শাওয়াল ১৪৩১   ||   অক্টোবর ২০১০

মিন্‌ আদাবিল্‌ ইসলাম

শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ

ঘরে প্রবেশের আদব

১. ঘরে প্রবেশের পর এবং ঘর থেকে বের হওয়ার পর আস্তে করে দরজা লাগাবে, সজোরে বন্ধ করবে না বা জোরে ধাক্কা দিয়ে ছেড়ে দিবে না। কারণ তা ইসলামের শিক্ষার পরিপন্থী। ইসলাম সকল ক্ষেত্রে মার্জিত আচরণের শিক্ষা দান করেছে।

উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন যে, যে কাজ কোমলতা আছে তা সুন্দর। আর যাতে কোমলতা নেই তা অসুন্দর ও ত্রুটিযুক্ত।-সহীহ মুসলিম

২. পরিবারের নারী-পুরুষ সবাইকে আসসালামু আলাইকুম বলবে। অন্য কোনো অভিবাদন, যেমন-সুপ্রভাত, শুভসন্ধ্যা ইত্যাদি ব্যবহার করবে না। কারণ সালাম হল ইসলামের চিহ্ন ও মুসলমানদের পরিচয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বাণী ও কর্মের মাধ্যমে তা শিক্ষা দিয়েছেন। সালামের পরিবর্তে অন্য কোনো বাক্য ব্যবহার করার অর্থ হল ইসলামের একটি  নিদর্শনকে বিলুপ্ত করা।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রিয় খাদিম হযরত আনাস রা. বলেন, ‘‘আমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেছেন, হে বৎস! যখন পরিবারের নিকট যাবে তখন তাদের সালাম দিবে। এটা হবে তোমার ও তোমার পরিবারের জন্য বরকতের কারণ’’-জামে তিরমিযী

বিশিষ্ট মনীষী তাবেয়ী হযরত কাতাদাহ রাহ. বলেন, ঘরে প্রবেশ করে পরিবার-পরিজনকে সালাম দিবে। কারণ তারাই তোমার সালাম বা দুআ পাওয়ার বেশি হকদার।

হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, ‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমাদের কেউ যখন কোনো মজলিসে উপস্থিত হয় তখন সে যেন সালাম দেয়। তদ্রূপ যখন মজলিস থেকে বিদায় নেয় তখনও যেন সালাম দেয়। কারণ প্রথম (সালাম) দ্বিতীয় (সালাম) থেকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ নয়।-তিরমিযী

৩. ঘরে প্রবেশের পূর্বে ঘরের লোকদেরকে তোমার আগমন সম্পর্কে সচেতন কর। কারণ এমনভাবে ঘরে প্রবেশ করা অনুচিত যে, ঘরের লোকজন চমকে যায় বা মনে হয় তুমি তাদের দোষত্রুটি ধরতে চাও।

হযরত আবু উবাদাহ আমের বিন আবদুল্লাহ বিন মাসউদ রা. বলেন, আমার পিতা আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ যখন ঘরে প্রবেশ করতেন তখন ঘরের লোকদেরকে তার আগমন সম্পর্কে জানান দিতেন, যেমন কথা বলতেন বা উচ্চস্বরে আওয়াজ করতেন, যাতে তারা সতর্ক হয়।

ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রাহ. বলেন, কেউ যখন গৃহে প্রবেশ করে তখন গলাখাঁকারি দেওয়া বা জুতা দ্বারা আওয়াজ করা উচিত।

ইমাম আহমদের পুত্র আবদুল্লাহ রাহ. বলেন, আব্বা যখন মসজিদ থেকে ফিরতেন তখন ঘরে ঢোকার পূর্বে জুতা দিয়ে শব্দ করতেন, কখনো গলাখাঁকারি দিতেন, যাতে ঘরের লোকেরা তার আগমনের খবর জানতে পারে।

সহীহ বুখারী ও মুসলিমে জাবির রা.-এর সূত্রে বর্ণিত একটি হাদীস থেকেও এ বিষয়টি বোঝা যায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাউকে পরিবারের নিকট রাতের বেলায় সফর ইত্যাদি থেকে এমনভাবে ফিরতে নিষেধ করেছেন যেন সে পরিবারের খেয়ানত বা দোষত্রুটি অন্বেষণ করছে।

৪. পরিবারের কেউ যখন তার কামরায় অবস্থান করে, আর তুমি সেখানে যেতে চাও তাহলে আগে তার অনুমতি নাও। যেন এমন কোনো অবস্থায় তাকে দেখতে না হয়, যে অবস্থায় তাকে দেখা তোমার জন্য বা তার জন্য অপ্রীতিকর। চাই সে তোমার স্ত্রী হোক কিংবা মাহরাম, যেমন-মা-বাবা, ছেলেমেয়ে।

ইমাম মালেক রাহ. মুয়াত্তা কিতাবে (২/৯৬৩) মুরসাল সনদে আতা ইবনে ইয়াসার রাহ. থেকে বর্ণনা করেছেন যে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করল, আমি কি আমার মায়ের কাছে যাওয়ার পূর্বে অনুমতি নিব? তিনি বললেন, হ্যাঁ। লোকটি বলল, আমি তো তাঁর সাথেই থাকি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তবুও অনুমতি নিবে। প্রশ্নকারী পুনরায় বলল, আমি তো তাঁর সেবা-যত্নে নিয়োজিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, অনুমতি নিবে। তুমি কি তাকে বিবস্ত্র অবস্থায় দেখতে পছন্দ করবে? প্রশ্নকারী বলল, না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাহলে তার অনুমতি নাও।

এক ব্যক্তি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর কাছে এসে বলল, মায়ের কাছে যাওয়ার পূর্বে কি অনুমতি নিতে হবে? তিনি বললেন, (হ্যাঁ, নিতে হবে। কারণ) সব অবস্থায় তাকে দেখতে নিশ্চয়ই তোমার ভালো লাগবে না।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর পত্নী যায়নাব রা. বলেন, আবদুল্লাহ যখন কোনো কাজ থেকে ফিরতেন তখন দরজার কাছে পৌঁছে গলাখাঁকারি দিতেন। যেন আমাদের এমন কোনো বিষয় তাঁর দৃষ্টিগোচর না হয়, যা তার জন্য অপ্রীতিকর।

ইবনে মাজাহ কিতাবের তিব্ব অধ্যায়ের শেষে রেওয়ায়েতটি এভাবে আছে, যখন আবদুল্লাহ (বাড়িতে) ঢুকতেন তখন গলা খাঁকারি দিতেন এবং আওয়াজ করতেন।

এক ব্যক্তি হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান রা.কে জিজ্ঞাসা করল, আমি কি মায়ের কাছে যাওয়ার পূর্বেও অনুমতি নেব? তিনি বললেন, হ্যাঁ। কারণ, অনুমতি না নিলে অপ্রীতিকর কিছু দৃষ্টিগোচর হতে পারে।

(বিশিষ্ট) তাবেয়ী ও সাহাবী-পুত্র মুসা ইবনে তলহা ইবনে উবায়দুল্লাহ রাহ. বলেন, আমি আমার আব্বার সাথে আম্মার কাছে যাচ্ছিলাম। তিনি যখন কামরার ঢুকলেন তখন আমিও তার পিছু পিছু ঢুকে পড়লাম। তখন তিনি আমার বুকে এত জোরে ধাক্কা দিলেন যে, আমি মাটিতে পড়ে গেলাম। তিনি তখন বললেন, অনুমতি না নিয়েই ঢুকে পড়ছ!

আবদুল্লাহ ইবনে উমরের আযাদকৃত গোলাম নাফে রাহ. বলেন, ইবনে উমরের কোনো পুত্র যখন বালেগ হত তখন তাকে কামরা থেকে আলাদা করে দিতেন। এরপর সে অনুমতি ছাড়া তাঁর ঘরে যেতে পারত না।

হযরত ইবনে জুরাইজ রাহ. আতা ইবনে আবি রাবাহ রাহ. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি ইবনে আব্বাস রা. কে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার দু বোনের নিকট যাওয়ার পূর্বেও কি অনুমতি নিতে হবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আমি বললাম, তারা তো আমার বাড়িতে এবং আমার তত্ত্বাবধানেই রয়েছে। তাদের ভরণ-পোষণও আমিই করে থাকি! তিনি বললেন, তুমি কি তাদেরকে বিবস্ত্র অবস্থায় দেখতে পছন্দ করবে? অতঃপর তিনি এই আয়াত পাঠ করলেন : (তরজমা) তোমাদের শিশুরা যখন বালিগ হয় তখন তারা যেন (ঘরে প্রবেশের পূর্বে) অনুমতি প্রার্থনা করে যেমন তাদের পূর্ববর্তীরা অনুমতি প্রার্থনা করেছে।-সূরা নূর : ৫৯

‘‘হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন, অতএব অনুমতি প্রার্থনা করা সবার জন্যেই অপরিহার্য’’

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, পিতা-মাতা এবং ভাই-বোনের কাছে যাওয়ার পূর্বেও অনুমতি প্রার্থনা করবে।

হযরত জাবির রা. বলেন, নিজ পুত্রের কাছে যাওয়ার সময়ও অনুমতি নিতে হবে। মায়ের কাছে যাওয়ার সময়ও নিতে হবে, এমনকি তিনি বৃদ্ধা হলেও। তদ্রূপ ভাইবোন ও পিতার কাছে যাওয়ার সময়ও অনুমতি প্রার্থনা করবে।

উপরোক্ত অধিকাংশ আছার ইমাম বুখারী রাহ.-এর ‘‘আলআদাবুল মুফরাদ’’ কিতাবে রয়েছে। কিছু আছার ইমাম ইবনে কাছির রাহ. তাঁর তাফসীর-গ্রন্থে উপরোল্লিখিত আয়াতের আলোচনায় উল্লেখ করেছেন।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

অনুবাদ : নাজিবুল্লাহ সিদ্দীকুল্লাহ

 

advertisement