বয়ঃসন্ধিকালীন সচেতনতা : চারিত্রিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য ইসলামী ব্যবস্থার বিকল্প নেই
আল্লাহ তাআলা আমাদের যে দ্বীন দান করেছেন তা নিছক আচারসর্বস্ব কোনো ধর্ম নয়; বরং তা মানবজীবনের সকল ক্ষেত্র ও অঙ্গনের জন্য আদর্শ। এখানে জীবন ও আদর্শ দুটো বিষয়ই তার বিস্তৃতির সাথে বুঝতে হবে। জীবন শুধু এই পার্থিব জীবনই নয়; এ জীবনের পর আছে পারলৌকিক জীবন, যেখানে মানুষ তার কৃতকর্মের জবাবদিহিতা ও প্রতিদানের মুখোমুখি হবে। কর্মের জীবন ও প্রতিদানের জীবন- এই দুই নিয়েই ‘মানুষের জীবন’ কথাটি সম্পূর্ণ হয়। আমাদের দ্বীনী পরিভাষায় বললে, তা হচ্ছে দুনিয়ার জীবন ও আখেরাতের জীবন। ইসলামের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, জীবনের এই বিস্তৃত অর্থেই ইসলাম মানুষের জীবনাদর্শ।
ইসলাম আমাদের জীবন ও কর্মকে এমনভাবে বিন্যস্ত করে, যা আমাদের পার্থিব জীবনকেও পবিত্র ও সংযত করে, আখেরাতের জীবনকেও শান্তিময় ও আল্লাহ তাআলার নৈকট্য দ্বারা সৌভাগ্যমণ্ডিত করে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যেই দ্বীন মানুষের পার্থিব জীবন ও কর্মকে সুশৃঙ্খল ও সুবিন্যস্ত করার জন্য এসেছে তা কিছুতেই শুধু আচারসর্বস্ব হতে পারে না, তা অবশ্যই মানুষের গোটা জীবন ও কর্ম সম্পর্কে এবং জীবনের ছোট-বড় সকল বিষয় সম্পর্কে স্পষ্ট ও ভারসাম্যপূর্ণ নির্দেশনা প্রদান করবে। যে নির্দেশনা মুক্ত হবে সকল প্রান্তিকতা ও অব্যবস্থা থেকে। একইসাথে জীবন ও কর্ম সংক্রান্ত এই নির্দেশনায় পার্থিব কল্যাণই মুখ্য হবে না, পারলৌকিক মুক্তি ও সাফল্যের বিষয়টিও যথাযোগ্য মর্যাদায় লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের অন্তভুর্ক্ত হবে।
যে কোনো সুবিবেচক মানুষ নির্মোহ ও ন্যায়নিষ্ঠ মন নিয়ে চিন্তা করলে উপলব্ধি করবেন যে, মানুষের সাফল্য ও সৌভাগ্যের জন্য এইরকম আদর্শ নির্দেশনারই একান্ত প্রয়োজন। আর তা মৌলিকভাবে একমাত্র আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকেই হতে পারে। জীবনের বিস্তৃতি, বৈচিত্র্য ও সংবেদনশীলতা সম্পর্কে সচেতন হয়ে আমরা যখন কুরআন মাজীদের ‘হুদা’ বা পথনির্দেশ কথাটি পাঠ করি তখন এর যথার্থতা ও প্রাসঙ্গিকতা এবং প্রয়োজনীয়তা ও অনিবার্যতা খুব স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করি।
আমরা দেখেছি, আল্লাহ তাআলার পথনির্দেশ থেকে বিমুখ হয়ে মানুষ তার সীমাবদ্ধ ও বিভিন্ন উপসর্গে আক্রান্ত বুদ্ধি ও চিন্তা থেকে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে; কিন্তু সে ব্যবস্থা না তার দুনিয়ার জীবনের জন্য কল্যাণকর হয়েছে, না আখেরাতের জীবনের জন্য; বরং ব্যবস্থার ভুলে তার আখেরাতের জীবনের কথা তো বলাই বাহুল্য দুনিয়ার জীবনটাও এলোমেলো হয়ে পড়েছে। বর্তমান সময়ে ব্যবস্থা নামক নানা অব্যবস্থার মধ্যেও এই হৃদয়বিদারক সত্যই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে সামনে আসছে।
জীবনের বিভিন্ন অঙ্গন থেকে এই বিশৃঙ্খলার দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যায়। বিষয়টি বোঝার জন্য জীবনের একটি অংশ নিয়েই চিন্তা করুন, যে অংশটি অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত হলেও বিভিন্ন কারণে তা জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যন্ত স্পর্শকাতর অংশ। যে কোনো প্রাজ্ঞ ও সুবিবেচক মানুষ যদি মানুষের যৌনজীবন সম্পর্কে চিন্তা করেন তাহলে বুঝতে পারবেন, এ বিষয়ে স্বচ্ছ, সঠিক ও ভারসাম্যপূর্ণ নীতি-নির্দেশনার কত প্রয়োজন। কিন্তু এক্ষেত্রে আমাদের চারপাশে কী এলোমেলো অবস্থা! বয়ঃসন্ধিকাল থেকে জীবনের যে নতুন পর্বের উন্মেষ ঘটে, চিন্তা-চেতনায়, দেহমনে যে পরিবর্তন আসে এবং সে কারণে ছেলে-মেয়েরা যে অস্থিরতা ও অজানা ভয়-ভীতিতে জর্জরিত হতে থাকে পরিণত বয়সে তা যতই হাস্যকর মনে হোক তা যে জীবনের কঠিন বাস্তবতা- তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তবে এর চেয়েও কঠিন বাস্তবতা হচ্ছে, জীবনের এই পর্বে স্বচ্ছ, সঠিক নৈতিক ও চারিত্রিক শিক্ষা না পেলে গোটা জীবনটাই অবক্ষয়ের দিকে চলে যেতে পারে। অথচ ভেবে দেখুন, জীবনের এই অতি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর ক্ষেত্রেও সঠিক নীতি-নির্দেশনার কী প্রচণ্ড অভাব!
ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, এসব ক্ষেত্রে অনেকেই পশ্চিমা নীতি-নির্দেশনার দিকে ঝুঁকছেন। অথচ বিশ্বাসগত অধঃপতনের পর চারিত্রিক ও নৈতিক অবক্ষয়ই হচ্ছে পশ্চিমের ঐ ভয়াবহ ব্যাধি, যা তাদেরকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে পশ্চিমের উত্থান নিঃসন্দেহে ঈর্ষণীয়, কিন্তু এ উত্থানের কারণ তাদের জ্ঞান-চর্চা, অসংযত যৌনতা নয়। তাদের রিপুপরায়ণতা ও অসংযত-অব্যবস্থিত জীনবযাত্রা তাদের সকল অর্জনকে ম্লান করে দিয়েছে। তাদের পারিবারিক বন্ধন চুরমার করে দিয়েছে, মানসিক প্রশান্তি বিলুপ্ত করে দিয়েছে এবং গোটা জীবনে চরম অশান্তি-অস্থিরতার বিস্তার ঘটিয়েছে। কাজেই এ বিষয়ে পশ্চিমের নীতি ও পন্থা অনুসরণের পরিণাম যে খুবই ভয়াবহ ও মর্মান্তিক হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়ে আমরা যদি সত্যি সত্যিই কল্যাণকর ও ভারসাম্যপূর্ণ নীতি ও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চাই তাহলে তা কুরআন-সুন্নাহ ও ইসলামের বিধান থেকেই গ্রহণ করতে হবে। ইসলামের পবিত্র ও নির্মল চারিত্রিক শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে হবে এবং ছেলে-মেয়ের জন্য আলাদা পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে পশ্চিমের অনুসরণ গোটা ভবিষ্যত প্রজন্মের চরিত্র ও নৈতিকতাই শুধু নয়, দ্বীন-ঈমানকেও চরম ঝুঁকির মুখে ফেলে দিতে পারে। আর দুনিয়া-আখেরাতে এর দায় বহন করতে হবে সমাজের কর্ণধারদেরই।
আল্লাহ তাআলা আমাদের হেফাযত করুন এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে সুস্থ-সুন্দর ব্যবস্থা গ্রহণের তাওফীক দান করুন- আমীন।