুমিন ব্যক্তি তো আল্লাহর সন্তুষ্টির পথেই ব্যয় করবে। যে কাজে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন, যে কাজে তাঁর বিধান লঙ্ঘিত হয়, সে কাজে মুমিন কী করে আল্লাহর দেয়া নিআমত ও রিযিক নষ্ট করবে? তাই মুমিন ব্যক্তি তার প্রতিটি অর্থব্যয়ের জন্যেই পুরস্কৃত হবে মহান আল্লাহর দরবারে। হাদীসে স্পষ্ট করা হয়েছে-স্ত্রীর জন্যে সে যে খাবারের ব্যবস্থা করেছে, যা তার ওপর আরোপিত এক অপরিহার্য দায়িত্ব, সেটাও তার জন্যে সদকা। আরেকটি হাদীস লক্ষ করুন, এর ভাষ্য আরও পরিষ্কার, আরও আলোছড়ানো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
دِينَارٌ أَنْفَقْتَهُ فِى سَبِيلِ اللهِ، وَدِينَارٌ أَنْفَقْتَهُ فِى رَقَبَةٍ، وَدِينَارٌ تَصَدّقْتَ بِهِ عَلَى مِسْكِينٍ، وَدِينَارٌ أَنْفَقْتَهُ عَلَى أَهْلِكَ، أَعْظَمُهَا أَجْرًا الّذِى أَنْفَقْتَهُ عَلَى أَهْلِكَ.
একটি দিনার তুমি আল্লাহর রাস্তায় (জিহাদে) ব্যয় করেছ, একটি দিনার তুমি দাসমুক্তির জন্যে ব্যয় করেছ, একটি দিনার তুমি কোনো মিসকীনকে সদকা করেছ, আরেকটি দিনার তুমি তোমার পরিবার-পরিজনের জন্যে ব্যয় করেছ। এসবের মধ্যে সর্বাধিক প্রতিদান সেটাতেই পাওয়া যাবে, যা তুমি তোমার পরিবার-পরিজনের জন্যে ব্যয় করেছ। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৯৯৫
আমাদের আলোচ্য হাদীসটিতে সেরা দানের পরিচয়ে বলা হয়েছে-নিজের সচ্ছলতা ঠিক রেখে যে দান করা হয় সেটাই সেরা দান। প্রথম কথা হল, নিজের পরিবার-পরিজনের প্রয়োজন পূরণে যে অর্থ ব্যয় করা হয় সেটার সওয়াবই সবচেয়ে বেশি। এটাও একপ্রকার সদকা, একপ্রকার দান। এটা যেহেতু শরীয়তের পক্ষ থেকেই আরোপিত এক দায়িত্ব, যা অবহেলা কিংবা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই, সঙ্গত কারণেই তাতে সওয়াব বেশি হওয়াটাও স্বাভাবিক। আর পরিবার ও অধীনস্তদের বাইরে যখন কাউকে দানের প্রসঙ্গ আসে, তখন ততটুকুই দান করো, যেন তোমার ওপর আরোপিত দায়িত্ব পালনে, তোমার অধীনস্তদের ভরণপোষণ ও অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন পূরণে তুমি আবার অপারগ হয়ে বসে না থাক। কোনো অভাবী ব্যক্তির সহায়তায় নিজের সবটুকু বিলিয়ে দিয়ে যদি আবার নিজেই অভাবের শিকার হতে হয়, নিজের এবং পরিবার-পরিজনের প্রয়োজন পূরণের জন্য অন্য কারও কাছে হাত পাততে হয়, তবে এ দান ও সহযোগিতা শরীয়তের উদার দৃষ্টিতে কিছুতেই কাম্য হতে পারে না। হযরত জাবের রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদীস-একবার আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে ছিলাম। এক লোক তখন ডিমের মতো এক টুকরো স্বর্ণ নিয়ে এসে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! খনি থেকে আমি এটা পেয়েছি। এটি ছাড়া আমার আর কিছুই নেই। আপনি এটি গ্রহণ করুন। এটি সদকা।’
একথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। লোকটি তখন ডান দিক দিয়ে এসে একই কথা বলল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবার মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। এবার সে বাম দিক থেকে এল। এবারও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। লোকটি এরপর পেছন দিক থেকে কথা বলল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন তার হাত থেকে ওই টুকরোটা নিয়ে তার দিকেই ছুড়ে মারলেন। যদি তার গায়ে লাগত, তবে সে মারাত্মক ব্যথা পেত। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
يَأْتِى أَحَدُكُمْ بِمَا يَمْلِكُ فَيَقُولُ هَذِهِ صَدَقَةٌ، ثُمَّ يَقْعُدُ يَسْتَكِفّ النَّاسَ، خَيْرُ الصّدَقَةِ مَا كَانَ عَنْ ظَهْرِ غِنًى.
তোমাদের কেউ কেউ নিজের মালিকানাধীন সবকিছু নিয়ে এসে বলে-এসব সদকা। এরপর সে মানুষের কাছে হাত পেতে বসে থাকে। সর্বোত্তম সদকা তো সেটাই, যা সচ্ছলতা বজায় রেখে করা হয়। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৬৭৫
দান-সদকা আমাদের পবিত্র ধর্মে অত্যন্ত ফযীলতময় ও মর্যাদাপূর্ণ একটি আমল। কিন্তু এ দানের ক্ষেত্রেও যেন স্বাভাবিকতার সীমা লঙ্ঘিত না হয়, নিজের এবং পরিবার-পরিজনের বৈধ অপরিহার্য প্রয়োজনাদি মেটানোর দিকটি যেন উপক্ষিত না হয়, ইসলাম আমাদেরকে এ শিক্ষাও দেয়। কুরআনে মহান রাব্বুল আলামীনের অমোঘ নির্দেশনা-
وَ لَا تَجْعَلْ یَدَكَ مَغْلُوْلَةً اِلٰی عُنُقِكَ وَ لَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُوْمًا مَّحْسُوْرًا.
(দান না করে) তুমি তোমার হাতকে গলায় আটকে রেখো না, আবার তা সম্পূর্ণরূপে বিছিয়েও দিয়ো না। অন্যথায় তুমি তিরস্কৃত ও নিঃস্ব হয়ে পড়বে। -সূরা ইসরা (১৭) : ২৯
কার্পণ্য করা যাবে না। দান করা থেকে সবসময় হাত গুটিয়ে রাখা যাবে না। কোনো উপলক্ষ যখন আসে, সাধ্যমতো সেখানে দান করতে হবে। পরিমাণে তা কম-বেশি যা-ই হোক। এটা মুমিনের গুণ, মুমিনের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু তাই বলে নিজেকে অভাবের মুখে ঠেলে দিয়ে সবকিছুই দান করে দেয়া-এটাও ইসলামের শিক্ষা নয়। অবশ্য কেউ যদি এতটাই সংযমী ও ধৈর্যশীল হয়, সবকিছু বিলিয়ে দিয়েও নিজের অভাবের কথা, প্রয়োজনের কথা অন্য কারও কাছে প্রকাশ করবে না, আল্লাহ তাআলার ওপর তার ভরসা যদি এতটাই প্রবল হয় এবং এ নিয়ে তার অধীনস্তদের কোনো প্রকার অনুযোগ না থাকে, তখন সে চাইলে পুরো সম্পদও দান করে দিতে পারে। তাবুকের যুদ্ধের প্রাক্কালে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. এমনটাই করেছিলেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে দান গ্রহণও করেছিলেন। আবার তিনিই অবস্থার ভিন্নতাকে আমলে নিয়ে কোনো কোনো সাহাবীর পুরো সম্পদ দান হিসেবে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। দান-সদকার ক্ষেত্রে ভারসাম্যের এ শিক্ষাটি কুরআনে কারীমের আরেকটি স্থানেও আলোচিত হয়েছে। সেখানকার উপস্থাপন অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত, মাত্র একটি শব্দে, কিন্তু এতে নিহিত রয়েছে অর্থের ব্যাপকতা। সাহাবায়ে কেরাম নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করতেন-তারা কোন্ সম্পদ দান করবে? এ প্রশ্নটি উল্লেখ করে আল্লাহ তাআলা জানিয়ে দিয়েছেন-
قُلِ الْعَفْوَ.
আপনি বলে দিন, যা (তোমাদের প্রয়োজনের) অতিরিক্ত। -সূরা বাকারা (২) : ২১৯
কথা সহজ-প্রথমে নিজের এবং নিজের পরিবারস্থ প্রতিপাল্য যারা তাদের হক আদায় করো। এরপর যদি কিছু সম্পদ হাতে থেকে যায়, সেখান থেকে দান করো অভাবী-অসহায়দের, শরীক থাকো কল্যাণকর কাজে। মনে রাখতে হবে-নফল ও ঐচ্ছিক এ দানের জন্যে কিছুতেই ফরয ও অবধারিত হক লঙ্ঘন করা যাবে না। ভারসাম্যের এ পথে যে দান, সেটাই সেরা দান।
দুই.
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তিনি প্রশ্ন করেছেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কোন্ সদকা সবার সেরা? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিয়েছেন-
جَهْدُ الْمُقِلِّ وَابْدَأْ بِمَنْ تَعُولُ.
অর্থসম্পদ যার কম, যে অসচ্ছল, কষ্ট করে সে যা দান করে (সেটাই সর্বোত্তম সদকা)। আর তুমি তোমার অধীনস্তদের দিয়ে শুরু করো। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৬৭৯
এ তো স্পষ্ট-একজন ধনী মানুষ নিজের প্রয়োজন মেটানোর পর বেশ পরিমাণ অর্থ সঞ্চিত রেখেও চাইলে অনেক টাকা দান করতে পারবে। এতে তাকে কোনো সংকটের মুখে পড়তে হবে না। কিন্তু একজন অসচ্ছল মানুষ, নিজের আবশ্যকীয় প্রয়োজন মেটানোই যার জন্য কষ্টকর, অল্প পরিমাণে দান করাও তার জন্যে কষ্টকর। নিজের প্রয়োজনই যেখানে মেটে না, সেখানে অন্যের প্রয়োজন মেটানোয় এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টি কল্পনা করা সহজ নয়। এর পরও যখন অসচ্ছল কোনো ব্যক্তি দান করে, পরিমাণে তা যত অল্পই হোক, ইখলাস ও আন্তরিকতার মিশেলে তা আল্লাহর দরবারে অনেক অনেক মূল্যবান বলে বিবেচিত হতে পারে।
তিন.
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত আরেকটি হাদীস, এক ব্যক্তি এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কোন্ সদকায় সবচেয়ে বেশি সওয়াব হবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিয়েছেন-
أَنْ تَصَدّقَ وَأَنْتَ صَحِيحٌ شَحِيحٌ تَخْشَى الْفَقْرَ وَتَأْمُلُ الْغِنَى، وَلاَ تُمْهِلْ حَتّى إِذَا بَلَغَتِ الْحُلْقُومَ قُلْتَ لِفُلاَنٍ كَذَا وَلِفُلاَنٍ كَذَا أَلاَ وَقَدْ كَانَ لِفُلاَنٍ.
যখন তুমি সুস্থ-সবল, তোমার উপার্জিত সম্পদ তুমি তোমার নিজের কাছে রেখে দিতে চাচ্ছ, অভাবে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও তোমার রয়েছে, তুমি সচ্ছলতার স্বপ্নও দেখ-এমন পরিস্থিতিতে তুমি যে দান করবে (সেটাই তোমার জন্যে অধিক প্রতিদান বয়ে আনবে)। (দান-সদকার ক্ষেত্রে) তুমি এতটা বিলম্ব করো না যে, তোমার প্রাণ ওষ্ঠাগত হল আর তখন তুমি বলতে থাকলে-এটা অমুকের, এটা তমুকের। শোনো, এটা তো তখন অন্যদেরই হয়ে যায়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৩২
অনেকসময় দেখা যায়, মানুষ যখন কোনো বিপদে পড়ে তখন সে দান করতে চায়। একইভাবে যখন অসুস্থতা, বার্ধক্য কিংবা অন্য কোনো পরিস্থিতির মুখে পড়ে কেউ নিজের জীবন সম্পর্কে নিরাশ হয়ে পড়ে, জীবন কিংবা নিজের উপার্জিত সম্পদ উপভোগ করার কোনো আশা আর তার থাকে না, তখনও সে সম্পদ গরীবদের দান করে দিতে চায়। সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় কেউ নিজের সম্পদ ইচ্ছেমতো দান করতে পারে। কিন্তু যদি মৃত্যুপরবর্তী সময়ের জন্যে ওসিয়ত করে যেতে চায়, তবে তা অবশ্যই রেখে যাওয়া সম্পদের এক তৃতীয়াংশের মধ্যে সীমিত থাকতে হবে। বাকিটা ওয়ারিশদের। এ হাদীসের মূল মর্ম এটাই-দান যা করতে চাও, সুস্থ-স্বাভাবিক অবস্থাতেই করে নাও। মৃত্যু যখন তোমার দুয়ারে কড়া নাড়বে, তখন এটা-ওটা দান করার ওসিয়ত করতে থাকবে-এমনটা করার খুব সুযোগ নেই।
মানুষ যতদিন সুস্থ-সবল থাকে, দুনিয়ার রঙিন স্বপ্ন তাকে হাতছানি দিতে থাকে। একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের আশায় সে বিভোর থাকে। অভাবের মুখে পড়ার আশঙ্কাও মনে উঁকি দেয়। আর শয়তান তো এ ভয় দেখানোতেই লিপ্ত। পবিত্র কুরআনের ঘোষণা-
اَلشَّیْطٰنُ یَعِدُكُمُ الْفَقْرَ وَ یَاْمُرُكُمْ بِالْفَحْشَآءِ.
শয়তান তোমাদেরকে দরিদ্রতার ভয় দেখায় আর তোমাদেরকে মন্দ কাজের (কৃপণতার) আদেশ করে। -সূরা বাকারা (২) : ২৬৮
অভাব ও দরিদ্রতার এ ভয় ও আশঙ্কাকে উপেক্ষা করে, সম্পদের প্রতি স্বভাবজাত লোভ ও কার্পণ্যকে জয় করে যারা সম্পদ দান করতে পারে, সন্দেহ নেই, এজন্যে নিজেদের মনের বিরুদ্ধে তাদের লড়াই করতে হয় অবিরাম। আর কষ্ট যেখানে বেশি, তা যদি সঠিক পন্থায় হয়, কেষ্টও সেখানে বেশি। সওয়াব ও প্রতিদানে সেটাই হবে সেরা।
চার.
আরেকটি হাদীস। এখানে অবশ্য সরাসরি সেরা দানের কথা নেই। তবে রয়েছে একটি অনন্য মর্যাদা ও ফযীলতের কথা। রোজ হাশরে যখন সূর্য থাকবে খুব কাছাকাছি, তাপে আর তৃষ্ণায় মানুষ থাকবে অস্থির, হাদীসের ভাষ্যানুসারে, কঠিন সে মুহূর্তে সাত শ্রেণির লোককে আল্লাহ তাআলা নিজ ছায়ায় স্থান দেবেন। তাদের অন্যতম-
رَجُلٌ تَصَدّقَ بِصَدَقَةٍ فَأَخْفَاهَا حَتّى لاَ تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ.
এমন ব্যক্তি, যে এতটাই গোপনে দান করে, তার ডান হাতের দান বাম হাতও জানতে পারে না। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৪২৩
গোপন দানে ইখলাস, আন্তরিকতা ও সওয়াবের প্রত্যাশা বেশি থাকাই স্বাভাবিক। আর আল্লাহ তাআলা এ ইখলাসেরই মূল্যায়ন করেন।
অবশ্য গোপন দানের ফযীলতের কথা শুনে প্রকাশ্য দানকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। পবিত্র কুরআনে গোপন-প্রকাশ্য উভয় দানের কথাই বলা হয়েছে-
اِنْ تُبْدُوا الصَّدَقٰتِ فَنِعِمَّا هِیَ وَ اِنْ تُخْفُوْهَا وَ تُؤْتُوْهَا الْفُقَرَآءَ فَهُوَ خَیْرٌ لَّكُمْ .
যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান কর তবে তা কতই না উত্তম। আর যদি তা গোপনে কর এবং গরীবদের দিয়ে থাক তবে তা আরও উত্তম। -সূরা বাকারা (২) : ২৭১
নিয়ত ও ইখলাসে যদি কোনো ত্রুটি না থাকে, তবে প্রকাশ্য দানে উন্মোচিত হতে পারে কল্যাণের আরেক দুয়ার। কারও দান দেখে যদি কেউ উৎসাহিত হয় আর সে ব্যক্তিও পরে দান করে, তবে দ্বিতীয় ব্যক্তির সমপরিমাণ সওয়াব যোগ হবে প্রথম ব্যক্তির আমলনামায়। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস-
مَنْ سَنّ فِى الإِسْلاَمِ سُنّةً حَسَنَةً فَعُمِلَ بِهَا بَعْدَهُ كُتِبَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِ مَنْ عَمِلَ بِهَا وَلاَ يَنْقُصُ مِنْ أُجُورِهِمْ شَىْءٌ.
মুসলমানদের মধ্যে কেউ যখন কোনো ভালো কাজের সূচনা করে, এরপর তা অন্যদের আমলে পরিণত হয়, এ আমলকারীরা সকলে মিলে যে সওয়াব পাবে এর সমপরিমাণ সওয়াব সূচনাকারীর জন্যেও লিখে দেয়া হবে, তবে তাদের সওয়াব বিন্দু পরিমাণও কমবে না। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০১৭
এই তো ইসলাম। একটু সচেতন হলেই এখানে রয়েছে অঁাচল ভরে নেয়ার সুযোগ। দান-সদকার ক্ষেত্রে আমাদেরকে ভারসাম্য মেনে চলার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নফল দানের আগে ফরয দায়িত্ব পালনে উৎসাহিত করা হয়েছে। আবার সীমিত আয়ের অসচ্ছল কেউ যখন কষ্ট করে সামান্যও দান করে, সেটাকে বলা হচ্ছে সেরা দান। বিপদাপদ দূর করার জন্যে দান করতে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই, কিন্তু উৎসাহিত করা হয়েছে সুস্থ কর্মক্ষম স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে বেশি পরিমাণে দান করার প্রতি। সে দান প্রকাশ্যে হতে পারে, হতে পারে গোপনেও। দানের এ শিক্ষা যদি ছড়িয়ে পড়ে, আমাদের জীবন ও সমাজ তবে আলোকিত হবেই।