যেগুলো ইসলামী গবেষণার সঠিক ফর্মুলা নয়
কুরআন-হাদীস শাশ্বত। কিয়ামত পর্যন্ত এর বিধি-বিধান বহাল থাকবে। কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের সামনে যত দ্বীনী প্রয়োজন আসবে, যত দ্বীনী সমস্যা দেখা দেবে, সব ব্যাপারে কুরআন-হাদীসে দিকনির্দেশনা পাওয়া যাবে। কুরআন-হাদীসে কোনো কিছু ছেড়ে দেয়া হয়নি; সবকিছুই বলা হয়েছে। আল্লাহ্ তাআলা ইরশাদ করেছেনÑ
مَا فَرَّطْنَا فِی الْكِتٰبِ مِنْ شَیْءٍ ٍ.
এই কিতাবে আমি কোনো কিছু ছেড়ে দিইনি। Ñসূরা আনআম (৬) : ৩৮
আরেক আয়াতে ইরশাদ হয়েছেÑ
وَ نَزَّلْنَا عَلَیْكَ الْكِتٰبَ تِبْیَانًا لِّكُلِّ شَیْءٍ.
আর আমি আপনার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছি, যা প্রত্যেক (জরুরি) বিষয়ের স্পষ্ট বর্ণনাকারী। Ñসূরা নাহল (১৬) : ৮৯
কিতাবে তথা কুরআনে সবকিছু বলে দেয়া হয়েছেÑ এর অর্থ এই নয় যে, সবকিছু বিশদভাবে বলে দেয়া হয়েছে; বরং অনেক বিষয় তো বিশদভাবেই বলে দেয়া হয়েছে, আবার অনেক বিষয়ের মূলনীতি বলে দেয়া হয়েছে। স্বতন্ত্রভাবে সেগুলো বলা না হলেও বর্ণিত মূলনীতির মধ্যে সেগুলো এসে গিয়েছে। আবার অনেক বিষয় ইশারা-ইঙ্গিতে বলে দেয়া হয়েছে। মুজতাহিদ ও গবেষকগণ সেই মূলনীতি ও ইশারা-ইঙ্গিত থেকে নতুন সৃষ্ট বিষয়াদির ব্যাপারে সমাধান বের করে নেবেন। কিংবা যেসব বিষয়ে ভাষ্য নেই, সেগুলোর সমাধান তার অনুরূপ যেসব বিষয়ে ভাষ্য আছে, সেগুলোর ওপর কিয়াস করে বের করে নেবেন।
মুজতাহিদ ও গবেষকগণ উসূল ও ইশারা-ইঙ্গিত থেকে কীভাবে নতুন সৃষ্ট বিষয়াদির হুকুম বের করবেন, যেসব বিষয়ে ভাষ্য নেই সেগুলোকে ভাষ্য আছেÑ এমন বিষয়ের উপর কীভাবে কিয়াস করবেন, তথা কীভাবে ইজতিহাদ-গবেষণা করবেন তার বিধিবদ্ধ ফর্মুলা বা সূত্র রয়েছে। উসূলে ফিক্হের কিতাবপত্রে সেগুলো সবিস্তারে বর্ণিত রয়েছে। এই সূত্রগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ
১. عَامٌّ وخَاصّ ২. مُطْلَقٌ ومُقَيَّدٌ ৩. مُشْتَرَكٌ ومُؤَوَّلٌ ৪. حَقِيقَةٌ ومَجَازٌ ৫. صَرِيْحٌ وكِنايَةٌ ৬. عِبارَةُ النّصِّ ৭. إشَارَةُ النّصِّ ৮. اقْتِضَاءُ النّصِّ ৯. دَلاَلَةُ النّصِّ ১০. ظَاهِرٌ ১১. نَصٌّ ১২. مُفَسّرٌ ১৩. مُحْكَمٌ ১৪. خَفِيّ ১৫. مُشْكِلٌ ১৬. مُجْمَلٌ ১৭. مُتَشابِهٌ
-ইত্যাদি। এগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট নিয়মাবলি অনুসারে ইস্তিমবাত-ইস্তিদলাল করতে হয়। এসব সূত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবা ও তাবিয়ীন-এর ইজতিহাদ-গবেষণার তরীকা দেখেই বের করা হয়েছে। কিছু ফর্মুলা এমন রয়েছে, যা স্বতঃসিদ্ধ ও আপনা-আপনি স্পষ্ট (بديهى /Self Evident), যার কোনো দলীলের প্রয়োজন পড়ে না।
উসূলে ফিক্হের কিতাবপত্রে বর্ণিত ইজতিহাদ-গবেষণার এই ফর্মুলাগুলো উম্মতকর্তৃক স্বীকৃত ও অনুসৃত। এর বাইরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নজন কর্তৃক যেসব মনগড়া ফর্মুলা বের হয়েছে, সেগুলো না উম্মত কর্তৃক স্বীকৃত আর না অনুসৃত। সেগুলো বাতিল ও প্রত্যাখ্যানযোগ্য। সেসব ফর্মুলা স্বীকৃতি দিলে কুরআন-হাদীস থেকে অনাকাক্সিক্ষত ও অগ্রহণযোগ্য বিষয়াদি প্রমাণ করার পথ খুলে যাবে। যেমন সামনের আলোচনায় আমরা দেখব ইনশাআল্লাহ্।
বিভিন্ন সময়ে ইসলামী ইজতিহাদ-গবেষণার ক্ষেত্রে মনগড়া বিভিন্ন বাতিল ফর্মুলা অনুসরণ করে কিছু লোককে অদ্ভুত ধরনের সব প্রমাণাদি দাঁড় করাতে দেখা যায়। এরকম কয়েকটা বাতিল ও প্রত্যাখ্যানযোগ্য ফর্মুলা সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত কিছু আলোচনার প্রয়াস পাচ্ছি।
এক. কোনো কিছুর ভৌগোলিক অবস্থান দিয়ে কোনো মাসআলা বা বিধান প্রমাণিত করা
এটা এমন একটা মনগড়া ফর্মুলা, যা দ্বারা কোনো শরয়ী বিধান প্রবর্তন উম্মত কর্তৃক স্বীকৃতও নয়, স্বীকৃতিযোগ্যও নয়। যেমন, কেউ কেউ ‘গোল্ডেন রেশিও’র ভিত্তিতে কা‘বা শরীফকে পৃথিবীর নাভি প্রমাণিত করে মক্কা মুকাররমাকে সারা পৃথিবীর মূল কেন্দ্র ধরে মক্কা মুকাররমার সাথেই একসঙ্গে সারা পৃথিবীর রোযা ও ঈদ উদ্যাপনের থিওরি দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। যদিও তাদের গোল্ডেন রেশিওর ভিত্তিতে কা‘বা শরীফকে পৃথিবীর নাভি প্রমাণিত করার হিসেবে ভুল রয়েছে, তদুপরি শরীয়তে ভিত্তি হিসেবে স্বীকৃত নয়Ñ এমন সব ভিত্তির উপর আলোচনা দাঁড় করানো হয়েছে, যা আমি আমার ‘গোল্ডেন রেশিও এবং কা‘বা শরীফ পৃথিবীর নাভি কি নাÑ এ প্রসঙ্গ’ শীর্ষক প্রবন্ধে প্রমাণিত করে দেখিয়েছি। গোল্ডেন রেশিওর হিসেবে বা কোনো রকম ভৌগোলিক অবস্থানের বিচারে কোনো স্থানকে কোনো বিধানের ভিত্তি বানানোর ধারাকে স্বীকৃতি দিলে আরও কত অনাকাক্সিক্ষত ও অগ্রহণযোগ্য বিষয় প্রমাণ করার পথ খুলে যাবেÑ সে সম্বন্ধেও আমি উদাহরণসহ বিবরণ তুলে ধরেছি। প্রবন্ধটি ‘মাসিক আলকাউসার’-এর এপ্রিল ২০১৭ সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। এটি নেটে ও ফেসবুকে আমাদের একাধিক আইডি, পেজ ও ওয়েবসাইটেও রয়েছে। আলোচনা দীর্ঘ হওয়ার কারণে সে বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ এ প্রবন্ধে আনা সম্ভব হল না।
দুই. হরফের সংখ্যা দিয়ে কোনো কিছু প্রমাণিত করা
এটাও একটা মনগড়া ফর্মুলা, যা উম্মত কর্তৃক স্বীকৃত নয়, স্বীকৃতিযোগ্যও নয়। যেমন, কেউ কেউ কুরআনে কারীমের সূরা আলে ইমরানের ৯৬ নং আয়াত দ্বারা কা‘বা শরীফকে গোল্ডেন রেশিও পয়েন্টে দেখানোর চেষ্টা করেন। (এই চেষ্টার উদ্দেশ্যও তাই, যা পূর্বে এক নম্বরে উল্লেখ করা হয়েছে।) আয়াতটি এইÑ
اِنَّ اَوَّلَ بَیْتٍ وُّضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِیْ بِبَكَّةَ مُبٰرَكًا وَّ هُدًی لِّلْعٰلَمِیْنَ.
এ আয়াতে কা‘বাগৃহ সর্বপ্রথম গৃহÑ এ প্রসঙ্গ উল্লেখিত হয়েছে। আয়াতে উল্লেখিত বাক্কা (بكة) হল মক্কারই আরেক নাম। এখন যারা এই আয়াত দ্বারা কা‘বা শরীফকে গোল্ডেন রেশিও পয়েন্টে দেখানোর চেষ্টা করেন, তারা বলেন, এ আয়াতে বাক্কা (তথা মক্কা) শব্দটি উচ্চারিত হওয়া পর্যন্ত হরফ-সংখ্যা ২৯ এবং গোটা আয়াতে হরফ-সংখ্যা ৪৭। এখন গোল্ডেন রেশিও পয়েন্ট বের করার নিয়ম অনুযায়ী বড় সংখ্যাকে ছোট সংখ্যা দ্বারা ভাগ দিলে গোল্ডেন রেশিও পয়েন্ট তথা ১.৬১ বের হয় (৪৭÷২৯=১.৬১)।
এখানে আমাদের প্রথম বক্তব্য হলÑ এখানে ভাগফল ভুল হয়েছে। হবে ৪৭÷২৯=১.৬২। তাহলে সঠিক গোল্ডেন রেশিও হল না। যদি ভাগফল ১.৬১ হত তাহলে সঠিক গোল্ডেন রেশিও হত। কা‘বা শরীফ সংক্রান্ত অন্য যেসব আয়াত রয়েছে সেগুলোতে গোল্ডেন রেশিওর ধারে কাছেও যায় না। যেমন একটি আয়াতÑ
جَعَلَ اللهُ الْكَعْبَةَ الْبَیْتَ الْحَرَامَ قِیٰمًا لِّلنَّاسِ.
এখানে শুরুতে কা‘বা শব্দসহ ১৪ হরফ। আর মোট হরফ-সংখ্যা ৩৬। তাহলে ৩৬÷১৪= ২.৫৭। কৈ গোল্ডেন রেশিও গেল কোথায়? যদি কা‘বা শব্দের আগের ৮ হরফ এবং কা‘বা শব্দসহ পরের মোট ২৮ হরফÑ এভাবে হিসাব করা হয়, তাহলে হবে ২৮÷৮= ৩.৫। কৈ গোল্ডেন রেশিও গেল কোথায়?
এ তো গেল এ ব্যাপারে প্রথম বক্তব্য। দ্বিতীয় বক্তব্য হল, যদি হরফের সংখ্যা দিয়ে আহকাম ফাওয়ায়েদ গবেষণা করে বের করার তথা ইস্তিমবাত-ইস্তিদলাল করার এই তরীকা মেনে নেয়া হয়, তাহলে কুরআন-হাদীস দিয়ে অনেক গোমরাহী প্রমাণিত করার অবকাশ বের হয়ে আসবে। যেমন, কেউ যদি বলে, রব (رب) শব্দে মোট তিনটি হরফ, অতএব (নাউযু বিল্লাহ) খ্রিস্টানদের কথিত ত্রিত্ববাদ তথা তিন খোদা থাকার দর্শন ঠিক, তাহলে তার কী জবাব দেয়া যাবে?
এমনিভাবে কেউ যদি বলে, ইলাহ (اله) শব্দে মোট চারটি হরফ। অতএব হিন্দুদের কথিত ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহাদেবÑ এই তিনজন এবং পরমেশ্বর মোট চারজন ইলাহ থাকার মতবাদ সঠিকÑ তাহলে তার কী জবাব দেয়া যাবে?
কেউ যদি বলে, মাসজিদ (مسجد) শব্দে চারটি হরফ, অতএব মাসজিদে চারটির বেশি পিলার দেয়া যাবে না, একাধিক তলা করতে হলে চার তলার বেশি করা যাবে নাÑ তাহলে কী বলা যাবে?
এভাবে কুরআনের কোনো শব্দ বা বাক্যের হরফ-সংখ্যা দিয়ে গবেষণা তথা ইস্তিমবাত-ইস্তিদলালের ছেলেমিপনা শুরু হলে তা ঠেকানোর কী উপায় থাকবে?
তিন. হরফের মান দিয়ে কোনো কিছু প্রমাণিত করা
এটাও একটা মনগড়া ফর্মুলা, যা উম্মত কর্তৃক স্বীকৃত নয়, স্বীকৃতিযোগ্যও নয়।
أبجد، هوز، حطي، كلمن، سعفص، قرشت، ثخذ، ضظغ.
Ñএই বিন্যাস অনুসারে আরবী হরফগুলোর মান ধরা হয় যথাক্রমে ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯, ১০, ২০, ৩০, ৪০, ৫০, ৬০, ৭০, ৮০, ৯০, ১০০, ২০০, ৩০০, ৪০০, ৫০০, ৬০০, ৭০০, ৮০০, ৯০০, ১০০০। এভাবে ابجد -এর আলিফ থেকে ضظغ -এর গাইন পর্যন্ত (ধারাবাহিকভাবে) হরফগুলোর যে মান (উপরে বর্ণিত) ধরা হয়Ñ তা একটা পারিভাষিক বিষয়। সেটা কোনো দ্বীনী বা শরয়ী বিষয় নয়। এর কিছু প্রাচীন যুগ থেকে এভাবে কথিত হয়ে আসছে আর কিছু (ثخذ ضظغ) পরবর্তীতে নাসর ইবনে আসিম নাহবী (নাহ্ব শাস্ত্রবিদ) যোগ করেছেন। এই বিন্যাস অনুসারে হরফগুলোর যে মান ধরা হয়েছে সেই মানে কোনো প্রভাব আছেÑ এমন কিছুও কুরআন হাদীস দ্বারা সমর্থিত নয়। এজন্যই উলামায়ে কেরাম বলেছেন, বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম-এর সংখ্যা ৭৮৬ লিখলে বিসমিল্লাহ লেখার হক আদায় হবে না। তাতে বিসমিল্লাহ্র ফায়দা আছর কিছুই হবে না।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, ইংরেজি বর্ণমালারও যে মান ধরা হয় যথা : A, i, J, Q, Y এই অক্ষরগুলোর প্রত্যেকটির মান ১। তারপর B, K, R এই অক্ষরগুলোর প্রত্যেকটির মান ২। তারপর C, L, S, G এই অক্ষরগুলোর প্রত্যেকটির মান ৩। তারপর D, M, T এই অক্ষরগুলোর প্রত্যেকটির মান ৪। তারপর E, H, N, X এই অক্ষরগুলোর প্রত্যেকটির মান ৫। তারপর U, V, W এই অক্ষরগুলোর প্রত্যেকটির মান ৬। তারপর O, Z এই অক্ষরদুটোর প্রত্যেকটির মান ৭। তারপর F, P এই অক্ষরদুটোর প্রত্যেকটির মান ৮Ñ এই মানও নিছক একটি পারিভাষিক বিষয়। দ্বীন ও শরীয়তের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ কিছু লোককে দেখা যায়, আরবী হরফের এই মান দিয়ে আর কিছু লোককে দেখা যায়, ইংরেজি বর্ণের বা সংখ্যার মান দিয়ে অনেক কিছু প্রমাণিত করতে চান। যেমন, তাবিজ-তুমারের অনেক বইপত্রে আরবী বিভিন্ন শব্দের হরফের মান দিয়ে অনেক নকশা ইত্যাদি দাঁড় করানো হয়েছে এবং সেসব নকশার নানাবিধ প্রভাব থাকার কথা বিশ্বাস করা হয়ে থাকে। জ্যোতিষীরা মানুষের নামের অক্ষরগুলোর মান দিয়ে বা জন্মের বছর, মাস ও তারিখের সংখ্যাগুলোর মান দিয়ে কে কোন্ রাশির জাতক তা নির্ধারণ করেন এবং এক এক জাতকের জীবনে ঐ সংখ্যার ফলে এক এক ধরনের প্রভাব রয়েছে বলে বিশ্বাস করেন। এগুলো না কুরআন-হাদীস দ্বারা সমর্থিত, না বিজ্ঞান কিংবা যুক্তি-বুদ্ধি দ্বারা সমর্থিত। (এ সম্বন্ধে আমার রচিত ‘ইসলামী আকীদা ও ভ্রান্ত মতবাদ’ গ্রন্থে (পৃ. ১৮৭-১৯৯) খণ্ডনমূলক বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে।
চার. গাণিতিক হিসাব দিয়ে কোনো কিছু প্রমাণ করা
এটাও একটা মনগড়া ফর্মুলা, যা উম্মত কর্তৃক স্বীকৃত নয়, স্বীকৃতিযোগ্যও নয়। কোনো রকম গাণিতিক হিসাবের ভিত্তিতে কোনো মাসআলা বা বিধান বের করার বিধিবদ্ধতা কুরআন-হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। অথচ কিছু লোককে দেখা যাচ্ছে, নানান রকম গাণিতিক হিসাব দিয়ে নানা রকমের ইসলামী বিধান প্রমাণের চেষ্টা চালাচ্ছেন। যেসব হিসেবের কোনো আগা-মাথাও নেই। যেমন, একজন গবেষণা করে বের করেছেনÑ তারাবির নামায ৮ রাকআত। কেননা আরবী বছর সর্বনিম্ন ৩৫৩ দিনের হয়। আর ৩৫৩ সংখ্যার যোগফল হয় (৩+৫+৩=) ১১। এই ১১ থকে ৩ রাকআত বিতিরের আর বাকি ৮ রাকআত তারাবীর। আবার আরবী বছর সর্বোচ্চ হয় ৩৫৫ দিনে। আর ৩৫৫-এর যোগফল হয় (৩+৫+৫=) ১৩। এখানে আগের চেয়ে ২ রাকআত বেশি হয়, সেটা হল ফজরের ২ রাকআত সুন্নাত। আবার আরবী বছর ৩৫৪ দিনেও হয়। আর ৩৫৪-এর যোগফল হয় (৩+৫+৪=) ১২। এর ৮ রাকআত তারাবীহের, আর ফজরের সুন্নত ও ফরয মিলে ৪ রাকআত। আবার এভাবেও বলেছে, কুরআন মাজীদের সূরা হল ১১৪টি, আর ১১৪-এর সংখ্যাগুলোর যোগফল হয় (১+১+৪=) ৬। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের নিয়ে তারাবীহ পড়েছেন মোট ৩ দিন। এবার ৬+৩=৯। এর মধ্যে ৮ হল তারাবীহ আর ১ হল বিতির। কী সব অদ্ভুত তরীকার গবেষণা!
তাহলে হিসাবের সময় এক জায়গায় বিতির অন্তর্ভুক্ত হল আর এক জায়গায় হল না, এক জায়গায় বিতির তিন রাকআত ধরা হল আর এক জায়গায় এক রাকআত, এক জায়গায় ফজরের ফরয অন্তর্ভুক্ত হল আর এক জায়গায় হল নাÑ এগুলোর কারণ কী? এটা নিছক ইচ্ছেমত জোড়াতালি দিয়ে মতলব হাসিলের প্রয়াস নয় কি? এরকম গবেষণার সূত্র কি কুরআন-হাদীস দ্বারা বা ইজমায়ে উম্মত কিংবা কিয়াস দ্বারা স্বীকৃত? তারাবীহ নামাযের রাকআত-সংখ্যার সাথে বছরের দিন-সংখ্যার কী সম্পর্ক? তারাবীহের রাকআত-সংখ্যার সাথে কুরআনের সূরা-সংখ্যার কী সম্পর্ক? এরকম খামখেয়ালি মতে এখান-ওখান থেকে এটা ওটা নিয়ে বা এটা ওটা বাদ দিয়ে যোগফল বের করে তা দিয়ে কোনো বিধান প্রমাণ করাÑ গবেষণার এই অদ্ভুত জগাখিচুড়ি পদ্ধতি কোথা থেকে বের হল?
গবেষণার এই পদ্ধতি মেনে নিলে কেউ যদি গবেষণা করে বের করেÑ জাহান্নামের সংখ্যা হচ্ছে ৭, অতএব জাহান্নামে কারও শাস্তি হলে সর্বোচ্চ হবে ৭ দিন। আর জান্নাতের সংখ্যা হচ্ছে ৮, অতএব জান্নাতে অবস্থান হবে সর্বোচ্চ ৮ দিন, তারপর আর (নাঊযু বিল্লাহ) জাহান্নাম জান্নাত থাকবে না। এরকম গবেষণার কী উত্তর থাকবে?
পাঁচ. সাংখ্যিক তাৎপর্য দিয়ে কোনো কিছু প্রমাণিত করা
এটাও ইসলামী গবেষণার স্বীকৃতিযোগ্য কোনো পন্থা নয়। এটা একটা বাতিল পন্থা, যা কেউ কেউ ব্যবহার করছে। যেমন, কেউ কেউ কুরআনের অলৌকিকত্ব প্রমাণ করার জন্য কুরআনের এক ধরনের সাংখ্যিক তাৎপর্য আবিষ্কার করেছেন। তারা কুরআনের সূরা-সংখ্যা, কিছু কিছু ক্ষেত্রে একই শব্দ যতবার ব্যবহার হয়েছে তার সংখ্যা ইত্যাদি অনেক কিছুর সংখ্যা ১৯ দ্বারা বিভাজ্য হয় দেখিয়ে এটা দ্বারা কুরআনের অলৌকিকত্ব প্রমাণ করতে চেয়েছেন। (বলতে চেয়েছেন, এমনটা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।) যেমন তারা বলেছেন, কুরআনের সূরা-সংখ্যা ১১৪, যা ১৯ দ্বারা বিভাজ্য হয় (১১৪÷১৯=৬)। সূরা আলাক কুরআন মাজীদের ৯৬নং সূরা। শেষ থেকে উল্টোক্রমে এলে ১৯তম সর্বশেষ সূরাও এই আলাক। সর্বশেষ সূরা নাস-এর শব্দ-সংখ্যা ১৯। কুরআন মাজীদের প্রথম বাক্য বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম; যাতে মোট অক্ষর-সংখ্যা ১৯। পবিত্র কুরআনে ইস্ম (অর্থ নাম) শব্দটি আছে ১৯বার, আল্লাহ্ শব্দটি আছে ২৬৯৮বার, আররহমান ৫৭বার আর আররহীম ১১৪বারÑ সবগুলোই ১৯ দ্বারা বিভাজ্য। এভাবে তারা অনেক কিছুই ১৯ দ্বারা বিভাজ্য হয় এবং উনিশ সংখ্যার পুনঃপৌণিক উপস্থিতি দেখা যায় বলে দেখিয়েছেন। আর এটা দ্বারাই কুরআনে কারীমের অলৌকিকত্ব প্রমাণিত করতে চেয়েছেন। এব্যাপারে আমাদের সংক্ষিপ্ত কথা হল, ১৯-এর এই সাংখ্যিক তাৎপর্য দেখানোর মধ্যে প্রচুর ফাঁক-ফোঁকর রয়েছে। যেমন, কুরআনের যে বিষয়গুলোর সংখ্যা ১৯ দ্বারা বিভাজ্য হয় না, কিংবা যেগুলোতে ১৯ সংখ্যার উপস্থিতি নেই, সেগুলোর কথা তারা এড়িয়ে গেছেন। যেমন, কুরআনের বহু সূরার আয়াত-সংখ্যা ১৯ দ্বারা বিভাজ্য হয় না। বহু শব্দের ব্যবহার-সংখ্যা ১৯ দ্বারা বিভাজ্য হয় না। এরকম যেসবের সংখ্যা ১৯ দ্বারা বিভাজ্য হয় নাÑ সেগুলোর কথা তারা এড়িয়ে গেছেন।
যাইহোক এই সাংখ্যিক তাৎপর্য নিয়ে অনেক পর্যালোচনা হতে পারে। এর সমালোচনায় অনেকেই অনেক কিছু লিখেছেনও। তাই এ সম্বন্ধে আমি আর বিস্তারিত কিছু লিখলাম না। আমি শুধু এতটুকু বলতে চাই, কোনো সংখ্যা দিয়ে কোনোভাবে কোনো কিছু প্রমাণিত করার নীতিÑ না কুরআন-হাদীস দ্বারা স্বীকৃত, না উম্মত কর্তৃক স্বীকৃত ও অনুসৃত। আচ্ছা ভেবে দেখুন তো, কোনো গ্রন্থের অনেক কিছু একটা নির্দিষ্ট সংখ্যা দ্বারা বিভাজ্য হলে যদি সেটা অলৌকিক বলে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য হয়ে যায়, তাহলে কোনো লোক যদি দীর্ঘ সময় নিয়ে হিসাব-নিকাশ করে এমন একটা গ্রন্থ দাঁড় করায়, যার অনেক কিছু একটা নির্দিষ্ট সংখ্যা দ্বারা বিভাজ্য হয় এবং সেটাকে ঐশী গ্রন্থ এবং সেই সুবাদে নিজেকে নবী বলে দাবি করে বসে, তাহলে কি মেনে নেওয়া যাবে? আদৌ না। বস্তুত একটা গ্রন্থের অনেক কিছু একটা নির্দিষ্ট সংখ্যা দ্বারা বিভাজ্য হবেÑ এমন গ্রন্থ রচনা করা মানব সাধ্যের ঊর্ধ্বে নয়। অতএব এটাকে অলৌকিকত্ব সাব্যস্ত করার উপাত্ত বানানোর কোনোই অবকাশ নেই।
আরও ভেবে দেখুন, কোন লোক যদি বর্তমান বিকৃত বাইবেলের অনেক কিছুকে নির্দিষ্ট একটি সংখ্যা দ্বারা বিভাজ্য দেখাতে পারে (যেমনটা কেউ কেউ করেছে বলেও শোনা যায়। কেউ ৭ দ্বারা কেউ ১২ দ্বারা অনেক কিছু বিভাজ্য দেখানোর চেষ্টা করেছে বলে শোনা যায়।), তাহলে কি বাইবেলের অলৌকিকত্ব বহাল থাকা সাব্যস্ত হয়ে সেটাকে অবিকৃত তথা সঠিক আখ্যায়িত করতে পারবে? কখনো নয়।
যারা ১৯ সংখ্যা দ্বারা বিভাজ্য হওয়ায় কুরআনের অলৌকিকত্ব প্রমাণ করতে চান, তারা বলতে পারেন, ১৯ ছাড়া অন্য কোনো সংখ্যা দ্বারা বিভাজ্য হলে তাতে অলৌকিকত্ব প্রমাণিত হবে না, ১৯ দ্বারাই বিভাজ্য হতে হবে। কেননা ১৯ সংখ্যা সম্বন্ধে কুরআনে সূরা মুদ্দাসসিরের ৩০ নং আয়াতে বলা হয়েছেÑ عَلَیْهَا تِسْعَةَ عَشَرَ
এ আয়াতে বলা হয়েছে, সবকিছুর উপর ১৯ সংখ্যা। (তারা এমনই ভাবার্থ করে থাকে।) কাজেই ১৯ সংখ্যার ব্যাপারটাই ভিন্ন। এ ব্যাপারে আমরা বলব, আয়াতের তরজমায় মারাত্মক বিভ্রান্তি ঘটানো হয়েছে। تِسْعَةَ عَشَر অর্থ ১৯Ñ এটা ঠিক আছে। কিন্তু عَلَيْهَا -এর অর্থ ‘সবকিছুর উপর’Ñ এটা ঠিক নয়; বরং عَلَيْهَا শব্দে ه জমীরের ‘মারজি’ (مرجع) জাহান্নাম। সেমতে عَلَيْهَا -এর অর্থ হচ্ছে জাহান্নামের উপর। পুরো বাক্যের অর্থ হল জাহান্নামের উপর তথা জাহান্নামে ১৯ জন (প্রহরী) রয়েছে। তাহলে এবার বলুন, জাহান্নামের প্রহরীদের সংখ্যার মধ্যে এমন কী মাহাত্ম্য ঢুকল যে, সেই সংখ্যা দ্বারা বিভাজ্য হলে তাতে অলৌকিকত্ব প্রমাণিত হবে, অন্য সংখ্যা দ্বারা বিভাজ্য হলে অলৌকিকত্ব প্রমাণিত হবে না?
আল্লাহ্ আমাদেরকে সব ধরনের বিভ্রান্তি থেকে হেফাজত রাখেন।
وما علينا إلا البلاغ.