কুরআন কারীমের শব্দ, বাক্য, বিষয় ও শৈলী
একটি পরিচিতিমূলক আলোচনা
الحمد لله نحمده ونستعينه ونستغفره ونؤمن به ونتوكل عليه، ونعوذ بالله من شرور أنفسنا ومن سيئات أعمالنا، من يهده الله فلا مضل له، ومن يضلل فلا هادي له، وأشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له، و أشهد أن محمدا عبده و رسوله، أما بعد :
আমরা সবাই কুরআন কারীমের ছাত্র। আমাদের সকলকে কুরআন কারীম থেকে নূর ও আলো গ্রহণ করতে হবে। এ উদ্দেশ্য পূরণের জন্য, কুরআন কারীমের শিক্ষা ও নির্দেশনা ভালোভাবে জেনে বুঝে বাস্তব জীবনে অনুসরণ করার জন্য কুরআন কারীমের চর্চা অব্যাহত রাখা আমাদের কর্তব্য। আমরা যদি একটু একটু করে অগ্রসর হই, গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যদি আমাদের পথচলা অব্যাহত থাকে, তাহলে ইনশাআল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে মানযিলে মাকসূদে পৌঁছার তাওফীক দান করবেন।
কুরআন কারীম আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নিআমত। আমাদের দুনিয়া-আখেরাতের কল্যাণের চাবিকাঠি। আমাদের পার্থিব জীবনের সাফল্য ও সুপথগামিতা আর পারলৌকিক জীবনের মুক্তি ও নাজাতের অনন্য উপায়। আমরা যদি সঠিক পথের দিশা পেতে চাই তাহলে আমাদেরকে কুরআন কারীমের সাথে পরিচিত হতে হবে। কুরআন কারীমকে বুঝতে হবে, কুরআন কারীমের শিক্ষা ও নির্দেশনা সঠিকভাবে উপলব্ধি করে নিজের জীবনে তা বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করতে হবে। এটি অত্যন্ত মুবারক একটি কাজ।
কুরআন কারীম যেহেতু আল্লাহ তাআলার কালাম তাই এর অনেক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এর শব্দ-বাক্যও আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে। এজন্য কুরআন কারীমের শব্দও মুবারক ও বরকতপূর্ণ এবং এর তিলাওয়াতও একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এবং তা বিশুদ্ধভাবে পাঠ করার আদেশও আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে করেছেন। সূরাতুল মুযযাম্মিলের শুরুর আয়াতগুলোতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-
یٰۤاَیُّهَا الْمُزَّمِّلُ، قُمِ الَّیْلَ اِلَّا قَلِیْلًا، نِّصْفَهٗۤ اَوِ انْقُصْ مِنْهُ قَلِیْلًا، اَوْ زِدْ عَلَیْهِ وَ رَتِّلِ الْقُرْاٰنَ تَرْتِیْلًا.
এখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে আল্লাহ তাআলা যে আদেশগুলো করেছেন তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ আদেশ-
وَ رَتِّلِ الْقُرْاٰنَ تَرْتِیْلًا.
তারতীলের সাথে কুরআন তিলাওয়াত করুন।
তারতীল কাকে বলে? হযরত আলী ইবনে আবু তালিব রা. থেকে বর্ণিত-
الترتيل تجويد الحروف ومعرفة الوقوف.
তারতীল হচ্ছে, কুরআন কারীমের বর্ণমালা বিশুদ্ধভাবে উচ্চারণ করা এবং শুরু-শেষ সঠিকভাবে জেনে সে অনুসারে তিলাওয়াত করা। -আত তামহীদ ফী ইলমিত তাজবীদ, পৃ. ৪০
কুরআন কারীমের শব্দেরও অনেক গুরুত্ব। এটা জগতের অন্যান্য বইয়ের মত নয়, যেখানে শব্দ-বাক্যের গুরুত্ব শুধু মর্মের বাহন হিসেবে। কুরআন কারীমের বৈশিষ্ট্য হল, এখানে শব্দ আলাদা গুরুত্ব ও তাৎপর্য রাখে। কুরআনের শব্দের মধ্যেও আছে নূর, বারাকাহ, খাইর ও কল্যাণ। এর সাথে অনেক বিধান সংশ্লিষ্ট। সর্বোপরি ‘তাজবীদুল হুরূফ’ তথা কুরআন কারীমের বর্ণমালাকে বিশুদ্ধভাবে পাঠ করা কুরআনের আদেশ।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ্য় দেখতে পাই, কুরআন মাজীদের বিশুদ্ধ পাঠের বিষয়ে তিনি কত যত্নবান ছিলেন। সহীহ বুখারীতে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন-
كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ أَجْوَدَ النّاسِ، وَكَانَ أَجْوَدُ مَا يَكُونُ فِي رَمَضَانَ حِينَ يَلْقَاهُ جِبْرِيلُ، وَكَانَ يَلْقَاهُ فِي كُلِّ لَيْلَةٍ مِنْ رَمَضَانَ فَيُدَارِسُهُ القُرْآن...
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সবচেয়ে উদার। বিশেষত মাহে রমাযানে যখন হযরত জিবরীল আ. তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন তখন তিনি আরো বেশি উদার ও দানশীল হয়ে যেতেন। হযরত জিবরীল আ. মাহে রমযানের প্রতি রাতে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং তাঁর সাথে কুরআনের ‘মুদারাসা’ করতেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬
অর্থাৎ হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কুরআন পাঠ করে শোনাতেন; আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও হযরত জিবরীল আলাইহিস সালামকে কুরআন পাঠ করে শোনাতেন।
এর বিভিন্ন উদ্দেশ্য ছিল। একটা গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হল, এর মাধ্যমে কুরআন পাঠের পদ্ধতি উপস্থাপিত হয়েছে। এরপর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সাহাবায়ে কেরাম কুরআন পাঠের বিশেষ পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন।
আমরা যদি সাহাবায়ে কেরামের জীবনের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব, কুরআনের শব্দাবলি বিশুদ্ধভাবে পাঠ করার ব্যাপারে তাঁরাও কত যত্নবান ছিলেন। তাঁরা নিজেরাও কুরআনের বিশুদ্ধ তিলাওয়াত শিখেছেন, অন্যদেরও শিখিয়েছেন। কুরআনের বিশুদ্ধ তিলাওয়াত শেখা-শেখানোর এই প্রয়াস শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ে ছিল না; ইসলামী খেলাফত এর ব্যবস্থা করেছে।
হযরত ওমর রা.-এর খেলাফত আমলের একটি ঘটনা। তাঁর কাছে শাম থেকে ইয়াযীদ ইবনে আবু সুফিয়ান রা. বার্তা পাঠালেন যে, আমাদের এখানে অনেক মানুষ ইসলাম কবুল করেছে। এখানে জনসংখ্যাও অনেক। তাদেরকে কুরআন কারীম শেখানো প্রয়োজন। অতএব এ অঞ্চলে এমন কিছু শিক্ষক পাঠিয়ে দিন, যারা সহীহ-শুদ্ধভাবে কুরআন শেখাবেন। ইয়াযীদ ইবনে আবী সুফিয়ান রা. একজন সাহাবী ছিলেন। ফাতহে মক্কার সময় ইসলাম কবুল করেছেন। হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. তাকে শাম অঞ্চলের অভিযানে সেনাপতি করে প্রেরণ করেছিলেন। সে অঞ্চল বিজিত হওয়ার পর তিনি সে অঞ্চলের শাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
ইয়াযীদ ইবনে আবু সুফিয়ান রা. যখন ওমর রা.-এর কাছে এই পত্র পাঠান তখন ওমর রা. আনসারী সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে পাঁচজন বড় সাহাবীর সাথে এ বিষয়ে কথা বললেন এবং প্রস্তাব করলেন, আপনাদের মধ্যে অন্তত তিনজন যদি সেখানে যান তাহলে এই প্রয়োজন পূরণ হতে পারে। হযরত ওমর রা.-এর আদেশক্রমে যে তিনজন সাহাবী শামে গিয়েছিলেন তারা হলেন, হযরত মুআজ ইবনু জাবাল রা., হযরত উবাদা ইবনুস সামিত রা. ও হযরত আবুদ দারদা রা.। ওমর রা. বললেন, আপনারা তিনজন প্রথমে হিমস শহরে যাবেন। সেখানে অবস্থান করে মানুষকে কুরআন শেখাবেন। ছাত্রদের মধ্য থেকে যারা ভালোভাবে কুরআন গ্রহণ করবে, তাদেরকে বাছাই করে শিক্ষক বানিয়ে দেবেন এবং তাদের সাথে অন্যদেরকে যুক্ত করে দেবেন। এভাবে যখন বেশ কিছু মানুষ কুরআন কারীম শিখে ফেলবে তখন আপনাদের মধ্য থেকে একজন হিমসে অবস্থান করবেন আর বাকি দুই জন ফিলিস্তীন ও দিমাশকে চলে যাবেন। -তবাকাত, ইবনে সা‘দ ২/৩৫৬; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, যাহাবী ২/৩৪৪
তাহলে দেখা যাচ্ছে, ওমর রা. সাহাবায়ে কেরামের মধ্য থেকে তিনজন বিজ্ঞ সাহাবীকে শাম অঞ্চলে প্রেরণ করেছেন এবং সেখানের অধিবাসীদের কুরআনে কারীম শেখানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।
এটি একটি দৃষ্টান্ত, যাতে দেখা যাচ্ছে, সাহাবায়ে কেরাম কুরআনের বিশুদ্ধ পঠন-পাঠন এবং কুরআনের শিক্ষা বিস্তারের জন্য কীভাবে নিজ অঞ্চল ছেড়ে অন্য অঞ্চলে গিয়েছেন এবং কুরআনের বিশুদ্ধ পাঠের বিস্তার ঘটিয়েছেন। আমরা যে আজ সাড়ে চৌদ্দ শ বছর পর কুরআনে কারীমের বিশুদ্ধ পাঠ গ্রহণ করতে পারছি- এর পিছনে এক দীর্ঘ কুরবানীর ইতিহাস আছে। সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন এবং প্রত্যেক যুগের মনীষী ব্যক্তিবর্গের ত্যাগ-তিতিক্ষা ও আন্তরিক প্রয়াসের এক উজ্জ্বল ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাসের সাথে পরিচিত হলে বুঝতে পারব, কুরআন কারীমের বিশুদ্ধ পাঠ আমাদের পর্যন্ত এসে পৌঁছার ক্ষেত্রে কত মানুষের, কত মনীষীর ত্যাগ ও কুরবানী রয়েছে।
আরেকটি ছোট্ট ঘটনা থেকেও বোঝা যায়, সাহাবায়ে কেরাম কীভাবে কুরআন শিখিয়েছেন এবং তাদের কাছ থেকে তাদের ছাত্ররা কীভাবে কুরআন কারীমের বিশুদ্ধ পাঠ গ্রহণ করেছেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর নাম আমরা সবাই জানি। তাঁর ঘরটাই ছিল মাদরাসা। এখানে সকাল বেলায় লোকেরা আসতেন। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. তাদেরকে কুরআন কারীম শেখাতেন। কীভাবে শেখাতেন? ইতিহাস ও জীবনী গ্রন্থে আছে, তিনি বলতেন, আবা ফুলান! (অমুকের বাবা!) আপনি কোন্ পর্যন্ত এসেছেন? কোন্ সূরার কোন্ আয়াত পর্যন্ত পৌঁছেছেন?
তিনি বলতেন, অমুক আয়াত পর্যন্ত। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. তাকে পরের আয়াতটি শিখিয়ে দিতেন এবং বলতেন, নিন এটি শিখুন, এই আয়াত আপনার জন্য দুনিয়ার সবকিছু থেকে উত্তম। -আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, বর্ণনা ৮৬৬২; মাযমাউয যাওয়ায়েদ ৭/১৭০
قال الهيثمي : رواه الطبراني ورجاله ثقات.
এভাবে তাঁরা ছাত্রদের উৎসাহিত করেছেন। উৎসাহিত করে কুরআন কারীম শিখিয়েছেন।
একবার হযরত খাব্বাব রা. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার এই যুবক ছাত্ররা কীভাবে কুরআন শিখছে? তারা কি আপনার মতো পড়তে পারে? আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. তার বিশেষ ছাত্র, বিখ্যাত তাবেয়ী আলকামা রাহ.-কে কুরআন কারীম তিলাওয়াত করতে বললেন। তিনি সূরা মারইয়াম থেকে পঞ্চাশ আয়াত তিলাওয়াত করলেন। তখন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বললেন, কেমন দেখলেন?
হযরত খাব্বাব রা. বললেন, ‘কাদ আহসানা’- মাশাআল্লাহ, সুন্দর পড়েছে!
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. মন্তব্য করলেন, আমি যা কিছু জানি, সবকিছু আলকামাকে শিখিয়েছি, আমার জানা সবকিছু সেও জানে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪১৩০
এই ঘটনায় আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, আলকামা রাহ. তার দুইজন বিজ্ঞ উস্তায হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. ও হযরত খাব্বাব রা.-এর সামনে কুরআন কারীমের পাঠ শুনিয়েছেন।
যাই হোক, কুরআন কারীমের বিশুদ্ধ পাঠের ক্ষেত্রে এপর্যন্ত আমরা তিনটি বিষয়ে কিছু নমুনা দেখতে পেলাম।
এক. কুরআন কারীমের আদেশ-
وَ رَتِّلِ الْقُرْاٰنَ تَرْتِیْلًا.
দ্ইু. আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ। রসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে কুরআন কারীমের বিশুদ্ধ পাঠ শিখিয়েছেন।
তিন. সাহাবায়ে কেরামের জীবনব্যাপী সাধনা। অনেক ত্যাগ স্বীকার করে তারা যে শিক্ষার বিস্তার ঘটিয়েছেন তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল কুরআন কারীমের বিশুদ্ধ পাঠ।
আজকাল অনেকেরই এ বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা নেই। ফলে তারা কুরআন কারীমকে আর দশটা গ্রন্থের মত মনে করে থাকেন এবং কুরআন কারীমের বিশুদ্ধ পাঠ শেখার ব্যাপারে অবহেলাও করে থাকেন। এটা উচিত নয়। শরীয়তের দলীল-প্রমাণ- কুরআনে কারীমের আদেশ, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ এবং সাহাবায়ে কেরামের জীবনব্যাপী সাধনার ইতিহাস যদি সামনে থাকে তাহলে বুঝে আসবে যে, কুরআন কারীমের শব্দ-বাক্যও কুরআনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এর বিশুদ্ধ পাঠ শেখা ইসলামী শরীয়তের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিধান।
ইলমুল কিরাআতের বিখ্যাত মনীষী ইমাম ইবনুল জাযারী রাহ. তার কেরাত সংক্রান্ত ছন্দে রচিত গ্রন্থের শুরুর দিকে বলেন-
الأخذ بالتجويد حتم لازم.
তাজবীদ শিক্ষা করা ও সে অনুসারে কুরআন পাঠ করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য আবশ্যক।
من لم يجود القرآن آثم.
যে কুরআন কারীম বিশুদ্ধভাবে পাঠ করবে না সে গুনাহগার হবে।
কারণ-
لأنه به الإله أنزل، وهكذا منه إلينا وصل.
এভাবেই বিশুদ্ধ পাঠ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নাযিল করেছেন আর এভাবেই তা আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে।
কাজেই এটা কুরআনে কারীমের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক।
কুরআন কারীমের অর্থ-মর্ম
দ্বিতীয় দিক হল, কুরআন কারীমের অর্থ ও মর্ম। কুরআন কারীমের অর্থ-মর্ম এবং এসংক্রান্ত শৈলী-উপস্থাপনা সম্পর্কেও এ নিবন্ধে অল্প কিছু আলোচনা করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ। কুরআনের মনোযোগী পাঠক এ বিষয়টি জানেন যে, কুরআন কারীমে আইন, দর্শন, মানবজীবন, প্রকৃতি, পরিবেশ, সৌরজগৎ, জ্যোতির্বিদ্যা এবং এরকমের আরো বহু বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সারগর্ভ ও নিখুঁত তত্ত্ব, তথ্য ও উপস্থাপনা রয়েছে। কিন্তু কুরআন কারীম এসকল বিষয়ের গ্রন্থ নয়। কুরআন কারীম দর্শনের গ্রন্থও নয়, জ্যোতির্বিদ্যার কিতাবও নয়, বিজ্ঞানের বইও নয়, কুরআন কারীম ইতিহাস গ্রন্থও নয়।
কুরআন কারীম আসলে কীসের গ্রন্থ? কুরআন কারীমের মূল পরিচয় কী? কুরআন কারীমের পরিচয় হচ্ছে, কুরআন ‘কিতাবুল হিদায়াহ’-হেদায়েত গ্রন্থ। মানবজাতির হেদায়েতের জন্য আল্লাহ তাআলা এই কালাম নাযিল করেছেন। এতে তাদের পার্থিব জীবনের সুপথগামিতা এবং পারলৌকিক জীবনের মুক্তি ও সাফল্য রয়েছে।
এজন্য এই কিতাবের মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে, সরল পথের নির্দেশনা। আল্লাহ তাআলা এই কিতাবে সরল পথের নির্দেশনা দান করেছেন। কুরআন কারীমের শুরুতে সূরাতুল ফাতিহায় এই দুআ শেখানো হয়েছে-
اِهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِیْمَ.
আমাদেরকে সিরাতে মুস্তাকীমের- সরল পথের সন্ধান দান করুন। এরপর গোটা কুরআন যেন সেই সিরাতে মুস্তাকীমেরই ব্যাখ্যা। এটাই এই কালামের কেন্দ্রীয় ও মৌলিক বিষয়বস্তু। এই বিষয়বস্তুর সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যত বিষয় সংশ্লিষ্ট, সকল বিষয় নিয়ে কুরআন কারীম আলোচনা করে এবং যে বিষয়টা এই কেন্দ্রীয় বিষয়ের যত বেশি কাছের, কুরআন কারীম তত বেশি বিস্তারিতভাবে এবং তত বেশি গুরুত্বের সাথে সে সম্পর্কে আলোচনা করেছে।
খুব ছোট্ট একটি দৃষ্টান্তের মাধ্যমে আমরা বিষয়টি বুঝতে পারি। দেখুন, কুরআন কারীম মানুষের সূচনা ও পরিণাম দুই বিষয়েই আলোচনা করেছে। মানুষ কোত্থেকে এল, কীভাবে এল, কীভাবে সে সৃজিত হল- এই বিষয় নিয়েও কুরআন কারীম আলোচনা করে। আবার অবশেষে মানুষের কী হবে, সে কোথায় যাবে- এ সম্পর্কেও কুরআন আলোচনা করে। মানুষের ভালো পরিণাম কী, মন্দ পরিণাম কী, ভালো পরিণামের পথ কোন্টি ও মন্দ পরিণামের পথ কোন্টি, মানুষের বর্তমান জীবন কীভাবে অতিবাহিত হলে তার পরিণাম শুভ হবে আর বর্তমান জীবন কীভাবে অতিবাহিত হলে তার পরিণাম অশুভ হবে- এই বিষয়গুলোও কুরআন কারীম আলোচনা করে। তাহলে আমরা বলতে পারি যে, কুরআন কারীম মানুষের সূচনা সম্পর্কেও আলোচনা করে, পরিণাম সম্পর্কেও আলোচনা করে। কিন্তু আপনি যদি কুরআন কারীম পাঠ করেন, তাহলে দেখতে পাবেন, মানুষের সূচনা সম্পর্কে কুরআনের আলোচনা খুবই সংক্ষিপ্ত। যদিও সে আলোচনা অত্যন্ত নিখুঁত, অত্যন্ত সারগর্ভ ও সর্বজনবোধ্য। অন্যদিকে মানুষের পরিণাম সম্পর্কে এবং এই পরিণামের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো সম্পর্কে কুরআনের আলোচনা সুবিস্তৃত। এই পার্থক্য কেন? আমরা যদি চিন্তা করি, তাহলে বুঝতে পারব, এই পার্থক্যটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
মানুষের সূচনা তিার ইখতিয়ারাধীন নয়। মানুষ যখন সৃষ্টি হচ্ছে তখন সে জানেও না যে, সে সৃষ্টি হচ্ছে। তার দেহের রং, দৈহিক গঠন, কোন্ পরিবারে বা কোন্ গোত্রে সে আসবে এর কোনোটাই মানুষের ইখতিয়ারাধীন নয়, ইচ্ছাধীন নয়। কিন্তু মানুষের ভবিষ্যত তার ইখতিয়ারাধীন। আল্লাহ তাআলা মানুষকে তার ভবিষ্যত নির্মাণের এক প্রকারের সক্ষমতা দান করেছেন। মানুষ আল্লাহর ইচ্ছায় তার ভবিষ্যত নির্মাণ করতে পারে। কিন্তু ইচ্ছা করলেই সে তার অতীত নির্মাণ করতে পারবে না। এটুকু করতে পারবে যে, অতীতে যদি সময় নষ্ট হয়ে থাকে বা কম গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যয় হয়ে থাকে সেটার জন্য অনুতাপ করতে পারবে, তওবা-ইস্তিগফার করতে পারবে।
এটুকুও হতে পারে যে, সেখান থেকে সামনের জীবনের জন্য শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে; কিন্তু যে অতীত গত হয়েছে তা নতুন করে নির্মাণ করতে পারবে না। আল্লাহর আদেশে মানুষ যেটা নির্মাণ করতে পারে সেটা হচ্ছে তার ভবিষ্যত। কাজেই যে গ্রন্থ মানুষের পথনির্দেশের জন্য তাতে মানুষের ভবিষ্যত সম্পর্কেই পথনির্দেশ আসা উচিত। মানুষের অতীত সম্পর্কে ঐটুকু আলোচনাই যথার্থ, যেটুকু আলোচনা তার ভবিষ্যত নির্মাণের পক্ষে সহায়ক হবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে বোঝা যাবে যে, কুরআনে কারীমে মানুষের সূচনা সম্পর্কে সুসংক্ষিপ্ত আলোচনা আর মানুষের পরিণাম সম্পর্কে সুবিস্তৃত আলোচনা কত যথার্থ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কুরআন কারীম মানুষকে যে পথনির্দেশ দান করে, সেই নির্দেশনার মৌলিক বিভাগগুলো কী? আলেমগণ বিভিন্নভাবে কুরআন কারীমের এই বিষয়বস্তু আলোচনা করেছেন। সহজ-সরল ভাষায় আমরা কুরআন কারীমের মৌলিক বিষয়বস্তুকে পাঁচ ভাগে ভাগ করতে পারি। আকাইদ, আহকাম, আখলাক, কাসাস, মাওত ওয়া মা-বা‘দাল মাওত। আকাইদ অর্থ বিশ্বাস, আকীদা-বিশ্বাস। আহকাম অর্থ বিধি-বিধান। আখলাক অর্থ স্বভাব-চরিত্র, আচার-আচরণ। কাসাস অর্থ বৃত্তান্ত এবং মাওত ওয়া মা-বা‘দাল মাওত অর্থ মৃত্যু ও মৃত্যুপরবর্তী জীবন।
আকাইদ
কুরআনে কারীমের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আকাইদ। কুরআন কারীম মানুষকে তার নিজ সত্তা সম্পর্কে, তার ¯্রষ্টা আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে, আল্লাহ তাআলার সিফাত ও গুণাবলি সম্পর্কে, তার চারপাশের প্রকৃতি সম্পর্কে, তার পরিণাম সম্পর্কে এবং দৃশ্য-অদৃশ্য জগৎ সম্পর্কে সত্য ও যথার্থ সংবাদ দান করে। এই সংবাদই হচ্ছে আকাইদ-মানুষের বিশ্বাস্য বিষয়।
আকাইদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা সঠিক হওয়া, যথার্থ হওয়া খুবই প্রয়োজন। মানুষের জীবনের গতিপথ নির্ধারিত হওয়ার ক্ষেত্রে আকীদার গুরুত্ব অপরিসীম।
আমরা সবাই জানি যে, মানুষের স্বভাব-প্রকৃতিতে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে, কিংবা বলুন, তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি রয়েছে; যে শক্তিগুলো দ্বারা মানুষ চালিত হয়, পরিচালিত হয়। প্রথমত তার চিন্তা-ভাবনা, যেটার কেন্দ্র মস্তিষ্ক। দ্বিতীয়ত আবেগ-অনুভূতি, যার কেন্দ্র হৃদয়। আর তৃতীয়ত কর্মশক্তি, যা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। তো চিন্তা-ভাবনা, আবেগ-অনুভূতি এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কর্ম- এই তিনটি বিষয়ের মধ্যে পরিচালকের স্থানে যে বিষয়টি রয়েছে তা হচ্ছে মানুষের চিন্তা-ভাবনা-আবেগ-অনুভূতি। মানুষের চিন্তা, ভাবনা ও আবেগ-অনুভূতির দ্বারা তার কাজকর্ম নিয়ন্ত্রিত হয়, কাজকর্মের গতিপথ নির্ধারিত হয়। সুতরাং মানুষের চিন্তা-ভাবনা, বিশ্বাস ও আবেগ সঠিক পথে পরিচালিত হলে তার গোটা জীবন নিয়ন্ত্রিত হবে এবং সঠিক পথে পরিচালিত হবে। এজন্য কুরআন কারীম খুবই গুরুত্বের সাথে মানুষকে সঠিক আকীদা জানিয়ে দিয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কুরআন কারীম এই সত্য ও বাস্তবতাকে বা আকীদাসমূহকে কীভাবে উপস্থাপন করে?
মৌলিক তিনভাবে তা উপস্থাপিত হয়েছে।
প্রথমত : কুরআন কারীম সঠিক আকীদা খুবই সহজবোধ্য, দ্ব্যর্থহীন ও পরিষ্কার ভাষায় বর্ণনা করেছে। নমুনা হিসেবে আয়াতুল কুরসী দেখুন। আল্লাহ তাআলা আয়াতুল কুরসীতে তাঁর পরিচয় দান করেছেন। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আকীদা- তাওহীদের আকীদা বয়ান করেছেন। ইরশাদ হয়েছে-
اَللهُ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ.
আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই।
এটি একটি আকীদা। এখানে খুবই পরিষ্কারভাবে সর্বজনবোধ্য ভাষায় জানানো হয়েছে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই।
সূরাতুল ইখলাস পাঠ করুন-
قُلْ هُوَ اللهُ اَحَدٌ،اَللهُ الصَّمَدُ، لَمْ یَلِدْ وَ لَمْ یُوْلَدْ، وَ لَمْ یَكُنْ لَّهٗ كُفُوًا اَحَدٌ.
এখানে পরিষ্কার ভাষায় আল্লাহ তাআলার তাওহীদ ও তাঁর পরিচয় জানানো হয়েছে।
এভাবে কুরআন কারীমের বহু আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সঠিক আকীদাগুলো খুবই পরিষ্কার ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উল্লেখ করে দিয়েছেন।
এটা হল প্রথম পদ্ধতি। দ্বিতীয় পদ্ধতি হচ্ছে, কুরআন কারীম শুধু আকীদার সঠিক বিষয়গুলোই বয়ান করেনি; বরং সে বিষয়গুলোর যুক্তি, প্রমাণ, দলীলও উপস্থাপন করেছে। আয়াতুল কুরসির নমুনাতে আমরা আবার ফিরে আসতে পারি। আয়াতুল কুরসির প্রথম বাক্যটি হচ্ছে-
اَللهُ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ
এটি আকীদা। এর পরে আল্লাহ তাআলার সিফাত ও গুণাবলি বর্ণিত হয়েছে-
اَلْحَیُّ الْقَیُّوْمُ لَا تَاْخُذُهٗ سِنَةٌ وَّ لَا نَوْمٌ...
(আয়াতের শেষ পর্যন্ত।) এই গুণাবলিই প্রমাণ করে যে, তিনিই সেই সত্তা, যিনি সত্য মা‘বুদ। তিনি ছাড়া আর কোনো মা‘বুদ হতে পারে না। এভাবে কুরআন কারীম অত্যন্ত যৌক্তিক ও হৃদয়গ্রাহী ভাষায়, মানুষের হৃদয়, মস্তিষ্ক, আবেগ-অনুভূতি এইসকল বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ পন্থায় আকীদা ও এর দলীলগুলো উপস্থাপন করেছে। আপনি যখন কুরআন কারীম পাঠ করতে থাকবেন কুরআন কারীমের সূরায় সূরায় আয়াতে আয়াতে এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারবেন। এটি হচ্ছে দ্বিতীয় পদ্ধতি।
তৃতীয় পদ্ধতি হচ্ছে, কুরআন কারীম শুধু সহীহ আকীদা ও সহীহ আকীদার দলীল- এইটুকুই উল্লেখ করে না; বরং সঠিক আকীদার ক্ষেত্রে মানুষ যেসকল বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে ঐসকল বিভ্রান্তিকেও অত্যন্ত সহজ ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় খণ্ডন করে। যে-ই কুরআন পড়বে সে-ই বিষয়টি বুঝতে পারবে। আমি শুধু শিরোনামগুলো উল্লেখ করছি। প্রত্যেক বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা অন্য কোনো অবসরে করা যেতে পারে।
সারকথা এই যে, কুরআন কারীম আকীদাকে তিনভাবে উপস্থাপন করেছে :
এক. সহজ-সরল স্পষ্ট ভাষায় আকীদার উল্লেখ, উপস্থাপনা।
দুই. অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী ভাষায় সেই আকীদার যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপনা।
তিন. সহীহ আকীদার ক্ষেত্রে মানুষ যেসকল বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে সেসবের খণ্ডন। কুরআনে কারীম খুবই সহজ সহজ ছোট ছোট বাক্যে ঐসকল বিভ্রান্তি খণ্ডন করে দিয়েছে।
এই হচ্ছে কুরআন কারীমের শৈলী। আকীদার ক্ষেত্রে কুরআনে কারীমের উপস্থাপনা।
এখন যে প্রসঙ্গটি আলোচনা করে অন্য প্রসঙ্গে যাব সেটি হচ্ছে, কুরআন কারীমে আকীদার মৌলিক বিষয়গুলো কী। আমাদের আলিমগণ বলেন, কুরআন কারীম মৌলিক নয়টি বিষয় আলোচনা করে। যে নয় বিষয়ের মধ্যে সকল আকীদা এসে যায়। ছয়টি বিষয় হচ্ছে, যা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিখ্যাত হাদীসে, যা হাদীসে জিবরীল নামে পরিচিত, তাতে উল্লেখিত হয়েছে। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈমানের পরিচয় দান করেছেন এভাবে-
أَنْ تُؤْمِنَ بِاللهِ، وَمَلَائِكَتِهِ، وَكُتُبِهِ، وَرُسُلِهِ، وَالْيَوْمِ الْآخِرِ، وَتُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ.
ঈমান এই যে, তুমি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে, ফিরিশতাগণের প্রতি ঈমান আনবে, আল্লাহর রাসূলগণের প্রতি ঈমান আনবে, তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান আনবে, ইয়াওমে আখির-শেষ দিবসের প্রতি ঈমান আনবে এবং ঈমান আনবে তাকদীরের উপর, তাকদীরের ভালো-মন্দ উভয়টার উপর। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮
এই ছয় বিষয় হল আকীদার ছয় রুকন। যে ছয় রুকনের বিস্তারিত বিবরণ এবং যে শৈলীর কথা বললাম, এই শৈলীতে কুরআন কারীমের আয়াতে আয়াতে উল্লেখিত হয়েছে।
সপ্তম বিষয় হচ্ছে, মানুষের সূচনা ও পরিণাম। এ সম্পর্কে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে মানুষকে জানানো হয়েছে।
অষ্টম বিষয়টি হচ্ছে, মানুষের চার পাশের দৃশ্যমান জগৎ। মানুষ যা দেখে, তার চারপাশের এই ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য জগৎ সম্পর্কে, এই জগতের স্রষ্টা সম্পর্কে, এই জগতের সূচনা ও সমাপ্তি সম্পর্কে এবং এই জগতের পরিচালনা সম্পর্কে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় মানুষকে জানানো হয়েছে।
আর নবম বিষয়টি হচ্ছে, মানুষের চার পাশের অদৃশ্য জগৎ। আল্লাহ তাআলার এমন অনেক সৃষ্টি রয়েছে, যা মানুষের ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য নয়। যেমন, জিনজগৎ, শয়তানজগৎ। এগুলো মানুষের ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য নয়। মানুষের দৃষ্টির বাইরে। কিন্তু কুরআন কারীম এদের সম্পর্কে সঠিক আকীদা ও প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে।
এই হচ্ছে আকীদার মৌলিক নয়টি বিষয়। এই নয় বিষয়ের মধ্যে অনেক শাখা বিষয় আছে, যেগুলো কুরআন কারীমে উল্লেখিত হয়েছে এবং যেগুলোর বিস্তারিত বিবরণ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীস শরীফে জানিয়েছেন।
আহকাম
কুরআন কারীমের মৌলিক পাঁচ বিষয়ের দ্বিতীয়টি হচ্ছে, আহকাম। আহকাম অর্থ বিধি-বিধান। মানুষের জীবন যেন সুন্দর হয় এজন্য আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে বিধি-বিধান দান করেছেন। সেই বিধি-বিধানকে মৌলিক দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এক. আহকামুল ইবাদাত, আর দুই. আহকামুল মুআমালাত। আহকামুল ইবাদাত অর্থ ইবাদত-সংক্রান্ত বিধিবিধান। অর্থাৎ বান্দা ও আল্লাহর মাঝে যে সম্পর্ক, সে সম্পর্কের হক আদায়ের জন্য বান্দার উপর যে দায়িত্ব বর্তায় তার মধ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের শিরোনাম হচ্ছে ইবাদত। সেই ইবাদত সংক্রান্ত আহকাম কুরআনে কারীমে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। যেমন, সালাত, যাকাত, সওম, হজ্ব, যিকির, তিলাওয়াত, ইতিকাফ এবং এ ধরনের বিভিন্ন ইবাদতমূলক কাজের বিধি-বিধান কুরআন কারীমে উল্লেখিত হয়েছে।
দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, আহকামুল মুআমালাত। মুআমালাত আরবী শব্দ। এর পরিধি অনেক বিস্তৃত। এর মধ্যে যেমন মানুষের পারস্পরিক লেনদেন, আর্থিক কাজকর্ম এবং সেই কাজকর্ম সংক্রান্ত বিধি-বিধান রয়েছে, তেমনি মানুষের পরস্পরের সম্পর্ক, আচার-ব্যবহার, অধিকার ও কর্তব্য ইত্যাদি সংক্রান্ত বিধি-বিধানও রয়েছে। কুরআন কারীমে মুআমালাত তথা লেনদেন ও মানুষের পারস্পরিক কাজকর্ম সংক্রান্ত যে বিধি-বিধান বর্ণিত হয়েছে, সেগুলোকে যদি কিছুটা আধুনিক পরিভাষায় বা আধুনিক বিন্যাসে বিন্যস্ত করা হয় তাহলে বেশ কিছু মৌলিক শিরোনাম আমাদের সামনে আসবে। কুরআন কারীমে এই মৌলিক শিরোনামের প্রত্যেকটির উপরই সরাসরি আয়াত রয়েছে, যে আয়াতগুলো ঐসকল বিষয়ের মৌলিক নীতি বা মৌলিক বিধানের মর্যাদা রাখে।
এই মৌলিক নীতি ও বিধানের বিস্তারিত ব্যাখ্যা হাদীস ও সীরাতে বর্ণিত হয়েছে। এরপর ফিকহে ইসলামীতে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে তা সংকলিত হয়েছে। আমি শুধু শিরোনামগুলো উল্লেখ করে দিচ্ছি। মিশরের একজন মনীষী ডক্টর আব্দুল ওয়াহ্হাব খাল্লাফ রাহ. علم أصول الفقه শীর্ষক তাঁর একটি গ্রন্থে এভাবে বিষয়টিকে শিরোনামবদ্ধ করেছেন।
প্রথম বিষয় হল-
أحكام الأحوال الشخصية.
অর্থাৎ মানুষের পারিবারিক জীবনের বিধি-বিধান। পরিবার গঠন এবং বংশ ও পরিবার সংক্রান্ত বিধি-বিধান। আমাদের বর্তমান সময়ের পরিভাষায় বিষয়টি ‘পারিবারিক আইন’ নামে পরিচিত। এই বিষয়ে কুরআন কারীমে প্রায় সত্তরটি আয়াত রয়েছে। যে আয়াতগুলোতে এই বিষয়ে মৌলিক নির্দেশনা ও মৌলিক বিধান দান করা হয়েছে।
দ্বিতীয় বিষয় হল-
الأحكام المدنية.
অর্থাৎ সমাজ ও রাষ্ট্রে বসবাসরত মানুষের পারস্পরিক লেনদেন, চুক্তি, অঙ্গিকার, পারস্পরিক কাজকর্ম সংক্রান্ত বিধি-বিধান। এ বিষয়েও কুরআন কারীমে সত্তরটি বা এর কাছাকাছি সংখ্যক আয়াত রয়েছে।
তৃতীয় ভাগ-
الأحكام الجنائية.
অর্থাৎ অপরাধ ও দ- সংক্রান্ত বিধি-বিধান। কুরআন কারীমে এসংক্রান্ত অনেকগুলো আয়াত এসেছে, যা এই বিষয়ে মৌলিক বিধান এবং মৌলিক নির্দেশনা প্রদান করে।
চতুর্থ বিষয় হল-
أحكام المرافعات.
অর্থাৎ বিচার ও বিচার-প্রক্রিয়া সংক্রান্ত বিধি-বিধান। এ বিষয়েও কুরআন কারীমে অত্যন্ত মৌলিক ও সারগর্ভ দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
পঞ্চম বিষয় হল-
الأحكام الدستورية.
অর্থাৎ শাসন ও রাষ্ট্র পরিচালনা সংক্রান্ত নীতি ও বিধান। শাসক-শাসিতের মধ্যকার সম্পর্ক, সেই সম্পর্কের দাবি এবং সেই সম্পর্কের দায়-দায়িত্ব, কর্তব্য, অধিকার সম্পর্কে কুরআন কারীমে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নীতি ও বিধান দান করা হয়েছে।
ষষ্ঠ বিষয়টি হল-
الأحكام الدولية.
আন্তরাষ্ট্রীয় বিধি-বিধান। এ সম্পর্কেও কুরআন অত্যন্ত মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা ও বিধি-বিধান দান করেছে। মুসলিম রাষ্ট্রের সাথে অন্য রাষ্ট্রের সম্পর্ক কেমন হবে? শান্তি ও যুদ্ধ উভয় অবস্থায় সম্পর্কের স্বরূপ কী হবে এবং এ সম্পর্কের দায়-দায়িত্ব, কর্তব্য, অধিকার কী হবে? একইসাথে মুসলিম রাষ্ট্রে বসবাসরত অমুসলিমদের কতর্ব্য ও অধিকার, তাদের সাথে আচরণগত বিভিন্ন বিধান কুরআনে কারীমে উল্লেখিত হয়েছে, যা উপরোক্ত শিরোনামে আমাদের মনীষীগণ আলোচনা করেছেন।
আর সপ্তম বিষয়টি হল-
الأحكام الاقتصادية والمالية.
অর্থাৎ সমাজে বিত্তশালী ও বিত্তহীন ব্যক্তিবর্গের পারস্পরিক সম্পর্ক ও দায়-দায়িত্ব কীভাবে সুবিন্যস্ত হবে, বিত্তশালীর সম্পদে আল্লাহ তাআলা বিত্তহীনের জন্য যে অধিকার দান করেছেন সে অধিকার কীভাবে তারা পাবে। সমাজে সম্পদের সুষম বণ্টন কীভাবে হবে- এসব বিষয়ে কুরআন কারীম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নীতি ও বিধান দান করে।
সারকথা, আহকামুল মুআমালাত তথা মানুষের পারস্পরিক কাজকর্ম সংক্রান্ত বিধি-বিধানের মৌলিক শিরোনামগুলো যদি এভাবে চিন্তা করা হয় তাহলে আমরা বুঝতে পারব যে, মানবজীবনের সকল অঙ্গনের জন্যই কুরআন কারীম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নীতি ও বিধান দান করেছে।
এটা হচ্ছে শুধু আহকাম অংশটির কাঠামো সম্পর্কে কিছু কথা; এবার আহকাম বা বিধি-বিধানগুলো কুরআন কারীম কীভাবে উপস্থাপন করে- এ সম্পর্কে শুধু একটি কথা বলে আমি পরবর্তী প্রসঙ্গে যাব ইনশাআল্লাহ।
কুরআন কারীম আহকামকে আকাইদের সাথে সংযুক্ত করে। মানুষের কর্ম ও জীবন সংক্রান্ত যে বিধি-বিধান কুরআন কারীম দান করে তা আইনের ধারা বর্ণনার মতো করে শুষ্ক ভাষায় বর্ণনা করে না; বরং কুরআন কারীম এই বিষয়টাকে ঈমানের সাথে, আকাইদের সাথে, মানুষের পরিণামের শুভ-অশুভের সাথে সংযুক্ত করে উপস্থাপন করে; যার কারণে মানুষ তার ভেতরের প্রেরণা থেকে এই বিধানগুলো পালন করার তাড়না বোধ করে। এটা কুরআন কারীমের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য, যে বৈশিষ্ট্য অন্য কোনো মতবাদ বা অন্য কোনো ব্যবস্থার মধ্যে পাওয়া যাবে না।
আখলাক
কুরআন কারীমের তৃতীয় মৌলিক বিষয় হচ্ছে আখলাক। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কুরআন কারীমের বহু আয়াতে মানুষের স্বভাব-চরিত্র ও আচার-আচরণের পরিশীলন সংক্রান্ত নীতি-নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আমি শুধু একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করব। আমাদের উপমহাদেশের একজন বিখ্যাত মনীষী হযরত মাওলানা মনযূর নুমানী রাহ.। তাঁর একটি অনবদ্য গ্রন্থ ‘কুরআন আপ সে কিয়া কেহতা হ্যায়?’ (কুরআন আপনাকে কী বলে?) সেই গ্রন্থে ‘হুসনে আখলাক’ শিরোনামে তিনি বলেন, ‘উত্তম স্বভাব-চরিত্রের দাওয়াত ও তালীমও কুরআন মাজীদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিস্তৃত ও একান্ত একটি বিষয়। স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে কুরআন মাজীদের শিক্ষা এত পূর্ণাঙ্গ, বিস্তৃত, ভারসাম্যপূর্ণ ও মানবস্বভাবের সাথে এত সামঞ্জস্যপূর্ণ যে, মানুষ যদি এ শিক্ষার অনুসরণ করে এবং নিজের কর্ম ও স্বভাবকে কুরআন মাজীদের চারিত্রিক শিক্ষা-নির্দেশনার অনুগত করে ফেলে, তাহলে সে এই পৃথিবীতে মানবরূপী ফিরিশতায় পরিণত হবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কুরআন কারীম এই স্বভাব-চরিত্র ও আচার-আচরণগত শিক্ষা ও নির্দেশনা কীভাবে উপস্থাপন করেছে? লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এক্ষেত্রেও কুরআন কারীমের নির্দেশনা অত্যন্ত স্পষ্ট। কুরআন কারীম মৌলিক ভালো স্বভাবগুলোকে চিহ্নিত করে সেগুলোর প্রতি উৎসাহিত করেছে। মৌলিক মন্দ স্বভাবগুলো চিহ্নিত করে তা বর্জনের আদেশ করেছে। আর বিভিন্ন আয়াতে এমন দ্ব্যর্থহীন ও সহজবোধ্য দৃষ্টান্ত ও মানদ- উপস্থাপন করেছে, যে মানদ-ের মাধ্যমে মানুষ তার প্রাত্যহিক জীবনে ভালো-মন্দ আচরণ, ভালো-মন্দ স্বভাব ও তার দাবি খুব সহজেই উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে।
দ্বিতীয়ত, কুরআন কারীমের আদব আখলাক সংক্রান্ত বিধানগুলোও আকীদার সাথে যুক্ত। তাই এটা শুধু মানুষের বাহ্যিক সৌজন্য বা নিছক ভদ্রতা প্রদর্শনমূলক বিষয় নয়; বরং তা মানুষের উত্তম পরিণামের জন্য অপরিহার্য একটি বিষয়।
মানুষ যদি শুভ পরিণামের অধিকারী হতে চায় তাহলে অবশ্যই তাকে উত্তম স্বভাবের অধিকারী হতে হবে। উত্তম আদব-আখলাক রপ্ত করতে হবে। মানুষ যদি সত্যিকার ধার্মিক হতে চায়, আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জন করতে চায়, তাহলে তাকে উত্তম স্বভাবের অধিকারী হতে হবে এবং কুরআনী আদব-আখলাক অনুসরণ করতে হবে।
সারকথা হচ্ছে, কুরআন কারীম আখলাকের বিষয়টাকে আকীদার সাথে এবং মানুষের শুভ পরিণামের সাথে সংযুক্ত করে উপস্থাপন করেছে। এজন্য কুরআনের প্রকৃত অনুসারী। সবক্ষেত্রে কুরআনের স্বভাব-চরিত্রগত বিধি বিধান মেনে চলবেন। যেখানে তার স্বার্থ আছে সেখানেও মেনে চলবেন, যেখানে স্বার্থ নেই সেখানেও মেনে চলবেন। যেখানে মানুষ দেখছে সেখানেও তিনি ভদ্রতা রক্ষা করবেন শালীন, যেখানে দেখছে না সেখানেও ভদ্রতা রক্ষা করবেন শালীন। এটা কুরআন কারীমের আদব-আখলাক সংক্রান্ত শিক্ষা ও নির্দেশনার এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
কুরআন কারীমে আদব-আখলাক উপস্থাপনের হৃদয়গ্রাহী দৃষ্টান্ত হচ্ছে, কুরআন বিভিন্ন পরিচিত শিরোনামের উন্নত ব্যক্তিত্বের রূপরেখা বর্ণনা করেছে। যেমন মনে করুন আমরা সবাই মুমিন। মুমিন বিশেষণটির সাথে আমরা সবাই পরিচিত। কিন্তু এই বিশেষণের অধিকারী ব্যক্তির কাম্য গুণ ও বৈশিষ্ট্যগুলোর সাথেও কি আমরা পরিচিত? কুরআন কারীম ‘আলমুমিনূন’ শিরোনামে তাদের ব্যক্তিত্বের রূপরেখা ও গুণাবলি আলোচনা করেছে। আপনারা নিজেরা পড়ে নিতে পারেন। আমি কিছু উদ্ধৃতি দিয়ে দিচ্ছি : সূরাতুল আনফাল (৮) : ২-৪। সূরাতুত তাওবা : (৯) ৭১। সূরাতুল মুমিনূন (২৩) : ১-১১।
আপনি যখন কুরআন পড়বেন তখন নিজেকে বিচার করতে পারবেন, আমি কেমন মুমিন আর কুরআন কারীমে কেমন মুমিনের কথা বলা হয়েছে।
এরকম দেখুন আমাদের অতি পরিচিত একটি শব্দ ‘মুসল্লি’ অর্থাৎ নামায আদায়কারী। কিন্তু সত্যিকারের মুসল্লি কে, কী তার ব্যক্তিত্বের কাঠামো, কী তার গুণাবলি, কেমন তার আদব-আখলাক- এ বিষয়গুলো কুরআন কারীম জানিয়েছে-
اِلَّا الْمُصَلِّیْنَ ،الَّذِیْنَ هُمْ عَلٰی صَلَاتِهِمْ دَآىِٕمُوْنَ...
সূরাতুল মাআরিজের বাইশ থেকে পঁয়ত্রিশ নাম্বার পর্যন্ত আয়াতগুলো পাঠ করুন। সেখানে মুসল্লির ব্যক্তিত্বের রূপরেখা পেয়ে যাবেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কত সহজবোধ্য ভাষায় তা উল্লেখ করেছেন।
সূরাতুল ফুরকানে আরেকটি শিরোনাম এসেছে- ‘ইবাদুর রহমান’। ইবাদুর রহমান মানে রহমানের বান্দাগণ। ‘আল্লাহ পাকের নেক বান্দা’ কথাটা আমাদের কাছে পরিচিত, কিন্তু কাকে বলে নেক বান্দা, কী তার বৈশিষ্ট্য- এটি কুরআন কারীমের এই আয়াতগুলোতে উল্লেখিত হয়েছে-
وَ عِبَادُ الرَّحْمٰنِ الَّذِیْنَ یَمْشُوْنَ عَلَی الْاَرْضِ هَوْنًا...
(তরজমা) রহমানের বান্দা তারা, যারা ভূমিতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং অজ্ঞ লোক যখন তাদেরকে লক্ষ্য করে (অজ্ঞতাসুলভ) কথা বলে, তখন তারা শান্তিপূর্ণ কথা বলে। এবং যারা রাত অতিবাহিত করে নিজ প্রতিপালকের সামনে (কখনও) সিজদারত অবস্থায় এবং (কখনও) দণ্ডায়মান অবস্থায়। এবং যারা বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! জাহান্নামের আযাব আমাদের থেকে দূরে রাখুন। ...এবং যারা ব্যয় করার সময় না করে অপব্যয় এবং না করে কার্পণ্য; বরং তা হয় উভয়ের মাঝখানে ভারসাম্যমান। এবং যারা আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোনও মাবুদের ইবাদত করে না এবং আল্লাহ যে প্রাণকে মর্যাদা দান করেছেন, তাকে অন্যায়ভাবে বধ করে না এবং তারা ব্যভিচার করে না। ... এবং যারা অন্যায় কাজে শামিল হয় না এবং যখন কোনও বেহুদা কার্যকলাপের নিকট দিয়ে যায়, তখন আত্মসম্মান বাঁচিয়ে যায়। এবং যখন তাদের প্রতিপালকের আয়াত দ্বারা তাদেরকে উপদেশ দেওয়া হয় তখন তারা বধির ও অন্ধরূপে তার উপর পতিত হয় না। এবং যারা (এই) বলে (দুআ করে যে), হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে আমাদের স্ত্রী ও সন্তানদের পক্ষ হতে দান কর নয়নপ্রীতি এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের নেতা বানাও। এরাই তারা, যাদেরকে তাদের সবরের প্রতিদানে জান্নাতের সুউচ্চ প্রাসাদ দেওয়া হবে এবং সেখানে শুভেচ্ছা ও সালামের সাথে তাদের অভ্যর্থনা করা হবে। তারা তাতে স্থায়ী জীবন লাভ করবে। অবস্থানস্থল ও বাসস্থান হিসেবে তা অতি উত্তম। -সূরা ফুরকান (২৫) : ৬৩-৭৬
সূরাতুল ফুরকানের তেষট্টি থেকে ছিয়াত্তর নাম্বার আয়াত পর্যন্ত মূলত ইবাদুর রহমানের ব্যক্তিত্বের কাঠামো এবং তাদের বৈশিষ্ট্য-গুণাবলি বর্ণিত হয়েছে।
এভাবে কুরআন কারীম আখলাক ও স্বভাব-চরিত্রের শিক্ষা দান করেছে, আখলাক সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী ভাষায় উপস্থাপন করেছে।
কাসাস
কুরআন কারীমের মৌলিক চতুর্থ বিষয় হচ্ছে কাসাস। কাসাস অর্থ, পূর্ববর্তী ব্যক্তি ও জাতিসমূহের বৃত্তান্ত। এটি কুরআন কারীমের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কুরআন কারীম আমাদেরকে পূর্বের ব্যক্তি ও জাতিসমূহের বৃত্তান্ত জানিয়েছে। এই বৃত্তান্ত দুই ধরনের : ভালো ও আদর্শ দৃষ্টান্ত। মন্দ ও বর্জনীয় দৃষ্টান্ত। আদর্শ দৃষ্টান্ত হিসেবে কুরআন কারীম পূর্বের যে ব্যক্তিবর্গের আলোচনা করেছে তাদের প্রথম কাতারে রয়েছেন আম্বিয়ায়ে কেরাম। আল্লাহ তাআলা নবীগণের জীবন ও কর্মকে মানবজাতির জন্য উত্তম আদর্শ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
এক্ষেত্রেও কুরআন কারীমের শৈলী অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। যুগে যুগে বহু নবী-রাসূল এসেছেন। কিন্তু কুরআন কারীমে চব্বিশ-পঁচিশজন নবী-রসূলের কথাই উল্লেখিত হয়েছে। এই চব্বিশ-পঁচিশজন নবী-রাসূলকে নির্বাচন করার তাৎপর্য কী? অনেক তাৎপর্য থাকতে পারে। শুধু একটি তাৎপর্য আলোচনা করব। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আম্বিয়ায়ে কেরামের বৃত্তান্ত উপস্থাপন করেছেন আদর্শ হিসেবে। কুরআন কিন্তু ইতিহাস বা জীবনীগ্রন্থ নয়। এজন্য কুরআনে আম্বিয়ায়ে কেরামের বৃত্তান্ত জীবনীর মত করে বা ইতিহাসের মত করে উল্লেখিত হয়নি। কুরআন কারীমে আম্বিয়ায়ে কেরামের জীবনের টুকরো টুকরো অংশ আদর্শ ও দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। তাদের জীবন কেমন ছিল, কর্ম কেমন ছিল, বিশ্বাস কেমন ছিল, দাওয়াতের ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান কেমন ছিল- এই বিষয়গুলো কুরআন কারীম দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করেছে।
আমাদের উপমহাদেশের একজন বিখ্যাত চিন্তাবিদ মনীষী মুফাক্কিরে ইসলাম হযরত মাওলানা সায়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ.-এর একটি গ্রন্থ রয়েছে- ‘মানসিবে নবুওত আওর উসকে আলী মাকাম হামেলীন’। এই গ্রন্থটি পাঠ করলে বোঝা যাবে, কুরআন কারীম আম্বিয়ায়ে কেরামকে কী মর্যাদা দান করেছে এবং কীভাবে আম্বিয়ায়ে কেরামের জীবন কুরআন কারীমে উপস্থাপিত হয়েছে।
আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের যেসব ঘটনা কুরআন মাজীদ উল্লেখ করেছে তার পেছনে অনেক তাৎপর্য আছে। একটি গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য হচ্ছে, আম্বিয়ায়ে কেরাম সবাই সাধারণভাবে আদর্শস্থানীয়, অনুসরণীয়। তাঁদের সকলের সব ঘটনাতেই রয়েছে শিক্ষা ও আদর্শ। কিন্তু কুরআন কারীম মানুষকে যেসকল গুণ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী করতে চায়, মানুষের দুনিয়ার জীবন সুন্দর হওয়ার জন্য, আখেরাতের জীবন সুন্দর হওয়ার জন্য যেসকল গুণ ও বৈশিষ্ট্যের প্রতি পথনির্দেশ দান করে, ঐসকল বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একেক নবী একেক ক্ষেত্রে অনন্যসাধারণ ছিলেন। কুরআন কারীম সেভাবে ঘটনাগুলো নির্বাচন করেছে। যেরকম মনে করুন কুরআন কারীম সবর ও শোকর অবলম্বনের আদেশ করে। আল্লাহর পথে হিজরত ও কুরবানীর প্রতি উৎসাহিত করে। জালেম শাসক ও জালিম জাতির সামনে আল্লাহর বাণী দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উপস্থাপনের আদেশ করে। এইসব গুণের প্রত্যেকটি কুরআনের দৃষ্টিতে কাম্য ও বাঞ্ছিত গুণ।
এবার আপনি যদি চিন্তা করেন তাহলে দেখতে পাবেন, সকল আম্বিয়ায়ে কেরামের জীবনেই সবর ছিল, কিন্তু হযরত আইয়ুব আ. এই ক্ষেত্রে অনন্যসাধারণ ছিলেন।
সকল আম্বিয়ায়ে কেরামের জীবনেই শোকর ছিল, কিন্তু সুলাইমান আ. এক্ষেত্রে অনন্যসাধারণ ছিলেন। শক্তি, ক্ষমতা, কর্তৃত্ব, ধন-সম্পদ এই সবকিছু পাওয়ার পর আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের শোকরগুযারি করার মহিমাই আলাদা, যেটা হযরত সুলাইমান আ.-এর জীবনে আমরা দেখতে পাই।
সকল আম্বিয়ায়ে কেরামের জীবনে দাওয়াতের জন্য ত্যাগ-তিতিক্ষা ছিল, কুরবানী ছিল, কিন্তু হযরত ইবরাহীম আ.-এর জীবনে সেটা ভিন্ন মাত্রার ছিল। তিনি এ বিষয়ে অনন্যসাধারণ ছিলেন।
সকল আম্বিয়ায়ে কেরামের জীবনে আল্লাহ তাআলার সত্য-সঠিক পয়গাম জালিম শাসক ও অবাধ্য জাতির সামনে উপস্থাপন করে দেওয়ার দৃষ্টান্ত ছিল, কিন্তু এই বিষয়ে হযরত মূসা আ. অনন্যসাধারণ ছিলেন। ফেরাউনের মত জালিম শাসকের সামনে তিনি আল্লাহ তাআলার বিধান অত্যন্ত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উপস্থাপন করেছেন।
তো কুরআন কারীম এইসকল বিষয়ে তাঁদের দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছে, যেন মানুষ কুরআন কারীমের কাম্য ও বাঞ্ছিত বৈশিষ্ট্যগুলো, তার অনন্যসাধারণ দৃষ্টান্তসহকারে কিয়ামত পর্যন্ত চোখের সামনে দেখতে পায়।
ঠিক এর বিপরীতে মন্দ বৈশিষ্ট্য, বিচ্যুতি, বিভ্রান্তি ইত্যাদিরও অনেক রকমের দৃষ্টান্ত জগৎজুড়ে ছিল। বিভিন্ন কারণে মানুষের ব্যক্তিজীবন ও সমাজজীবনে বিচ্যুতি ও বিভ্রান্তির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। কুরআনে কারীম এক্ষেত্রেও মৌলিক কারণগুলো দৃষ্টান্তসহ উপস্থাপন করে দিয়েছে।
মানুষের জীবনে বিচ্যুতি ও বিভ্রান্তির এক বড় কারণ হয় ক্ষমতা-প্রতিপত্তি। এর জঘন্য দৃষ্টান্ত হচ্ছে ফেরাউন ও নমরূদ।
অনেকসময় মানুষের নিজের ক্ষমতা থাকে না। কিন্তু ক্ষমতাসীনের সঙ্গী ও মুসাহিব হওয়ার কারণে তার মধ্যে বিচ্যুতি-বিভ্রান্তির বিস্তার ঘটে। এর এক দৃষ্টান্ত হামান। কুরআন কারীম তার দৃষ্টান্তও উল্লেখ করে দিয়েছে।
মানুষের মধ্যে বিচ্যুতি ও বিভ্রান্তির আরেক বড় কারণ অর্থ-সম্পদ। এ কারণে বিচ্যুতির দৃষ্টান্ত কারুন। কুরআন কারীম তার দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছে। আর উপরোক্ত সকল ক্ষেত্রে কুরআন কারীম তাদের মর্মন্তুদ পরিণামও খুবই গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেছে।
আরো লক্ষ্য করুন, কুরআন কারীম হযরত লূত আ.-এর স্ত্রীর বৃত্তান্ত উল্লেখ করেছে। হযরত নূহ আ.-এর সন্তানের কথা উল্লেখ করেছে। তাদের মর্মন্তুদ পরিণামের কথা উল্লেখ করে জানিয়ে দিচ্ছে, শুধু সম্পর্কের কারণে নাজাত পাওয়া যাবে না, তা যত বড় সম্পর্কই হোক। হেদায়েতের পথ থেকে বিচ্যুত হলে ভয়াবহ পরিণাম রোধ করার নেই। এরকম বিচ্যুত লোককে মর্মন্তুদ পরিণামের মুখোমুখি হতেই হবে। পক্ষান্তরে দেখুন, ইমরাআতু ফিরআউন, ফিরআউনের স্ত্রী হযরত আসিয়ার ঘটনা কুরআন কারীম উল্লেখ করেছে। ফেরাউনের মত দাম্ভিক এবং খোদাদ্রোহীর স্ত্রীর বৃত্তান্ত উল্লেখ করে কুরআন জানিয়ে দিয়েছে যে, এরকম দাম্ভিক ব্যক্তির স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তিনি যখন ঈমান এনেছেন, ঈমানের পথ অবলম্বন করেছেন তার পরিণাম শুভ হয়েছে। তিনি আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জন করেছেন। এটা হচ্ছে কুরআন কারীমের কাসাস অংশের এক গুরুত্বপূর্ণ দিক। এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
এ পর্যন্ত শুধু ব্যক্তি সম্পর্কে বললাম। কুরআন কারীম যেসকল জাতির ঘটনা আমাদেরকে জানিয়েছে, সেগুলোও মানুষের জন্য দৃষ্টান্ত হিসেবেই উল্লেখ করেছে। কুরআন কারীমের এই কাসাস অংশে, যা কুরআন কারীমের অধিকাংশ সূরায় বিস্তৃত, চিন্তা করলে দেখবেন, এই অংশের সম্পর্ক আকীদার সাথেও, আহকামের সাথেও, আখলাকের সাথেও। বিশুদ্ধ আকীদা, সঠিক কর্ম ও ভালো আখলাকের কারণে শুভ পরিণামের অধিকারী হওয়া আর ভ্রান্ত আকীদা, ভুল কর্র্ম ও মন্দ আখলাকের কারণে অশুভ পরিণামের অধিকারী হওয়া- এটাই তো কাসাসের সারমর্ম। তাহলে ‘কাসাস’ অংশের সম্পর্ক উপরোক্ত আকীদা, আহকাম, আখলাক এই সবগুলোর সাথে। কুরআন কারীমের কাসাস অংশ একদিকে স্বয়ংসম্পূর্ণও বটে আরেকদিকে কুরআন কারীমের তিন মৌলিক বিষয়- আকীদা, আহকাম ও আখলাক এই তিন বিষয়ের জন্য দলীল ও দৃষ্টান্ত বটে।
চতুর্থ বিষয়টা আলোচনা করলাম। পঞ্চম ও শেষ বিষয় সম্পর্কে দু-একটি কথা বলেই আমার আলোচনা শেষ করব। সেটি হচ্ছে, ‘মাওত ওয়া মা-বা‘দাল মাওত’।
মাওত ওয়া মা-বা‘দাল মাওত
কুরআন কারীমে মানুষের পরিণাম সম্পর্কে খুবই গভীরভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, মানুষের সামনে আছে অনিবার্য মৃত্যু। আর মৃত্যুর পরে এক জীবন রয়েছে, যা হবে জবাবদিহিতার জীবন। যে জীবন হবে বর্তমান জীবনের কর্ম ও আচরণের প্রতিদানের জীবন। কুরআন কারীম সেই জীবনের দৃশ্যাবলি আমাদের সামনে খুবই জীবন্তভাবে উপস্থাপন করেছে। কুরআনের পাঠক যদি মনোযোগ দিয়ে কুরআন পড়েন তাহলে দেখতে পাবেন, কিয়ামতের দৃশ্য, জান্নাত-জাহান্নামের দৃশ্য, জান্নাতী-জাহান্নামীদের অবস্থা কুরআন কারীম কী সুস্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করে। উদ্দেশ্য, মানুষ যেন শিক্ষা গ্রহণ করে এবং নিজের ভবিষ্যত গতিপথ নির্ধারণ করে। তার জীবনের করণীয়-বর্জনীয় সম্পর্কে যেন এখান থেকে হেদায়েত গ্রহণ করে।
এই হচ্ছে কুরআন কারীমের মৌলিক পাঁচ বিষয়- আকাইদ, আহকাম, আখলাক, কাসাস ও মাওত ওয়া মা-বা‘দাল মাওত। এই পাঁচটি বিষয় মৌলিক। মানুষের পার্থিব জীবনের সুপথগামিতা, পারলৌকিক জীবনের মুক্তি ও সাফল্যের জন্য যে কিতাব আল্লাহ পাক নাযিল করেছেন মূলত এই পাঁচ বিষয় সেই হেদায়েতের পথই নির্দেশ করে। অন্য ভাষায়, সিরাতে মুস্তাকীমের এই পাঁচটি বড় বড় বিভাগ কুরআন কারীমে উল্লেখিত হয়েছে।
খুবই সংক্ষিপ্ত আকারে কুরআন কারীমের বিষয়বস্তুগত পরিচয় আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম। এখন আলোচনার শেষে, হযরত আলী ইবনে আবি তালিব রা.-এর একটি বাণী এবং কুরআন কারীমের কয়েকটি আয়াত পেশ করে এই আলোচনা আজকের মতো শেষ করব ইনশাআল্লাহ।
হযরত আলী ইবনে আবি তালিব রা. থেকে কুরআন কারীমের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে একটি দীর্ঘ রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে, সেই রেওয়ায়েতের কয়েকটি কথা হচ্ছে-
فيه حكم ما بينكم وخبر من قبلكم و نبأ ما بعدكم .
অর্থাৎ কুরআন কারীম হচ্ছে ঐ গ্রন্থ, যাতে রয়েছে তোমাদের মধ্যকার সকল বিষয়ের মীমাংসা, রয়েছে তোমাদের পূর্ববর্তীদের বৃত্তান্ত এবং রয়েছে তোমাদের সামনের জীবনের সংবাদ।
আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীম সম্পর্কে ইরশাদ করেন-
یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ قَدْ جَآءَكُمْ بُرْهَانٌ مِّنْ رَّبِّكُمْ وَ اَنْزَلْنَاۤ اِلَیْكُمْ نُوْرًا مُّبِیْنًا .
হে মানুষ! তোমাদের কাছে তোমাদের রবের কাছ থেকে এসে গেছে এক মহা প্রমাণ। আর আমি অবতীর্ণ করেছি তোমাদের প্রতি এক উজ্জ্বল আলো। -সূরা নিসা (৪) : ১৭৪
আল্লাহ তাআলা আরো ইরশাদ করেন-
یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ قَدْ جَآءَتْكُمْ مَّوْعِظَةٌ مِّنْ رَّبِّكُمْ وَ شِفَآءٌ لِّمَا فِی الصُّدُوْرِ وَ هُدًی وَّ رَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِیْنَ.
হে মানুষ! তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের রবের পক্ষ হতে উপদেশ, অন্তরের ব্যাধির উপশম এবং মুমিনদের জন্য হেদায়েত ও রহমত। -সূরা ইউনুস (১০) : ৫৭
আল্লাহ তাআলা আরো ইরশাদ করেন-
قَدْ جَآءَكُمْ بَصَآىِٕرُ مِنْ رَّبِّكُمْ فَمَنْ اَبْصَرَ فَلِنَفْسِهٖ ۚ وَ مَنْ عَمِیَ فَعَلَیْهَا وَ مَاۤ اَنَا عَلَیْكُمْ بِحَفِیْظٍ .
তোমাদের নিকট এসেছে তোমাদের রবের পক্ষ হতে প্রজ্ঞার জ্যোতিসমূহ। এখন যে দেখবে সে নিজের কল্যাণার্থেই দেখবে আর যে অন্ধ হয়ে থাকবে সে নিজেরই ক্ষতি সাধন করবে। আমি তো তোমাদের তত্ত্বাবধায়ক নই। -সূরা আনআম (৬) : ১০৪
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সবাইকে কুরআন কারীমের সত্যিকারের ছাত্র হওয়ার, কুরআন থেকে নূর ও আলো গ্রহণ করার তাওফীক দান করুন- আমীন।
وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين. হ