সফর ১৪৪৩   ||   সেপ্টেম্বর ২০২১

উম্মাহ ইস্যু : একপেশে প্রচারের চোখ

মাওলানা শরীফ মুহাম্মাদ

যেন স্বাভাবিক ও সঙ্গত প্রচারের আবহটা থাকে এমনই। এমনকি কখনো কখনো মনে হতে থাকে, দরকার ও প্রাসঙ্গিকতাটাও বেশি এভাবেই প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাবার। ইসলামের কোনো অনুশাসন ও মুসলিম উম্মাহ সংশ্লিষ্ট কোনো ইস্যুতে উল্টো ও বিরুদ্ধবাদী প্রচারের সময় এমন একটি অপরিহার্যতার বোধ ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সময়ে সময়েই ইসলামোফোবিক এই আতঙ্ক-আক্রান্ত মিডিয়া-প্রচারণার একপেশে চেহারা দেখতে পাওয়া যায়। বিশেষ কোনো ইস্যু সামনে এসে দাঁড়ালে এই একপেশে প্রচারের মাত্রা ও ধারণাটিও বিশেষরকম হয়ে ওঠে। মজলুম মুসলিমদের কোনো ভূখ- ও গোষ্ঠীকে উপর্যুপরি একপেশে উপেক্ষা ও অপপ্রচারের শিকার বানিয়ে পরিস্থিতি বিষিয়ে তোলা হয় এবং একটি ইস্যু বা জানালা ধরে সামগ্রিকভাবে ইসলাম ও উম্মাহর বিরুদ্ধে অপপ্রচারের বাজার গরম করে তোলা হয়।

মূলত মুসলিম উম্মাহ বিরোধী এই একতরফা ও একপেশে অপপ্রচারের স্রােতটি প্রবাহিত করা হয় নির্দিষ্ট কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করে এবং নির্ধারিত লক্ষ পূরণের টার্গেট নিয়ে।

দুই.

আগস্টের মাঝামাঝি সময় থেকে মুসলিম দেশ আফগানিস্তান ও তালেবান সংশ্লিষ্ট খবরাখবরে চোখ পড়লেই দেখা যাচ্ছে, তালেবানের উত্থানের কারণে সম্ভাব্য নানা সঙ্কটেরগল্পে বিশ্ব গণমাধ্যমের প্রভাবশালী পাতা-পোর্টাল ও স্ক্রীনগুলো মুখর হয়ে আছে। ২০ বছরে সাম্রাজ্যবাদী ও তল্পিবাহীদের নির্বিচার আঘাত-আক্রমণে কী কী হয়েছে- সেখান থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আর তালেবানের হাতে কল্পিত ভবিষ্যত-বিপর্যয়েরপ্রতিবেদন দিয়ে চেষ্টা করছে দর্শক-পাঠকের মগজ দখলের। মুসলমানদের ২০ বছরের ক্ষয়ক্ষতি ও দুঃখের সমুদ্র গায়েব করে দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র ও তাদের তল্পিবাহীদের কল্পিত নিরাপত্তা শংকানিয়ে চারদিক ভারাক্রান্ত করে তোলা হচ্ছে। এক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃতভাবেই গণমাধ্যমের একপেশে ব্যবহারে হৃদয়স্পর্শী বিশাল বেদনার ইস্যুগুলো থেকে মানুষের চোখ সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বায়বীয় ইস্যুর দিকে। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত আফগানের লাখো লাখো এতীম, বিধবা ও দুঃখীজনের জীবনের প্রয়োজনীয়তার প্রশ্নগুলো গায়েব করে দিয়ে সামনে আনা হচ্ছে বিদেশি অনুচরদের ভয়-ভীতি ও পলায়নের দুঃখীদাস্তান।

বারবার এ-জাতীয় ও একপেশে রিপোর্ট-প্রতিবেদন বিশ্লেষণ, ফলোআপ প্রচার করে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ার এ কাজটি করছে। পাশ্চাত্য-গণমাধ্যম তাদের গুটিকয়েকের স্বাচ্ছন্দ্য ও শংকার পেরেশানিকে দুনিয়ার মাথাব্যথায় পরিণত করে দিচ্ছে। একই সঙ্গে মুসলিম উম্মাহ ও রাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট ইস্যুকে চোখের সামনেই আসতে দিতে চাচ্ছে না, দিচ্ছে না। আর এটা করা হচ্ছে সম্পূর্ণভাবেই দর্শক-পাঠকের মাথা ও চোখ রদবদলের একটি কৌশলী উপস্থাপন প্রক্রিয়ার সাহায্য নিয়ে; যার প্রায় পুরোটাই চাতুর্যপূর্ণ ও ধূর্ত গণমাধ্যম মিশনের অন্তর্ভুক্ত। ভালো, কল্যাণকর ও দরকারি জিনিস শুনতে-দেখতে না দিয়ে বিপরীত জিনিসের মধ্যে মানুষের চিন্তা-বুদ্ধি, মনোযোগ আটকে রাখার এ এক পুরোনো কূট-কৌশল। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

وَ قَالَ الَّذِیْنَ كَفَرُوْا لَا تَسْمَعُوْا لِهٰذَا الْقُرْاٰنِ وَ الْغَوْا فِیْهِ لَعَلَّكُمْ تَغْلِبُوْنَ.

এবং অবিশ্বাসীরা বলে, তোমরা এই কুরআন শুনো না, বরং কুরআন পাঠের সময় হৈ-হট্টগোল করো। হয়তো এতেই তোমরা বিজয়ী হবে। -সূরা ফুসসিলাত (৪১) : ২৬

তিন.

এই মধ্য আগস্টের আফগান-তালেবান ইস্যুই গণমাধ্যমের এই চাতুর্য ও চোখ-সরানো নীতি বোঝার জন্য একমাত্র নগদ উদাহরণ নয়। এখন এই ইস্যুটি খুব তাজা হয়ে সামনে এলেও কয়েক মাস আগের ফিলিস্তিন ইস্যু, গাজায় হামলা, পশ্চিম তীরে বায়তুল মোকাদ্দাসের পাশে ঐতিহাসিক বসতি শেখ জাররাহর মুসলিম বাড়িঘর দখল ইস্যুর সময়ও গণমাধ্যমের এমন একপেশে চরিত্র দেখা গেছে। পশ্চিমা কিছু কিছু গণমাধ্যম কোনো কোনো সময় সত্য ঘটনা ও প্রকৃত নিউজের কিছু চিত্র পেশ করতে চাইলেও বেশির ভাগ সময়ে তাদের একচোখা দুর্বিষহ পক্ষপাতের আয়োজন-উপস্থাপনই চোখে পড়েছে। শুধু দুনিয়ার চোখ, সমর্থন ও সহানুভূতির গতি ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য তাদের এসব কসরত।

এর আগেও আপনি এমন একপেশে প্রচার ও তথ্যের বিকৃত মেনিপুলেশন দেখতে পেয়েছেন। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা এবং ভারতের দিল্লি ও কাশ্মীরে মুসলিম-বিরোধী ব্যাপক হত্যা ও দমন অভিযানের সময়ও গণমাধ্যমের চাতুর্য চোখে পড়েছে। এর সবই গত কয়েকদিন থেকে কয়েক বছরের মধ্যের চিত্র। গণমাধ্যমে চোখ আছে এবং বুঝবুদ্ধির মাথা ও কান খোলা এমন প্রায় প্রতিটি মানুষই এইসব ঘটনার একপেশে উপস্থাপন ও বিশ্লেষণ সম্পর্কে সচেতন। অনেকসময় মূলধারার বহু গণমাধ্যমে নিউজ উপস্থাপনে একপেশে আয়োজনের বিষয়টি এককভাবে স্পষ্ট ধরা না গেলেও একই রকম অন্য ঘটনার তুলনায় মুসলিম সংশ্লিষ্ট বেদনাবহ ও মজলুমিয়্যাতের ঘটনাগুলো কম আয়োজনে, কম সময়ে ও সল্প পরিসরে উপস্থাপনের বিষয়টি বুঝতে মোটেও বেগ পেতে হয় না এবং একই সময়ে অন্য কিছু মানবিক ও আবেগস্পর্শী ইস্যুকে সামনে নিয়ে এসে এজাতীয় বেদনার ইস্যুকে চাপের মধ্যে রাখার একটি চাতুর্যও বেশ প্রকটভাবে লক্ষণীয় হয়ে ওঠে।

এ ছাড়াও প্রকৃত ইস্যু থেকে চোখ সরিয়ে নেওয়ার নানারকম উপলক্ষ দাঁড় করাচ্ছে সাম্প্রতিককালে ফেইসবুক বা প্রধান সামাজিক মাধ্যম। মুসলিম উম্মাহর আবেগযুক্ত ইস্যু কিংবা মুসলিম বিরোধী তা-বের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন পক্ষের বর্ণনা প্রকাশ করলে সামাজিক মাধ্যম থেকে ওই আইডি ও পোস্ট নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ছবি-ভিডিও-টেক্সট মুছে দেওয়া হয়। শব্দ ও বিষয়ের অটো কমা-বসিয়ে উম্মাহ-সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ন্ত্রণে নানারকম শাস্তি, স্থগিত প্রক্রিয়া এবং দীর্ঘমেয়াদী নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনার ব্যবস্থা করা হয়। দরকারি ইস্যুটি যেন উচ্চারিত না হয় কিংবা ওইদিকে যেন মানুষের চোখ না যায় সেজন্যই সামাজিক মাধ্যমে এসব ব্যবস্থাপনা সচেতনভাবে অবলম্বন করা হয়।

চার.

গণমাধ্যমের বড় অংশটির এসব চাতুর্যের একটি ফল হচ্ছে, ইস্যু বদলে দেওয়া অথবা প্রধান ইস্যুর দিক থেকে গণমানুষের চোখ ও মনোযোগ সরিয়ে দেওয়া। অপর একটি পরিণতিও থাকে তাদের সিদ্ধান্তে। সেটি হল, প্রকৃত দোষীর দিক থেকে মানুষকে বিমুখ করে দিয়ে কল্পিত দোষ ও দায়ের সঙ্গে মজলুম মুসলমানদের যুক্ত করে দিয়ে অভিযোগের চোখ তাদের দিকে তাক করার ব্যবস্থা করা। এরই একটি অনুশীলন হল, ২০ বছরের যুদ্ধে যাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তাদের কথা ভুলে গিয়ে যে কয়েকজন অনুচর-ধরনের মানুষের ক্ষতি হওয়ার আশংকা আছে তাদের জন্য আগেই ব্যাপক মাতম শুরু করা।

একপেশে প্রচারের এ-জাতীয় কৌশলের তৃতীয় একটি লক্ষ্য হল, দেশে দেশে মুসলিমদের চিন্তা ও মানসের ধরন বদলে দেওয়া। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তাদের তল্পিবাহী গোষ্ঠীর প্রতি সমর্থনের মিডিয়া-কসরতের মধ্যে মজলুম মুসলমানদের প্রতি অসহযোগিতার মনোভাব ছড়িয়ে দেওয়া। বিশেষত মুসলিম দেশগুলোর কথিত শিক্ষিত হীনম্মন্যতাগ্রস্ত সুশীল শ্রেণির পরানুকরণ-প্রিয় ও সংহতি-রহিত পরাজিত মানসিকতার মধ্যে আরো একটু  দূরত্ববাচক গতি  তৈরির চেষ্টা করা। বারবারের উল্টো প্রচারে মুসলমানদের নিজেদের বোধ ও চিন্তায় আত্মবিশ্বাস ও সহানুভূতির বিরোধ তৈরি করা।

পশ্চিমা সমাজের দার্শনিক খুঁটি, সামাজিক জীবন ও রাজনীতির ডালপালার সঙ্গে তাদের গণমাধ্যমের প্রতিনিধিত্বের রসায়নটি যথেষ্ট কার্যকর। এইসব একচোখা ও একপেশে প্রচারের একটি গড় মুনাফা তারা হাতিয়ে নেয় অন্যভাবেও। কোনো একটি মুসলিম দেশ ও গোষ্ঠীকে টার্গেট করে প্রচার-অপপ্রচারের খেলা শুরু করতে গেলে প্রায় শুরু থেকেই তারা ইস্যুটিকে ব্যাপকায়ন করে ইসলামী জীবন ও উম্মাহ ধারণার সবকিছুকেই আঘাত করার খোলামেলা সুযোগ নিতে থাকে। আফগান-তালেবানের সমালোচনার পথ ধরেই নারীর পর্দা, ইসলামী অনুশাসন ও শিক্ষার সবকিছুকে ঢালাওভাবে তীরবিদ্ধ করতে ছাড়ছে না এবং একইসঙ্গে আতঙ্কের পোশাক গায়ে চড়িয়ে দিয়ে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান, রাষ্ট্রকাঠামো ও জীবনের নীতি-বিধির প্রতি প্রশ্ন ও কটাক্ষের বাজার উসকে দেওয়ার সব চেষ্টাও করে যাচ্ছে।

অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদ চালায় ভূমি, সম্পদ ও ক্ষমতার ময়দানি লড়াই। আর লড়াইয়ে অনুকূল্য তৈরি করতে তাদেরই নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমের নানান কলকব্জা ব্যবহার করে মুসলমানদের সমাজে বিছিয়ে দেয় তারা মানসিক সমর্থন-অনুকরণের ধুসর জাল।

পাঁচ.

পশ্চিমা গণমাধ্যমের একপেশে সাজানো প্রচারের ছক ধরে চিন্তা না করাই হচ্ছে সচেতন মুসলমানের কাজ; অন্তত দ্বীন ও উম্মাহ ইস্যুতে। এসব অপপ্রচার ও উম্মাহর ভিতর অসংহতি উসকে দেওয়া উদ্দেশ্যমূলক ইস্যু-রূপান্তরের কৌশল সম্পর্কে সচেতন হওয়া ছাড়া এদের ফাঁদ ভেদ করা কঠিন। অথচ ধূর্ত ও ষড়যন্ত্রমূলক প্রচারের ফাঁদ ভেদ করেই স্বাতন্ত্র্য ধরে রাখতে হবে। অবশ্য অনেক সময় এতসব কৌশল ও চাতুর্যের মধ্যেও আল্লাহ তাআলার কুদরতি ইশারায় বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারীদের অনেক রকম জারিজুরির নকশাটাও উল্টে যায়।

২৩ আগস্ট যখন লেখাটি তৈরি হচ্ছে, তার এক দিন আগেই কাবুল-ফেরত এক ভারতীয় বাঙালি (তমাল ভট্টাচার্য) ভারতীয় গণমাধ্যমের নানামাত্রিক আতংক জাগানিয়াগল্প-কাহিনীর বেলুন পুরোপুরি ফুটো করে দিয়েছেন। বিমানবন্দরে দেওয়া তার এক সাক্ষাৎকারের ফুটেজ এখন দেশে-বিদেশের অন্তর্জালে ঝড় তুলেছে। সেই বেচারাতো ভারতীয় প্রোপাগান্ডার বিপরীত পারে দাঁড়িয়ে কাবুলে নগদ শরীয়া আইনের সুফলের প্রশংসাও শুনিয়ে দিয়েছে দুনিয়াকে। আসলে একপেশে প্রচার হচ্ছে একটি পরিকল্পিত উদ্দেশ্যমূলক প্রোগ্রাম আর বাস্তব ও স্বাভাবিক সত্য আল্লাহ তাআলা অনেক সময় সামনে এনে দেন সব মিথ্যার চাদর ভেদ করে। হঠাৎ কালের দেয়ালে সত্যের পোস্টার এভাবেই সজ্জিত হয়ে ওঠে।

পৃথিবীর মানুষের সামনে হক ও সত্যের উচ্চারণ করে যাওয়া এবং বারবার সত্যের কথা তুলে ধরা মুমিনের এক শাশ্বত জীবন ধারা, সত্য প্রচারের এক বিরতিহীন মিশন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

وَّ ذَكِّرْ فَاِنَّ الذِّكْرٰی تَنْفَعُ الْمُؤْمِنِیْنَ.

এবং আপনি মনে করিয়ে দিন, নিশ্চয়ই এই মনে করিয়ে দেওয়াটা মুমিনদের উপকৃত করবে। -সূরা যারিয়াত (৫১) : ৫৫

মিথ্যার প্রলেপ কিংবা চাপা দেওয়া ইস্যুর পরিবর্তে সত্য ও মানবতার ইস্যু, মজলুম উম্মাহর ইস্যু, হক ও ইনসাফের ইস্যু বারবার সামনে তুলে ধরার দায়িত্বও এ উম্মাহর সচেতন সদস্যদের পালন করে যেতে হবে। তবেই দূর হবে একপেশে বিভ্রান্তির প্রচার। হ

 

 

advertisement