যিলকদ ১৪৪২   ||   জুন ২০২১

মিথ্যার কিছু রূপ : বেঁচে থাকতে চেষ্টা করি

মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ মাসুম

বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনÑ

عَلَيْكُمْ بِالصِّدْقِ، فَإِنّ الصِّدْقَ يَهْدِي إِلَى الْبِرِّ، وَإِنّ الْبِرّ يَهْدِي إِلَى الْجَنّةِ، وَمَا يَزَالُ الرّجُلُ يَصْدُقُ وَيَتَحَرّى الصِّدْقَ حَتّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللهِ صِدِّيقًا، وَإِيّاكُمْ وَالْكَذِبَ، فَإِنّ الْكَذِبَ يَهْدِي إِلَى الْفُجُورِ، وَإِنّ الْفُجُورَ يَهْدِي إِلَى النّارِ، وَمَا يَزَالُ الرّجُلُ يَكْذِبُ وَيَتَحَرّى الْكَذِبَ حَتّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللهِ كَذّابًا.

তোমরা সত্যকে অবলম্বন কর। কারণ সত্যবাদিতা ভালো কাজে উপনীত করে। আর ভালো কাজ উপনীত করে জান্নাতে। মানুষ সত্য বলে ও সত্যবাদিতার অন্বেষায় থাকে, একপর্যায়ে সে আল্লাহর কাছে সত্যবাদী হিসেবে লিখিত হয়ে যায়।

আর তোমরা মিথ্যা থেকে দূরে থাক। কারণ মিথ্যা উপনীত করে পাপাচারে। আর পাপাচার উপনীত করে জাহান্নামে। ব্যক্তি মিথ্যা বলে ও মিথ্যার অন্বেষায় থাকে, এভাবে একসময় আল্লাহর কাছে সে চরম মিথ্যুক হিসেবে লিখিত হয়ে যায়। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬০৭

হাদীসের অর্থ একেবারেই সরল। মর্ম খুবই প্রাঞ্জল। অর্থাৎ সত্যবাদিতা যেমন একটি ভালো গুণ, তার বৈশিষ্ট্য হল, মানব-জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও এটি ভালো প্রভাব সৃষ্টি করে, ভালোর দিকে পরিচালিত করে। ফলে লোকটির ঠিকানা হয় জান্নাত। পক্ষান্তরে মিথ্যা খোদ একটি মন্দ ও ঘৃণিত স্বভাব। সাথে তার একটি মন্দ প্রতিক্রিয়া এ-ও যে, এটি মানুষের মধ্যে পাপাচার ও অবাধ্যতার প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করে। পুরো জীবনটাকে অন্যায় ও অনাচারে কলুষিত করে তোলে। ফলে তার পরিণতি হয় জাহান্নাম। (দ্র. মিরকাতুল মাফাতীহ ৯/১৪০ মাআরেফুল হাদীস, মনযুর নুমানী, হাদীস ১৯৪)

আরেকটি হাদীসে এসেছেÑ

يُطْبَعُ الْمُؤْمِنُ عَلَى الْخِلَالِ كُلِّهَا إِلّا الْخِيَانَةَ وَالْكَذِبَ

قال الزرقاني في الشرح على المؤطا: وَضَعّفَ الْبَيْهَقِيّ رَفْعَهُ، وَقَالَ الدّارَقُطْنِيّ: الْمَوْقُوفُ أَشْبَهُ بِالصّوَابِ، قَالَ غَيْرُهُ: وَمَعَ ذَلِكَ فَحُكْمُهُ الرّفْعُ عَلَى الصّحِيحِ ; لِأَنّهُ مِمّا لَا مَجَالَ لِلرّأْيِ فِيهِ، انْتَهَى.

মুমিনের চরিত্রে সবকিছুর অবকাশ থাকতে পারে, কিন্তু প্রতারণা ও মিথ্যা নয়। Ñমুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ২৬১২১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২১৭০; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৪৪৬৯

অর্থাৎ কেউ যদি প্রকৃত মুমিন হয়ে থাকে, তাহলে অন্য কোনো দোষ-ত্রুটি ও দুর্বলতা তার মধ্যে হয়ত থাকতে পারে, কিন্তু মিথ্যা ও খেয়ানতের কোনো অংশ তার চরিত্রে জায়গা করতে পারে না। ঈমানের সাথে মিথ্যা ও খেয়ানতের মতো মুনাফিকসুলভ বিষয় একত্রিত হতে পারে না। কাজেই কারো মধ্যে যদি মিথ্যা এবং প্রতারণার মতো মন্দ কোনো স্বভাব থাকে, বুঝতে হবেÑ ঈমানের হাকীকত এখনও তার অর্জিত হয়নি। (দ্র. মাআরেফুল হাদীস)

মিথ্যার রয়েছে বহু ক্ষেত্র। ইসলামী শরীয়তে সবিস্তারে মিথ্যার পরিধি বর্ণনা করা হয়েছে। এমন কিছু মিথ্যা আছে, যেগুলোকে অনেকসময় মিথ্যাও মনে করা হয় না। ইসলাম সেগুলো থেকেও বেঁচে থাকার নির্দেশ দিয়েছে। নিম্নে মিথ্যার অবহেলিত কিছু দিক তুলে ধরা হল।

যাচাই-বাছাই ছাড়া বলা ও প্রচার করাও মিথ্যা

মিথ্যার একটি সূক্ষ্ম রূপ, যাচাই-বাছাই ছাড়া যা শোনে তাই বলে বেড়ানো। কারণ এর মাধ্যমে অনায়াসেই একটি ভুল তথ্য সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। কাজেই আল্লাহ তাআলা বলেনÑ

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اِنْ جَآءَكُمْ فَاسِقٌۢ بِنَبَاٍ فَتَبَیَّنُوْۤا اَنْ تُصِیْبُوْا قَوْمًۢا بِجَهَالَةٍ فَتُصْبِحُوْا عَلٰی مَا فَعَلْتُمْ نٰدِمِیْنَ.

হে মুমিনগণ! কোনো ফাসেক যদি তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তবে ভালোভাবে যাচাই করে দেখবে, যাতে তোমরা অজ্ঞতাবসত কোনো সম্পদ্রায়ের ক্ষতি না করে বস! ফলে নিজেদের কৃতকর্মের কারণে তোমাদের আনুতপ্ত হতে হয়। Ñসূরা হুজুরাত (৪৯) : ৬

হাদীসে এসেছেÑ

كَفَى بِالْمَرْءِ كَذِبًا أَنْ يُحَدِّثَ بِكُلِّ مَا سَمِعَ.

কারো মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শোনে (কোনো বাছ-বিচার ছাড়া) তাই প্রচার করতে থাকে। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ৫; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯৯২

আর যদি দ্বীনী বিষয় হয় তখন তো ব্যাপারটা আরও ভয়াবহ হয়ে দাঁড়ায়! পরিভাষায় একে বলা হয়, ‘আলকাযিবু আলাল্লাহি ওয়া রাসূলিহিÑআল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ব্যাপারে মিথ্যা বলা। কারণ এর মাধ্যমে শরীয়তের ভুল ব্যাখ্যা  প্রকাশিত হয়। এর দায় কখনো ওই ব্যক্তি এড়াতে পারে না, যার অসতর্কতার কারণে এই ভুল তথ্যটি প্রচারিত হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসÑযে আমার ব্যাপারে মিথ্যা বলল, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামে বানিয়ে নেয়!Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ১০৭

কোনো বর্ণনায় আছেÑযে ইচ্ছাকৃতআমার ব্যাপারে মিথ্যা বলবে...।বলা বাহুল্য, অসাবধানতা, অসতর্কতা, যাচাই-বাছাই ছাড়া দ্বীনের ব্যাপারে বেপরোয়া ও বল্গাহীন বলতে থাকাও প্রকারান্তরে ইচ্ছাকৃত বলার শামিল। তাই  স্যোশাল মিডিয়া বা অন্য কোনো মাধ্যমে মুখরোচক যা শোনে তা-ই প্রচার করার ব্যাপারে সতর্ক থাকা কাম্য।

গণমাধ্যমে মিথ্যা

গণমাধ্যমে বস্তুনিষ্ঠ ও সৎ সাংবাদিকতা দেশ ও জাতির তথা বিশ্ব মানব কল্যাণে যথেষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম। আবার মিথ্যা, অবাস্তব ও বানোয়াট সংবাদ প্রচারের কারণে অশান্তি ও অস্থীতিশীলতাও তৈরি হয়। এখানে যে মিথ্যা প্রচার করা হয় তা সারা দেশে, সারা বিশ্বে প্রচারিত হয়ে যায় এবং এর কারণে নানা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। ফলে এমন ক্ষেত্রে মিথ্যা প্রচারের শাস্তি অনেক ভয়াবহ।

মেরাজের রাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিভিন্ন অপরাধীদের শাস্তি দেখানো হল। তার মধ্যে ছিলÑ এক লোক বসা, পাশে আরেকজন দাঁড়ানো। তার হাতে লোহার পেরেক। লোহার পেরেক দিয়ে এই লোক পাশের লোকটির চোয়ালে আঘাত করে এবং পেরেকটি তার চোয়ালে ঢুকিয়ে ঘাড় পর্যন্ত নিয়ে যায়। তারপর একইভাবে অপর চোয়ালে আঘাত করে। ততক্ষণে আগের চোয়াল স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে এবং সে আবার আঘাত করতে থাকে। জিজ্ঞাসা করা হল, এরা কারা? বলা হল, সামনে চলো। (এভাবে অন্যান্য অপরাধীদের শাস্তিও দেখানো হল। পরিশেষে যখন একে একে সবার শাস্তির কারণ জানানো হল, তখন বলা হলÑ)

أَمّا الّذِي رَأَيْتَهُ يُشَقّ شِدْقُهُ، فَكَذّابٌ يُحَدِّثُ بِالكَذْبَةِ، فَتُحْمَلُ عَنْهُ حَتّى تَبْلُغَ الآفَاقَ، فَيُصْنَعُ بِهِ إِلَى يَوْمِ القِيَامَةِ.

আঘাত করে করে যার চোয়াল বিদীর্ণ করে ফেলতে দেখেছেন, সে ছিল মিথ্যাবাদী। মিথ্যা বলত (এবং তা প্রচার করত) ফলে তার বলা মিথ্যা প্রচার হতে হতে দিগদিগন্তে ছড়িয়ে পড়ত। কাজেই কিয়ামত পর্যন্ত তার সাথে এমনটি করা হতে থাকবে, এভাবেই তাকে শাস্তি দেয়া হবে। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ১৩৮৬

সাক্ষ্য প্রদানে মিথ্যা

ইসলামে সত্য সাক্ষ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। এর মাধ্যমে মানুষের হক ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে সামান্য হেরফেরের মাধ্যমেও অন্যের উপর বড় ধরনের জুলুম হয়ে যেতে পারে। অনেক সময় অন্যের সম্পদ আত্মসাতের মতো ভয়াবহ গোনাহও সংঘটিত হয়ে যায় এই মিথ্যা সাক্ষ্যের কারণে। তাই ইসলাম সত্য সাক্ষ্যের প্রতি উৎসাহিত করেছে। একান্ত ওজর না থাকলে সাক্ষ্যদান থেকে বিরত থাকতেও নিষেধ করেছে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছেÑ

وَ لَا تَكْتُمُوا الشَّهَادَةَ ؕ وَ مَنْ یَّكْتُمْهَا فَاِنَّهٗۤ اٰثِمٌ قَلْبُهٗ.

তোমরা সাক্ষ্য গোপন করো না। যে তা গোপন করে, অবশ্যই তার অন্তর পাপী। Ñসূরা বাকারা (২) : ২৮৩

বিপরীতে মিথ্যা সাক্ষ্যের ব্যাপারে রয়েছে কঠিন হুমকি-বাণী। সবথেকে বড় গোনাহগুলোর মধ্যে রাখা হয়েছে এই মিথ্যা সাক্ষ্যকে। হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বড় (কবীরা) গোনাহগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া।Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ২৬৫৩

মিথ্যা সাক্ষ্য অনেক বড় গোনাহ। এর মাধ্যমে অনেকসময় নিরাপরাধ মানুষ নির্যাতিত এবং নিপীড়িত হয়। হতে হয় মিথ্যা হয়রানির শিকার।

অনুরূপ মিথ্যা শপথের ব্যাপারেও হাদীসে কঠিন ধমকি এসেছেÑযে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের সম্পদ আত্মসাৎ করার জন্য বিচারকের সামনে মিথ্যা শপথ করবে, কিয়ামতের দিন সে আল্লাহর সাথে এই অবস্থায় সাক্ষাৎ করবে যে, তিনি তার উপর খুবই অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত থাকবেন।Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ৪২৭৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৭২

অন্য হাদীসে ইরশাদ হয়েছেÑযে ব্যক্তি মিথ্যা কসম খেয়ে কোনো মুসলমানের হক বিনষ্ট করল, আল্লাহ তাআলা তার জন্য জাহান্নাম অবধারিত করে দেবেন এবং জান্নাত তার উপর হারাম করে দেবেন। একজন সাহাবী জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সেটা যদি কোনো সামান্য জিনিসও হয়? (অর্থাৎ কেউ যদি কারো সামান্য ও তুচ্ছ জিনিসও কসম খেয়ে আত্মসাৎ করে, তারও কি এই পরিণতি হবে?) উত্তরে নবীজী বললেনÑ

وَإِنْ قَضِيبًا مِنْ أَرَاكٍ.

হাঁ, যদি সেটা পিলু বৃক্ষের একটি ডালও হয়। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ১৩৭

ব্যবসায় মিথ্যা

ব্যবসা হালাল উপার্জনের একটি উত্তম উপায়। সাহাবীগণ ব্যবসা করেছেন। কেউ যদি ব্যবসা  করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দেয়া বিধি-বিধান পালন করে, সততা ও আমানতদারি রক্ষা করে, এর মাধ্যমে দুনিয়াতেও যেমন তার জন্য রয়েছে শান্তি ও সমৃদ্ধি, পরকালেও রয়েছে অনেক মর্যাদা ও পুরস্কার।

হাদীস শরীফে এসেছেÑ

التَّاجِرُ الصَّدُوقُ الأَمِينُ مَعَ النَّبِيِّينَ، وَالصِّدِّيقِينَ، وَالشّهَدَاءِ.

সত্যবাদী ও আমানতদার ব্যবসায়ী (আখেরাতে) নবী-রাসূল, সিদ্দীক ও শহীদদের সাথে থাকবে। Ñজামে তিরমিযী, হাদীস ১২০৯; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ২১৪৩

ব্যবসা করার ক্ষেত্রে অনেকসময় খুব সাধারণভাবেই মুখে মিথ্যা চলে আসে। মিথ্যার ধরনটা হলÑভাই! মাত্র পাঁচ টাকা লাভ করছি! বরং আপনাকে কেনা দামেই ছেড়ে দিচ্ছি! এটাই সবচেয়ে ভালো কোম্পানির; এর চেয়ে ভালো আপনি আর কোথাও পাবেন না!ইত্যাদি বাক্য মুখে মুখে থাকে! অথচ এখানে কেবল কি মিথ্যা? ধোঁকা, প্রতারণা ও খেয়ানতের মতো বড় বড় অনেকগুলো গোনাহের সমাবেশ ঘটে! বিশেষত ধোঁকা ও প্রতারণার বিষয়টি তো একেবারে স্পষ্ট। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনÑ

যে আমাদের (মুসলমানদেরকে) ধোঁকা দেয় সে আমাদের দলভুক্ত (মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত) নয়।

এই হুমকি-বাণীর প্রেক্ষাপটটিও কিন্তু ব্যবসা কেন্দ্রিক। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার একজন শস্যব্যবসায়ীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি তার শস্যের স্তুপের ভেতর হাত ঢুকিয়ে ভেতরের শস্যগুলোতে কিছুটা আর্দ্রতা অনুভব করলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কী? ব্যবসায়ী উত্তর দিল, বৃষ্টিতে ভিজে গেছে। নবীজী বললেন, ভেজা অংশটা উপরে রাখলে না কেন? এরপর নবীজী বললেনÑ

مَنْ غَشَّ فَلَيْسَ مِنِّي.

যে ধোঁকা দেয় সে আমাদের দলভুক্ত (মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত) নয়। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ১০২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৬৪৮৯

মিথ্যা বলে গ্রাহককে ত্রুটিযুক্ত পণ্য ধরিয়ে দেয়া

মিথ্যা বলে গ্রাহককে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ত্রুটিযুক্ত পণ্যটি ধরিয়ে দেয়ার মধ্যে বড় ধরনের খেয়ানত বিদ্যমান। হাদীসে এসেছেÑ

كَبُرَتْ خِيَانَةً تُحَدِّثُ أَخَاكَ حَدِيثًا هُوَ لَكَ مُصَدِّقٌ، وَأَنْتَ بِهِ كَاذِبٌ.

এটা অনেক বড় খেয়ানত যে, তুমি তোমার ভাইকে কোনো কথা বলছ, সে এটাকে সত্য বলে বিশ্বাস করে নিচ্ছে, অথচ তুমি এতে মিথ্যাবাদী। Ñমুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৭৬৩৫; আলআদাবুল মুফরাদ, বুখারী, হাদীস ৩৯৩; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯৭১

আরেক হাদীসে বলা হয়েছে, তিন ধরনের ব্যক্তির সাথে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা কথা বলবেন না, তাদের প্রতি দয়া-দৃষ্টিতে তাকাবেন না এবং তাদেরকে পবিত্রও করবেন না। আর তাদের জন্য থাকবে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। এদের অন্যতম হলÑ

وَالْمُنَفِّقُ سِلْعَتَهُ بِالْحَلِفِ الْكَاذِبِ.

যে মিথ্যা কসম খেয়ে নিজের পণ্য চালিয়ে দেয়। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৬

মিথ্যা প্রতিশ্রুতি

ব্যক্তিগতভাবে একে অপরকে, অনেকসময় রাজনৈতিকভাবেও জনগণকে মিথ্যা প্রতিশ্রম্নতি দেয়া হয়। যাকে কেবল কবীরা গোনাহই নয়, হাদীসে মুনাফিকের স্বভাব বলা হয়েছে। হাদীসে মুনাফিকের একটি নিদর্শন বলা হয়েছেÑ

وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ.

মুনাফেকের একটি নিদর্শন হল, ওয়াদা করে ভঙ্গ করে। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৭

অন্য হাদীসে প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনÑ

آيَةُ الْمُنَافِقِ ثَلَاثٌ: إِذَا حَدَّثَ كَذَبَ، وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ، وَإِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ.

মুনাফিকের নিদর্শন তিনটি; কথা বললে মিথ্যা বলে। ওয়াদা করে ভঙ্গ করে এবং আমানত রাখা হলে খেয়ানত করে। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ৫৯

শিশুদের সাথে মিথ্যা

বাচ্চাদের সাথে কৌতুক, তাদের মন ভুলানো বা তাদের কান্না থামানোর জন্য তাদেরকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ও প্রলোভন দেয়া হয়ে থাকে। যা কেবল গোনাহই নয়, পাশাপাশি আরো অনেক ক্ষতিও ডেকে আনতে পারে! কারণ এর মাধ্যমে শিশুর কোমল অনুভূতিতে মিথ্যার মতো অপরাধকে হালকা করে দেয়া হল এবং তার স্বভাবে অনুপ্রবেশের রাস্তা খুলে দেয়া হল। প্রকারান্তরে তাকে এই অপরাধটির প্রতি উৎসাহিত করা হল।

সুন্দর একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়। নবী-যুগের ঘটনা। আবদুল্লাহ ইবনে আমের রা. বলেন, একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। তখন আমি ছিলাম ছোট্ট শিশু। খেলতে বের হচ্ছিলাম। আম্মা আমাকে ডাক দিয়ে বললেন, এদিকে এসো, তোমাকে একটা জিনিস দেব। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আম্মাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তাকে কী দেয়ার ইচ্ছা করেছ? আম্মা বললেন, আমি তাকে একটি খেজুর দেয়ার ইচ্ছা করেছি। নবীজী বললেনÑ

أَما إِنّكِ لَوْ لَمْ تُعْطِيهِ شَيْئًا كُتِبَتْ عَلَيْكِ كِذْبَةٌ.

মনে রেখো! যদি তুমি তাকে কিছু না দিতে, তাহলে তোমার আমলনামায় একটি মিথ্যার গোনাহ লিখে দেয়া হত। Ñসুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯৯১

অন্য এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনÑ

مَنْ قَالَ لِصَبِيٍّ: تَعَالَ هَاكَ، ثُمَّ لَمْ يُعْطِهِ فَهِيَ كَذْبَةٌ.

যে ব্যক্তি কোনো শিশুকে বলল, এসো তোমাকে (এটা-সেটা) দিব। তারপর দিল না; এটিও একটি মিথ্যা। Ñমুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৯৮৩৬; আয্যুহদ, ইবনুল মুবারক, হাদীস ৩৭৫

বন্ধুদের সাথে মিথ্যা

বন্ধুদের আড্ডা ও হাস্যরসের আসরগুলোও যেন মিথ্যা ছাড়া জমে না। রসিয়ে রসিয়ে এবং মিথ্যার মিশেলে যে যত সুন্দর করে মিথ্যা বলতে পারে এবং বন্ধুদের হাসাতে পারে, সে তত বাহবা পায়!

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনÑ

وَيْلٌ لِلَّذِي يُحَدِّثُ فَيَكْذِبُ، لِيُضْحِكَ بِهِ الْقَوْمَ، وَيْلٌ لَهُ وَيْلٌ لَهُ.

ধ্বংস তার জন্য, যে মানুষকে হাসানোর জন্য কথা বলার সময় মিথ্যা বলে! ধ্বংস তার জন্য! ধ্বংস তার জন্য! Ñমুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২০০৪৫; জামে তিরমিযী, হাদীস ২৩১৫; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯৯০

শেষকথা

এখানে মিথ্যার কিছু রূপ তুলে ধরা হল। এছাড়াও মিথ্যার আরও বহু ক্ষেত্র ও রূপ রয়েছে। অর্থাৎ মিথ্যা যেমন হতে পারে কথায়, তেমনি হতে পারে লেখায়ও। জাল সার্টিফিকেট, মিথ্যা দলিলপত্র ও সনদপত্র ইত্যাদি সবই এর আওতাভুক্ত।

আমাদের উচিত, সকল ধরনের মিথ্যা থেকে বেঁচে থাকা।

সত্যবাদিতা একটি মহৎ গুণ। ভালো স্বভাবগুলোর উৎস। মিথ্যা একটি সর্বজনবিদিত অপরাধ। যা কেবল ব্যক্তির পরকালকেই বরবাদ করে না, তার ব্যক্তিত্বকেও ধ্বংস করে। মানুষের আস্থা, ভালবাসা, আন্তরিকতার জায়গাটা তখন আহত হয়। ডেকে আনে ক্ষতি আর ক্ষতি। ক্ষেত্রবিশেষে মিথ্যাকে নগদ লাভ মনে হলেও এর রয়েছে কঠিন পরিণতি।

আসুন, সত্য গ্রহণ করি। মিথ্যা বর্জন করি। সত্যের সাথে থাকি, মিথ্যা পরিহার করি। আল্লাহ তাআলাই তাওফীকদাতা। হ

 

 

advertisement