ফিলিস্তিনের মজলুম মুসলমান : কিছু কথা কিছু ব্যথা
[গত ২ মে-এর মধ্যে চারটি ফিলিস্তিনী পরিবারকে ইসরাইলী আদালত বাড়ি ছাড়ার আদেশ জারি করার পর তাদের বাড়িতে ফিলিস্তিনীরা জড়ো হলে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে ৬ মে বৃহস্পতিবার পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বাধে। এতে অন্তত ২০জন আহত ও ১৫জন গ্রেফতার হয়। পরদিন শুক্রবার মসজিদে আকসায় জুমার নামায আদায়ের পর হাজার হাজার মুসল্লী এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেন। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে ইসরাইলী পুলিশ রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে। বিক্ষোভকারীরাও পুলিশকে লক্ষ্য করে পাথর নিক্ষেপ করে। এতে ২০৫জন ফিলিস্তিনী ও ১৭জন ইসরাইলী পুলিশ আহত হয়।
টানা দুই-তিন দিন সংঘর্ষের পর ২৭ রমযানুল মুবারক (১০ মে) সোমবার বায়তুল মাকদিসে তারাবীর নামাযরত মুসল্লীদের উপর এক সাঁড়াশি অভিযান চালায় ইসরাইলী বাহিনী। এতে বিক্ষোভকারীদের সাথে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এ সংঘর্ষেও ৩০০জন ফিলিস্তিনী ও ইসরাইলী বাহিনীর ২০জন সদস্য আহত হয়। এরপর ফিলিস্তিনের ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস মসজিদে আকসা চত্বর ও শেখ জাররাহ এলাকা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের প্রত্যাহারের জন্য সময়সীমা বেঁধে দেয়। নির্ধারিত সময়ে ইসরাইল তাদের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের প্রত্যাহার না করলে হামাস ইসরাইলের বিভিন্ন শহরে রকেট নিক্ষেপ করে। যার অধিকাংশই ইসরাইলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আটকে দেয়। এর জবাবে ইসরাইল বিমান হামলা চালানো শুরু করে। এপি ও আলজাজিরা কার্যালয়সহ বিভিন্ন স্থাপনায় চলে ইসরাইলের বোমা হামলা। গাজা পরিণত হয় ধ্বংসের নগরীতে। ১১ দিন স্থায়ী এই সংঘর্ষে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান মতে, ২৩২ জন ফিলিস্তিনী শহীদ হয়। যাদের মধ্যে ৬৫ জন শিশু। আহত হয় ১ হাজার ৯০০ জন। এছাড়া গৃহহীন হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার।
২০১৪-এর ইসরাইল-হামাস সংঘাতের পর এবারের সংঘাতকেই বলা হচ্ছে সবচেয়ে ভয়াবহ। তবে এবারে সর্বাধিক আলোচিত বিষয় ছিল, ইসরাইলের অভ্যন্তরে সুর্নিদিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে হামাসের একটানা রকেট ছোঁড়ার সক্ষমতা। ইসরাইলের অত্যাধুনিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা আয়রন ডোমকে ফাঁকি দিয়ে এসব রকেট হাইফা ও তেলআবিবসহ ইসরাইলের বিভিন্ন শহরে আঘাত হানে। মাত্র ৫ মিনিটেই হামাসের ১৩৭ টি রকেট নিক্ষেপের ঘটনা ইসরাইলকে হতবাক করে দেয়। ইসরাইলি সেনাবাহিনী বলছে, হামাস এবার ৪ হাজার ৩০০-এরও বেশি রকেট ছুঁড়েছে। এতে ১২জন ইসরাইলি নিহত হয়েছে। যাদের মধ্যে ১জন সেনাসদস্যও রয়েছে। ২০ মে রাতে মিশরের মধ্যস্থতায় দু’পক্ষ যুদ্ধ বিরতিতে সম্মত হয়।
এ যুদ্ধে হামাসই জয়ী হয়েছে- এমনটাই বলেছেন বিশ্লেষকগণ। ১১ দিন চলা এ যুদ্ধে কী শিক্ষা রয়েছে মুসলিম বিশে^র রাষ্ট্রপ্রধানদের জন্য এবং কী বার্তা রয়েছে মজলুম ফিলিস্তিনীদের পক্ষ থেকে খোদ ইসরাইলের জন্য- তার খানিকটা আলোচনা উঠে এসেছে পাকিস্তানের জি-নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)-এর প্রেসিডেন্ট, প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট হামিদ মীরের দুটি লেখায়। মাসিক আলকাউসারের পাঠকবর্গের জন্য তাঁর সে লেখাদুটোর অনুবাদ ছাপা হল।
অনুবাদ করেছেন- মাওলানা আবদুল্লাহ ফাহাদ]
১. ভ্রান্তিটা এখন শোধরে নিন
কেউ ভুল বুঝে থাকলে শোধরে নিন। গাজাকে ধ্বংসস্তুপে পরিণতকারীদের দৃষ্টি পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়েই। তাদের নেতৃবৃন্দ সৌদি আরব ও ইরান থেকে নিয়ে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান পর্যন্ত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম দেশের মানচিত্র ও সীমানায় পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা করে রেখেছে। আরব দেশগুলি ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেও দেখেছে, ফিলিস্তিনীদের উপর ইসরাইলের জুলুম-নির্যাতনে কোনো হ্রাস ঘটেনি। আর ২০২১-এর রমযানুল মুবারকে বাইতুল মাকদিস থেকে গাজা পর্যন্ত পুরো এলাকায় ইসরাইল নিজেদের শক্তি ও ক্ষমতার যে অমানবিক প্রকাশ ঘটিয়েছে এর পরও ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কথা বলা মূলত ইসরাইল সরকারের কৃত অপরাধের সাথে শরিক হওয়ার শামিল। ইসরাইল সরকার ‘সেলফ ডিফেন্স’ (আত্মরক্ষা)-এর নামে গাজায় ছোট ছোট শিশুর বুক ঝাঁঝরা করে অনেক ইহুদীকেও ইসরাইলের সমালোচনা করতে বাধ্য করেছে।
লন্ডনের পথে পথে অনেক অর্থোডকস ইহুদী নেতাকেও মুসলমানদের সাথে মিলে ফিলিস্তিনীদের পক্ষে শ্লোগান দিতে দেখা গেছে। ইসরাইলের জুলুম-নির্যাতনের প্রতিবাদে শুধু মুসলমানই নয়; বরং খ্রিস্টান ও ইহুদীরাও রয়েছে। খোদ ইসরাইলেও এমন অনেকে আছেন, যারা জায়নবাদী চেতনার বিরুদ্ধে।
এখন সময় এসেছে, আমাদের জায়নবাদ ও ইহুদীবাদের মধ্যে পার্থক্য বোঝার এবং ইসরাইল সরকারের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী ইহুদীদের সাথে মিলে জায়নবাদী পরিকল্পনাকে বিশ^ব্যাপী তুলে ধরার। ইসরাইল পৃথিবীর একমাত্র রাষ্ট্র, যা ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও আজ পর্যন্ত এর সীমান্ত চূড়ান্ত হয়নি।
১৯৬৭ ও ১৯৭৩-এর আরব যুদ্ধের সময় ইসরাইল নিজেদের সীমান্তরেখায় পরিবর্তন আনে। আর বিগত কয়েক বছর যাবৎ জাতিসংঘের সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আবারও নিজেদের সীমানা বৃদ্ধি করে চলছে। ভারতের নরেন্দ্র মোদী সরকারও ইসরাইলের এই নীতি গ্রহণ করেছে এবং জাতিসংঘের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে ৫ আগস্ট ২০১৯ সালের পর থেকে অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীর রাষ্ট্রের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে সংখ্যালঘুতে রূপান্তরের চক্রান্ত করে চলেছে। তবে বর্তমান করোনা ভাইরাস এই পথে বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একটা অদ্ভুত মিল হল, ইসরাইলকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য যে শক্তি পাকিস্তানের উপর সবসময় চাপ প্রয়োগ করে আসছে তারাই এখন চায়, পাকিস্তান যেন শান্তি আলোচনার নামে ভারতের কাছে কাশ্মীরকে সোপর্দ করে দেয়। যেন ইসরাইল আজ গাজায় যা করছে তার সবই ভারত আগামীতে কাশ্মীর ভূ-খণ্ডে করতে পারে।
পাকিস্তান মুসলিম বিশে^র পারমাণবিক শক্তির অধিকারী একমাত্র রাষ্ট্র। কিন্তু চিন্তার বিষয় এই যে, পারমাণবিক শক্তি অর্জনের আগে পাকিস্তানের প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল অনেক বেশি। পারমাণবিক শক্তি অর্জনের পর থেকে পাকিস্তান রাষ্ট্র এই বিচারে বহির্শক্তির প্রতি নমনীয় হয়ে পড়েছে যে, তার উপর সর্বদা কোনো না কোনো দিক থেকে ‘ডু মোর’ (আরো কিছু করো)-এর চাপ থাকে।
ভালো খবর এই যে, ইমরান খানের সরকার ইসরাইল বিষয়ে এখনও এমন নমনীয়তা প্রদর্শন করেনি, যা কোনো কোনো ভ্রাতৃপ্রতীম ইসলামী দেশ আশা করেছিল। ইমরান খানের যত বিরোধিতাই করুন, ইসরাইলের বিষয়ে তার অবস্থান শুধু পাকিস্তানী জনগণেরই নয়; বরং বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমেরই প্রতিনিধিত্ব করে। তিনি এখনও ইসরাইলের স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেছেন এবং ফিলিস্তিনীদের বিরুদ্ধে ইসরাইলী হামলার সমালোচনা করেছেন।
সমালোচনার চেয়ে বেশি কিছু তিনি করতেও পারবেন না। কেননা যুলফিকার আলী ভুট্টোর পরিণতি তিনি ভুলে যাননি।
আজকের তরুণ প্রজন্ম, যারা সব নির্বাচনেই ‘যিন্দা হ্যায়, ভুট্টো যিন্দা হ্যায়’ (বেঁচে আছেন, ভুট্টো বেঁচে আছেন) শ্লোগান শুনে আসছে, তাদেরকে পিপলস পার্টির আজকের নেতৃত্ব এই কথা বোঝাতে সমর্থ হয়নি যে, ১৯৭৩ সালের রমযান মাসে যখন আরব-ইসরাইল যুদ্ধ হয় তখন যুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তান বিমানবাহিনীর পাইলটকে সিরিয়া ও জর্ডানে প্রেরণ করেছিলেন। এসব পাকিস্তানী বিমানসেনা ইসরাইলের বেশ কয়েকটি বিমান ভূপাতিত করেছিল। উত্তর কোরিয়াও এই যুদ্ধে তাদের ২০জন পাইলটকে মিসর পাঠিয়ে ছিল। অন্যদিকে সৌদী আরব, কুয়েত, মরক্কো, লেবানন ও সুদানও ইসরাইলের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে সেনা প্রেরণ করেছিল।
সে যুদ্ধে আমেরিকা পুরোদস্তুর ইসরাইলের সহযোগিতা করেছে। আরব দেশগুলো বাইতুল মাকদিসকে ইসরাইলের গ্রাস থেকে মুক্ত করতে না পারলেও তারা প্রথমবারের মতো তেলকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। এই যুদ্ধের কিছুদিন পর ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লাহোরে মুসলিম দেশগুলোর শীর্ষ নেতাদের একটি কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। এতে মিসরের রাষ্ট্রপতি আনওয়ার সাদাত ও লিবিয়ার রাষ্ট্রপতি মুয়াম্মার গাদ্দাফী একই বিমানে লাহোর আসেন। পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাতকে কুয়েতের আমীর নিজের বিমানে করেই নিয়ে আসেন।
সিরিয়ার আরব সমাজবাদী রাষ্ট্রপতি হাফিজ আসাদ ও সৌদী আরবের বাদশাহ ফয়সাল একসাথে ভুট্টোর সাথে লাহোরের বাদশাহী মসজিদে বাইতুল মাকদিসের আযাদীর জন্য দুআ করেন। পাঞ্জাব পরিষদের সামনের মিনারটি আজও সেই ঐতিহাসিক কনফারেন্স-এর সাক্ষী হয়ে আছে। তবে এই কনফারেন্স-এর পর বাদশাহ ফয়সাল, ভুট্টো ও আনোয়ার সাদাত পর্যায়ক্রমে ষড়যন্ত্রের শিকার হতে থাকেন।
ইসরাইল শান্তি আলোচনার নামে আরব বিশ^কে বিভক্ত করেছে এবং তাদেরকে পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। পারমাণবিক শক্তি অর্জনের আগে ইসরাইলের বর্বর হামলার বিরোধিতা করার সাহস পাকিস্তানের ছিল। ভুট্টোর ফাঁসির পর এমনটি আর কখনও হয়ে ওঠেনি। ১৯৯৮ সালে পাকিস্তানে পারমাণবিক শক্তি অর্জনকারী প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফও আজ দেশান্তরে আছেন।
ইসরাইলের সমালোচনা করলেও আমাদের নেতারা ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার সাহস দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। আমাদেরকে যারা ইসরাইলের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন, তাদের প্রতি নিবেদন, জায়নবাদী চিন্তার আড়ালে ‘গ্রেটার ইসরাইল’ গঠনের পরিকল্পনা বুঝতে চেষ্টা করুন। হিন্দু কট্টরপন্থীরা আজ যেভাবে পুরো দক্ষিণ এশিয়াকে অখণ্ড ভারতে পরিণত করতে চায়, তেমনি কট্টর জায়নবাদীরাও নীলনদ উপত্যকা থেকে ফোরাত নদী পর্যন্ত গ্রেটার ইসরাইল গঠনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চায়। যা জর্ডান, সিরিয়া ও সৌদি আরবের অনেক অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত।
কট্টর জায়নবাদী কর্মী ও মার্কিন সেনাবাহিনীর এক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্নেল রালফ পিটার্স (Ralph Peters) অনেক বছর আগেই নতুন মধ্যপ্রাচ্যের একটি নকশা তুলে ধরেছিলেন। তার প্রস্তাবিত নতুন নকশায় পাকিস্তানের সীমারেখাতেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। রালফ পিটারস-এর নকশা অনুযায়ী তুরস্ক, সিরিয়া, ইরান ও ইরাকের কুর্দ অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত কুর্দিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হবে। ইরাককে শিয়া ও সুন্নী দুই রাষ্ট্রে বিভক্ত করা হবে। সৌদি আরবের কিছু এলাকা জর্ডান ও ইয়েমেনের অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়া হবে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের শিয়া অধ্যুষিত এলাকাকে ইরাকের শিয়া রাষ্ট্রে যুক্ত করা হবে। আফগানিস্তানের কিছু অঞ্চল ইরাককে দেওয়া হবে। ইরানের কিছু এলাকা আযারবাইজানকে দেওয়া হবে। পাকিস্তানের ভেতর স্বাধীন বেলুচিস্তান নামে নতুন আরেকটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হবে। আর পূর্বের পখতুন অঞ্চলটি আফগানিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়া হবে।
বাহ্যত এটি এক দিবা স্বপ্ন। আর এর বাস্তবায়নও প্রায় অসম্ভব। কিন্তু গ্রেটার ইসরাইল গঠনের পরিকল্পনা জায়নবাদী ইশতিহারে বিদ্যমান আছে।
পূর্ব জেরুজালেম থেকে ইসরাইলের জোরপূর্বক ফিলিস্তিনী বসতি উচ্ছেদ করা এবং জর্ডান নদীর পশ্চিম তীরে ইহুদী বসতি স্থাপন করার চেষ্টা কোনো গোপন বিষয় নয়।
ইসরাইল বিষয়ে পাকিস্তানের স্থপতি কায়েদে আযম মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে যে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন তা আজও সঠিক। ইসরাইল ও ভারতের উগ্র নেতৃত্ব বিশ^াযোগ্য ও গ্রহণযোগ নয়। কেউ ভুল বুঝে থাকলে এখন তা শোধরে নিন।
(ডেইলি জং, ১৭ মে ২০২১)
২. মারইয়ামেরই হল জয়!
সারা বিশ্বিই দেখল। একাকী এক নিরস্ত্র তরুণীর জয়সূচক হাসি জালেম রাষ্ট্রের সব অহমিকা মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। নিরস্ত্র তরুণীটির হাতে শিকল পরিয়ে যখন পিছমোড়া করে বাঁধা হচ্ছিল তখন সে একটুও কাঁদেনি, চিৎকার করেনি। এমনকি কোনো উচ্চবাচ্যও করেনি। সে বরং জালেম সৈন্যদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। আর অমনি দূর থেকে একটি ফ্ল্যাশ তার হাসিটিকে ক্যামেরাবন্দি করে নিল। এরপর টুইটার, ফেসবুক, ইউটিউব, টিভির স্ক্রিন ও সংবাদমাধ্যম হয়ে গোটা দুনিয়ায় হাসিটি ভাইরাল হয়ে গেল। জুলুম-নির্যাতনের প্রাসাদ যেন মুহূর্তেই কেঁপে উঠল। তাদের কাছে নিজেদের কামান, ট্যাঙ্ক ও যুদ্ধজাহাজগুলি এক নিরস্ত্র তরুণীর হাসির সামনে খুবই বেমানান লাগছিল। মাত্র একটি হাসিতেই জালেমদের পরাজয় ঘোষণাকারী ওই তরুণীর নাম মারইয়াম।
রমযানুল মুবারকের শেষ দশকে জালেম ইসরাইল রাষ্ট্রের দখলদার বাহিনী অধিকৃত ফিলিস্তিনের অসহায় ও নিরুপায় মুসলমানদের ইবাদত পালনে বিঘ্ন ঘটাতে লাগলে মুসলমানরা তার প্রতিবাদ করতে থাকে। পূর্ব জেরুজালেমের শায়েখ জাররাহ এলাকাতেও এমনই একটি প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হচ্ছিল। সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর জনৈক চিকিৎসক শায়েখ জাররাহ-এর নামে এলাকাটির নামকরণ করা হয়েছে। জেরুজালেম বিজয়ের পর শায়েখ হুসামুদ্দীন জাররাহ সুলতান সালাহ উদ্দীন আইয়ুবীর সাথে ফিলিস্তিন এসেছিলেন। মসজিদে আকসার মহব্বতে সিক্ত হয়ে তিনি এখানেই স্থায়ী হয়ে গেলেন। তার কবর যে অঞ্চলে অবস্থিত তা-ই আজ শায়েখ জাররাহ নামে পরিচিত। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল জেরুজালেমের পশ্চিমাঞ্চল দখল করে নিলে সেখানকার অনেক মুসলমান নিজেদের বসত-ভিটা ছেড়ে পূর্ব জেরুজালেমের শায়েখ জাররাহ এলাকায় চলে আসেন। যা তৎকালে জর্ডানের শাসনাধীন ছিল। ১৯৬৭ সালে এই অঞ্চলটিও ইসরাইল দখল করে নেয়। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে ইসরাইল সরকার এখানকার মুসলমানদেরকে তাদের ঘর-বাড়ি ও বাজার-ঘাট থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করতে আরম্ভ করে। আর শায়েখ জাররাহ এলাকায় ইহুদীদের বসতি স্থাপন করতে থাকে। শায়েখ জাররাহর মুসলমানগণ জোরপূর্বক উচ্ছেদের কারণে এমনিতেই উদ্বিগ্ন ছিল। তার মধ্যে ২৭ রমযানুল মুবারকের দিকে ইসরাইলী বাহিনী মসজিদে আকসায় তারাবীহ নামায আদায়ে বাধার সৃষ্টি করে। ইসরাইলী বাহিনীর হামলার প্রতিবাদে শায়েখ জাররাহর লোকেরাও পথে নেমে আসে।
মসজিদে আকসার মর্যাদাহানির প্রতিবাদে শায়েখ জাররাহ্য় সমবেত লোকদের সংখ্যা যখন বেড়েই চলছে তখন ইসরাইলের নিরাপত্তা বাহিনী তাদের এক দল অশ্বারোহীকে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীদের উপর লেলিয়ে দেয়। অশ^ারোহীদের চালানো তাণ্ডবের মধ্যেই এক ফিলিস্তিনী শিশু ইসরাইল বাহিনীর সামনে পড়ে যায়। তারা তাকে বন্দুকের বেয়নেট দিয়ে আঘাত করতে থাকে। শিশুটিকে মারতে দেখে মারইয়াম নিজেকে স্থির রাখতে পারল না। ফিলিস্তিনী শিশুটিকে নির্যাতনের হাত থেকে উদ্ধারের চেষ্টা করলে এক ইসরাইলী সেনা মারইয়ামকে তার মাথার উপরের হিজাব ধরে টেনে মাটিতে ফেলে দেয়। তিন-চারজন সেনা তাকে নিজেদের বেষ্টনীতে নিয়ে আসে। এরপর পথেই তাকে মারতে শুরু করে এবং টেনে-হিঁচড়ে নিজেদের সাঁজোয়া গাড়ির দিকে নিয়ে যায়। তাকে যখন রাস্তায় টেনে-হিঁচড়ে নেওয়া হচ্ছিল তখন এক সাংবাদিক তার উপর চলা নির্যাতনের ভিডিও ধারণের সময় তার নাম জিজ্ঞাসা করলে সে জানায়, আমি মারইয়াম। কিছুক্ষণ পর এলাকাবাসীও নিশ্চিত করে যে, সে হল মারইয়াম আফীফী। মারইয়ামকে গ্রেফতারের পর যেখানে নেওয়া হয়েছিল সেখানে বেশ কয়েকজন প্রতিবাদী ফিলিস্তিনীকে হাতকড়া পরিয়ে পিছমোড়া করে বেঁধে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। একটু সুযোগ পেয়েই মারইয়াম নিজের হিজাব ঠিক করে নিলেন। কিন্তু পরমুহূর্তে তাকেও হাতকড়া পরানো হল। তার হাত কোমরের পিছনে নিয়ে যখন পিছমোড়া করে বাঁধা হচ্ছিল তখন সে হেসে ওঠে। দূরে দাঁড়ানো এক সাংবাদিক নিজের ক্যামেরায় এই দৃশ্যটি ধারণ করে নেয়। সাংবাদিকটি লক্ষ্য করল, মারইয়ামের এই হাসিটি ইসরাইলী সেনাদেরকে হয়রান ও পেরেশান করে তুলেছে।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সে সাঁজোয়া গাড়ির কাছে গিয়ে মারইয়ামের ভিডিও ধারণ করতে থাকে। মারইয়াম স্পষ্ট ইংরেজিতে ইসরাইলী সেনাকে জিজ্ঞাসা করছিল :
= আমার অপরাধ কি শুধু এটুকুই যে, আমি এক শিশুকে তোমাদের অত্যাচার থেকে উদ্ধার করছিলাম?
সেনাটি চুপ থাকল।
তাকে লক্ষ করে সে আবার বলল :
= আচ্ছা। একটু ভেবে দেখো তো। তুমি যখন ছোট ছিলে তখন কি এমনটিই হতে চেয়েছিলে যেমনটি তুমি আজ হয়েছ?
সেনাটি এখনও নিশ্চুপ।
মারইয়াম অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলতে লাগল :
= তোমরা জালেম। তোমাদের লজ্জা হওয়া উচিত।
সেনাটির দৃষ্টি অবনত হয়ে গেল। আর শিকলে বন্দি মারইয়াম তার সাথে জিতে গেল।
মারইয়ামের ভিডিওটি আমাকে ফিলিস্তিনের এক সাংবাদিক বন্ধু পাঠিয়েছিলেন। সাথে এই মন্তব্যও লিখেছিলেন-
‘ভাই! ২০০৯ সালে গাজার ধ্বংসযজ্ঞ তো আপনি নিজ চোখেই দেখেছিলেন। ২০১৪ সালে ইসরাইল আরো একবার ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল। আর এখন ২০২১ সালে গাজা আবারও ইসরাইলের বোমা হামলার শিকার।
ভাই! এবারের ঈদ তো আমাদের লাশ বহন ও দাফন করেই পার হয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের এক বোন মারইয়াম আফীফীর এই হাসিটি দেখুন। এই হাসিটি বলে দিচ্ছে, শেষ জয় আমাদেরই হবে। আমাদের জন্য দুআ করবেন।’
ফিলিস্তিনী বন্ধুর মন্তব্যটি আমি অনেকবার পড়েছি এবং মারইয়াম আফীফীর হাসিটিও বারবার লক্ষ্য করেছি। হাসিতে কোনো কৃত্রিমতা আছে বলে মনে হয়নি। তবে হাসির এই বাস্তবতা আজ হয়তো ওইসব লোক বুঝবে না, যারা (পরা)শক্তির কাছে নিজেদের অস্ত্র সমর্পণ করাকেই বড় হেকমত মনে করে। হাসিটির মর্ম শুধু ওইসব লোকই অনুধাবন করতে পারে, যারা আল্লাহর উপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখে। আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদের সূরা আলে ইমরান-এ ইরশাদ করেছেনÑ
وَ مَكَرُوْا وَ مَكَرَ اللهُ وَ اللهُ خَیْرُ الْمٰكِرِیْنَ.
আর তারা চক্রান্ত করেছিল। আল্লাহও কৌশল করেছিলেন। আর আল্লাহ কৌশলীদের শ্রেষ্ঠ। Ñসূরা আলে ইমরান (৩) : ৫৪
২০২১ সালের রমযানুল মুবারকের শেষ দিনগুলিতে এক সুচিন্তিত ও পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ইসরাইল মসজিদে আকসার সম্মানে আঘাত হানে। যেন ফিলিস্তিনীরা হিম্মত হারিয়ে ফেলে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা মারইয়াম আফীফীসহ অসংখ্য মজলুম ফিলিস্তিনীকে এতটা সাহস ও হিম্মত দান করেছেন যে, তারা ইসরাইলের বন্দুক ও ট্যাঙ্কের সামনেও দৃঢ় ও অবিচল ছিল।
ইসরাইলের হামলার জবাবে হামাসও পাল্টা মিসাইল হামলা করেছে। তাদের হামলায়ও কিছু নারী ও শিশু হতাহত হয়েছে। হামলা যে-ই করুক, কোনো নারী ও শিশুর উপর জুলুম না হওয়া উচিত।
মোটকথা, ইসরাইল এই বার্তা পেয়েছে যে, মুসলিম দেশগুলোর সাথে তারা যতই কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করুক এবং ফিলিস্তিনীদের বিরুদ্ধে সামরিক যত শক্তিই প্রয়োগ করুক না কেন ফিলিস্তিনীদের দমন করা যাবে না। ফিলিস্তিনীরা হল গোটা বিশ্বের নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের প্রতিচ্ছবি। ফিলিস্তিন যেন কাশ্মীর, আর কাশ্মীরই যেন ফিলিস্তিন। ফিলিস্তিন জয়ী হবে আর কাশ্মীরও জয়লাভ করবে। মারইয়ামের হাসি ওইসব লোকের মুখে এক চপেটাঘাত, যারা আমাদেরকে ইসরাইলের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনের পরামর্শ দেয়। মারইয়ামের হাসি হল বিজয়ের ঘোষণা। হয়তো বিজয়ের এ ঘোষণা আজ আপনার কাছে কৃত্রিম মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তবে এমনটিই ঘটবে ইনশাআল্লাহ।
এ যুদ্ধে মারইয়ামেরই জয় হয়েছে! হ
(ডেইলি জং, ১৩ মে ২০২১)