আফগানিস্তানে ইসলামী সরকারের প্রত্যাবর্তন
পরাশক্তিগুলোর এজেন্ডা এবং আমাদের প্রত্যাশা
প্রাচ্যের কবি আল্লামা ইকবাল। তার কাব্য বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। তার বিভিন্ন কবিতায় তিনি শয়তানদের সংলাপ এবং তাদের সংসদীয় আলোচনার কাল্পনিক বিবরণও পেশ করেছেন। তার একটি কবিতার শিরোনাম- ‘ইবলীস কি মাজলিসে শূরা’ (ইবলীসের পার্লামেন্ট)। এমনিভাবে আরেকটি শিরোনাম- ‘ইবলীস কা ফরমান আপনে সিয়াসী ফরযানদোঁ কে নাম’ (ইবলীসের বার্তা- তার রাজনৈতিক সহযোগী ও সভাসদদের প্রতি)।
আফগানদের সম্পর্কে ইবলীস তার সভাসদদের কী নির্দেশ ‘দিয়েছেন’ সেটিই উঠে এসেছে নি¤েœর দুটো পঙক্তিতে-
افغانیوں کی غیرت دیں کا ہے یہ علاج
ملا کو ان کے کوہ و دمن سے نکال دو
আফগানদের ধর্মীয় আত্মমর্যাদাবোধের চিকিৎসা হল, মোল্লাকে তার আস্তানা ও আস্তিন থেকে বের করে আনো!
ইকবাল এখানে বলতে চেয়েছেন, বিভিন্ন জনপদের লোকদের ধ্বংসের মুখে পতিত ও তাদেরকে বে-দ্বীন করার যেসব পন্থার কথা ইবলীস তার সভাসদদের বলেছে, তার মধ্যে আফগানদের সম্পর্কে তার নির্দেশ ছিল এই যে, আফগানরা স্বভাবগতভাবেই দ্বীনদার এবং তাদের দ্বীনী গায়রত, তথা ধর্মীয় আত্মমর্যাদাবোধ অত্যন্ত প্রবল। ইবলীস বলছে, আফগানদের এই দ্বীনী আত্মমর্যাদাবোধ ‘রোগ’-এর চিকিৎসা হল, ‘তাদের অন্তর থেকে দ্বীন এবং দ্বীনের ধারক-বাহক আলেম-উলামার প্রতি মহব্বত ও আনুগত্যের প্রবণতাটি খতম করে দাও’।
ইকবাল দূরদর্শী দার্শনিক ছিলেন। ভাব দেখে মনে হচ্ছে, তিনি গত শতাব্দীর শুরুতেই আঁচ করে ফেলেছিলেন, ঐ শতাব্দীর শেষে কী ঘটতে যাচ্ছে। আরবদের ব্যাপারে, আফগানদের ব্যাপারে, মধ্যএশিয়া ও সেন্ট্রাল এশিয়ার ব্যাপারে ইকবাল যা বলেছিলেন এবং যেসব আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, সেগুলোর অনেক কিছুই পরবর্তীতে হুবহু ঘটতে দেখা গেছে। আল্লামা ইকবাল তার কবিতায় শয়তানের যে চিন্তা ও পরিকল্পনার কথা শয়তানের নিজের ভাষায় ব্যক্ত করেছেন; আফগানিস্তানে সে চিন্তারই প্রতিফলন দেখানোর চেষ্টা চলেছে বিগত কয়েক দশক ধরে। গত শতাব্দীর আশি ও নব্বইয়ের দশকে এবং নাইন ইলেভেনের পরের প্রেক্ষাপটে বিশ্বমোড়লরা আফগানিস্তানকে ঘিরে যেসব পরিকল্পনা এঁটেছিল এবং তার বাস্তবায়নের জন্য যেভাবে মরিয়া হয়ে উঠেছিল; যেমন, নিজেদের পশ্চিমী নোংরা সংস্কৃতিকে একটি স্বাধীনচেতা ও আত্মমর্যাদাশীল জাতির উপর জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা, তাদের একাংশকে অর্থ ও অস্ত্র এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ও মিডিয়ার পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে নিজেদের সেবাদাস বানিয়ে স্বজাতীয়দের ধ্বংসের জন্য লেলিয়ে দেওয়া এবং আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় ভাবধারাকে চিরতরে বিলুপ্ত করতে সেক্যুলার মানসিকতার শাসকশ্রেণি এবং সৈনিক ও নাগরিক তৈরির জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয়... এ সবকিছু ইকবালের ঐ কবিতাকেই মনে করিয়ে দেয় বারবার।
কিন্তু যেহেতু এগুলো সবই ছিল শয়তানী কর্মকা- আর কুরআনে কারীমের সুস্পষ্ট ইরশাদ হল-
اِنَّ كَیْدَ الشَّیْطٰنِ كَانَ ضَعِیْفًا.
‘শয়তানের সকল কলাকৌশলই দুর্বল’
তাই কয়েক দশক পরে আবারো সে কথাই দিবালোকের ন্যায় সত্য প্রমাণিত হল।
মাত্র তিন দশকের ব্যবধানে আফগানিস্তানে দু-টি সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত পরাজয় হয়েছে। তাদের কবর রচিত হয়েছে এমন লোকদের হাতে, যারা প্রচলিত শিক্ষাদীক্ষা এবং তথাকথিত আধুনিক সভ্যতা থেকে অনেকটাই দূরে।
এখন যাদের বয়স পঁয়তাল্লিশ-এর বেশি, তাদের নিজেদেরই মনে থাকবে, পৃথিবীতে গত শতাব্দীতে দুটি পরাশক্তি পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। এক. সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার মিত্ররা। দুই. যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। গত শতাব্দীর আশি এবং নব্বইয়ের দশকে দেখা গেল, সোভিয়েত ইউনিয়ন শুধু মধ্যএশীয় ইসলামী রাষ্ট্রগুলোকে এবং আরো কিছু রাষ্ট্রকে গিলেই ক্ষান্ত হল না; বরং আফগানিস্তানেও আক্রমণ করে বসল এবং তাদের উপর আধিপত্যের জাল বিস্তারের সবরকম পাঁয়তারা সম্পন্ন করল। কিন্তু স্বাধীনচেতা আফগান জাতি তা মেনে নিল না। তারা প্রতিরোধ গড়ে তুলল। তাদের বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠী আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ে নেমে পড়ল। তখন বিশ্বের অন্য পরাশক্তিটি পাকিস্তানের মাধ্যমে আফগানদের সহযোগিতায় এগিয়ে এল। বাহ্যিকভাবে মনে হচ্ছিল, তারা তাদের চিরশত্রু সোভিয়েত ইউনিয়নের মোকাবেলায় যুদ্ধরতদের সহযোগিতা দেয়ার জন্যই এসেছে, কিন্তু তাদের মতলব যে অন্য কিছু ছিল, সেটা আরো পরে স্পষ্ট হয়েছে। সে কথায় পরে আসছি।
যাইহোক, সোভিয়েত ইউনিয়ন পরাজিত হয়ে আফগানিস্তান থেকে বিদায় নেয়। শুধু তাই নয়, এই আফগানিস্তানেই তাদের সলিল সমাধিও হয়েছিল। কারণ, এরপর একে একে তাদের কব্জায় থাকা [মধ্যএশীয় মুসলিম রাষ্ট্রগুলো (উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, কাজাখস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কিরঘিজস্তান...)সহ] সকল রাষ্ট্র স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যায় এবং চূড়ান্ত পরিণতিতে সোভিয়েত ইউনিয়নেরও যবনিকাপাত হয়। আজ সেটি ইতিহাস।
এখন অর্থনীতি পড়াতে গেলে ছাত্রদেরকে সমাজতন্ত্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন- এ দুটি বিষয় বোঝাতে হয় অনেক কষ্ট করে। অথচ গত শতাব্দীর সত্তর বছরজুড়ে কী দাপট এবং দাপাদাপিই না ছিল তাদের! প্রতিদিনই মনে হতো, এই বুঝি যুদ্ধ বেঁধে গেল পরাশক্তিদুটোর! তাদের পরস্পরের নিত্যনৈমিত্তিক এই ঝগড়াকে তখন স্নায়ুযুদ্ধ বা শীতল লড়াই নামেও অভিহিত করা হতো।
সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তান থেকে বিতাড়িত হওয়া এবং তাদের পতনের পর স্বভাবতই আফগানিস্তানে মুজাহিদদের সরকার কায়েম হল। কিন্তু মুজাহিদরা যেহেতু বহু জালে বিভক্ত ছিল এবং আফগানিস্তানের প্রতি বিজাতীয় শক্তিগুলোর বদ-নজর ও ষড়যন্ত্র অব্যাহত ছিল, তাই তাদের সরকার স্থিতিশীলতা পায়নি। যার পরিণতিতে গত শতাব্দীর শেষ দশকে আফগানিস্তানে ব্যাপকভাবে ছাত্র আন্দোলন শুরু হয় এবং সে আন্দোলনের লোকেরাই পরবর্তীতে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসে। যারা বিশ্বব্যাপী তালেবান নামে পরিচিতি লাভ করে।
নাইন ইলেভেন ও তারপর
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হল। এরপর ইমারাতে ইসলামী (তালেবান)-এর সরকার গঠিত হল। ক্ষমতায় আরোহণের পর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বিভিন্ন বিষয়ে তারা ব্যাপক সফলতা অর্জন করল। বিশেষ করে, যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে তারা শান্তি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হল। আফগানিস্তানের বেশির ভাগ অঞ্চল তখন সুন্দরভাবেই চলছিল। তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা একটু তাড়াহুড়ো করেছে এবং একটু বেশিই কঠোর হয়েছে। অন্যদিকে বিশ্ব-কুফরী শক্তি পৃথিবীর কোথাও শরীয়া আইন মেনে নেয়ার মত ধৈর্য্য হাসিলের সবক তখনো পায়নি। তারা তালেবানদের নিয়ে বল্গাহীন সমালোচনায় মেতে ওঠে এবং তাদেরকে বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি আখ্যায়িত করে তাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে লুণ্ঠনের জন্য নতুন ফন্দি-ফিকির শুরু করে , নতুন এজেন্ডা নিয়ে হাজির হয় বিশ্বরাজনীতির রঙ্গমঞ্চে।
সেই এজেন্ডার অংশ হিসেবেই নাইন ইলেভেনের রহস্যময় ঘটনার জেরে ওসামা বিন লাদেনকে উঠিয়ে নেয়ার ছুতা ধরে আমেরিকা ও তার মিত্র ন্যাটো জোট হামলে পড়ে আফগান জনতার উপর। শুধু ন্যাটো নয়, অন্যান্য আরো দেশকেও (যাদের মোট সংখ্যা ছিল সম্ভবত ৪৯) নিয়ে আসা হয় সেই সময়কার অর্ধলক্ষেরও কম (তাদের হিসাব মতে) তালেবানকে দমন করতে। বিমান থেকে মুহুর্মুহু বোমাবর্ষণ করে আফগানিস্তান জুড়ে তারা কায়েম করে ত্রাসের রাজত্ব। যদিও মুখে বলতে থাকে যে, তাদের লক্ষ্য কেবল তালেবান ‘জঙ্গিরা’। বেসামরিক স্থাপনায় তারা কোনো হামলা করবে না, কিন্তু বাস্তবে সামরিক আর বেসামরিক-এর কোনো ভেদাভেদ ছিল না তাদের হামলার নিশানা হবার ক্ষেত্রে। মানুষের ঘরবাড়ি তো বটেই, শিশু-নারী, মসজিদ-মাদরাসা, স্কুল-কলেজ, এমনকি হাসপাতালগুলোও রক্ষা পায়নি তাদের নিষ্ঠুর আক্রমণ থেকে। সেই বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে তালেবান সরকার লড়াইয়ের কৌশল হিসেবেই ক্ষমতার মসনদ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়, কিন্তু তারা ছড়িয়ে থাকে আফগানিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চলজুড়ে এবং লড়াই চালিয়ে যেতে থাকে নব্য দখলদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে- দীর্ঘ দুই দশকের দম না ফুরানো এবং হার না-মানা লড়াই। সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত ও সঙ্ঘবদ্ধ বাহিনীর বিরুদ্ধে ঈমানের শক্তিতে বলীয়ান, অসম্ভব আত্মবিশ্বাসী এক জাতির সন্তানদের অবিশ্বাস্য লড়াই!... বিশ বছর পর এ লড়াইয়ের ভাগ্য ও ফলাফল আজ সবার সামনে। আফগানিস্তানজুড়ে আবারো উড়ছে ইমারাতে ইসলামীর বিজয় নিশান। পাততাড়ি গুটিয়ে ভেগেছে দখলদার শক্তি ও তাদের তল্পিবাহক কাপুরুষেরা।
আফগান জাতিকে সেক্যুলার বানাতে আমেরিকার এজেন্ডা ও তার ফলাফল
উসামা বিন লাদেনকে উঠিয়ে নেয়ার অজুহাত দেখিয়ে আমেরিকা ও তার মিত্র ন্যাটো জোট আফগানিস্তানে বিশ বছর পর্যন্ত তাদের আগ্রাসনকে প্রলম্বিত করেছে। এ সময়টাতে এই দখলদার শক্তি- আল্লামা ইকবালের কবিতায় যেমন বলা হয়েছে, ওখানে আফগানদের নিয়ে ইবলীসের পরিকল্পনার কথা যেভাবে উঠে এসেছে, সেটাই তারা করে দেখানোর চেষ্টা করেছে। আফগানিস্তানের ঐতিহ্য-ইতিহাস-সভ্যতা-সংস্কৃতি সবকিছু তারা বদলে দিতে চেষ্টা করেছে। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার তারা ব্যয় করেছে আফগানিস্তানের মেয়েদেরকে ঘর থেকে বের করার জন্য। তাদেরকে বেপর্দা করার জন্য, তাদেরকে ক্রীড়া ও খেলাধুলায় নিয়ে আসার জন্য...। মোটকথা, পশ্চিমের সেই নোংরা সংস্কৃতিতে এদেরকে অভ্যস্ত করার জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। এবং আফগানিস্তানে তথাকথিত সেক্যুলার সেনাবাহিনী গড়ার জন্য, শুধু সেক্যুলার আর্মি এবং ডিফেন্স তৈরির জন্য সত্তর বিলিয়নের মতো ডলার তারা খরচ করেছে। অনেক বিশেষজ্ঞের মত হল, এক্ষেত্রে প্রকাশিত ও প্রচারিত সংখ্যাটি অনেক কম। বাস্তবে তা কয়েক ট্রিলিয়ন বটে।
আফগানদের লক্ষ লক্ষ লোক তারা মেরেছে। এভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে আফগানদেরকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে বলেই তাদের ধারণা। কিন্তু আফগানদের হতাহতের পাশাপাশি তাদেরও অনেক সৈন্য মারা পড়েছে। তাদের অসংখ্য সৈন্যের আত্মহত্যার কথাও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে চাউড় হয়েছে। আমেরিকা ও তার মিত্র দেশগুলোতে সৈন্যদের আত্মীয়-স্বজনের পক্ষ থেকে সরকারের উপরে বিশাল চাপও এসেছে।
এর মানে তাদেরও বড় রকমের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তারপরও দুই দশক ধরে তারা অর্থব্যয় এবং ‘প্রাণের জলাঞ্জলি’ অব্যাহত রেখেছে। কেন? আফগানিস্তানের দ্বীনদার শ্রেণিকে শেষ করা এবং সেখানে সেক্যুলার সমাজ ও রাষ্ট্র কায়েম করার সেই ইবলীসী স্বপ্ন পূরণের জন্য...! কিন্তু আফগানিস্তানের সেই আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, স্বাধীনচেতা, স্বনির্ভর ও লড়াকু জাতির প্রতিরোধের মুখে তারা শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েছে পরাজয় মেনে নিয়ে আফগানিস্তান ছাড়তে।
এসব থেকে কী বোঝা গেল
আফগানদের টানা চার দশকের এই অবিশ্রান্ত লড়াই এবং আজকে তাদের অর্জিত ফলাফল প্রমাণ করল :
এক. কোনো স্বাধীনচেতা, আত্মপ্রত্যয়ী এবং আত্মমর্যাদাশীল জাতির পরাজয় হয় না
হাঁ, কোনো স্বাধীনচেতা, আত্মপ্রত্যয়ী এবং আত্মমর্যাদাশীল জাতির কখনো পরাজয় হয় না। হলেও সেটা স্থায়ী হয় না। এখানে একটি কথা মনে রাখা দরকার, যদিও যোদ্ধা হিসেবে মুখোমুখী রণক্ষেত্রে ইমারতে ইসলামী আফগানিস্তান (তালেবান) জয়ী হয়েছে, কিন্তু এটা আসলে পুরো আফগান জাতির কৃতিত্ব। কারণ, অল্পকিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সকল আফগান তাদের সঙ্গে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। যে কারণে বিদেশী শক্তি চলে যাবার পর অনেকটা রক্তপাতহীনভাবে পুরো দেশে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেটি এ সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করল যে, কোনো জাতি যদি সত্য-ন্যায়ের পথে শিশাঢালা প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে যায় তাহলে তাদের বিজয় ও সফলতা অনিবার্য। তাদের জন্য শুধু দরকার হয় নিজেরা সততার সাথে থাকা এবং অন্যদের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সচেতন থাকা। আফগানরা বিশ্বশক্তিকে প্রতিহত করে সেটি দেখিয়ে দিয়েছে।
দুই. অল্প কিছু লোককে লোভের বশবর্তী করে একটি জাতিকে ধ্বংস করা যায় না
একথা আফগানিস্তানে পাকাপাকিভাবে প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, বিশ বছর পর্যন্ত বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে আফগানদের চিরাচরিত ইসলামী চেহারা পরিবর্তন করে দেয়ার যে চেষ্টা চালানো হয়েছে এবং তথাকথিত পরাশক্তিগুলো এক্ষেত্রে যে সফলতার ঢেকুর তুলেছে তার পুরোটাই ছিল আসলে মরীচিকা। তাদের ঐ সেবাদাসগণ এখন কোথায়? কেন তাদের একশ ব্যক্তিও ইমারাতে ইসলামী (তালেবান)-এর মোকাবেলায় সামনে দাঁড়ালো না? আসলে চাপিয়ে দেওয়া সভ্যতা অথবা কেনা গোলামদের দিয়ে চালু করা কোনো ইতিহাস ও সংস্কৃতি স্থায়িত্ব লাভ করে না; যদি মোকাবেলায় মূল পক্ষ আসল সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর থাকে। আজকের আফগানিস্তান এটির জ্বলন্ত উদাহরণ।
তিন. হাজারবার বললেও মিথ্যা মিথ্যাই থেকে যায়
কোনো একনায়ক নাকি বলেছিল, ‘একটি মিথ্যাকে দশ বার বল, তাহলে সেটি সত্য হয়ে যাবে’। কিন্তু সেটার তামিল করতে গিয়ে পৃথিবীব্যাপী বড় বড় গণমাধ্যমগুলো (আমাদের দেশ ও প্রতিবেশী বড় দেশটিসহ) তাদের বানানো মিথ্যা কথা দশবার নয়, শত শতবার অহরহ বলে যায়। একসময় কিছু বোকা লোক সেগুলো বিশ্বাসও করতে শুরু করে, যাদের অধিকাংশই থাকে তাদের হালুয়া-রুটি খাওয়া কেনা গোলাম। আফগানিস্তানের ব্যাপারে কয়েক দশক থেকে বিশ্ব গণমাধ্যম তাদের মনগড়া সব মিথ্যা প্রচার করে গেছে এবং এখনও করে যাচ্ছে। কিন্তু শতবার হাজারবার, লক্ষবার, যতবারই বলা হোক না কেন; মিথ্যা মিথ্যাই থাকে এবং একসময় তা সত্যের নিচে চাপা পড়তে বাধ্য হয়।
বিগত দুই দশক ধরে আমেরিকা ও তার মিত্ররা এবং তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আফগানিস্তানের খবরা-খবর এমনভাবে প্রচার করেছে, যেন সেখানে সবকিছুই পাল্টে গেছে। সেখানকার মানুষের চিন্তা-চেতনা, ধর্ম-কর্ম সবকিছুই এখন পাশ্চাত্যমুখী। তালেবানরা কিছু কিছু জায়গায় বিশৃঙ্খলা করে শুধুই মার খাচ্ছে এবং আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যাচ্ছে...। কিন্তু এখন কী দেখা গেল? কোথায় গেল তাদের অনুসারীরা? তাদের প্রচার-প্রচারণার বাস্তবতা? আসল সত্যটি ছিল- বিভিন্ন শহরে অল্পকিছু সুবিধাবাদী লোককেই তারা কব্জায় আনতে পেরেছিল। যাদের কিছু লোক তাদের আখের গুছিয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে, কিছু লোভের নিচে ডুবেছে এবং কিছু সময়ের ভাবগতিক দেখে খোলস পাল্টে নিয়েছে।
বাকি পুরো আফগানিস্তানই ছিল স্বাভাবিক। কারণ, সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এখনও ঈমানদার ও ধর্মপ্রাণ। তারা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আগের মতোই অনমনীয়। কোনো আগ্রাসী দখলদারকে- এমনকি বৃটিশদেরকেও- তারা অতীতেও কবুল করেনি এবং ভবিষ্যতেও কবুল করবে বলে মনে হয় না। পুরো বিশ্বে হাজার হাজারবার মিথ্যাবাদী মিডিয়াগুলো এসব সত্যকে ধামাচাপা দিয়ে তাদের মনগড়া মিথ্যা প্রচার করেছে বটে, কিন্তু এখন?
মিথ্যাকে রং চড়িয়ে গলা ফাটিয়ে বলে যাওয়ার আরেকটি তরতাজা উদাহরণ হল, এবার ইমারাতে ইসলামীর কাবুলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভারতজুড়ে তাদের বিরুদ্ধে তুমুল বিষোদ্গার। এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে নির্লজ্জ ভূমিকায় ছিল ইসলাম ও মুসলমান বিরোধী যে কোনো প্রপাগান্ডায় বরাবর ‘দাদার ভূমিকা’ পালনকারী আমাদের গায়ে ঘেঁষে থাকা একটি প্রদেশের নামকরা দৈনিক পত্রিকা। ইমারাতে ইসলামীর প্রত্যাবর্তনে তাদের অন্তর্দাহের অন্ত ছিল না। মনে হচ্ছিল, মিথ্যার বান ছুটিয়ে তারা তালেবানদের ডুবিয়ে মারবে, ঠিক যেমন করে বন্যায় ডোবায় আমাদের এই দেশকে...। কিন্তু কাবুলজয়ের দু’সপ্তাহের মাথায় তাদেরই দেশের ছেলে ‘তমাল’ (কাবুলের একটি আন্তর্জাতিক স্কুলের শিক্ষক তমাল ভট্টাচার্য) কাবুল থেকে সদ্য ফিরে এসে যখন ইমারাতে ইসলামী নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তানে বর্তমান শান্তিপরিস্থিতি এবং ‘তমাল’সহ আরো যত বিদেশী ও অমুসলিমরা সেখানে অবস্থান করছে, তাদের সঙ্গে তালেবানদের সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণের কথা উচ্ছ্বাস ভরে বলে গেল এবং সে দেশের একটি নিউজ চ্যানেল তার সঙ্গে আলাপের সেই দৃশ্য প্রচার করল আর তা মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ল বিশ্বময় তখন বিদ্বেষ ও বিষোদ্গারের ফেরিওয়ালা সেই পত্রিকাটির মুখ লুকানোর কোনো জায়গাই রইল না! তবে এরা হচ্ছে সেই উটপাখী, যারা বালুতে মাথা গুঁজে রেখে ভাবতে চায়, বাহিরে ঝড় বহিছে না! কিন্তু অন্ধ হলেই কি বন্ধ হবে প্রলয়...?
চার. গণমানুষের চিন্তা-চেতনা ও ইচ্ছা-আকাক্সক্ষার বিরুদ্ধে চাপিয়ে দেওয়া কোনো শাসন স্থায়ী হয় না
আরেকটি সত্য, যেটি আগেও বারবার প্রমাণিত হয়েছে, এবারও প্রমাণিত হল। তা এই যে, গণমানুষের ইচ্ছা-আকাক্সক্ষা এবং তাদের চিন্তা-চেতনার বিরুদ্ধে চাপিয়ে দেওয়া কোনো শাসন কিছুদিন বা কিছু বছর, ক্ষেত্রবিশেষে হয়তো কিছু বেশি বছর চলতে পারে, কিন্তু তা কখনও স্থায়িত্ব পায় না। এবং সকল ক্ষেত্রেই তার পরিণতি হয় অত্যন্ত ভয়াবহ ও দৃষ্টান্তমূলক। পৃথিবীর বহু একনায়ক যখন তাদের বিচ্ছিন্ন বাহিনীর দাপট দেখিয়ে এবং তাবেদার ও নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে জবরদস্তি ক্ষমতা আঁকড়ে ছিল, তখন কেউ চিন্তাও করেনি যে, একসময় এদের মারাত্মকভাবে পতন হবে। কিন্তু সেটা হয়েছে এবং তারা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে।
আজকে আফগানিস্তানের আশরাফ গনিদের অবস্থাই দেখা যাক। কীভাবে লেজ গুটিয়ে, গাড়ি ও হেলিকপ্টার ভরে দেশের সম্পদ নিয়ে নিজের ও ইসরাইলের পরম বন্ধুর কাছে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। একদিন আগেও যার হাঁকডাক ও কথাবার্তা ছিল কর্তাসুলভ...। পালিয়ে যাওয়ার পর অবশ্য বলেছেন, রক্তপাত এড়ানোর জন্যই নাকি তিনি দেশত্যাগ করেছেন। তার কথায় মানুষ হাসবে না কাঁদবে কিছু খুঁজে পায়নি। আর গনি সাহেবদের অনুসারীরা? তাদের অবস্থা যে কী, সেটা বুঝতে কাবুল বিমানবন্দরের ফ্লাইটে ওঠার জন্য হুড়োহুড়ির ঘটনার দিকে তাকালেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায়। এতদিনের রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটকারী, অবৈধ সুবিধাভোগী, বিদেশী আগ্রাসী শক্তির দালাল ও সেবাদাসরা পালানোর জন্য কীভাবে বিভিন্ন প্লেনে উঠতে লাফালাফি ও দৌড়ঝাঁপ করেছে, সেটা তাদের প্রভু মিডিয়ারা চেষ্টা করেও ধামাচাপা দিতে পারেনি।
এ থেকে যদি বিভিন্ন দেশের সেবাদাস ও অনুগত মিডিয়ারা কিছু সবক নেয় তবে তা ভবিষ্যতে কাজে আসবে বলে আশা করা যায়। বোঝার বিষয় হল, যেখানে পুরো দেশ শান্ত, যেখানে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছে ইমারাতে ইসলামী আফগানিস্তান (তালেবান), যেখানে রক্তপাতহীনভাবে তারা বিভিন্ন শহরে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর রাজধানী কাবুলকেও কোনোরকম সংঘাত ছাড়া জয় করে নিয়েছে, সেখানে এই লোকগুলো পালিয়ে যাওয়ার জন্য এত দিশেহারা কেন হয়ে পড়ল। কারণটা খুবই স্পষ্ট। আসলে তারা তো জানে যে, এতদিন যে জঘন্য অপকর্ম তারা করেছে; জনগণের উপর অত্যাচার, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট, দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেওয়া এবং এজাতীয় অন্যান্য অপকর্মগুলোর জন্য একসময় তাদেরকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। তাই তারা পালিয়ে গিয়ে তাদের ঐ প্রভুদের কোলেই আশ্রয় নিয়েছে। অবশ্য তাদের কিছু লোককে তাদের প্রভুরা সাথে করেই নিয়ে গেছে। নিজ দেশের সৈন্যদেরকে যখন তারা বিভিন্ন ফ্লাইটে ফিরিয়ে নিচ্ছিল, তখন ‘দোভাষী’ এবং আরো বিভিন্ন নাম দিয়ে এই আজ্ঞাবহ সেবাদাসদের অনেককে তারা পার করে নিয়েছে। ভবিষ্যতে হয়ত এদেরকেই ষড়যন্ত্রের হাতিয়ার হিসাবে কাজে লাগাবে আফগানিস্তানে পরাজিত বিশ্বশক্তি।
পাঁচ. জনসম্পৃক্ত আন্দোলনই সাফল্য বয়ে আনে
যেমনটি বিশ্বমিডিয়া প্রচার করেছে- আফগানিস্তানের সদ্য শেষ হওয়া দীর্ঘ দুই দশক কালের যুদ্ধে তালেবান যোদ্ধার সংখ্যা ছিল মাত্র সত্তর হাজার। অন্যদিকে পরাশক্তিগুলোর অনুগত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আফগান সৈন্যের সংখ্যা ছিল তিন লক্ষ। অনেকে বলতে পারেন, এই অনুগত বাহিনী আসলে মতলবী ছিল। সুযোগ বুঝে তারা নিজেদের খোলস পাল্টে নিয়ে তালেবানদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, যাতে ক্ষমতার পটপরিবর্তন হলেও সেই অবস্থায় বেকায়দায় পড়তে না হয়। আর এতেই তালেবানের জয়ের পথ প্রশস্ত হয়েছে। এ যুক্তি খ-ন না করেই বলা যায়, বাস্তবে আমরা যেমনটি দেখেছি, ইমারাতে ইসলামী আফগানিস্তান বিনা বাধায় যেভাবে প্রদেশের পর প্রদেশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে; যদি তাঁদের শক্তিশালী গণসম্পৃক্ততা না থাকত তাহলে এ বিজয় অর্জন এত সহজ এবং এত বিশাল হতো না।
ইমারাতে ইসলামী দখলদার আগ্রাসী পরাশক্তির সঙ্গে দীর্ঘ দুই দশকের যুদ্ধে যে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে এবং যে কৌশলী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, আগ্রাসী শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে নিজ দেশের জনগণের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হতে না দেওয়া। এ দীর্ঘ যুদ্ধকালে তারা জনগণকে সাথে নিয়েই চলেছে। এর বিপরীতে পরাশক্তির সঙ্গে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে গিয়ে নিজেদের মাটি ও মানুষের সঙ্গে বৈরিতা তৈরির দৃষ্টান্ত হল, টিটিপি (তেহরিকে তালিবান পাকিস্তান)। এ দলটির ব্যাপারে পাকিস্তান ও বিশে^র অন্যান্য দেশের সাধারণ মুসলমান ও আলেম-উলামা নেতিবাচক বার্তাই পেয়েছেন। বেসামরিক জনগণ ও বেসামরিক স্থাপনাগুলোতে তাদের অহরহ হামলার ঘটনা দেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিঘিœত করার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী ইসলাম ও মুসলমানের ভাব-মর্যাদাকে চরমভাবে ক্ষুণœ করেছে। কিন্তু ইমারাতে ইসলামীর প্রতি আফগান জনগণের এমন কোনো নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়নি। দেশ ও মানুষের সঙ্গে বৈরিতা তো নয়ই; বরং জনতার সাথে মিশে থেকে এবং সর্বস্তরের জনতাকে সঙ্গে নিয়েই ইমারাতে ইসলামী (তালেবান) গড়ে তুলেছে দখলদার পরাশক্তিগুলোর বিরুদ্ধে তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ও দীর্ঘমেয়াদী প্রতিরোধ যুদ্ধ।
ছয়. অপরাধীরা সবসময়ই আতঙ্কিত থাকে
আফগানিস্তানে এখন যে সুরতেহাল তৈরি হয়েছে- ইমারাতে ইসলামী আফগানিস্তান (তালেবান)-এর ক্ষমতার কেন্দ্রে প্রত্যাবর্তন নিয়ে, কয়েক মাস আগে থেকেই এটা ছিল অনুমিত। বিশেষ করে পশ্চিমা সৈন্যদের আফগানিস্তান ত্যাগের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর থেকে এটা অনেকটা সময়ের ব্যাপার ছিল। তবে যতদিনে এমনটা ঘটবে বলে মনে করা হয়েছিল এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়ার যে অনুমান প্রচার করা হচ্ছিল তার চেয়ে অনেক অনেক কম সময়ে তা ঘটে গেছে। এই নিয়ে এখন পুরা বিশ্বেই আতঙ্ক। বড় বড় শক্তিগুলো এবং প্রভাবশালী মিডিয়াগুলোর (স্বদেশীসহ) ভাষা ও আচরণে আতঙ্কের আলামত স্পষ্ট। কিন্তু কেন? আফগান জনগণ কি তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনার অধিকার রাখে না? আর আফগানিস্তান বর্তমানে পৃথিবীর একটি দরিদ্র রাষ্ট্র। সে তার সীমানার মধ্যেই তো আছে। তার সাথে অনেক দেশের সীমান্ত জড়িয়ে রয়েছে। এখন যারা ক্ষমতায় তারা চীন, ইরান ও ভারতসহ কোনো দেশেই কখনো অনুপ্রবেশ করেনি। আসলে পরাশক্তিগুলোর পরাজিত হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হওয়াই এদের আতঙ্কিত হবার কারণ। আর আরব ও আজমের বিভিন্ন দেশে তাদের তাবেদাররা এবং বিভিন্ন মুসলিম দেশে নিজেদের জাতিসত্তা পরিপন্থি বিজাতীয়দের চিন্তা-চেতনা দ্বারা পরিচালিত সরকারগুলো, যাদের অনেকেরই গণভিত্তি নেই বললেই চলে, তাদের আতঙ্কিত হওয়ার কারণ অন্য জায়গায়। তাদের এবং তাদের সেবাদাস গণমাধ্যমগুলোর মধ্যে নতুন করে ভয় ঢুকেছে। তারা ভাবছে, যদি এরকম গণজাগরণ তাদের দেশেও এসে যায়...!
সাত. ঈমানী শক্তির উপর কোনো শক্তি নেই
আফগানিস্তানের পূর্বাপর ঘটনা থেকে যে বিষয়টি আবারো দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণিত হয়েছে, তা এই যে, ঈমানী শক্তির উপর কোনো শক্তি নেই। পৃথিবীর দুই দুটি পরাশক্তি লাঞ্ছিত, অপদস্থ ও বিধ্বস্ত হয়ে এবং নিজেদের বহু কিছু খুইয়ে অবশেষে কেন পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যেতে বাধ্য হল? তারা আসলে কীসের কাছে পরাজিত হয়েছে? শক্তি-সামর্থ্য, প্রচার-প্রচারণা সবদিক থেকেই তো আফগানদের সাথে তাদের ব্যবধান ছিল অনেক অনেক বেশি। অস্ত্র-শস্ত্রে তাদের সাথে আফগানদের তুলনা করার তো প্রশ্নই ওঠে না। তারপরও বিগত কয়েক দশকে, বিশেষত নাইন-ইলেভেনের পরের দুই দশকে আফগানরা টিকে থাকল কীসের জোরে? সেটি আসলে অন্য কিছু নয়। সেটি হল ঈমানী শক্তি। তাদের যে শক্তিটিকে স্বচক্ষে দেখতে পেয়েছিলেন আল্লামা ইকবাল। আর তাই হুঁশিয়ার করেছিলেন এই শক্তিটি কেড়ে নেওয়ার জন্য তাদের দুশমনদের সম্ভাব্য ষড়যন্ত্রের বিষয়ে। তাদের এই শক্তি ও সম্পদকে ধ্বংস করতে তারা লেগে পড়বে, সে আশঙ্কাও তিনি প্রকাশ করেছিলেন ইবলীসের ভাষায়। ইমারাতে ইসলামী আফগানিস্তান (তালেবান)-এর বিজয়, এটি ঈমান এবং কুফরের মধ্যকার চিরন্তন যুদ্ধে ঈমানেরই বিজয়।
এটি আসলে নতুন কিছু নয়। ইসলামের শুরু থেকেই যদি আমরা লক্ষ করি তাহলে বিভিন্ন গযওয়া (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সরাসরি অংশগ্রহণে সংঘটিত যুদ্ধ) ও পরবর্তীতে আমীরুল মুমিনীনদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত অসংখ্য যুদ্ধে শত্রুদের বহু শক্তিধর বাহিনীর বিরুদ্ধে মুসলমানরা যেসব বিজয় অর্জন করেছেন, সেখানে বাহ্যিক উপায়-উপকরণ প্রতিপক্ষের তুলনায় কমই ছিল। তারপরও তারাই জয়ী হয়েছেন। এটা সম্ভব হয়েছে সততা ও নিষ্ঠা এবং ঐক্য ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং ঈমানী শক্তির জোরেই।
আফগান জনগণ ও তালেবানরা তো মোকাবেলা করেছে আগ্রাসী দখলদার বাহিনীর। ইসলামী সরকারের অধীনে পরিচালিত একটি মুসলিম দেশে অন্যায় আগ্রাসন চালিয়েছিল বিশ্ব-কুফরী শক্তি। এক্ষেত্রে ইসলামের দৃষ্টিতে সেটা ছিল দিফা‘য়ী (আত্মরক্ষামূলক) জিহাদ। কোনো মুসলিম জনপদ কুফরী শক্তি দ্বারা আক্রান্ত হলে আমীরুল মুমিনীন যখন তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ-যুদ্ধের আহ্বান করেন তখন দেশের সামর্থ্যবান প্রতিটি নাগরিকের জন্য সেই প্রতিরোধ যুদ্ধে শামিল হওয়া আবশ্যকীয় হয়ে পড়ে। আফগানরা সে কাজটিই করেছে। অল্প কিছু দালাল, লোভী ও ক্ষমতালিপ্সু লোকজন ছাড়া প্রায় সকল আফগান নাগরিক দখলদার পরাশক্তিগুলোর হাত থেকে তাদের দেশকে মুক্ত করতে কয়েক দশক ধরে অব্যাহতভাবে বহুমুখী লড়াই চালিয়ে গেছে।
ঈমানী শক্তিতে বলীয়ান সেই লড়াইয়ে বিজয় তো অবশ্যম্ভাবীই থাকে। কখনো তা আসতে হয়তো বিলম্ব হয়। আফগানরা আজ সেই বিজয়ই উদ্যাপন করছে, যা তাদের প্রাপ্য ছিল।
ইমারাতে ইসলামী আফগানিস্তানের কাছে প্রত্যাশা
এ প্রসঙ্গে মূলকথায় যাওয়ার আগে বর্তমান আফগানিস্তানে যারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন তাদের নামের বিষয়টি পরিষ্কার করে নেয়া ভালো মনে হয়। বিশ্ব মিডিয়া এখনও তাদেরকে তালেবান নামেই প্রচার করছে। আমরা জানি, طالبان (তালিবান) একটি ফার্সি ও পশতু শব্দ। যার অর্থ, ছাত্রগণ। মোল্লা ওমর রাহ.-এর নেতৃত্বে যে তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতায় এসেছিল, তাদের অনেকেই তখন ছিলেন ছাত্র অথবা সদ্য লেখাপড়া শেষ করা যুবক আলেম। বর্তমানে তাদের অনেকেই পরিণত বয়সে উপনীত হয়েছেন। দাড়ি-গোঁফ সাদা হয়ে গেছে অনেকেরই। তারা তাদের সংগঠনের একটি নামও রেখেছিলেন। সেটি হল-
امارت اسلامى افغانستان
(ইমারাতে ইসলামী আফগানিস্তান)। তাই এখন আর তাদের নাম তালেবান নয়। তারা এখন ছাত্রও নেই। তাদের জন্যে ‘ইমারাতে ইসলামী আফগানিস্তান’ নামটিই ব্যবহার করা উচিত।
শুরুতেই আশার আলো
একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ১৯৯৬ সনের মোল্লা ওমর রাহ.-এর নেতৃত্বে গঠিত তালেবান শাসনের তুলনায় বর্তমান ইমারাতে ইসলামী আফগানিস্তানকে বেশ পরিণত মনে হচ্ছে। পরাশক্তিগুলো আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়া শুরু করার পর থেকে যেভাবে তারা বিনা বাধায় প্রদেশের পর প্রদেশ নিজেদের আওতায় নিয়ে এসেছেন- এক্ষেত্রে তাদের ধৈর্য ও বুদ্ধিমত্তা দেখে শত্রুরাও অবাক না হয়ে পারেনি। যেখানে এখনো তাদের নিয়মতান্ত্রিক সরকার গঠিতই হয়নি, সে অবস্থায় জনপ্রশাসনের দপ্তরগুলোকে সচল করা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে খুলে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া এবং সর্বোপরি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মাধ্যমে বড় ধরনের রক্তপাত এড়ানো, সেইসাথে যারা সংশোধন হয়ে সৎ পথে ফিরে আসতে চায় তাদেরকে সে সুযোগ করে দেওয়ার মত কাজগুলো বিশ্বব্যাপী ভালো মানুষদের ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে।
পরাশক্তি নিয়ন্ত্রিত বিশে^র প্রভাবশালী প্রচার মাধ্যমগুলো তাদের দোষত্রুটির জন্যে তো হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু এমন কোনো বড় সুযোগ এখন পর্যন্ত তাদেরকে দেয়নি ইমারাতে ইসলামী।
উদাহরণস্বরূপ, কাবুল বিমানবন্দরে দু-তিনজনের মৃত্যুর ঘটনা। ‘ইমারাতে ইসলামী আফগানিস্তান’ রাজধানী কাবুলে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর সুযোগ সন্ধানী (সত্যসন্ধানী নয়) মিডিয়াগুলো দুই-তিন দিন পর্যন্ত যখন তালেবানদের হাতে কোনো হত্যাকাণ্ডের খোঁজ-খবর দিতে পারেনি, তখন আশরাফ গনির অনুগত কিছু লোকের কাবুল বিমানবন্দরে নিহত হওয়ার ঘটনাকে প্রচার করে তারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চেয়েছিল। পরে তারাই আবার বলতে বাধ্য হয়েছে যে, মূলত দিকবিদিকশূন্য হয়ে পালানোর সময় বিমানে উঠতে গিয়ে হুড়োহুড়ির কারণে ঐ লোকগুলো মারা গিয়েছে। আসল সত্যটি সামনে আসার পর বিশ্বমিডিয়ার ‘মিসকীনি’ (অসহায়) ভাব দেখে নিরপেক্ষ মানুষের সত্যিই করুণা হয়েছে তাদের জন্য ।
কিছু প্রত্যাশা
যাইহোক, ভবিষ্যতের কথা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলাই ভালো জানেন। তবে একটি বড় প্রাপ্তি তো ঘটে গেছে সন্দেহ নেই। যেটা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি যে, শুধু বড় পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই নয়; বরং ন্যাটো জোটের মাধ্যমে পুরো ইউরোপ এবং আরো কিছু বড় বড় রাষ্ট্রের সৈন্যদের চরম পরাজয় হয়েছে আফগানিস্তানে। আমরা মনে করি, ভবিষ্যত বিশ্বশক্তির ভারসাম্যের জন্য এটা সহায়ক ভূমিকা হিসেবে কাজ করবে। যদি পরাশক্তিগুলো এর থেকে সামান্যও শিক্ষা নেয়।
এখন নতুনভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ইমারাতে ইসলামীর দিকে তাকিয়ে থাকবে পুরো বিশ্বমুসলিম। সৎ, যোগ্য, মুত্তাকী ও যুগসচেতন উলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানে দক্ষতার সাথে ইসলামী শরীয়া মোতাবেক তারা রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন- এমন প্রত্যাশা তো নিশ্চয়ই সচেতন সকল মুমিনের অন্তরেই রয়েছে। পূর্বাপর পরিস্থিতিগুলোর বিবেচনায় এবং সীরাতে নববীয়্যাহ (على صاحبها أفضل الصلاة و التحية) -এর মাক্কী ও মাদানী জীবনের শিক্ষা এবং ইসলামের الحكمة في الدعوة و السياسة [দাওয়াত ও রাজনীতির ক্ষেত্রে ইসলামের শেখানো হিকমাহ (কলাকৌশল)]-কে সামনে রেখে তারা রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন- এমন প্রত্যাশাই লালন করছেন বিশ্বের দ্বীনী ব্যক্তিত্বগণ। তাদের কাছে আমাদের আরো কিছু প্রত্যাশার কথা নিম্নে তুলে ধরা হল :
এক. ধীরে চলা
আমরা আশা করছি, উসূল ও আকায়েদ (ইসলামী বিশ্বাস ও মৌলনীতি)-এর উপর অনড়-অটল থেকে, দেশ ও বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে, রাষ্ট্রীয়ভাবে জনগণের উপর শরীয়া আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে তারা কিছুটা ‘ধীরে চলো’ নীতি অবলম্বন করবেন। যেন বিগত দুই দশক থেকে চাপিয়ে দেওয়া বিজাতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির সম্মুখীন হওয়া আফগান জনগণ শরীয়া আইনে চলতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।
দুই. ‘রুখাসে’র বিষয়ে ছাড়
দ্বিতীয় প্রত্যাশা, যেসব ক্ষেত্রে শরীয়তে عزيمة (আযীমত, তথা মূল বিধানের উপর অটল থাকার নীতি) এবং رخص (রুখাস, শরীয়তের সীমার ভিতরে থেকে ছাড়)- দুটো বিষয় রয়েছে, সেখানে উলামায়ে কেরামের পরামর্শে গণমানুষের জন্য রুখাসের পথকে তারা বেছে নেবেন।
তিন. অভ্যন্তরীণ ঐক্যকে জোরদার করা
তৃতীয়ত, আফগানিস্তান হচ্ছে বহু জাতি ও গোষ্ঠীর সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা একটি দেশ। যদিও সেখানে পশতুভাষী পখতুনরা (পাঠান) সংখ্যাগরিষ্ঠ, তথাপি সেখানে আরো বহু বংশের মুসলমান রয়েছেন। স্বভাবতই তাদের ভাষা এবং কৃষ্টি-কালচারেও তারতম্য রয়েছে। আর পরাশক্তিগুলোর চাপিয়ে দেওয়া কয়েক দশকের যুদ্ধে ভীষণভাবে বিধ্বস্ত হওয়ার কারণে আফগান জাতি বিভক্ত হয়ে আছে বহু ভাগে। তাই ইসলামী সরকারকে আফগানদের ঐক্য সুপ্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে বেশি করে নজর দিতে হবে। যেন কারো প্রপাগান্ডার শিকার হয়ে এবং বাইরের শক্তির আশ্রয়-প্রশ্রয়ে সেখানে কোনো উপদল সৃষ্টি হতে না পারে এবং তারা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ক্ষতি করতে না পারে।
চার. প্রতিরক্ষাকে মজবুত করা
আমরা আরো আশা করছি যে, রাষ্ট্রের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে স্থায়ী ও সুদৃঢ় করার জন্যে এবং ভবিষ্যতের সম্ভাব্য হুমকির মোকাবেলায় আধুনিক যুদ্ধ সরঞ্জামে সজ্জিত একটি মজবুত প্রতিরক্ষা বিভাগ গড়ে তুলতে তারা এখন থেকেই তৎপর হবেন এবং সম্ভাব্য সকল উপায়ে সর্বাত্মক প্রয়াস চালাবেন। এটা ঠিক যে, আল্লাহ তাআলার গায়েবী নুসরত শামিলে হাল হওয়ায় নিজেদের বুদ্ধিমত্তা ও রণকুশলতাকে কাজে লাগিয়ে তারা পুরোনো প্রযুক্তির অতি সাধারণ মানের হালকা অস্ত্র ব্যবহার করেও সর্বাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত সুপ্রশিক্ষিত বিশাল সৈন্যবাহিনীগুলোকেও সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত ও ধরাশায়ী করেছেন। সেটা ছিল দখলদার কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার পর সেই পরিস্থিতিতে নিজেদের বিদ্যমান সামর্থ্য দিয়েই শত্রুর জবাব দেয়া। কিন্তু ইমারাতে ইসলামীকে তো যেতে হবে বহু দূর। আফগানিস্তানকে নিরাপদ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে সামরিক খাতেও তাদের নিতে হবে সময়োপযোগী বিভিন্ন উদ্যোগ...।
পাঁচ. কৌশলী পররাষ্ট্রনীতি
নবগঠিত আফগান ইসলামী সরকারকে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও খুবই কৌশলী হতে হবে। স্থায়ী ও অস্থায়ী শত্রু-মিত্র বাছাইয়ে সচেতনতা, জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে দরকষাকষি, আফগানিস্তানে আল্লাহ প্রদত্ত অঢেল প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগিয়ে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিশ্চিত করতে সঠিক লোকদের নির্বাচন... এসব বিষয়ে তারা দক্ষতার স্বাক্ষর রাখবেন বলে আমাদের প্রত্যাশা।
ছয়. ষড়যন্ত্রের বিষয়ে সচেতন থাকা
কোনো সন্দেহ নেই যে, পরাজিত বিশ্বশক্তিগুলো এবং তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম শুধু এই সরকারের দোষত্রুটি খুঁজতেই ব্যস্ত থাকবে না; বরং এ সরকারকে অকার্যকর করা এবং তাদের ক্ষতিসাধনের জন্য যে কোনো সুযোগকে তারা ধুর্ততার সঙ্গে লুফে নেবে। তারা পেছনে লেগেই থাকবে। তাই ষড়যন্ত্রের বিষয়ে সতর্ক ও সচেতন থাকা এবং কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা অতিআবশ্যক।
সাত. আন্তর্জাতিক মানের শক্তিশালী মিডিয়া সেল গড়ে তোলা
ইমারাতে ইসলামী আফগানিস্তান ইতিমধ্যেই অনেক বিষয়ে সচেতনতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে এবং দিয়ে যাচ্ছে। নিজেদের বার্তা এবং যে কোনো বিষয়ে নিজেদের অবস্থান বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে গণমাধ্যমের ভূমিকার বিষয়টি উপলব্ধিতে নেয়ার ফল হিসেবেই আমরা কাতারে এবং আরো কিছু জায়গায় তাদের মুখপাত্রদের সেই দিক থেকে প্রস্তুত হবার কিছু নমুনা দেখতে পেলাম, যা অবশ্যই আশাব্যঞ্জক। যেমনটা মনে হচ্ছে, দেশীয় মিডিয়াগুলোকে সক্রিয় ও শক্তিশালী করতেও তারা ভালো উদ্যোগ নিয়েছেন। তবে এইক্ষেত্রে পুরোপুরি সফল হতে বিশ্ব মানের শক্তিশালী মিডিয়াসেল গঠন করা সময়ের দাবি। প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার একটি মেগাপ্ল্যান ও বহুমুখী প্রকল্প গ্রহণ করে তথ্যমহাসড়কে নিজেদের সগৌরব উপস্থিতি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার অঙ্গনে তাদের এগিয়ে রাখতে অনেক সাহায্য করবে, ইনশাআল্লাহ। আশা করছি, তারা এ বিষয়ে আশু মনোযোগী হবেন।
প্রসঙ্গ : মানবাধিকার
ইমারাতে ইসলামীর হাতে দেশটির নিয়ন্ত্রণভার যাওয়ার পর বিশে^র ‘মানবাধিকারে’র ফেরিওয়ালারা আবারো বকবক শুরু করেছে। তাদের অনেকেই বলছেন, তালেবানরা যেন মানবাধিকারের প্রতি সম্মান দেখায়। কেউ কেউ বলছে, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা না করলে তাদেরকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে না। জাতিসংঘের কেউ কেউ এবং তথাকথিত কিছু মানবাধিকার সংগঠন বেশ চেঁচামেচি করছে। জানি না, কোন্ মতলবে এবং কোন্ নৈতিক শক্তি থেকে তারা এমনটা করছে। কয়েক দশক ধরে একটি দেশের সার্বভৌমত্বকে ভূলুণ্ঠিত করে পরাশক্তিগুলো যখন সেখানে আস্তানা গেড়ে বসে রইল এবং অসংখ্য বেসামরিক লোকদের নির্মমভাবে হত্যা করল, অকথ্য নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে গোটা জনপদ তছনছ করে দিল এবং একটি জাতির বিশ্বাস ও সভ্যতাকে পাল্টে দেওয়ার জন্য জঘন্য সব উপায়ে চেষ্টা চালিয়ে গেলো... তখন সবকিছু দেখেও যারা মুখে কুলুপ এঁটে বসে ছিল, তাদের মুখে কি আর ‘মানবাধিকার’ শোভা পায়?
যে পশুশক্তি তালেবানদেরকে দমন করার নামে হাজার হাজার নিরীহ লোকদের হত্যা করেছে, এমনকি যাদের হাত থেকে প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিশুরাও রক্ষা পায়নি, মজসিদ-মাদরাসা-হাসপাতাল এবং জনসমাগমের কোনো এলাকাই বাদ যায়নি; তাদের প্রতিনিধিরাই আবার শোনাচ্ছে মানবাধিকার ও মানবদরদের কথা! এমন মানবাধিকার ও তার প্রবক্তাদের জন্য করুণা ছাড়া আর কি-ই বা করার আছে!
প্রসঙ্গ : স্বদেশী গণমাধ্যম
গত সপ্তাহে গিয়েছিলাম একটি বড় কোম্পানির শো-রুমে। দেখেই ম্যানেজার সাহেব বলে উঠলেন, ‘স্যার, আমাদের দেশের টেলিভিশনগুলো (তিনি কয়েকটির নামও নিলেন) তো এমনভাবে খবর প্রচার করছে, যেন তালেবানরা এখন বাংলাদেশের বর্ডারেই আছে। কিছুক্ষণ পরেই আমাদের দেশে আক্রমণ করে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে’।
শুনে হাসলাম। আর ভাবলাম, এদেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া তালেবানদেরকে নিয়ে যে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে, এটি কি শুধু অপপ্রচার, না আসলেই তারা এই পর্যায়ের ভীতসন্ত্রস্ত। যদি দ্বিতীয়টি হয়ে থাকে তাহলে তো এদেশের সাধারণ মুসলিম জনতা কখনো জেগে উঠলে আশরাফ গনি ও তার লোকদের চেয়েও এদের পলায়ন ঘটবে আরো দ্রুত এবং আরো করুণভাবে। যারা আফগানিস্তানে ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে এদেশের তরুণরা সেখানে চলে যাবে- এরকম অপপ্রচার চালাচ্ছেন, তারা কি তা বুঝেই বলছেন? যখন আফগানিস্তানে যুদ্ধ ছিল তখন কারো কারো সেখানে গিয়ে আফগান মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের বিষয়টির যৌক্তিকতা থাকলেও এখন এদেশের যুবকরা কেন সেখানে যাবে? এরা আসলে সবসময়ই ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করে মতলব হাসিল করতে চায়। কিন্তু এবার তারা ধরা পড়ে গেছে...!
অতএব গণমাধ্যমগুলোকে আমরা আহ্বান জানাবো, সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করা বন্ধ করুন। সাংবাদিকতার নীতি ও আদর্শ মেনে সত্য, সততা ও ন্যায়ের সঙ্গে থাকুন। তাতে পরিণামে আপনারাই লাভবান হবেন...।
আমাদের গণমাধ্যমগুলো বিদেশ ও বিদেশীদের হুকুম তামিল করার পরিবর্তে দেশ ও দেশের জনগণের স্বার্থ রক্ষার জন্য যদি তাদের মেধা, শক্তি এবং শ্রমের সামান্য কিছু অংশও ব্যয় করত তাহলে দেশের অবস্থা আজ কিছুটা হলেও ভালো হত।
শেষ কথা
ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম রাষ্ট্র আফগানিস্তান সবেমাত্র দখলদার মুক্ত হয়েছে। সেখানে ইসলামী শাসনে বিশ্বাসী মুসলিম জনতার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কয়েক দিন হল। কিন্তু এখনো সেখানে তারা সরকার গঠন করেননি। সে প্রক্রিয়ায় তারা রয়েছেন। দরদী মনের ব্যাকুলতা থেকে আমরা তাদের জন্য উপরের প্রত্যাশাগুলো ব্যক্ত করলাম। যেমন করেছেন এবং করে যাচ্ছেন অন্য মুসলিমগণও।
পরিশেষে আমরা নবগঠিত ইমারাতে ইসলামী আফগানিস্তান সরকারের সর্বাত্মক কামিয়াবীর জন্য আল্লাহ তাআলার দরবারে কায়মনোবাক্যে দুআ করছি, তারা যেন ইসলামী শরীয়তের এ‘তেদাল-এর উপর থেকে সঠিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করে একবিংশ শতাব্দীতে একটি নজির স্থাপন করতে সক্ষম হন।
আল্লাহ তাআলাই তাওফীকদাতা। হ