নতুন বিভাগ : ‘আনওয়ারুল কুরআন’
আসুন কুরআন থেকে আলো গ্রহণ করি
الحمد لله، وسلام على عباده الذين اصطفى، وأشهد أن لا إله إلا الله، وأشهد أن محمدا عبده ورسوله، خاتم النبيين لا نبي بعده، فلا كتاب بعد الكتاب المنزل عليه، ولا شريعة بعد الشريعة التي جعله الله تعالى عليها، ولا أمة بعد أمته، صلوات الله عليه وسلامه، وعلى آله الأطهار الطيبين، ورضي الله عن صحابته الكرام، الغر الميامين، الذين هم سيد الخلائق بعد الأنبياء عليهم الصلاة والسلام، أما بعد:
আমরা আমাদের জীবনের প্রতিটি ধাপে আলোর মুখাপেক্ষী। দিবসের আলোর জন্য আল্লাহ আমাদের সূর্য দান করেছেন। আর রাতের জন্য দান করেছেন জ্যোতির্ময় চন্দ্র। এছাড়া আলো গ্রহণের আরো অনেক পন্থার জ্ঞান আল্লাহ তাআলা মানুষকে দান করেছেন। আমাদের চোখে দেখা যে আলো-আধার দু’টোই আমাদের প্রয়োজন। চিন্তা করলে অন্ধকারেরও বিভিন্ন প্রয়োজন ও উপকারিতা স্পষ্ট হবে। ঘুম ও বিশ্রামের জন্য এর প্রয়োজন সবাই বোঝেন অথচ এই অন্ধকার থেকে বের হওয়ার জন্যও আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে আলো দান করেছেন। তাহলে এটা কীভাবে সম্ভব যে, বিশ্বাস ও কর্মের অন্ধকার, যা সবদিক থেকে মন্দ, যাতে নিমজ্জিত থাকা কারোই কাম্য নয়; বরং তা থেকে বের হওয়া সবার জন্যই আবশ্যক; এমন অন্ধকার থেকে বের হবার জন্য আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে কোনো আলো দান করবেন না? এটা রব্বে কারীমের দয়া ও করুণার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সে আলো কুরআনে কারীম আকারে দান করেছেন। কুরআনে কারীম হল প্রমাণ এবং স্পষ্ট জ্যোতি। ইরশাদ হয়েছে-
یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ قَدْ جَآءَكُمْ بُرْهَانٌ مِّنْ رَّبِّكُمْ وَ اَنْزَلْنَاۤ اِلَیْكُمْ نُوْرًا مُّبِیْنًا، فَاَمَّا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا بِاللهِ وَ اعْتَصَمُوْا بِهٖ فَسَیُدْخِلُهُمْ فِیْ رَحْمَةٍ مِّنْهُ وَ فَضْلٍ، وَّ یَهْدِیْهِمْ اِلَیْهِ صِرَاطًا مُّسْتَقِیْمًا.
হে মানুষ! তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণ এসে গেছে এবং আমি তোমাদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি ‘নূরে মুবীন’ তথা এমন এক আলো, (যা পথকে) সম্পূর্ণরূপে পরিষ্কার করে তোলে।
সুতরাং যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে এবং এই নূরে মুবীন (কুরআনে কারীম) আঁকড়ে ধরেছে, আল্লাহ তাদেরকে নিজ রহমতের ভেতর দাখিল করবেন এবং নিজের কাছে পৌঁছানোর জন্য তাদেরকে সরলপথে আনয়ন করবেন। -সূরা নিসা (৪) : ১৭৪-১৭৫
অতএব, আকাশম-লী ও পৃথিবীর যিনি নূর সেই মহান রবের প্রতি যার ঈমান নসীব হয়েছে, তাঁর নাযিলকৃত নূরে মুবীনের জ্ঞান অর্জিত হয়েছে এবং দৃঢ়তার সঙ্গে সেই নূরের পেছনে চলতে আরম্ভ করেছে, সে-ই তো আল্লাহ তাআলার দয়া ও অনুগ্রহ লাভের যোগ্য। আল্লাহ তাআলা তাকে আপন রহমতে আচ্ছাদিত করে নিয়েছেন এবং তাকে সিরাতে মুস্তাকীম তথা সরল পথে পরিচালিত করেছেন।
আরো ইরশাদ হয়েছে-
قَدْ جَآءَكُمْ مِّنَ اللهِ نُوْرٌ وَّ كِتٰبٌ مُّبِیْنٌ، یَّهْدِیْ بِهِ اللهُ مَنِ اتَّبَعَ رِضْوَانَهٗ سُبُلَ السَّلٰمِ وَ یُخْرِجُهُمْ مِّنَ الظُّلُمٰتِ اِلَی النُّوْرِ بِاِذْنِهٖ وَ یَهْدِیْهِمْ اِلٰی صِرَاطٍ مُّسْتَقِیْمٍ.
আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে এক জ্যোতি এবং এমন এক কিতাব, যা (সত্যকে) সুস্পষ্ট করে।
যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অনুসন্ধান করে, তাদেরকে তিনি এর মাধ্যমে শান্তির পথ দেখান এবং নিজ ইচ্ছায় তাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে নিয়ে আসেন এবং তাদেরকে সরল পথের দিশা দেন। -সূরা মায়েদা (৫) : ১৫-১৬
এই সুস্পষ্ট কিতাব (আলকুরআনুল কারীম), যা কেবলই নূর, এর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা শুধু সেই মানুষদেরই পথ দেখাবেন, যারা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি প্রত্যাশী। এই নূর সিরাতে মুস্তাকীমের একমাত্র নূর এবং দুনিয়া-আখেরাতে নিরাপত্তার একমাত্র মাধ্যম। সব ধরনের অন্ধকার থেকে বের হয়ে আলো লাভের একমাত্র মাধ্যম এই ‘কিতাবুম মুবীন’-সুস্পষ্ট কিতাব। মূর্খতা, ভ্রষ্টতা, কুফর-শিরক, কপটতা, অহংকার-বিদ্বেষ, যুলুম-খেয়ানতসহ সব ধরনের অন্যায় ও পাপাচারের অন্ধকার থেকে বাঁচার একমাত্র আলো এই ‘নূরুম মুবীন’-স্পষ্ট জ্যোতি।
এই জ্যোতি মানুষকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পরিচয়, ইলম ও হেদায়েত, ঈমান ও তাওহীদ, ইখলাস ও বিনয়, সত্যগ্রহণ, দয়া ও আমানত রক্ষা, আনুগত্য ও সমর্পণসহ সকল প্রকার নেক কাজ ও ভালো বিষয়ের আলোয় আলোকিত করে তুলবে।
আল্লাহ তাআলা নিজ অনুগ্রহে এই জ্যোতির অনুসারীদেরকে সব ধরনের অন্ধকার থেকে রক্ষা করে নিরাপত্তার পথে পরিচালিত করেন। ইসলাম ও ইসলামের শিক্ষা গ্রহণের জন্য ‘শরহে সদর’-এর নিআমত লাভ হওয়া অর্থাৎ (ঈমান ও ইসলামকে গ্রহণের জন্য) বক্ষ উন্মুক্ত হওয়া এবং অন্তর নরম হওয়া- এটা কেবল তারই নসীব হয়, আল্লাহর অনুগ্রহে যার এই নূরে মুবীন লাভ হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
اَفَمَنْ شَرَحَ اللهُ صَدْرَهٗ لِلْاِسْلَامِ فَهُوَ عَلٰی نُوْرٍ مِّنْ رَّبِّهٖ فَوَیْلٌ لِّلْقٰسِیَةِ قُلُوْبُهُمْ مِّنْ ذِكْرِ اللهِ، اُولٰٓىِٕكَ فِیْ ضَلٰلٍ مُّبِیْنٍ، اَللهُ نَزَّلَ اَحْسَنَ الْحَدِیْثِ كِتٰبًا مُّتَشَابِهًا مَّثَانِیَ تَقْشَعِرُّ مِنْهُ جُلُوْدُ الَّذِیْنَ یَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ ثُمَّ تَلِیْنُ جُلُوْدُهُمْ وَ قُلُوْبُهُمْ اِلٰی ذِكْرِ اللهِ، ذٰلِكَ هُدَی اللهِ یَهْدِیْ بِهٖ مَنْ یَّشَآءُ، وَ مَنْ یُّضْلِلِ اللهُ فَمَا لَهٗ مِنْ هَادٍ.
আল্লাহ ইসলামের জন্য যার বক্ষ খুলে দিয়েছেন, ফলে সে তার প্রতিপালকের দেওয়া আলোতে এসে গেছে (সে কি কঠোর-হৃদয় ব্যক্তিদের সমতুল্য হতে পারে?) সুতরাং ধ্বংস সেই কঠোর-প্রাণদের জন্য, যারা আল্লাহর যিকির থেকে বিমুখ। তারা সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে নিপতিত।
আল্লাহ নাযিল করেছেন উত্তম বাণী- এমন এক কিতাব, যার বিষয়বস্তুসমূহ পরস্পর সুসামঞ্জস্যপূর্ণ, (যার বক্তব্যসমূহ) পুনরাবৃত্তিকৃত; যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে এর দ্বারা তাদের শরীর ভীত-কম্পিত হয়। তারপর তাদের দেহ-মন বিগলিত হয়ে আল্লাহর স্মরণে ঝুঁকে পড়ে। এটা আল্লাহর হেদায়েত, যার মাধ্যমে তিনি যাকে চান সঠিক পথে নিয়ে আসেন আর আল্লাহ যাকে বিপথগামী করেন, তাকে সঠিক পথে আনার কেউ নেই। -সূরা যুমার (৩৯) : ২২-২৩
আর যাদের এই জ্যোতির বরকতে শরহে সদরের নিআমত লাভ হয়ে গেছে আখেরাতে তার ঠিকানা ‘দারুস সালাম’-শান্তির নিবাস। আল্লাহ তাআলা স্বয়ং তার অভিভাবক ও তত্ত্বাবধায়ক। তিনি তাকে নিরাপদে শান্তির নিবাসে (জান্নাত) পৌঁছে দেবেন এবং সেখানেও তিনি তার অভিভাবক ও রক্ষাকর্তা হবেন।
لَهُمْ دَارُ السَّلٰمِ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَ هُوَ وَلِیُّهُمْ بِمَا كَانُوْا یَعْمَلُوْنَ.
তাদের জন্যই তাদের প্রতিপালকের কাছে রয়েছে সুখ-শান্তির নিবাস। এবং তাদের নেক আমলের পুরস্কার হিসেবে তিনিই তাদের রক্ষাকর্তা।
[সূরা আনআম (৬) : ১২৫-১২৭; সূরা বাকারা (২) : ২৫৭]
যে এই জ্যোতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, দুনিয়া-আখেরাতে সবখানে তার ভাগ্যে শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার।
ظُلُمٰتٌۢ بَعْضُهَا فَوْقَ بَعْضٍ اِذَاۤ اَخْرَجَ یَدَهٗ لَمْ یَكَدْ یَرٰىهَا وَ مَنْ لَّمْ یَجْعَلِ اللهُ لَهٗ نُوْرًا فَمَا لَهٗ مِنْ نُّوْرٍ.
স্তরের উপর স্তরে বিন্যস্ত আঁধারপূঞ্জ। সে যখন নিজ হাত বের করে, তাও দেখতে পায় না। বস্তুত আল্লাহ পাক যাকে আলো না দেন, তার নসীবে কোনো আলো নেই। -সূরা নূর (২৪) : ৪০
হাশরের ময়দানে সকল মুমিন নর-নারী, যারা দুনিয়াতে নূরে মুবীনের আলোতে জীবন অতিবাহিত করেছে, তাদের সামনে, ডানে-বায়ে এই নূরে মুবীনই আলো ছড়াতে থাকবে। এর আলোয় তারা চিরদিনের জন্য চিরস্থায়ী জান্নাতে পৌঁছে যাবে। [দ্র. সূরা হাদীদ (৫৭) : ১২]
সে সময় এই ‘নূরে মুবীন’ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া বেঈমান নর-নারীরা মুমিনদের বলতে থাকবে, আমাদের কিছু সুযোগ দাও; আমরা তোমাদের আলো থেকে কিছু আলো নেব। তখন তাদেরকে নূরে মুবীন দানকারী রব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে বলা হবে-
ارْجِعُوْا وَرَآءَكُمْ فَالْتَمِسُوْا نُوْرًا
তোমরা তোমাদের পেছনে ফিরে যাও, তারপর আলো খোঁজ কর। [সূরা হাদীদ (৫৭) : ১৩]
পেছনে ফিরে তারা কোথায় আলো পাবে; ব্যস জাহান্নাম তাদের অপেক্ষায় থাকবে আর সেটাই তাদের ঠিকানা এবং সেটাই তাদের সঙ্গী।
فَالْیَوْمَ لَا یُؤْخَذُ مِنْكُمْ فِدْیَةٌ وَّ لَا مِنَ الَّذِیْنَ كَفَرُوْا مَاْوٰىكُمُ النَّارُ هِیَ مَوْلٰىكُمْ وَ بِئْسَ الْمَصِیْرُ.
সুতরাং আজ তোমাদের থেকে কোনো মুক্তিপণ গ্রহণ করা হবে না এবং তাদের থেকেও না, যারা কুফর অবলম্বন করেছিল। তোমাদের ঠিকানা জাহান্নাম। তা-ই তোমাদের আশ্রয়স্থল এবং তা অতি মন্দ পরিণাম। -সূরা হাদীদ (৫৭) : ১৫
* * *
আল্লাহ তাআলার বড় অনুগ্রহ, তিনি এই নূরে মুবীন খাতামুন নাবিয়্যীন হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি নাযিল করেছেন, যাঁর সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَ مَاۤ اَرْسَلْنٰكَ اِلَّا رَحْمَةً لِّلْعٰلَمِیْنَ.
(হে নবী!) আমি আপনাকে বিশ্বজগতের জন্য কেবল রহমত করেই পাঠিয়েছি। -সূরা আম্বিয়া (২১) : ১০৭
আরো বলেন-
وَّ دَاعِیًا اِلَی اللهِ بِاِذْنِهٖ وَ سِرَاجًا مُّنِیْرًا.
এবং (আপনাকে তো পাঠিয়েছি) আল্লাহর নির্দেশে মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী ও ‘সিরাজুম মুনীর’ সমুজ্জ্বল প্রদীপরূপে। -সূরা আহযাব (৩৩) : ৪৬
‘সিরাজুম মুনীর’ (সমুজ্জ্বল প্রদীপ) সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র সীরাত, তাঁর শিক্ষা ও হাদীস শরীফ এবং তাঁর সুন্নত ও পথ-পদ্ধতি সব ওই ‘নূরুম মুবীন’-এরই ঝলক এবং বাস্তব প্রয়োগ। এই নূরে মুবীনের মাধ্যমেই তিনি সাহাবায়ে কেরামকে (যাদের মধ্যে নবী পরিবারের মনীষীগণও অন্তর্ভুক্ত) আলোকিত সম্প্রদায় বানিয়ে দিয়েছেন।
كِتٰبٌ اَنْزَلْنٰهُ اِلَیْكَ لِتُخْرِجَ النَّاسَ مِنَ الظُّلُمٰتِ اِلَی النُّوْرِ بِاِذْنِ رَبِّهِمْ اِلٰی صِرَاطِ الْعَزِیْزِ الْحَمِیْدِ.
(হে নবী!) এটি এক কিতাব, যা আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি মানুষকে তাদের প্রতিপালকের নির্দেশক্রমে অন্ধকার থেকে বের করে আলোর ভেতর নিয়ে আসতে পারেন। অর্থাৎ সেই সত্তার পথে, যাঁর ক্ষমতা সকলের উপর এবং যিনি সমস্ত প্রশংসার উপযুক্ত। -সূরা ইবরাহীম (১৪) : ১
দ্বীনের নূরানী কাফেলার প্রথম জামাত সাহাবায়ে কেরামেরই জামাত, এরপর তাবেয়ীন-তাবে তাবেয়ীনের জামাত। কিয়ামত পর্যন্ত এই নূরে মুবীন এবং তার নির্দেশনা ও নিদর্শন, তার বিধিবিধান ও শিক্ষার ধারক ব্যক্তিবর্গ কমবেশি কিয়ামত পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবেন, যারা নূরানী কাফেলার প্রথম তিন জামাতের ঠিক ঠিকভাবে প্রতিনিধিত্ব করতে থাকবেন।
দ্বীন ও শরীয়তের জ্ঞানের যে ভাণ্ডার আজ আমরা লিপিবদ্ধ আকারে দেখছি এবং যেগুলোর বাস্তব প্রয়োগ আমরা ইলমে দ্বীনের ধারক-বাহকগণ, শরীয়ত ও সুন্নতের অনুসারী উলামা-মাশায়েখ এবং তাঁদের সোহবতপ্রাপ্ত নেককার ব্যক্তিগণের মাঝে দেখতে পাচ্ছি- এই সবকিছু সেই নূরে মুবীনেরই প্রতিবিম্ব। যে নূরে মুবীন সম্পর্কে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি-
اِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَ اِنَّا لَهٗ لَحٰفِظُوْنَ.
বস্তুত এ উপদেশ বাণী (কুরআন) আমিই অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই এর রক্ষাকর্তা। -সূরা হিজর (১৫) : ৯
আল্লাহ তাআলার নাযিলকৃত এই নূরে মুবীন (কুরআনে কারীম) থেকে আলো গ্রহণের জন্য ফরয হল, আমাদের জীবনকে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত মোতাবেক গঠন করা, তাঁর ওয়ারিস উলামায়ে কেরাম থেকে ইলম-আমল শেখা এবং তাঁদের অনুসরণ করা।
এই ফরযের এক অংশ এটাও যে, কুরআনে কারীমের সঙ্গে আমাদের সরাসরি সম্পর্ক হবে। আর তা এভাবে যে, আমাদের প্রত্যেকে কুরআনে কারীমের বিশুদ্ধ তিলাওয়াত শিখবে এবং দৈনিক তিলাওয়াত করবে। এরপর তার অর্থ-মর্ম শেখার চেষ্টা করবে; তারপর প্রত্যেক শ্রেণির মানুষ নিজ নিজ সাধ্য মোতাবেক আপন গণ্ডির ভেতরে থেকে তাদাব্বুরে কুরআন অর্থাৎ কুরআনের আয়াতসমূহে চিন্তা-ভাবনারও চেষ্টা করবে। কিন্তু এখন তো বড় বিপদ এই যে, অনেক মানুষকে দেখা যায়, তারা কুরআনে কারীমের কোনো অনুবাদ সামনে রেখেই গবেষণা শুরু করে দেয়; অথচ তার দায়িত্ব ছিল কুরআন শিক্ষা করা। শেখার দায়িত্ব ছেড়ে গবেষণায় লেগে গেছে। যেটা কখনো তার কাজ নয়।
বিভিন্ন ভাষায় যে কুরআনে কারীমের অনুবাদ লেখা হয়, সেটা মানুষকে কুরআন শিক্ষা করা থেকে অমুখাপেক্ষী করার জন্য নয়; বরং শেখাকে সহজ করার জন্য। এমনটা বোঝা যে, অনুবাদের মাধ্যমে আমরা উলামায়ে কেরাম থেকে অমুখাপেক্ষী হয়ে গেছি; এখন আর আমাদের কুরআন শেখার প্রয়োজন নেই- এটা একদম ভুল। এ সম্পর্কে সম্মানিত পাঠকগণ মাওলানা আবু সাবের আবদুল্লাহ দামাত বারাকাতুহুমের প্রবন্ধ ‘কুরআন বোঝার চেষ্টা : আমাদের করণীয়’ (আলকাউসারের বিশেষ সংখ্যা ‘কুরআনুল কারীম সংখ্যা’ পৃষ্ঠা ৭৩-৮৫) বিশেষভাবে অধ্যয়ন করা উচিত। এমনিভাবে ‘তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন’-এর উভয় ভূমিকা পাঠ করলেও ইনশাআল্লাহ উপকার হবে।
মনে রাখতে হবে, একথা আপন জায়গায় ঠিক যে, কিছু লোকের অসাবধানতার কারণে মানুষকে কুরআনের অর্থ-মর্ম শিখতে বাধা দেওয়া উচিত নয়; বরং সঠিক পন্থায় শেখার তাকিদ করা জরুরি এবং এর জন্য সহজ ও উপকারী পথ ও পন্থা উদ্ভাবন করা উচিত।
মাসিক আলকাউসারের দায়িত্বশীলগণের পরিকল্পনাসমূহের মধ্যে ছিল, ‘আলকাউসার’-এও এই খেদমত আঞ্জাম দেয়ার জন্য কোনো বিভাগ খোলা। তবে তা বাস্তবায়নে যথেষ্ট বিলম্ব হয়ে গেল। এদিকে কয়েকজন মহব্বতের মানুষের পক্ষ থেকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার ধারাও অব্যাহত ছিল। তাই এখন আল্লাহর উপর ভরসা করে উক্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ইচ্ছা করা হয়েছে।
নূর শব্দের বহুবচন আনওয়ার। তাই এই বিভাগের নাম ‘আনওয়ারুল কুরআন’ করা হয়েছে। ইনশাআল্লাহ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩ হি. (অক্টোবর ২০২১ ঈসায়ী)-এর সংখ্যা থেকে তা নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকবে। তাওফীকদাতা একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। আমরা তাঁরই নিকট তাওফীক প্রার্থনা করি।
এই বিভাগের উদ্দেশ্য নিয়মতান্ত্রিক দরসে তাফসীরের ধারা শুরু করা নয়। বরং এর উদ্দেশ্য কুরআনের নির্দেশনাবলি ও বিধিবিধানসমূহকে সহজ-সরল ও বোধগম্যরূপে উপস্থাপন করা। কখনো এমন হবে যে, কোনো ছোট সূরা বা কয়েক আয়াতের হেদায়েত ও শিক্ষা পেশ করা হবে। কখনো কুরআনের আদেশ-নিষেধ বা অন্যান্য বিষয়ের কোনো একটি সম্পর্কে কুরআনী হেদায়েত পেশ করা হবে। কখনো কুরআনে কারীমের পরিচয় এবং কুরআন, তাফসীরুল কুরআন বা উলূমুল কুরআন সংশ্লিষ্ট জরুরি বিষয়াবলি সম্বলিত কোনো প্রবন্ধ প্রকাশিত হবে। কখনো সবক’টি নিয়েই সংক্ষেপে কিছু কিছু লেখা আসবে। কুরআনের নূর এক অতলান্ত সমুদ্র। এর ধারা শেষ হবার নয়। ব্যস, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এর সঙ্গে জুড়ে রাখুন এবং এই নূরে মুবীনের আলোয় আমাদের পরিচালিত করুন-
آمين يا منزل القرآن الكريم، والفرقان الحكيم!
সবশেষে একথা আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, আলকাউসারের এই বিভাগ এবং তার এই সাধারণ খেদমত গুরুত্বপূর্ণ ও উপকারী হওয়া সত্ত্বেও তা কুরআনে কারীমের বিষয়ে মানুষকে উলামায়ে কেরামের শরণাপন্ন হওয়া এবং মাশায়েখে কেরামের সোহবত গ্রহণ করা থেকে অমুখাপেক্ষীকারী নয়, বরং তা বৈধও নয়, সম্ভবও নয়। কুরআনকে কুরআনের আলোয় আলোকিত আল্লাহওয়ালাদের কাছ থেকেই বেশি শিখতে হবে।
ভালো হয়, আমরা যদি শেষরাতে এবং দুআর অন্যান্য মুহূর্তে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকৃত ওই দুআ পড়ি; যাতে রাব্বুল আলামীনের দরবারে কুরআনের নূরকে আমাদের ভেতর-বাহির এবং আমাদের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে প্রবাহিত করার এবং এর মাধ্যমে আমাদের বাস্তব জীবনকে আলোকিত করার প্রার্থনা করা হয়েছে। সহীহ হাদীসসমূহে এই দুআ বারবার এসেছে-
اللهُمَّ اجْعَلْ فِي قَلْبِي نُورًا، وَفِيْ لِسَانِيْ نُوْرًا، وَفِي سَمْعِي نُورًا، وَفِي بَصَرِي نُورًا، وَفِيْ عَصَبِيْ نُوْرًا، وَفِيْ لَحْمِيْ نُوْرًا، وَفِيْ دَمِيْ نُوْرًا، وَفِيْ شَعْرِيْ نُوْرًا، وَفِيْ بَشَرِيْ نُوْرًا، وَمِنْ فَوْقِيْ نُوْرًا، وَمِنْ تَحْتِي نُورًا، وَعَنْ يَمِينِي نُورًا، وَعَنْ شِمَالِيْ نُورًا، وَمِنْ بَيْنِ يَدَيَّ نُورًا، وَمِنْ خَلْفِيْ نُورًا، وَاجْعَلْ فِي نَفْسِي نُورًا، وَأَعْظِمْ لِيْ نُوْرًا، وَاجْعَلْ لِي نُورًا.
অর্থ : হে আল্লাহ! আমার অন্তরে আলো দান করুন। আমার যবানে আলো দান করুন। আমার কানে আলো দান করুন। আমার চোখে আলো দান করুন। আমার ধমনীতে আলো দান করুন। আমার গোশতে আলো দান করুন। আমার রক্তে আলো দান করুন। আমার চুলে আলো দান করুন। আমার চামড়ায় আলো দান করুন। আমার ওপরে-নিচে আলো দান করুন। আমার ডানে-বামে আলো দান করুন। আমার সামনে এবং আমার পশ্চাতে আলো দান করুন। আমার ভেতরে আলো দান করুন। আমাকে অগাধ নূর দান করুন। আলোকে আমার সঙ্গী বানিয়ে দিন। (দ্র. সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৬৩; সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৩১৬)
هذا، وصلى الله تعالى وبارك وسلم على نبينا خاتم النبيين، وعلى آله وأصحابه أجمعين، وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.
-আরযগুযার
বান্দা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক গুফিরালাহু
২৭-১২-১৪৪২ হি.
শনিবার
পুনশ্চ : বান্দার এই লেখা যে-ই পড়বেন, তারই খেদমতে আরয, আনওয়ারুল কুরআন বিভাগটি লেখার বিষয় ও ধরন উভয় দিক থেকে যেমন ব্যাপক, তেমনি লেখকের বিবেচনায়ও ব্যাপক। আমরা এই বিভাগে লেখার জন্য সকল মুআল্লিমে কুরআন ও মুতাআল্লিমে কুরআনকে দাওয়াত দিচ্ছি। এটা জরুরি নয় যে, সকল প্রবন্ধ ইলমী বা গবেষণাধর্মী হবে, তেমনিভাবে লেখা দীর্ঘ হওয়াও জরুরি নয়; বরং আধা কলাম এক কলামের লেখাও আমাদের চাই। একদম সহজ-সরল দাওয়াতী লেখাও আমাদের প্রয়োজন। কুরআন থেকে কোনো হেদায়েত নিয়ে সহজ-সরল ভাষায় পেশ করলেই তা নূর-ই নূর। কিংবা কুরআন সংশ্লিষ্ট কিছু লেখা হলে বা কুরআনওয়ালাদের সম্পর্কে কিছু বলা হলে- সবই দরকারী ও উপকারী।
যাঁরা কোনো সময়ে আলকাউসারে কিছু লিখে আমাদের ধন্য করেছেন তাঁদের সকলের খেদমতে আমাদের আরয, তাঁরা যেন এ বিভাগে লেখেন আর যাঁরা এখনও লেখেননি তাঁদের কাছেও আবেদন, তারা যেন লেখেন এবং আমাদের কৃতজ্ঞতা আদায়ের সুযোগ দেন।
(বান্দা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক)