প্রিয় তালিবানে ইলম!
বিনয় আদব ও ইলমী নিমগ্নতা শিখুন
নিজের বর্তমান যিম্মাদারীর প্রতি মনযোগী হোন
সাধ্যাতীত কাজের ফিকিরে পড়ে সাধ্যের ভেতরের কাজ থেকে গাফেল হওয়া উচিত নয়
তলাবায়ে কেরামের খেদমতে আরয করার মত অনেক বিষয় আমার মুযাককিরায় লেখা আছে। এ শিরোনামটিও অনেক পুরনো; কিন্তু বর্তমান অবস্থা দেখে বলা যায়, এটি একেবারে সাম্প্রতিক একটি বিষয়।
আমার প্রিয় তালিবানে ইলম!
আপনাদের সামনে আমি সাফ সাফ আরজ করতে চাই যেÑ
ترسم نہ رسی بہ کعبہ اے اعرابی
کہ ایں راہ کہ تو می روی بترکستان است
আপনি যে পথে চলছেন তা আপনার পূর্বসূরি সালাফ-আকাবিরের পথ নয়। আপনার চলার পথ হলÑ
১. আসাতেযায়ে কেরামের সাথে আদব ও তাওয়াযুপূর্ণ আচরণ করা।
২. মাদরাসার নিয়ম-কানুন যথাযথভাবে মেনে চলা।
৩. মাদরাসার ইন্তেযামী ও ব্যবস্থাপনাগত বিষয়াবলিতে দখল না দেওয়া।
৪. স্ট্রাইক বা এ ধরনের যে কোনো কার্যকলাপ থেকে যোজন যোজন দূরে থাকা।
৫. রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক, নামধারী বা বেনামী, অজ্ঞাত বা গোপন যে কোনো ধরনের তানযীম বা সংগঠনের সাথে যুক্ত না হওয়া।
৬. তলবে ইলমীর যামানায় সক্রিয় রাজনীতিতে না জড়ানো।
৭. কোনো মাদরাসায় ভর্তি হওয়ার অর্থই হল, মাদরাসার নিয়ম-কানুন এবং মাদরাসা কতৃর্পক্ষের আদেশ-নিষেধ মেনে চলা আমার উপর ফরয।
৮. কোন্ কাজ ‘নাহি আনিল মুনকার’-এর অন্তভুর্ক্ত আর কোন্ কাজ ‘নাহি আনিল মুনকার’ নয়; কোন্ নাহি আনিল মুনকার তালিবে ইলমের দায়িত্বের মাঝে পড়ে আর কোন্টা তার দায়িত্বের মাঝে পড়ে না এবং কোন্ নাহি আনিল মুনকারে শামিল হওয়া তালিবে ইলমের জন্য স্পষ্ট নাজায়েযÑ এসব বিষয়ে যদি মাদরাসা কতৃর্পক্ষের (যারা আমাদের বড় এবং উসতায ও মুরব্বীও) ফয়সালা আর তালিবে ইলমের খেয়ালের সাথে মতবিরোধ হয় তাহলে অপছন্দ হওয়া সত্ত্বেও আদব ও তাওয়াযুর সাথে কতৃর্পক্ষ ও আসাতেযায়ে কেরামের ফয়সালা মত আমল করা কর্তব্য। ইজমায়ে মুতাওয়াতির এবং কাতইয়্যুছ ছুবুত ও কাতইয়্যুদ দালালাহ শরয়ী নছ ছাড়া এক্ষেত্রে তলাবাদের জন্য মাদরাসা কর্তৃপক্ষের বিরোধিতা করার অধিকার নেই।
৯. তলাবায়ে কেরামের আসল কাজ হল তালীম-তরবিয়তে নিমগ্ন থাকা এবং নিজেকে প্রস্তুত করার চেষ্টায় মগ্ন থাকা।
১০. সকল প্রকার অনর্থক কাজ ও অন্যায় দখল-আন্দাজি থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা।
আশ্চর্যের শেষ থাকে না, যখন শুনিÑ কাদামাত ও আদব-তাওয়াযুর পতাকাবাহী মাদরাসার তালিবে ইলমরা আজকাল আসাতেযা ও মাদরাসা কতৃর্পক্ষের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে; তাও আবার পরীক্ষা চলাকালে। আর তা এমন এক বিষয়ে, যার শরয়ী বিধান কীÑ তা হয়ত না তাদের জানা আছে, না তাদের গুরুদের!
আমার প্রিয় তালিবানে ইলম! জযবার শিকার না হয়ে বুঝেশুনে কাজ করুন। এখন আপনাদের সামনে দীর্ঘ বয়ান করার ইচ্ছা নেই। আমি শুধু আমার পুরনো একটি লেখা আপনাদের খেদমতে পেশ করছি। আপনাদের কাছে আমার আজেযানাহ মহব্বতপূর্ণ মিনতি, আপনারা লেখাটি স্থিরচিত্তে চিন্তা-ফিকির করে মুতালাআ করবেন। প্রবন্ধটি পুষ্প সমগ্র ‘পুষ্প দ্বিতীয় প্রকাশনা’-এর একেবারে শেষে (পৃ. ৬৯৮-৭০০) ছাপা হয়েছে। প্রবন্ধের কয়েক জায়গায় পুষ্পের সম্পাদক হযরত মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ (আদীব হুজুর) দামাত বারাকাতুহুম-এর লেখা কিছু অতিব গুরুত্বপূর্ণ হাশিয়া রয়েছে। দুটি হাশিয়া আমরা এখানেও উদ্ধৃত করেছি। পুষ্প ও পুষ্প সম্পাদকের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শুকরিয়ার সাথে আমরা এ লেখাটি আলকাউসারের শিক্ষার্থীদের পাতায় ছাপছি।
তলাবায়ে কেরামের কাছে দরখাস্ত, যে প্রসঙ্গে বান্দাহ গত যিলকদ ১৪৪১ হিজরী সংখ্যায় ‘প্রিয় তালিবানে ইলম! সুস্থতা ও অবসরের কদর করুন’ শিরোনামের লেখাটি আপনাদের খেদমতে পেশ করেছিলাম, সে প্রসঙ্গ আজো আমাদের সামনে বর্তমান। তাই আমার উপর অনেক বড় ইহসান হবে, যদি আপনারা লেখাটি পুনরায় পড়ে নেন ও সে অনুযায়ী আমলের চেষ্টা করেন।
এ সংক্ষিপ্ত ভূমিকার পর এখন পুষ্পে ছাপা বান্দার সেই লেখাটি আপনাদের খেদমতে পেশ করছিÑ
তলাবায়ে কেরাম, একটু ভাবুন!<br>
‘আমীরে আম’-এর চেয়ে ‘আমীরে খাস’ অগ্রগণ্য<br>
‘ইলমী মাশগালা’-ই তালিবে ইলমের আসল মাশগালা<br>
আমার ধারণা ছিল, তলাবায়ে কেরামের সামনে এ বিষয়টি এবং এজাতীয় মৌলিক বিষয়গুলো স্পষ্ট। কারণ, এগুলো তো সর্বজনস্বীকৃত বিষয়। কিন্তু কোনো কোনো তালিবে ইলমের আচরণ-উচ্চারণ থেকে বোঝা যায়, বিষয়গুলো হয় তাদের জানা নেই অথবা তাদের কাছে পরিষ্কার নয়। তাই মনে হল, এ বিষয়ে কিছু কথা তাদের সামনে খোলামেলা পেশ করি।
১. প্রথম কথা, যা সবসময় স্মৃতি ও উপলব্ধিতে জাগরূক থাকা উচিত। তা এই যে, তালিবে ইলমের প্রধান ব্যস্ততা ও নিমগ্নতা হচ্ছে ইলমের তলব ও আমলের প্রতি যত্নবান হওয়া। সে মাদরাসায় এসেছে তালীম-তরবিয়ত হাসিল করার জন্য; দ্বীনের সঠিক বুঝ হাসিল করার জন্য এবং আদব ও আখলাকের আমলী মশক গ্রহণ করার জন্য। ‘দ্বীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা’-বিষয়ক যেসব কর্ম ও বিধান শরীয়তে আছে, সেগুলো অবশ্যই সে জানবে এবং খুব ভালো করে বুঝবে, কিন্তু তলবে ইলমের প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থায়, বিশেষ করে মাদরাসি নেযামে থাকা অবস্থায় এসব কাজে সম্পৃক্ত হবে না। এমনকি শরীয়তের দৃষ্টিতেও এসময় সে এজাতীয় কাজের মুকাল্লাফ নয়। হাঁ, যদি তরবিয়ত বা মশকের অংশ হিসেবে দাওয়াত ও নসীহতের কোনো কাজ মাদরাসার নেযাম বা কর্মসূচিরই অন্তভুর্ক্ত থাকে তাহলে ভিন্ন কথা।
২. কোনো কোনো তালিবে ইলমের মনে এ চিন্তা বেশ বদ্ধমূল যে, সিয়াসাত হল ইসলামের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি শাখা; তাতে আমারও অংশগ্রহণ করা উচিত। সেজন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ইসলামী দল ও সংগঠনের সাথে আমাকেও শরিক হতে হবে।
কিন্তু তাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, যে ‘সিয়াসাত’ ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ শাখা সেটা হচ্ছে ‘সিয়াসাতুর রায়িয়্যাহ’ (سياسة الرعية) অর্থাৎ জনগণের দ্বীন-দুনিয়া দুরস্ত করা ও দুরস্ত রাখা, রাষ্ট্রীয় সকল কাজকর্ম আল্লাহ তাআলার হুকুম মুতাবেক করা, মানুষের মাঝে ন্যায়-ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা। ইসলামের ‘আহকামুল জিনায়াত’ বা দণ্ডবিধি বাস্তবায়ন করা, এভাবে ইসলামের অন্যান্য সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিধি-বিধান, নাহি আনিল মুনকার, ইহতিসাব এবং সামর্থ্য অনুযায়ী জিহাদ ইত্যাদি শাখাগুলো বাস্তবায়ন করা। আর একথা তো স্পষ্ট যে, এই অর্থে ‘সিয়াসাত’ হচ্ছে ‘সায়িস’ বা শাসকের কাজ, যার কাছে জনগণকে শাসন ও নিয়ন্ত্রণ করার মতো শক্তি আছে। সাধারণ জনগণ তো ‘সায়িস’ (سائس) নয়, ‘মাসূস’ অর্থাৎ পরিচালক নয়, পরিচালিত; কর্তা নয়, অধীনস্ত।
যদি কোনো শাসক রাষ্ট্রে আল্লাহ তাআলার নাযিলকৃত বিধানের পরিবর্তে সেক্যুলার শাসনপদ্ধতি অনুসরণ করে তাহলে তাকে আল্লাহ তাআলার বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রচালনার দাওয়াত দেওয়া এবং এ উদ্দেশ্যে শরীয়তসম্মত সমকালীন কোনো পদ্ধতি অবলম্বন করা আর যাই হোক না কেন এগুলো ভিন্ন কাজ। এগুলোকে ‘সিয়াসাত’ নাম দেওয়া একটি নতুন পরিভাষা। অন্যথায় বাস্তবতা হল, এসব কাজ যদি শরীয়তের বিধান অনুসারে করা হয় তাহলে নাহি আনিল মুনকার এবং ‘ইযহারে কালিমায়ে হক’-জাতীয় দ্বীনী কাজের অন্তভুর্ক্ত; সিয়াসাতের অন্তভুর্ক্ত নয়। কেননা শরয়ী সিয়াসাতের মুকাল্লাফ তো রাষ্ট্রপ্রধান বা শাসক, প্রজা বা জনগণ নয়। অতএব যে সায়িস বা শাসক নয় সে কীভাবে ‘সিয়াসাত’ করবে?১
এ সংক্ষিপ্ত কথাগুলো যদি বুঝে আসে তাহলে ইনশাআল্লাহ একথা বুঝতেও কোনো অসুবিধা হবে না যে, তালিবে ইলম কোনো বিচারেই সিয়াসাতের মুকাল্লাফ নয়। মূল অর্থে নয় এজন্য যে, সে প্রজা, শাসক নয়; আর সমকালীন অর্থেও এজন্য নয় যে, তার কর্তব্য হল ইলম ও আমলের সাধনায় আত্মনিমগ্নতা। দেশ ও সমাজপর্যায়ের ‘নাহি আনিল মুনকার’-শ্রেণির কাজগুলো তার এখনকার কর্তব্যের অন্তভুর্ক্ত নয়।
এর একটি তাৎপর্য এই যে, তাবলীগে দ্বীন ও নুসরতে দ্বীনের যত শাখা এবং যত রকমের কাজ ও উদ্যোগ রয়েছে সেগুলোকে সফল ও কল্যাণকররূপে আঞ্জাম দেয়ার জন্যও তো বিশুদ্ধ ইলম, গভীর প্রজ্ঞা এবং ভারসাম্যপূর্ণ ও পরিপক্ব দ্বীনী সমঝ অপরিহার্য প্রয়োজন। আর তালিবে ইলমের শিক্ষাজীবন হচ্ছে মূলত সেগুলো অর্জন করারই মূল সময়। সেজন্য তার মধ্যে মেধা, চিন্তা ও কর্মশক্তির বিক্ষিপ্ততা আদৌ কাম্য নয়, কাম্য হল নিমগ্নতা ও একাগ্রতা। এ বিষয়ে সকল যুগের তালীম তারবিয়াতের চিন্তাশীল উলামায়ে কেরাম একমত। আমাদের সালাফ-খালাফের সকল আকাবিরের এ বিষয়ে ইত্তেফাক রয়েছে।
৩. কখনো কোনো বিশেষ অবস্থায় বা বিশেষ প্রেক্ষাপটে যদি আকাবির উলামায়ে উম্মতের পক্ষ থেকে কোনো সম্মিলিত কাজে শরিক হওয়ার সাধারণ ঘোষণা আসে, তাহলে কেবল সেই ঘোষণার ভিত্তিতেই তালিবে ইলম ভাই তার মাদরাসা ছাড়তে পারেন না। কারণ এরূপ ঘোষণার অর্থ কখনো এটা নয় যে, যার যেভাবে ইচ্ছা কোনো উসূল ও আদব ছাড়াই বের হয়ে পড়বে; বরং এক্ষেত্রেও উসূলের পাবন্দীর শর্তটি অপরিহার্য ও স্বতঃসিদ্ধ। তাছাড়া আকাবির উলামায়ে কেরামের অবস্থান আমীরের পর্যায়ে নয়। যদি তা হতোও তাহলেও একটি স্বীকৃত মূলনীতি এই যে, ‘আমীরে খাস’-এর হক ‘আমীরে আম’-এর আগে। এক্ষেত্রে যেহেতু মাদরাসার মুহতামিম হলেন আমীরে খাস আর এখানে তিনি তার পরিমণ্ডলে প্রকৃত অর্থেই আমীর। তবে তার এই যিম্মাদারী মাদরাসার দস্তুর ও উসূল-যাওয়াবেত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
তাছাড়া তালিবে ইলম মাদরাসার সাথে এ অঙ্গীকার করে ভর্তি হয়েছে যে, সে মাদরাসার সকল উসূল ও নেযাম মেনে চলবে। তাই ‘নির্দিষ্ট অথরিটি’র অনুমতি ছাড়া মাদরাসা থেকে বের হওয়া বা মাদরাসার নেযামের বাইরের কোনো কাজে অংশগ্রহণ করা তার জন্য জায়েয নয়। আর যারা মাদরাসার যিম্মাদার তারা তালিবানে ইলমকে কখন অনুমতি দেবেন, কীভাবে দেবেন তা চূড়ান্ত করবেন শরয়ী নীতিমালা ও মাদরাসার দস্তুরকে সামনে রেখে, পরস্পর মাশওয়ারা ও চিন্তা-ভাবনার পর। এতে যদি অনুমতি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় তাহলে পূর্ণ আনুগত্যের সঙ্গে তালিবে ইলম ভাইদের সে সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো ‘বদগুমানি’ বা ‘বদযবানি’ তাদের জন্য কোনোভাবেই জায়েয হবে না। এরপরও যদি তারা তা করে অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া মাদরাসা থেকে বের হয় তাহলে সেটা হবে আবেগতাড়িত এমন অন্যায় কাজ, যা তাদের শিক্ষাজীবন বরকতহীন করে দেবে। এটা ‘নুসরতে দ্বীন’ হিসেবে গণ্য করার কোনো সুযোগ নেই।
আর যদি আহলে মাদরাসা অনুমতি দেন, তখন দেখতে হবে, এ বিষয়ে তারা তালিবুল ইলমের পারিবারিক অভিভাবকের সাথে কথা বলেছেন কি না। যদি না বলে থাকেন তাহলে তালিবুল ইলমের কর্তব্য হবে, সম্ভব হলে মা-বাবার কিংবা২ তার ব্যয়ভার বহনকারী মুরব্বী ও অভিভাবকের অনুমতি ও দুআ নিয়ে অংশগ্রহণ করা। নতুবা তার এ অংশগ্রহণ হবে খেলাফে উসূল বা নীতিবিরুদ্ধ কাজ। যা কোনো তালিবে ইলমে নবুওতের জন্যে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবার নয়।
ومن ارتاب في صحة ما قيل هنا فليتذكر حديث رسول الله صلى الله عليه وسلم >ففيهما فجاهد<، وقوله >الزمها، فإن الجنة عند رجلها<، وإذا كان هذا في الجهاد الحقيقي فكيف فيما هو من قبيل الملحق بالجهاد على أكبر تقدير، إن فرضت صحة رأيكم. قاله الراقم.
৪. আজকের মজলিসের শেষ পর্যায়ে আরেকটি কথা এই যে, কোনো কোনো তালিবুল ইলম ভাইকে দেখা যায়, কোথাও কোনো মাহফিলের সংবাদ, কোনো সেমিনারের ঘোষণা, কিংবা দেশি-বিদেশি কোনো বুযুর্গের আগমনের সংবাদ শুনলে সোজা রওয়ানা হয়ে যায়। অথচ তার একটু ভাবা দরকার ছিল যে, সে তার প্রধান ব্যস্ততা কেন ছেড়ে যাচ্ছে? এর পরও যদি যেতেই হয় তাহলে যথানিয়মে মাদরাসা থেকে ছুটি নেবে এবং অবশ্যই নিজের তালিমী মুরব্বীর অনুমতি নেবে। বাবা-মায়ের থেকেও অনুমতি নেবে। শুধু জযবার ভিত্তিতে কাজ করা তো কখনোই কোনো তালিবুল ইলমের জন্য শোভন নয়। অথচ আমাদের একজন বুযুর্গের নিয়ম হল, ঘর থেকে বের হওয়ার সময় অবশ্যই তিনি তাঁর মাকে জানিয়ে বের হন এবং তাঁর দুআ নিয়ে বের হন। এক্ষেত্রে তাঁর অভিজ্ঞতা এই যে, এর দ্বারা তিনি অনেক ফায়েদা পান এবং সব ধরনের বিপদ-মুসীবত থেকে নিরাপদ থাকেন। অতএব যদি তালিবে ইলমকে মাদরাসা থেকে বের হতে হয় তাহলে নিয়ম অনুযায়ী বের হবে। অন্যথায় তালিবুল ইলমের মেযাজ তো হওয়া উচিত ফকীহুন নাফস হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রাহ. (৬-১১-১২৪৪ হি.- ৯-৬-১৩২৩ হি.)-এর তালিবে ইলমী মেযাজের মতো।
‘তাযকিরাতুর রশীদ’-এ আছেÑ ‘একদিন হযরত মাওলানা মামলূক আলী রাহ.-এর কাছে তার সবক চলছিল। এমন সময় নীল রঙ্গের একটি লুঙ্গি কাঁধে ঝুলিয়ে এক ব্যক্তি হাজির হলেন। তাকে দেখে মাওলানা মামলূক আলী রাহ. পুরো মজলিসসহ দাঁড়িয়ে গেলেন। আর বললেন, দেখো ভাই! হাজ¦ী সাহেব এসে গেছেন, হাজ¦ী সাহেব এসে গেছেন। এরপর তিনি আমাকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘ভাই রশীদ! এই সবক পরে হবে।’
সবক ছুটে যাওয়ায় আমার খুব আফসোস হল। আমি মওলবী মুহাম্মাদ কাসেম সাহেবকে বললাম, ‘ভাই, দেখো এক হাজ¦ী এলেন আর আমাদের সবক গেল!’
মওলবী কাসেম সাহেব বললেন, হায়, হায়! এভাবে বলো না। তিনি অনেক বড় বুযুর্গ মানুষ। তিনি এমন, তিনি এমন...’ (তাযকিরাতুর রশীদ ১/৬৮; আপবীতী ২/৫৯, তৃতীয় ফছল)
তরবিয়তের উদ্দেশ্যে তালিবুল ইলমদেরকে কোনো বুযুর্গের কাছে নিয়ে যাওয়া অথবা কোনো বুযুর্গকে মাদরাসায় আসার দরখাস্ত করা, এসব তো মুরব্বী এবং ব্যবস্থাপকদের কাজ। তালিবে ইলমের কাজ হল, আসাতিযায়ে কেরামের দেয়া নেযাম যত্নের সাথে পালন করতে থাকা। তাছাড়া তালিবে ইলমের জন্যে তো তার আসাতিযায়ে কেরামই বড় বুযুর্গ। তারা তাঁদের সোহবতকে গনীমত মনে করবে এবং তাঁদের কাছ থেকে ইলমের পাশাপাশি আদব ও আখলাক শেখার চেষ্টা করবে।
হযরত থানভী রাহ.-এর একথা সবসময় যেহেনে রাখা উচিত। তিনি বলেছেনÑ
جس کے سر پر کوئی بڑا ہو اس سے پوچھ کر سب باتیں کرنی چاہئیں، یہ تاکید لڑکوں کو رکھنی چاہئے۔ کمالات اشرفیہ ص : ২২৩
হযরত আরো বলেছেনÑ
جب تک تمہارے ضابطے کے بڑے موجود ہوں ان سے استصواب کرنے بغیر کبھی کوئی اہم کام نہ کرو۔
میرے والد میرے شیخ، حضرت مولانا محمد تقی عثمانی، بحوالۂ حضرت مولانا محمد شفیع، خلیفۂ مجاز حکیم الامت تھانوی ، ص : ৫৫
তালিবে ইলম ভাইদের কাছে দরখাস্ত, তারা যেন বান্দার নিবেদনগুলো একটু চিন্তা-ভাবনার সাথে পাঠ করেন। এরপর এরই আলোকে আমার প্রিয় শাগরেদ মাওলানা ত্বহা হুসাইন দানিশ এর ‘ইলমী নিমগ্নতা : সে যুগে এ যুগে’ শীর্ষক প্রবন্ধটি মুতালাআ করেন। প্রবন্ধটি আলকাউসার ১৪৩১ হিজরীর জুমাদাল আখিরাহ সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। পরে ‘তালিবানে ইলম : পথ ও পাথেয়’ ( পৃ. ৩২৬-৩২৯)-এর অংশ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে।
এর সাথে আলকাউসারের রবিউল আউয়াল ১৪৩৫ হি. মোতাবেক জানুয়ারি ২০১৪ ঈ. সংখ্যায় এ বিভাগেই প্রকাশিত আযীয তাওহীদুল ইসলামের লেখা ‘প্রতিকূল পরিস্থিতি : সময় তবু চলেই যাচ্ছে’ শীর্ষক প্রবন্ধটিও বার বার মুতালাআ করেন। উভয় প্রবন্ধেই ইতিহাসের মাত্র দু-চারটি ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ এজাতীয় ঘটনা ইলম ও উলামায়ে কেরামের জীবনেতিহাসে অগণিত। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সালাফের, পূর্বসূরিদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে জীবন চলার তাওফীক দান করুনÑ আমীন।
Ñবান্দাহ মুহাম্মাদ আবদুল মালেক
সফর ১৪৩৫ হি.
১. এক্ষেত্রেÑ
ألا كلكم راع وكلكم مسؤول عن رعيته
Ñহাদীসটি গুরুত্বপূর্ণ। তো সমাজের সর্বশ্রেণির মানুষ, এমনিভাবে তালিবানে ইলমও নিজ নিজ পরিমণ্ডলের মধ্যে থেকে এর উপর আমল করবে এবং অবশ্যই আমল করবে। তবে এক্ষেত্রে দুটি বিষয় অবশ্যই মনে রাখতে হবে, নিজের পরিমণ্ডল অতিক্রম না করা এবং নিয়মতান্ত্রিক বড়কে অমান্য না করা, যেমন থানবী রাহ. বলেছেন। Ñআদীব হুজুর
২. তালিবে ইলমের অভিভাবক যখন তালিবে ইলমকে মাদরাসায় ভর্তি করেন তখন আসলে অভিভাবকের সঙ্গে আহলে মাদরাসার একটি চুক্তি সম্পন্ন হয়, যার খোলাছা হল, দ্বীনী তা‘লীম ও দ্বীনী তারবিয়াতের যে متعارف কর্মকাণ্ড রয়েছে, সেগুলোর মধ্যেই আহলে মাদরাসা তালিবে ইলমকে ব্যবহার করবে। ‘মাদরাসার যে কোনো সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য থাকবো’-জাতীয় কথার কারণে متعارف গণ্ডির বাইরে যাওয়ার সুযোগ থাকবে না। সেজন্য দাখেলার সময় সুনির্দিষ্টভাবে সেটার উল্লেখ থাকতে হবে। তালিবে ইলমকে متعارف তা‘লীম ও তরবিয়তের বাইরে কোনো আন্দোলনে, বিশেষ করে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ব্যবহার করার অধিকার আহলে মাদারাসার নেই। তালিবে ইলম বালিগ ও প্রাপ্তবয়স্ক হলেও তার অভিভাবক, যিনি তার আর্থিক দায় বহন করছেন তার অনুমোদন ছাড়া কোনো কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারে না। শরীয়তের দৃষ্টিতেও সেটা বৈধ নয়। بـلوغ সুবিধা ভোগ করতে হলে, অভিভাবককে আর্থিক দায় থেকে মুক্ত করে দিতে হবে।
এখানে ‘সম্ভব হলে’ যোগাযোগ করার কথা বলা হয়েছে, তবে আমার বক্তব্য হল, সেটা সম্ভব না হলে তালিবে ইলমকে استصحاب حال -এর উপর আমল করতে হবে। (অর্থাৎ এই অবস্থায় মাদরাসা থেকে বের হবে না) Ñআদীব হুজুর