মুহাররম ১৪৪৩   ||   আগস্ট ২০২১

সুকুকের দ্বিতীয় প্রসপেক্টাস : একটি সাধারণ মূল্যায়ন

মাওলানা আব্দুল্লাহ মাসুম

[গত ২৩ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে বাংলাদেশ সরকারের অর্থ বিভাগের পক্ষ থেকে সুকুক (এক প্রকারের ইসলামিক বন্ড) ইস্যুর জন্য প্রথম প্রসপেক্টাস প্রকাশিত হয়। প্রসপেক্টাস অনুযায়ী ২৮ ডিসেম্বর প্রথম সুকুক নিলাম/অকশন অনুষ্ঠিত হয়।

সম্পূর্ণ নতুন ও প্রথমবারের মতো চালু হওয়া সুকুক সম্পর্কে দেশের সর্বস্তরের মুসলমানদের শরয়ী রাহনুমায়ীর জন্য মাসিক আলকাউসারে একটি বিস্তারিত সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। এতে মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা’র রঈস ও প্রধান মুফতী এবং মাসিক আলকাউসারের সম্পাদক মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম সুকুক-এর প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণ ও শরয়ী পর্যালোচনা তুলে ধরেন। তিনি সরকার ঘোষিত সুকুকের কাঠামোগত ও মৌলিক কিছু সমস্যাও চিহ্নিত করে দেন। যেগুলোর পরিবর্তন ও সংশোধন ছাড়া সুকুক শুধু ‘নাম সর্বস্ব ইসলামিক প্রোডাক্ট’ হলেও বাস্তবিক অর্থে কখনো ইসলামিক প্রোডাক্ট হতে পারে না। পাশাপাশি তিনি সুকুক-এর বিদ্যমান ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে উত্তরণ ও করণীয় সম্পর্কেও দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন।

সাক্ষাৎকারটি মাসিক আলকাউসার, ফেব্রুয়ারি ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এছাড়া দেশের অন্যান্য ফতোয়া বিভাগের আলেমগণও বিভিন্নভাবে  তাদের মতামত প্রকাশ করেছেন। সরকারের প্রকাশিত সুকুক প্রসপেক্টাস যে শরীয়তসম্মত হয়নি তা তারা সুস্পষ্টভাবে বলেছেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ সুকুকের কাঠামোগত কিছু পরিবর্তন ও সংশোধন এনে গত ৩১ মে ২০২১ নতুন করে প্রসপেক্টাস প্রকাশ করে। এরপর সে অনুযায়ী ৯ জুন ২০২১ সুকুকের দ্বিতীয় নিলাম অনুষ্ঠিত হয়।

এখানে লক্ষ্যণীয় যে, দ্বিতীয় প্রসপেক্টাসেও পূর্বে ইস্যুকৃত সুকুকের অবকাঠামো ও মৌলিক সমস্যাগুলোর যথাযথ সংশোধন করা হয়নি। শুধু ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা সংক্রান্ত কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। আর একথা তো বলাই বাহুল্য, যে মৌলিক সমস্যাগুলির কারণে সুকুকের প্রথম বরাদ্দ শরীয়তসম্মত হয়নি তা বিদ্যমান থাকা অবস্থায় শুধু ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কিছু পরিবর্তন আনলেই তা ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধতা পাবে না। এর জন্য দরকার হবে সুকুক প্রোডাক্টটিকে গোড়া থেকেই শুদ্ধ করা। প্রথম নিলামে অংশগ্রহণকারীদের সাথে কৃত চুক্তি বাতিল করে নতুন করে চুক্তিবদ্ধ হওয়া। কিন্তু এখনও পর্যন্ত এমন কিছু চোখে পড়েনি। তাই যতদিন পর্যন্ত তারা এই পরিবর্তনগুলো না করবেন এবং ইসলামী পদ্ধতিতে পরিচালনার বিষয়টি নিশ্চিত না করবেন ততদিন এটিকে ইসলামী বিনিয়োগ বলা যাবে না। তাছাড়া ধর্মপ্রাণ মানুষও এতে প্রতারণার শিকার হবেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক সুকুকের কাঠামোগত ও ব্যবস্থাপনাগত কিছু পরিবর্তন করে সংশোধনী ঘোষণা দেওয়ার পর মারকাযের খিররিজ ও জামিআ শারইয়্যাহ মালিবাগ-এর উস্তায মাওলানা আবদুল্লাহ মাসুম তা নিয়ে একটি লেখা প্রস্তুত করেছেন। সে লেখাটির সারমর্ম ও সংক্ষিপ্ত রূপ আলকাউসারের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল। -সহ-সম্পাদক]

 

 

প্রথম প্রসপেক্টাস ও দ্বিতীয় প্রসপেক্টাসের আলোকে সরকারি সুকুক অবকাঠামো : তুলনামূলক আলোচনা

সম্প্রতি প্রকাশিত উভয় সুকুক প্রসপেক্টাস অনুযায়ী, বাংলাদেশ গভর্মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট সুকুক-এর অবকাঠামো হল, ইজারা (প্রকৃত অর্থে ইজারা এন্ড লিজ ব্যাক)।

অবকাঠামোর পক্ষসমূহ

প্রসপেক্টাস অনুযায়ী উক্ত সুকুকের পক্ষসমূহ হল :

ক. অবলিগর (Obligor)/ওরিজিনেটর (Originator)

অর্থাৎ শরীয়াহ নীতি অনুযায়ী সুকুক ইস্যুর প্রস্তাবকারী। এখানে সেই পক্ষ হল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। যার পক্ষে কাজ করবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ। একইসাথে তারা পরবর্তীতে ভাড়া গ্রহীতা (Lessee)-ও হবে। (প্রথম প্রসপেক্টাসে তাদেরকে সরাসরি সার্ভিসিং এজেন্টও দেখানো হয়েছিল। পরবর্তী প্রসপেক্টাসে সেটি দেখানো হয়নি।

খ. ইস্যুয়ার (Issuer)

সম্পদের বিপরীতে সুকুক ইস্যু করার জন্য নিযুক্ত পক্ষ। এখানে সেই পক্ষ হল, বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ ব্যবস্থাপনা বিভাগ (DMD)-এ সৃষ্ট একটি স্বতন্ত্র সেকশন, যার নাম- Islamic Securities Section। এর সদস্য সংখ্যা ৫ জন। প্রধান হলেন ঋণ ব্যবস্থাপনা বিভাগের ডিজিএম। বাকি সদস্যরাও এই বিভাগেরই বিভিন্ন কর্মকর্তা। তাই অন্যভাবে বলা যায়, ‘ডেট ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট’-ই ইস্যুয়ার। এই বিভাগ একইসাথে ভাড়াদাতা (Lessor) ও এসপিভি (SPV-Special purpose vehicle) হিসাবেও কাজ করবে। সরকারের পুরো সুকুক ম্যানেজমেন্টে তারা থাকবে।

গ. ট্রাস্ট্রি (Trustee)

অর্থাৎ এমন পক্ষ, যারা সুকুক ধারকদের স্বার্থ সংরক্ষণ, এসপিভির কার্যক্রম তত্ত্বাবধান কাজে নিয়োজিত থাকে। পাশাপাশি অরিজিনেটরের সাথে সম্পাদিত চুক্তি অনুসারে প্রসপেক্টাসে বর্ণিত দলীলাদি ও গ্যারান্টির নিরাপত্তা প্রদানের দায়িত্বও পালন করে থাকে।

এখানে সেই পক্ষ বাংলাদেশ ব্যাংকেরই বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তাগণ। এর প্রধান ও চেয়ারম্যান হিসাবে থাকবেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর। (আগের প্রসপেক্টাসে ছিল, তিনি হবেন ঋণ ব্যবস্থাপনা বিভাগের ডেপুটি গভর্নর) প্রসপেক্টাস অনুযায়ী এর সদস্য সংখ্যা ০৬ জন। এর মধ্যে তিনজনই ‘ডেট ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট’-এর কর্মকর্তা। পরবর্তী প্রসপেক্টাসে দুইজন রাখা হয়েছে।

উল্লেখ্য, প্রথম প্রসপেক্টাসে বলা হয়েছিল, সুকুক আন্ডার লায়িং এ্যাসেটের মালিকানা ট্রান্সফার হবে ট্রাস্টি বডির কাছে। পরবর্তী প্রসপেক্টাসে বলা হয়েছে, সেটি ট্রান্সফার হবে এসপিভি-এর কাছে।

ঘ. সার্ভিসিং এজেন্ট

সুকুক প্রজেক্ট/এ্যাসেট বাস্তবায়ন ও বাস্তবায়ন সংক্রান্ত যাবতীয় আপডেট দেয়ার জন্য অর্থ বিভাগ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরকে এসপিভির পক্ষে দায়িত্ব দেবে। তারাই মূলত প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করবে। (এদেরকে সার্ভিসিং এজেন্ট না বলে প্রজেক্ট/সম্পদ বাস্তবায়নকারী বলা উচিত।) প্রথম প্রসপেক্টাসে এই কাজটি দেয়া হয়েছিল সরাসরি অর্থ বিভাগকে।

ঙ. শরীয়াহ বোর্ড

যারা সুকুক ইস্যুর ক্ষেত্রে শরীয়াহ বিষয়ক যে কোনো মতামত ও পরামর্শ প্রদান করবেন। সুকুক গাইডলাইন অনুযায়ী সরকারি সুকুকের ক্ষেত্রে এটি গঠন করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রসপেক্টাস অনুযায়ী এর সদস্য-সংখ্যা ১১ জন। এর চেয়ারম্যান হিসাবে আছেন ‘ডেট ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট’-এর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর। ১১ জনের মধ্যে প্রায় অর্ধেক-ই শরীয়াহ স্কলার নন! ৫ জনই হলেন বাংলাদেশ ব্যাংক ফিন্যান্স ডিভিশনের। সবচেয়ে বড় কথা, শরীয়াহ্ বোর্ডের চেয়ারম্যান হলেন একজন নন-শরীয়াহ্ পারসন। এ বিষয়গুলো দ্বিতীয় প্রসপেক্টাসেও উন্নত হয়নি। তবে, প্রথম প্রসপেক্টাসে বিষয়টি সমালোচিত হওয়ার কারণে এবার কয়েকজন ব্যক্তির নামের শুরুতে ‘মাওলানা’ যুক্ত করা হয়েছে। অথচ তারা ইসলামী ফিকহের কোনো বিজ্ঞজন হিসেবে পরিচিত নন।

 

পর্যালোচনা

নতুন সুকুক প্রসপেক্টাসে যে সুকুক স্ট্রাকচার অঙ্কন করা হয়েছে তাতে এখনও বড় ধরনের শরয়ী দুর্বলতা রয়ে গেছে। আসল ব্যাপারটি মূলত এমন হওয়ার কথা ছিল, যেহেতু একে ইজারা সুকুক বলা হচ্ছে, তাই প্রথমে সুকুক হোল্ডারদের কাছে Existing assets বিক্রয় করতে হবে। ফিন্যান্স ডিভিশন সেটি এসপিভির কাছে হস্তান্তর করবে। এরপর এসপিভি সুকুক ইস্যু করে ফান্ড কালেকশন করবে। সেই ফান্ড মূল্য বাবদ ফিন্যান্স ডিভিশনকে প্রদান করবে। এরপর পূর্ব সমঝোতা অনুযায়ী এসপিভি সেই এ্যাসেট ফিন্যান্স ডিভিশনকে ভাড়ায় প্রদান করবে। ভাড়া যা উসূল হবে, সেটি এসপিভি সুকুক হোল্ডারদের মাঝে বিতরণ করবে। ভাড়ার মেয়াদ শেষে এ্যাসেটটি ফিন্যান্স ডিভিশন ক্রয় করে নিবে। ব্যস, এতটুকুই। সহজে এর চিত্র হবে এরূপ-

অর্থ বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মাঝে MoU A অর্থ বিভাগ সুকুক এ্যাসেট বিক্রয় করবে ঋণ বিভাগ তথা সুকুক ইস্যুকারী/এসপিভি এর নিকট ঋণ বিভাগ কর্তৃক সুকুক ইস্যুকরণ। ঋণ বিভাগ কর্তৃক মূল্য পরিশোধ।   ঋণ বিভাগ কর্তৃক ভাড়া প্রদান অর্থ বিভাগ কর্তৃক ভাড়া গ্রহণ। অর্থ বিভাগ কর্তৃক ক্রয়। = সুকুক নিষ্পত্তি।

এটি হল ইজারা সুকুক-এর সঠিক স্ট্রাকচার বা রূপরেখা। কিন্তু তারা এভাবে করেননি। আসলে তাদের পক্ষে এভাবে করা সম্ভব নয়। কারণ একদিকে তারা বলছেন ইজারা সুকুক। অপরদিকে তাদের এ্যাসেট নেই। এ্যাসেট ছাড়া ইজারা সুকুক হাস্যকর। সুকুক অকশনের মাধ্যমে যে ফান্ড সংগ্রহ হবে, সেটি এসপিভি মূল্য বাবদ প্রদান করবে। কিন্তু পণ্য বা এ্যাসেট নেই। এ্যাসেট ছাড়া মূল্য হয় কীভাবে! এরপর সেই এ্যাসেট লিজ দেয়া হবে। রেন্ট উঠে আসবে। এ্যাসেট-ই তো নেই! লিজ দেয়া হবে কী! সংগৃহিত অর্থে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর এ্যাসেট তৈরি করবে। এর আগেই সেটি লিজ দেয়া হয় কীভাবে! ভাড়া আসে কীভাবে!  এ সবকিছুই অস্পষ্ট। সম্পূর্ণ গোঁজামিল দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এভাবে এ্যাসেট ছাড়া টাকা আদান-প্রদান স্পষ্ট সুদ বৈ কিছু নয়।

বস্তুত তারা যে পদ্ধতিতে ফান্ড সংগ্রহ করতে চেয়েছেন, সেটি ইজারা স্ট্রাকচারের সাথে যায় না। এর জন্য ইস্তিসনা স্ট্রাকচার অবলম্বন করা দরকার ছিল।

শরীয়াহ পর্যালোচনা

সুকুক স্ট্রাকচার আলোচনা করতে গিয়ে শরয়ী কিছু পর্যালোচনার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। এখানে বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে আলোচনা করা হল। আলোচিত সরকারি ইজারা সুকুক-এর শরীয়াহ পর্যালোচনা দুটি ভাগে বিভক্ত।

এক. ইতিবাচক শরীয়াহ উন্নয়ন।

দুই. শরীয়াহ ত্রুটি-বিচ্যুতি। প্রথমে শরীয়াহ উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা করা হল-

ইতিবাচক শরীয়াহ উন্নয়ন

আমরা আগেও বলেছি, সুকুকের প্রথম প্রসপেক্টাস ইস্যুর পর আমরা এর বিস্তারিত শরীয়াহ পর্যালোচনা পেশ করেছি। এর নীতি নির্ধারকগণের সাথে আমাদের মতবিনিময়ও হয়েছে। উক্ত পর্যালোচনার আলোকে তারা পরবর্তী প্রসপেক্টাসে  কিছু শরীয়াহ উন্নয়ন করেছেন। এজন্য আমরা তাদের সাধুবাদ জানাই। ২য় প্রসপেক্টাসে যেসব শরীয়াহ উন্নয়ন করা হয়েছে, সংক্ষেপে তা নিম্নে তুলে ধরা হল-

১। সুকুক প্রসপেক্টাসে শরীয়াহ প্রনাউন্সমেন্ট বা মতামত থাকা বাঞ্ছনীয়। কারণ সুকুক একটি শরীয়াহ ইন্সট্রুমেন্ট। এতে শরীয়াহ্ বোর্ডের মতামত থাকা জরুরি। প্রথম প্রসপেক্টাসে তা ছিল না। দ্বিতীয় প্রসপেক্টাসে শরীয়াহ বোর্ডের মতামত দস্তখতসহ যুক্ত করা হয়েছে।

২। প্রথম প্রসপেক্টাসে বলা হয়েছিল, এই সুকুক ট্রেডেবল (Tradable)। এটি আপত্তিকর। কারণ, সেকেন্ডারি মার্কেটে সুকুক ট্রেড করতে হলে সুকুক এ্যাসেট অস্তিত্বে আসতে হবে। আলোচিত সুকুক প্রজেক্টে সুকুক ফান্ড কালেকশনের পরপরই তো এ্যাসেট তৈরি হয়ে যায়নি।

সুতরাং প্রসপেক্টাসে সরাসরি একে ‘ট্রেডেবল’ বলা শরীয়াতসম্মত ছিল না। পরবর্তী প্রসপেক্টাসে বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে। বলা হয়েছে, অন্তত তিন ভাগের এক ভাগ এ্যাসেট কমপ্লিট হলে ওদের অনুমোদন সাপেক্ষে সেকেন্ডারি মার্কেটে ট্রেড করা যাবে। এর আগে ট্রেড হবে না। করতে চাইলে সেটি শুধু ফেস ভ্যালুতে ট্রান্সফার হবে শুধু। এটি ভালো সংশোধনী।

৩। প্রথম প্রসপেক্টাসে অর্থ বিভাগ কর্তৃক রি-পারচেজের আন্ডারটেকিং (Undertaking to repurchase) দেয়া ছিল। এটি শরীয়াতসম্মত ছিল না। কারণ তা নিষিদ্ধ ‘বাই বিল ওয়াফা’ হয়ে যায়। নতুন প্রসপেক্টাসে বলা হয়েছে, এখানে রি-পারচেজের শর্ত থাকবে না। কেবল ওয়াদা থাকবে। এভাবে করা হলে কারো কারো মতে বৈধ হয়ে যায়। তবে শর্ত হল, পরবর্তীতে বাস্তব ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন করা। তদুপরি এরকম ওয়াদাও খুব একটা ভালো প্র্যাকটিস নয়। অনেক বিজ্ঞ আলেম এটিকে বৈধ মনে করেন না।

এছাড়া আরও যেসব উন্নয়ন হয়েছে

* প্রথম প্রসপেক্টাসে সুকুক এ্যাসেট ও লিজ এ্যাসেট আলাদা করে বলা হয়নি। দ্বিতীয় প্রসপেক্টাসে আলাদা করে বলা হয়েছে। তাছাড়া এতে বিদ্যমান ও ভবিষ্যত এ্যাসেটের বিবরণও যুক্ত হয়েছে। বলা হয়েছে বর্তমান পর্যন্ত (মার্চ, ২০২১ ঈ.) পুরো সুকুক প্রজেক্ট/সম্পদের মাত্র ৫.৪৭ শতাংশ বাস্তবায়ন/অস্তিত্বে এসেছে। 

* সুকুক সম্পদের ট্রান্সফরমেশন প্রথম প্রসপেক্টাসে সুনির্দিষ্ট ছিল না। ভুল তথ্য দেয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল সেটি ট্রাস্টির কাছে স্থানান্তর হবে। আসলে তা এসপিভির কাছে হবে। এটি পরবর্তী প্রসপেক্টাসে সঠিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে। শরীয়াহ বাস্তবায়নের জন্য সম্পদের সঠিক ট্রান্সফরমেশন অতীব জরুরি একটি বিষয়।

* প্রথম প্রসপেক্টাসে সুকুক ডায়াগ্রাম স্পষ্ট ছিল না। পরবর্তী প্রসপেক্টাসে তা তুলে ধরা হয়েছে।

* সার্ভিসিং এজেন্ট হিসেবে কার ভূমিকা থাকবে, তা পরবর্তী প্রসপেক্টাসে অধিক স্পষ্ট করা হয়েছে।

মোটকথা, এভাবে শাখাগত কিছু শারীয়াহ উন্নয়ন হয়েছে। আলেমদের পর্যালোচনাগুলো কিছুটা হলেও আমলে নেয়ার জন্য কর্তৃপক্ষকে অশেষ ধন্যবাদ।

শরীয়াহ ত্রুটি-বিচ্যুতি

মূলত শরীয়াহ উন্নয়ন হয়েছে খুব কম। ২য় প্রসপেক্টাসে শরীয়াহ বিচ্যুতির অনেকগুলোই আগের মতো থেকে গেছে। প্রথম প্রসপেক্টাস পর্যালোচনায় বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এখানে কেবল মৌলিক ত্রুটিগুলো আলোচনা করা হল-

শরীয়াহ ইস্যু-০১ : সুকুক এ্যাসেট

ইজারা সুকুক-এর নিয়ম অনুযায়ী, ইনভেস্টরগণের টাকা দিয়ে প্রথমে এসপিভি কর্তৃক সুকুকের আন্ডার লায়িং অ্যাসেট ক্রয় করতে হবে। এরপর তা ভাড়ায় প্রদান করা হবে। এখানে সেই অ্যাসেট কী, সেটি স্পষ্ট নয়। টোটাল প্রজেক্টের মধ্যে মাত্র ৫.৪৭ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। এই এ্যাসেট কাদের? প্রথম অকশনে যারা অর্থায়ন করেছিল, তাদের টাকায় তা বাস্তবায়ন হয়েছে। অথচ এই স্বল্প এ্যাসেটকেই দ্বিতীয় প্রসপেক্টাসে Existing assets হিসাবে দেখানো হয়েছে। একই এ্যাসেট কয়বার বিক্রয় করা যায়?!

তাছাড়া টোটাল প্রজেক্টের প্রায় ৯৫ শতাংশরই অস্তিত্ব নেই। সম্পূর্ণ Future asset। একেই Underlying Asset হিসেবে দেখানো হয়েছে, যা মূলত Future sell-কে নিশ্চিত করে। পণ্য না থাকা অবস্থায়-ই তা বিক্রয় করা হয়েছে। এরপর ভাড়াও চালু হয়ে গেছে। এটি স্পষ্ট শরীয়াহ লঙ্ঘন ও প্রকাশ্য সুদ।

প্রশ্ন হল, এ্যাসেট যেখানে নেই সেখানে সুকুক ডায়াগ্রামে ‘পারচেজ প্রাইজ অব এ্যাসেট’ কীভাবে দেখানো হল?

এককথায় প্রথম প্রসপেক্টাসের মতো এখানেও সুকুক এ্যাসেট নেই। এ সমস্যাটি আমরা প্রথম প্রসপেক্টাসে ধরিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু সেটি আমলে নেয়া হয়নি। এভাবে বেচাকেনা শুদ্ধ হয় না।

এ অবস্থায় রেন্ট-এর নামে প্রাপ্ত টাকা শরীয়তের দৃষ্টিতে সুদ হিসেবে গণ্য হবে। যেমন- দশ হাজার টাকার বিনিময়ে কেউ একটি সুকুক ক্রয় করল। বিনিময়ে ৪.৬৯ হারে তার মূল প্রাপ্তি হবে ১০,৪৬৯/- টাকা। এটি স্পষ্ট সুদী লেনদেন, যা কখনোই বৈধ নয়।

শরীয়াহ ইস্যু-০২ : রেন্ট

সুকুক ইস্যুয়িং ঘোষণা অনুযায়ী, (ষাণ্নাসিক) ৪.৬৯ শতাংশ প্রফিট রেন্ট হিসেবে সুকুক হোল্ডারদের মাঝে বণ্টন করা হবে। প্রথম বণ্টন সময় ২৯ জুন, ২০২১। যা ইতিমধ্যেই অতিবাহিত হয়েছে। এদিকে নতুন প্রসপেক্টাসের বিবরণ অনুযায়ী প্রজেক্ট/এ্যাসেট বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৫.৪৭ শতাংশ। বাকি ৯৫ শতাংশের এখনও অস্তিত্ব নেই। তাহলে ভাড়া/প্রফিট কীসের ভিত্তিতে বণ্টন হবে?

এত বিশাল রেন্ট/প্রফিট কি মাত্র ৫ শতাংশের বিপরীতে, নাকি সুকুক হোল্ডারদের প্রদত্ত টাকার বিপরীতে? স্পষ্টতই এখানে দ্বিতীয়টি প্রযোজ্য। কারণ এ্যাসেট এখনও প্রস্তুতই হয়নি। বস্তুত রেন্টের নামে দেওয়া হলেও এ টাকা যে স্পষ্ট সুদ- তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, প্রথম প্রসপেক্টাস অনুযায়ী সুকুক হোল্ডারগণ তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থের বিপরীতে শতকরা ৪.৬৯ হারে ভাড়া প্রাপ্ত হওয়ার কথা। কিন্তু যেহেতু সুকুক প্রকল্পের মৌলিক সমস্যাগুলির এখনো সংশোধন করা হয়নি, তাই সুকুকের বিপরীতে প্রাপ্ত এই ভাড়া সুকুকহোল্ডারদের জন্য ভোগ করা বৈধ হবে না। সওয়াবের নিয়ত ছাড়া তা গরীবদের মাঝে সদকা করে দিতে হবে।

কেউ হয়তো বলতে পারেন, একে ফরওয়ার্ড লিজ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এর উত্তর হল, সেটি বললে প্রসপেক্টাসে স্পষ্ট বলতে হবে। তাছাড়া ফরওয়ার্ড লিজ ধরা হলে এর ফায়েদা শুধু এতটুকু যে, এ্যাসেট ছাড়াও লিজ চুক্তি বৈধ হয়ে যায়। কিন্তু রেন্ট তো আসবে এ্যাসেটের পর। এখানে তো সেই এ্যাসেট-ই নেই। তাহলে রেন্ট কোত্থেকে আসবে?

মোটকথা, এভাবে প্রাপ্ত রেন্ট কোনোভাবেই বৈধ নয়। শরীয়াহ বোর্ড এসবের দায় এড়াতে পারেন না।

শরীয়াহ ইস্যু-০৩ : সার্ভিসিং এজেন্ট

নতুন প্রসপেক্টাসে বলা হয়েছে, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর প্রজেক্টের সার্ভিসিং এজেন্ট হিসেবে কাজ করবে। এসপিভির পক্ষে তাকে নিয়োগ দেবে অর্থ বিভাগ। প্রশ্ন হল, সার্ভিসিং-এর জন্য তো আগে এ্যাসেট লাগবে। এখানে সেই এ্যাসেট নেই। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর মূলত সেই প্রজেক্ট তৈরি করবে। প্রসপেক্টাসে তা-ই বলা হয়েছে। তাহলে তারা কী করে সার্ভিসিং এজেন্ট হয়? তারা তো প্রজেক্ট প্রস্তুতকারী।

শরীয়াহ প্রশ্ন তৈরি হয়, প্রজেক্ট তৈরির আগেই পারচেজ, এরপর লিজ কীভাবে সম্পন্ন হল? এগুলোর কোনোও সদুত্তর নেই।

সারকথা

পুরো অবকাঠামোতে ক্রয়-বিক্রয়, লিজ এগুলো শুধু নামমাত্র ব্যবহার হয়েছে। বাস্তবতা নেই। বাস্তবে টাকার বিপরীতে অতিরিক্ত আদান-প্রদান হচ্ছে। যা স্পষ্ট না-জায়েয। শোনা যায়, গত শতাব্দীর শেষের দিকে পাকিস্তানে যখন ইসলামী ব্যাংকের সূচনা হয়েছিল তখন মুরাবাহা নামে একটি ইনভেস্টমেন্ট প্রকল্প চালু করা হয়েছিল। যেটি বাস্তবে মুরাবাহা ছিল না। কার্যত নামমাত্র মুরবাহা ছিল। কেউ টাকা নিতে আসলে তাকে টাকা দিয়ে দেয়া হতো। আর ধরে নেয়া হতো, তিনি সেই টাকা দিয়ে প্রথমে ব্যাংকের পক্ষে পণ্য ক্রয় করেছেন, এরপর ব্যাংক থেকে তিনি ক্রয় করে নিয়েছেন। সবই ধরে নেয়া। বাস্তবতা ছিল না। কিন্তু অর্ধ শতাব্দী পার হয়ে যাওয়ার পর বর্তমান বিশে^ও এরকম কল্পিত শরীয়াহ সুকুক দেখতে হবে তা খুবই দুঃখজনক।

আরও কিছু বিষয়

এছাড়া আরও কিছু বিষয়ে আপত্তির জায়গা আছে। ভাড়া চুক্তি কার্যকর থাকার জন্য অন্যতম শর্ত হল ভাড়ায় দেয়া বস্তু বিদ্যমান থাকা (Durability)। ভাড়া গ্রহণের যোগ্য থাকা। বলা হচ্ছে, আলোচিত প্রজেক্টে নলকূপ, পানির ট্যাংকি ইত্যাদি বস্তু আছে। যদি থেকেও থাকে তবুও এগুলো যখন তখন নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে পুনঃমেরামত করে ভাড়া সচল রাখা হবে, নষ্টকালীন ভাড়া চুক্তি সাময়িকভাবে বন্ধ থাকবে- প্রসপেক্টাসে এধরনের শরীয়াহ স্বচ্ছতা নেই।

বিকল্প নির্দেশনা

সবশেষে আমরা বলতে চাই, সরকার যে উদ্দেশ্যে ও পদ্ধতিতে সুকুকের মাধ্যমে ফান্ড সংগ্রহ করতে চেয়েছে, সেটি করতে হলে ইজারা পদ্ধতি ত্যাগ করতে হবে। ইজারা পদ্ধতির মাধ্যমে শরীয়তসম্মত সুকুক বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। কারণ সরকারকে সুকুক প্রজেক্ট/এ্যাসেট তৈরি করতে হবে। আগে থেকে তৈরি করা নেই। এমন ক্ষেত্রে সবচেয়ে উপযোগী সুকুক স্ট্রাকচার হল- ইস্তিসনা স্ট্রাকচার (Istisna’a Sukuk)।

অর্থাৎ ইনভেস্টরগণ তাদের প্রদানকৃত অর্থ দিয়ে এসপিভির মাধ্যমে অরিজিনেটরকে বলেছেন, সুকুক অর্থের বিনিময়ে এসব স্থাপনা তৈরি করে দিতে। তৈরি ও হস্তান্তরের পর সেটি ওরিজিনেটরের কাছে বিক্রয় করা হবে। (Istisna’a+Sell based Sukuk) অর্থাৎ ইস্তিসনা ও বিক্রয় দুটি চুক্তি যথা সময়ে ঘটবে। তবে একটির সাথে অপরটি শর্তযুক্ত হবে না। তাছাড়া সংশ্লিষ্ট অন্যান্য শরীয়াহ রুলিংও অনুসরণ করতে হবে।

কেউ কেউ বলেছেন, এখানে জমি আছে। সরকার মূলত জমি বিক্রয় করবে, কিন্তু সেটিও অজ্ঞাত। যদি ধরেও নেয়া হয় তাতে জমি জ্ঞাত তাহলে বিষয়টি দাঁড়ায়, এসপিভির মাধ্যমে জমি ক্রয় করা হবে। এরপর তাতে এসব স্থাপনা তৈরি করা হবে। এগুলো Existing হওয়ার পরই কেবল তা ভাড়ায় দেয়া যাবে। এটিও সময় সাপেক্ষ। যেমনটি পূর্বে বলা হয়েছে।

সুতরাং বাস্তব অর্থে এক্ষেত্রে ইজারা সুকুক সম্ভব নয়। এর শরীয়াহ স্ট্রাকচারই আরো গভীরভাবে ডিজাইন করতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবশ্যই বিষয়টি ভেবে দেখা উচিত। 

লেখাটি শেষ করার আগে দুঃখের সাথেই বলতে হচ্ছে, প্রথম প্রসপেক্টাসের আলোচিত কিছু বিষয় তারা আমলে নিলেও মৌলিক শরীয়াহ-বিচ্যুতি এখনও থেকে গেছে। যে কারণে এই সুকুককে শরীয়াহ ইনভেস্টমেন্ট হিসেবে আখ্যা দেওয়া এখনও প্রশ্নবিদ্ধ। হ

 

 

advertisement