খতমে নবুওত সংরক্ষণ আন্দোলন : মক্তব কায়েম করুন
[২৭শে জুন, ২০২১ রবিবার, বাদ মাগরিব খতমে নবুওত মাদরাসা, পঞ্চগড় প্রতিষ্ঠার অগ্রগতি বিষয়ে উত্তরা মাখযানুল উলূম মাদরাসার দফতরে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় হযরত প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রাহমান ছাহেবের বয়ান]
আমার বন্ধু, সম্পর্কে আমার সম্বন্ধী। আমার বাসায় আসর থেকে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগের কথা। একসাথে পড়েছি। তুই-তুকারি সম্পর্ক। আমি মাগরিবের পর বাসায় ফিরলে আমাকে দেখে বলল, কোথায় ছিলি?
আমি বললাম, খতমে নবুওতের সভায় যোগ দিতে গিয়েছিলাম। বাইতুল মোকাররমের খতীব মাওলানা ওবায়দুল হক হুজুরের নেতৃত্বে কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা করার আন্দোলনে শরীক হতে গিয়েছিলাম।
এই কথা বলতেই আমার বন্ধু উষ্মা প্রকাশ করে বললেন, তোরা মৌলভীরা খেয়ে দেয়ে আর কাজ পাস না, কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে! জানিস ওরা কত কাজ করছে? হেগে মসজিদ বানিয়েছে। জার্মানিতে মসজিদ বানিয়েছে। ইসলামের জন্য ওরা কত কাজ করছে, আর তোরা আছিস ‘কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা কর, অমুসলিম ঘোষণা কর’ নিয়ে।
আমি বললাম, তুই জানিস, ওরা কী বলে?
সে জিজ্ঞাসা করল, কী বলে?
বলে, “আমাদের নবীর পর গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নামে এক নবী এসেছে। যারা তাকে নবী না মানবে তারা সবাই কাফের। তাদের কথায় আমরা সবাই কাফের। আমাদের রাসূলের পর চার খলীফা ছিল, হযরত আবু বকর রা., হযরত ওমর রা., হযরত উসমান রা. ও হযরত আলী রা.। ওদের সেইরকম খলীফা আছে, ২০০৩ সন থেকে এখন তাদের পঞ্চম খলীফার রাজত্ব চলছে।
যে মানুষটা এতক্ষণ কাদিয়ানীদের গুণগান করছিল, আমার সেই বন্ধুটা বাংলায় শ-আকার ‘শা’ দিয়ে এক গালি আছে, সেটা ব্যবহার করে বলল, ‘শা...রা, এরকম বলে?’
আমি বললাম, শহীদ মিনারের পশ্চিমে বুয়েটের বাইতুস সালাম যে মসজিদ আছে, তার পাশ দিয়ে দক্ষিণ দিকে গেলে বকশিবাজারের চৌরাস্তা, সেখান থেকে আরেকটু দক্ষিণে এগুলে কাদিয়ানীদের সদর দপ্তর। বাইরে থেকে লেখা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’। কত বড় ধোঁকাবাজ! ভেতরে গেলে তারা বলে, ‘গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে নবী মানো, তা না হলে তুমি কাফের।’
এই গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নবী দাবি করে ১৯০১ সনে। সে মারা যায় ১৯০৮ সনে। ১০০ বছরের বেশি হয়েছে সে মারা গেছে। এই দীর্ঘ সময় তারা মেহনত করেই যাচ্ছে। আমাদের বুযুর্গরা যুগে যুগে এর বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী রাহ. এর বিরুদ্ধে লড়েছেন। আমাদের দেশে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বড় হুজুর মাওলানা তাজুল ইসলাম রাহ.-এর ছাত্র মাওলানা সিরাজুল ইসলাম হুজুরের নেতৃত্বে এক বিশাল আন্দোলন হয়েছিল। তার ফলে সেসময় সেখান থেকে কাদিয়ানীদের মূলোৎপাটন করা হয়েছিল। সেখানে এক বিরাট মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, খতমে নবুওত মাদরাসা।
১৯৭৪ সনে উলামায়ে কেরামের নেতৃত্বে মুসলমানেরা কাদিয়ানীদের কাফের ঘোষণার দাবিতে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। জুলফিকার আলী ভুট্টো তখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। তিনি খুব একটা ইসলাম-বান্ধব ছিলেন না; তথাপি আলেম সমাজের আন্দোলনের ফলে পাকিস্তান সরকার কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। পরে সৌদিআরব, মিসর, ইরাকেও কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা করা হয়।
নবী হওয়ার মিথ্যা দাবি করার ঘটনা বহু পুরোনো। খোদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবিত থাকা অবস্থায় মুসাইলামা কাযযাব নিজেকে নবী দাবি করে বসল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে চিঠি লিখল এভাবে- ‘আল্লাহর রাসূল মুসাইলামার পক্ষ থেকে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের প্রতি...।’
চিঠিতে লেখা ছিল, ‘আপনিও নবী আমিও নবী, আসুন পৃথিবীর অর্ধেক আপনি রাজত্ব করেন, অর্ধেক আমি করি।’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে লিখলেন, ‘আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে মিথ্যুক মুসাইলামার প্রতি...।’
মুসাইলামা কাযযাবের কাছে সেই চিঠি নিয়ে গিয়েছিলেন হযরত হাবীব ইবনে যায়েদ আলআনসারী রা.। তিনি তার মা-বাবাসহ হিযরতের আগেই মুসলমান হয়েছিলেন। দ্বিতীয় আকাবার শপথের সময় যারা মুসলমান হয়ে মিনায় আকাবার প্রান্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাতে বাইআত হয়েছিলেন হাবীব ইবনে যায়েদ আলআনসারী রা. ও তাঁর বাবা-মা তাদের মধ্যে ছিলেন। হাবীব ইবনে যায়েদ আলআনসারী রা. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দূত হওয়া সত্ত্বেও মুসাইলামা কাযযাব তার উপর অনেক নির্যাতন করেছিল এবং তাকে শহীদ করে দিয়েছিল। অথচ আরবের প্রথা অনুযায়ী একজন দূতের উপর কোনো আক্রমণ করার নিয়ম ছিল না।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওফাতের পর আবু বকর রা.-এর খেলাফতকালে দুর্বল ঈমানের অনেক মুসলিম মুসাইলামা কাযযাবের অনুসারী হয়ে যায়। এক পর্যায়ে হযরত আবু বকর রা.-এর নেতৃত্বে ইয়ামামার প্রান্তরে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যা ইয়ামামার লড়াই নামে বিখ্যাত। সেই যুদ্ধে শত শত সাহাবী শহীদ হন। শেষ পর্যন্ত মুসায়লামা কাযযাব নিহত হয়। আল্লাহর মেহেরবানীতে এ ফেতনা শেষ হয়ে যায়।
যাইহোক, কাদিয়ানীরা বর্তমানে অনেক অপতৎপরতা চালাচ্ছে। এই গত বৃহস্পতিবারের ঘটনা। আমার ছেলে মাসীহুর রহমানের বাসার মজলিসে মাওলানা তাহমীদুল মাওলা এসেছিল। একজন নবীন যোগ্য মাওলানা। হবিগঞ্জের বিখ্যাত মাওলানা তাফাজ্জুল হক হুজুরের জামাই। মজলিসে আমি বললাম, কিছু কথা শোনাতে হবে। আবরারুল হক হুজুর বলতেন, ‘দ্বীন কি বাত সুনাও!’
সে বয়ানে বলেছিল, সম্ভবত চট্টগ্রামের এক ইমাম সাহেব তার পরিবার নিয়ে সবাই কাদিয়ানী হয়ে গেছে। সে তাহমীদুল মাওলাকে দাওয়াত দেয়- কাদিয়ানী হওয়ার জন্য। কত বড় সাহস, একজন ভালো বিজ্ঞ আলেমকে তাদের এই ভ্রান্ত দাওয়াত দিতেও তারা কুণ্ঠিত হচ্ছে না।
আমি আমেরিকায় সফরে গেলে ফ্লোরিডায় আমাদের মেজবান ছিল জসিম সাহেব। সে সম্প্রতি শোনালো, তার পরিবারের প্রায় সবাই- বউ, ছেলে, শ্যালক ইত্যাদি সবাই কাদিয়ানী হয়ে গিয়েছে। কত দুর্ভাগ্য জসিম সাহেবের!
ভণ্ড নবীদের কথা, কাজ-কর্ম দিবালোকের মতো এতো স্পষ্ট মিথ্যা যে, একজন শিক্ষিত মানুষ সহজেই বোঝার কথা যে, তারা একেবারেই ভ্রান্ত। অথচ এই শিক্ষিত মানুষরা এই ফাঁদে পা দেয় বেশি। বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক, আর্কিটেকচারের অধ্যাপক ছিলেন, মুবাশ্বির আলী বাংলাদেশ কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের সাধারণ সম্পাদক। বুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠানের একজন অধ্যাপক মানে অনেক জ্ঞানী একজন ব্যক্তি, সেই মানুষও নবুওতের মিথ্যা দাবিদার এই ভণ্ডের অনুসারী। তাই এটা আল্লাহ তাআলার মেহেরবানী যে, তিনি আমাদেরকে সঠিক পথে, খাঁটি ঈমানের পথে রেখেছেন। এটা আমাদের কামাই না, আল্লাহ তাআলার মেহেরবানী।
পঞ্চগড়ে কাদিয়ানীদের মোকাবেলায় আমাদের আন্দোলন হল, সেখানে মক্তব প্রতিষ্ঠা করা। অনেকে বলবেন, মক্তব প্রতিষ্ঠা করা তো কোনো আন্দোলনই না। নাহ, এটা অনেক বড় আন্দোলন। হয়ত আমরা থাকব না। এই মক্তব থেকে পড়ে পরবর্তীতে আরো উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে এমন এমন যোগ্য আলেম তৈরি হবে, যারা এই কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে, মোকাবেলা করবে।
আপনারা এই কাজে লেগে থাকুন। আল্লাহ আমাদের কবুল করুন।
[শ্রুতিলিখন ও প্রস্তুতকরণ : ড. লুৎফুল কবীর] হ