সফর ১৪৪৩   ||   সেপ্টেম্বর ২০২১

নিজেকে নিলামের বাজারে তুলবেন না

মাওলানা সায়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ.

[২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮ ঈ. রোজ বুধবার মাগরিবের নামাযের পর দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামা লক্ষেèজামালিয়াহ হলেশিক্ষাসমাপনকারী তলাবায়ে কেরামের বিদায়ী জলসায় সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ. এই ফিকর-আনগীযবয়ান করেন। এ বয়ান যে কোনো দারুল উলূমে অধ্যয়নকারী কিংবা শিক্ষাসমাপনকারী তলাবায়ে কেরামের জন্য পথনির্দেশকের ভূমিকা পালন করবে। -সম্পাদক : তামীরে হায়াত]

الحمد لله رب العالمين، والصلاة والسلام على سيد المرسلين، وخاتم النبيين محمد وآله وصحبه أجمعين، ومن تبعهم بإحسان ودعا بدعوة ربهم إلى يوم الدين. أما بعد!

আমার সহকর্মী দারুল উলূমের আসাতেযায়ে কেরাম! প্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ এবং প্রাণপ্রিয় সন্তানগণ!

আমার মন চাইছে, প্রথমে নিজের মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে। এখানে বিদায়ী তালেবে ইলম ভাইগণ উর্দূ ও আরবীতে যে প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও রচনা পেশ করেছেন, সেগুলো শুনে আমি আল্লাহ তাআলার শোকর আদায় করেছি। আমি সবার সামনেই বলছি, আলহামদু লিল্লাহ! এগুলো শুনে আমার মনে হয়েছে, দারুল উলূমে তালেবে ইলমদের নিয়ে যে মেহনত করা হচ্ছে তা বৃথা যাচ্ছে না। আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে বলেছেন-

وَ اَنْ لَّیْسَ لِلْاِنْسَانِ اِلَّا مَا سَعٰی، وَ اَنَّ سَعْیَهٗ سَوْفَ یُرٰی.

মানুষ কেবল তা-ই পায়, যার চেষ্টা সে করে। আর তার চেষ্টা অচিরেই প্রতিভাত হবে। -সূরা নাজম (৫৩) : ৩৯-৪০

আমি আমার প্রিয় সহকর্মী ও দারুল উলূমের আসাতেযায়ে কেরামকে মোবারকবাদ দিচ্ছি যে, তাদের মেহনত ও পরিশ্রমের প্রভাব আছে এই লেখাসমূহে। দারুল উলূমের পূর্বতন যোগ্য তলাবায়ে কেরামের লেখা ও রচনার ছাপও আছে এই লেখাগুলোয়।

আমি বহু বছর যাবত দারুল উলূমের বিদায়ী জলসায় অংশগ্রহণ করে আসছি। কখনো কখনো আলইসলাহ’-এর মজলিসগুলোতেও শরীক হয়েছি। সে সুবাদে অনেকের লেখা শোনারই সুযোগ হয়েছে আমার। মাশাআল্লাহ আজকে আমরা যে লেখাগুলো শুনলাম তাতে ইলমী দক্ষতা, চিন্তার গভীরতা, বয়ান ও বর্ণনাশৈলির কুশলতা, ভাষা ও সাহিত্যের বোধ ও রুচি এবং লেখা ও রচনার নৈপুণ্য সবকিছুর বিচারেই যথেষ্ট উন্নতি ও অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে। এটি সত্যিই শুকরিয়ার বিষয়। প্রিয় তলাবায়ে কেরাম তাদের আসাতেযায়ে কেরামের সাথে ইখলাস, ইহতিরাম ও মহব্বতের যে সম্পর্ক রেখেছেন এবং তাদের উন্নতি ও অগ্রগতির যে চিত্র আজ আমি দেখলাম তার জন্য তাদেরকে মোবারকবাদ জানাচ্ছি।

কিছু তালেবে ইলম ভাই তাদের লেখা শোনাতে পারেননি। আমি তাদের কাছে মাযেরাত করছি। কিন্তু আমি তাদেরকে বলব, তারা যেন হিম্মত রাখেন। আমি বলব যে, তাদের এই দৃঢ় বিশ্বাস রাখা উচিত, তাদের মেহনত বিফলে যাবে না। কারণ তারা লেখা তৈরির জন্য যে সময় ব্যয় করেছেন সর্বাবস্থায় তা তাদের জন্য উপকারী। এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। আজ তা শোনা সম্ভব হয়নি, কিন্তু দেখা যাবে যে, কাল হয়তো সেগুলো ছাপা অক্ষরে চলে আসবে, যা তাদের জন্য স্মারক হয়ে থাকবে।

এখন আমি অল্প সময়ে কিছু জরুরি এবং বিদায়ী কথা বলতে চাই। এমনিতে তো যে কোনো সময়ই যে কোনো কথা বলা যায়, কিন্তু যেহেতু এটি বিদায়ী মজলিস, তাই আমি আপনাদের সামনে সেই কথাই বলব, যা আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা এবং সুদীর্ঘ সময়ের অধ্যবসায়ের ফল। এমন কথা বলারই চেষ্টা করব, যা আমি আপনাদের জন্য উপকারী বলে মনে করি। আমার উপর আপনাদের যে হক রয়েছে এবং আমার প্রতি আপনারা যে মহব্বত-ভালোবাসা লালন করেন তা-ই ছিল এ কথাগুলো বলার পেছনে প্রধান উদ্দীপক।

এখন আমি বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে চারটি কথা আরয করব। আর চারটি কথা বলব আপনাদের নিজের সম্পর্কে।

প্রথম কথাটি যদিও অনেক বড় এবং আমার অবস্থার চেয়ে অনেক উঁচু স্তরের কথা, কিন্তু কথাটি অনেক বরকতপূর্ণ এবং কথাটি বলতে পারা অত্যন্ত আনন্দদায়ক।

ভূমিকাস্বরূপ প্রথমে একটি ঘটনা বলছি, একবার হযরত উমর ফারুক রা. বড় বড় ও বিশিষ্ট কিছু সাহাবীর সাথে ছিলেন। হযরত উমর রা. বলেন, আমার মনে হচ্ছে, এখন আমার দুআ করার সময়। তিনি মনে মনে বার বার দুআ করার জন্য তাগিদ অনুভব করছিলেন। আরেফগণের মাঝে যেমন বিশেষ সময়ে বিশেষ আমলের তাগিদ জন্ম নেয় তদ্রƒপ তাঁর মাঝে তখন দুআর আমলের তাগিদ জন্মেছিল। আর তিনি তো ছিলেন আরেফগণেরও আরেফ। তিনি উপস্থিত সাহাবীগণকে বললেন, আপনারা সবাই মুক্তমনে দুআ করুন। আল্লাহর কাছে মনের আকাক্সক্ষা পূরণের জন্য কায়মনোবাক্যে দুআ করুন।

তখন কেউ এই দুআ করলেন, হে আল্লাহ! আমাকে আপনার রাস্তায় জিহাদে বের হওয়ার তাওফীক দিন, আমি আমার ধন-সম্পদ আপনার রাস্তায় বিলিয়ে দিব এবং আপনার রাস্তার মুজাহিদদের খেদমত করব। কেউ বললেন, হে আল্লাহ! আমাকে আপনার রাস্তায় জিহাদে বের হওয়ার তাওফীক দিন, আমি আমার বুকের খুন ঝড়াবো, জিহাদের ময়দানে নিজেকে উৎসর্গ করে দিব। ...এভাবে সবাই নিজ নিজ দুআ করলেন।

অবশেষে উমর রা.-এর পালা এল। তিনি দুআ করলেন, হে আল্লাহ! আমার কাছে যেন আবু উবায়দাহ ইবনুল জাররাহ, সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস, তালহা ও খালেদ ইবনুল ওয়ালীদ থাকে। তিনি এঁদের ছাড়া আরো কতিপয় সাহাবীর নাম নিয়েছিলেন। এঁরা ছিলেন সেইসব সাহাবী, যাঁদের ভাগ্যে আল্লাহ তাআলা অনেক অনেক ভূখ- বিজয় ও অনেক মহান কীর্তির কথা লিখে রেখেছিলেন।

যাই হোক, উমর রা. বললেন, আমি এদের মধ্য থেকে কাউকে এই যুদ্ধের ময়দানে পাঠাব আর কাউকে ঐ যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠাব। এভাবে এঁদের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা সারা দুনিয়ায় ইসলামের পতাকা উড্ডীন করবেন। সারা দুনিয়া ইসলামের ছায়াতলে চলে আসবে।

আমারও মন চাইছে, আজ আপনাদের সামনে কিছু যুদ্ধের ময়দানের কথা বলতে। হিন্দুস্তানের বুকে ইসলামের ভবিষ্যতের ফায়সালা কোন্ কোন্ যুদ্ধের ময়দানে হবে- বর্তমান সময়ের আগে তা এতটা স্পষ্ট ছিল না। কিছুটা ধূ¤্রজাল ছিল। কিছুটা অস্পষ্টতা ছিল, তাই তখন নির্দিষ্ট করে এ কথা বলা মুশকিল ছিল যে, যুদ্ধের এই চার ময়দানের জয়-পরাজয়ের ভিত্তিতেই হিন্দুস্তানে ইসলাম এবং হিন্দুস্তানী মুসলমানদের ভবিষ্যতের ফায়সালা হতে চলেছে এবং ফায়সালা হতে চলেছে যে, এদেশের মুসলমানরা নিজেদের আকীদা-বিশ্বাস, নিজেদের কওমী পয়গাম এবং নিজেদের জাতীয় পরিচয় ও স্বাতন্ত্র্য নিয়ে হিন্দুস্তানের বুকে টিকে থাকতে পারবে কি না?

আমার অধ্যবসায় ও পর্যবেক্ষণের ফল হল, আজ থেকে কিছুদিন আগেও, বিশেষভাবে ১৯৪৭-এর আগে যুদ্ধের এই ময়দানগুলো এতটা নির্দিষ্ট এবং এতটা স্পষ্ট ছিল না। কিন্তু এই সময়কালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ধারা, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতন, ইসলামের বিরুদ্ধে গ্রহণকৃত নানা পদক্ষেপের অবলোকন এবং জ্ঞানগত অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ- এ সবকিছু বিষয়টিকে একটি ধ্রুব সত্য ও বাস্তবতা হিসেবে সামনে নিয়ে এসেছে।

যুদ্ধের এই চার ময়দানের কথাই আজ আমি আপনাদের বলব, যার জন্য উচ্চমনোবলসম্পন্ন সৈনিক, দ্বীনী দরসগাহের ফুযালা, তারবিয়ত গ্রহণ ও সম্পন্নকারী আলেমেদ্বীন এবং মুখলিসীনদের এক জামাত প্রয়োজন, যারা যুদ্ধের এই ময়দানগুলোতে লড়াই করার জন্য সামনে এগিয়ে আসবে। তাদের জন্য এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কী হতে পারে যে, তারা এই যুদ্ধের ময়দানসমূহে নিজেদের যোগ্যতা, শক্তিমত্তা ও দক্ষতার স্বাক্ষর রাখতে পারবে।

সবচেয়ে বড় ময়দান : হিন্দুস্তানের মুসলমানদের আগামী প্রজন্মকে ইরতিদাদ ও ধর্মচ্যুতি থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করা

 আগামী প্রজন্ম যেন মুসলমানথাকে, তারা যেন ইরতিদাদ ও ধর্মচ্যুতির শিকার না হয়। শুধু চিন্তা, সভ্যতা ও সংস্কৃতি নয়; বরং বিশ্বাসগতভাবে ধর্মচ্যুতি (ইরতিদাদ)-এর ফেতনা থেকে বাঁচতে পারে।

এখন সবচেয়ে বড় ফরয হল, যারা আমাদের এইসকল মাদরাসা থেকে শিক্ষা সমাপন করে বের হবে, তারা এই ময়দানের দায়িত্ব নেওয়া এবং নিজেদেরকে এই যুদ্ধক্ষেত্রের জন্য ওয়াকফ করে দেওয়া। তারা যেন প্রাণপণ চেষ্টা করে যে, মুসলমানদের আগামী প্রজন্ম, যারা এখনো আট-দশ বছরের বাচ্চা, কিংবা বারো-পনের বছর বয়সের তরুণ, তারা যেন অন্ততপক্ষে ইসলামের উসূলী, ফিকহী এবং কালামশাস্ত্রীয় সংজ্ঞায় মুসলিম হিসেবে উত্তীর্ণ হতে পারে। (অর্থাৎ আমলী দুর্বলতা থাকলেও তারা যেন বিশ্বাসগতভাবে অন্তত মুসলমানথাকে)।

এর জন্য প্রয়োজন, গ্রামে-গ্রামে, শহরে-শহরে মসজিদ-মাদরাসা ও মক্তবের ভিত্তি স্থাপন করা। মাদরাসা ও মক্তবে সকালে-বিকালে বিভিন্ন সময় পড়ানোর ব্যবস্থা থাকবে। প্রভাতী শাখা, দিবা শাখা, বৈকালিক শাখা, সান্ধ্য শাখা প্রভৃতি থাকবে। জেনারেল শিক্ষিত যে সকল লোক নিজেদের সন্তানদের সরকারি স্কুলেই পাঠাবে বলে স্থির করে রেখেছে, তাদের কাছেও দ্বীনের ও রূহের খোরাক সরবারহ করার ব্যবস্থা করা হবে। যদি তাদেরকে এখনি বাঁচানোর চেষ্টা করা না হয়, তাহলে ভয় হয় যে, এই নতুন প্রজন্মকে হয়তো ফিকহ ও কালামশাস্ত্রীয় পরিভাষায়ও মুসলমান বলা সহীহ হবে কি না। তাওহীদ-শিরক, ঈমান ও কুফরের মাঝে পার্থক্যও তারা করতে পারবে কি না? রিসালাত, মানছাবে রিসালাত এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাফাআত- প্রভৃতি বিষয়ে তাদের ঈমান ও বিশ্বাস থাকবে কি না?

إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللهِ الْإِسْلَامُ .

(নিঃসন্দেহে ইসলামই আল্লাহর নিকট একমাত্র দ্বীন) এবং 

وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ .

(কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো দ্বীন গ্রহণ করতে চাইলে তা গৃহীত হবে না)- এ দুই আয়াতের উপর এদের ঈমান থাকবে কি না?

আপনাদের উচ্চ মনোবলশক্তি, উন্নত চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি, পড়াশোনা ও জানাশোনার বিস্তৃতি এবং যোগ্যতা ও দক্ষতার জন্য আল্লাহ তাআলার কাছে আমরা শুকরিয়া আদায় করছি এবং এজন্য আপনাদেরকে মুবারকবাদও জানাচ্ছি। কিন্তু এখন ভাবনার বিষয় হল, কে কোন্ যুদ্ধের ময়দানের দায়িত্ব নেবে? কে কোন্ যুদ্ধক্ষেত্র সামলাবে? আপনারা এখনই নিয়ত করুন, আমরা এই নাযুক ও সঙ্গীন যুদ্ধের ময়দানগুলোর জন্য নিজেদেরকে উৎসর্গ করে দিব। নিয়ত করলে আল্লাহ তাআলা আপনাদের সাহায্য করবেন এবং ওসিলা ও উপায়-উপকরণের ব্যবস্থা করবেন। আগামী প্রজন্ম, যারা আমাদের এবং আপনাদেরই সন্তান হবে, তাদেরকে মুসলমান হিসেবে বাকি রাখার জন্য যে চেষ্টা-ফিকির ও  মেহনত-মুজাহাদাই করা সম্ভব হয়, তা করার চেষ্টা করুন। যে দৌড়-ঝাঁপই করা সম্ভব হয়, জানপ্রাণ দিয়ে তা করুন। এটিই এখন যুদ্ধের সবচেয়ে বড় ময়দান।

দ্বিতীয় ময়দান : ভারতে মুসলমানগণ জাতীয় পরিচয় ও স্বাতন্ত্র্য এবং ধর্মীয় স্বকীয়তা নিয়ে থাকতে পারা

অর্থাৎ তাদের পারিবারিক আইন, কুরআন মাজীদের কত্য়ী ও অকাট্য বিধিবিধান, বিয়ে ও তালাকের বিধিবিধান, মীরাছের বিধিবিধান এবং মুসলমানদের একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত বিধিবিধান যেন তারা পালন করতে পারে। যদি কোনো দেশ বা ভূখ-ে তারা এই বিধিবিধানগুলো পালন করতে না পারে তাহলে তো অনেকসময় ঐ দেশ বা ভূখ-ে বসবাস করা তাদের জন্য নাজায়েয ও হারাম হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলার ইরশাদ-

اِنَّ الَّذِیْنَ تَوَفّٰىهُمُ الْمَلٰٓىِٕكَةُ ظَالِمِیْۤ اَنْفُسِهِمْ قَالُوْا فِیْمَ كُنْتُمْ  قَالُوْا كُنَّا مُسْتَضْعَفِیْنَ فِی الْاَرْضِ قَالُوْۤا اَلَمْ تَكُنْ اَرْضُ اللهِ وَاسِعَةً فَتُهَاجِرُوْا فِیْهَا فَاُولٰٓىِٕكَ مَاْوٰىهُمْ جَهَنَّمُ وَ سَآءَتْ مَصِیْرًا.

নিজ সত্তার উপর জুলুমরত থাকা অবস্থায়ই ফিরিশতাগণ যাদের রূহ কব্জা করার জন্য আসে, (তাদেরকে লক্ষ্য করে) তারা বলে, তোমরা কী অবস্থায় ছিলে? তারা বলে, যমীনে আমাদেরকে অসহায় করে রাখা হয়েছিল। ফিরিশতাগণ বলে, আল্লাহর যমীন কি প্রশস্ত ছিল না যে, তোমরা তাতে হিজরত করতে? সুতরাং এরূপ লোকদের ঠিকানা জাহান্নাম এবং তা অতি মন্দ পরিণতি। -সূরা নিসা (৪) : ৯৭

অত্যন্ত কঠিন হুঁশিয়ারি। যদি আল্লাহ না করুন, এমন সময় চলে আসে যে, মুসলমান এখানে নামায তো পড়তে পারে, কালেমা তো পড়তে পারে, কুরআন মাজীদের তিলাওয়াত তো করতে পারে, কিন্তু কুরআন মাজীদের পারিবারিক বিধানের উপর আমল করতে পারে না- তখন আলেমগণকে নিরুপায় হয়ে একথা ভাবতে হবে যে, ‘এখন হিজরত করা ওয়াজিব হয়ে গেছে’- মুসলমানদেরকে এমন কোনো ফতোয়া দিতে তারা বাধ্য হয়ে গেছেন কি না। আল্লাহ রক্ষা করুন, এমন  সময় যেন না আসে!

আমরা মনে করি যে, এই জমিনের উপর আমাদের হক আছে। এখানকার ছাহেবে ইলহাম আহলে বসীরত আরেফগণ এবং আপন সময়ের এখলাসের উচ্চমার্গে সমাসীন বুযুর্গগণ একথা প্রকাশ করে গেছেন যে, এ দেশ থেকে ইসলাম মিটে যাবে না, এ দেশের কিসমতে ইসলাম লিখে দেওয়া হয়েছে, তাকদীরে ইলাহীর ফয়সালা হল, ইসলাম এই দেশে থাকবে।

ইসলাম এই দেশ পরিচালনার ভারও নিতে পারে এবং এই দেশকে বাঁচাতেও পারে। এমনও হতে পারে, দ্বিতীয়বার এই দেশ পরিচালনার দায়িত্ব মুসলমানদের হাতে চলে আসবে।

তাই আমরা আল্লাহ তাআলার রহমত থেকে নিরাশ নই। কিন্তু আমাদেরকে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি ও প্রেক্ষাপট এবং বাস্তবতাকে সামনে রেখে নিজেদের চেষ্টা-ফিকির এবং মেহনত-মুজাহাদার গতিপথ ও দিক ঠিক করতে হবে। কারণ মুসলমানদের জাতীয় পরিচয় ও স্বাতন্ত্র্য এবং ধর্মীয় স্বকীয়তা দিন দিন হুমকির মুখে পড়ে যাচ্ছে। এখন এই চেষ্টা-ফিকির ও মেহনত-মুজাহাদার খুব প্রয়োজন।

আল্লাহ তাআলা যেন শাহ বানু বেগমের মামলার১ মাধ্যমে গায়বী সাহায্য করেছেন। এর মাধ্যমে সকল মুসলমানের মাঝে এই বিপদের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছিল। যার ফলে একটি বড় পদক্ষেপ নেওয়া হয় এবং পদক্ষেপটি একধরনের সফলতাও লাভ করে। এ থেকে এটাও বুঝা গেল যে, সমষ্টিগতভাবে ও ঐক্যবদ্ধভাবে এবং ইখলাস ও নিষ্ঠার সাথে যে পদক্ষেপ নেওয়া হয় তা নিশ্চয়ই সফল হয়। অথচ আদালতের ফায়সালা হওয়ার আগে এই ভবিষ্যদ্বানী করা অনেক কঠিন ছিল যে, ফায়সালা মুসলমানদের পক্ষে হবে কি না? তাদের দাবি পূরণ হবে কি না?

কিন্তু আল্লাহ তাআলার কিছু নেককার ও মুখলিস বান্দা আল্লাহ তাআলার হেদায়েত অনুসারে, কুরআন মাজীদের নির্দেশনা অনুসারে এবং অতীত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে সঠিক পথ ও পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। তাই তারা সফল হতে পেরেছিলেন।

তৃতীয় যুদ্ধক্ষেত্র : মানবতার পয়গাম

আমরা এই দেশে এমনভাবে থাকব, যেন আমরা এখানে নিজেদের দ্বীনকে অক্ষত রাখতে পারি, দ্বীন অনুযায়ী আমল করতে পারি, নিজেদের প্রতিষ্ঠান ও কেন্দ্রগুলোকে হেফাযত করতে পারি, দাওয়াতের কাজ নির্বিঘেœ করতে পারি, তালীম-তালীফ তথা শিক্ষা-দীক্ষা ও রচনা-লিখনীর কাজ করে যেতে পারি। একটি উদ্দেশ্যপূর্ণ জীবন যাপন করতে পারি এবং সম্মান ও ইজ্জতের যিন্দেগী যাপন করতে পারি। নিজেদের স্বতন্ত্র আকীদা-বিশ্বাস, নিজস্ব মান-মর্যাদা এবং অন্যদের প্রতি আমাদের যে পয়গাম ও বার্তা আছে তা নিয়ে এই দেশে থাকতে পারি। এই সবকিছুর জন্য জরুরি হল, সার্বিক পরিস্থিতি যেন শান্ত ও স্বাভাবিক থাকে। পরিবেশ যেন উত্তপ্ত ও বিক্ষুব্ধ না হয়। নতুবা যে কোনো সময় সকল মেহনতের উপর মাটি পড়ে যাবে। তাই আমাদের কর্তব্য হবে সকলের মাঝে মানবতার পয়গাম ছড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু খুব কম লোকই এই বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছে। তারা মনে করে যে, এগুলো কিছু মানুষের মনের নবচিন্তা, অথবা তা তাদের নিজস্ব খেয়াল, বিশেষ কোনো কারণে যা তাদের মনে উদয় হয়েছে।

আপনারা বিশ্বাস করুন, পরিস্থিতির বাস্তব ও নির্মোহ পর্যবেক্ষণই আমাকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত করেছে। আমার মত আমার অনেক সতীর্থদের পর্যবেক্ষণের ফলও তাই। তাই তারা মনে করেন, এর জন্য আমাদের কিছু করতে হবে। আমাদেরকে মানবতার পয়গাম ছড়িয়ে দিতে হবে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা যে পরিমাণ নাযুক, সে অনুপাতে আমাদের এই টুটাফাটা প্রয়াস কিছুই নয়।

যদিও এখানে সমবেত লোকেরা সেই জনতা নয়, যাদের সামনে মনের কথা খুলে বললে মনে করা যেতে পারে যে, হয়তো আমার এই আবেদনগুলি আন্দোলনের রূপ লাভ করবে। কিন্তু অসম্ভব কী যে, আল্লাহ তাআলা হয়তো আপনাদের মাধ্যমেই এই কাজ করিয়ে নেবেন। সুতরাং আপনারা এ বিষয়টিও খেয়াল রাখবেন এবং পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি এবং আস্থা ও শ্রদ্ধার পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করবেন।

স্পেনে যে দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছিল, সে সম্পর্কে অনেক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। তন্মধ্যে একটি কঠিন বাস্তবতা হল, সেখানে ইলমে দ্বীনের অনেক খেদমত হয়েছে। সেখানে আল্লাহ পর্যন্ত পৌছানোর জন্য এমন এমন মুজাহাদা করা হয়েছে, যার দ্বারা উচ্চস্তরের ওলীআল্লাহ জন্ম নিয়েছে। কেউ কেউ তো এমনও বলে ফেলেছেন যে, প্রাচ্য যদি হয় নবীগণের ভূমি তাহলে প্রতীচ্য হবে ওলীআল্লাহদের ভূমি। শায়েখ মুহিউদ্দীন ইবনে আরাবীর মত জালীলুল কদর শায়েখ সেখানে জন্ম নিয়েছেন। এ কারণেই সেখানে ফুনুনে লাতীফার উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। আন্দালুসের একটি স্বতন্ত্র ইতিহাসও আছে। একে আলমাদরাসাতুল আন্দালুসিয়া বলা হয়।

এমনিভাবে স্পেনে উচ্চস্তরের মনীষী লেখক জন্ম নিয়েছে। আলমুওয়াফাকাত-এর লেখক আল্লামা শাতেবী সেখানে জন্ম নিয়েছেন, আততামহীদ-এর লেখক ইমাম ইউসুফ ইবনে আবদুল বার জন্ম নিয়েছেন। এ ধরনের আরো অনেক কালজয়ী গ্রন্থের রচয়িতা জন্মগ্রহণ করেছেন। মুয়াত্তায়ে মালেকের অনেক উঁচু মানের ব্যাখ্যাগ্রন্থ লেখা হয়েছিল সেখান থেকে।

কিন্তু একটি বিষয়ে সেখানে চোখ বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। সেটা হল, নিজেদের এত বড় সাম্রাজ্য ও শক্তি-ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বিচক্ষণতার সাথে সেখানকার সাধারণ জনগণ ও সাধারণ মানুষকে ইসলামের সাথে পরিচিত করার এবং ইসলামের মুবারক আঙিনায় দাখেল করার কোনো চেষ্টা করা হয়নি।

এর কারণ হল, ক্ষমতাসীনদের মাথায় অনেকসময়ই এই চিন্তা ভর করে যে, এই ভূখ-ের উপর আমাদের নাম লিখে দেওয়া হয়েছে। মোগল সাম্রাজ্যের ফরমান-পত্রে এই শব্দ পাওয়া যায়- চিরকালীন সাম্রাজ্য’ (দওলতে আবাদে কারার)। অর্থাৎ আমরা সরাসরি ইস্রাফিল আ.-কে এই ভূখণ্ডের ক্ষমতা হস্তান্তর করব। এর আগ পর্যন্ত আমাদের কোনো ভয় বা শঙ্কা নেই। এ ছিল এক মারাত্মক ভুল ও বোকামি চিন্তা। এই বিশাল ভূখণ্ডকে অযত্ন-অবহেলায় ছেড়ে রাখা ছিল চরম ভুল। এই ভূখণ্ডের আবেগ-অনুভূতিকে ভুল শিক্ষা-দীক্ষা এবং ভ্রান্ত ও বিকৃত ইতিহাসের শিকার হতে দেওয়া, এ ভূখণ্ডের লোকদের নিজস্ব চারিত্রিক দুর্বলতার অনুষঙ্গগুলোকে বিকাশপ্রাপ্ত হতে দেওয়া এবং সর্বোপরি বিপরীত পক্ষ কর্তৃক রাজনৈতিক আন্দোলনের দ্বারা ফায়েদা লুটে  এ জনগোষ্ঠীর আবেগ-অনুভূতি ও চিন্তা-চেতনাকে ভুল খাতে প্রবাহিত করার সুযোগ দেওয়া ছিল আত্মঘাতী।

হিন্দুস্তানে তো এ বিষয়টি আরো স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়। মুসলমানরা হিন্দুস্তানে আট শ বছর শাসন করেছে। এখন এখানে বিপরীতধর্মী রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু হয়েছে এবং তারা অমুসলিমদের মনে মুসলমানদের প্রতি অনেক বড় বিষক্ষত সৃষ্টি করে দিয়েছে। এই বিষক্ষতকে কেবল মানবতার পয়গামের মাধ্যমেই অবলুপ্ত করা সম্ভব।

বিষয়টি আমি অনেক সংক্ষিপ্তাকারে বয়ান করলাম। এ ব্যাপারে বড় বড় লিটারেচার তৈরি হয়েছে। আপনারা সেগুলো পড়বেন।

চতুর্থ এবং শেষ যুদ্ধক্ষেত্র : দ্বীনী উলূমকে হেফাযত করা এবং যামানার উপযোগীরূপে পেশ করা

যামানার উপযোগীরূপে পেশ করার অর্থ দ্বীনী উলূমকে অনুগামী বানানো নয়; বরং যামানার জায়েয ও ওয়াজিব চাহিদা পূরণ করার লক্ষ্যে যামানার ভাষা, বোধ ও চরিত্রের প্রতি লক্ষ্য রেখে দ্বীনী উলূমকে জীবন্ত ও প্রাণবন্তরূপে পেশ করার চেষ্টা করা এবং দ্বীনী উলূমকে আপন দায়িত্ব পালনে উপযোগী করে তোলা। দ্বীনী উলূমকে কেবল যামানার সঙ্গদান নয়; বরং যামানার নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্য বানাতে হবে। এই কাজের জন্য আমাদের আরবী মাদরাসাগুলো হল শরীরে মেরুদ-ের হাড়ের মত। এই মাদরাসাসমূহকে শাক্তিশালি করতে হবে। এর জন্য যোগ্য উস্তায ও শিক্ষক তৈরি করতে হবে। নদওয়াতুল উলামার সঙ্গে সম্পৃক্ত মাদরাসার সংখ্যা এখন প্রায় পঞ্চাশ-ষাটের মত। এর পরও যোগ্য শিক্ষক পাওয়া যায় না। এর জন্যও আপনারা তৈরি  হন। নিজেকে যোগ্য শিক্ষকরূপে গড়ে তুলুন।

নতুন নতুন মাদরাসা তৈরি করুন। উলূমে দ্বীনীয়াতে নতুন প্রাণ সঞ্চার করুন। আমি একথা বলছি না, আপনারা প্রাচীন বিষয়কে প্রাচীন এবং জীর্ণ-শীর্ণ মনে করেই পড়াতে থাকুন; বরং আমার উদ্দেশ্য হল, আপনারা এগুলোতে নতুন প্রাণ ও শক্তি সঞ্চার করুন। নতুন গ্রন্থাবলি রচিত হোক। নতুন করে ব্যাখ্যাগ্রন্থ তৈরি হোক। নতুন উপস্থাপনা হোক। পঠন-পাঠনে ও শিক্ষাক্রমে নতুন শক্তি, উদ্যম ও প্রাণচাঞ্চল্য যোগ হোক। যোগ হোক ভাবনা-চিন্তার নতুন মাত্রা, পড়াশোনা ও অধ্যবসায়ের বিস্তৃতি, মেধা ও ধী-শক্তির বিকাশ ও উৎকর্ষ।

এই ছিল চারটি বিষয়, সংক্ষিপ্তাকারে যার দিকে আমি দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম, বিষয়গুলোর প্রতি গভীর দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।

এখন আমি সেই চারটি বিষয় বলছি, যা আপনার নিজের সাথে সম্পৃক্ত। এ বিষয়গুলোকে আপনি সাধারণ কিছু মনে করবেন না। এগুলো আমার হাজার হাজার পৃষ্ঠা অধ্যয়নের সারনির্যাস। যদিও নিজের ব্যাপারে বলা হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এতে কোনো ফযীলতের দাবি নেই, শুধু নিজের কথার গুরুত্ব বোঝানোর জন্য বলছি- পূর্ববর্তী মনীষীগণ এবং সমসাময়িক মনীষী আলেমগণ এবং এ দুইয়ের মধ্যবর্তী সময়ের আলেম মনীষীগণ, বিশেষত হিন্দুস্তানের আলেম মনীষীগণের জীবনচরিত পড়ার সৌভাগ্য আমার যতটা হয়েছে, এরূপ সৌভাগ্য অন্যদের কমই হয়ে থাকে। এর একটি বিশেষ কারণ ছিল। সেটি হল, আমি ইতিহাস অনুরাগী একটি পরিবেশে চোখ মেলেছিলাম। আমার ঘরের লোকেরা ছিল ইতিহাস-প্রণেতা। ইতিহাসের পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত ও জরুরি উপাদান আমাদের ঘরেই মজুদ ছিল।

নুযহাতুল খাওয়াতিরগ্রন্থে প্রায় সাড়ে চার হাজারের অধিক হিন্দুস্তানী আলেম মনীষীর জীবনী আছে। এ গ্রন্থ আমি কয়েকবার পড়েছি। পা-ুলিপি প্রস্তুতের সময় থেকে নিয়ে ছাপা আকারে প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেক ধাপে কয়েক বার পড়েছি। এমনিভাবে আমি ওফাইয়াতুল আইয়ান এবং তাবাকাতের উপর লিখিত গ্রন্থাবলি পড়েছি। এছাড়া আল্লাহ তাআলা সরাসরি বুযুর্গগণের কাছে থাকার এবং তাঁদের সান্নিধ্য লাভেরও তাওফীক দিয়েছেন।

যাইহোক, যে চারটি বিষয় বলতে চাচ্ছি তা হল :

এক. আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পর্ক ঠিক করা

আল্লাহ তাআলার সাথে আমাদের সম্পর্ক যেন ঠিক হয়। তাকওয়া, দিয়ানতদারি এবং তাআল্লুক মাআল্লাহ-এর একটা পর্যায় যেন অর্জিত হয় এবং এর জন্য চেষ্টা-ফিকির করা হয়। এটি এমন একটি মৌলিক ও অনিবার্য বিষয়, যা ছাড়া না কোনো কাজে বরকত হয় আর না কোনো চেষ্টা-ফিকির ও মেহনত-প্রয়াসে বরকত হয়। বাস্তবিকপক্ষে উপকারী কোনো কিছু করা তখনই সম্ভব হয়, যখন আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক থাকে।

আমি একথা বলছি না যে, আপনারা সবাই রাত্রিজাগরণকারী ইবাদতগোযার হয়ে যান। বড় সূফীসাধক ও আরেফ বিল্লাহ হয়ে যান। এমনটি হওয়া সবার জন্য জরুরি নয়। কিন্তু যা জরুরি তা হল, তাকওয়ার একটি পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছা এবং আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পর্ক ঠিক করা এবং এ বিষয়ের ফিকির থাকা। নামাযের ফিকির থাকা, দুআর যাওক-শওক থাকা এবং একপর্যায়ের ইনাবাত ইলাল্লাহঅবশ্যই থাকা। এটি হল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক বিষয়। এ বিষয়টি কখনো ভোলা যাবে না। কখনো এ থেকে গাফেল হওয়া যাবে না।

এটি অর্জনের বহু পথ রয়েছে। তন্মধ্যে একটি তো হল, আপনারা মনোযোগ দিয়ে কুরআন মাজীদ, হাদীস এবং ফিকহের কিতাবাদি পড়বেন এবং সে মোতাবেক নিজেদের নামায সুন্দর ও উন্নত করার চেষ্টা করবেন। এছাড়া সবচেয়ে ফলপ্রসূ পন্থা হল, বুযুর্গানে দ্বীনের জীবন চরিত শিক্ষা গ্রহণের নিয়তে পড়া। আর যদি আল্লাহ তাআলা তাওফীক দেন তাহলে কোনো বুযুর্গের সোহবত অবলম্বন করা। আমি বে-তাকাল্লুফ বলছি, এক্ষেত্রে সর্বোত্তম এবং সর্বাধিক উপকারী হল, হযরত হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ.-এর গ্রন্থাবলি। বিশেষভাবে তাঁর মালফুযাত এবং মাওয়ায়েযের একটি বিশেষ আছর ও প্রভাব আছে।

আলহামদু লিল্লাহ! আমি আমার নদভী নিসবত, সাহিত্য ও ইতিহাসপ্রীতির রুচি ও বোধ, বরং সুষ্ঠু সমালোচনা ও পর্যালোচনার রুচিসহই মালফুযাত ও মাওয়ায়েয পড়েছি এবং এই পঠন থেকে ব্যাপক উপকৃত হয়েছি। আমি আপনাদেরকেও এগুলো পড়ার পরামর্শ দিচ্ছি। এই পঠনের মাধ্যমে আপনারা ধন-সম্পদের মোহ, পদ-সম্মানের মোহ এবং লেনদেনের নানা বিচ্যুতি সম্পর্কে জানতে পারবেন। বিশেষভাবে আখলাক-চরিত্রের সংশোধন এবং পারস্পরিক সম্পর্ক ও কাজের বিষয়ে তাঁর গ্রন্থাবলিতে বেশ জোর প্রদান করা হয়। আল্লাহ তাআলা বিশেষভাবে তাঁর দ্বারা এই কাজগুলো করিয়ে নিয়েছেন। আপনারা অবশ্যই তাঁর রচনাবলি, মালফুযাত ও মাওয়ায়েযের প্রতি মনোযোগী হবেন। এগুলোর একটি অংশ আপনাদের অবশ্যই পড়া থাকা উচিত।

দুই. যুহদ ও ইছার

ইসলামের ইতিহাস বিশেষ করে দাওয়াত ও আযীমতের ইতিহাস এবং ইসলামের ইসলাহী আন্দোলনের ইতিহাস একথা বলে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যামানা থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত সবসময় ইলম, মানব-কল্যাণ, ইসলাহ ও সংশোধনের কাজ এবং মানব সমাজে ব্যাপক কোনো পরিবর্তন আনয়নের কাজ- এই বিষয়গুলোর সাথে যুহদ ও ইছার তথা ত্যাগ ও কুরবানী এবং দুনিয়ার প্রতি নির্মোহতার গভীর সম্পর্ক আছে। এই দুই বিষয় সবসময়কার সঙ্গী। আপনি গোটা ইসলামী ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখুন, দেখবেন এ দুই বিষয় কখনো পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়নি। আল্লাহ তাআলা যাদের মাধ্যমে উম্মতে মুসলিমাহকে উপকৃত করেছেন বা কোনো ফেতনা থেকে হেফাযত করেছেন তাদের সবার মাঝে যুহদ ও ইছার তথা ত্যাগ ও কুরবানী এবং দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তির গুণ ছিল।

উম্মতের মাঝে সবচেয়ে বড় ফিতনা ছিল, ফেতনায়ে ইরতিদাদ। আর দ্বিতীয় ফিতনা ছিল খালকে কুরআনের ফিতনা। কতক লোক যেমনটি বলেছে-

نصر الله هذه الأمة بأبي بكر الصديق يوم الردة، وبأحمد بن حنبل يوم الفتنة.

এরপর ফালসাফা ও দর্শনের যে হামলা ছিল তার জন্য যারা আগমন করেছেন, ইমাম গাযালী হোক বা ইমাম আবুল হাসান আশআরী। পরবর্তীতে যে ফিতনাসমূহ সৃষ্টি হয়েছে তার মোকাবেলার জন্য ইমাম ইবনে তাইমিয়া ও অন্যান্যরা এসেছেন। হিন্দুস্তানে গাফলত ও বস্তুপূজার ফিতনা ছিল, ছিল সালতানাত ও সাম্রাজ্যের প্রভাবে তৈরি হওয়া মান-মর্যাদার পূজা। শক্তি-পূজা, সম্পদ-পূজা, নফসের পূজা। সূফিয়ায়ে কেরাম এইসব ফেতনাকে রোধ করেছেন। এরপর অমুসলিমদের প্রভাবে মুসলিম সমাজে যে বিদআত এবং শিরকী আকীদা-বিশ্বাস অনুপ্রবেশ করেছিল এবং ওয়াহদাতুল উজূদের যে বিরূপ প্রভাব দার্শনিক ও সূফীদের থেকে নিয়ে কবি-সহিত্যিকদের পর্যন্ত আক্রান্ত করে ফেলেছিল তার জন্য হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রাহ. আগমন করেন। অতঃপর ভারতে তাফসীর গ্রন্থের সহায়তা ছাড়া কেবল নিরেট কুরআন মাজীদের অধ্যয়ন এবং ব্যাখ্যাগ্রন্থকে উপেক্ষা করে নিরেট হাদীস অধ্যয়নের প্রবণতার কারণে সৃষ্টি হয়েছিল এক হিন্দুস্তানী জাহিলিয়্যাত, এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল আঞ্চলিক একটি প্রভাব। তৈরি হয়েছিল আকীদা-বিশ্বাসে চরম ভঙ্গুর দশা এবং ইত্তিবায়ে সুন্নাতের প্রতি প্রবল অনীহার পরিবেশ । এই সবকিছুর পথ বন্ধ করার জন্য আল্লাহ তাআলা শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলবী রাহ. এবং তাঁর বংশীয় উত্তরসূরী ও খলীফাগণকে তৈরি করেছেন। এই সকল মহান ব্যক্তিবর্গের সবাই ছিলেন যুহদ ও ইছারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

মোটকথা, ইসলামের গোটা ইতিহাস এই সাক্ষ্য দেয় যে, ইসলাহের কাজ, আযীমতের কাজ, উম্মতের জন্য উপকারী কাজ এগুলোর সাথে যুহদ ও ইছার তথা দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি এবং ত্যাগ ও কুরবানীর স্বভাবজাত কোনো সম্পর্ক আল্লাহ তাআলা কায়েম করে রেখেছেন। ইসলামের গোটা ইতিহাসে এর কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি।

তাই আমি আপনাদের পরিষ্কারভাবে বলছি, আপনারা ত্যাগ ও কুরবানীর গুণ এবং যুহদ ও দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তির গুণ নিজেদের মাঝে তৈরি করুন। কারণ, ত্যাগ-তিতীক্ষা ছাড়া এবং দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি ছাড়া অন্য কোনো জাতির মাঝেও বৃহৎ কোনো কাজ হয়নি। যদিও সেই কাজের প্রকৃতি ভিন্ন, ফলাফল ভিন্ন, সেগুলোর বিধান অন্য। তাই আমি অপনাদের অনুরোধ করব, নিজেদেরকে সস্তামূল্যে বিক্রি করে দিবেন না। ধন-সম্পদ ও পদমর্যাদাকে জীবনের লক্ষ্য বানাবেন না। কোনো জায়গা থেকে প্রস্তাব এল এবং সেখানে গেলে পার্থিব উন্নত জীবনের একটা আশার আলো দেখা গেল- এরকম হলেই আপনি চোখ বন্ধ করে সেখানে চলে যাবেন না; বরং আপনি ত্যাগ-তিতীক্ষা ও অনাসক্তির পথ ধরুন। এই যুহদ ও ইছারের আলোচনা দ্বারা কুরআন মাজীদ পূর্ণ হয়ে আছে। এ সম্পর্কিত কুরআন মাজীদের সকল আয়াত না আমি এখানে উল্লেখ করতে পারব আর না আপনাদের সামনে সব আয়াত উল্লেখ করার প্রয়োজন আছে।

ইতিহাস সাক্ষী, যুহদ ও ইছারের বদৌলতে যে স্বস্তি ও প্রশান্তি এবং যে সম্মান ও মর্যাদা লাভ হয় তা অন্য কোনো কিছু দ্বারা অর্জন করা যায় না। আর এটিই সেই জিনিস, যা লাখপতি ও কোটিপতির ভাগ্যে জোটে না। এক লোকমা খাবার কণ্ঠনালী থেকে নিচে নেমে পেটে যাওয়ার জন্য তারা কখনো কখনো অস্থির হয়ে পড়ে।

হিন্দুস্তানী এক বিত্তশালী বলত, আমার সকল সম্পদ নিয়ে নাও বিনিময়ে আমার হজমশক্তি ঠিক করে দাও, আমি যেন কিছু খেতে পারি। যুহদ ও ইছারের পরিচয় দিলে বাস্তব প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোর ব্যবস্থাও আল্লাহ তাআলা করে দেন। ইজ্জতের জীবনও আল্লাহ তাআলা দিয়ে দেন।

যদি অপ্রাসঙ্গিক কথা না হত তাহলে আমি বলতাম আমাকে এবং আমার কতক বন্ধুবরকে কেবল বুযুর্গ ও মুরব্বীদের দুআ ও ফয়যের বদৌলতে আল্লাহ তাআলা রক্ষা করেছেন। আমাদের পড়াশোনা ও অধ্যবসায়েরও কিছু প্রভাব ছিল। মোটকথা আল্লাহ তাআলা আমাদের রক্ষা করেছিলেন। তাই আজ আমরা এ পর্যায়ে আসতে পেরেছি। নতুবা আজ হয়তো কোনো ইউনিভার্সিটি বা কলেজ থেকে রিটায়ার্ড করে সামান্য যে পেনশন পেতাম তা দিয়ে নিজের গ্রামে দিন পার করতাম।

কিন্তু এ ধরনের প্রস্তাব যখন আসত তখন সবসময় বুযুর্গদের ঘটনবলি চোখের সামনে ভেসে উঠত। তন্মধ্যে কেবল মাওলানা আবদুর রহীম সাহেবের একটি ঘটনা শোনাচ্ছি। এ ধরনের ঘটনা বিরল।

নুযহাতুল খাওয়াতির গ্রন্থের শেষ খণ্ডে আব্বাজান রাহ. মাওলানা নাজমুল গণী সাহেব রামপুরীর বরাতে লিখেছেন যে, মাওলানা আবদুর রহীম ছাহেব মাকুলাত এবং রিয়াযিয়াতে (গণিতশাস্ত্রে) অনেক দক্ষ ছিলেন। তিনি প্রাচীন কিতাবাদি পড়াতেন। রামপুর রাজ্যের পক্ষ থেকে তাঁকে মাসিক পনেরো-বিশ রুপি করে দেওয়া হত। তাঁর শাস্ত্রীয় যোগ্যতা ও দক্ষতার কথা দূর দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। বেরেলীতে যখন প্রথম কলেজ প্রতিষ্ঠা হয় তখন কলেজের প্রিন্সিপাল মিস্টার হকিংস তাঁকে অফার করেন যে, আপনি বেরেলী কলেজে চলে আসুন। আপনাকে মাসিক দুশ রুপি বেতন দেওয়া হবে। তখন তিনি বড় সরলভাবে জবাব দিয়েছিলেন, আমার পনেরো রুপির বেতন তো বন্ধ হয়ে যাবে।

মিস্টার হকিংস বললেন, আপনি গণিতে এত দক্ষ অথচ আপনি পনেরো রুপি আর দুশ রুপির পার্থক্য বোঝেন না? তিনি প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, এখানে আমি যে ছেলেদের পড়াতাম তাদের পড়াশোনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। হকিংস বলছেন, তারা সবাই আমাদের কলেজে এসে আপনার কাছে পড়বে, সবাইকে স্কলারশিপ দিয়ে দেওয়া হবে। তিনি ফের বললেন, একটি বড় সমস্যা হল, আমার ঘরের সামনে একটি বড়ই গাছ আছে। এই গাছের তাজা ফল দিয়ে আমি নাশতা করি। সেখানে যাওয়ার পর এই তাজা ফল পাওয়া যাবে না। ফলে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে! ইংরেজ প্রিন্সিপাল তখন বললেন, ঐ ফলও ডাক বিভাগের মাধ্যমে সকাল সকাল আপনার কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। অবশেষে তিনি বললেন, এই সবকিছু না হয় হল, কিন্তু আপনি বলুন, কাল কিয়ামতের দিন যখন আল্লাহ তাআলা আমাকে প্রশ্ন করবেন যে, তুমি রামপুর ছেড়ে বেরেলী গিয়েছিলে কেবল এজন্য যে, এখানে পনেরো রুপি পেতে আর সেখানে দুশ রুপি পাবে, তখন আমি এর কী জবাব দেব? ইংরেজ তো ইংরেজই  ছিল। সে বলল, আমার কাছে এর কোনো জবাব নেই।

আমার প্রিয় ভাইয়েরা! আমি আপনাদের স্পষ্ট বলছি, এ ধরনের উদাহরণ পুনর্বার জন্ম নেওয়া উচিত। সকল আসমানী ছহীফা, আম্বিয়ায়ে কেরামের সীরাত এবং মুসলিহীনে উম্মতের ইতিহাস একথার সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ তাআলার ফায়সালা ও রীতি হল, তিনি তাঁর মাকবুল বান্দাদের যে ইজ্জত-সম্মান, মানসিক স্বস্তি ও শান্তি এবং রূহানী প্রশান্তি দান করেন এবং তাদের জীবনে যে বরকত নাযিল হয়- এই সবকিছু যুহদ ও ইছার তথা দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি এবং ত্যাগ-তিতীক্ষার উপরই নির্ভর করে।

এখন সেই সময় এসেছে, যখন যুহদ ও ইছারের বড় প্রয়োজন। বিশেষ করে হিন্দুস্তানের অবস্থা এখন এমন যে, এখানে যুহদ ও ইছারের খুব প্রয়োজন। বড় মন্দ প্রচলন শুরু হয়েছে এখন, যেখানে অর্থ-সম্পদ বেশি মিলবে, যেখানে অধিক আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা হবে, যেখানে নিজের পরিবারকে অপেক্ষাকৃত সচ্ছল ও উন্নত জীবন উপহারদেওয়া যাবে সেখানেই যাওয়ার কথা ভাবা হয়। এ বড় কঠিন পরীক্ষা। এ থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করা উচিত।

তিন. জুমহুরের মত ও পথ থেকে বিচ্যুত না হওয়া

এটি একটি অভিজ্ঞতাসঞ্জাত কথা এবং খুবই জরুরি একটা কথা। আমি চার মাযহাবের কিতাবাদি তুলনামূলক পর্যালোচনা করে পড়েছি। চার মাযহাবের বাইরের কিতাবাদিও তুলনামূলক পর্যালোচনা করে পড়েছি। সম্ভবত খুব কম লোকই এভাবে তুলনামূলক পড়াশোনা করে থাকে। আমার এই দীর্ঘ অধ্যবসায়ের সারনির্যাস হিসেবে আমি একটি গূঢ় তত্ত্বের কথা বলছি। জুমহুর আহলে সুন্নাতের পথ থেকে কখনো দূরে সরবেন না। এই কথাটি আপনারা লিখে রাখুন। আপনার মন-মস্তিষ্ক আপনাকে যা-ই বলুক না কেন, আপনার মেধা ও প্রতিভা আপনাকে যেখানেই নিয়ে যাক না কেন, যত শক্তিশালী দলীলই আপনি পান না কেন, জুমহুরের মত থেকে কিছুতেই সরবেন না।

জুমহুরের সাথে আল্লাহ তাআলার গায়েবী নুসরত ও সাহায্য আছে। ইতিহাসে এর অসংখ্য সাক্ষী রয়েছে। এর কারণ হল, আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা ছিল এই দ্বীনকে অক্ষুণœ রাখা, বাকি রাখা। আর বাকি রাখার অর্থ হল, নিজের আসল অবস্থার উপর থাকা। নতুবা বৌদ্ধধর্মের কী বাকি আছে? খ্রিস্টধর্মের কী বাকি আছে? খ্রিস্ট ধর্মের ব্যাপারে কুরআন যে শব্দ ব্যবহার করেছে (وَ لَا الضَّآلِّیْنَ) অর্থাৎ  তারা সত্য পথ থেকে সরে গেছে। তাদের সম্পর্কে এ শব্দের ব্যবহারও খোদ একটি মুজেযা। পক্ষান্তরে ইসলামের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেছেন-

اِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَ اِنَّا لَهٗ لَحٰفِظُوْنَ.

বস্তুত এ উপদেশ বাণী (কুরআন) আমিই অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই এর রক্ষাকর্তা। -সূরা হিজ্র (১৫) : ৯

ইসলামের সাথে আল্লাহ তাআলার যে গায়বী নুসরত আছে, যে শক্তিশালী দলীলের মাধ্যমে ইসলামকে জোরদার করা হয়েছে, মেধাবী থেকে মেধাবী ব্যক্তিরা এর জন্য যে মেহনত ও চেষ্টা-ফিকির করেছেন, উন্নত চিন্তা ও উন্নত হৃদয়ের অধিকারী ব্যক্তিবর্গ এর জন্য যে বিপুল পরিমাণ সময় দিয়েছেন, ইসলামের জন্য তাদের মনে যে এহসাসও জ¦লন ছিল- এ সব কিছু অন্য কোনো ধর্মের ভাগ্যে জোটেনি। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে এই দ্বীন এখনো সংরক্ষিত আছে। জুমহুরের চেষ্টা-ফিকির ও মেহনত-মুজাহাদার বদৌলতে সব ধরনের বিকৃতি ও বিচ্ছিন্ন মত ও পথ থেকে দ্বীন ও শরীয়ত নিরাপদ আছে। তাই জুমহুরের পথ থেকে দূরে যাওয়া ঠিক নয়।

একথা আমাদের এবং আপনাদের উস্তায সায়্যিদ সুলাইমান নদভী রাহ. তাঁর এক শাগরেদকে বলেছিলেন। মাওলানা উয়াইস ছাহেব বিষয়টি বর্ণনা করেছেন। আর সায়্যিদ সুলাইমান নদভীকে একথা তাঁর উস্তায সায়্যিদ শিবলী নোমানী রাহ. বলেছিলেন।

অনেক লোক বাহ্যিক কুশলতাপূর্ণ লেখা পড়ে ধোঁকায় পড়ে যায়-

وَ مِنَ النَّاسِ مَنْ یُّعْجِبُكَ قَوْلُهٗ فِی الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا وَ یُشْهِدُ اللهَ عَلٰی مَا فِیْ قَلْبِهٖ وَ هُوَ اَلَدُّ الْخِصَامِ.

আর মানুষের মধ্যে এমন লোক আছে, পার্থিব জীবন সম্বন্ধে যার কথাবার্তা তোমাকে চমৎকৃত করে আর তার অন্তরে যা আছে সে সম্বন্ধে সে আল্লাহকে সাক্ষীও বানায়, অথচ তোমার শত্রুদের মধ্যে সে সর্বাপেক্ষা কট্টর। -সূরা বাকারা (২) : ২০৪

জুমহুর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এরা ভয়ঙ্কর বিভ্রান্তির শিকার হয়। কিছু উদাহরণ দেখুন, তারা কেউ শহীদদের নিয়ে পরিহাস করে, কখনো সালাফের মনীষী আলেমগণকে নিয়ে পরিহাস করে। কখনো মুফাসরিরীনে কেরাম তাদের সমালোচনার লক্ষ্যবস্তু হন।

যাই হোক, নিজেকে সর্বাবস্থায় জুমহুরের মাসলাকের সাথে জুড়ে রাখবেন। এর দ্বারা আপনার জীবনে অনেক ফায়েদা দেখতে পাবেন। আল্লাহ তাআলার খাস নুসরত ও বরকত হবে এবং এর বদৌলতে হুসনে খাতেমাও হবে।

এই ছিল আমার মনের কিছু কথা, যা আমি হয়তো আপনাদের খুব হৃদয়গ্রাহী আকারে উপস্থাপন করতে পারিনি। কিন্তু, আমি আশা করব আপনারা এগুলোকে বাস্তবতার মর্যাদা দান করবেন। এগুলো আমার দীর্ঘ অধ্যবসায় এবং দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ফসল। আল্লাহ তাআলার ফযল ও করমে এ কথাগুলো পর্যন্ত আমি পৌঁছাতে পেরেছিলাম। আর এখন এগুলো আপনাদের কাছে আমানত হিসেবে দিয়ে যাচ্ছি এবং আপনাদের এগুলো মেনে চলার অসিয়ত করছি।

চার. ইলম অন্বেষণে নিমগ্ন থাকা

শেষ কথা হল, নিজেকে ইলম অন্বেষণে নিমগ্ন রাখুন। নিজেকে কখনো ফারেগুত তাহসীলমনে করবেন না। আপনি যেখানেই থাকুন হাতের কাছে থাকা পুরনো কিতাবাদি কিংবা নতুন ছাপা কিতাবাদি পড়তে থাকবেন, কুরআন মাজীদের তাফসীর গ্রন্থ, হাদীসের শারহ ও ভাষ্যগ্রন্থ, তারিখ ও ইতিহাস গ্রন্থাবলি  পড়বেন। ইলমে কালাম সম্পর্কে লিখিত যে কিতাবগুলো সহীহ আকীদার উপস্থাপনের লক্ষ্যে সঠিক পন্থায় লেখা হয়েছে সেগুলোও পড়া যেতে পারে। এই গ্রন্থাবলির সাথে যেন আপনার সম্পর্ক থাকে। আপনি সর্বাবস্থায় এগুলো মুতালাআয় রাখবেন এবং নিজের মারকাযের সাথে সবসময় সম্পর্ক কায়েম রাখবেন-

پیوستہ  رہ شجر سے، امید بہار رکھ .

(মর্ম :) হে বৃক্ষশাখা! নিজেকে বৃক্ষের সঙ্গে যুক্ত রাখো, আগত বসন্তের আগমনে বৃক্ষের সঙ্গে তুমিও সজীব ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে। মনে রেখো, বিচ্ছিন্ন বৃক্ষশাখায় বসন্তের আগমনে প্রাণের সঞ্চার ঘটে না। -ইকবাল, বাঙ্গে দারা

 

[সূত্র : তামীরে হায়াত, লক্ষ্মৌ, ২৫ মার্চ ১৯৮৮ ঈ.

ভাষান্তর : মাওলানা হুজ্জাতুল্লাহ]

 

১. ভারতে মোহাম্মদ আহমদ খান নামক এক ব্যক্তি ১৯৭৮ ঈ. তার স্ত্রী শাহ বানুকে তালাক প্রদান করলে শাহবানু স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করেন এবং খোরপোষ দাবি করেন। সুপ্রিম কোর্ট তার পক্ষে রায় প্রদান করে এবং ইদ্দত পূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও পুনর্বিবাহ হওয়ার আগ পর্যন্ত আজীবন তাকে খোরপোষ প্রদানের নির্দেশ প্রদান করে। ২৩ এপ্রিল ১৯৮৫ ঈ. এই রায় প্রদান করা হয়। এ রায় ছিল ইসলামী শরীয়তের পরিপন্থি। ইসলামী শরীয়া মোতাবেক তালাকপ্রাপ্তা নারীর ইদ্দত পালনকালে খোরপোষের দায়িত্ব তার স্বামীর। ইদ্দতের পর সামর্থ্যবান হলে তার নিজের। সামর্থ্যবান না হলে শরীয়া কর্তৃক নির্ধারিত নিয়ম অনুসারে পিতা কিংবা ভাই কিংবা সন্তান অথবা অন্য নিকটাত্মীয়ের।

আদালতের উক্ত রায় মুসলিম পারিবারিক শরীয়া আইনের পরিপন্থি হওয়ায় অল ইন্ডিয়া পার্সোনাল লবোর্ডেরউদ্যোগে রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করা হয়। ৩০ জুলাই ১৯৮৫ একটি প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের জন্য যান। ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬ ঈ. সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ.-কে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। এরপর প্রধানমন্ত্রীর সাথে আবুল হাসান আলী নদভী রাহ. ও মিন্নাতুল্লাহ রাহমানী রাহ.-এর কয়েকবার বৈঠক হয়। এরই প্রেক্ষিতে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী মুসলিমদের এই ন্যায্য দাবি মেনে নেন। অতঃপর ৬ মে ১৯৮৬ ঈ. পার্লামেন্টে মুসলিম নারীদের সম্পর্কে উক্ত শরীয়া আইনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে একটি বিল পাশ করা হয়।

সূত্র : কারওয়ানে যিন্দেগী, আবুল হাসান আলী নদভী, ৩/১১৬-১৫১; অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল লবোর্ড : খিদামাত আওর সারগরমিআঁ; প্রকাশক : অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল লবোর্ড, পৃষ্ঠা ৬৫-৬৬ (অনুবাদক)

 

 

advertisement