কুরআন আমাকে পথ দেখিয়েছে <
একটি আয়াত যাঁর জীবন বদলে দিয়েছিল
হামযা মায়েট। পূর্ব নাম ড্যারেন মায়েট। ছিলেন খ্রিস্টধর্মের অনুসারী। অনুসারী বলতে জন্মসূত্রেই অনুসারী। এর বেশি কিছু না। ছোট বেলা বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। বাবা ও সৎমায়ের সঙ্গে লন্ডনের কাছে এক শহরে বেড়ে ওঠেন। ওই সময়ে হরেক রকমের অন্যায়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।
তাঁর আপন মা থাকতেন ম্যানচেস্টারে। একটি মুসলিম মালিকানাধীন কাপড়ের দোকানে চাকরি করতেন। একদিন মা স্বপ্নে দেখেন, ড্যারেন একটি সুপার শপে গিয়ে খুব সমস্যায় পড়েছে। মায়ের মন বলে কথা। ঘুম থেকে উঠেই ছেলের কাছে চলে আসেন। ঘটনাক্রমে স্বপ্নেদেখা সেই সুপারশপের সামনেই ড্যারেনকে পেয়ে যান। জিজ্ঞেস করেন, তোমার কোনো সমস্যা নেই তো?
ড্যারেন বললেন, না তো কোনো সমস্যা নেই। ভালোই আছি।
মা একটি কাগজে ফোন নম্বর লিখে দিয়ে বললেন, কোনো সমস্যা হলে ফোন করবে।
মা তো ফোন নম্বর লিখে দিয়ে বিদায় নিলেন। একদিন সত্যি সত্যিই ড্যারেন বিপদে পড়লেন। একটি সুপার শপ থেকে বড় বড় চকলেটের বার চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েন। ঘটনাক্রমে সেখানে তাঁর বাবা ও সৎ মা কেনাকাটা করতে এসেছিলেন। ছেলেকে চুরি করতে দেখে বাবা নিয়ন্ত্রণ হারান। ছেলেকে মারধর শুরু করেন। সৎমা তার গলা টিপে ধরেন।
সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে ড্যারেন মায়ের কাছে ফোন করেন। সমস্যার কথা শুনে মা তাঁকে ম্যানচেস্টারে চলে আসতে বললেন। সেখানে গিয়ে মা যে শপে চাকরি করতেন সেখানে খণ্ডকালীন কর্মচারী হিসেবে কাজ শুরু করে। দোকানের মালিক ছিলেন মুসলমান। দোকানটি ছিল দুই ভাই-বোনের মালিকানাধীন। মালিকের বোন ড্যারেনকে দেখলেই ইসলামের দাওয়াত দিতেন। ড্যারেন এসবে পাত্তা দিতেন না। একদিন বিরক্ত হয়ে বললেন, আচ্ছা আমি মুসলমান না হলে কী হবে? জাহান্নামে যাব? জাহান্নামে গেলেই বা কী? একবারই তো শুধু ব্যথা পাব। একবার পুড়ে গেলে তো আর অনুভূতি থাকবে না। এরপর ব্যথা পাব না।
তিনি মরিয়া হয়ে বললেন, তুমি মনে করছ একবারের বেশি পুড়বে না। আল্লাহ বলেছেন, একবার পোড়ার পর আবার নতুন করে চামড়া গজাবে!
এই সময়ে আমার দোকানের মালিক ফয়সালও আমাকে ইসলাম গ্রহণের কথা বলতেন। আমি তাঁর হাত থেকে বাঁচার জন্য বলতাম, তুমি কি পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়?
তাঁর তখন না বলা ছাড়া উপায় থাকত না। কারণ, তিনি তখনো প্র্যাক্টিসিং মুসলিম ছিলেন না। কিন্তু ৯/১১ -এর পর সব বদলাতে থাকে। মিডিয়া মুসলমানদেরকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করতে থাকে। তখন ইসলামকে জানার জন্য ড্যারেন পড়াশোনা শুরু করেন। ততদিনে ফয়সাল লন্ডনে চলে আসেন। ইসলাম পরিপালনে মনোযোগী হয়ে ওঠেন।
ড্যারেন একদিন একদল মানুষকে দেখলেন ইসলাম নিয়ে সমালোচনা করতে। তিনি তাদেরকে রুখে দাঁড়ালেন। ইসলামের হয়ে জবাব দিলেন। তারা বলল, তুমি কি মুসলিম?
ড্যারেন বললেন, না আমি মুসলিম নই।
তারা বলল, না, তুমি মুসলিম!
তখন তিনি নিজেকে জিজ্ঞেস করলেন, এসব বিশ্বাস করেও কেন আমি মুসলিম নই? আমার তো মুসলিম হয়ে যাওয়া উচিত।
ড্যারেন বলেন, ‘এভাবেই আমি অমুসলিমদের থেকে ইসলামের দাওয়াত পাই। এরপরও নানা বাধার কারণে ইসলাম গ্রহণ করা হয়ে উঠছিল না। এর মধ্যে প্রচণ্ড এক বৃষ্টির দিনে গাড়ি চালাচ্ছিলাম। দ্রুত গতির ফার্স্ট লেনে যে বিপদ সংকেত দেওয়া ছিল তা লক্ষ করিনি। গাড়ির গতি ছিল বিপজ্জনক। হঠাৎ সতর্কসংকেত দেখে চমকে উঠি। দ্রুত গাড়ি থামানোর চেষ্টা করি। তখন ভাবতে থাকি, আমি তো আজ মারাও যেতে পারতাম।’
ড্যারেনের মনে হল, আজ মারা গেলে সবকিছুই তো হারাতে হতো, তাহলে ইসলামের জন্য এখনই সব হারাতে বাধা কোথায়? মনে হল, এখন আর দেরি করার সুযোগ নেই। এখন মুসলিম হয়ে যাওয়া উচিত।
এখানে এসে তাঁর মনে পড়ল সেই মহিলার বলা কুরআনের আয়াত-
اِنَّ الَّذِیْنَ کَفَرُوْا بِاٰیٰتِنَا سَوْفَ نُصْلِیْهِمْ نَارًا، كُلَّمَا نَضِجَتْ جُلُوْدُهُمْ بَدَّلْنٰهُمْ جُلُوْدًا غَیْرَهَا لِیَذُوْقُوا الْعَذَابَ، اِنَّ اللهَ کَانَ عَزِیْزًا حَکِیْمًا
নিশ্চয় যারা আমার নিদর্শনসমূহ অস্বীকার করবে, আমি তাদেরকে আগুনে নিক্ষেপ করব। তাদের চামড়া জ্বলে-পুড়ে গেলে আবার আমি তা পাল্টে দেব অন্য চামড়া দিয়ে, যাতে তারা আযাব আস্বাদন করতে থাকে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ মহাপরাক্রমশালী, হিকমতের অধিকারী। -সূরা নিসা (৪) : ৫৬
আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে, ব্যথার উৎস হল চামড়া, চামড়ার নীচের অংশ নয়। যেমনটা অতীতকালে বিজ্ঞানীরা মনে করতেন।
ড্যারেন বলেন, ‘যখন আমার বিশ্বাস হল, কুরআন আল্লাহর কালাম তখন গিয়ে কুরআনে এ আয়াত খুঁজে পাই। তখন বুঝতে পারলাম, বন্ধুর বোন আমাকে নিজ থেকে উত্তর দেননি। উত্তর দিয়েছেন কুরআনের আয়াতের মাধ্যমে। এটাই আমার ইসলাম গ্রহণ করার মূল এবং প্রকৃত কারণ, আমি আগুনে পুড়তে চাই না। আমার মধ্যে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল, পরকালে আযাব, আগুন অবশ্যই আছে।
বন্ধুকে বললাম, আমি জানি ইসলামই সত্যধর্ম। কিন্তু ইসলাম গ্রহণ করলে আমি আমার চাকরি, বান্ধবি, বাড়ি সব হারাব। আমি কী করব?
বন্ধু আমাকে আশ্বস্ত করল। বলল, শুধু সে নয়, বরং মুসলিম কমিউনিটির সবাই আমাকে সাহায্য করবে।
তখন আমার সামনে থেকে সব বাধা দূর হয়ে গেল। তাঁর বাসায় কালেমায়ে শাহাদাত পড়ে মুসলিম হয়ে গেলাম।’
হামযা মায়েট এখন ইসলামের একনিষ্ঠ দাঈ। মানুষকে ইসলামের প্রতি আহ্বানই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। তাঁর দাওয়াতের একটি অংশ হলো, শপিং করতে আসা মানুষকে ইসলামের প্রতি আহ্বান করা। ২০১৪ সাল পর্যন্ত তাঁর হাতে শপিং করতে আসা ১২০ জন মানুষ কালিমায়ে শাহাদাৎ পড়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন।
آيٌ من القرآن لها بروحي صدى
و فاضتْ العينان تُجيب ذاك النداء
ثبتني يا الله على طريق الهدى
فكل ما أخشاه سوء الختام غدا
কুরআনের একেকটি আয়াত/আমার প্রাণের আওয়াজ।
চোখ অশ্রুসজল হয়/সে ডাকে সাড়া দেয়।
হে আল্লাহ, আমাকে রেখো হেদায়াতের পথে/আমার সব ভয় মন্দ পরিণাম নিয়ে।
[বিশিষ্ট দাঈ ফাহাদ আলকান্দারীর প্রোগ্রাম ‘বিলকুরআন ইহতাদাইতু’ অবলম্বনে।]