মুহাররম ১৪৪৩   ||   আগস্ট ২০২১

হযরত মাওলানা তাফাজ্জুল হক রাহ.
সংক্ষিপ্ত জীবন ও কর্ম

মাওলানা তাহমীদুল মাওলা

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

 

রচনা ও লেখালেখি

মাওলানা তাফাজ্জুল হক রাহ. প্রায় ষাট বছর ছাত্র ও সাধারণ মানুষের মধ্যে দ্বীনী ইলম প্রচারের কাজ করে গেছেন। পাশাপশি ছাত্রাবস্থায়ই আরবী ও উর্দু দুই ভাষাতেই লেখালেখির বেশ আগ্রহ রাখতেন। হাটহাজারী মাদরাসায় হেদায়া পড়াকালে ‘ইকতিনাছুশ শাওয়ারিদ ফি ছুহবাতিল আমারিদ’ নামে আরবীতে একটি পুস্তিকা তৈরি করেন, যা পরবর্তীতে প্রকাশিত হয়। কিছু সংযোজন ও বিয়োজন করে পরে এর একটি উর্দু সংকলনও তৈরি করেন। এতে মুফতি ফয়জুল্লাহ রাহ. ও মাওলানা কুরবান আলী রাহ.-এর তাকরীজ তথা প্রশংসাবাক্যও যুক্ত করেন। এটি অপ্রকাশিতই থেকে যায়। করাচি থাকাকালীন ‘জাওয়াহিরুল আদাব ফি লিসানিল আরব’ নামে আরবী লুগাহ ও সাহিত্যের একটি চমৎকার রচনাকর্মের সূচি ও খসড়া তৈরি করে হযরত বানূরী রাহ.-কে দেখান। হযরত দেখে খুশি হন এবং এটি পূর্ণ করার জন্য উৎসাহ দেন। করাচি ও দেওবন্দে থাকাবস্থায় তিনি এর কাজ সম্পন্ন করে ফেলেন। পরবর্তীতে এর একটি সংশোধিত ও পরিমার্জিত কপি তৈরি করান তাঁর ছাত্র মাওলানা আব্দুল মালিক ওলীপুরীকে দিয়ে। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত সেটাও অপ্রকাশিতই ছিল। অবশেষে ২০১২ সলে অধমের সামান্য মেহনত যুক্ত হয়ে হযরাতুল উসতায মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেবের সংক্ষিপ্ত ভূমিকাসহ এটি মাকতাবাতুল আযহার ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়।

এরপর দীর্ঘ সময় বহুমুখী কাজের চাপে এ কাজে মনোযোগ দিতে পারেননি। প্রথম যুগের আংশিক ও পূর্ণাঙ্গ অনেক লেখা ও লেখার খসড়া তাঁর কাছে সংরক্ষিত ছিল। একসময় তাঁর হাতে লেখা প্রায় সবকিছুই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এজন্য  আজীবন  হযরত মাওলানার মনে অনেক কষ্ট ছিল।

দশ-বারো বছর আগের কথা। তাঁর চতুর্থ ছেলের বিয়ের পরদিন তিনি বেশ অসুস্থতা ও অস্বস্তি বোধ করছিলেন। আমি একাই তাঁর পাশে ছিলাম। একদিন তিনি বললেন, আমার সব সংগ্রহ উঁইপোকা খেয়ে ফেলেছে। যা ছিল তাও ঘর পরিষ্কার করার সময় ওরা খোয়াই নদীতে ফেলে দিয়েছে। দুটো কিতাব আমার এক ছাত্রের কাছে ছিল, সেও আর পাওয়া গেল না। কথাগুলো তিনি বারবার বলছিলেন। আমি তাঁকে আশ্বাস দিলাম এবং পরে বেশ দৌড়ঝাঁপের পর তাঁর প্রিয় ছাত্র মাওলানা আবদুল মালিক ওলীপুরীর কাছ থেকে কিতাবদুটো অক্ষত অবস্থায় সংগ্রহ করলাম। মাওলানা আব্দুল মালিক ওলীপুরী কিতাবদুটো তার ঘরের মাচার উপর এমনভাবে সংরক্ষিত পেয়েছিলেন, মনে হয়েছে এটা তাঁর কারামত ছিল। এর মধ্যে ‘জাওয়াহিরুল আদাব’ কিতাবটি আমার খুব পছন্দ হয়। তখন থেকেই এটি নিয়ে কিছু কাজ করার ইচ্ছা করি। হযরতের ধারণা ছিল-এ কিতাবের অনেক উৎসগ্রন্থ প্রাচীন। আমি হয়ত সফলভাবে এটি প্রকাশের ব্যবস্থা করতে পারব না। কিন্তু আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় দেশ ও দেশের বাইরে থেকে এর সবগুলো উৎস ও সহায়ক গ্রন্থ সংগ্রহ করতে পারি। আলহামদু লিল্লাহ মাস তিনেক অনেক খাটুনি করে বইটি ছাপার উপযুক্ত করতে সক্ষম হই। কাজ চলমান দেখে তাঁর থেকে একেকবার যে আনন্দ ও তৃপ্তি ঠিকরে পড়ত তা আমাকে কাজে শক্তি ও উৎসাহ যুগিয়েছে। শেষ কয়েকদিন কাজ নিয়ে যতবার তাঁর সাথে কথা হয়েছে, যতবার দেখা হয়েছে, মনে হয়েছে তিনি তাঁর উচ্ছাস চেষ্টা করেও আটকে রাখতে পারছেন না। বই প্রকাশিত হল। প্রায় পাঁচশ কপি তিনি বিভিন্ন জনকে হাদিয়া দেন। আল্লাহ তাকে উত্তম বদলা দান করুন।

ক’দিন পর হযরত মাওলানার হাদীসের সনদের উপর একটি আরবী গ্রন্থ তৈরির কাজে হাত দিই। এটিও তাঁর স্পষ্ট ইঙ্গিতেই শুরু করেছিলাম। প্রাথমিক কাজ শেষ করে দুইবার তাঁকে দেখানো হয়েছিল। এতেও তিনি অসম্ভব খুশি প্রকাশ করেছিলেন। মাঝপথে বিশেষ কারণে প্রায় তিন বছর কাজ একেবারেই বন্ধ থাকে। দীর্ঘদিন পর ইনতিকালের কয়েক মাস আগে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে তাঁর সাথে দেখা হলো। অনেক কথার ফাঁকে সাক্ষাৎটি অর্থবহ করার জন্য আমি নিয়ত করি, সব বাধা অতিক্রম করে এবার সনদের কিতাবটি প্রস্তুত করবই ইনশাআল্লাহ। নিয়ত পোক্ত করে তাঁকে বললাম, ইনশাআল্লাহ আগামী সাক্ষাতে সনদের কিতাবটি ছাপার উপযুক্ত করে আপনাকে দেখাব।

তিনি হেসে বললেন, ‘ঠিক আছে, আমারে দেখাইও, আমি দেখে দেব’।

তিনি এত বেশি খুশি হলেন যে, কথাগুলো কয়েকবার বলতে থাকলেন। তাঁর আগ্রহ আর আনন্দ দেখে আমি নিজেও যারপরনাই উৎসাহিত হই। বাসায় এসে রাতভর কিতাবের নাম ঠিক করলাম। কাজ শুরু করব করব করে প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু তাঁকে এ কাজটি দেখিয়ে তার পরম তৃপ্তির হাসি আর দেখা হল না...। 

শেষদিকে হযরতের মধ্যে ‘ইমলা’ তথা শ্রুতিলিখনের মাধ্যমে রচনা সংকলনের আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল। আল্লামা সুয়ুতী রাহ.-এর ‘আলইতকান ফী উলূমিল কুরআন’ কিতাবের তালখীস ও তাহযীব করার আগ্রহের কথা আমাকে একাধিকবার বলেছেন। আমি কাজটি করার জন্য প্রস্তুতও ছিলাম। আফসোস, বিশেষ কারণে এটিও আর পূর্ণতা পেল না। অবশ্য তরুণ আলেম মাওলানা আব্দুল্লাহ মাসুম শ্রুতিলিখনের মাধ্যমে কিছু কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। ‘আমার দেখা মনীষীদের স্মৃতিচারণ’ নামে প্রথমে মাসিক আলকাউসারে কয়েক কিস্তি এবং পরে বই আকারে প্রকাশিত হয়।

আমার খুব ইচ্ছা ছিল, তাঁর প্রায় ষাট বছরের ওয়ায ও দাওয়াতের ময়দানে কাজের অভিজ্ঞতা ও ইতিহাস এবং বর্তমান সময়ের বিবেচনায় এক্ষেত্রে সম্ভাবনা ও আশঙ্কার দিকগুলো তাঁর কাছ থেকে শুনে লিপিবদ্ধ করবো। তাও করা হয়ে ওঠেনি। এমনিতে বিষয়টি আমাকে পীড়া দিচ্ছিল। তার উপর আবার হযরত মাওলানা নূর হুসাইন কাসেমী রাহ. আফসোস ও তিরস্কারের সুরে আমাকে একদিন বললেনকাজটা করে ফেলা দরকার ছিল।

(দুই) সোহবতে সালিহীন ও আল্লাহর সাথে সম্পর্ক

মাওলানা তাফাজ্জুল হক রাহ.-এর দ্বীনী ও দাওয়াতি জীবনের সব সাফল্যের পেছনেও আল্লাহওয়ালাদের সাহচর্যের ভূমিকাই ছিল বড়। একদিকে তাঁর উস্তাযগণ সকলেই ছিলেন ছাহেবে নিসবত আল্লাহওয়ালা বুযুর্গ। আবার তিনি প্রথমে মুফতী ফয়জুল্লাহ রাহ.-এর হাতে বায়আত হন। তাঁর ইনতিকালের পর শাইখুল ইসলাম মাদানী রাহ.-এর অন্যতম খলীফা, মাওলানা বদরুল আলম শায়খে রেঙ্গা রাহ.-এর হাতে বায়আত হন। সাথে সাথে তিনি সিলেট বিভাগে অবস্থানরত হযরত মাদানী রাহ.-এর সকল খলীফা ও সমকালীন শীর্ষ আল্লাহওয়ালা বুযুর্গদের সাহচর্যের স্বাদ প্রাণভরে গ্রহণ করেন। তাদের সাহচর্যের বরকত তাঁর জীবনে কী ধরনের প্রভাব সৃষ্টি করেছিল এর কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরছি-

শায়েখের জন্য নিজেকে ফানা করে দেওয়া

উলামা-মাশায়েখ ও মুরব্বীদের সম্মান ও আদব রক্ষা করার ক্ষেত্রে উলামায়ে দেওবন্দের মেযাজ ও রুচিবোধকে তিনি ভালোরকম রপ্ত করতে পেরেছিলেন। ফলে নিজের শায়েখ হযরত মাওলানা বদরুল আলম শায়খে রেঙ্গার পাশাপাশি সব মাশায়েখদের আদব রক্ষা করতেন। তাঁদের সম্মান রক্ষার জন্য নিজে যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না। নিজের শায়েখ ছাড়াও শায়খে বরুনী, শায়খে কাতিয়া, শায়খে কৌড়িয়া, শায়খে গাজিনগরী প্রমুখ মাশায়েখদের জন্য তিনি নিজেকে ফানা করে দিতে চাইতেন। তাঁরা তাঁকে যোগ্যতা ও নৈপুণ্যের কারণে যতই সম্মান করে নিজেদের কাছে টানার চেষ্টা করতেন, তিনি ততই নিজেকে ছোট জ্ঞান করে তাঁদের কদর ও ইকরাম করার চেষ্টায় লেগে থাকতেন। হযরত ফেদায়ে মিল্লাত আসআদ মাদানী রাহ.-এর জন্য তাঁর যে বিনয় ও ভক্তির দৃশ্য আমরা দেখেছি তা বর্তমানে একরকম অবিশ্বাস্য মনে হয়। এমনকি আল্লামা আহমদ শফী রাহ.-এর ক্ষেত্রেও তিনি যেন নিজেকে কুরবান করে দিতেন। অথচ আহমদ শফী ছাহেব ছিলেন তাঁর প্রাথমিক স্তরের উস্তায। আবার আল্লামা আহমদ শফী রাহ.ও তাঁকে ব্যক্তিত্বের কারণে ভালবেসে অনেক সম্মান করতেন।

এমনকি বয়সের বড়কেও তিনি শ্রদ্ধার জায়গাতেই রাখতেন। আমার আব্বা সৈয়দ আহমদ রাহ. ছিলেন তাঁর ভায়রা এবং তাঁর চেয়ে বয়সে বড়। দুজনেই ছিলেন একই শায়েখের খলীফা। তবে ইলমের দিক থেকে তাঁর তুলনায় আমার আব্বা ছিলেন অতি সাধারণ পর্যায়ের। আব্বা তাঁকে বড় মুহাদ্দিস হিসেবেই সম্মান করতেন। তো  তাঁর প্রতিষ্ঠিত মহিলা মাদরাসায় যে বছর প্রথম দাওরায়ে হাদীস খোলা হয় এবং প্রথম খতমে বুখারী হয়, তখন তিনি নিজের খ্যাতি ও আকাশচুম্বী ব্যক্তিত্ব আড়াল করে আব্বাকে দাওয়াত করে নিয়ে গিয়েছিলেন দুআ করার জন্য। সেদিন আমি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলাম, কতটুকু বিনয় ও নম্রতা থাকলে এত বড় একজন বরেণ্য ব্যক্তিত্ব এমন কাজ করতে পারেন।

নিজেকে তরবিয়ত ও সংশোধনের আওতামুক্ত মনে না করা

আশরাফ আলী থানবী রাহ. বলতেন, কারো খেলাফত পাওয়ার অর্থ এই নয় যে, তাঁর পরিপূর্ণ ইসলাহ ও সংশোধন হয়ে গেছে; বরং খেলাফত পাওয়ার পরও নিজের সংশোধনের জন্য তাঁর শায়েখের প্রয়োজন বাকি থাকে। এ বিষয়টি যেভাবে আমাদের আকাবির আলেমদের মধ্যে ছিল ঠিক সেভাবেই হযরত মাওলানার মধ্যেও ছিল। তিনি বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত নিজেকে মুরব্বিদের সাথে সম্পৃক্ত করে রাখাকেই  প্রাধান্য দিতেন। তিনি হযরত শায়খে রেঙ্গা রাহ.-এর খেলাফত পেয়েছেন একথার কোনো আভাসও প্রকাশ করতেন না। বস্তুত যে কোনো মানুষের জন্যই, সে যত বড়ই হোক না কেন, নিজেকে মুরব্বিদের তরবিয়ত ও তত্ত্বাবধানে রাখাই নিরাপদ। তাঁর মত ব্যক্তিদের জীবন থেকে এটি আমাদের জন্য বড় শিক্ষা।

নিজেকে আড়াল করে রাখা

আকাবিরে উলামায়ে দেওবন্দের একটি বিশেষ স্বাতন্ত্র্য হলো, নিজেকে আড়াল করে রাখা। মাওলানা তাফাজ্জুল হক রাহ. আকাবিরদের এ বৈশিষ্ট্য যেন শতভাগ আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন। তিনি এত বেশি প্রচারবিমুখ থাকতেন, যা এ যুগে মানুষকে বিশ্বাস করানোই অসম্ভব। তিনি প্রায় প্রতি বছরই ইউরোপ-আমেরিকা ও হজ্বের সফরে যেতেন। কিন্তু ঠিক কবে কোন্ সময় সফরে যাচ্ছেন তা অনেক সময় আগের দিন পর্যন্ত তাঁর পরিবারের মানুষজনও জানত না। তাঁর দ্বীনী ও সামাজিক খেদমতের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছিল। এর মাধ্যমে কখন কীভাবে কী করতেন নিকটতম মানুষেরা অনেকসময়ই জানত না। তিনি হযরত শায়খে রেঙ্গা রাহ.-এর খেলাফত পেয়েছেন। তাঁর যোগ্যতা ও ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতাও আছে। প্রচুর ভক্ত-অনুরক্ত আছে। তা সত্ত্বেও তিনি আগ্রহীদেরকে বায়আত করতে চাইতেন না। নিজের মাদরাসায় বড় বড় মাহফিল হত। অসংখ্য মানুষের সমাগম হত। তাতে হযরত ফেদায়ে মিল্লাত, মাওলানা আরশাদ মাদানী, মাওলানা মাহমুদ মাদানী, এমনকি মাওলানা আহমদ শফী রাহ.-এর মাধ্যমে শত শত লোককে বায়আত করাতেন। নিজে কখনো এ সুযোগে কোনো বায়আতের অনুষ্ঠান করতেন না। এমনকি বিচ্ছিন্নভাবেও তখন কাউকে বায়আত করতে আমরা দেখিনি। হযরত মাওলানার চতুর্থ ছেলে মামনূনুল হক ভাই বলেন, আব্বার সাথে সফরের সুবাদে অনেকসময় এমনও দেখেছি, কোনো এলাকায় কিছু লোক আব্বার কাছে বায়আত হতে একত্র হয়েছে। কিন্তু তাদেরকে বায়আত না করিয়ে নীরবে চলে এসেছেন। বস্তুত ঘনিষ্ট আত্মীয়তার পাশাপাশি ছোটবেলা থেকেই ঘনঘন আসা যাওয়া ও যোগাযোগ থাকা সত্ত্বেও অনেকদিন পর্যন্ত আমি জানতামই না, তিনি কার খলীফা এবং তিনি আসলেই কাউকে বায়আত করেন কি না। এর কারণ, তিনি নিজেকে লুকিয়ে রাখার মধ্যেই পরম তৃপ্তি অনুভব করতেন।

তাঁর কাছের মানুষদের অভিব্যক্তি হল, তিনি তাঁর শিক্ষাজীবন ও কর্মজীবনের বর্ণাঢ্য ইতিহাসের কিছুই নিজের মুখে কখনো বলতেন না। এমনকি একটু আভাসও দিতেন না। আমি নিজেও তাঁর বিষয়ে জেনেছি তাঁর সাথী-সঙ্গীদের মুখ থেকে। বিশেষ করে দুটো বিষয় আমাকে বেশি অবাক করেছে। একটি হল, আমি বিভিন্ন সময় তাঁর ব্যক্তিজীবনের অনেক কীর্তি ও কৃতিত্বের বিষয়ে জিজ্ঞেস করতাম। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই  কৌশলে পাশ কাটিয়ে যেতেন অথবা হেসে এড়িয়ে যেতেন। নিজেকে নিজে কখনোই স্বীকৃতি দিতেন না। দ্বিতীয় হল, যতটা সঙ্গোপনে ও নিভৃতে তিনি নিজেকে আল্লাহর কাছে সঁপে দিতেন, তাঁর কাছে আত্মসমর্পন করতেন সেটিও ছিল দেখার মতো। কিন্তু দূর থেকে অনুমান করার সাধ্য কারো ছিল না।

ব্যক্তিজীবন ও আমলী যিন্দেগীর অপূর্ব সমন্বয়

আল্লাহওয়ালাদের সাহচর্য থেকে তাঁর প্রধান যে অর্জন ছিল তা হল, সবক্ষেত্রে সুন্নতের পাবন্দী ও নফল বন্দেগীর প্রতি প্রবল আকর্ষণ। তিনি সাধারণত এটা সুন্নত ওটা মুস্তাহাব এ রকম ভাগ করার পরিবর্তে সকল সুন্নত ও মুস্তাহাবের উপর আমলের নীরব ও নিরলস চেষ্টা অব্যাহত রাখতেন। ফরজের পর নফলের মধ্যেই মুমিনের পূর্ণতা। হাজারও ব্যস্ততার মাঝে নফল ইবাদতের মধ্যে নামায, বিশেষ করে তাহাজ্জুদ, রমযান, ইতিকাফ এবং হজ্ব তাঁর কাছে বেশি প্রিয় ছিল।

সফরের মধ্যেও যথাসময়ে জামাতে নামায আদায়ের পাবন্দি এবং তাঁর নামাযের অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য ছিল উপভোগ করার মত। যত গভীর রাতেই সফর থেকে ফিরতেন, ফজর নামায মসজিদে গিয়েই আদায় করতেন। কখনো এর ব্যত্যয় ঘটত না। তার ছোট মেয়ের বর্ণনা, ছোটবেলা থেকে দেখেছি, আব্বা প্রথম রাতে থাকতেন সফরে ও ওয়াযের প্রোগ্রামে। শেষ রাতে তাহাজ্জুদ ও যিকিরে। মাঝে অল্পই ঘুমাতেন। সকালে আর ঘুমাতেন না। বিশ্রাম নিতেন শুধু যোহরের পর অল্প সময়। আসরের আগেই নিজে নিজে ঘুম থেকে উঠে মসজিদে চলে যেতেন। এত ক্লান্তি-অবসাদের পর কোনোদিন তাঁর আসরের জামাত ছুটত না। জীবনের শেষ ক’দিন যখন খুব অসুস্থ, একরকম শয্যাশায়ী, তখনো চেয়ারে বসে ছেলেদেরকে নিয়ে জামাতে নামায আদায় করতেন। নিয়মিত আযান দেওয়াতেন। ছেলেরা কেউ না থাকলে ছোট্ট নাতিকে নিয়েই জামাত করতেন। 

নফলের মধ্যে তাহাজ্জুদের গুরুত্ব ছিল সবচেয়ে বেশি। আর্ধরাত পর্যন্ত সফরের সব ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে শেষ রাতে তাহাজ্জুদে দাঁড়িয়ে যেতেন। নামায শেষে যিকর করতেন। তাঁর ছোট মেয়ের বর্ণনা, প্রায়ই ফজর নামাযের আগে পাশের কামরা থেকে ভেসে আসা আব্বার যিকিরের মৃদুমধুর আওয়াজে আমাদের ঘুম ভাঙত।

কুরআন তিলাওয়াত করা, তিলাওয়াত শোনা ও শোনানো তাঁর কাছে অতিশয় মজাদার ইবাদত ছিল। রমযান মাসে তা আরো বেড়ে যেত। এমনিতে রমযান মাস ছিল হযরত মাওলানার জন্য আল্লাহ তাআলার বিশেষ রহমত। রমযান মাসকে তিনি যারপরনাই কাজে লাগাতেন! সতত ব্যস্ত কর্মময় এ মহান মানুষটি রমযানে কীভাবে দুনিয়ার সমস্ত ব্যস্ততা ঠেলে আল্লাহর পাগল সেজে এক কোণে বসে যেতেন তা সত্যিই এক বিস্ময়। এতে আমাদের জন্য অনেক শিক্ষা রয়েছে। মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ. বলতেন, ‘মওলবী কে শায়তান ভি মওলবী হোতা হায়’। কারণ শয়তান রমযান মাসে বিভিন্ন ‘দ্বীনী’ কাজের বাহানা দিয়ে একান্ত ব্যক্তিগত ইবাদতে নিমগ্ন থাকতে বাধাগ্রস্ত করে। শাইখুল হাদীস যাকারিয়া রাহ.-এর ‘আকাবিরের রমযান’ কিতাবটি পাঠ করলে মুফতী সাহেব রাহ.-এর কথার আসল মর্ম সহজে বুঝে আসবে।

মাওলানা হবিগঞ্জী রাহ.-এর রমযান ছিল আকাবিরের রমযানের প্রতিচ্ছবি। ছোটবেলায় আমরা বেশি ঘুমালে আব্বা বলতেন, ‘তোমরা ঘুমাও, হবিগঞ্জের মুহাদ্দিস সাহেব তো রমযানে রাতে ঘুমানই না’।

রমযান মাসে দেশ-বিদেশে তাঁর মত মানুষের অনেক চাহিদা ছিল। অনেক অনুষ্ঠানে অনেক প্রোগ্রামে তাঁকে দাওয়াত করা হত। কিন্তু তিনি সব উপেক্ষা করে রমযানে যে কোনো এক স্থানে জায়গায় বসে যেতেন। নিয়মিত শেষ দশদিন ইতিকাফ করতেন। কিন্তু পুরো রমযানই ইতিকাফের মত কাটাতেন। রমযানে তাঁর কাজই ছিল, কুরআন তিলাওয়াত, যিকির এবং বাদ মাগরিব নফল, তারাবি ও তাহাজ্জুদে কুরআন খতম করা। খুব দুআ করতেন। কেউ সাক্ষাৎ করতে এলেও অল্পই কথা বলতেন।

২০০৮ সালে একবার কতৃর্পক্ষের জোর আবদারে সিলেট বন্দর জামে মসজিদে রমযান কাটান। আমি দুই-একদিন সেখানে সময় কাটাই। তিনি সত্তরোর্ধ্ব বয়সে উপনীত। তখনো দেখেছি, মাগরিবের পর নফল নামায, তারাবির পর দরসে তাফসীর, তারপর সেহরী পর্যন্ত তাহাজ্জুদ। এভাবে নিঘুর্ম রাত কাটিয়ে ফজরের পর আমরা যখন ঘুমাতে যাচ্ছি তখনো তাঁকে দেখেছি প্রশান্ত মনে লম্বা সময় ধরে সকালের ওযীফা ও আযকার আদায় করছেন। কয়েক ঘণ্টা পর জেগে দেখি তাঁর ঘুম শেষ। তিনি আবার কিতাব পাঠে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তাঁর নাতি মাওলানা আদনানকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি কি ঘুমাননি?

সে বলল, নানার ঘুম এতটুকুতেই শেষ।

আমি বিস্মিত হয়ে বলতে লাগলাম। ‘এটি আল্লাহর দান। তিনি যাকে খুশি তাকেই দান করেন’।

এককথায় যৌবনে তাঁর সাথে যারা ঘনিষ্ঠভাবে রমযান কাটিয়েছেন এবং সূক্ষ্ম দৃষ্টি রাখেন, তারাই হযরত মাওলানার রমযান কাটানোর আসল চিত্র আঁকতে পারবেন।

তাঁর বিশেষ আকর্ষণ ছিল হজ্বের প্রতি। ১৯৭৫ সালে তাঁর প্রথম হজ্ব হয়। এর কয়েক বছর পর থেকে প্রায় নিয়মিত প্রতি বছর হজ্ব করতে থাকেন। প্রতি বছর হজ্ব করাটা এখন সহজ শোনা গেলেও বছর দশেক আগে বিষয়টা এমন ছিল না। তিনি কতটা আগ্রহ ও আকর্ষণ নিয়ে হজ্ব করতে যেতেন তা বোঝা যেত কোনো বছর হজ্বে যেতে না পারলে। হজ্বের সময়ে বাইতুল্লাহর জন্য ব্যাকুলতা, অস্থিরতা এবং না পাওয়ার যন্ত্রণা দেখে অনুভব করা যেত। একবার হজ্বে যেতে পারেননি। খুব অস্থিরতা আর ব্যাকুলতার মাঝে আরাফার দিনে ফজর নামাযে ইমামতি করেন। কে যেন তা রেকর্ড করে রেখে দেয়। সেই নামাযে তাঁর কী যে তিলাওয়াত আর কী যে কান্না। 

শক্তি-সামর্থ্য থাকা পর্যন্ত তিনি সব সফরই সাধারণত একা একা করতেন। যখন হুইল চেয়ারে চলতেন তখনো একা একা উমরা করতে চলে গেছেন। মদীনা থেকে মাওলানা নূরুল ইসলাম আমাকে তাঁর অবস্থা জানিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন। এমনকি বাসা থেকে ঢাকা এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যাওয়াটাও একা চলে যেতেন।

দুআ

সবকিছু ছাপিয়ে হযরত মাওলানার জীবনে আল্লাহ তাআলার অসামান্য দান ছিল দুআ। তিনি রবের সামনে নিজেকে পেশ করার, রব থেকে চাওয়া ও পাওয়ার যে অনন্য সাধারণ মনোজ্ঞ পদ্ধতি রপ্ত করতে পেরেছিলেন, নিঃসন্দেহ তা ছিল জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যার জন্য দুআর দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে তার জন্য রহমতের দ্বারও উন্মুক্ত হয়ে গেছে’। বাস্তবেই দুআর বরকতে যেন আল্লাহ তাআলা তাঁর এ বান্দার সব দরজা অবারিত করে দিয়েছিলেন।

ছোটবেলা থেকে আমরা তাঁর দুআর কথা শুনতাম। রেকর্ড শুনতাম। শেষ রাতে তাহজ্জুদ পড়ে দুআর মধ্যে সুমধুর কন্ঠে নিজস্ব ভঙ্গিতে অনেক উর্দু-ফার্সি পংক্তি আবৃত্তি করতেন। এগুলো ঘরের ছোটদের মুখে মুখে শুনতাম। যত বড় বড় মাহফিল হতো তাতে শেষ মুনাজাত তিনিই করতেন। চুনারুঘাট শহরে সাত দিনব্যাপী তাফসীর-মাহফিল হত। মাহফিলের অনেক নামডাক ছিল। এখানেও শেষ দিনের দুআ তিনি করতেন। দুআয় শরীক হতে চারদিক থেকে মানুষ এসে জড়ো হত মাহফিল-প্রাঙ্গণ ও আশপাশের এলাকায়। রোডঘাট ও বাড়িঘরের ছাদেও মানুষের ভিড় দেখা যেত। নারীরাও জড়ো হত পাশ্ববর্তী বাসা-বাড়িতে। আধা ঘণ্টাব্যাপী এক অনন্য সাধারণ দুআ হত। লাখো মানুষের কান্নার আওয়াজে এক অবর্ণনীয় সূরের লহরি সৃষ্টি হয়ে বাতাসে ভেসে বেড়াত। চোখের পানিতে হাজারো মানুষের বুক ভাসত। কী যে উপলদ্ধি হতো তা  ব্যক্ত করার মত ভাষা আমার নেই। 

এরও অনেক আগ থেকেই আমাদের শায়েস্তাগঞ্জে তাফসীর-মাহফিল হত। একসময় এখানেও সাত দিনব্যাপী মাহফিল শুরু হয়। এখানেও শেষ দিনের দুআ তিনিই করতেন। লাখো মানুষ অপেক্ষা থাকত তাঁর সাথে দুআয় শরীক হওয়ার জন্য। অবশ্য তিনি সবসময় নিয়মিত একান্তে নিভৃতে যে দুআগুলো করতেন তা ছিল আরো মনোজ্ঞ, আরো মজাদার।

তাঁকে অনেকেই ‘মুস্তাজাবুদ দাওয়াহ’ মনে করতেন। তাঁর দুআ আল্লাহর দরবারে খুব কবুল হত। আমি মনে করি, সব আল্লাহওয়ালাদের দুআই আল্লাহর কাছে কবুল হয়। তবে দুআ কবুলের বিভিন্ন ধরন থাকে। কিন্তু তাঁর দুআর ক্ষেত্রে একটি ভিন্ন বিষয় ছিল, একটি সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা তাঁর দুআর বিষয়ে বিশেষ সুসংবাদ দিয়েছেন। ঘটনাটি ছিল নিম্নরূপ,

ঢাকার সুপ্রসিদ্ধ উচ্চতর ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গবেষণাকেন্দ্র মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা। এ প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি বড় জমির প্রয়োজন। এজন্য অনেক দুআ ও চেষ্টা তদবীর চলছে। একদিন এখানকার অন্যতম প্রধান কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব আমার উস্তায দেশের অন্যতম শীর্ষ আলেম মাওলানা আবদুল মালেক ছাহেব দামাত বরাকাতুহুম আমাকে বললেন, তোমার শ্বশুর মাওলানা তাফাজ্জুল হক ছাহেবকে আমাদের মারকাযে দাওয়াত করে আনার জন্য আমি হবিগঞ্জ যেতে চাই। তুমি তাঁর সাথে কথা বল।

আমি কথা বলে হুজুরকে জানালাম যে, আপনাকে আসতে হবে না। নির্দিষ্ট তারিখে তিনি নিজেই চলে আসবেন। সময়মত আমি তাঁকে নিয়ে ঢাকার মিরপুরস্থ মারকাযুদ দাওয়াতে হাজির হলাম।

ছাত্রদের নিয়ে একটি মজলিস হল। হযরাতুল উস্তায মাওলানা আবদুল মালেক ছাহেব দাঁড়িয়ে ভূমিকাস্বরূপ উপস্থিত মজলিসের প্রেক্ষাপট বলতে লাগলেন। একপর্যায়ে তিনি মারকাযের পুরোনো ছাত্র মাওলানা আব্দুজ জাহেরকে দাঁড় করিয়ে পরিচয় করালেন। তাঁরপর কেঁদে কেঁদে বললেন, আমাদের একটি বড় জমি প্রয়োজন। সবাই দুআ ও চেষ্টা করছেন। স্বপ্ন যদিও শরীয়তের কোনো দলীল না, তবুও সত্য স্বপ্ন হলে তাতে সুসংবাদ থাকে। আমাদের মাওলানা আব্দুজ জাহের একদিন স্বপ্নে দেখেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বলছেন, তোমরা মারকাযের জমির জন্য মাওলানা তাফাজ্জুল হককে এনে দুআ করাও; জমির ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

কথাগুলো বলছিলেন আর হুজুরের দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। এরপর দুআ হল। সে কী দুআ ছিল আমি তা ব্যক্ত করতে পারব না! একে তো হযরত মাওলানা দুআ করছেন। আবার হুজুরের বিবরণের পর উপস্থিত সকলের মধ্যে এক ভিন্নরকম অবস্থা তৈরি হয়েছিল। মারকাযের জমির জন্য হযরত মাওলানার সেদিনের দুআ এবং আরো শত মনীষীর দুআ আল্লাহ তাআলা কবুল করেছেন।

এর এক বছরের মাথায় হজ্বের সফরে হযরত মাওলানার সাথে হযরাতুল উসতায মাওলানা আবদুল মালেক ছাহেবের সাক্ষাৎ হয়। তিনি তখন হযরত মাওলানাকে জানান, আল্লাহ্ তাআলার মেহেরবানীতে মারকাযের জন্য একটি জমির ব্যবস্থা হয়েছে। রেজিস্ট্রিও হয়ে গেছে।

হজ্ব থেকে ফিরে হযরত মাওলানা নিজেই আমাকে খুশিখুশি সংবাদটি জানিয়েছিলেন। এরপর হুজুর মারকাযের নতুন ও প্রধান প্রাঙ্গণ হযরতপুরের এ বিশাল আঙিনায় হযরত মাওলানাকে আবার নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে সুযোগ আর হয়ে ওঠেনি। মাওলানার ইনতিকালের পর হুজুর আফসোসের সুরে বললেন, হযরতকে আর আমাদের এখানে আনা হল না!

(তিন) কুরআনুল কারীম ও দরসে কুরআন

ছাত্রাজীবন থেকেই কুরআনে কারীমের সাথে তাঁর বিশেষ সম্পর্ক তৈরি হয়। সহপাঠী মওলানা আব্দুল হান্নান ছিলেন হাফেজ, কিন্তু তিনি হাফেজ ছিলেন না। তাই তাঁর মধ্যে হাফেজ হওয়ার একটা সখ জাগে। মুফতী ফয়জুল্লাহ রাহ. তাকে কুরআন হিফজ করার জন্য উৎসাহ দিলেন। তখন তিনি সহপাঠীদের আড়ালে দিনের একটা সময়ে দূরের কোনো মসজিদে গিয়ে কিছু কিছু করে কুরআনে কারীম মুখস্থ শুরু করেন। তা  বেশি দূর এগোয়নি। পাকিস্তানের জামেয়া আশরাফিয়া লাহোরে দ্বিতীয় বার দাওরা পড়তে গেলে শুনতে পান, মাওলানা ইদরীস কান্ধলবী রাহ. যারা হাফেজ নয়, তাদেরকে সাধারণত বুখারী শরীফের ইবারত পড়ার অনুমতি দেন না। তাই তিনি হযরতকে গিয়ে দ্রুততম সময়ে কুরআন হিফজ সম্পন্ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইবারত পড়ার অনুমতি নেন। সে বছর আল্লামা রাসূল খান রাহ. হজ্বে যাচ্ছিলেন। হযরত মাওলানা তাঁর কাছে কুরআন হিফজ করার জন্য দুআ চেয়ে একটি চিরকুট লিখে দেন। হযরত সে সফরে তার জন্য দুআ করেন। আলহামদু লিল্লাহ বছর শেষ হবার আগেই দাওরায়ে হাদীসের দরসের ব্যস্ততা সত্ত্বেও তিনি কুরআনে কারীমের হিফজ সম্পন্ন করেন। এরপর থেকে কুরআনের প্রতি তাঁর ভালবাসা ও আকর্ষণ বেড়েই চলেছে। সারা বছর ও বিশেষ করে রামাযানে এবং নামাযে যে কী পরিমাণ কুরআন পড়তেন, কত মনোহরি আওয়াজে তিলাওয়াত করতেন। কীযে মধু ছিল তাঁর তিলাওয়াতে, যারা শোনেনি তাদের বোঝানো সম্ভব নয়। বয়ানের মধ্যেও একটা বড় অংশজুড়ে থাকত কুরআন তিলাওয়াত।

অপর দিকে পাকিস্তানে এক রমযানে তিনি মাওলানা আব্দুল্লাহ দরখাস্তী রাহ.-এর দরসে কুরআনের কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেন। এটি ছিল তাঁর কুরআনের তাফসীরের একটি প্রাথমিক অনুশীলন। দেশে ফেরার পর থেকে তিনি কুরআন তিলাওয়াত, কুরআনের তাফসীর পড়ানো এবং সর্বসাধারণের জন্য তাফসীর করা শুরু করেন।

কুরআনের সাথে তাঁর এ সম্পর্ক সারা জীবন অব্যাহত ছিল। জীবনের শেষ রমযান পর্যন্ত নিয়মিত তারাবীহ, তাহাজ্জুদে এবং নামাযের বাইরেও কুরআনের তিলাওয়াত শোনা ও  শোনানোর কাজ অব্যাহত রাখেন। শেষ দিকে তাঁর ছেলে ও নাতিদের অধিকাংশই হিফজ সম্পন্ন করে। তাদেরকে নিয়েও কুরআনের দাওর করতেন। আমার মেয়ে বাহজাহ ও বড় ছেলে আব্দুর রহমান তাঁর ছোট মেয়ের দিকের নাতি-নাতনি। তাঁরা দুজনই হিফজ করছে। ইনতিকালের সপ্তাহ দুই আগেও তিনি তাঁদের দুজন থেকে তিলাওয়াত শুনেছেন। দুজনের হাতেই কিছু হাদিয়াও দিয়েছেন। 

(চার) ওয়ায ও ইরশাদ, দাওয়াত ও ইসলাহ

সর্বসাধারণের মধ্যে ঈমানী জযবা পয়দা করা, দ্বীনী শিক্ষা বিস্তার, সমাজে ইসলামী শিক্ষার আবহ তৈরি করা এবং শিরক-বিদআত, অনৈতিকতা ও পাপাচার থেকে মানুষকে রক্ষা করতে ওয়ায মাহফিল একটি নির্বিকল্প দাওয়াতী কর্মসূচি। হযরত মাওলানা প্রায় ষাট বছর দেশ থেকে দেশান্তরে এ ময়দানে খেদমত করেছেন। ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে ওয়াযের ময়দানে কাজ শুরু করার কিছু দিনের মধ্যেই গোটা দেশেই তাঁর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর খলীফা বুয়েটের সাবেক প্রফেসর জনাব হামীদুর রহমান ছাহেব দামাত বরাকাতুহুম আমাকে দেখলেই বলতেন-‘আমি ১৯৬৩ সাল থেকে তোমার শ্বশুরের বয়ান শুনি। আমি তাঁর বয়ানের খুব ভক্ত’।

এভাবে তখন থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মুরব্বী আলেমদের সাথে বড় বড় মাহফিলে তাঁর অংশগ্রহণের সুযোগ হয়। ফলে তৎকালীন শীর্ষ সব আলেমের সাহচর্য-ভালবাসা,তরবিয়ত ও দুআ লাভ করেন।

হযরত মাওলানার ওয়াযের শেষ পনের বিশ বছর বাদ দিলে বাকি চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বছর ওয়ায করা আমাদের দেশে যেমন আকর্ষণীয় কোনো পেশা ছিল না, তেমনি ওয়াযের ময়দান এতটা মসৃণ, নিষ্কণ্টক ও আরামের ছিল না। তাঁর জন্য নিজস্ব পড়াশোনা, শিক্ষকতা, মাদরাসা পরিচালনা ও রাজনীতির সাথে সমানভাবে ওয়াযের ময়দানে অবিচল থেকে সুনামের সাথে দ্বীনের খেদমত করতে পারাটাই আল্লাহ তাআলার বড় মেহেরবানী; বরং এটি ছিল তাঁর একটি বড় কারামত। মাওলানার ওয়াযের খেদমতের বিশালতা ও গভীরতা তলিয়ে দেখতে এবং এখান থেকে বর্তমান প্রজন্মের শেখার বিষয়গুলো তুলে আনতে রীতিমত গবেষণার প্রয়োজন। এখানে কয়েকটি বিষয়ের দিকে শুধু ইঙ্গিত করে যাচ্ছি।

১. ওয়াযের জন্য ত্যাগ

ষাটের দশকে তিনি ওয়ায শুরু করেন। তখন ওয়াযের ময়দান ছিল বহুমাত্রিক প্রতিকূলতায় ঘেরা। মূর্খতা ও অজ্ঞতার ব্যাপকতার ফলে শিরক-বিদআতের ছড়াছড়ি ছিল সর্বত্র। ফলে ওয়াযে বিভিন্ন রকমের প্রতিবন্ধকতা আসত। ধৈর্য ও হিকমতের সাথে এর মোকাবিলা করতে হত। লোকস্বল্পতার দরুন মহান শিক্ষকতার গুরুদায়িত্ব মাথায় নিয়েই তাঁকে ওয়াযের ময়দানে কাজ করতে হয়েছে। দেশের তৎকালীন অবস্থা এবং আয়োজকদের অসচেতনতার কারণেও অনেকসময় যাতায়াতের কষ্ট হাসিমুখে বরণ করে নিতে হত। হযরত মাওলানা একদিন বলছিলেন, ‘শায়খে কৌড়িয়া রাহ.-এর সাথে ৫০ মাইল পায়ে হেঁটে ওয়ায করতে গিয়েছি। বুযুর্গদের সাথে ছিলাম তাই কষ্ট অনুভব হয়নি’।

অর্থসঙ্কট সামাল দেওয়ার জন্য সবসময় ছোটখাট ব্যবসার সাথে যুক্ত থাকতেন। উপরিউল্লিখিত প্রতিটা বিষয়েই না বলা অনেক গল্প আছে। যেগুলো আমাদের গৌরবময় ইতিহাস।

২. বিষয়ের বৈচিত্র্য ও উপস্থাপনার নৈপুণ্য

তিনি প্রায় ৬০ বছর বিরামহীন ওয়াযের ময়দানে খেদমত করেছেন। সে হিসেবে তাঁর বয়ানের সংখ্যা হাজার হাজার। ওয়াযের ময়দানে তাঁর একটি বড় বৈশিষ্ট্য ছিল বিষয় নিবার্চনে বৈচিত্র্য। কীভাবে যে তিনি নতুন নতুন বিষয়ের অবতারণা করতেন যা শ্রোতাদের মুগ্ধ করত। আবার একই বিষয়ে দুইবার আলোচনা করলেও থাকত তথ্য ও উপস্থাপনায় নতুনত্ব। বৃটেনের ব্রাডফোর্ডে অবস্থিত জামিয়া খাতামুন্নাবিয়্যীনের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল মুফতী সাইফুল ইসলাম একদিন আমাকে বলেন-‘হবিগঞ্জের মুহাদ্দিস সাহেব বাইশ বছর ধরে আমার এখানে প্রতি বছর বয়ান করেন। কিন্তু এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে কোনো দিন এক বিষয়ে দুবার বয়ান করতে শুনিনি। আমি নিজেও অনেক সময় একই বিষয়ে তাঁর একাধিক বয়ান শুনেছি। কিন্তু বিষয় এক হওয়া সত্ত্বেও দুই বয়ানের চরিত্র ও স্বাদ সম্পূর্ণই ভিন্ন ভিন্ন পেয়েছি।

৩. ওয়াযের উৎস ছিল কুরআন-হাদীস ও ইতিহাস

তিনি কুরআনে কারীম হিফজ করেছেন দাওরায়ে হাদীস সম্পন্ন করার পর। কুরআন তিলাওয়াতের আদতও ছিল অনেক বেশি। আবার সূচনাকাল থেকেই তিনি যেখানে থাকতেন সেখানেই বিভিন্ন মসজিদে ধারাবাহিক কুরআনের তাফসীর করতেন। তাই তাঁর ওয়াযের প্রধান উৎস ছিল কুরআনে কারীম। যে কোনো বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট কুরআনের আয়াতগুলো যেন তার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করত। শিক্ষকতার শুরু জীবন থেকেই হাদীস পড়াচ্ছেন। প্রখর স্মৃতিশক্তিও ছিল। তাই অনেক হাদীস তাঁর মুখস্থ ছিল। ফলে হাদীসের বিভিন্ন ঘটনাবলি ও শিক্ষা সবসময় তাঁর বয়ানে মুগ্ধতা ছড়াত। রিজালুল হাদীস ও ইসলামের ইতিহাসের পাতায় লুকিয়ে থাকা শিক্ষামূলক অনেক গল্পও তাঁর মুখে শোভা পেত।

একদিন তাঁর সাথে পরপর তিনটি মাহফিলে শরীক হয়েছিলাম। তিন জায়গাতেই বুখারী শরীফের তিনটি প্রসিদ্ধ হাদীস থেকে বয়ান করলেন। আমি মুগ্ধ হয়ে লক্ষ করছিলাম, সুপ্রসিদ্ধ এ হাদীসগুলোতে এত চমকপ্রদ শিক্ষণীয় বিষয়গুলো লুকিয়ে ছিল, অথচ আমার জানা ছিল না।

৪. ভারসাম্য রক্ষা করা, ওয়াযে ফতোয়ার ভাষা প্রয়োগ না করা

ওয়ায ও দাওয়াতের ভাষা আর ফতোয়ার ভাষা এক নয়। ফতোয়ার মধ্যে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়ার বিষয়টি মৌলিক থাকে। আর ওয়াযে সচেতন করা, দাওয়াত দেওয়া ও আক্রান্ত ব্যক্তিকে ফিরিয়ে আনার বিষয়টি প্রধান থাকে। হযরত মাওলানাও ওয়াযের মধ্যে প্রতিপক্ষকে খোঁচা দেওয়া, উস্কানী দেওয়া থেকে দূরে থাকতেন। ভারসাম্যপূর্ণ পন্থায় দাওয়াতী উসলূব ও রীতি অবলম্বন করে ঘোর প্রতিপক্ষকেও সুপথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতেন।

একদিন আমাকে সিলেটের কিছু এলাকার নাম নিয়ে বলছিলেন, ‘এসব এলাকায় ফুলতলীর পীর সাহেবের বেশ প্রভাব। আমি এদিকে গেলে এমনভাবে আলোচনা করি যে, আমরা এবং তারা মূলত একই সিলসিলার দুটি শাখা। তারপর হক কথাগুলো দাওয়াতের ভাষায় বলতে থাকি। এতে অনেক মানুষ সঠিক বিষয়টিও বুঝে যেত; আবার বিরূপ কোনো প্রতিক্রিয়াও হত না’।

ইংল্যান্ড ও আমেরিকার বিভিন্ন স্থানেও তিনি এ তরীকায় দ্বীনের অনেক খেদমত করেছেন।

৫. প্রয়োজনে কঠোর হতেন

সত্য বলার প্রয়োজনে ওমরী কঠোরতাও তাঁর মধ্যে ছিল। তাঁর বয়ান ও কর্মপন্থা যারা প্রত্যক্ষ করেছেন এর অনেক উদাহরণ তাদের সামনেই থাকবে। কোনো বিষয়ে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের প্রয়োজন হলে তিনি কখনো সন্ত্রস্ত হতেন না। বুড়ো বয়সেও প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে তাঁর তেজস্বিতা শ্রোতাদের অবাক করত। হযরত মাওলানার সাহসিকতার কিছু ঘটনা আমিও প্রত্যক্ষ করেছি। ২০১৩ সালে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সকল নিরবতা ভেঙে তিনি প্রতিবাদের আওয়ায তুলেছিলেন রাতভর বিক্ষোভ করেছিলেন। 

৬. ইসলামী রাজনীতির ময়দানে ছিলেন সতত কর্মমুখর

ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন ও পকিস্তান আমলে ইসলামী রাজনীতিতে সরাসরি সংশ্লিষ্ট অনেক বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ উলামায়ে কেরামের গভীর সাহচর্য তিনি পেয়েছেন। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ইসলামী রাজনীতিতে দীর্ঘকাল তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন। পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী। আবার তাঁর কাছে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চোখে পড়ার মত বিশেষ অবদান রাখার চেয়ে শৃঙ্খলা রক্ষার গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। বর্তমান সময়ের বর্ষীয়ান ইসলামী রাজনীতিবিদ মাওলানা নূর হুসাইন কাসেমী রাহ. একদিন আমাকে বললেন, ‘রাজনৈতিক কাজের ক্ষেত্রে হুজুর আমাদের জন্য বড় একটি আশ্রয় ছিলেন। যে কোনো সঙ্কটে পরামর্শ পেতাম। সর্বশেষ ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতাল থেকে যাওয়ার দিন একটি জরুরি বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম। হুজুর একটি ভালো পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন তো আর সে সুযোগ নেই’।

জীবনভর তিনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সাথে এবং উলামায়ে কেরামদের জাতীয় ইস্যুভিত্তিক যে কোনো আন্দোলনের সাথে নিজেকে একান্তভাবে জড়িয়ে রেখেছেন। আঞ্চলিক সাধারণ ও ধর্মীয় ইস্যুতে সর্বাত্মক নেতৃত্ব দিয়েছেন। পরিস্থিতির প্রয়োজনে নিরবতাও অবলম্বন করেছেন। কিন্তু কোথাও কখনো শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে এমন কোনো কাজের নজির তার থেকে পাওয়া যায় না। সুবিশাল ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও পদ-পদবীর ক্ষেত্রে সবসময় পিছিয়ে থাকতেই দেখেছি তাঁকে। তারপরও জাতীয় ও আঞ্চলিক অনেক ইসলামী সংগঠনের সাথে তার নেতৃত্ব ও কতৃত্বের সম্পর্ক ছিল। এ বিষয়টি মূলত স্বতন্ত্র ও দীর্ঘ আলোচনার জন্য রেখে দেওয়াই সমীচীন মনে করছি। 

৭. মেয়েদের জন্য ওয়ায ও দ্বীনী শিক্ষার আয়োজন

মেয়েদের দ্বীনী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার উপলব্ধি আছে অনেকেরই। আমাদের দেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এর আয়োজনও শুরু হয়েছে বেশ আগেই। দিন দিন এর সংখ্যাও বাড়ছে আলহামদু লিল্লাহ। কিন্তু সামর্থ্যরে অভাবে এবং অসতর্কতার কারণে বিভিন্ন জটিলতা ও আশঙ্কাও তৈরি হচ্ছে।

মাওলানা তাফাজ্জুল হক রাহ. বিষয়ের গুরুত্ব ও স্পর্শকাতরতা অনুভব করতেন গভীরভাবে। তিনি এ উদ্দেশ্যেই ১৯৯৭ সালে উপযুক্ত পরিবেশ, সুষ্ঠু পরিচালনা ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের যাবতীয় আয়োজন করে মেয়েদের জন্য একটি মাদরাসার সূচনা করেন। হযরত মাওলানা এ মাদরাসার অবকাঠামোগত ও ব্যবস্থাপনাগত সৌন্দর্যের দিকে যেমন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতেন, তারচে বেশি খেয়াল রাখতেন এর শিক্ষা কার্যক্রমের প্রতি। এখানে তিনি শুরু থেকে ইনতিকালের দিন পর্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পড়িয়েছেন। ছেলেদের মাদরাসায় বুখারী শরীফের অর্ধেক পড়াতেন। কিন্তু মেয়েদের মাদরাসায় সবসময় পূর্ণ বুখারী একাই পড়াতেন। এছাড়া শত ব্যস্ততা পাশ কাটিয়ে তিনি সাধারণ মেয়েদের জন্য নিজ বাসায় একটি মাসিক মাহফিলের আয়োজন করতেন, যা এলাকার মেয়েদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল।

সর্বোপরি তাঁর জীবন ছিল শুযুজ ও বিচ্ছিন্নতামুক্ত

মাওলানা তাফাজ্জুল হক রাহ. দীর্ঘ ষাট বছর শিক্ষা-দাওয়াত-ওয়ায-রাজনীতি এবং সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনায় শীর্ষ পর্যায়ে থেকে কাজ করেছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশে ইসলাম ও মুসলমানদের অনেক সুদিন-দুর্দিন তিনি সতত উপস্থিত থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন। অনেক সঙ্কটের মোকাবিলা করেছেন। কিন্তু দীর্ঘ ষাট বছরের ইতিহাসে ফিকহী মাসআলা, কুরআন-সুন্নাহ ও আহলুস সুন্নাহর কোনো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে বা রাজনৈতিক দিকদর্শনে তাঁর থেকে কোন শুযুজ-যাল্লাত বা বিচ্ছিন্ন মত ও বিশৃঙ্খলার নজীর পাওয়া যায় না। বস্তুত তাঁর মধ্যে এটিও ছিল আমাদের আকাবির ও আসলাফের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। হ

 

 

advertisement