জ্ঞানসাধক মাওলানা হাফেয মুরতাহিন বিল্লাহ জাসির রাহ.
আমার বন্ধু আমার মুরব্বী
[হাফেয মাওলানা মুরতাহান বিল্লাহ জাসির রাহ.-এর ইনতিকালের খবর আমি কিছুটা দেরিতেই পেয়েছি। মারকাযুদ দাওয়াহ যখন মুহাম্মাদপুর সাত মসজিদ রোডে অবস্থিত তখন তিনি এসেছিলেন। বিভিন্ন ইলমী বিষয়ে মুযাকারা করেছেন। জিদ্দা ফিকহ একাডেমির ফিকহ বিষয়ক ‘মাজাল্লা’র খণ্ডগুলো মারকাযের কুতুবখানায় দেখে খুশি হয়েছেন। মারকাযের কেন্দ্রীয় দফতর ৩০/১২ পল্লবীতেও তিনি এসেছিলেন। জালালাবাদী ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম তাঁর জীবনী সম্পর্কে কিছুটা বিস্তারিত লিখেছেন।
আল্লাহ তাঁকে আমাদের পক্ষ থেকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।
অধমের দৃষ্টিতে মাওলানা মরহুমের জীবনের যে বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং অনুসরণীয় তা হল, কর্মক্ষেত্রের বৈচিত্র্য সত্ত্বেও আকীদা-বিশ্বাস ও চিন্তা-চেতনা থেকে নিয়ে আচার-আচরণ ও বেশ-ভূষা পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রে শরীয়ত ও সুন্নত এবং আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের মাসলাকের উপর মজবুতির সাথে অটল থাকা। আর এটা বাহ্যত সম্ভব হয়েছে শায়খুল ইসলাম হযরত মাদানী রাহ.-সহ কওমী ও দেওবন্দী ঘরানার আকাবিরের সান্নিধ্যপ্রাপ্ত বুযুর্গ কিছু উলামায়ে কেরামের শিষ্যত্ব ও সাহচর্যের বরকতে। আল্লাহ তাআলা মরহুমকে জান্নাতের উঁচু মাকামে জায়গা দিনÑ আমীন। Ñআবদুল মালেক]
আরবী প্রবাদ বাক্যটি অত্যন্ত মশহুর।
موت العالِم موت العالَم.
অর্থাৎ একজন আলেমের মৃত্যু জগতের মৃত্যু। সে আলেম যদি কোনো যশস্বী বক্তা বা কোনো বড় ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা বা শিক্ষক-পরিচালকরূপে সুদীর্ঘকাল দ্বীনের খেদমতে নিযুক্ত থেকে দীর্ঘকাল অতিবাহিত করে সে অবস্থায়ই চিরবিদায় গ্রহণ করেন তাহলে তাঁর জানাযায় হাজার হাজার ভক্ত-জনতা ও শাগরেদদের উপস্থিতিতে তা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে লোকচক্ষে ধরা পড়ে। অন্যথায় উক্ত সত্যটি তেমন স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে না। কিন্তু একজন জ্ঞানসাধকের মৃত্যুতে ইলম ও গবেষণার ক্ষেত্রে যে প্রভূত ক্ষতি হওয়ার তা তো হয়েই যায়। নিভৃতচারী মহাসাধক আলেমগণের মৃত্যুটা তেমন সাড়া ফেলে না বা তাঁর কথা তেমনটি আলোচিত হয় না। কিন্তু গুণগ্রাহী পণ্ডিত ও আলেমমহলে তা ঠিকই হাহাকার সৃষ্টি করে। আমার বন্ধু ও মুরব্বী হাফেয মাওলানা মুরতাহিন বিল্লাহ জাসির রাহ. ছিলেন তেমনি একজন গুণী জ্ঞানসাধক আলেম।
১৯১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসা থেকে বিগত শতাধিক বছরে যেসকল প্রাজ্ঞ আলেম শিক্ষা লাভ করে বের হয়ে গোটা বিশ্বে আলো ছড়িয়েছেন তিনি তাঁদেরই প্রথম সারির একজন। উক্ত প্রাচীন মাদরাসাটি থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হযরত মাওলানা তাজুল ইসলাম রাহ. ও মাওলানা মাদানী রাহ.-এর অপর এক খলীফা অজীবন আসাম রাজ্যসভার সদস্য (৭ বার) মাওলানা আবুদল জলীল রাহ., কোলকাতা আলিয়া মাদরাসার সাবেক হেডমাওলানা ও পশ্চিমবঙ্গ জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সাবেক সভাপতি হযরত মাওলানা তাহির রাহ., বাংলাভাষার শ্রেষ্ঠ ও সর্বাধিক প্রামাণ্য নবীচরিত রচয়িতা মাওলানা তাফাজ্জুল হোসাইন, যিনি আজীবন ঢাকার বড় কাটারা আশরাফুল উলূম মাদরাসার শায়খুল হাদীসের দায়িত্ব পালন করে শত শত আলেম সৃষ্টি করে গেছেন, সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ ও প্রাচীন বাংলা মাসিক আলইসলাহের প্রতিষ্ঠাতা ও দীর্ঘ অর্ধ শতাব্দীকালের সম্পাদক মওলবী নূরুল হক, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে রায়ের বাজারের বধ্যভূমিতে বর্বর বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শহীদ প্রখ্যাত ওয়ায়েয, মুফাসসির ও তুখোড় লেখক-গবেষক মাওলানা অলিউর রহমান, ঢাকা আলিয়া মাদরাসার সাবেক প্রিন্সিপাল ও বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের ভূতপূর্ব চেয়ারম্যান মাওলানা প্রফেসর আবদুল মান্নান প্রমুখ বিদগ্ধ মনীষীগণ এ তালিকায় রয়েছেন। কিন্তু হাফেয মাওলানা মুরতাহিন বিল্লাহ দুটি ব্যাপারে অপর সকলের চাইতে অনন্য।
একান্তই বাল্যকালে মাতৃহারা হয়ে মাওলানা মাদানীর খলীফা হযরত মাওলানা আবদুল জলীল মোগ্লাবাজারী (পরে বদরপুরী)-এর পবিত্র হাতে বিসমিল্লাখানির মাধ্যমে শিক্ষাজীবন শুরু করে সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসার ছাত্র থাকা অবস্থায় একান্তই নিজ ইচ্ছায় তিনি ও তার একজন সহপাঠী হাফেয আবদুল মুকীত (কালারুকী ছাতক) মরহুম কোনো উস্তাযের সাহায্য নেয়া ছাড়াই কুরআন শরীফ মুখস্থ করে হাফেয হয়েছিলন।
যখন তাঁর ও তাঁর উক্ত বন্ধু হাফেয আবদুল মুকীতের হিফয সমাপ্ত হওয়ার কথাটি শিক্ষক মহলেও জানাজানি হল তখন কেউ কেউ আফসোস করে বললেন, আগে এ তথ্যটি জানলে এবারের চারিত্রিক পুরস্কার উক্ত দুজনকেই দেওয়া হতো। কিন্তু ততক্ষণে পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানটি সমাপ্ত হয়ে গেছে।
মাদরাসার পাঠ্যকিতাবসমূহের পাশাপাশি কুরআন মুখস্থ করার এ প্রচেষ্টাটি ছিল একান্তই অকল্পনীয় এবং বিশেষ ধৈর্য ও অধ্যবসায় সাপেক্ষ। অথচ মাদরাসার পরীক্ষাসমূহে তিনি সর্বদা তাঁর শ্রেণিতে প্রথম হতেন এবং পূর্ব পাক মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের অধীনে পরিচালিত মাদরাসার আলেম, ফাযিল, কামিল প্রতিটি স্তরেই গোটা পূর্বপাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ)-এর মধ্যে তিনি শীর্ষ তালিকায় ৩/৪ জনের মধ্যেই থাকতেন। কী পরিমাণ প্রখর মেধা, নিষ্ঠা ও প্রবল মনোবল থাকলে এমনটি সম্ভব হতে পারে তা আলেম শিক্ষিত ব্যক্তিমাত্রই অনুধাবন করতে পারেন। অথচ এ মহা কঠিন কাজটি তারা দুই বন্ধু মিলে এত সন্তর্পণে চালিয়ে যাচ্ছিলেন, যা অন্য কারো জানা ছিল না। কারো এ ব্যাপারে প্রণোদনা দান তো দূরের কথা।
মাদরাসায় মাওলানা মুরতাহিন বিল্লাহ জাসির আমার ৩/৪ জামাত উপরেই পড়তেন। আমি ঐ মাদরাসায় ১৯৫৪ সালে ৫ম শ্রেণির প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম দাখেল চাহারমে। সে যুগে দাখেল কোর্স ছিল ছয় বছর। আলিম চার বছর। ফাযিল ও কামিল ক্লাস দুই বছর করে।
তিনি ফুলবাড়ির বিখ্যাত ও প্রাচীন আজিরিয়া মাদরাসা থেকে এসে সিলেট আলিয়া মাদরাসায় আলেম ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলেন। পাঠ্যবহিভূর্ত কার্যক্রমে ছাত্রদের সাপ্তাহিক বিতর্ক-সভায় অনেকসময় আমরা মুখোমুখি হতাম যোগ্য উস্তাযগণের তত্ত্বাবধানে। এছাড়াও দেখা হতো ছাত্র কমনরুমে যোহরের নামাযের ছুটির ফাঁকে পত্রিকা পাঠকালে। সিলেট মাদরাসার ছাত্র কমনরুমে সেকালে দৈনিক আজাদ ও উদূর্ দৈনিক পাসবান রাখা হতো। আমরা দুজনই সেগুলোর রীতিমত পাঠক ছিলাম। বছরান্তে যখন আলিয়া মাদরাসা ১২ জামাত ও হাই মাদরাসার ৪র্থ ক্লাসসহ মোট ষোলটি ক্লাসের ছাত্রদের মধ্যে মেধা, চরিত্র, বিতর্ক প্রতিযোগিতা ও খেলাধুলার বার্ষিক পুরস্কারও দেওয়া হতো তখন পুরস্কার গ্রহণে আমরা দুজনই বেশ এগিয়ে থাকতাম।
ছাত্রজীবনের একপর্যায়ে আমরা দুজনই সিলেট শহরের উপকণ্ঠে সুরমা নদীর তীরবর্তী কলাপাড়া গ্রামে পাশাপাশি বাড়িতে লজিং থাকতাম। তখন দৈনিক বেশ ক’বারই মসজিদে দেখা হতো। এছাড়া মাইল দুয়েক দূরে সিলেট আলিয়া মাদরাসার ক্লাসে যোগদানের জন্যে যাতায়াতকালেও আমরা একত্রে চলতাম।
বড় বড় আলেম-উলামা থেকে উপকৃত হওয়ার ব্যাপারেও আমরা দু’জনেই ছিলাম সমান আগ্রহী। তাই রমযান মাসে সিলেট শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত বন্দর বাজার মসজিদে তারাবীহের নামাযের পর জেলার বিশিষ্ট আলেম শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা মুশাহিদ বাইয়ামপুরীর তাফসীর মাহফিলে আমরা দুজনেই পায়ে হেঁটে তারাবীহের পর গিয়ে শামিল হতাম। দুই-আড়াই ঘণ্টা তাঁর দীর্ঘ জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা শোনার পর সাহরীর পূর্বেই আমরা কলাপাড়ায় ফিরে এসে সাহরী করতাম। যাতায়াতকালে পথে তাঁর সাথে অনেক মতবিনিময় হতো। তাঁর কাছ থেকে অনেক কিছু শিখবার জানবার সুযোগ পেতাম। দু’জনের রুচির অপূর্ব মিল থাকায় আমাদের সে সহাবস্থান অত্যন্ত উপাদেয় ছিল। সে স্মৃতিগুলো প্রায় ষাট বছরের পুরনো হলেও এখনো চোখে লেগে রয়েছে।
মাওলানার দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যও চোখে পড়ার মতো। আগেকার যুগে ফাযিল-কামিল পরীক্ষাসমূহের কোনো সরকারি স্বীকৃতি না থাকায় যারাই মাদারাসা পাশের পর ইংরেজি শিখতে চেয়েছেন তাদেরকে নিজেদের পক্ষ থেকে প্রচুর পড়াশোনা করে প্রবেশিকা (আজকের এসএসসি) পরীক্ষা দিতে হতো। তাতে পাশ করলে কলেজে ভর্তির সুযোগ পাওয়া যেতো। তাই তাঁর পূর্বসূরী মাওলানা ওলিউর রহমান, মাওলানা আবদুল মান্নান ও মাওলানা আবদুল হান্নান (গৌরকরণী কুলাউড়া) মরহুমের মতো তাঁকেও প্রাইভেট পড়াশোনা করে প্রবেশিকায় উত্তীর্ণ হতে হল। সে পরীক্ষায় যথারীতি কৃতিত্বের সাথে পাশ করে তিনি গিয়ে ভর্তি হলেন সিলেট মুরারীচাঁদ কলেজে। সেখান থেকে আইএ পরীক্ষা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিকম-অনার্স ও এমকম পরীক্ষায় কৃতিত্ব সহকারে উত্তীর্ণ হলেন।
কর্মজীবনে প্রথমে তিনি সিলেটের বিশ্বনাথ থানাধীন সৎপুর আলিয়া মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন। ঘটনাচক্রে ঐসময় ঠিক আলিম পরীক্ষার পূর্বক্ষণে মাস দুয়েক আমাকেও উক্ত মাদরাসায় পাঠাভ্যাস করে ঐ মাদরাসা থেকেই মাদরাসা বোর্ডের অধীনে আলিম পরীক্ষা দিতে হয়। তখনো মাস দুয়েক আমরা ঘনিষ্ঠভাবেই সেখানে ছিলাম। যদিও তিনি তখন সে মাদরাসার শিক্ষক আর আমি তাঁরই সহকর্মী অন্য শিক্ষকদের ছাত্র। কিন্তু তাতে আমাদের ঘনিষ্ঠতা বিঘ্নিত হয়নি। ভাগ্যচক্রে দুজনের জীবনের সাথে উক্ত সৎপুর মাদরাসাটি জড়িয়ে গেল।
একাধারে আলকুরআনের হাফেয। ফাযিল হাদীস ক্লাসে হযরত মাদানীর খলীফা মাওলানা আবদুল ওয়াহিদ রাহ., মাওলানা আবদুল হক রাহ., মাওলানা ফজলে হক ফাযিল সাহেব ও মাওলানা আবদুল বারী সাহেবের মত দক্ষ মুহাদ্দিসদের কাছে হাদীস অধ্যয়নকারী এবং পাশাপাশি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী পণ্ডিত। এরূপ চতুর্মুখী শিক্ষায় সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী এ উপমহাদেশে খুবই বিরল। এক কথায় জ্ঞানসাধনাই যেন তাঁর গোটা জীবনের একমাত্র ব্রত ছিল।
কারা ছিলেন তাঁর হাদীসের উস্তাযবর্গ?
কারা ছিলেন সেই উস্তাযবর্গ? আমাদের অপর এক বড়ভাই প্রফেসর মাওলানা আবদুল মান্নান আমাদেরকে তাঁদের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, ফাযিল পাশ করার পর আমরা দুই বন্ধু মনস্থ করেছিলাম টাইটেল ক্লাসের পড়াশোনাটা আমরা ছরছিনা মাদরাসায় গিয়ে করব। কথাটি প্রিন্সিপাল মোহাম্মাদ হোসাইন বাহরুল উলূম সাহেবের কানে যেতেই তিনি আমাদেরকে ডেকে নিয়ে বললেন, উঁচু মানের উস্তাযদের কাছে পড়ার জন্যে তোমরা সেখানে যাবে, তাইতো? শোনো, আমাদের সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসায় যে যোগ্য মুহাদ্দিসগণ রয়েছেন, দেওবন্দ-সাহারানপুর মাদরাসায় গিয়েও এর চাইতে উন্নত মানের শিক্ষক তোমরা হয়ত পাবে না। প্রতিটি নামকরা মাদরাসায়ই জাত উস্তায দু-চারজনই হয়ে থাকেন। ফলে আমরা আর মাদরাসা পরিবর্তন না করে সিলেট মাদরাসায় হাদীস অধ্যয়ন করি। উল্লেখ্য, পূর্বপাক মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষায় উক্ত মাওলানা আবদুল মান্নান গোটা পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন।
আসামে মাওলানা মাদানীর খেদমতে
সাধনার আরেকটি বড় ময়দান হচ্ছে তাসাওউফ সাধনা। এ ব্যাপারে মাওলানা মুরতাহিন বিল্লাহর আগ্রহ বা চেষ্টার কমতি ছিল না। কৈশোরেই হযরত মাওলানা সায়্যিদ হুসাইন আমহদ মাদানীর সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশ্যে তিনি আসামের শিলচর জেলার বাঁশকান্দিতে গিয়ে উপস্থিত হন। উল্লেখ্য, মাওলানা মাদানী রাহ. দীর্ঘ প্রায় কুড়ি বছরকাল সিলেটের নয়াসড়ক মসজিদে রমযানের ইতিকাফ উপলক্ষে পুরো মাস সিলেটে অতিবাহিত করেছেন। তিনি যেহেতু ভারতীয় জাতীয়তায় বিশ্বাসী এবং পাকিস্তান আন্দোলনের বিরোধী ছিলেন তাই ১৯৪৭ সালে গণভোটের মাধ্যমে সিলেট পাকিস্তানভুক্ত হওয়ার পর সিলেটে আর তাঁর আগমনের সুযোগ ছিল না। অগত্যা আসামের বাঁশকান্দিতে তাঁর সেই সাধনার কেন্দ্র স্থানান্তরিত হয়ে যায়।
ঐ সময়ে তিনি মাওলানা মাদানীর জমজমাট মজলিস, শায়খে কাতিয়া মাওলানা আমীনুদ্দীন মরহুমের স্বেচ্ছাসেবী তৎপরতা, শায়খে গওহরপুরী হাফেয মাওলানা নূরুদ্দীন ও শায়খে গাজীনগরী মাওলানা আব্দুল হকের খেলাফত লাভের দৃশ্য নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করেন। পরবর্তীকালে গল্পচ্ছলে এগুলো তিনি আমাকে বলেছেন।
তখনো তিনি কিশোর একজন ছাত্র মাত্র। তাই মুরীদ হওয়ার বয়স ছিল না। শেষ বয়সে এসে মাওলানা আবদুল জলীল বদরপুরী রাহ.-এর খলীফা তৈয়বুর রহমান বড় লশকর সাহেবের সাথে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন। ঢাকায় মাওলানা মুরতাহিন বিল্লাহর মোহাম্মাদপুর হুমায়ুন রোডস্থ বাসভবনে তাঁর আগমনকালে কয়েক বছর পূর্বে আমার তাঁর সাথে দেখাও হয়েছিল এবং তাঁকে আমি মাসিক আলকাউসারের একটি ভলিউমও উপহারস্বরূপ দিয়েছিলাম এই আশায় যে, আসাম তথা পূর্বভারতের ‘সাতকন্যা’ বলে খ্যাত এলাকায় আমাদের আওয়াজটা তাঁর মাধ্যমে পৌঁছে যাবে। মাওলানা তৈয়বুর রহমান মাওলানা বদরপুরীর খলীফা হিসেবে পূর্বভারতের ‘আমীরে শরীয়ত’রূপে বরিত ব্যক্তিত্ব। তিনি মাওলানা মুরতাহিন বিল্লাহর সহযোগিতায় বেশ কয়েক বছরই সিলেট সফর করেছেন এবং তাঁদের ঘনিষ্ঠতাও লোকজনের বেশ চোখে পড়েছে। তিনি যে আধ্যাত্মিকভাবে তাঁর সাথে যুক্ত হয়েছিলেন তা আমার কাছে তিনি প্রকাশ করেছিলেন।
কর্মজীবনে মাওলানা মুরতাহিন বিল্লাহ ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা কলেজের প্রভাষক পদে, তারপর বাংলাদেশ সরকারের সচিবালয়ের উন্নয়ন ও প্রকল্প বিভাগের গবেষক পদে কিছুকাল চাকরি করার পর জেদ্দাস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে অনুবাদক পদে যোগদান করেছিলেন। এরপর একপর্যায়ে তিনি জিদ্দাস্থ ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের গবেষণা অফিসার পদে নিযুক্তি লাভ করেন এবং দীর্ঘ প্রায় ত্রিশটি বছর সেখানেই প্রথমে গবেষণা অফিসার তারপর ২০০৫ সাল পর্যন্ত পরামর্শক পদে চাকরি করেন। আশির দশকের শুরুতে আমি জেদ্দায় অবস্থিত তাঁর বাসভবনে তাঁর একান্ত আতিথ্য উপভোগ করেছি। অফিস থেকে এসেই তিনি তার ছেলেদুটোকে পাঠদান করতে লেগে গেলেন। ক্লান্তিতে একপর্যায়ে পিতাপুত্র সকলেই নিদ্রাভিভূত হয়ে পড়লেন। সাথে সাথে আমিও সোফায় গা এলিয়ে দিলাম। তারপর আবার খাবার সময় নিদ্রা থেকে জেগে সকলেই খাবার খেলাম। বিদেশ বিভুঁইয়ে আপন সন্তানদের লেখাপড়ার ব্যাপারে তিনি এত বেশি যত্নবান, চাকরির ফাঁকে ফাঁকে তাদের লেখাপড়ার বিষয়টিও পূর্ণোদ্যমে চালিয়ে যাচ্ছেন দেখে আমি সেদিন খুবই অভিভূত হই। একাধারে দ্বীন ও দুনিয়ার কাজ দায়িত্বশীলতার সাথে সফলভাবে চালিয়ে যাওয়া যে কী কঠিন কাজ, তা চিন্তাশীল ব্যক্তিরাই অনুধাবন করতে পারেন। রমযানে তাঁর নিবেদিত সম্মোহিত ভাব ছিল দর্শনীয় ও উপভোগ্য।
মাওলানা মুরতাহিন বিল্লাহর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাঁর স্বজাত্যবোধ ও সচেতনতা। তিনি যেমন চিনতেন নিজের জাতিকে তেমনি হাড়ে হাড়ে চিনতেন তার শত্রুদেরকেও। পার্শ্ববর্তী হিন্দু জাতি ও বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্রে অহর্নিশ মুসলিম নির্যাতনের প্রতি ছিল তাঁর তীব্র সতর্ক-দৃষ্টি। এ ব্যাপারে তিনি গভীর পড়াশোনা করেছেন এবং অনেক লেখালেখি করেছেন। তাই কুরআন-হাদীস নিয়ে লেখালেখির ফাঁকে ফাঁকে তিনি হিন্দুধর্ম ও ভারতে মুসলিম নির্যাতনের বিষয়াদি নিয়ে এত বেশি লেখালেখি করেছেন যে, মনে হয় এটি তাঁকে সর্বদা অস্থির করে রখতো। এ বিষয়ে তাঁর লিখিত বইগুলো হচ্ছে :
১। জেদ্দা থেকে প্রকাশিতÑ
Hinduism and Islam : A Comparative study (1997)
পুস্তকটি সৌদিআরব, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বিখ্যাত ধর্মতত্ত্ববিদ ও ইসলামপ্রচারক আহমদ দিদাত রাহমাতুল্লাহি আলাইহি অসুস্থ অবস্থায় তা অন্যকে দিয়ে পড়িয়ে শুনে অত্যন্ত সন্তোষ প্রকাশ করেন বলে তার জামাতা জেদ্দায় মাওলানাকে জানিয়েছেন।
২। Hindu chauvinism and Muslims of India
এটি ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর তারিখ হিন্দু উগ্রবাদীদের হাতে অযোধ্যার ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ শহীদ হওয়ার পর লিখিত তার অগ্নিগর্ভ রচনা। এর বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার হিন্দুরা সেখানে তার কুশপুত্তলিকা দাহ করে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল। বিদেশে বসে লিখিত তার এ গ্রন্থটির তীব্র প্রতিবাদ হল সুদূর আফ্রিকা মহাদেশে। কেমন সে লেখাটি আর কেমন তীব্র সে প্রতিবাদ! আমাদের দেশের কোনো লেখকের কোনো পুস্তক বিদেশে এত তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছেÑ এমন সংবাদ কি কেউ কোনোদিন শুনেছেন!
৩। আলমুসলিমুন ওয়াত তাতাররুফ আলহুন্দুসী ফিল হিন্দ
এটি মাওলানার দ্বিতীয় পুস্তকটির আরবী, যা জেদ্দা থেকে প্রকাশিত হয়ে সারা বিশ্বে প্রচারিত হয়েছে।
৪। হিন্দুধর্ম ও ইসলাম : জানা-অজানা কথা
এটি আগের দ্বিতীয় ইংরেজি পুস্তকটির বর্ধিত ও সমৃদ্ধতর বাংলা, যা তিন শতাধিক আরবী, উর্দু, বাংলাভাষ্য, ইংরেজি ফার্সি উঁচু মানের গ্রন্থের উদ্ধৃতিসহ অত্যন্ত সুলিখিত একটি গ্রন্থ।
আমার মতে এটি মাওলানা মুরতাহিন বিল্লাহ জাসিরের এমন একটি অনন্য গ্রন্থ, যা আমাদের স্কুল-কলেজ-মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যতালিকায় স্থান পাওয়া উচিত। পুস্তকের কলেবর নির্ঘণ্টসহ মাত্র দুই শ কুড়ি পৃষ্ঠা। কিন্তু হাজার পৃষ্ঠার একটি গ্রন্থেও এত বেশি তথ্য ও তত্ত্ব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আমার মতে এ পুস্তকটি তাঁকে অমর করে রাখবে।
৫। রাম ও কৃষ্ণ চরিত
এটি আসলে হিন্দু ধর্মের প্রতি চরম বিতৃষ্ণ হয়ে তিন লক্ষাধিক শিষ্যসহ বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণকারী ভারতের আইন রচয়িতা ও প্রথম আইনমন্ত্রী বাবাসাহেব আম্বেদকরের ১০ খণ্ডে লিখিত বিখ্যাতÑ জরফফষবং ড়ভ ঐরহফঁরংস গ্রন্থের রাম ও কৃষ্ণ চরিত অংশের বঙ্গানুবাদ। এ পুস্তকটি ভারত সরকার বাজেয়াপ্ত করে রেখেছিল। অবশেষে এই বাজেয়াপ্তকরণ প্রত্যাহারের দাবিতে বোম্বের দশ লক্ষ দলিতের তীব্র প্রতিবাদ মিছিলের পর ভারত সরকার এ বাজেয়াপ্তাদেশ প্রত্যাহার করেছিল। মাওলানার অনূদিত পুস্তকটি সর্বপ্রথম আমিই সম্পাদনা করে ঢাকা থেকে প্রকাশ করেছিলাম গত শতকের নব্বইয়ের দশকে। পরে মাওলানা নিজে তা আরো উন্নত ছাপা কাগজে উত্তমরূপে প্রকাশ করেছিলেন। এ পুস্তকটি পাঠে যে কোনো গোঁড়া হিন্দুও তার অনুসৃত ধর্মের অসারতা ও অলীকতার ব্যাপারটি অনুধাবন করতে পারবে।
একজন আলেম হিসাবে তিনি ধর্মীয় গ্রন্থাদি লিখবেন ও প্রচার করবেন এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। তাই তিনি একে একে লিখেছেন :
১) আলমুনাব্বিহাত-এর অনুবাদÑ যার তিনি নামকরণ করেছেন ‘জাগরণী’।
তবে এতে আপত্তির দিক হল, আলমুনাব্বিহাত বইটি ইবনে হাজার আসকালানী রাহ.-এর নামে চালিয়ে দেওয়া হলেও এটি কিন্তু তাঁর সংকলন নয়। তাছাড়া এতে রয়েছে অনেক মুনকার ও মওযু বর্ণনা। আল্লাহ মাওলানাকে ক্ষমা করে দিন। তিনি খেয়াল করেননি।
২) আমপারার তাফসীরÑ মধ্যম সাইজের একটি তাফসীরগ্রন্থ, যাতে বিশেষত : নামাযে পঠিতব্য, কুরআনের শেষ সূরাগুলোর মনোজ্ঞ অনুবাদ ও তাফসীর তুলে ধরা হয়েছে।
৩) Radiun : saying of the Prophet
তাঁর ইতিহাসাশ্রয়ী মনোজ্ঞ পুস্তকসমূহের মধ্যে রয়েছে :
১. Wit and wisdom of Famous People
২. আমাদের সোনালী অতীত (কিশোর পাঠ্য) মনোজ্ঞ পুস্তক।
৩. মাওলানা আবদুল জলীল : জীবন ও সংগ্রাম
তার ইসলাম প্রচারমূলক পুস্তকগুলোর মধ্যে আছে :
ক. ফতোয়া কী ও কেন?
খ. বাইবেলের সাক্ষ্য : বাইবেল আসমানী গ্রন্থ নয়।
Food for Thought (চিন্তার খোরাক) শিরোনামে তাঁর ইংরেজিতে রচিত চয়নিকা পুস্তকটি প্রকাশের ঘোষণা দিয়েছিলেন; যা আলোর মুখ দেখেনি।
মাওলানা মুরতাহিন বিল্লাহ জাসির অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে তাঁর পুস্তকগুলো প্রকাশ ও প্রচার করেছেন। তিনি যেহেতু পুস্তক ব্যবসায়ী ছিলেন না, তাই অসৎ কিছু ব্যবসায়ী বই বিক্রি করে দেয়ার কথা বলে তার কাছ থেকে পুস্তকগুলো নিয়ে যেতো। অধিকাংশ পুস্তকের মূল্য তিনি আর ফেরত পাননি। প্রচারেই যেহেতু তাঁর মনের শান্তি, তাই এ নিয়ে তাঁর তেমন কোনো আফসোসও ছিল না।
দীর্ঘ তিন দশক বিদেশে অবস্থানের পর দেশে ফিরে শেষ জীবনে তিনি বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায় লেখা-লেখি করেছেন। মাসিক মদীনা, মাসিক আলকাউসার, মাসিক নেয়ামত ও দৈনিক নয়া দিগন্তে তাঁর অনেক মূল্যবান রচনা শেষ জীবনে প্রকাশিত হয়েছে। এগুলো সংকলিত করে প্রকাশ করলে একটি গবেষণা পুস্তকরূপে তা বিবেচিত হতে পারে। এগুলো থেকে পরবর্তী প্রজন্ম উপকৃত হবে।
মাওলানার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য
তিনি সুন্নতের অত্যন্ত পাবন্দ ছিলেন। অট্টহাস্য করতেন না। কিন্তু কথার ফাঁকে কখনো কখনো হাসতেন। তাতে তাঁর উজ্জ্বল দন্তরাশি উন্মোচিত হলেও তেমন কোনো আওয়াজ হতো না। সে দৃশ্য মধুর হতো।
তিনি অত্যন্ত বিনয়ী চরিত্রের লোক ছিলেন। বয়সে আমি ছিলাম তাঁর অনুজসম। অথচ একজন লেখক হিসেবে তিনি আমাকে অত্যন্ত সমীহ করতেন এবং ভালবাসতেন। তাঁর ‘হিন্দুধর্ম ও ইসলাম’ গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি দরাজ দিলে আমার প্রশংসা করে এমনভাবে আমার কথা উল্লেখ করেছেন তাতে পাঠকমাত্রই তাঁর মহানুভবতার কথা উপলব্ধি করবেন। তাঁর লিখিত ‘আমপারা তাফসীর’-এর কপি আমাকে দিতে গিয়ে তিনি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলেন, এ পথ তো আপনিই আমাকে দেখিয়েছেন। আমার লিখিত সহজ কুরআন অনুবাদ ‘ইয়াস সারনাল কুরআন’-এর দিকে ইঙ্গিত করেই তিনি একথাটি বলেন, যার কয়েক কিস্তি (সূরা আনআম পর্যন্ত) মহানবী স্মরণিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন এবং ৬ই রমযান (১৯ এপ্রিল) তারিখে তিনি ইন্তেকাল করেন। ইন্তেকালের পূর্বে একাধিকবার মৃত্যুশয্যা থেকে আমার সাথে মোবাইল ফোনে কথা বলেন। ইন্তেকালের সময় তার বয়স হয়েছিল প্রায় ৮৫ বছর। তাঁর জন্ম হয়েছিল ১৯৩৭/৩৮ সালের দিকে সিলেট সদর থানার ফুলবাড়ী পূর্ব পাড়ায়।
একজন আলেম হিসেবে বিভিন্ন ধর্মীয় মাহফিল ও মাদরাসার বার্ষিক মাহফিলে তিনি আহূত হতেন এবং আন্তরিকতার সঙ্গে সেগুলোতে আলেম-উলামার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করতেন। ফেরার সময় চুপি চুপি মাদরাসার ছাত্রদের জন্য দানও করে আসতেন। ১০/১২ বছর পূর্বে একবার মৌলভিবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল থানাধীন বরুনা মাদরাসায় আমরা একত্রে আমন্ত্রিত হই। মাদরাসার বার্ষিক সভায় শায়খে বর্ণবী রাহ.-এর ভক্তদের বিশাল সমাবেশ ছিল সেটি। বক্তাও ছিলেন অনেক। ঢাকা থেকে যাওয়া মেহমানদের মধ্য থেকে মাওলানা আমাকেই মঞ্চের দিকে ঠেলে দিলেন এবং বললেন, আমাদের পক্ষ থেকে বক্তব্য কেবল আপনিই দেবেন! অথচ বয়সে ও জ্ঞান-গরিমায় তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য।
অমায়িক ও অতিথি পরায়ণ
মাওলানা মুরতাহিন বিল্লাহর ব্যবহার ছিল অমায়িক। জীবনে কাউকে রুক্ষ ব্যবহারের দ্বারা কষ্ট দিয়েছেনÑ তা বিশ্বাস হয় না। তাঁর অতিথি পরায়ণতাও ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তাঁর সাথে দেখা করতে গিয়েছি আর তিনি না খেয়ে আসতে দিয়েছেনÑ তেমনটি খুব স্মরণে পড়ে না। কোনো সামাজিক ব্যাপারে টেলিফোনে কোনো কথাবার্তা হলেই তিনি একাধিক বন্ধু-বান্ধবকে তারই বাসায় একত্র হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সকলের মেহমানদারির ব্যবস্থা করতেন। এযুগে বিশেষতঃ শহুরে পরিবেশে এরূপ অতিথিপরায়ণতা খুব একটি চোখে পড়ে না।
তিনি তাঁর পিতা ও উস্তাযদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উদ্দেশ্যে নামের সঙ্গে ‘ফযলী’ ও ‘জাসির’ যোগ করেন।
ফযলী ছিল তার উস্তায ফযলে হক ফাযিল সাহেবের স্মরণে আর নামের ‘জাসির’ অংশ তাঁর পিতার প্রতি শ্রদ্ধাবশত। পিতা-মাতার নামে প্রতিষ্ঠা করেন তাকিয়া-জাসির নূরানী মাদরাসা এবং প্রথম উস্তাযের নামে মাওলানা আবদুল জলীল সাবাহী মকতব। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যয়ভার তিনি নিজেই বহন করতেন। সামাজিক কাজকর্মে তিনি অত্যন্ত উৎসাহবোধ করতেন। জিদ্দায় অবস্থানকালে তিনি সেখানে বৃহত্তর সিলেট সমিতির সভাপতি ছিলেন। জিদ্দায় ইসলামিক এডুকেশন ফাউন্ডেশনে মাসিক বাংলা সেমিনারের তিনি ছিলেন অন্যতম উদ্যোক্তা ও বক্তা। সিলেট কেন্দ্রীয় সাহিত্য সংসদের তিনি ছিলেন অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ও আজীবন সদস্য। ১৯৭৭ সালে জিদ্দায় অনুষ্ঠিত প্রথম World Islamic Education Conference-এ মরহুম অধ্যাপক সৈয়দ আলী আশরাফের সহযোগী হিসাবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর প্রথম উস্তায মাওলানা আবদুল জলীল বদরপুরী রাহ.-এর স্থলাভিষিক্ত মাওলানা তৈয়বুর রহমান বড়লশকরকে নিয়ে তিনি সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চলে তার উস্তাযের ফয়েয বিতরণে সক্রিয় ছিলেন।
মৃত্যুর পরদিন সিলেটের সদর থানাধীন গোলাপগঞ্জ ফুলবাড়ি পূর্বপাড়ায় তাঁর পৈত্রিক গোরস্থানে পিতা-মাতার পাশে এই হাফেযে কুরআন আলেমেদ্বীন মাওলানা মুরতাহিন বিল্লাহকে অন্তিম শয্যায় সোপর্দ করা হয়।
আল্লাহ তাআলা ইসলামের নিবেদিত প্রাণ এ মনীষীকে জান্নাতের উচ্চতম মাকাম দান করুনÑ আমীন।
একটি অপূর্ণ বাসনা
সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসার প্রাক্তন ছাত্রদের মধ্যে অধ্যাপক মাওলানা আবদুল মান্নান, মাওলানা মুরতাহিন বিল্লাহ জাসির ও ঢাকা তিব্বিয়া কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাওলানা ইব্রাহীম আলীকে নিয়ে সিলেট মাদরাসার শতবার্ষিকী পালনের একটি উদ্যোগ ২০১০-১৪ সালে আমি গ্রহণ করেছিলাম। মাওলানার মোহাম্মাদপুর হুমায়ুন রোডের বাসায় এর একাধিক বৈঠকও হয়েছিল।
কিন্তু তখনকার রাজনৈতিক পরিবেশ উত্তপ্ত থাকায় আমরা খুব একটা এগুতে পরিনি। মাওলানা মুরতাহিন বিল্লাহ জাসির ও আমি একাধিকবার এ উপলক্ষে সিলেটে সফরও করি। কিন্তু সে মাদরাসায়ও কোনো আলেম প্রিন্সিপাল না থাকায় মাদরাসার আলেম শিক্ষকবৃন্দকে অনেকটাই বিধ্বস্ত মনমরা অবস্থায় দেখতে পাই। তারপর মাওলানা আবদুল মান্নান সাহেবের ইন্তেকালে আমরা আরো পিছিয়ে যাই। এ অনুষ্ঠানটি করতে না পারায় মাওলানা মুরতাহিন বিল্লাহর অনেকটা আশাভঙ্গ হয়। আমাদের ইচ্ছা ছিল, সিলেট মাদরাসার সোনালী অতীত জাতিকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার মাধ্যমে দ্বীনী চেতনার একটা জোয়ার বহিয়ে দেয়া। মাওলানার মৃত্যুতে এখন আমরা আরো পিছিয়ে গেলাম। প্রতিষ্ঠার ১০৭ বছর অতিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করতে না পারায় দুঃখ নিয়েই মাওলানা বিদায় নিলেন। পরবর্তী প্রজন্মের আলেমগণ যদি একটু বিলম্বে হলেও এ গৌরবপূর্ণ ইতিহাসটা পুনঃজাগ্রত করতে পারেন, তাহলে মাওলানার আত্মাও শান্তি পাবে।
নাম ভুল হওয়ার স্বীকারোক্তি ও নামের সার্থকতা
তার নামটি এমন বিরল নাম, যা দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে ভ্রমণের ও বহু গ্রন্থ পাঠের সুযোগ হলেও আর কারোই আমি দেখিনি বা পাইনি। কিন্তু তাঁর আসল নামের উচ্চারণটি যে ভুল, তা কোনো আলেমের নজরেও পড়েনি। জীবনে অন্তিম পর্যায়ে সম্ভবত সর্বশেষ হজে¦র সময় তিনি হেরেম শরীফের একজন বুযুর্গ ধরনের কাতিবের হাতে তাঁর নামটি লেখাতে আগ্রহ প্রকাশ করলে কাতিব তার নাম কী জিজ্ঞেস করল। উক্ত বুযুর্গ একনজর তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, ভুল উচ্চারণ, আপনার আসল নাম তো ‘মুরতাহান বিল্লাহ’। (আল্লাহর কাছে বন্ধকিকৃত)
মাওলানা আমাকে বলেন, আসলেই তো ঐ বুযুর্গ সত্য কথাটিই বলেছেন! আমার আসল নাম হবে মুরতাহান বিল্লাহ!
কী সরল স্বীকারোক্তি! এত বড় একজন বিজ্ঞ লোক এভাবে নিজের আজীবন চর্চিত নামটি যে আজীবন ভুলভাবে উচ্চারিত হয়েছে ও লিখেছে তা অকপটে ও নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নিলেন! ঐ বুযুর্গ কাতিবের লিখিত সেই مرتهن بالله লিপিটি তিনি অত্যন্ত যত্নসহকারে কাঁচের ফ্রেমে সংরক্ষণ করে রেখেছেন। যা আজও তাঁর সংরক্ষণে রয়ে গেছে!
মুরতাহান বিল্লাহ নাম রেখে তাঁর পিতামাতা তাঁকে আল্লাহর কাছে বন্ধক রেখে আদৌ ঠকেননি; বরং হাজারগুণ বেশি লাভবান হয়েছেন। এই মাতৃহারা বালকটি কালক্রমে আল্লাহর কুরআনের হাফেয, দ্বীনের আলেম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতম আধুনিক শিক্ষার উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণ করে দ্বীন ও দুনিয়ার শীর্ষ উন্ননি লাভ করে তাঁর নামের সার্থকতা প্রকাশ করে গেছেন!