ক্লাব-বারের রঙিন অন্ধকার
চাই অনুতাপ ও দাওয়াহর উদ্যোগ
আড়ালে-আবডালে রঙিন অন্ধকারের এ জগৎ চালুই ছিল। এটা মোটামুটি অনেকেই জানতো। কিন্তু গত জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে একটি নারী-বিষয়ক ঘটনায় সে চিত্রটি অনেক ভয়ঙ্করভাবে সামনে চলে এলো এবং তাতে দেখা গেল এজাতীয় মদ-বার-ক্লাব-ফুর্তির রঙিন অন্ধকার যেন সমাজের মাথা থেকে নিয়ে পেট ও হাঁটু- সব গিলে খেয়ে ফেলতে বসেছে। একটি ধর্মপ্রাণ মুসলিম সমাজের জন্য এটি একটি ভয়াবহ সংকেত ও সংকট। এর সঙ্গে দ্বীনী জীবনের প্রতি বিদ্রোহের আয়োজন-সংস্কৃতির বিষয় যেমন জড়িত, তেমনি যুক্ত দেশের প্রচলিত আইন ও মানিত রীতিনীতির লঙ্ঘনেরও ব্যাপার।
জুনের মাঝামাঝি সময় ঢাকা আশুলিয়ার বোট ক্লাবের মধ্যরাত, বিনোদন, নারী, বার ও দেশী-বিদেশী মদের বোতল, বিত্ত প্রভাব ও পোশাকি ক্ষমতার অদ্ভুত সমন্বিত এক রঙিন অন্ধকার দেশবাসীর চোখে ধরা দিয়েছে। সেখানে দ্বীনী মূল্যবোধ ও নৈতিকতার যে অবনমন ঘটেছে, তার অনেক ক’টি দিক একের পর এক সামনে চলে এসেছে। ঘটনাপ্রবাহের স্রোতও বয়ে গেছে এক বোটক্লাব ও বার থেকে অভিজাত পাড়ার বিভিন্ন অলিগলি ও চত্বরে। এতে হঠাৎ করেই যেন সমাজের উপরতলার দগদগে ঘা-য়ের মুখ উদোম হয়ে পড়েছে।
। দুই।
আশুলিয়ার বোট ক্লাবকাণ্ডের পর এবং সে কাণ্ডের সূত্র ধরে আরও কিছু ঘটনা, গ্রেফতার, খবর ও চিত্র চোখে পড়ার পর অনেকের যে কথাটা মনে হয়েছে, এমন মদ-আয়োজন ও ঘটনা আগে হয়তো এতটা সামনে ছিল না। এখন অনেক কিছু সামনে এসেছে। শুধু তাই নয় এর সঙ্গে এটাও দেখা গেছে যে, অভিজাত ‘বড়লোকি’ সমাজে এটা বেশ মহামারির মতো জেঁকে বসে আছে। খবরে দেখা গেছে, আশুলিয়ার বোট ক্লাব-এর জায়গায় নদী দখল, ভূমি দখলের বিতর্ক আছে। আবার পোশাকি বাহিনীর সর্বোচ্চ ব্যক্তিরা তার নেতৃত্বে যুক্ত আছে। সেই ক্লাবের সঙ্গে আছে মদের বার। ক্লাবের সদস্যদের জন্য এবং সদস্যদের গেস্টদের জন্য সেই বারে বসে মদ পানের ব্যবস্থাও আছে।
বোট ক্লাব-ঘটনার সূত্র ধরে ঢাকার গুলশান-বনানীর পাশাপাশি বড় শহরের বিভিন্ন হোটেল ও ক্লাবে এজাতীয় মদ বিপণন ও মদ্যপান সংশ্লিষ্ট অনেক রকম আয়োজনের চিত্র ঢাকনা-মুক্ত হয়েছে। এতে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখা গেছে যে, সমাজের বহু প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, রাজনীতিক ও প্রশাসনের বড় চেয়ারের মালিকেরা মাদকের প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত। উপরন্তু এজাতীয় ক্লাব-মাদক-যুক্ততাকে এখন তারা সামাজিক ও পারিবারিক মর্যাদার জন্য ক্ষতিকরও মনে করছেন না।
উল্টো মদ্যপান ও মাদক আয়োজন সংযুক্তি যেন একশ্রেণির ক্ষমতাধর ও বিত্তপতির জন্য সামাজিক মর্যাদার ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। খবরের বর্ণনা ও জাতীয় সংসদের দেওয়া বক্তব্যে জানা গেছে, ওইসব ক্লাব-বারে সদস্য হতে হলে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা জামানত দিতে হয়, ডোনেশন করতে হয়। এই সমাজের বহু রথী-মহারথীরা সেই টাকা দিয়ে রঙিন বোতলের রেকের কর্তৃত্বে ভাগ বসাতে পেরে তৃপ্তি বোধ করেন।
আমাদের জাতি ও সমাজের জন্য এটি একটি ভয়াবহ পতন-সংকেত। এই করোনাকালে নিজেদের সংযমী ও অনুতপ্ত জীবন যেখানে সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশিত, যেখানে দুঃখি-দরিদ্র কর্মহীন মানুষগুলোর দিকে সাহায্যের হাত বাড়ানোর মতো দরকারি ও মানবিক পরিস্থিতি যাচ্ছে- সে সময়টাতে মদের বোতলের কর্তৃত্বের পেছনে অর্ধ কোটি টাকা ঢেলে দেওয়ার এই ‘আভিজাত্য ও ফুটানি’ কতটা অমানবিকতার পচনগন্ধ তৈরি করতে পারে- এটা ভাবতেও কষ্ট লাগে।
। তিন।
ক্লাব-বার কাণ্ডের নানান খবর যখন গণমাধ্যমের বরাতে জুন মাস জুড়ে সামনে আসছিল তখন একটি চিত্র এটাও চোখে পড়েছে যে, সমাজের ‘মুদ্রা-বিনোদিনীদের’ অনেকেই এসব ক্লাবে রাতবিরাতে মদপানে এবং মদ পানের নামে হৈ-হুল্লোড়ে ছুটে যায়। এই মুদ্রা বিনোদন ও বিনোদিনীদের অনেক রকম রসদ ও মজমা জোগানোর দরবারগুলোও এসব বোতলকেন্দ্রিক আখড়াগুলোতে তৈরি হয় ও প্রণীত হয়।
এসব ক্লাব-বার শুধু চোখ বুজে মদ পান করারই জায়গা নয়; বরং রঙিন অন্ধকারের আরো বহু দুর্গন্ধ-আয়োজনের পেছনেও এইসব ক্লাব ও তাদের কর্তাদের উদ্যম-মনোযোগ নিয়োজিত হয়। আর ক্লাব-বার সংস্কৃতি বিনোদনের এসব নষ্ট চর্চা এভাবেই ক্ষমতা ও প্রভাবের একটা দুষ্ট শক্তিময় অনুমতি লাভ করে।
অপরদিকে পাপের স্বাভাবিকীকরণ ও সহজীকরণ এক ভয়ঙ্কর অভিশাপের বিষয়। এ স্বাভাবিকীকরণ সমাজে যেমন ক্ষতিকর বার্তা দেয় তেমনি পরিবারের ভেতর দেয় অবক্ষয়ের ধাক্কা। বোট ক্লাব-কাণ্ডের পর একে একে বিভিন্ন ঘটনা ও খবরে একটা ব্যাপার বোঝা গেছে, বিত্ত ও ক্ষমতার উপরতলায় থাকা পরিবারগুলোর বড় একটি অংশ জেনে গেছে এবং মেনেও নিয়েছে যে, তাদের পরিবারের কর্তারা বোতল ও বিনোদনের রঙিন অন্ধকারের সঙ্গে জড়িত।
স্ত্রী-সন্তান জানে, তাদের পরিবার প্রধানের ফুর্তির ধরন ও জগৎটা কেমন, কোথায়। এরপরও সেই পরিবারে স্বাভাবিক পারিবারিক, দ্বীনী ও সহজাত শালীন মানবিক মূল্যবোধ টিকে থাকবে- এটা মনে হয় কিছুটা কষ্ট-কল্পনা। অথবা সবাই যার যার জায়গায় ‘নিচে’ নেমে গিয়ে ‘স্বাভাবিকীকৃত’ রঙিন অন্ধকার জগতের শান্ত সদস্যে পরিণত হয়ে যায়।
এ-ও এক কষ্টের গল্প। নৈতিক অবনমনের এক ‘অভিজাত’ বিচ্যুতি। সমাজের মাথায় বসে থাকা প্রভাবশালী একটি শ্রেণির এই বিচ্যুত জীবনচলা বন্ধ না হলে অথবা বন্ধ করার মতো ভাবনা-চিন্তা, দাওয়াহ-উদ্যোগ না থাকলে পরিস্থিতি দিন দিন ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে।
। চার।
অভিজাত পাড়ায় গড়ে ওঠা এইসব ক্লাব-বার ও নানা রঙের অন্ধকার আয়োজন আসলে শালীন মুসলিম ভূখণ্ডে পশ্চিমের একেকটি হাহাকারের ঘাঁটি। শান্তি ও স্থিতি হারানো পশ্চিমের রঙিন অন্ধকার এইসব ক্লাব-বার ও আয়োজনে ভর করে মুসলিম দেশগুলোর বিত্ত ও প্রতিপত্তির মাথায় পচন ধরিয়ে দেওয়ার কাজটি ‘ফুর্তিতে ফুর্তিতে’ করে যায়। এর ফলে অনেক অবক্ষয় ও বিকারের ঘটনা ঘটতে থাকে। দেশের কর্পোরেট জগতের মালিক-মোক্তারদের অতি অন্ধকার জীবনের পর্দা সরিয়ে দেয়- হঠাৎ একটি-দুটি প্রলুব্ধ তরুণীর আত্মহত্যার ‘ঢাকা-পড়া’ গল্প। অনেক গল্প আবার শুরু থেকেই মলাটের ভেতরে চাপা পড়ে থাকে, টেরই পাওয়া যায় না।
এভাবেই ক্লাব-বার ও বিনোদনের নষ্ট স্রোতে দেশের শক্তিধর বহু হাত ও চেয়ারকে ভেসে যেতে দেখা যায়। অথবা দেখা যায় না- ভেসে যায়। ভেতর থেকে ফোঁকলা হয়ে যায় সমাজের মাথা। অনেকসময় দেশ সমাজ ও জাতি, উম্মাহ ও দ্বীনের জন্য ধ্বংসাত্মক ভূমিকায় নামে রঙিন স্রোতে ভেসে যাওয়া এসব মালিক-মোক্তারেরা। আন্তরাষ্ট্র ব্যবসা, মিডিয়ার মালিকানা আর রাজনীতির পেছনের দরজায় বিচরণের সুযোগে এরা এসব করতে পারে সহজেই।
। পাঁচ।
ক্ষমতা ও বিত্তের উপরতলায় ক্লাব-বার মদ-জুয়া ও নষ্ট বিনোদনের গল্প হঠাৎ করেই যেন ফেঁপে উঠেছে। কিছুদিন আগে ক্যাসিনো ও পাপিয়াকাণ্ডে আরো অনেক চিত্র সামনে এসেছিল। তখনও অনেকের ধারণা ছিল, ক্ষুদ্র একটি অংশের চিত্র এটা, বেশি দূর ছড়িয়ে পড়েনি। কিন্তু বোট ক্লাব কাণ্ড, মুদ্রা-বিনোদিনীর হইচই, আরো আরো ক্লাবের মধ্যরাত পর্বের খবর সামনে চলে আসায় বোঝা যাচ্ছে, পাপের সয়লাব নগরীর অভিজাত পাড়া প্রায় ডুবিয়ে দিয়েছে। এর শুদ্ধি ও চিকিৎসা দরকার; ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে।
কিন্তু একটি ব্যাপার বেশ তামাশাদার মনে হয়। রাজধানী ও দেশের বড় শহরগুলোর বার-ক্লাবের কর্তৃত্বে যুক্ত থাকছে বিত্ত ও পোশাকি প্রশাসনের কর্তারা, ফুর্তিতে-রঙে অন্ধকার রাত মাতিয়ে তুলছে; কিন্তু তাদেরই কেউ কেউ আবার দিনের বেলায় বিভিন্ন শহর-গ্রামের মসজিদগুলোতে গিয়ে মাদকের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিতে ইমাম সাহেবদের হাতে স্লিপ ধরিয়ে দিচ্ছে। অনেকসময় নিজেরাই বক্তব্য দেওয়ার মহৎ কাজেও লেগে যাচ্ছে। রাজধানীতে মাদকের হর্তাকর্তারা গ্রামেগঞ্জে গিয়ে মাদকের বিরুদ্ধে এভাবেই জোশ ছুটিয়ে দিচ্ছে! এ যেন নিষ্ফল এক প্রদর্শনীর খেলা!
দ্বীনী নৈতিকতার বিধান লংঘনের একেকটি রঙিন অন্ধকার জগতের নির্মাতাদের এসব দৃশ্যচিত্র জাতি হিসেবে আমাদের জন্য দুঃখের। এসব বিষয়ে দ্বীনী নৈতিকতা ও জাতীয় সভ্যতার বিষয় নিয়ে যাদের কাজ, তাদের সক্রিয় ভাবনা-পদক্ষেপ দরকার। রাষ্ট্র ও কর্তৃত্বের বড় কর্তারা এসব বিষয়ে চোখ বন্ধ রাখতে পারেন না। হ