দুটি ভিত্তিহীন বর্ণনা
এক. যে ব্যক্তি মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপলক্ষ্যে এক দিরহাম খরচ করবে সে জান্নাতে আমার (আবু বকরের) সঙ্গী হবে
দুই. যে ব্যক্তি মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উনাকে সম্মান করবে, সে ঈমানের সাথে মৃত্যু
প্রতি বছর রবিউল আউয়াল মাস এলে আমাদের দেশের একটি বিদআতী ফেরকার পক্ষ থেকে কিছু জাল বর্ণনা প্রচার করা হয়। সেসব জাল বর্ণনার মধ্য থেকে তাদের প্রচারিত দুটি প্রসিদ্ধ বর্ণনা আরবী পাঠ, লিপি ও হরকতের ভুলসহ নি¤েœ পেশ করা হল-
এক. “সর্বশ্রেষ্ঠ সাহাবী ও ইসলামের প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর সিদ্দীক আলাইহিস সালাম বলেন-
من انفق درهما على قراةَ مولد النبيُ صلي الله عليه وسلم كان رفيقي فى الجنة.
অর্থাৎ- যে ব্যক্তি মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপলক্ষ্যে এক দিরহাম খরচ করবে সে জান্নাতে আমার সঙ্গী হবে।”
দুই. “চতুর্থ খলীফা হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়জহাহু আলাইহিস সালাম বলেন-
من عظَّم مولدِ النبى صلى الله عليه وسلم، وكان سَببَا لقراته، لا يخرج من الدنيا إلا بالايمان، ويدخل الجنة بغير حساب.
অর্থাৎ- যে ব্যক্তি মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উনাকে সম্মান করবে, সে ঈমানের সাথে মৃত্যুবরণ করবে এবং বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”
এগুলো একেবারেই ভিত্তিহীন বর্ণনা। যাদের নামে এগুলো জাল করা হয়েছে তাদের সঙ্গে এগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই।
আশ্চর্যের বিষয় হল, এগুলোর সমর্থনে তারা ইবনে হাজার মাক্কী রাহ.-এর ‘আননি‘মাতুল কুবরা আলাল আলাম’-এর উদ্ধৃতি দিয়েছে। অথচ তাতে এগুলোর চিহ্নমাত্র নেই। এই কিতাবটির মাখতূতাহ (পা-ুলিপি) দারুল কুতুবিল মিছরিয়্যাহ কায়রোতে (ইতিহাস ২৫০৮/১৯২১) সংরক্ষিত রয়েছে এবং আমাদের কাছে এর ফটোকপি রয়েছে। আমরা তা অদ্যোপান্ত দেখেছি। তাতে এসব বর্ণনা নেই।
ইবনে হাজার মাক্কী রাহ.-এর মূল কিতাবটি এখন ছাপা আকারেও পাওয়া যায়। প্রকাশক : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, বাইরুত, লেবানান।
আসল বিষয় হল, তারা মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য একটি নকল ‘আননি‘মাতুল কুবরা’র হাওয়ালা দেয়, যা ইস্তাম্বুলের ফাতিহ অঞ্চলের-
مكتبة ايشيق شارع دار الشفقة
থেকে ছাপা হয়েছে। এটি তুরস্কের কট্টর বিদআতপন্থীদের প্রকাশনা مكتبة الحقيقة -এর সমগোত্রীয় একটি প্রকাশনা, যারা প্রচলিত বিভিন্ন শিরক-বিদআতের সমর্থনে কিতাবপত্র প্রকাশ করে। এমনকি কখনো কখনো কোনো বিদআতপন্থী লেখকের বাজে কিতাব হাজির করে কিতাবের বা লেখকের নাম পরিবর্তন করে পূর্ববর্তী কোনো সর্বজনস্বীকৃত আলেমের নামে চালিয়ে দেয়। এখানেও এমনটিই ঘটেছে। ইবনে হাজার মাক্কী রাহ.-এর নাম ও তাঁর কিতাব ‘আননি‘মাতুল কুবরা’র নাম এমন একটি কিতাবের উপর লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা কোনো বে-দ্বীন ও নির্বোধ বিদআতীর রচনা; যার কি না কিছুটা বুদ্ধি খরচ করে জাল বর্ণনা তৈরি করারও যোগ্যতা নেই।
বর্ণনাদুটির আরবী দেখেই বিজ্ঞজন বুঝতে পারবেন যে, এটি অত্যন্ত কাঁচা হাতে গড়া একটি জাল কথা; যার জালকারী আরবী ভাষাও ভালো করে জানে না। [সাথে সাথে এ দেশে এগুলো যারা প্রচার করছে, তারাও এর আরবী লিপি ঠিকমত লেখার যোগ্যতা রাখে না এবং ই‘রাব লাগানোর ক্ষেত্রে তাদের ভুল তো নযীরবিহীন; যা পাঠক দেখেছেন।]
আর যার নামে এবং যে কিতাবের উদ্ধৃতিতে এমন বানোয়াট কথা প্রচার করা হচ্ছে, সে কিতাবেই তিনি মীলাদকে ইসলামের প্রথম তিন শতাব্দীর অনেক পরের উদ্ভাবিত বিদআত বলেছেন এবং মীলাদের তথাকথিত বর্ণনাগুলো খ-ন করে বলেছেন যে, মানুষকে এগুলো থেকে দূরে রাখা ওয়াজিব। [দ্র. আননি‘মাতুল কুবরা আলাল আলাম, ইবনে হাজার মাক্কী, ওয়ারাকা ২-৩ (পা-ুলিপি)]
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এসব জাল বর্ণনা ও তার অনিষ্ট থেকে হেফাজত করুন।
[এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, মাসিক আলকাউসার-এ প্রকাশিত হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেব দা. বা.-এর দুটি প্রবন্ধ- ‘মওলুদখানী : হক্ব আদায়ের না-হক পন্থা, ইতিহাস ও বর্ণনার আলোকে’, সফর ১৪২৮ হি./মার্চ ২০০৭ ঈ. এবং ‘আলবাইয়্যিনাত-এ প্রকাশিত মওজু রেওয়ায়েত, আরও তথ্য ও পর্যালোচনা’, রবিউল আউয়াল ১৪২৮ হি./এপ্রিল ২০০৭ ঈ.]