কুরআন মাজীদের নাম-পরিচয়
আলকুরআন নামের তাৎপর্য
কুরআনে কারীম সর্বশেষ আসমানী কিতাব, যা মহান রাব্বুল আলামীন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর নাযিল করেছেন। কুরআনে কারীমের তিলাওয়াত এবং এর বিধানাবলির অনুসরণের মধ্যেই মানব জাতির হেদায়েত ও সফলতা নিহিত। এর মাধ্যমেই মানুষ আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভ করতে পারে। যে ব্যক্তি এ কুরআনকে সর্বক্ষেত্রে শিক্ষক ও সিদ্ধান্তদাতারূপে গ্রহণ করবে দোজাহানের সফলতা কেবল তারই নসীব হবে। সুতরাং কুরআনে কারীমের সাথে আমাদের আস্থা, ভালোবাসা ও সমর্পণের সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।
মহাগ্রন্থ আলকুরআনুল কারীমে মানব জাতির যে প্রভূত কল্যাণ নিহিত, মানুষের উপর এই মহাগ্রন্থের যে ইহসান ও অনুগ্রহ তার দাবি হল, মানুষ কুরআনে কারীম এবং কুরআনের বার্তা ও শিক্ষা সম্বন্ধে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবে।
কুরআনের পরিচয় লাভের এবং এর মাহাত্ম্য-বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে অবগতি লাভের একটি উপায় এর নাম-পরিচয় এবং এর উপাধি ও বিশেষণসমূহের মর্ম ও তাৎপর্য অনুধাবন করা। সর্বোপরি কুরআনে কারীমের যেসব নাম ও বিশেষণ খোদ কুরআনে কারীমে বর্ণিত হয়েছে সেসবের তাৎপর্য অনুধাবন করলে আমরা বুঝতে পারব, কুরআনের সাথে আমাদের সম্পর্ক কতটা গভীর হওয়া প্রয়োজন।
আলকুরআনের নাম ও বিশেষণের পরিসংখ্যান
কুরআনে কারীমে বিভিন্ন শব্দে ও বিভিন্ন আঙ্গিকে কুরআনের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হল নামবাচক শব্দসমূহ ও গুণবাচক শব্দসমূহ। সব মিলে সংখ্যা প্রায় একশ হবে। এরপর পবিত্র হাদীস শরীফে এবং সালাফ তথা সাহাবা ও তাবেয়ীনের বাণীতে এর যেসব নাম বা বিশেষণ বর্ণিত হয়েছে সেগুলোকে যোগ করা হলে সংখ্যা একশ ছাড়িয়ে যাবে। এসব নাম ও বিশেষণের ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য সম্বন্ধে তাফসীরগ্রন্থগুলোর সংশ্লিষ্ট স্থানে এবং কোনো কোনো তাফসীরগ্রন্থের ভূমিকা অংশে আলোকপাত করা হয়েছে। তেমনি ‘উলূমুল কুরআন’ বিষয়ক বিভিন্ন কিতাবে স্বতন্ত্র অধ্যায়ে এ বিষয়ে আলোচনা রয়েছে। তাছাড়া পূর্ববতী কোনো কোনো আলেম এ বিষয়ে স্বতন্ত্র পুস্তিকাও রচনা করেছেন।
ইমাম ইবনু জারীর তবারী রাহ.-সহ অনেকে কুরআনের চারটি নাম উল্লেখ করেছেন। যথা : আলকুরআন, আলকিতাব, আলফুরকান ও আযযিকর। অনেকে আবার এর সাথে পঞ্চম আরেকটি নাম ‘আততানযীল’ও যোগ করেছেন। এছাড়াও অনেকে কুরআনে কারীমের জন্য ব্যবহৃত গুণবাচক বিভিন্ন শব্দ ও বিশেষণকেও নাম হিসেবে গণ্য করেছেন। ফলে নামের সংখ্যায় কম-বেশি হয়েছে। আবুল মাআলী শায়যালাহ (মৃত্যু : ৪৯৪ হি.) ‘আলবুরহান ফী মুশকিলাতিল কুরআন’ কিতাবে কুরআনের পঞ্চান্নটি নাম উল্লেখ করেছেন। আলী ইবনু আহমদ আলহাররালী (মৃত্যু : ৬৩৮ হি.) কুরআনের নাম উল্লেখ করেছেন নব্বইয়েরও বেশি। উমর ইবনু মুহাম্মাদ নাসাফী (৫৩৭ হি.) তার তাফসীরগ্রন্থের ভূমিকায় এবং মাজদুদ্দীন ফায়রুযাবাদী (মৃত্যু : ৮১৭ হি.) ‘বাসাইরু যাবিত তাময়ীয’ নামক তাফসীরগ্রন্থে (১/৮৮-৯৬) একশত নাম উল্লেখ করেছেন।
এ ব্যাপারে সঠিক কথা এটাই যে, ভাষা ও পরিভাষার স্বীকৃত নিয়ম-কানুন অনুসারে ‘আলকুরআন’, ‘আলফুরকান’, ‘আলকিতাব’, ‘আযযিকর’ ও ‘আততানযীল’-এই পাঁচটি শব্দ কুরআনে কারীমের মূল নাম। অন্যান্য শব্দগুলো কুরআনের সিফাত বা বিশেষণ। এই পাঁচটি শব্দ নাম হিসেবে খোদ কুরআনে কারীমেরই অনেক আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। আয়াতের পূর্বাপর শব্দ লক্ষ করলে বোঝা যায়, উপরোক্ত শব্দগুলো কুরআনে কারীমের মূল নামরূপে বর্ণিত হয়েছে আর অন্যান্য গুণবাচক শব্দগুলো আসলে উপরোক্ত নামসমূহের সিফাত বা বিশেষণরূপে বর্ণিত হয়েছে। যেমন- ‘কুরআন কারীম’ এই যুগল শব্দের মধ্যে ‘কারীম’ শব্দটি এবং ‘কুরআন মাজীদ’-এর ‘মাজীদ’ শব্দটি।
কুরআনের এসব নাম ও বিশেষণ মাহাত্ম্যের পরিচায়ক
মহাগ্রন্থ আলকুরআন হল সর্বস্রষ্টা মহান আল্লাহ তাআলার কালাম বা বাণী। আল্লাহ তাআলা যত মহান তাঁর কালামও তত মহান। যে মহামহিম আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারীম নাযিল করেছেন তাঁর যেমন সত্তাবাচক নাম-‘আল্লাহ’ ছাড়াও গুণবাচক সুন্দর সুন্দর আরো অনেক নাম রয়েছে, যা ‘আলআসমাউল হুসনা’ নামে পরিচিত এবং কুরআনে কারীম যে মহান রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর নাযিল হয়েছে তাঁর ‘মুহাম্মাদ’ ও ‘আহমাদ’ নাম ছাড়াও আরো গুণবাচক সুন্দর সুন্দর নাম রয়েছে, তেমনি কুরআনে কারীমেরও রয়েছে বহুসংখ্যক নাম ও বিশেষণ, যা ইলাহী কালামের মাহাত্ম্যকেই ফুটিয়ে তোলে।
নামের মর্ম ও ব্যঞ্জনা
কুরআনে কারীমের প্রতিটি নাম কুরআনে কারীমের বৈশিষ্ট্য ও মাহাত্ম্যকে প্রকাশ করে। প্রতিটি নামই ব্যঞ্জনাময়। প্রতিটি নামই কালামে ইলাহীর কোনো না কোনো বৈশিষ্ট্যের প্রতি ইঙ্গিত করে। এই নামগুলো নিছক নাম নয়; বরং কুরআনে কারীমের বৈশিষ্ট্য, মর্যাদা ও প্রশংসাজ্ঞাপক উপাধি।
প্রজ্ঞাময় মহামহিম আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পবিত্র কালামের কোনো নামই অর্থহীন নয়, বরং প্রতিটি নামই অর্থময় এবং স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। এতে যেমন রয়েছে ভাষাগত মাধুর্য ও সাবলীলতা তেমনি রয়েছে ভাবগাম্ভীর্য এবং নিগূঢ় মর্ম ও তাৎপর্য। বস্তুত কুরআনে কারীম এক মহা মুজিযা বা অলৌকিক কালাম। এর প্রকাশভঙ্গী সাধারণ আরবী কালামের প্রকাশভঙ্গী থেকে আলাদা ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এর প্রতিটি নামই অনন্যসাধারণ ও গভীর মর্মসম্পন্ন।
নিম্নে কুরআনের নাম ও বিশেষণ নিয়ে সংক্ষেপে কিছু কথা আলোচনা করার প্রয়াস পাচ্ছি।
القرآن শব্দের আভিধানিক অর্থ
قرآن এই শব্দরূপটি ব্যাকরণের ভাষায় ‘মাসদার’ বা ‘ক্রিয়াবিশেষ্য’। এর সমার্থক শব্দরূপ- قرء ও قراءة। এর মূল ধাতু : ق- ر- ء এই ধাতুর মূল বা প্রাথমিক অর্থ একত্র করা ও সমন্বয় করা। এরপর এটি পাঠ করা ও পড়া অর্থে ব্যবহৃত হতে থাকে। আর এটিই এই শব্দের সর্বাধিক প্রচলিত ব্যবহারিক অর্থ। বস্তুত পাঠ করা বা পড়ার মাঝেও একত্র করা ও সমন্বয় করার ভাব বিদ্যমান। কারণ ‘পাঠ করা’ মানে হরফ ও শব্দকে একত্রে জুড়ে উচ্চারণ করা।১
কুরআন মাজীদের সর্বপ্রথম যে পাঁচটি আয়াত নাযিল হয়েছিল অর্থাৎ সূরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত তার প্রথম শব্দটিই হল-اِقْرَاْ। বলার অপেক্ষা রাখে না, اِقْرَاْ শব্দরূপটি কাফ-রা-হামযা ধাতু থেকে গঠিত অনুজ্ঞাবাচক শব্দ। অর্থ ‘পড়ো’ বা ‘পাঠ করো’।
কুরআন মাজীদে قرآن শব্দের প্রয়োগ
قرآن শব্দটি কুরআন মাজীদে বহু স্থানে বিভিন্ন প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই قرآن শব্দটি ইলাহী কিতাবের নামরূপে ব্যবহৃত হয়েছে।
কুরআনে কারীমের যেসব আয়াতে قرآن শব্দটি ‘কিতাবুল্লাহ’-এর নামরূপে ব্যবহৃত হয়েছে, এমন কিছু আয়াত তরজমাসহ নিম্নে উল্লেখ করছি-
১। সূরা মুযযাম্মিল, কুরআন নাযিলের শুরুর দিকে নাযিল হয়েছে। এটি সম্ভবত নাযিলের তারতীব অনুসারে তৃতীয় সূরা। এর ৪র্থ আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
وَ رَتِّلِ الْقُرْاٰنَ تَرْتِیْلًا.
(এবং ধীর-স্থিরভাবে স্পষ্টরূপে কুরআন তিলাওয়াত কর।)
২। সূরা তাওবা-এর ১১১ নং আয়াতে তাওরাত, ইনজিল ও কুরআন-এই তিনটি নাম একসঙ্গে এসেছে-
وَعْدًا عَلَیْهِ حَقًّا فِی التَّوْرٰىةِ وَ الْاِنْجِیْلِ وَ الْقُرْاٰنِ.
(...তাওরাত, ইঞ্জিল ও কুরআনে এই সম্পর্কে তাদের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি রয়েছে।)
৩। সূরা বাকারার ১৮৫ নং আয়াত-
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِیْۤ اُنْزِلَ فِیْهِ الْقُرْاٰنُ هُدًی لِّلنَّاسِ وَ بَیِّنٰتٍ مِّنَ الْهُدٰی وَ الْفُرْقَانِ .
(রমযান মাস, এতে মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে।)
৪। সূরা আরাফ, মাক্কী সূরা এবং নাযিলের তারতীব অনুসারে সম্ভবত ঊনচল্লিশতম সূরা। এই সূরার ২০৪ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
وَ اِذَا قُرِئَ الْقُرْاٰنُ فَاسْتَمِعُوْا لَهٗ وَ اَنْصِتُوْا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُوْنَ.
(যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন তোমরা মনোযোগের সাথে তা শোনো এবং নিশ্চুপ হয়ে থাক। যাতে তোমাদের প্রতি দয়া করা হয়।)
৫। সূরা হা-মীম সাজদাহ, যা একটি মাক্কী সূরা এবং নাযিলের তরতীব অনুসারে সম্ভবত ৬১ নং সূরা। এই সূরার ২৬ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
وَ قَالَ الَّذِیْنَ كَفَرُوْا لَا تَسْمَعُوْا لِهٰذَا الْقُرْاٰنِ وَ الْغَوْا فِیْهِ لَعَلَّكُمْ تَغْلِبُوْنَ.
(কাফিররা বলে, তোমরা এই কুরআন শোনো না এবং তা পাঠকালে শোরগোল সৃষ্টি কর, যাতে তোমরা জয়ী হতে পার।)
তার অর্থ, হযরত মূসা আলাইহিস সালামের উপর অবতীর্ণ কিতাবের বিশেষ নাম যেমন ‘তাওরাত’ এবং হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের উপর অবতীর্ণ কিতাবের বিশেষ নাম যেমন ইনজীল, তেমনি খাতামুন-নাবিয়্যীন হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর অবতীর্ণ আসমানী কিতাবের বিশেষ নাম ‘আলকুরআন’। এটি কুরআন মাজীদের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ও পরিচিত নাম।
‘আলকুরআন’ নামটি খাতামুন-নাবিয়্যীন-এর উপর অবতীর্ণ কিতাবের জন্য বিশিষ্ট
উল্লেখ্য, ‘আলকুরআন’ শব্দটি পারিভাষিক অর্থে বা নাম হিসেবে আল্লাহ তাআলার সেই পাক কালামের জন্যই নির্দিষ্ট, যা তিনি তাঁর প্রিয় রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর হযরত জিবরীল আ.-এর মাধ্যমে ওহী আকারে নাযিল করেছেন, যা বর্তমানে আমাদের হাতে গ্রন্থাকারে সংরক্ষিত রয়েছে। যা সূরা ফাতিহা দ্বারা শুরু হয়ে সূরা নাস-এ সমাপ্ত হয়েছে।
কোনো মাখলুকের বাণীসমগ্রের নাম বা মানবরচিত কোনো গ্রন্থের নাম ‘আলকুরআন’ ছিল না এবং নেই।
‘আলকুরআন’ নামের ভাষাগত বিশ্লেষণ
আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি, আরবী ব্যাকরণ অনুসারে قُرْاٰنٌ -এই শব্দটি فُعْلَان কাঠামোর একটি ‘মাসদার’ বা ক্রিয়ামূল। আরবী ভাষায় শব্দটির মূল অর্থ ‘একত্র করা বা ‘জমা করা’। পরে এটি ‘পঠন’ বা ‘পড়া’ অর্থে প্রচলন লাভ করে। এই ক্রিয়া দ্বারা যখন পাঠ্যবিষয়কে বা পাঠ্যগ্রন্থকে নামকরণ করা হয়েছে, তখন قُرْاٰنٌ শব্দটি مَقْرُوء তথা ‘পঠিত’ বা ‘পাঠ্য’ অর্থে প্রযোজ্য হয়েছে। অতএব আরবী ব্যাকরণের ভাষায় এখানে قُرْاٰنٌ ‘মাসদার’ مَقْرُوء ‘সিফাত’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলা ব্যাকরণের ভাষায় ক্রিয়া-বিশেষ্য এখানে বিশেষণ অর্থে প্রযোজ্য হয়েছে।
الْقُرْاٰنُ নামের শুরুর ‘আলিফ-লাম’
‘আলকুরআন’ নামের শুরুতে যে ‘আলিফ লাম’ রয়েছে তা বিশিষ্টতাজ্ঞাপক বা আধিক্য ও অতিশয়তাজ্ঞাপক। সে হিসেবে ‘আলকুরআন’ নামের শুরুর ‘আলিফ-লামটি’ এখানে ‘বহুল পঠিত’ বা ‘বহুল পাঠ্য’ এরূপ ভাব প্রকাশ করছে। -জামালুল কুররা ওয়া কামালুল ইকরা, আলামুদ্দীন সাখাভী ১/২৩
কুরআন মাজীদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য পঠিত হওয়া
উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট, ভাষাগত বিশ্লেষণে ‘আলকুরআন’ নামটি গভীর ব্যঞ্জনাময় শব্দ, যা মহামহিম আল্লাহ তাআলার পবিত্র কালামের একটি স্বতন্ত্র গুণ ও বৈশিষ্ট্যকে বিশেষভাবে ব্যক্ত করে। সেটি হল ‘পঠিত’ বা ‘পঠনীয়’ হওয়ার গুণ। এটি যে কুরআন মাজীদের বিশেষ ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য তা খোদ কুরআনে কারীমে বর্ণিত قُرْاٰنٌ বিশেষণের ব্যবহার থেকে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠে। চলুন আমরা এ সংক্রান্ত কিছু আয়াত সম্পর্কে একটু তাদাব্বুর করি-
যেমন, সূরা হিজরের শুরুতে ইরশাদ হয়েছে-
تِلْكَ اٰیٰتُ الْكِتٰبِ وَ قُرْاٰنٍ مُّبِیْنٍ.
এগুলি হচ্ছে এক পরিপূর্ণ কিতাবের এবং সুস্পষ্ট কুরআনের আয়াত। -সূরা হিজর (১৫) : ২
সূরা ইয়াসীনের ৬৯ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
اِنْ هُوَ اِلَّا ذِكْرٌ وَّ قُرْاٰنٌ مُّبِیْنٌ.
এটা তো এক উপদেশবাণী এবং এমন কুরআন, যা (সত্যকে) সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করে।
লক্ষ করুন, উপরোক্ত আয়াতদুটিতে قُرْاٰنٌ শব্দটি الواو অব্যয় যোগে যথাক্রমে الْكِتٰبِ এবং ذِكْرٌ শব্দদ্বয়ের পর পৃথকভাবে এসেছে। এ থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায়, القرآنيّة বা ‘পাঠ্য’ হওয়া, কিতাব বা গ্রন্থ হওয়া এবং ‘যিকর’ বা উপদেশ হওয়া-এই তিনটি আল্লাহর পবিত্র কালামের পৃথক তিনটি গুণ।
এ সংক্রান্ত কুরআন মাজীদের আরো কিছু আয়াত লক্ষ করুন-
الٓرٰ، تِلْكَ اٰیٰتُ الْكِتٰبِ الْمُبِیْنِ، اِنَّاۤ اَنْزَلْنٰهُ قُرْءٰنًا عَرَبِیًّا لَّعَلَّكُمْ تَعْقِلُوْنَ.
এগুলো সুস্পষ্ট কিতাবের আয়াত। এই কিতাবকে অবশ্যই আমি নাযিল করেছি আরবী ভাষার কুরআনরূপে, যাতে তোমরা বুঝতে পার। -সূরা ইউসুফ (১২) : ১-২
وَ كَذٰلِكَ اَنْزَلْنٰهُ قُرْاٰنًا عَرَبِیًّا وَّ صَرَّفْنَا فِیْهِ مِنَ الْوَعِیْدِ لَعَلَّهُمْ یَتَّقُوْنَ اَوْ یُحْدِثُ لَهُمْ ذِكْرًا.
আর এভাবেই আমি এই কিতাবকে অবতীর্ণ করেছি আরবী কুরআনরূপে এবং এতে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেছি হুঁশিয়ারবাণী, যাতে তারা তাকওয়া অবলম্বন করে অথবা তা তাদের কিছুটা চিন্তা-চেতনা উৎপাদন করে। -সূরা ত্বহা (২০) : ১১৩
দেখুন, উপরোক্ত আয়াত দুটি, তেমনিভাবে সূরা যুমারের ২৮ নং আয়াতে এবং সূরা হা-মীম-সাজদার ৩ নং আয়াতে قُرْاٰنًا عَرَبِیًّا শব্দদুটি ‘হাল’ বা অবস্থাবাচক পদ, যা অত্যন্ত জোরালোভাবে আল্লাহ তাআলার কালাম ‘পঠনীয় হওয়া’ এবং ‘আরবী ভাষায় হওয়া’- এই উভয় বৈশিষ্ট্যকে ফুটিয়ে তুলেছে।
সর্বোপরি কুরআনে কারীমের প্রথম ওহী ছিল সূরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত, যা হেরা গুহায় নাযিল হয়েছিল। এর প্রথম শব্দই হল اِقْرَاْ ‘পড়ো’। এরপর তৃতীয় আয়াতেও اِقْرَاْ ‘পড়ো’ নির্দেশটির পুনরাবৃত্তি হয়েছে।
‘আলকুরআন’ নামকরণের তাৎপর্য
আলকুরআন নামের তাৎপর্য কী- তা আমরা উপরের আলোচনা থেকে কিছুটা উপলব্ধি করতে পেরেছি। যার খোলাসা হল, ‘আলকুরআন’ নামটি একথাই ঘোষণা করছে, এই মহাগ্রন্থ মানব জাতির সর্বজনীন ‘পাঠ্যগ্রন্থ’, যা সকলের জন্য পাঠ্য ও পঠিতব্য এবং অধিক পরিমাণে ও বারবার পঠনীয়। এই নামের মধ্যে মক্কার কাফির-মুশরিকদের রদ রয়েছে। যারা বলত-
لَا تَسْمَعُوا لِهَذَا الْقُرْآنِ وَالْغَوْا فِيهِ لَعَلَّكُمْ تَغْلِبُونَ.
তোমরা এই কুরআন শোনো না এবং তা পাঠকালে শোরগোল সৃষ্টি কর, যাতে তোমরা জয়ী হতে পার। -সূরা হা-মীম সিজদা (৪১) : ২৬
কাফিরদের এই অপচেষ্টা সত্ত্বেও কুরআন নামকরণের মাঝে এই ইশারা রয়েছে, কুরআনে কারীমের দাওয়াতকে কোনো অপচেষ্টা ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দমানো যাবে না; বরং কুরআন নাযিল হয়েছে পড়ার জন্য এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা পড়া হবে। আর স্বীকৃত বাস্তবতা হল, আজ পৃথিবীর বুকে কুরআনে কারীমই সর্বাধিক পঠিত আসমানী গ্রন্থ।
‘আলকুরআন’ নামের উপরোক্ত তাৎপর্যের যেসব অপরিহার্য দাবি তা সামনে বিস্তারিত আলোচনা করা হল-
এক.
কুরআন মাজীদের তিলাওয়াত কুরআন নাযিলের গুরুত্বপূর্ণ মাকসাদ এবং স্বতন্ত্র একটি আমল ও পুণ্যের কাজ। তা অর্থ না বুঝেই তিলাওয়াত করা হোক না কেন। কেননা শব্দমালার পঠনকেই মূলত আরবীতে ‘কিরাআত’ এবং ‘কুরআন’ বলা হয়। আর শব্দমালার উদ্দিষ্ট অর্থ অনুধাবন করা, তার শিক্ষা ও নির্দেশনা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করা ও উপলব্ধি করাকে বলা হয় ‘তাদাব্বুর’ ও ‘তাযাক্কুর’। আর আয়াতের শব্দমালায় বর্ণিত শিক্ষা ও নির্দেশনাকে বাস্তবে অনুসরণ করাকে বলা হয় ‘ইত্তেবা’, ‘ইতাআত’ ও আমল।
আরেকটি বিষয় এখানে লক্ষণীয়, ‘আলকুরআন’ নামটি একমাত্র আল্লাহ তাআলার কালামের জন্য বিশিষ্ট। অন্য কারো কালামকে কুরআন বলা হয় না। এমনকি কুরআন যাঁর উপর নাযিল হয়েছে তাঁর কালামকে হাদীস বলা হয়; কুরআন বলা হয় না। অথচ কুরআন যেমন ওহীর মাধ্যমে অবতীর্ণ, ছাহেবে কুরআন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কালামের ভিত্তিও ওহী। স্বয়ং কুরআনের সাক্ষ্য, তিনি নিজের থেকে কিছু বলেন না, যা কিছু বলেন ওহী দ্বারা প্রাপ্ত হয়েই বলেন। ইরশাদ হয়েছে-
وَ مَا یَنْطِقُ عَنِ الْهَوٰی اِنْ هُوَ اِلَّا وَحْیٌ یُّوْحٰی.
এবং সে মনগড়া কথা বলে না। এটা তো ওহী, যা তার প্রতি প্রত্যাদেশ হয়। -সূরা নাজম (৫৩) : ৩-৪
এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে এক হাদীসে ইরশাদ করেন-
أوتيت القرآن ومثله معه.
আমাকে দেওয়া হয়েছে কুরআন এবং কুরআনের অনুরূপ। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৭১৭৪
‘আলকুরআন’ নামের এই বিশেষত্বের কারণ এটাই যে, এর শব্দ ও মর্ম উভয়ই মহান আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এবং উভয়ের সঙ্গেই শরীয়তের বিধান জড়িত। এর শব্দমালার শুধু তিলাওয়াতও মহান আল্লাহ তাআলার শ্রেষ্ঠ যিকির ও ইবাদত হিসেবে গণ্য। এর আয়াত ও সূরা তিলাওয়াত করা সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত তথা নামাযের অপরিহার্য রোকন ও অংশ হওয়া ছাড়াও নামাযের বাইরেও কুরআনে কারীম তিলাওয়াত করা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। এর প্রতিটি হরফ তিলাওয়াতে দশটি করে সওয়াব দানের ঘোষণা করা হয়েছে। সুতরাং কুরআনে কারীম তিলাওয়াত একটি স্বতন্ত্র ইবাদত, ওসিলা ও মাধ্যম নয়। পক্ষান্তরে হাদীসের শব্দমালার শুধু তিলাওয়াত স্বতন্ত্র ইবাদত নয় এবং এর প্রতি হরফ তিলাওয়াতে সওয়াব লাভের ঘোষণাও নেই। যদিও হাদীসের শব্দমালার ভেতরেও রয়েছে নূর ও বরকত (কেননা তা নবীজীর বাণী এবং এর মর্ম ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত)। তবে হাদীসের মূল মাকসাদ হল এর অর্থ ও মর্ম অনুধাবন করা এবং সে অনুসারে আমল করা। এ কারণে আহলে ইলমদের পরিভাষায় ‘আলকুরআন’কে বলা হয়- وحي متلوّ (নামাযে পঠিত ওহী) এবং হাদীসকে বলা হয়-وحي غير متلوّ (নামাযে অপঠিত ওহী)।
কুরআনে কারীম তিলাওয়াত করা বা পাঠ করা যে স্বতন্ত্র আমল এবং কুরআন নাযিলের গুরুত্বপূর্ণ মাকসাদ তা কুরআন মাজীদের একাধিক আয়াতে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে।
যেমন খাতামুন নাবিয়্যীন হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُبِينٍ
তিনিই উম্মীদের মধ্যে একজন রাসূল পাঠিয়েছেন তাদেরই মধ্য থেকে, যে তাদের নিকট পাঠ করে তার আয়াতসমূহ, তাদেরকে পবিত্র করে এবং শিক্ষা দেয় কিতাব ও হিকমত। ইতিপূর্বে তো তারা ঘোর বিভ্রান্তিতে ছিল। -সূরা জুমআ (৬২) : ০২
উক্ত আয়াত থেকে বোঝা যায়, কুরআনে কারীমের আয়াত তিলাওয়াত করে শোনানো নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্বতন্ত্র একটি দায়িত্ব, যেমন আয়াতের অর্থ ও মর্ম এবং আয়াতে বর্ণিত বিধিবিধান শিক্ষাদান করা স্বতন্ত্র একটি দায়িত্ব। কুরআনী হেদায়েত অনুসারে মানুষের জীবনকে পরিশুদ্ধ করা স্বতন্ত্র আরেকটি দায়িত্ব।
এছাড়াও একাধিক আয়াতে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কুরআন তিলাওয়াত করার আদেশ করা হয়েছে। একটি আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّمَا أُمِرْتُ أَنْ أَعْبُدَ رَبَّ هَذِهِ الْبَلْدَةِ الَّذِي حَرَّمَهَا وَلَهُ كُلُّ شَيْءٍ وَأُمِرْتُ أَنْ أَكُونَ مِنَ الْمُسْلِمِينَ وَأَنْ أَتْلُوَ الْقُرْآنَ فَمَنِ اهْتَدَى فَإِنَّمَا يَهْتَدِي لِنَفْسِهِ وَمَنْ ضَلَّ فَقُلْ إِنَّمَا أَنَا مِنَ الْمُنْذِرِينَ .
আমি তো আদিষ্ট হয়েছি এই নগরীর প্রভুর ইবাদত করতে, যিনি একে সম্মানিত করেছেন। সমস্ত কিছু তাঁরই। আমি আরো আদিষ্ট হয়েছি, যেন আমি আত্মসমর্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত হই। আমি আরো আদিষ্ট হয়েছি, কুরআন তিলাওয়াত করতে। অতএব যে ব্যক্তি সৎ পথ অনুসরণ করে, সে নিজের কল্যাণের জন্য সৎ পথ অনুসরণ করে। আর কেউ ভ্রান্তপথ অবলম্বন করলে তুমি বল, আমি তো কেবল সতর্ককারীদের একজন। -সূরা নামল (২৭) : ৯১-৯২
সূরা ফাতিরের ২৯ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّ الَّذِينَ يَتْلُونَ كِتَابَ اللهِ وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَأَنْفَقُوا مِمَّا رَزَقْنَاهُمْ سِرًّا وَعَلَانِيَةً يَرْجُونَ تِجَارَةً لَنْ تَبُورَ ، لِيُوَفِّيَهُمْ أُجُورَهُمْ وَيَزِيدَهُمْ مِنْ فَضْلِهِ إِنَّهُ غَفُورٌ شَكُورٌ .
যারা আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করে, সালাত কায়েম করে, আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে তারাই আশা করে এমন ব্যবসায়ের, যার ধ্বংস নেই। এজন্যই যে, আল্লাহ তাদের কর্মের পূর্ণ প্রতিফল দেবেন এবং তিনি নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে আরো বেশি দেবেন। তিনি ক্ষমাশীল গুণগ্রাহী। -সূরা ফাতির (৩৫) : ২৯-৩০
লক্ষ করুন, উপরোক্ত আয়াতে সালাত কায়েম করা এবং দান-সদকা করার মতো কুরআন তিলাওয়াতও স্বতন্ত্র আমল ও ইবাদত হিসেবে উল্লিখিত হয়েছে এবং এই প্রত্যেক প্রকার আমলের জন্যই সওয়াবের ঘোষণা করা হয়েছে।
এমনিভাবে বহু সংখ্যক হাদীসেও নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন তিলাওয়াতের ফযীলত আলাদাভাবে বর্ণনা করেছেন। এক হাদীসে নবীজী ইরশাদ করেন-
لاَ حَسَدَ إِلّا فِي اثْنَتَيْنِ: رَجُلٌ آتَاهُ اللهُ القُرْآنَ فَهُوَ يَتْلُوهُ آنَاءَ اللّيْلِ وَآنَاءَ النّهَارِ، وَرَجُلٌ آتَاهُ اللهُ مَالًا فَهُوَ يُنْفِقُهُ آنَاءَ اللّيْلِ وَآنَاءَ النّهَارِ.
দুটি জিনিস ছাড়া অন্য কিছুতে হিংসা নেই। যে ব্যক্তিকে আল্লাহ কুরআন দিয়েছেন আর সে দিন-রাত তা তিলাওয়াত করে। আর যে ব্যক্তিকে আল্লাহ সম্পদ দিয়েছেন, আর সে দিন-রাত তা (আল্লাহর পথে) ব্যয় করে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৭৫২৯
মোদ্দাকথা, কুরআন মাজীদ আল্লাহ তাআলার কালাম, মানবরচিত বই-পুস্তকের সাথে এর তুলনা চলে না। মানবরচিত বই-পুস্তকের অর্থটাই আসল, অর্থ না বুঝলে পড়া নিরর্থক। কিন্তু কুরআন মাজীদ আল্লাহ তাআলার সিফাতে কালামের প্রকাশ, অন্য কারও রচনা নয়। এর শব্দ ও অর্থ উভয়টাই উদ্দেশ্য। এর শব্দমালার ভেতরেও রয়েছে নূর ও হেদায়েত, বরকত ও প্রশান্তি এবং হৃদয়ের উদ্ভাস ও উদ্দীপনা।
এটা ভিন্ন কথা যে, পবিত্র কুরআন মাজীদ নাযিলের আসল উদ্দেশ্য, অর্থ ও মর্ম বুঝে সে অনুযায়ী আমল করা, যাকে কুরআনের পরিভাষায় ‘তাদাব্বুর’ (গভীরভাবে চিন্তা করা) ও ‘তাযাক্কুর’ (উপদেশ গ্রহণ করা) এবং ‘ইত্তেবা’ (অনুসরণ করা) বলা হয়। ইরশাদ হয়েছে-
كِتٰبٌ اَنْزَلْنٰهُ اِلَیْكَ مُبٰرَكٌ لِّیَدَّبَّرُوْۤا اٰیٰتِهٖ وَ لِیَتَذَكَّرَ اُولُوا الْاَلْبَابِ.
এটা এক বরকতময় কিতাব, যা আমি আপনার প্রতি এজন্য নাযিল করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহে চিন্তা-ভাবনা করে এবং বোধসম্পন্ন ব্যক্তিগণ উপদেশ গ্রহণ করে। -সূরা সাদ (৩৮) : ২৯
পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
وَ هٰذَا كِتٰبٌ اَنْزَلْنٰهُ مُبٰرَكٌ فَاتَّبِعُوْهُ وَ اتَّقُوْا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُوْنَ.
(এমনিভাবে) এটা এক বরকতপূর্ণ কিতাব, যা আমি নাযিল করেছি। সুতরাং এর অনুসরণ কর ও তাকওয়া অবলম্বন কর, যাতে তোমাদের প্রতি রহমত বর্ষিত হয়। -সূরা আনআম (৬) : ১৫৫
পবিত্র কুরআনে আরো ইরশাদ হয়েছে-
الَّذِیْنَ یَسْتَمِعُوْنَ الْقَوْلَ فَیَتَّبِعُوْنَ اَحْسَنَهٗ اُولٰٓىِٕكَ الَّذِیْنَ هَدٰىهُمُ اللهُ وَ اُولٰٓىِٕكَ هُمْ اُولُوا الْاَلْبَابِ.
যারা কথা শোনে মনোযোগ দিয়ে, অতঃপর তার মধ্যে যা কিছু উত্তম তার অনুসরণ করে তারাই এমন লোক, যাদেরকে আল্লাহ তাআলা হেদায়েত দান করেছেন এবং তারাই বোধশক্তিসম্পন্ন। -সূরা যুমার (৩৯) : ১৮
সূরা যুমার এর ৫৫ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
وَ اتَّبِعُوْۤا اَحْسَنَ مَاۤ اُنْزِلَ اِلَیْكُمْ مِّنْ رَّبِّكُمْ مِّنْ قَبْلِ اَنْ یَّاْتِیَكُمُ الْعَذَابُ بَغْتَةً وَّ اَنْتُمْ لَا تَشْعُرُوْنَ.
(এবং তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে তোমাদের উপর উত্তম যা কিছু অবতীর্ণ করা হয়েছে তার অনুসরণ কর তোমাদের কাছে অতর্কিতভাবে শাস্তি আসার আগে, অথচ তোমরা তা জানতেও পারবে না।)
প্রকাশ থাকে যে, কুরআনের তাদাব্বুর কেবল অর্থ বোঝার নাম নয়। অর্থ তো আরবের কাফের, মুশরিক ও মুনাফিকরাও বুঝত কিন্তু তারা তাদাব্বুর আদৌ করত না। তাদাব্বুরের সত্তাসার হল, উপদেশ গ্রহণের লক্ষে ভক্তি ও ভালবাসা সহকারে চিন্তা ও ধ্যানমগ্নতার সাথে আয়াতসমূহ পাঠ করা, সেইসঙ্গে সতর্ক থাকা, যাতে আল্লাহ তাআলার উদ্দিষ্ট মর্ম বোঝার ক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিগত মেযাজ-মর্জি, ভাবাবেগ ও চিন্তা-চেতনার কিছুমাত্র প্রভাব না পড়ে। ইরশাদ হয়েছে-
اِنَّ فِیْ ذٰلِكَ لَذِكْرٰی لِمَنْ كَانَ لَهٗ قَلْبٌ اَوْ اَلْقَی السَّمْعَ وَ هُوَ شَهِیْدٌ.
নিশ্চয়ই এর ভেতর এমন ব্যক্তিদের জন্য উপদেশ রয়েছে, যার আছে অন্তর, কিংবা যে মনোযোগ দিয়ে কর্ণপাত করে। -সূরা ক্বাফ (৫০) : ৩৭
দুই.
‘আলকুরআন’ নামের শাব্দিক অর্থ বহুল পঠিত বা বহুল পাঠ্য। আর আমরা জানি, পাঠ করা মূলত প্রত্যক্ষভাবে ভাষা ও শব্দের সাথে সংশ্লিষ্ট। সুতরাং নামটি একথা প্রমাণ করে যে, ‘কুরআন’রূপে আল্লাহ তাআলার যে পবিত্র কালাম আমাদেরকে দেওয়া হয়েছে তার ভাষা ও শব্দ সরাসরি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ওহী আকারে নাযিল হয়েছে।
লক্ষ করুন, কুরআনের প্রথম ওহী ছিল-
اِقْرَاْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِیْ خَلَقَ.
পড়ো তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। -সূরা আলাক (৯৬) : ১
তাছাড়া আল্লাহ তাআলা কুরআন তিলাওয়াতের নির্দেশ দিয়েছেন এভাবে-
وَ رَتِّلِ الْقُرْاٰنَ تَرْتِیْلًا.
ধীর-স্থিরভাবে স্পষ্টরূপে কুরআন তিলাওয়াত কর। -সূরা মুযযাম্মিল (৭৩) : ৪
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-
وَ اتْلُ مَاۤ اُوْحِیَ اِلَیْكَ مِنْ كِتَابِ رَبِّكَ .
তোমার কাছে তোমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে যে ওহী পাঠানো হয়েছে তা পড়ে শোনাও। -সূরা কাহ্ফ (১৮) : ২৭
আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে বলেছেন-
لَا تُحَرِّكْ بِهٖ لِسَانَكَ لِتَعْجَلَ بِهٖ ،اِنَّ عَلَیْنَا جَمْعَهٗ وَ قُرْاٰنَهٗ ،فَاِذَا قَرَاْنٰهُ فَاتَّبِعْ قُرْاٰنَهٗ ،ثُمَّ اِنَّ عَلَیْنَا بَیَانَهٗ.
তুমি এ কুরআনকে তাড়াতাড়ি মুখস্থ করার জন্য তোমার জিহ্বা নাড়িও না। নিশ্চয়ই এটা মুখস্থ করানো ও পাঠ করানোর দায়িত্ব আমারই। সুতরাং আমি যখন এটা (জিবরাঈলের মাধ্যমে) পাঠ করি তখন তুমি সেই পাঠের অনুসরণ কর। -সূরা কিয়ামাহ (৭৫) : ১৬-১৮
সূরা আলাকের ৬ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
سَنُقْرِئُكَ فَلَا تَنْسٰۤی.
আমি তোমাকে পাঠ করাব, ফলে তুমি বিস্মৃত হবে না। -সূরা আলাক (৮৭) : ০৬
খেয়াল করুন, উপরোক্ত আয়াতগুলোতে কুরআনের জন্য الإقراء ـ القراءة (পঠন ও পাঠন) التلاوة والترتيل (তারতীলের সাথে তিলাওয়াত করা) تحريك اللسان (জিহ্বা নাড়ানো) শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, উপরোক্ত বিষয়গুলো প্রত্যক্ষভাবে শব্দ ও বাক্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য; শুধু অর্থ ও মর্মের ক্ষেত্রে নয়। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, কুরআনে কারীমের শব্দ ও বাক্য মহান আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ওহীর মাধ্যমে অবতীর্ণ; এর ভাষা ও শব্দে কোনো মাখলুকের হস্তক্ষেপ নেই।
তিন.
‘আলকুরআন’ নামের দাবি হল তা ‘পঠিত’ হবে। আর বাস্তবেও এই মহাগ্রন্থ সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থ। কিয়ামত পর্যন্ত এই গ্রন্থের পঠন-পাঠন চালু থাকবে। হাদীসে বর্ণিত কিয়ামত সংঘটনের বড় বড় আলামতের মধ্যে অন্যতম হল, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের প্রাক্কালে মানুষের অন্তর থেকে এবং কিতাবের পৃষ্ঠা থেকে কুরআনে কারীমকে উঠিয়ে নেবেন। কিন্তু সেই সময় আসার আগ পর্যন্ত কুরআনে কারীমের পঠন-পাঠন জারি থাকবে। আল্লাহ তাআলাই তাঁর কালাম কুরআন মাজীদকে হেফাজত করবেন। তিনি ঘোষণা করেছেন-
إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ.
আমিই কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং অবশ্যই আমিই তার সংরক্ষক। -সূরা হিজর (১৫) : ০৯
ইতিহাস সাক্ষী, কুরআন নাযিলের সময় থেকে আজ অবধি অব্যাহতভাবে কুরআনের পঠন-পাঠন চালু রয়েছে। কুরআন তিলাওয়াত যেহেতু স্বতন্ত্র ইবাদত তাই কুরআন যখন নাযিল হয় তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণ রা. নামাযে ও নামাযের বাইরে; প্রকাশ্যে ও একান্তে স্বতন্ত্র আমল হিসেবে কুরআন তিলাওয়াত করেছেন।
এরপর আজ অবধি বিশ্বের যেখানেই মুসলমান রয়েছেন সেখানেই কুরআন তিলাওয়াতের আমল অব্যাহত রয়েছে। এ এমন এক উজ্জ্বল বাস্তবতা, আধুনিক কালে কুরআন অবিশ্বাসকারী, বস্তুবাদী ও যুক্তিপূজারী কিছু অমুসলিম গবেষক ও পণ্ডিতও একথা স্বীকার করেছেন, ‘কুরআন হল বিশ্বের সর্বাধিক পঠিত কিতাব’। এখানে এ সংক্রান্ত দুটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করছি :২
১। Encyclopedia Britannica-Gi Koran welqK বিষয়ক প্রবন্ধে বলা হয়েছে : ৩
''Since the use of the Koran in public worship, in schools and otherwise, is much more extensive than, for example, the reading of the Bible in most christian countries, it has been truely described as the most widely-read book in existence.'' (The Encyclopedia Britannica; Page 898 vol-xv, Eleventh Edition 1910-1911, Encyclopedia Britannica, Inc. Newyork)
অর্থাৎ যেহেতু মুসলমানদের ইবাদত-বন্দেগীতে আলকুরআনের ব্যবহার ব্যাপক-বিস্তৃত, যতটা না খ্রিস্টান দেশগুলোতে বাইবেলের ব্যবহার। তাই পবিত্র কুরআনকে যথাযথভাবেই বিশ্বের সর্বাধিক পঠিত কিতাব আখ্যা দেওয়া যায়।
২। প্রসিদ্ধ পশ্চিমা ঐতিহাসিক প্রফেসর ফিলিপ কে. হিট্টি (২২ জুন ১৮৮৬-২৪ ডিসেম্বর ১৯৭৮), যিনি আমেরিকার প্রিন্সটন এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন লেবানিজ-আমেরিকান অধ্যাপক ছিলেন, তিনি তার The Arabs : A Short History গ্রন্থে বলেন-
''Although there are approximately twice as many christians as moslems in the world it can safely be said that the Koran is the most widely read book ever written.''- (The Arabs : A Short History; Page: 32, Fourth Edition 1960, MACMILLAN & CO. LTD., LONDON )
অর্থাৎ যদিও মুসলমানদের চেয়ে খ্রিস্টানরা সংখ্যায় প্রায় দ্বিগুণ, তথাপি এ কথা নির্বিঘেœ বলা যায়, আলকুরআন এ যাবতকালের সর্বাধিক ব্যাপক পঠিত গ্রন্থ।
উল্লেখ্য, বিষয়টি এতটাই স্পষ্ট এবং স্বতঃসিদ্ধ, এক্ষেত্রে কারোও উদ্ধৃতি উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। এটা যে স্বীকার করবে সে নিজের ভালো করবে, আর যে অস্বীকার করবে সেটা তার জন্যই ক্ষতিকর।
একটি বিষয়, যা আমাদেরকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, কুরআন মাজীদের বিধানাবলি মানার নিয়ম এই নয় যে, আগে জানতে হবে, এসবের কোন্টি কুরআন মাজীদের কোন্ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে তারপর সেই জ্ঞান অনুসারে তা পালন করা ফরয হবে; বরং ঈমানের পরই আমল শুরু করে দিতে হবে। কুরআনী বিধানাবলির জ্ঞান কুরআনের তাফসীর শিখে অর্জন করা জরুরি না এবং এরূপ জ্ঞানার্জনের উপর হুকুম পালনকে মওকুফ রাখাও জায়েয নয়। সাহাবায়ে কেরাম যে বলেছেন-
تعلمنا الإيمان ثم تعلمنا القرآن فازددنا إيمانا.
‘আমরা আগে ঈমান শিখেছি, তারপর কুরআন শিখেছি, ফলে আমাদের ঈমান বৃদ্ধি পেয়েছে।’ এর অর্থ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে তারা ঈমান, ঈমানের আরকান ও বিধানাবলি সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করেছিলেন। তারা এটাকে কুরআনের তাফসীর শেখার উপর মওকুফ রাখেননি। বস্তুত তাদের সে পন্থাই দ্বীন শেখার স্বভাবসিদ্ধ পন্থা।
পরিশেষে একথাও মনে রাখতে হবে, পবিত্র কুরআনে কারীম পাঠ ও তিলাওয়াতের মতো গুরুত্বপূর্ণ আমলের বহু আদব-কায়দা ও নিয়ম-কানুন রয়েছে। কুরআনে বিশ্বাসী প্রকৃত মুমিনের বৈশিষ্ট্য হল, যথাযথ আদব রক্ষা করে প্রতিদিন কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত করা। তাজবীদের সাথে পড়া, মাখরাজ ও সিফাতের প্রতি লক্ষ রাখা এবং পাঠরীতির অনুসরণ করা তিলাওয়াতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আজকাল এ ব্যাপারে চরম উদাসীনতা লক্ষ করা যায়। কুরআন মাজীদের অর্থ ও তাফসীর বোঝার জন্য তো সময় বের করা হয়, কিন্তু তিলাওয়াত সহীহ করার জন্য মশক করা, কিংবা মশকের জন্য সময় বের করার প্রয়োজন মনে করা হয় না। যেন মানুষের কাছে কুরআনের তিলাওয়াত সহীহ করা অপেক্ষা অর্থ বোঝাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। কুরআনের প্রতি ঈমান আনার পর সর্বপ্রথম কাজ হল অবিলম্বে কুরআনের নিত্যকার ফরযসমূহের উপর আমল শুরু করে দেওয়া এবং সহীহ-শুদ্ধভাবে কুরআন তিলাওয়াত শেখার জন্য মেহনত করা। হ
১. দ্রষ্টব্য : ‘মাকাইসুল লুগাহ’ ৮৫৩; ‘আলমুফরাদাত ফী গারীবিল কুরআন’ পৃ. ৪০২; ‘লিসানুল আরব’ ১/১২৮-১২৯; ‘জামালুল কুররা ওয়া কামালুল ইকরা’ ১/২৩-২৬; লুগাতুল কুরআন, মুহাম্মাদ আবদুর রশীদ নুমানী রাহ., ৫/৮৮
২. উদ্ধৃতিদুটি আল্লামা আব্দুল মাজেদ দরিয়াবাদী রাহ.-এর তাফসীরে মাজেদী-এর সৌজন্যে গৃহীত।
৩. উক্ত প্রবন্ধের লেখক দু’জন :
(এক).Theodor Noldeke. PHD.
(দুই). Friedrich Schwally, Professor of Semitic Philology in the University of Giessen.