কুরআন কারীম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ থেকে এবং তাঁর সাহাবীদের জীবনের আলোকে বোঝা জরুরি
কুরআন কারীম যেমনিভাবে স্বয়ং কুরআন থেকে বুঝতে হবে, তেমনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র সুন্নাহ (হাদীস ও সীরাত) থেকেও বোঝা জরুরি। কুরআনের নির্দেশনা ও বিধিবিধান স্বয়ং কুরআন অবতীর্ণকারী তাঁকে শিখিয়েছেন [দ্র. সূরা কিয়ামাহ (৭৫) : ১৯]। আর তিনি তাঁর শাগরিদদেরকে সবিস্তারে মৌখিকভাবে এবং আমলের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন, [দ্র. সূরা নাহল (১৬) : ৪৪]। অতএব তাদাব্বুরে কুরআন পূর্ণ ও যথার্থ হওয়ার জন্য এটা শর্ত যে, কুরআন বোঝার ক্ষেত্রে হাদীস শরীফ ও পবিত্র সীরাত সামনে রাখা হবে এবং সাহাবায়ে কেরামের জীবনীর সাহায্য নেওয়া হবে।
এ নীতিটি তো সর্ববাদীসম্মত। তবে এখন আমরা শুধু ইমাম আবু মানসুর মাতুরীদী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির বক্তব্য উল্লেখ করব। তিনি সূরা রূমের (৩০) ১৭-১৮ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যায় এই নীতির দিকে ইশারা করেছেন। সূরা রূমে ইরশাদ হয়েছে-
فَسُبْحٰنَ اللهِ حِیْنَ تُمْسُوْنَ وَ حِیْنَ تُصْبِحُوْنَ وَ لَهُ الْحَمْدُ فِی السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ وَ عَشِیًّا وَّ حِیْنَ تُظْهِرُوْنَ.
আল্লাহর তাসবীহতে লিপ্ত থাকো, যখন তোমরা সন্ধ্যায় উপনীত হও এবং যখন তোমরা ভোরের সম্মুখীন হও। তাঁরই প্রশংসা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে এবং বিকাল বেলায় (তার তাসবীহতে লিপ্ত হও) এবং জোহরের সময়ও। -সূরা রূম (৩০) : ১৭-১৮
ইমাম আবু মানসুর মাতুরীদী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন-
إنهم فهموا من هذه الآية فرضية الصلوات الخمس. ولو كانت أفهامهم مثل أفهام أهل زماننا لما فهموا منها سوى التسبيح المذكور.
অর্থাৎ উম্মতের প্রথম সারির ব্যক্তিগণ এই আয়াত থেকে প্রত্যেকদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয হওয়ার বিধান বুঝেছেন। যদি তাঁরা আজকালকার মানুষের মতো চিন্তা করতেন, তাহলে তাঁরা এখান থেকে শুধু তাসবীহ পাঠ করাই বুঝতেন। [বাদায়েউস সানায়ে, আল্লামা আবু বকর কাসানী (ওফাত ৫৮৭ হি.) ১/২৫৩]১
ইমাম মাতুরীদী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি একথা বলতে চাচ্ছেন যে, উম্মতের প্রধান ব্যক্তিবর্গের (সাহাবা, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন) ঈমানী যিন্দেগীর আলোকে কুরআন বোঝা উচিত। কেননা তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা থেকে কুরআন বুঝেছেন এবং তাদের ইসলামী যিন্দেগী কুরআন কারীম ও নববী শিক্ষারই দর্পণ ছিল।
এই নীতির আলোচনার পর ইমাম মাতুরীদী রাহ. বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছেন, উম্মতের ইমামগণ এই দুই আয়াত থেকে নামাযের বিধান এবং প্রত্যহ পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয হওয়া কীভাবে বুঝেছেন। তাঁর কিতাব তাবীলাতু আহলিস সুন্নাহ (৮/২৫৮) দ্রষ্টব্য। আরও দেখুন, বাদায়েউস সানায়ে ১/২৫২-২৬৫।
একথা স্মরণ রাখা আবশ্যক, পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয হওয়া ইসলামের মৌলিক এবং অকাট্য বিধান। ইসলামের অন্যান্য বুনিয়াদের মতো এই বিধানও তাওয়াতুরের সাথে যুগ পরম্পরায় সুস্পষ্ট ও অকাট্যভাবে চলে এসেছে। যেভাবে আমরা ইসলাম ধর্মের নিম্নোক্ত বিষয়াবলি জেনেছি।
১. হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। তিনি সর্বশেষ নবী ও রাসূল। তাঁর পরে কেউ নবুওতপ্রাপ্তও হবে না এবং রিসালাতও নয়। তাঁর পরে কারও কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো ওহীও আসবে না এবং তাঁর পরে কোনো নতুন নবীর আগমনও অসম্ভব।
২. কুরআন আল্লাহ তাআলার নাযিলকৃত সর্বশেষ হেদায়েতের কিতাব।
৩. কুরআনের এই আমানত আল্লাহ তাআলার হুকুম মতো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে সাহাবায়ে কেরামের কাছে রেখে গেছেন, তা আজোবধি সেভাবেই সুরক্ষিত আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত সুরক্ষিত থাকবে। এতে কোনো এক শব্দ বা অক্ষর বাড়ানোও সম্ভব নয় এবং কমানোরও কোনো সম্ভাবনা নেই।
৪. খাতামুন নাবিয়্যীন হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিয়ামত পর্যন্ত আগত সকলের নবী। তাঁকে আল্লাহ যে শরীয়ত দান করেছেন তা সর্বশেষ আসমানী শরীয়ত এবং সকলের জন্য তাঁর অনুসরণ অপরিহার্য।
৫. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস ও সুন্নাহ কুরআনের মতো শরীয়তের দলীল এবং তাঁর পবিত্র সীরাত উম্মতের জন্য উসওয়ায়ে হাসানাহ।
৬. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর হুকুমে উম্মতকে ফরযসমূহ শিক্ষা দিয়েছেন এবং হারাম সম্পর্কে নির্দেশনা দিয়ে তা থেকে বেঁচে থাকতে আদেশ করেছেন।
এগুলো এবং দ্বীন ও শরীয়তের অন্যান্য মৌলিক বিধানাবলি যুগ পরম্পরা থেকে সুস্পষ্টভাবে চলে আসছে। এগুলোর দলীল কেবল একটি আয়াত বা একটি হাদীস নয়; বরং এগুলোর দলীল অসংখ্য। পূর্ণাঙ্গ ইসলাম এবং পুরো নববী জীবনই এগুলোর দলীল।
কুরআন ও হাদীস এবং আছারে সাহাবা থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের কিছু দলীল এক নযরে দেখার জন্য মাসিক আলকাউসারে প্রকাশিত ‘হাদীস ও আসারে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ও রাকাত সংখ্যা’ শীর্ষক প্রবন্ধটি পড়তে পারেন। এই প্রবন্ধের প্রথম কিস্তি মাসিক আলকাউসার জুমাদাল আখিরাহ ১৪৪২ হিজরী মোতাবেক ডিসেম্বর ২০২০ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। হ
1 والعبارة في "تأويلات أهل السنة" للماتريدي 8/258، فهمت الأمة من قوله : (فَسُبْحٰنَ اللهِ): الصلاة؛ أي: صلوا لله،ولو كانت أفهام أهل زماننا هذا لكانوا لايفهمون سوى التسبيح المذكور. ثم ذكر رحمه الله تعالى وجه دلالة الآيتين على الصلوات الخمس. ومن الممكن أن الكاساني أخذ العبارة من مقام آخر من كتب الماتريدي، ويمكن أن يكون نقله على سبيل الرواية بالمعنى. (محمد عبد المالك)