প্রশ্নোত্তর
[আনওয়ারুল কুরআন বিভাগের সর্বশেষ শিরোনাম ‘প্রশ্নোত্তর’। এর অধীনে প্রত্যেক সংখ্যায় ইনশাআল্লাহ তিন থেকে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হবে। সংক্ষেপের জন্য প্রশ্নকারীর নাম-পরিচয় অনুল্লেখ থাকবে।]
প্রশ্ন ৪ : গত সংখ্যায় আপনি কোনো একজনের প্রশ্নের উত্তরে ইলমে তাজবীদের কিছু কিতাবের নাম সংক্ষিপ্ত পরিচয়সহ লিখেছেন। আলহামদু লিল্লাহ! এতে আমার অনেক ফায়দা হয়েছে। কিন্তু ওই প্রশ্নকারী যে কিতাবগুলোর নাম নিয়েছেন তিনি সেগুলো সম্পর্কে জানেন। আমার অবস্থা হল, আমি ওই কিতাবগুলো সম্পর্কেও জানি না। নুযহাতুল কারী, গুনইয়াতুল কারী এবং মুফীদুল কারী ইত্যাদি কিতাব ও তার মুসান্নিফ সম্পর্কে সংক্ষেপে হলেও কিছু জানাবেন। জাযাকুমুল্লাহু তাআলা খায়রান।
উত্তর : কিতাবের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পরিপূর্ণ মুতালাআ করা হলে, শুরু ও শেষে প্রকাশক বা মুহাক্কিকের কোনো ভূমিকা বা সমাপ্তিমূলক কথা থাকলে, তা পড়লে স্বতন্ত্র মেহনত ছাড়াও মুসান্নিফের নাম জানা যেতে পারে। তাছাড়া বিভিন্ন সংস্করণে অথবা মাখতুতের প্রচ্ছদে বা প্রথম পৃষ্ঠায় নাম উল্লেখ থাকে। কিতাবের ভেতরেও মুসান্নিফের পরিচয় অথবা তাঁর সম্পর্কে কিছু লেখা থাকে। তালিবে ইলমদের এ বিষয়গুলো মুতালাআ করার অভ্যাস গড়ে তোলা কর্তব্য। তবে তা হতে হবে হুঁশের সাথে, কারণ কোনো কোনো প্রকাশক বা পাণ্ডুলিপির মালিক তাহকীক ছাড়াই কিতাবের ওপর লেখক হিসেবে কারও নাম লিখে থাকেন। এখন প্রশ্নে উল্লিখিত কিতাবগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচয় শুনুন :
নুযহাতুল কারী : এর একটি সংস্করণ কুতুবখানা রশীদিয়া ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এখানে শুরুতে মুসান্নিফের নাম লেখা হয়েছে, কারী মুহাম্মাদ ইবরাহীম সাহেব রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। লেখকের ভূমিকাতে নিম্নোক্ত ইবারতটিও তাই বলে-
بعد اسکے فقیر محمد ابراہیم کی طرف سے خدمت میں بھائی مسلمانوں کی یہ التماس ہے
এই নুসখার তৃতীয় পৃষ্ঠায় মুসান্নিফের ভূমিকায় আরও উল্লেখ রয়েছে, ‘তাজবীদ সম্পর্কে আগ্রহীদের জন্য আমি এই কিতাব লিখেছি এবং নুযহাতুল কারী নাম দিয়েছি। আমি দেখলাম কতক হিন্দি পুস্তিকায় তাজবীদের কিছু নিয়মনীতি আরবী প্রসিদ্ধ কিতাবগুলোর বিপরীত। তাই নির্ভরযোগ্য আরবী কিতাবসমূহ মুতালাআ করে কিছু নিয়মনীতি সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ করেছি। আল্লাহ তাআলা এর দ্বারা সকলকে উপকৃত করুন- আমীন।’
আমাদের এ দেশে কারী ইবরাহীম নামে একাধিক বুযুর্গ ছিলেন। যাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধ উজানীর হযরত কারী ইবরাহীম ছাহেব রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এবং চাঁদপুর মুবিনবাড়ির কারী ইবরাহীম ছাহেব রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। লোকমুখে প্রসিদ্ধ নুযহাতুল কারী উজানীর হযরতের রচিত। যদিও বিষয়টি তাহকীকের সাথে বলা মুশকিল। কারও কাছে এ বিষয়ে সঠিক তথ্য থাকলে আমাদেরকে জানানোর অনুরোধ রইল।
গুনইয়াতুল কারী : আমার সামনে এর ‘ইমদাদিয়া লাইব্রেরি চকবাজার ঢাকা’ থেকে প্রকাশিত কপিটি রয়েছে। এখানে প্রথম পৃষ্ঠায় লেখকের নাম ‘কারী মাওলানা মিন্নাত আলী’ (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) লেখা আছে। শুরুতে লেখা আছে, ‘মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড কর্তৃক চতুর্থ শ্রেণির পাঠের অন্তর্ভুক্ত।’ লেখক নিজের উস্তায কারী মুহাম্মাদ আলী হুসাইন খান (শিক্ষক মাদরাসা আলিয়া নাওয়াবিয়া, রিয়াসাত, রামপুর)-এর সমীপে ض -এর উচ্চারণ সম্পর্কে যে প্রশ্ন করেছেন, সেই প্রশ্ন এবং উত্তর কিতাবের ৪১-৪৬ পৃষ্ঠায় যুক্ত করা হয়েছে। উত্তর প্রদানের তারিখ ১৩ রবীউস সানী ১৩৩৭ হিজরী লেখা হয়েছে। এ থেকে কিতাবের রচনাকাল সম্পর্কে কিছুটা অনুমান করা যেতে পারে।
৫২ পৃষ্ঠায় লেখা রয়েছে-
"حرره العبد منت العلي غفر له الولي، المتوطن بقرية مدنيرگاؤں، في ناحية چاندپور في البنجالة"
এখান থেকে মুসান্নিফের দেশ সম্পর্কে জানা যায়। চাঁদপুরের ফরীদগঞ্জের একটি গ্রাম মদনেরগাঁও। মাদরাসা আরাবিয়া খেড়িহর, শাহরাস্তি, চাঁদপুর-এর উস্তায মাওলানা আবদুল মান্নান ছাহেবের কাছে জিজ্ঞেস করে আমি তা জানতে পারি। তিনি আমার প্রশ্নের উত্তরের জন্য মুবিনবাড়ি মাদরাসা চাঁদপুরের মুহতামিম সাহেবকে ফোন করেছেন। তিনি এটাও জানিয়েছেন, মাওলানা মিন্নাত আলী ছাহেব কারী ইবরাহীম মুবিনবাড়ি ছাহেবের শাগরিদ।
এই কিতাবের ৪১ পৃষ্ঠায় তিনি নিজের সনদ বর্ণনা করে লিখেছেন, তিনি মাওলানা কারী মুহাম্মাদ আলী হুসাইন রামপূরী থেকে ইলমে কিরাআত ও তাজবীদ শিখেছেন, আর তিনি কারী আবদুর রহমান পানীপথী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি থেকে শিখেছেন।
মুফীদুল কারী : কিতাবের নামের সাথে যদিও মুসান্নিফের নাম উল্লেখ নেই। কিন্তু তৃতীয় পৃষ্ঠায় মুসান্নিফের ভূমিকায় তার নাম লেখা হয়েছে, আগা মুহাম্মাদ আলী ওরফে আবদুল মান্নান ইবনে আগা শুজাআত আলী। এখানে এটাও লেখা আছে, মুসান্নিফ জাহাঙ্গীরনগর তথা ঢাকার বাসিন্দা ছিলেন। জামিয়া উসমানিয়া, ভাওয়ালপুরের প্রাক্তন প্রফেসর মাওলানা আবদুস সামাদ সারেম রহমাতুল্লাহি আলাইহি তার তারীখে তাদবীনে কুরআন (কুরআন সংকলনের ইতিহাস) কিতাবের দু-এক জায়গায় মুফীদুল কারীর উদ্ধৃতি দিয়েছেন। সারেম ছাহেবের কিতাবের প্রথম সংস্করণ ১৯৬৩ ঈসাব্দে এবং দ্বিতীয় সংস্করণ ১৯৮০ ঈসাব্দে ছাপা হয়েছে।
প্রশ্ন ৫ : আসহাবুল আইকা কারা? তারা কখন কোথায় ছিল? তাদের নবী কে ছিলেন?
উত্তর : আইকা অর্থ ঘন বৃক্ষ-সম্বলিত বন। এটি মাদইয়ানের অন্তর্গত একটি স্থান। সেখানে নিবিড় বন-বনানী ছিল, এর সঙ্গে সম্বন্ধ স্থাপন করেই সেখানকার অধিবাসীদেরকে আসহাবুল আইকা বলা হত। তাদের নবী ছিলেন হযরত শুআইব আলাইহিস সালাম।
কেউ কেউ বলেন, আইকা এবং মাদইয়ান দুটো আলাদা জনপদ। হযরত শুআইব আলাইহিস সালাম উভয় স্থানেরই নবী ছিলেন। কিন্তু অধিক গ্রহণযোগ্য মত হল, আসহাবে মাদইয়ানেরই অপর নাম আসহাবুল আইকা। বিষয়টি এখান থেকেও স্পষ্ট যে, কুরআন কারীমে সূরা আরাফে মাদইয়ানবাসীর খাসলত ও আযাব সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, তেমনই কথা সূরা শুআরায় আসহাবুল আইকা সম্পর্কে বলা হয়েছে। (দ্র. তাফসীরে তবারী, তাফসীরে ইবনে কাসীর, রূহুল মাআনী)
প্রশ্ন ৬ : কুরআন কারীমের সাত মনযিলের উৎস কী?
উত্তর : নবীজীসহ সাহাবায়ে কেরাম সাধারণত সপ্তাহে এক খতম কুরআন তিলাওয়াত করতেন। তাই প্রতিদিনের জন্য একটা পরিমাণ নির্দিষ্ট ছিল। এভাবে তারা সপ্তাহের সাত দিনের জন্য সাত অংশ নির্ধারণ করেছিলেন। সেই সাত অংশই সাত মনযিল।
হযরত আউস ইবনে হুযাইফা রাযিয়াল্লাহু তাআলা আনহু সাহাবায়ে কেরামকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনারা কীভাবে সাত ভাগ করেছেন? সাহাবায়ে কেরাম বলেছেন, প্রথম ভাগে ৩ সূরা, দ্বিতীয় ভাগে ৫ সূরা, তৃতীয় ভাগে ৭ সূরা, চতুর্থ ভাগে ৯ সূরা, পঞ্চম ভাগে ১১ সূরা, ষষ্ঠ ভাগে ১৩ সূরা এবং সপ্তম ভাগে বাকি অংশ।
এর ব্যখ্যা হল, প্রথম ভাগে সূরা ফাতেহা থেকে সূরা নিসার শেষ পর্যন্ত। দ্বিতীয় ভাগে সূরা মায়েদা থেকে সূরা তাওবার শেষ পর্যন্ত। তৃতীয় ভাগে সূরা ইউনুস থেকে সূরা নাহলের শেষ পর্যন্ত। চতুর্থ ভাগে সূরা বনী ইসরাইল থেকে সূরা ফুরকানের শেষ পর্যন্ত। পঞ্চম ভাগে সূরা শুআরা থেকে সূরা ইয়াসীনের শেষ পর্যন্ত। ষষ্ঠ ভাগে সূরা সাফ্ফাত থেকে সূরা হুজুরাতের শেষ পর্যন্ত। আর শেষ ভাগে সূরা ক্বফ থেকে কুরআন কারীমের শেষ পর্যন্ত। কুরআন কারীমে এভাবেই সাত মনযিল রয়েছে। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৩৯৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৬১৬৬)
-বিভাগীয় সম্পাদক