সূরা মুমিনূন : সফল মুমিনের কয়েকটি গুণ
উপদেশ প্রদানের ক্ষেত্রে কুরআনের রয়েছে বহু শৈলী। কখনো আদেশ-নিষেধের সুরে, কখনো পূর্ববর্তী উম্মতের ঘটনা বর্ণনার মাধ্যমে, কখনো জান্নাতের সুখ-শান্তি ও জাহান্নামের শাস্তির বর্ণনা দিয়ে, কখনো সৃষ্টিজগতের বিভিন্ন নিআমতের কথা উল্লেখ করে। এছাড়াও আরও বিভিন্ন শৈলীতে কুরআনে কারীমে উপদেশ পেশ করা হয়েছে। প্রতিটি শৈলীরই রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও আবেদন।
এই শৈলীগুলোর একটি হল, মুমিনদের বিভিন্ন গুণ ও বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা। উদ্দেশ্য হল, মুমিনগণ যেন এসব গুণ-বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়; ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ জীবনে এগুলোকে গ্রহণ করে।
সূরা মুমিনূনের শুরুতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুমিনের এমনই কিছু বিশেষ গুণ ও বৈশিষ্ট্যের কথা তুলে ধরেছেন। ইরশাদ হয়েছে-
قَدْ اَفْلَحَ الْمُؤْمِنُوْنَ الَّذِیْنَ هُمْ فِیْ صَلَاتِهِمْ خٰشِعُوْن وَ الَّذِیْنَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُوْن وَ الَّذِیْنَ هُمْ لِلزَّكٰوةِ فٰعِلُوْن وَ الَّذِیْنَ هُمْ لِفُرُوْجِهِمْ حٰفِظُوْن اِلَّا عَلٰۤی اَزْوَاجِهِمْ اَوْ مَا مَلَكَتْ اَیْمَانُهُمْ فَاِنَّهُمْ غَیْرُ مَلُوْمِیْن فَمَنِ ابْتَغٰی وَرَآءَ ذٰلِكَ فَاُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْعٰدُوْن وَ الَّذِیْنَ هُمْ لِاَمٰنٰتِهِمْ وَ عَهْدِهِمْ رٰعُوْن وَ الَّذِیْنَ هُمْ عَلٰی صَلَوٰتِهِمْ یُحَافِظُوْن اُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْوٰرِثُوْنَ الَّذِیْنَ یَرِثُوْنَ الْفِرْدَوْسَ هُمْ فِیْهَا خٰلِدُوْنَ.
নিশ্চয়ই সফলতা অর্জন করেছে মুমিনরা; যারা তাদের নামাযে আন্তরিকভাবে বিনীত। যারা অহেতুক বিষয় থেকে বিরত থাকে। যারা যাকাত সম্পাদনকারী। যারা নিজ লজ্জাস্থান সংরক্ষণ করে; নিজেদের স্ত্রী ও মালিকানাধীন দাসীদের ছাড়া অন্য সকলের থেকে, কেননা এতে তারা নিন্দনীয় হবে না। তবে কেউ এছাড়া অন্য কিছু কামনা করলে তারাই হবে সীমালঙ্ঘনকারী। এবং যারা তাদের আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে। এবং যারা নিজেদের নামাযের পরিপূর্ণ রক্ষণাবেক্ষণ করে। এরাই হল সেই ওয়ারিশ, যারা জান্নাতুল ফিরদাউসের মীরাস লাভ করবে। তারা তাতে সর্বদা থাকবে। -সূরা মুমিনূন (২৩) : ১-১১
সুনানে কুবরা নাসায়ীর একটি হাদীসে এসেছে, ইয়াযিদ বিন বাবনুস রাহ. বলেন, একদা আমরা হযরত আয়েশা রা.-এর কাছে জিজ্ঞেস করলাম, হে উম্মুল মুমিনীন! কেমন ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আখলাক?
তিনি বললেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আখলাক হল কুরআন। এরপর তিনি قَدْ اَفْلَحَ الْمُؤْمِنُوْنَ থেকে وَ الَّذِیْنَ هُمْ عَلٰی صَلَوٰتِهِمْ یُحَافِظُوْنَ পর্যন্ত তিলাওয়াত করেন এবং বলেন, এমনই ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আখলাক। -সুনানে কুবরা, নাসায়ী ১১২৮৭
উল্লেখিত আয়াতগুলোতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুমিনের সাতটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন :
এক : الَّذِیْنَ هُمْ فِیْ صَلَاتِهِمْ خٰشِعُوْن
যারা তাদের নামাযে আন্তরিকভাবে বিনীত।
প্রথম বৈশিষ্ট্য হল, মুমিন নামাযে ‘খুশু’ অবলম্বন করে। নামায ঈমানের পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। মুমিনের চক্ষু-শীতলতা। আল্লাহর নৈকট্য লাভের অনেক বড় একটি মাধ্যম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
وَجُعِلَتْ قُرّةُ عَيْنِي فِي الصّلَاةِ.
নামাযে রাখা হয়েছে আমার চোখের শীতলতা। -সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৩৯৪০
অন্য হাদীসে এসেছে-
أَقْرَبُ مَا يَكُونُ الْعَبْدُ مِنْ رَبِّهِ، وَهُوَ سَاجِدٌ.
সিজদারত অবস্থায় বান্দা তার রবের সবচেয়ে বেশি নিকটবতীর্ হয়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪৮২
তবে নামাযের মিষ্টতা এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের অনুভূতি তখনই উপলব্ধি হবে, যখন নামায ‘খুশু’ এর সাথে আদায় করা হবে। আয়াতে শুধু নামায পড়ার কথা বলা হয়নি; বরং ‘খুশু’-এর সাথে নামায আদায়ের কথা বলা হয়েছে। ‘খুশু’-এর অর্থ হল, বিনয়ের সাথে অন্তরকে আল্লাহর অভিমুখী করা। -তাফসীরে কাবীর ২৩ : ২৫৯
নামাযে ইচ্ছাকৃত অন্তরে অন্য কোনো খেয়াল না আনা। অন্য কোনো খেয়াল এসে গেলে সাথে সাথে মন নামাযের অভিমুখী করা। ‘খুশু’ হাছিলের একটা সহজ পদ্ধতি হল নামাযে যা পড়া হয় তার দিকে ধ্যান রাখা। অর্থ জানা থাকলে অর্থের দিকে খেয়াল করা। দিলের মধ্যে এই অনুভূতি রাখা যে, আমি সর্বক্ষমতাময় আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। তিনি আমাকে দেখছেন।
‘খুশু’ এর অপরিহার্য দাবি হল, নিজের বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও স্থির রাখা। (প্রাগুক্ত)
যেটাকে আমরা ‘খুযু’ বলে থাকি। এর সারকথা হল, নামাযের মধ্যে প্রতিটি অঙ্গ সুন্নাহসম্মত পন্থায় রাখা। এজন্য প্রত্যেকের জন্য জরুরি হল, নামাযে কোন্ অবস্থায় কোন্ অঙ্গ কীভাবে রাখতে হয় তার সুন্নাহসম্মত পদ্ধতি জানা এবং সে অনুযায়ী আমল করা।
দুই : وَ الَّذِیْنَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُوْنَ
যারা অহেতুক বিষয় থেকে বিরত থাকে।
মুমিনের বিশেষ একটি গুণ হল সে لغو থেকে বেঁচে থাকে। হাদীছ শরীফে এসেছে-
مِنْ حُسْنِ إِسْلَامِ المَرْءِ تَرْكهُ مَا لَا يَعْنِيهِ.
সুন্দর মুসলিম হওয়ার একটি নিদর্শন হল, অর্থহীন কাজ ত্যাগ করা। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৩১৮
অহেতুক বিষয় (لغو) থেকে বেঁচে থাকার সর্বপ্রথম ক্ষেত্র হল, সকল প্রকার গুনাহের কাজ থেকে বিরত থাকা। তেমনিভাবে এমন কথা, কাজ, লেখা ও চিন্তা থেকে বেঁচে থাকা, যাতে না দ্বীনী কোনো ফায়েদা আছে, না দুনিয়াবী কোনো ফায়েদা আছে।
অহেতুক বিষয় (لغو) থেকে বেঁচে থাকার একটি প্রায়োগিক দিক হল, কোনো বেহুদা ও অহেতুক আচরণ বা কথার সম্মুখীন হলে প্রতিউত্তর না দেওয়া, এড়িয়ে চলা। এ প্রসঙ্গে কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে,
وَ اِذَا مَرُّوْا بِاللَّغْوِ مَرُّوْا كِرَامًا.
তারা (রহমানের বান্দারা) যখন বেহুদা কার্যকলাপের পাশ দিয়ে যায় তখন আত্মসম্মান বাঁচিয়ে যায়। -সূরা ফুরকান (২৫) : ৭২
তিন : الَّذِیْنَ هُمْ لِلزَّكٰوةِ فٰعِلُوْن
যারা যাকাত সম্পাদনকারী।
তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হল, মুমিন যাকাত আদায় করে। যাকাত ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরয বিধান। হাদীসের ভাষায় ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের একটি। তাই ঈমানের অপরিহার্য দাবি, যাকাত ফরয হলে যাকাত আদায় করা। যাকাত আদায় না করার ব্যাপারে কুরআন ও হাদীসে কঠিন হুঁশিয়ারি এসেছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন-
وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنْفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللهِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ أَلِيمٍ يَوْمَ يُحْمَى عَلَيْهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوَى بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوبُهُمْ وَظُهُورُهُمْ هَذَا مَا كَنَزْتُمْ لِأَنْفُسِكُمْ فَذُوقُوا مَا كُنْتُمْ تَكْنِزُونَ.
যারা সোনা-রুপা পুঞ্জীভূত করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে যন্ত্রণাময় শাস্তির ‘সুসংবাদ’ দাও। যেদিন সে ধন-সম্পদ জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে, তারপর তা দ্বারা তাদের কপাল, পাঁজর ও পিঠে দাগ দেয়া হবে (এবং বলা হবে) এই হচ্ছে সেই সম্পদ, যা তোমরা নিজেদের জন্য পুঞ্জীভূত করতে। সুতরাং তোমরা যে সম্পদ পুঞ্জীভূত করতে, তা মজা করে ভোগ কর। -সূরা তাওবা (৯) : ৩৪-৩৫
বুখারী শরীফের এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ آتَاهُ اللهُ مَالًا، فَلَمْ يُؤَدِّ زَكَاتَهُ مُثِّلَ لَهُ مَالُهُ يَوْمَ القِيَامَةِ شُجَاعًا أَقْرَعَ لَهُ زَبِيبَتَانِ يُطَوّقُهُ يَوْمَ القِيَامَةِ، ثُمّ يَأْخُذُ بِلِهْزِمَتَيْهِ - يَعْنِي بِشِدْقَيْهِ - ثُمّ يَقُولُ أَنَا مَالُكَ أَنَا كَنْزُكَ، ثُمّ تَلاَ: لَا يَحْسبَنّ الّذِينَ يَبْخَلُون الآيَةَ
যাকে আল্লাহ সম্পদ দান করেছেন, কিন্তু সে যাকাত আদায় করেনি, কিয়ামতের দিন সেই সম্পদকে বিষাক্ত সাপের আকৃতি দিয়ে তার গলায় পেঁচিয়ে দেয়া হবে। সাপটি তার মুখের দু’পার্শ্ব কামড়ে ধরে বলবে, আমি তোমার সম্পদ, আমি তোমার সঞ্চিত মাল। তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই আয়াত তিলাওয়াত করেন-
وَ لَا یَحْسَبَنَّ الَّذِیْنَ یَبْخَلُوْنَ بِمَاۤ اٰتٰىهُمُ اللهُ مِنْ فَضْلِهٖ هُوَ خَیْرًا لَّهُمْ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَّهُمْ سَیُطَوَّقُوْنَ مَا بَخِلُوْا بِهٖ یَوْمَ الْقِیٰمَةِ وَ لِلهِ مِیْرَاثُ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ وَ اللهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ خَبِیْرٌ.
[আল্লাহ প্রদত্ত সম্পদে যারা কৃপণতা করে, তারা যেন কিছুতেই মনে না করে- এটা তাদের জন্য ভালো কিছু; বরং এটা তাদের পক্ষে অতি মন্দ। যে সম্পদে তারা কৃপণতা করে, কিয়ামতের দিন তা তাদের গলায় বেড়ি বানিয়ে দেওয়া হবে। আকাশ ও পৃথিবীর মিরাছ কেবল আল্লাহরই জন্য। তোমরা যা-কিছুই কর আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক অবগত। -সূরা আলে ইমরান (৩) ১৮০] -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৪০৩
চার : وَ الَّذِیْنَ هُمْ لِفُرُوْجِهِمْ حٰفِظُوْنَۙ
যারা নিজ লজ্জাস্থানের হেফাজত করে।
চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হল, মুমিন তার লজ্জাস্থানের হেফাযত করে। নিজের চাহিদা পূরণের জন্য সে কোনো অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে না। নিজের স্ত্রী ও শরীয়তসম্মত দাসী ছাড়া অন্য কারো সাথে তার চাহিদা পূরণ করে না। এ প্রসঙ্গে আরও ইরশাদ হয়েছে-
قُلْ لِّلْمُؤْمِنِیْنَ یَغُضُّوْا مِنْ اَبْصَارِهِمْ وَ یَحْفَظُوْا فُرُوْجَهُمْ ذٰلِكَ اَزْكٰی لَهُمْ اِنَّ اللهَ خَبِیْرٌۢ بِمَا یَصْنَعُوْن وَ قُلْ لِّلْمُؤْمِنٰتِ یَغْضُضْنَ مِنْ اَبْصَارِهِنَّ وَ یَحْفَظْنَ فُرُوْجَهُنَّ .
মুমিন পুরুষদের বল, তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। এটাই তাদের জন্য শুদ্ধতর। তারা যা কিছু করে আল্লাহ সে সম্পর্কে পরিপূর্ণ অবগত। এবং মুমিন নারীদের বল, তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থান হেফজত করে। -সূরা নূর (২৪) : ৩০-৩১
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ يَضْمَنْ لِي مَا بَيْنَ لَحْيَيْهِ وَمَا بَيْنَ رِجْلَيْهِ أَضْمَنْ لَهُ الجَنَّةَ.
যে আমাকে তার দুই চোয়ালের মাঝের অঙ্গ অর্থাৎ, যবান এবং দুই পায়ের মাঝের অঙ্গের (সঠিক ব্যবহারের) যামানত দেবে, আমি তার জন্য জান্নাতের যামিন হব। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪৭৪
পাঁচ ও ছয় :وَ الَّذِیْنَ هُمْ لِاَمٰنٰتِهِمْ وَ عَهْدِهِمْ رٰعُوْنَ.
এবং যারা তাদের আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে।
এই আয়াতে মুমিনের দুটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে :
এক. মুমিন আমানতের হেফাযত করে। আমানতের হেফাযত ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। ইসলামে ‘আমানতের হেফাযত’ কথাটার মধ্যে যে ব্যাপকতা রয়েছে এবং এক্ষেত্রে মুসলমানদের যে ইতিহাস সংরক্ষিত আছে তা ইসলামের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। হিজরতের প্রসিদ্ধ ঘটনা অনেকেরই জানা আছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই কঠিন মুূহূর্তেও নিজের কাছে গচ্ছিত আমানত আদায়ের জন্য হযরত আলী রা.-কে মক্কায় রেখে যান। (দ্র. সুনানে কুবরা, বায়হাকী ৬/২৮৯)
কুরআন ও হাদীসের বিভিন্ন জায়গায় আমানত হেফাযতের ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন-
اِنَّ اللّٰهَ یَاْمُرُكُمْ اَنْ تُؤَدُّوا الْاَمٰنٰتِ اِلٰۤی اَهْلِهَا
নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ করছেন যে, তোমরা আমানতসমূহ তার হকদারকে আদায় করে দিবে। -সূরা নিসা (৪) : ৫৮
আমানতের খেয়ানতকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুনাফিকের আলামত বলেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
آيَةُ الْمُنَافِقِ ثَلَاثٌ: إِذَا حَدَّثَ كَذَبَ، وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ، وَإِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ.
মুনাফিকের আলামত তিনটি। যখন কথা বলে মিথ্যা বলে, ওয়াদা করলে ওয়াদা ভঙ্গ করে, তার কাছে কোনো কিছু আমানত রাখা হলে খেয়ানত করে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫৯
‘আমানত’ বলতে আমরা সাধারণত বুঝি, কারো কাছে কোনো কিছু সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে গচ্ছিত রাখা। এটাও আমানত এবং এর খেয়ানত অনেক বড় গুনাহ। তবে কুরআন-হাদীসে উল্লেখিত ‘আমানত’ শব্দ আরো অনেক বিষয়কে ধারণ করে। যেমন, আমাদের মেধা, যোগ্যতা, আমাদের সময়, আমাদের জীবন, মোটকথা আমরা যেসকল নিআমত ভোগ করি এসবকিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের কাছে আমানত। কিয়ামতের দিন এগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। হাদীসে এসেছে-
لَا تَزُولُ قَدَمَا عَبْدٍ يَوْمَ القِيَامَةِ حَتَّى يُسْأَلَ عَنْ عُمُرِهِ فِيمَا أَفْنَاهُ، وَعَنْ عِلْمِهِ فِيمَ فَعَلَ، وَعَنْ مَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيمَ أَنْفَقَهُ، وَعَنْ جِسْمِهِ فِيمَ أَبْلَاهُ.
কিয়ামতের দিন কোনো বান্দার পা নড়বে না, যতক্ষণ না তাকে জিজ্ঞেস করা হবে তার জীবন সম্পর্কে- কী কাজে তা ব্যয় করেছে। তার ইলম সম্পের্ক- তদনুযায়ী কী আমল করেছে। তার সম্পদ সম্পর্কে- কোথা থেকে তা অর্জন করেছে এবং কোথায় খরচ করেছে। এবং তার শরীর সম্পর্কে- কোন্ কাজে সে তা ক্ষয় করেছে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৪১৭
তেমনিভাবে আমাদের পারস্পরিক প্রার্থিত রায় ও পরামর্শ, গোপন কথাবার্তা, অর্পিত দায়দায়িত্ব এসব কিছুও আমানতের অন্তভুর্ক্ত।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
المُسْتَشَارُ مُؤْتَمَنٌ.
যার কাছে পরামর্শ চাওয়া হয় সে আমানতদার। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৮২২
অন্যত্র ইরশাদ করেন-
إِذَا حَدّثَ الرّجُلُ الحَدِيثَ ثُمَّ التَفَتَ فَهِيَ أَمَانَةٌ.
যদি কেও কোনো কথা বলার সময় (গোপনীয়তা রক্ষার উদ্দেশ্যে) এদিক সেদিক তাকায় (অথবা কথাটি বলে প্রস্থান করে।) তাহলে তার কথা আমানত বলে গণ্য হবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯৫৯
আরেক হাদীসে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
كُلُّكُمْ رَاعٍ وَمَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، فَالإِمَامُ رَاعٍ وَمَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالرَّجُلُ فِي أَهْلِهِ رَاعٍ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالمَرْأَةُ فِي بَيْتِ زَوْجِهَا رَاعِيَةٌ وَهِيَ مَسْئُولَةٌ عَنْ رَعِيَّتِهَا، وَالخَادِمُ فِي مَالِ سَيِّدِهِ رَاعٍ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ.
তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেককেই তার অধীনদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। জনগণের শাসক তাদের দায়িত্বশীল, কাজেই সে তাদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। পরিবারের কর্তা তার পরিবার পরিজনদের দায়িত্বশীল সে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। নারী তার পরিবার বিষয়ে দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। খাদেম তার মনিবের সম্পদের বিষয়ে দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৫৫৮
দুই. মুমিনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল, সে কৃত আহ্দ বা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে। এটিও ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন-
وَ اَوْفُوْا بِالْعَهْدِ اِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْـُٔوْلًا.
আর অঙ্গীকার পূরণ করো। নিশ্চয়ই অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। -সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ৩৪
অন্যত্র ইরশাদ করেছেন-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اَوْفُوْا بِالْعُقُوْدِ .
হে মুমিনগণ তোমরা অঙ্গীকার পূরণ করো। -সূরা মায়িদা (৫) : ১
কুরআন ও হাদীসে ব্যবহৃত ‘আহ্দ’ শব্দের ব্যাপক অর্থে অনেক বিষয় অন্তভুর্ক্ত। আমাদের পারস্পরিক চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি এই ‘আহ্দ’-এর অন্তভুর্ক্ত। এটা দুই ব্যক্তির মধ্যে হতে পারে, কোনো প্রতিষ্ঠানের সাথে হতে পারে অথবা কোনো রাষ্ট্রের সাথেও হতে পারে।
একে অপরকে যে ওয়াদা দেয়া হয় সেটাও এই ‘আহ্দ’-এর অন্তভুর্ক্ত। মুমিনের পুরো জীবনটাই আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এটা ‘আহ্দ’-এর সবচেয়ে বড় এবং সর্বপ্রথম ক্ষেত্র। কালেমার মাধ্যমে সে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, আল্লাহ তার মাবুদ। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সে তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলবে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেখানো পদ্ধতিতে সে তার জীবন পরিচালিত করবে। এটা হল একজন মুমিনের জীবনের সবচেয়ে বড় ‘আহ্দ’ বা প্রতিশ্রুতি, যা পূরণ করা একজন মুমিনের জন্য প্রথম ফরয। অন্যান্য সকল চুক্তি, প্রতিশ্রুতি ও ওয়াদা এই ‘আহদ’-এর অধীন।
সাত : وَ الَّذِیْنَ هُمْ عَلٰی صَلَوٰتِهِمْ یُحَافِظُوْنَ
যারা নিজেদের নামাযের পরিপূর্ণ রক্ষণাবেক্ষণ করে।
সপ্তম বৈশিষ্ট্য হল, মুমিন নামাযের পরিপূর্ণ রক্ষণাবেক্ষণ করে। ‘নামাযের রক্ষণাবেক্ষণ করে’ কথাটা ব্যাপক। এর মধ্যে অনেক বিষয় অন্তভুর্ক্ত। যেমন, পাবন্দির সাথে নামায আদায় করা, কখনো পড়বে কখনো পড়বে না-এমন নয়। সময়মতো নামায আদায় করা। জামাতের সাথে আদায় করা। নামাযের অন্য সকল শর্ত, আদাব ও নিয়ামাবলি রক্ষা করে সুন্দর ও সুচারুরূপে আদায় করা। (দ্র. তাফসীরে কাবীর ২৩/২৬৩)
এর জন্য জরুরি হল নামাযের এসকল শর্ত ও আদাব সম্পর্কে ইলম হাছিল করা।
এই সাতটি বৈশিষ্ট্য যাদের মধ্যে থাকবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁদের ব্যাপারে সফলতার ঘোষণা দিচ্ছেন এবং সুসংবাদ দিচ্ছেন যে, তাঁরা জান্নাতুল ফিরদাউস লাভ করবে। সেখানে তারা চিরকাল অবস্থান করবে।
লক্ষণীয় বিষয় হল, এই সাতটি বৈশিষ্ট্যের প্রথম ও শেষ উভয়টিই নামাযের সাথে সম্পৃক্ত। এর দ্বারা বুঝা যায় মুমিনের যিন্দেগীর সফলতার জন্য নামাযের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি।
আল্লাহ আমাদের সকলকে এই সব বৈশিষ্ট্য অর্জনের তাওফীক দান করুন এবং আপন ফযল ও করমে জান্নাতুল ফিরদাউসের উত্তরসূরি বানিয়ে দিন- আমীন।