যিলহজ্ব ১৪৪২   ||   জুলাই ২০২১

যিলহজ্ব ও যিলহজ্বের প্রথম দশক
যে বার্তা দিয়ে যায় যিলহজ্বের চাঁদ

মুহাম্মাদ আশিক বিল্লাহ তানভীর

দেখতে দেখতে গত হতে চলেছে আরো একটি বছর। এখন হিজরী ১৪৪২ সনের যিলহজ্ব মাস। আগামী মাসের প্রথম তারিখ থেকেই ১৪৪৩ হিজরী। শুরু হয়ে যাবে আরেকটি বছর। পৃথিবীর ইতিহাসে আর ফিরে আসবে না ১৪৪২ হিজরী। আমার জীবনেও আর ফিরে পাব না এ দিনগুলো। একটি বছরের সমাপ্তি আর একটি বছরের সূচনাÑ এর মাঝে রয়েছে আমাদের জন্য চিন্তা ও উপলব্ধির এবং শিক্ষা ও উপদেশ গ্রহণের যথেষ্ট উপকরণ। আল্লাহ তাআলা বলেনÑ

تَبٰرَكَ الَّذِیْ جَعَلَ فِی السَّمَآءِ بُرُوْجًا وَّ جَعَلَ فِیْهَا سِرٰجًا وَّ قَمَرًا مُّنِیْرًا، وَ هُوَ الَّذِیْ جَعَلَ الَّیْلَ وَ النَّهَارَ خِلْفَةً لِّمَنْ اَرَادَ اَنْ یَّذَّكَّرَ اَوْ اَرَادَ شُكُوْرًا.

কত মহান সেই সত্তা, যিনি আসমানে বুরূজসৃষ্টি করেছেন এবং তাতে স্থাপন করেছেন উজ্জ্বল প্রদীপ এবং আলো বিস্তারকারী চাঁদ। এবং তিনিই সেই সত্তা, যিনি রাত ও দিনকে পরস্পরের অনুগামী করে সৃষ্টি করেছেনÑ (কিন্তু এসব বিষয় উপকারে আসে কেবল) সেই ব্যক্তির জন্য, যে উপদেশ গ্রহণের ইচ্ছা রাখে কিংবা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে চায়। Ñসূরা ফুরকান (২৫) : ৬১-৬২

একজন মুমিনের জীবন-দর্শনে রাতদিনের এ পরিক্রমা কখনোই হেলার বিষয় নয়; নয় স্বাভাবিক কোনো ঘটনাও। সময়ের এ আগমন-নির্গমন তার মাঝে আত্মোপলব্ধি জাগ্রত করে। সে বিগত দিনের হিসাব মেলায় এবং সামনের পাথেয় সঞ্চয় করে।

পৃথিবীতে সফল ব্যক্তি তো তাকেই বলা হয়, যে বিগত দিনের হিসাব কষে এবং এর আদলে ভবিষ্যতে পথচলার নীতি নির্ধারণ করে। একজন আদর্শ ব্যবসায়ী তো সে-, যে দিনশেষে হিসাব মেলায় এবং সে অনুযায়ী ভবিষ্যৎ কর্মনীতি নির্ধারণ করে। তেমনি একজন সচেতন মুমিন সে-, যে নিজের বিগত দিনের আমলের হিসাব নেয় এবং ভবিষ্যৎ জীবনের কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করে। সর্বপরি পরকালের চির সফলতা লাভের জন্য সে আরো গতিশীল হয় ঈমান ও আমলের মেহনতে। গুণীজন চমৎকার দৃষ্টান্তে ব্যক্ত করেছেন বিষয়টিÑ

ہو رہی ہے عمر مثل برف کم/ چپکے چپکے رفتہ رفتہ دم بدم.

ایک دن مرنا ہے آخر موت ہے/ کرلے جو کرنا ہے آخر موت ہے.

জীবনটা তোমার অনবরত, যাচ্ছে গলে বরফের মতো।

আখের তো মরতেই হবে, করবার যা এখনই করো।

কাজেই যিলহজ্ব মাসের চাঁদ আমাদেরকে বিগত বছরগুলোর হিসাব মেলাবার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। পৌঁছিয়ে দেয় আমাদের নিকট স্বচ্ছ ঈমান, নেক আমল, শুদ্ধ ফিকির ও উত্তম আখলাকের দীপ্তিতে জীবনকে উদ্ভাসিত করার বার্তা।

যিলহজ¦ মাস : গুরুত্ব ও মহিমা

বছরের সর্বশেষ মাস, একটি বছরের বিদায়, আরেকটি বছরের সূচনাÑ সবমিলিয়ে এমনিতেই মাহে যিলহজ্ব বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। তথাপি ইসলামী শরীয়ত এ মাসকে ঘিরে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিধান ও আমল নির্ধারিত করেছে, যাতে এর মহিমা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।

কুরআনে কারীমে এ মাসকে আল্লাহ তাআলা সম্মানিত মাস হিসাবে ঘোষণা করেছেন। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনÑ

إِنّ الزّمَانَ قَدِ اسْتَدَارَ كَهَيْئَتِهِ يَوْمَ خَلَقَ اللهُ السّمَوَاتِ وَالأَرْضَ، السّنَةُ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا، مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ، ثَلاَثٌ مُتَوَالِيَاتٌ: ذُو القَعْدَةِ، وَذُو الحِجّةِ، وَالمُحَرّمُ، وَرَجَبُ مُضَرَ الّذِي بَيْنَ جُمَادَى، وَشَعْبَانَ.

সময়ের হিসাব যথাস্থানে ফিরে এসেছে, আসমান-যমীনের সৃষ্টির সময় যেমন ছিল। (কারণ, জাহেলী যুগে আরবরা নিজেদের স্বার্থ ও মর্জিমত মাস-বছরের হিসাব কম-বেশি ও আগপিছ করে রেখেছিল।) বার মাসে এক বছর । এর মধ্য থেকে চারটি মাস সম্মানিত। তিনটি মাস ধারাবাহিকÑ যিলকদ, যিলহজ্ব ও মুহাররম। আরেকটি হল রজব, যা জুমাদাল আখিরাহ ও শাবানের মধ্যবর্তী মাস। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ৪৬৬২

আশারায়ে যিলহজ্ব বা যিলহজ্বের প্রথম দশক

এ মাসে রয়েছে আশারায়ে যিলহজ্বঅর্থাৎ যিলহজ্বের প্রথম দশক। পবিত্র কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা মহিমান্বিত দশ রজনীর শপথ করে বলেনÑ

وَ الْفَجْرِ،  وَ لَیَالٍ عَشْرٍ.

শপথ ফজরের, শপথ দশ রাত্রির। Ñসূরা ফাজ্র (৮৯) : ১-

এখানে দশ রাত্রিদ্বারা যিলহজ্বের প্রথম দশ রাত উদ্দেশ্য। এমনটিই বলেছেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা., হযরত ইবনে যুবাইর রা. ও মুজাহিদ রাহ.-সহ পূর্ববর্তী-পরবর্তী অনেক মুফাসসির। (তাফসীরে ইবনে কাসীর, সূরা ফাজ্র-এর তাফসীর দ্রষ্টব্য)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দশকের ব্যাপারে ইরশাদ করেনÑ

مَا مِنْ أَيّامٍ الْعَمَلُ الصّالِحُ فِيهَا أَحَبّ إِلَى اللهِ مِنْ هَذِهِ الْأَيّامِ يَعْنِي أَيّامَ الْعَشْرِ، قَالُوا: يَا رَسُولَ اللهِ، وَلَا الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللهِ؟ قَالَ: وَلَا الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللهِ، إِلّا رَجُلٌ خَرَجَ بِنَفْسِهِ وَمَالِهِ، فَلَمْ يَرْجِعْ مِنْ ذَلِكَ بِشَيْءٍ.

আল্লাহ্র নিকট যিলহজ্বের দশ দিনের নেক আমলের চেয়ে অধিক প্রিয় অন্য কোনো দিনের আমল নেই।

সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ্র রাস্তায় জিহাদও (এর চেয়ে উত্তম) নয় কি?

তিনি বললেন, না, আল্লাহ্র রাস্তায় জিহাদও নয়। তবে হাঁ, সেই ব্যক্তির জিহাদ এর চেয়ে উত্তম, যে নিজের জান-মাল নিয়ে আল্লাহ্র রাস্তায় জিহাদের জন্য বের হয়েছে। অতঃপর কোনো কিছু নিয়ে ঘরে ফিরে আসেনি (অর্থাৎ শাহাদাত বরণ করেছে)। Ñসুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৪৩৮; সহীহ বুখারী, হাদীস ৯৬৯; জামে তিরমিযী, হাদীস ৭৫৭; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৭২৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৯৬৮

যিলহজ্বের নবম তারিখ ইয়াওমে আরাফাবা আরাফার দিন

এ দশকে রয়েছে ইয়াওমে আরাফা। যিলহজ্বের নয় তারিখের এই দিনে হাজ্বী ছাহেবান আরাফার ময়দানে উকূফ (অবস্থান) করেন। পবিত্র হজ্ব পালনের একটি ফরয বিধান হচ্ছে উকূফে আরাফাতথা আরাফায় অবস্থান করা এবং হজ্বের মূল দিন হচ্ছে যিলহজে¦র নয় তারিখ ইয়াওমে আরাফা

এ দিনে বান্দার দিকে রবের রহমতের জোয়ার প্রবলবেগে ধাবিত হয়। অসংখ্য বান্দাকে তিনি এ দিনে ক্ষমা করে দেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে জান্নাতের ফয়সালা করে দেন। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনÑ

مَا مِنْ يَوْمٍ أَكْثَرَ مِنْ أَنْ يُعْتِقَ اللهُ فِيهِ عَبْدًا مِنَ النّارِ، مِنْ يَوْمِ عَرَفَةَ، وَإِنّهُ لَيَدْنُو، ثُمّ يُبَاهِي بِهِمِ الْمَلَائِكَةَ، فَيَقُولُ: مَا أَرَادَ هَؤُلَاءِ؟

আরাফার দিনের মতো আর কোনো দিন এত অধিক পরিমাণে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হয় না। আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার নিকটবতীর্ হন এবং বান্দাদের নিয়ে ফিরিশতাদের নিকট গর্ব করেন। আল্লাহ বলেন, কী চায় তারা? Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ১৩৪৮

অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের ক্ষমা করার জন্য এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য ফিরিশতাদেরকে এভাবে বলতে থাকেন।

হযরত জাবের রা. থেকে বর্ণিত আরেক বর্ণনায় এসেছেÑ

يَنْزِلُ اللهُ إِلَى السّمَاءِ الدّنْيَا فَيُبَاهِي بِأَهْلِ الْأَرْضِ أَهْلَ السّمَاءِ، فَيَقُولُ: انْظُرُوا إِلَى عبادي شعثا غبرا ضاحين، جاؤوا مِنْ كُلِّ فَجٍّ عَمِيقٍ يَرْجُونَ رَحْمَتِي، وَلَمْ يَرَوْا عَذَابِي، فَلَمْ يُرَ يَوْمٌ أَكْثَرُ عِتْقًا من النار من يوم عرفة.

আল্লাহ তাআলা নিকটতম আসমানে আসেন এবং পৃথিবীবাসীকে নিয়ে আসামানের অধিবাসী অর্থাৎ ফিরিশতাদের সাথে গর্ব করেন। বলেন, দেখ তোমরাÑ আমার বান্দারা উস্কোখুস্কো চুলে, ধুলোয় মলিন বদনে, রোদে পুড়ে দূর-দূরান্ত থেকে এখানে সমবেত হয়েছে। তারা আমার রহমতের প্রত্যাশী। অথচ তারা আমার আযাব দেখেনি। ফলে আরাফার দিনের মতো আর কোনো দিন এত অধিক পরিমাণে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হয় না। Ñসহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৩৮৫৩

এ দিনে আল্লাহ তাআলা নাযিল করেছেন কুরআনে কারীমের সর্বশেষ আয়াতÑ

اَلْیَوْمَ اَكْمَلْتُ لَكُمْ دِیْنَكُمْ وَ اَتْمَمْتُ عَلَیْكُمْ نِعْمَتِیْ وَ رَضِیْتُ لَكُمُ الْاِسْلَامَ دِیْنًا.

আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার নিআমত পরিপূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম। Ñসূরা মায়েদা (৫) : ৩

হাদীসের কিতাবে হযরত উমর রা.-এর সুন্দর একটি ঘটনা বিবৃত হয়েছেÑ একবার এক ইহুদী হযরত উমর রা.-এর নিকট এসে বলল, আমীরুল মুমিনীন! আপনারা আপনাদের কিতাব থেকে একটি আয়াত তিলাওয়াত করে থাকেন। এমন কোনো আয়াত যদি আমাদের ইহুদীদের প্রতি নাযিল হত তাহলে আমরা আয়াত নাযিলের সেই দিনটিকে ঈদ হিসাবে গ্রহণ করতাম।

হযরত উমর রা. জিজ্ঞাসা করলেন, কোন্ সে আয়াত?

বলল, আয়াতটি হচ্ছেÑ

اَلْیَوْمَ اَكْمَلْتُ لَكُمْ دِیْنَكُمْ وَ اَتْمَمْتُ عَلَیْكُمْ نِعْمَتِیْ وَ رَضِیْتُ لَكُمُ الْاِسْلَامَ دِیْنًا.

আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার নিআমত পরিপূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম। Ñসূরা মায়েদা (৫) : ৩

হযরত উমর রা. একথা শুনে বললেনÑ আল্লাহ্র কসম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর কোন্ দিন কোন্ সময় কোন্ স্থানে এ আয়াত নাযিল হয়েছেÑ তা আমি জানি।  জুমার দিন সন্ধ্যায় এ আয়াত নাযিল  হয়েছে। নবীজী তখন আরাফায় অবস্থান করছিলেন। (দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৫, ৪৪০৭, ৪৬০৬, ৭২৬৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩০১৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৮৮, ২৭২)

তো আল্লাহ তাআলা এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি আয়াত এ দিনে নাযিল করেছেন।

এ দিনের ব্যাপারে যেভাবে মাগফিরাতের ঘোষণা এসেছে তেমনি হাদীসে এ দিনের রোযার ব্যাপারেও এসেছে বিশেষ ফযীলতের কথা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনÑ

صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ، أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السّنَةَ الّتِي قَبْلَهُ، وَالسّنَةَ الّتِي بَعْدَهُ.

আরাফার দিনের (নয় যিলহজ্বের) রোযার বিষয়ে আমি আল্লাহ্র কাছে প্রত্যাশা রাখি যে, তিনি পূর্বের এক বছরের এবং পরের এক বছরের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬২

হাদীসে এ দিনের দুআকেও শ্রেষ্ঠ দুআ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। নবীজী বলেনÑ

خَيْرُ الدّعَاءِ دُعَاءُ يَوْمِ عَرَفَةَ، وَخَيْرُ مَا قُلْتُ أَنَا وَالنّبِيّونَ مِنْ قَبْلِي: لَا إِلَهَ إِلّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، لَهُ المُلْكُ وَلَهُ الحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ.

শ্রেষ্ঠ দুআ (ও যিকির) হচ্ছে আরাফার দুআ। এ দিনের দুআ-যিকির হিসেবে সর্বোত্তম হল ঐ দুআ, যা আমি এবং আমার পূর্ববতীর্ নবীগণ করেছেন। তা হলÑ

لَا إِلَهَ إِلّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، لَهُ المُلْكُ وَلَهُ الحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ.

Ñজামে তিরমিযী, হাদীস ৩৫৮৫; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৩৭৭৮

হজ্ব ও কুরবানী : ইসলামের মহিমান্বিত দুটি ইবাদত

ইসলামের পরিচয়-চিহ্ন বহনকারী মহিমান্বিত দুটি ইবাদতÑ হজ্ব ও কুরবানী সংঘটিত হয় এ মাসে। পবিত্র কুরআন মাজীদে হজ্ব ও কুরবানীকে শাআইরুল্লাহ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। সূরা হজ্বে কুরবানীর বিষয়ে আল্লাহ তাআলা বলেনÑ

وَ الْبُدْنَ جَعَلْنٰهَا لَكُمْ مِّنْ شَعَآىِٕرِ اللهِ لَكُمْ فِیْهَا خَیْرٌ  فَاذْكُرُوا اسْمَ اللهِ عَلَیْهَا صَوَآفَّ،  فَاِذَا وَجَبَتْ جُنُوْبُهَا فَكُلُوْا مِنْهَا وَ اَطْعِمُوا الْقَانِعَ وَ الْمُعْتَرَّ،  كَذٰلِكَ سَخَّرْنٰهَا لَكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ.

কুরবানীর উট (ও গরু) তোমাদের জন্য আল্লাহ্র শাআইর’ (নিদর্শনাবলি)-এর অন্তভুর্ক্ত করেছি। তোমাদের জন্য তাতে রয়েছে কল্যাণ। সুতরাং যখন তা সারিবদ্ধ অবস্থায় দাঁড়ানো থাকে, তোমরা তার উপর আল্লাহ্র নাম নাও। তারপর যখন (যবেহ হয়ে যাওয়ার পর) তা কাত হয়ে মাটিতে পড়ে যায়, তখন তার গোশত নিজেরাও খাও এবং ধৈর্যশীল অভাবগ্রস্তকেও খাওয়াও; এবং তাকেও, যে নিজ অভাব প্রকাশ করে। এভাবেই আমি এসব পশুকে তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছি, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। Ñসূরা হজ্ব (২২) : ৩৬

একই সূরায় আল্লাহ তাআলা হজ্বের আলোচনার পর শাআইরুল্লাহ্র প্রসঙ্গটি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেনÑ

ذٰلِكَ وَ مَنْ یُّعَظِّمْ شَعَآىِٕرَ اللهِ فَاِنَّهَا مِنْ تَقْوَی الْقُلُوْبِ.

এসব বিষয় স্মরণ রেখ। আর যে কেউ আল্লাহ্র শাআইরতথা নিদর্শনাবলিকে সম্মান করবে তা তো তার হৃদয়ের তাকওয়া থেকেই (উদ্ভূত)। Ñসূরা হজ্ব (২২) : ৩২

এ মাসের যে দিনটি বিশেষ তাৎপর্য ধারণ করে তা হচ্ছে যিলহজ্বের দশম তারিখ। হাদীসের ভাষায় ইয়াওমুন নাহ্র। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দিনের ব্যাপারে বলেনÑ

إِنّ أَعْظَمَ الْأَيّامِ عِنْدَ اللهِ تَبَارَكَ وَتَعَالَى يَوْمُ النّحْرِ، ثُمَّ يَوْمُ الْقَرِّ.

আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তাআলার নিকট সবচে মহিমান্বিত দিন হচ্ছে ইয়াওমুন নাহ্রতথা কুরবানীর দিন। এরপর হচ্ছে ইয়াওমুল ক্বারঅর্থাৎ এর পরের দিন। Ñসুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৭৬৫

আল্লাহ তাআলা এ দিনকে মুসলমানের জন্য ঈদ সাব্যস্ত করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনÑ

أُمِرْتُ بِيَوْمِ الْأَضْحَى، جَعَلَهُ اللهُ عِيدًا لِهَذِهِ الْأُمّةِ.

আমাকে ইয়াওমুল আযহার আদেশ করা হয়েছে (অর্থাৎ, এ দিনে কুরবানী করার আদেশ করা হয়েছে); এ দিবসকে আল্লাহ তাআলা এ উম্মতের জন্য ঈদ বানিয়েছেন। Ñমুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৬৫৭৫; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৫৯১৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৮৯; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৪৩৬৫

অতএব সম্মান, মর্যাদা, আশারায়ে যিলহজ্ব, হজ্ব, কুরবানী, ইয়াওমে আরাফা, আইয়ামে তাশরীক প্রভৃতি সমূহ কল্যাণে বেষ্টিত একটি মাস যিলহজ্ব মাস। কাজেই এ মাসের খায়ের ও বরকত হাছিল করার ব্যাপারে মুমিন বেখবর থাকতে পারে না। আমলে আমলে, নেকী ও কল্যাণের মাধ্যমে এ মাসের বরকতময় মুহূর্তগুলো প্রাণবন্ত রাখার মাঝেই সে সফলতা খঁুজে নেয়।

যিলহজ্ব মাস : কিছু আমল, কিছু করণীয়

সম্মানিত এ মাসটিকে আমরা কীভাবে ফলপ্রসূ করতে পারিÑ এ ব্যাপারে সংক্ষেপে কিছু আমলের কথা তুলে ধরা হচ্ছে।

এক. যেহেতু যিলহজ্ব মাস আরবী বার মাসের সর্বশেষ এবং এর পরেই সর্বপ্রথম মাস মুহাররম তাই যিলহজ্ব মানে একটি বছরের সমাপ্তি এবং একটি বছরের সূচনার বার্তা। অতএব বিগত দিনের মুহাসাবা এবং আগত দিনের প্রস্তুতি গ্রহণ করাই প্রকৃত বুদ্ধিমানের কাজ।

দুই. যিলহজ্ব মানে একটি হিজরী বর্ষের সমাপ্তি এবং আরেকটি বর্ষের সূচনা তাই এর দিন-তারিখের হিসাব-নিকাশ সংরক্ষণ করা মুসলমানদের দ্বীনী যিম্মাদারী। সাধারণত এখন ব্যাপকভাবে হিজরী সন তারিখের ব্যাপারে শৈথিল্য পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা আদৌ কাম্য নয়। মুসলমান তার দ্বীনী প্রয়োজনের তাগিদেই হিজরী তারিখের হিসাব রাখবে।

তিন. যিলহজ্ব মাস একটি সম্মানিত মাস। সম্মানিত মাসের সম্মান রক্ষা করা ঈমানী দায়িত্বের অংশ। মহিমান্বিত সময়গুলোতে যেভাবে নেক আমল বান্দাকে বহু অগ্রসর করে দেয় তেমনি এ সময়কার নাফরমানীও আল্লাহ্র রহমত থেকে বহু দূরে ঠেলে দিতে পারে। তাই কমপক্ষে মন্দ থেকে বেঁচে থাকতে আপ্রাণ চেষ্টা করি এ দিনগুলোতে। মনে রাখি কবি ফরীদুদ্দীন আত্তারের এ পঙ্ক্তিটিÑ

قوت نیکی نہ داری بد مکن/ بر وجود خود ستم بے حد مکن.

ভালো করতে পারো, না পারো; কিন্তু মন্দ করতে যেও না। নিজের উপর অন্তত অবিচার করে বসো না।

অতএব ফরয-ওয়াজিব আমলের সাথেসাথে যথাসম্ভব নফলের প্রতি মনোযোগী হব। পাশাপাশি সর্বপ্রকার নাফরমানী এবং গুনাহের কাজ থেকে পুরোপুরি বেঁচে থাকতে আপ্রাণ চেষ্টা করব।

 

চার. যিলহজ্ব মাসের দিনগুলো এমনিতেই বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। তবুও এর প্রথম দশকের ব্যাপারে হাদীসে বিশেষভাবে ফযীলতের কথা এসেছে। প্রবন্ধের প্রথম অংশে আমরা পড়ে এসেছি নবীজীর হাদীসÑ

مَا مِنْ أَيّامٍ الْعَمَلُ الصّالِحُ فِيهَا أَحَبّ إِلَى اللهِ مِنْ هَذِهِ الْأَيّامِ يَعْنِي أَيّامَ الْعَشْرِ، قَالُوا: يَا رَسُولَ اللهِ، وَلَا الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللهِ؟ قَالَ: وَلَا الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللهِ، إِلّا رَجُلٌ خَرَجَ بِنَفْسِهِ وَمَالِهِ، فَلَمْ يَرْجِعْ مِنْ ذَلِكَ بِشَيْءٍ.

আল্লাহ্র নিকট যিলহজ্বের দশ দিনের নেক আমলের চেয়ে অধিক প্রিয় অন্য কোনো দিনের আমল নেই।

সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ্র রাস্তায় জিহাদও (এর চেয়ে উত্তম) নয় কি?

তিনি বললেন, না, আল্লাহ্র রাস্তায় জিহাদও নয়। তবে হাঁ, সেই ব্যক্তির জিহাদ এর চেয়ে উত্তম, যে নিজের জান-মাল নিয়ে আল্লাহ্র রাস্তায় জিহাদের জন্য বের হয়েছে। অতঃপর কোনো কিছু নিয়ে ঘরে ফিরে আসেনি (অর্থাৎ শাহাদাত বরণ করেছে)। Ñসুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৪৩৮; সহীহ বুখারী, হাদীস ৯৬৯; জামে তিরমিযী, হাদীস ৭৫৭; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৭২৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৯৬৮

হাদীসে আরো এসেছেÑ

مَا مِنْ أَيّامٍ أَعْظَمُ عِنْدَ اللهِ وَلَا أَحَبّ إِلَيْهِ الْعَمَلُ فِيهِنّ مِنْ هَذِهِ الْأَيّامِ الْعَشْرِ، فَأَكْثِرُوا فِيهِنّ مِنَ التّهْلِيلِ وَالتّكْبِيرِ وَالتّحْمِيدِ.

আল্লাহ তাআলার নিকট আশারায়ে যিলহজ্বের আমলের চেয়ে অধিক মহৎ এবং অধিক প্রিয় অন্য কোনো দিনের আমল নেই। সুতরাং তোমরা এই দিনগুলোতে বেশি বেশি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার এবং আলহামদু লিল্লাহপাঠ কর। Ñমুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৫৪৪৬; আদদাআওয়াতুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ৫৩৪

এ মাসে এ যিকিরগুলো বেশি বেশি করি। পাশাপাশি অন্যান্য যিকির, তিলাওয়াতে কুরআনে কারীম, নফল ইবাদত, দুআ-রোনাযারি, তওবা-ইস্তিগফার, দান-সদকা প্রভৃতি আমলের মাধ্যমে আমার জীবনের মূল্যবান সময়গুলোর সদ্ব্যবহার করি।

পাঁচ. এ দিনগুলোতে মনোযোগী হই রোযার প্রতি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যিলহজ্বের প্রথম নয় দিন রোযা রাখার ব্যাপারে যত্নবান ছিলেন। বর্ণিত হয়েছেÑ

كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يَصُومُ تِسْعَ ذِي الْحِجّةِ.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম যিলহজ্বের নয়টি দিবসে (সাধারণত) রোযা রাখতেন। Ñসুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৪৩৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২৩৩৪; সুনানে কুবরা, বায়হাকী, হাদীস ৮৩৯৩

উম্মুল মুমিনীন হযরত হাফসা রা. থেকে বর্ণিত আরেক বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেনÑ

أَرْبَعٌ لَمْ يَكُنْ يَدَعُهُنّ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: صِيَامَ عَاشُورَاءَ، وَالْعَشْرَ، وَثَلَاثَةَ أَيّامٍ مِنْ كُلِّ شَهْرٍ، وَرَكْعَتَيْنِ قَبْلَ الْغَدَاةِ.

চারটি আমল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো ছাড়তেন না। আশুরার রোযা, যিলহজ্বের প্রথম দশকের রোযা, প্রত্যেক মাসের তিন দিনের রোযা, ফজরের আগে দুই রাকাত সুন্নত নামায। Ñসুনানে নাসায়ী, হাদীস ২৪১৫; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৬৪২২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৬৩৩৯

ছয়. বিশেষকরে নয় তারিখ ইয়াওমে আরাফাকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে আমলে নেওয়া চাই। এদিন অতিবাহিত করি দুআ-দরূদ, কান্নাকাটি এবং তাওবা-ইস্তিগফারে। ইহতিমাম করি এ দিনে রোযা রাখার প্রতি। স্মরণ রাখি নবীজীর হাদীসÑ

صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ، أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السّنَةَ الّتِي قَبْلَهُ، وَالسّنَةَ الّتِي بَعْدَهُ.

আরাফার দিনের (নয় যিলহজ্বের) রোযার বিষয়ে আমি আল্লাহ্র কাছে প্রত্যাশা রাখি যে, তিনি পূর্বের এক বছরের এবং পরের এক বছরের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬২

নবীজীর এ হাদীসের উপর বিশ্বাস রেখে আমার আমল যেন এমন হয়, এ দিনের সূর্য ডোবার সাথে সাথে আমার আমলনামা থেকে গুনাহের কালিমাগুলোও মিটে গেল! আয় আল্লাহ! তুমি আমাদের সেই তাওফীক নসীব কর।

সাত. এছাড়া এ দশকের একটি বিশেষ আমল হলÑ যিলহজে¦র চাঁদ ওঠা থেকে নিয়ে কুরবানী করা পর্যন্ত নখ-চুল না কাটা, না ছাটা। এতে একদিকে হাজ¦ী ছাহেবানের সাথে একরকম সাদৃশ্য প্রকাশ পায়। পাশাপাশি এর রয়েছে বিশেষ ফযীলতও। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম ইরশাদ করেনÑ

إِذَا رَأَيْتُمْ هِلَالَ ذِي الْحِجّةِ، وَأَرَادَ أَحَدُكُمْ أَنْ يُضَحِّيَ، فَلْيُمْسِكْ عَنْ شَعْرِهِ وَأَظْفَارهِ.

যখন যিলহজ্বের চাঁদ দেখবে তখন তোমাদের মধ্যে যে কুরবানী করবে সে যেন তার চুল নখ না কাটে। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৭৭; জামে তিরমিযী, হাদীস ১৫২৩

অতএব যিলহজ¦ আগমনের পূর্বেই নখ-চুল কেটে ছেটে পরিপাটি হয়ে থাকা বাঞ্ছনীয়। যারা কুরবানী করবেন তারা তো এ মুস্তাহাবের প্রতি যত্নবান হবেনই। আর অন্যান্য বর্ণনার নিরিখে এ-ও বুঝে আসেÑ যারা কুরবানী করবেন না, তারাও ফযীলতপূর্ণ এ আমলে শরীক হতে পারেন। এমনকি বাচ্চাদেরকেও অভিভাবকগণ চুল-নখ কাটা থেকে বিরত রাখতে পারেন। এতে ইনশাআল্লাহ সাওয়াব হাছিল হবে। (দ্রষ্টব্য: সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৮৯; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৪৩৬৫; মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস ৭৫২০; আলমুহাল্লা, ইবনে হাযম ৬/২৮)

আট. দ্বীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরয বিধান হচ্ছে হজ্ব। এটি ইসলামের মৌলিক পাঁচ স্তম্ভের একটি। হজ্বের মূল কার্যক্রম সম্পাদিত হয় যিলহজ্ব মাসে। হজ্ব কেবলই একটি ইবাদত নয়; একে ঘিরে চর্চিত হয় বহু ধরনের নেক আমল। পাশাপাশি এর আধ্যাত্মিক উপকারিতারও তুলনা হয় না। বান্দা তাঁর রবের ঘরে হাজিরী দিয়ে যে উৎকর্ষ লাভ করেÑ ভাষা তা প্রকাশ করতে অক্ষম। বস্তুত নানাবিধ শিক্ষা, তত্ত্ব ও তাৎপর্য ধারণকারী একটি ইবাদতের নাম হজ্ব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনÑ

مَنْ حَجّ لِلهِ فَلَمْ يَرْفُثْ وَلَمْ يَفْسُقْ رَجَعَ كَيَوْمِ وَلَدَتْهُ أُمّهُ.

যে ব্যক্তি একমাত্র অল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য হজ্ব করে এবং কোনো অশ্লীল কাজ বা গুনাহে লিপ্ত হয় না, সে যেন সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুর ন্যায় নিষ্পাপ হয়ে বাড়ি ফেরে। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ১৫২১

নবীজী আরো বলেনÑ

الحَجّ الْمَبْرُورُ لَيْسَ لَهُ جَزَاءٌ إِلّا الجَنّةُ.

মাবরূর (কবুলকৃত) হজ্বের প্রতিদান তো কেবল জান্নাতই। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ১৭৭৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৩৪৯

কাজেই হজ্ব ফরয হয়ে গেলে তা আদায়ে কোনো মুমিন গড়িমসি করতে পারে না। মুমিন তো কেবল এই প্রতীক্ষায় থাকেÑ কবে লাব্বাইকবলে হাজিরা দেবে!

নয়. যিলহজ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হচ্ছে কুরবানী করা। যিলহজে¦র দশ এগার বারÑ এই তিন তারিখ কুরবানীর দিন। উত্তম হল, দশ তারিখেই কুরবানী করা। অতএব যে ব্যক্তি এ তিন দিনে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে তার জন্য কুরবানী করা ওয়াজিব।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি বছর কুরবানী করতেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেনÑ

أَقَامَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ بِالمَدِينَةِ عَشْرَ سِنِينَ يُضَحِّي كُلّ سَنَةٍ.

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনার দশ বছরের প্রতি বছরই কুরবানী করেছেন। Ñজামে তিরমিযী, হাদীস ১৫০৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৪৯৫

দশ. যিলহজ¦ মাসের নয় তারিখ ইয়াওমে আরাফাহ-এর ফজর থেকে নিয়ে তের যিলহজ¦ আসর পর্যন্ত (মোট ২৩ ওয়াক্ত) প্রত্যেক ফরয নামাযের পর নারী-পুরুষ সকলের জন্য একবার তাকবীরে তাশরীক বলা ওয়াজিব। ফরযের পর পর বলতে ভুলে গেলে যখন মনে হবে তখন পড়ে নেবে। তাকবীরে তাশরীক হলÑ

اللهُ أَكْبَرُ، اللهُ أَكْبَرُ، لَا إِلهَ إِلّا اللهُ، وَاللهُ أَكْبَرُ، اللهُ أَكْبَرُ، وَلِلهِ الْحَمْدُ.

সর্বমোট পাঁচ দিন তাকবীরে তাশরীক বলা হলেও পরিভাষায় সাধারণত এগার বার ও তের যিলহজ¦কে আইয়ামে তাশরীক বলা হয়। (দ্রষ্টব্য: মাউসুআ ফিকহিয়্যা কুয়েতিয়্যা ৭/৩২৫)

কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা বলেনÑ

وَ اذْكُرُوا اللهَ فِیْۤ اَیَّامٍ مَّعْدُوْدٰتٍ.

তোমরা নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহকে স্মরণ কর। Ñসূরা বাকারা (২) : ২০৩

ইবনে আব্বাস রা. বলেন, এখানে اَیَّامٍ مَّعْدُوْدٰتٍ দ্বারা উদ্দেশ্যÑ আইয়ামে তাশরীক। (দ্র. সহীহ বুখারী, বাবু ফাদলিল আমাল ফী আইয়ামিত তাশরীক)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনÑ

أَيّامُ التّشْرِيقِ أَيّامُ أَكْلٍ، وَشُرْبٍ، وَذِكْرِ اللهِ.

আইয়ামে তাশরীক হল পানাহার ও আল্লাহ্র যিকিরের জন্য। Ñমুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২০৭২২; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৪১

তো দেখা যাচ্ছে, এ দিনগুলো যিকির ও তাকবীরের ধ্বনি উচ্চকিত করার দিন। সাহাবায়ে কেরাম এই দিনগুলোতে তাকবীরÑআল্লাহু আকবারের ধ্বনি তুলতেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. ও হযরত আবু হুরাইরা রা. বাজারে গিয়ে তাকবীরের আওয়াজ তুলতেন। শুনে শুনে লোকেরাও তাদের সাথে তাকবীর বলত। Ñসহীহ বুখারী, বাবু ফাদলিল আমাল ফী আইয়ামিত তাশরীক; ফাতহুল বারী ২/৪৫৭

অতএব আমরা এ দিনগুলোতে যিকির ও তাকবীর পাঠের খুব ইহতিমাম করব।

এগার. হাদীসে বলা হয়েছে, এ দিনটি হল পানাহারের দিন (সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৪১)। ইমাম মুসলিম রাহ. এ হাদীসটি উল্লেখ করেন আইয়ামে তাশরীকে রোযা রাখা হারামঅধ্যায়ে। এ হিসাবে যিলহজে¦র দশ তারিখ থেকে তের তারিখ পর্যন্ত রোযা রাখা হারাম করা হয়েছে।

কুরবানী হবে একমাত্র আল্লাহ্র জন্য। তবে আল্লাহ তাআলা নিজ অনুগ্রহে বান্দার জন্য কুরবানীর পশুর গোশত খাওয়া হালাল করে দিয়েছেন; একে নির্ধারণ করেছেন বান্দার আপ্যায়ন হিসাবে। তাই আইয়ামে তাশরীকের রোযা রাখার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে; এ যেন সেই মেহমানদারী কবুল করার অপূর্ব সুযোগ! আব্দ ও মাবুদের পারস্পরিক প্রেম ও ভালবাসা এবং মুমিন-অন্তরের গভীরে ঈমানী অনুভূতিই কেবল অনুভব করতে পারে সেই আপ্যায়নের স্বর্গীয় স্বাদ!

শেষ কথা

যিলহজ্ব এসেছে। যিলহজ্ব চলে যাবে। বুদ্ধিমান সে, যে এ সুযোগকে তোহফা হিসাবে গ্রহণ করবে। আল্লাহ তাআলার নেক বান্দাগণ এমনসব মুহূর্তগুলো গনীমত মনে করতেন। তারা নিজেরাও আমলে মনোযোগী হতেন এবং সন্তান-সন্ততিসহ অধীনস্ত সবাইকে আমলে উৎসাহী করতেন।

হযরত সাঈদ ইবনে জুবাইর রাহ. যিলহজ্বের এ দিনগুলোতে ইবাদত বাড়িয়ে দিতেন। তিনি বলতেন, এ রাতগুলোতে তোমরা ঘরের বাতি বন্ধ করো না। অর্থাৎ রাত্রি জাগরণ করে আমলে লিপ্ত থাক। তিনি আরো বলতেন, তোমরা ঘরের খাদেমদেরও আরাফার দিনের রোযার জন্য সাহরী খেতে তুলে দাও। (দ্রষ্টব্য : হিলইয়াতুল আউলিয়া ৪/২৮১; তাহযীবুল আছার, তবারী, বর্ণনা ৬০৮)

তো আমরা নিজেরাও আমলের প্রতি মনোযোগ দেব এবং আমাদের সন্তান-সন্ততিদেরও আমলে অভ্যস্ত করব। তাদেরকে ছোট থেকেই আমলের তরবিয়তে গড়ে তুলব। উপহার দেব তাদেরকে আমলের এক নূরানী পরিবেশ। সাধারণত রমযান মাসে অনেকের মাঝে আমলের বেশ উদ্যম থাকে। নিঃসন্দেহে এটা প্রশংসার বিষয়। তবে রমযান ছাড়াও যে আরো কত কত বরকতময় আমলের মওসুম রয়েছে, সেগুলোর প্রতিও খেয়াল করা উচিত। কুরআন-হাদীসে যেসকল মুহূর্তকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে সেগুলোর প্রতি আগ্রহী হওয়া মুমিনের ঈমানের দাবি। সচেতন মুমিন এ মুহূর্তগুলোকে উৎকৃষ্ট উপলক্ষ হিসাবেই গ্রহণ করে।

অতএব বিশেষ বিশেষ মওসুমগুলোতে যদি এভাবে খায়ের ও নেকের পথে অগ্রসর হওয়া যায় এবং গুনাহ ও নাফরমানি থেকে বিরত থাকা যায় তাহলে ধীরে ধীরে আমার মাঝে গোটা বছর, এমনকি গোটা যিন্দেগী ঈমান-আমল নিয়ে বেঁচে থাকা এবং গুনাহমুক্ত জীবন যাপন করা সহজ হবে ইনশাআল্লাহ। 

এভাবে আমলে আমলে বছরের শেষ মাসটিকে সজীব রাখার মাধ্যমে হতে পারে আমার জীবনের একটি বছরের সুন্দর সমাপ্তি! আল্লাহ তাআলা সেই তাওফীক দান করুনÑ আমীন।

 

 

advertisement