পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি
দ্বীনী দাওয়াতই হতে পারে দেশের অখণ্ডতা রক্ষার কার্যকর উপায়
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে যে দ্বীন দান করেছেন তা শুধু আমাদের পরকালীন মুক্তিরই পথ নয়, আমাদের পার্থিব শান্তি ও কল্যাণেরও উপায়। আমাদের ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সুখ-শান্তি, শৃঙ্খলা ও সুরক্ষা নির্ভর করে বাস্তব জীবনে আমরা কতটুকু দ্বীন সম্পর্কে জানছি ও তা অনুসরণ করছিÑ এর উপর। এটি এমন এক সত্য, যা অস্বীকার করার উপায় নেই, কিন্তু এ সত্যকে উপলব্ধি করার জন্য প্রথম প্রয়োজন অটল ঈমান, এরপর দ্বীনের সঠিক ইলম, এরপর চারপাশের বাস্তবতা সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, প্রথম দুই ক্ষেত্রের ত্রুটি ও দুর্বলতার কারণে তৃতীয় ক্ষেত্রেও আমরা সামগ্রিকভাবে দুর্বলতারই পরিচয় দিচ্ছি।
আমাদের মধ্যে ব্যাপকভাবে ঈমানী দুর্বলতা, আল্লাহ তাআলার প্রতি অবিচল আস্থা-বিশ্বাসে ঘাটতি তো আছেই, দ্বীন সম্পর্কে স্বচ্ছ ও গভীর জ্ঞানেরও রয়েছে ভয়াবহ অভাব। ফলে জীবনের বিভিন্ন অঙ্গনে দ্বীনের বিধি-বিধানের বহুমুখী কল্যাণ সম্পর্কে অনেক মুসলিমেরই তেমন কোনো ধারণা নেই।
এই জ্ঞানগত দূরত্ব শুধু ইসলামের বিধি-বিধানের চর্চা ও অনুশীলনকেই বাধাগ্রস্ত করেনি, নানা ধরনের অলীক-অবাস্তব ধারণারও বিস্তার ঘটিয়েছে। পেশাগত জীবনে সচেতন একজন মুসলিমকেও দেখা যায়, দ্বীন ও দ্বীনের বিধি-বিধান সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের অবাস্তব ধারণা পোষণ করতে, যা দ্বীনের কল্যাণপূর্ণ শিক্ষার ব্যাপারে তাকে অনাগ্রহী করে রাখে। ক্ষেত্রবিশেষে দ্বীন সম্পর্কে চাপা ভীতি ও শঙ্কাও তৈরি করে। অথচ ভালোভাবে দ্বীন সম্পর্কে জানলে, দ্বীনী বিধি-বিধানের সুফল ও তাৎপর্য সম্পর্কে অবগত হলে দেখা যেত, এই ভীতি ও শঙ্কা কত অমূলক! দ্বীনের প্রতি অনাগ্রহ কেমন আত্মপ্রবঞ্চনা!
জীবনের অনেক অঙ্গন তো এমনও আছে, যে সম্পর্কে ‘দ্বীন’ কথাটি শুনতেও অনেকে নারাজ। এ অঙ্গনেও যে দ্বীন পালনের ব্যাপার থাকতে পারে, দ্বীন পালনের সুফল ও কল্যাণ থাকতে পারেÑ তা অনেকের কল্পনারও অতীত। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের দ্বীন আমাদের জীবনের সকল অঙ্গনেই আমাদের জন্য আলোকবর্তিকা। কিন্তু এ সত্য উপলব্ধি করার জন্য তো দ্বীন ও তার বিধি-বিধানকে সঠিকভাবে জানতে হবে, বুঝতে হবে। জানা-বোঝার এ চেষ্টাটাই তো আমাদের অনেকের হয়ে উঠছে না।
উদাহরণ হিসেবে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রসঙ্গটি আলোচনা করতে পারি। এ প্রসঙ্গের অবতারণা মাত্র অনেকের মধ্যে শঙ্কা জেগে উঠতে পারে। অন্তত মুসলমানদের এক বিরাট শ্রেণি যে সচকিত হয়ে উঠবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাদের মনে হতে পারে, স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে দ্বীন-ধর্মের প্রসঙ্গ কেন? অথচ দ্বীন সম্পর্কে এবং চারপাশের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে যাদের স্বচ্ছ ধারণা আছে, তারা গভীরভাবে উপলব্ধি করবেন যে, এ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার ক্ষেত্রেও আমাদের দ্বীন কত প্রাসঙ্গিক।
আমাদের এই মাতৃভূমিতে খ্রিস্টান মিশনারীদের যে অব্যাহত অপতৎপরতা, তা কি শুধু মুসলিম জনসাধারণের দ্বীন-ঈমানের জন্যই হুমকি, না তা এদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্যও ঝুঁকি?
কেউ হয়ত এখানে মুসলিম-অমুসলিমের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রসঙ্গ তুলবেন। তা তারা তুলতে পারেন, কিন্তু একটি প্রশ্নের জবাব তাদের দিতে হবে; আর তা হচ্ছে, মুসলিম-অমুসলিমের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ইসলাম-প্রদত্ত ব্যবস্থার মতো সুস্পষ্ট নীতি ও বিধান সম্বলিত যুক্তিসঙ্গত, ভারসাম্যপূর্ণ, কল্যাণপূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ কোনো ব্যবস্থা কি তারা উপস্থিত করতে পারবেন? আমরা নিশ্চিত যে, অনেকেই লম্বা-চওড়া দাবি করতে পারবেন, কিন্তু এরকম কোনো ব্যবস্থা আদৌ উপস্থিত করতে পারবেন না।
আসলে ব্যাপারটা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের না। বর্তমান সময়ের সেক্যুলার মানসিকতার অনেকেই মুসলিম-অমুসলিমের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের চেয়ে এ ভূখণ্ডের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও স্বাভাবিক ইসলামী চরিত্রেরই বিরোধী। আর এ কারণে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সব দায়-দায়িত্ব তারা মুসলিমসমাজের উপরই আরোপ করতে চান। এক্ষেত্রে অন্যান্য ধর্ম-মতের অনুসারীদের যেন কোনো দায়িত্ব নেই। তা যদি না হত তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামের ওমর ফারূক ত্রিপুরা রাহ.-এর শুধু মুসলিম হওয়ার কারণে সন্ত্রাসী হামলায় মর্মান্তিকভাবে নিহত হওয়ার পরও তাদের তরফ থেকে কোনো প্রতিবাদ-সমালোচনা কেন দেখা গেল না?
এদেশের মুসলিম জনগণ ইসলামী শিক্ষা অনুসারে অন্যান্য ধর্মমতের অনুসারীদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী এবং যুগ যুগ ধরে তারা এর প্রমাণ দিয়ে এসেছেন, কিন্তু এর অর্থ কিছুতেই এই নয় যে, তারা নিজ আদর্শ, দ্বীন ও ঈমান বিসর্জন দিয়ে দেবেন কিংবা দ্বীন-ঈমান ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হরণের কোনো অপতৎপরতাও মেনে নেবেন। আমাদের বুঝতে হবে যে, এইসকল অপতৎপরতা শুধু এ জনপদের মুসলিম জনগণের দ্বীন-ঈমানের পক্ষেই ঝুঁকি নয়, এদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্যও মারাত্মক ঝুঁকি। সময় থাকতেই এ সত্য আমাদের উপলব্ধি করা প্রয়োজন।
এই ঝুঁকি মোকাবেলায় আমাদের কর্তব্য, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের দরিদ্র ও সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে ব্যাপক দাওয়াতী কর্মতৎপরতা পরিচালনা করা, মসজিদ-মক্তব স্থাপন করা, দ্বীনী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। দেশের বিত্তবান শ্রেণি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা স্ব স্ব ক্ষেত্র থেকে যদি এই শিক্ষা ও সচেতনতামূলক দাওয়াতী কর্মকাণ্ডে আন্তরিকভাবে সহায়তা করেন এবং আল্লাহ্র সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে দ্বীনী কাজে অংশগ্রহণের চেতনা নিয়ে এগিয়ে আসেন, তাহলে তা এই দেশ ও জাতির নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্যও ইতিবাচক হয়ে উঠতে পারে।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সঠিক বিষয়টি যথাসময়ে সঠিকভাবে বোঝার তাওফীক দান করুনÑ আমীন।