নারী : ছাত্রীদের সুশিক্ষা ও মেধাবিকাশ কোন পথে
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বোরকা পরতে বাধ্য করা যাবে না-মর্মে গত আগস্টে এদেশের উচ্চআদালত থেকে একটি রায় দেওয়া হয়েছে। মেনে নেওয়া ও প্রশংসা করা ছাড়া উচ্চআদালতের কোনো রায় সম্পর্কে কোনো রকম মন-ব্য করা যায় না। আদালত-অবমাননা বিষয়ক আইন রয়েছে এবং সে আইন প্রয়োগের কঠিন দৃষ্টান-ও এরই মধ্যে স্থাপিত হয়েছে। সেজন্য এসব বিষয়ে পরিপূর্ণ সংযম অবলম্বন না করা অনিরাপদ ও বিপজ্জনক। কিন্তু সে রায়টির সূত্র ধরে জারি করা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন সম্পর্কে আমরা আলোচনা করতে পারি।
উচ্চআদালত কর্র্তৃক রায় ঘোষণার কয়েক দিনের মধ্যেই শিক্ষামন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জারি করা একটি প্রজ্ঞাপন বা নির্দেশপত্রের খবর সংবাদপত্রগুলোতে গত ২৬ ও ২৭ আগস্ট প্রকাশিত হয়েছে। প্রজ্ঞাপনের মূল বক্তব্য হিসেবে সংবাদপত্রে যা প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, দেশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদেরকে বোরকা পরতে বাধ্য করা যাবে না। একই কারণে কোনো ছাত্রীকে নির্যাতন, হয়রানি ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না। পাশাপাশি বোরকা কিংবা ধর্মীয় পোশাক পরতে বাধ্য করা এবং ছাত্রীদের খেলাধুলা ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বাধা দেওয়া অসদাচরণ হিসেবে গণ্য হবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
২৫ আগস্ট শিক্ষাসচিব-স্বাক্ষরিত এক পরিপত্রে আরও বলা হয়েছে, সরকারি-বেসরকারি কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত ছাত্রীদের বোরকা পরতে বাধ্য করা হচ্ছে মর্মে সমপ্রতি কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ সরকারের গোচরে এসেছে। ছাত্রীদের সুশিক্ষা ও মেধাবিকাশের জন্য বোরকা পরতে বাধ্য করা এবং খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কাজকর্মে অংশগ্রহণে বাধা দেওয়া কোনোক্রমেই কাম্য নয়। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মানবাধিকার সংরক্ষণের লক্ষ্যে এসব নির্দেশনা জারি করা হল। এই নির্দেশ অমান্যের অভিযোগ পাওয়া গেলে শিক্ষামন্ত্রণালয়, শিক্ষাঅধিদপ্তর ও শিক্ষাবোর্ড তদন-পূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’
শিক্ষামন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জারি করা যেকোনো প্রজ্ঞাপন সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটিকে কোনো অবস্থাতেই হালকা দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ নেই। প্রজ্ঞাপনটিকে শিরোধার্য ধরেই বহু শিক্ষক, শিক্ষাবিদ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান ব্যক্তিগত আলাপচারিতা, বৈঠকী আলোচনা ও লেখালেখিতে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু প্রশ্ন তুলে ধরেছেন। গুরুত্ব বিবেচনায় সেসব প্রশ্নের একটি নমুনা এখানে তুলে ধরা যেতে পারে।
এক. দেশে বিদ্যমান সহস্রাধিক মহিলা-মাদরাসার ছাত্রীদের ক্ষেত্রে কি এ প্রজ্ঞাপন অনুসরণ করা সম্ভব? যেসব ছাত্রী মহিলা-মাদরাসায় ভর্তি হন কিংবা তাদের অভিভাবকরা তাদেরকে ভর্তি করান ইসলামী শিক্ষা গ্রহণ ও ইসলামী অনুশাসন অনুশীলনের জন্যই তারা তা করেন। মহিলা-মাদরাসায় বোরকা পরে আসার ক্ষেত্রে এবং এ বিষয়ক বাধ্যতামূলক আইন থাকার ক্ষেত্রেও তাদের মাঝে কোনো অশ্বস্তি ও ভিন্নমত থাকার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এ প্রজ্ঞাপনটির কারণে কু-মতলবে কিংবা অনুপ্রবেশকারী হিসেবে কোনো ছাত্রী কোনো মহিলা-মাদরাসায় ভর্তি হওয়ার পর যদি বোরকা পরতে অস্বীকার করে তখন মাদরাসা-কর্তৃপক্ষ কী করবেন? তারা কি প্রজ্ঞাপন মেনে বোরকাহীন মেয়েটির দুর্বিনীত আচরণ মেনে নেবেন, নাকি ওই ছাত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে প্রজ্ঞাপনের নির্দেশ লঙ্ঘন করবেন?
দুই. এই প্রজ্ঞাপনে ‘ছাত্রীদের সুশিক্ষা ও মেধাবিকাশের জন্য’ এবং ‘মানবাধিকার সংরক্ষণের লক্ষ্যে’ কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মাত্র কয়েক মাস আগে ইডেন কলেজে যখন আবাসিক ছাত্রীদের দেহব্যবসায় বাধ্য করার খবর ব্যাপকভাবে সংবাদপত্রে প্রচার হয়েছে তখনও বহু প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে। তখন কি ‘ছাত্রীদের সুশিক্ষা ও মেধাবিকাশের জন্য’ এবং ‘মানবাধিকার সংরক্ষণের লক্ষ্যে’ শিক্ষামন্ত্রণালয় কোনো প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল? মহিলাকলেজ, মহিলা হোস্টেলগুলোর নিরাপত্তা এবং ছাত্রীদের জীবন ও সম্ভ্রম রক্ষায় মন্ত্রণালয়ের নীতিগত কোনো নির্দেশনা তখন কেন এল না? ছাত্রীরা বোরকা পরলেই ‘সুশিক্ষা ও মেধাবিকাশ’ স্তব্ধ হয়ে যায়? তবে কি যৌবন ও সম্ভ্রম লুট হওয়ার ঘটনা ঘটলে এবং লুট করার ফাঁদ পাতা থাকলেও ছাত্রীদের ‘সুশিক্ষা ও মেধাবিকাশ’-এর কোনো ক্ষতি হয় না? পরিপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, ছাত্রীদের প্রকাশ্যে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কাজকর্ম বন্ধ থাকলে ‘মানবাধিকার সংরক্ষিত’ থাকে না। তবে কি রাতের পর রাত হোস্টেল থেকে প্রলোভন দিয়ে বিপথগামী করে কিংবা জোরপূর্বক দেহব্যবসায় পাঠালে তাদের ‘মানবাধিকার সংরক্ষিত’ই থাকে?
তিন. যে সময়টাতে তরুণ-তরুণীদের অবাধ দেখা-সাক্ষাত ও মেলামেশার সুযোগে কথিত ইভটিজিং বা তরুণী উত্যক্তকরণের ঘটনা দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করছে, যার বেশির ভাগই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক, সে সময়টাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বোরকা বিষয়ে এ ধরনের নেতিবাচক নির্দেশনার ফল কী দাঁড়াতে পারে? ইভটিজিংয়ের ঘটনায় বখাটে তরুণদের অপরাধ ও দোষকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এ কথা তো মিথ্যা নয় যে, তরুণীদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েই তারা বখাটেপনার কুপথে নামে। এসব পর্যায়ে পোশাকের শালীনতা, বোরকায় আবৃত থাকা আর সৌজন্যমূলক দূরত্ব বজায় রাখার নীতি বাদ দিয়ে কেবল বোরকার ওপর খড়গহস্ত হলেই কি ‘ছাত্রীদের সুশিক্ষা ও মেধাবিকাশ’ নিরাপদ হবে?
চার. শিক্ষামন্ত্রণায়লয়ের এ প্রজ্ঞাপনটিতে ছাত্রীদের বোরকা পরতে বাধ্য করা যাবে না, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কাজকর্মে বাধা দেওয়া যাবে না-শুধু এ ধরনের একতরফা নির্দেশনাই দেওয়া হল। কিন্তু যে ছাত্রী বোরকা পরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসতে অভ্যস্ত তাকে কোনোভাবেই বিব্রত করা যাবে না, বোরকা না পরে আসতে বাধ্য করা যাবে না-এ ধরনের কোনো নির্দেশনা কেন থাকল না? যে ছাত্রী প্রকাশ্যে খেলাধুলা করতে চায় না, সাংস্কৃতিক কাজকর্মে জড়াতে চায় না, তাকে সেসব কাজে বাধ্য ও প্ররোচিত করা যাবে না-এ নির্দেশনাও তো থাকতে পারত? কিন্তু এসব প্রশ্নের মীমাংসা মন্ত্রণালয়ের সে পরিপত্রে নেই।
আশাবাদী থাকাটাই কল্যাণকর। শিক্ষামন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ওই প্রজ্ঞাপনের প্রেক্ষিতে ওঠে আসা এসব প্রশ্ন নিয়ে কিছু না কিছু ভাববেন বলেই আমরা আশা করি। শিক্ষামন্ত্রণালয় তো আর আদালত নয়, তাদের তো জবাবদিহিতা আছে। কিছু করলে সঙ্গতিপূর্ণভাবেই তাদের করা উচিত। আর আদালতের রায় নিয়ে আমরা কথা বলতে যাব না। আইনের বাধ্যবাধকতা আছে। আমাদের ডর-ভয়ও আছে।