দুআয়ে মাগফিরাতের আবেদন
গত যিলহজ্ব ১৪৪২ হি. ও মুহাররম ১৪৪৩ হি. এ দুই মাসে আমরা অনেক উলামা-মাশায়েখকে হারিয়েছি। অনেক মানুষই তাদের প্রিয়জনদের হারিয়েছেন। কেউ হারিয়েছেন মা-বাবা, কেউ সন্তান, কেউ আত্মীয়-স্বজন। কিন্তু মুসলিম ইসলামী শরীয়তের শিক্ষা এবং নিজ ঈমানী চেতনার ফলে আল্লাহ তাআলার ফয়সালার উপর রাজি থাকে এবং সবর ও শোকরের পরিচয় দেয়।
সম্প্রতি অনেক মানুষই ইন্তেকাল করেছেন; কিন্তু দারুল উলূম দেওবন্দের উস্তায হযরত মাওলানা আব্দুল খালেক সাম্ভলী, দারুল উলূম হাটহাজারীর সাবেক নায়েবে মুহতামিম হযরত মাওলানা শাহ হাফেয মুহাম্মাদ কাসেম রাহ. এবং দারুল উলূম হাটহাজারীর শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীর ইন্তেকাল প্রত্যেক আলেম ও তালিবুল ইলমকে কাঁদিয়েছে।
দেশ ভিন্ন হওয়াতে হযরত সাম্ভলী রাহ. থেকে তো বান্দার খুব বেশি ইস্তেফাদার সুযোগ হয়নি; কিন্তু হযরত মাওলানা শাহ হাফেয মুহাম্মাদ কাসেম রাহ. ও হযরত বাবুনগরী রাহ.-এর সাথে আমার সম্পর্ক অনেক পুরোনো। হাফেয মুহাম্মাদ কাসেম রাহ. সম্পর্কে আলকাউসারে হয়তো সামনে কোনো লেখা আসবে। হযরত বাবুনগরী রাহ.-এর যিয়ারতে ধন্য হয়েছি আমি অনেকবার। অবশ্য তাঁর সাথে সাক্ষাৎ হওয়ার পূর্বেই তাঁর নাম ও কর্মের সাথে পরিচিত হয়েছি। আমাদের উস্তায হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রশীদ নোমানী রাহ.-এর কাছে তার প্রশংসা শুনেছি। আর বাবুনগরী রাহ.-এর শাগরিদ উলূমুল হাদীসে আমাদের সহাপাঠী মাওলানা নূরুল্লাহ ইবনে খুরশিদ হুসাইন ছাহেব (মতলব, চাঁদপুর) থেকেও করাচী থাকতেই তাঁর সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছি।
বাবুনগরী রাহ. হযরত বানূরী রাহ.-সহ এখানের-ওখানের বহু আকাবিরের ফয়েয লাভে ধন্য হয়েছেন। জীবনের অধিকাংশ সময় তালীম-তাদরীস ও ওয়ায-নসীহতে অতিবাহিত হয়েছে। পরবর্তীতে দ্বীনী প্রয়োজন বিবেচনায় কিছু দাওয়াতী কাজের সাথেও যুক্ত হয়েছিলেন এবং হযরত মাওলানা আহমাদ শফী রাহ.-এর ইন্তেকালের পর হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ-এর আমীর নিযুক্ত হয়েছিলেন।
তিনি হযরত নোমানী রাহ.-এর অনেক প্রশংসা করতেন, তাঁর প্রতি অগাধ ভক্তি-ভালবাসা পোষণ করতেন এবং তাঁর রচিত কিতাবাদি থেকে পূর্ণ উপকৃত হতেন। নোমানী রাহ.-এর সাথে তার চিঠি-পত্রও আদান-প্রদান হত।
করাচীতে আমাদের ছাত্রযামানায়ই বাবুনগরী রাহ.-এর কিতাব ‘ইসলাম আওর সাইন্স’ (প্রকাশক : মাজলিসুল বুহুসিল ইসলামিয়া, জামেয়া বাবুনগর, চট্টগ্রাম, প্রকাশকাল : ১৪০৯ হি. মোতাবেক ১৯৮৮ ঈ.) আমাদের হস্তগত হয়। যতটুকু মনে পড়ে, বাবুনগরী রাহ. তাঁর এই কিতাব এবং তাঁর মুহতারাম আব্বাজান হযরত মাওলানা আবুল হাসান রাহ. (লেখক, তানযীমুল আশতাত)-এর রিসালা-
تنظيم الدراية لحل عويصات الهداية
(যা বাবুনগরী রাহ.-এর তাহকীক ও তারতীবে প্রকাশিত হয়েছিল) হযরত নোমানী রাহ.-এর জন্য হাদিয়া পাঠিয়েছিলেন।
আল্লাহ তাআলা হযরত বাবুনগরীকে ভরপুর মাগফিরাত করুন, তাঁর দারাজাত বুলন্দ করুন এবং তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন- আমীন।
যিলহজ্ব ১৪৪২ হি.-এ আমরা নিজেরাও কিছু শোকাবহ ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি। মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা’র বিশিষ্ট উস্তায এবং মাসিক আলকাউসারের সহ-সম্পাদক আমাদের প্রিয়ভাজন হযরত মাওলানা হাফেয মুহাম্মাদ যাকারিয়া আবদুল্লাহ ছাহেবের মুহতারাম আব্বা-আম্মাও আখেরাতের সফরে রওয়ানা হয়ে গেছেন।
মাওলানা যাকারিয়া ছাহেবের আব্বাজান জনাব আলহাজ¦ নসীব উল্লাহ ছাহেব তো বেশ কিছুদিন থেকে হাসপাতালে (আইসিইউতে) চিকিৎসাধীন ছিলেন; কিন্তু আব্বার আগেই তাঁর আম্মার ইন্তেকাল হয়ে যায়। ৭ যিলহজ্ব রবিবার দিন শেষ হয়ে ৮ যিলহজ্ব সোমবারের রাত শুরু হয়েছে। মাওলানা যাকারিয়া আব্বার ইয়াদাত থেকে ফারেগ হয়ে বাসায় গিয়ে দেখেন, আম্মা ঘুমিয়ে গেছেন। ফলে তিনিও শুয়ে যান। ফজরে উঠে দেখেন, তিনি আখেরাতের মুসাফির হয়ে গেছেন!
رَحِمَهَا الله رَحْمَةً وَاسِعَةً وَغَفَرَ لَهَا وَغَسَلَهَا بِالْمَاءِ وَ الثَلْجِ وَالْبَرَدِ، وَ أسْكَنَهَا الْجَنَّةَ جَنَّةَ الْفِرْدَوْسِ.
মঙ্গলবার বাদ যোহর দারুল উলূম মাদানী নগরে তাঁর জানাযা অনুষ্ঠিত হয় এবং মাদানীনগরে তাদের বাড়ির কাছেই এলাকার কবরস্তানে তাঁর দাফন হয়।
মুহাম্মাদ ইবনে যাকারিয়ার নানাজান হযরত মাওলানা নূরুল ইসলাম ছাহেব দা. বা.-এর নির্দেশে এবং আমার অনুরোধে মাওলানা যাকারিয়া আবদুল্লাহ জানাযা পড়ান। জানাযায় তার ভাই হাফেয মাওলানা এনআমুল হাসানও উপস্থিত ছিলেন। তিনি রাজশাহী থেকে সময়মতই পৌঁছে গিয়েছিলেন।
মাওলানা যাকারিয়া ছাহেবের আব্বাজান যেহেতু আইসিইউতে ছিলেন তাই তাঁকে মৃত্যুসংবাদ জানানো সমীচীন মনে করা হয়নি। মঙ্গলবার দুপুরে তার আব্বাজান তাকে বেশ কিছু ওসিয়তের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। আগামীকাল বুধবার (১০ যিলহজ্ব ১৪৪২ হি.) তাঁর পক্ষ থেকে কুরবানী করা হবে- একথা জেনে তিনি খুব খুশি প্রকাশ করেন এবং অনেক দুআ করেন। জনৈক ব্যক্তি তাঁর উপর যুলুম করে আসছিল, তার বিষয় উল্লেখ করে বলেন যে, তার সাথে মুআমালা সাফ হয়ে গেলে ভালো হত। কিন্তু এটি তো তাঁর হাতে ছিল না।
রাতে বাবার ইয়াদাত থেকে ফারেগ হয়ে মাওলানা যাকারিয়া বাসায় ফেরেন। কিছুক্ষণ পর হাসপাতাল থেকে ফোন করে তাকে যেতে বলা হয়। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর আব্বাজান নিজের আসল ঠিকানায় পৌঁছে যান!
اَللّهُمَّ ارْحَمْهُ وَاغْفِرْلَه وَأكْرِمْ نُزُلَه وَوَسّعْ مُدْخَلَه وَاغْسِلْهُ بِالْمَاءِ وَالثّلْجِ وَالْبَرَدِ وَنَقّهِ مِنَ الذُّنُوْبِ كَمَا يُنَقّى الثّوْبُ الْأبْيَضُ مِنَ الدَّنَسِ.
আমরা খবর পাই বাদ ফজর। জানাযার নামায উত্তরা সাত নাম্বার সেক্টর পার্ক মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়। এবার আমাকেই জানাযায় ইমামতি করতে হয়। ঈদের নামাযের পর জানাযা হয়। আর দাফন হয় মায়ের পাশে মাদানীনগরে তাদের এলাকার কবরস্তানে।
আলহামদু লিল্লাহ, মা-বাবা উভয়ের সময় মাওলানা যাকারিয়া আবদুল্লাহ ‘সবরে জামীল’-এর পরিচয় দিয়েছেন। আমরা তাকে আবেদন করেছিলাম, নিজ মা-বাবার জীবনী নিয়ে কিছু লিখতে। ইনশাআল্লাহ তিনি লিখবেন। আমরা তো সংক্ষেপে এতটুকুই বলব- যে মা-বাবা এমন সন্তান রেখে গেছেন তাঁরা সত্যিই ভাগ্যবান!
মাওলানা যাকারিয়া একটি লেখায় প্রসঙ্গক্রমে নিজ পিতা সম্বন্ধে লিখেছেন-
میرے والد ماجد -أطال الله بقاءه مع الصحة والعافية- ایک انگریزی تعلیم یافتہ انسان ہے، لیکن دعوت وتبلیغ کی بدولت اللہ تعالی نے ان کو انابت الی اللہ کا وافر حصہ عطا فرمایا ہے۔ بچپن سے والد ماجد نے اپنے بچوں میں انابت الی اللہ پیدا کرنے کی کوشش کئے ہیں۔
“আমার মুহতারাম আব্বাজান -আল্লাহ তাআলা সুস্থতা ও নিরাপত্তার সাথে আমাদের উপর তাঁর ছায়া দীর্ঘ করুন- ইংরেজি শিক্ষিত একজন মানুষ। কিন্তু দাওয়াত ও তাবলীগের বদৌলতে আল্লাহ তাআলা তাঁকে পরিপূর্ণ ‘ইনাবাত ইলাল্লাহ’ ও আল্লাহমুখিতার নিআমত দান করেছেন। তিনি নিজ সন্তানদের শৈশব থেকেই তাদের মাঝে ‘ইনাবাত ইলাল্লাহ’ সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন।”
এটা স্পষ্ট যে, তার আম্মাজানের মাঝেও এ গুণ বিদ্যমান ছিল। যার ফলশ্রুতিতে আমরা তাঁর এমন ‘সুযোগ্য/নেক সন্তান’-এর তোহফা লাভ করেছি।
فجزاهما الله تعالى خير الجزاء وأوفاه.
মাওলানা যাকারিয়ার দুই ভাই মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া ও হাফেয মাওলানা উবায়দুল্লাহ উভয়েই নিজ মা-বাবার জীবদ্দশায় ইন্তেকাল করেন। এবং উভয়েরই এলাকার ঐ একই গোরস্তানে দাফন হয়েছে। মুহাম্মাদ ইয়াহইয়ার স্মারক-তার এক ছেলে রয়েছে আর মাওলানা উবায়দুল্লাহ বিবাহের পূর্বেই আখেরাতের মুসাফির হয়ে গেছেন।
আল্লাহ তাআলা তাদের প্রত্যেককে ভরপুর মাগফিরাত করুন এবং সকলকে জান্নাতে সমবেত করুন। হযরত মাওলানা যাকারিয়া আবদুল্লাহ ছাহেব এবং তার ভাই হাফেয মাওলানা এনআমুল হাসান এবং তাদের সন্তানদের জন্য আমরা সকলের কাছে দুআর আবেদন করছি- আল্লাহ তাআলা সকলকে দ্বীন-ঈমান ও ‘নুসরতে ইসলাম’-এর উপর অটল-অবিচল রাখুন এবং তাদেরকে সবদিক থেকে আফিয়াত ও সালামাত এবং আম্ন ও আমানত তথা শান্তি ও নিরাপত্তার যিন্দেগী নসীব করুন- আমীন।
-বান্দা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক
১৩ মুহাররম, ১৪৪৩ হি.
২৩ আগস্ট, ২০২১ ঈ.
সোমবার