তারা তো তোমাদেরই ভাই-বোন
শিরোনামটি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরই বাণী থেকে গৃহীত, যার মাধ্যমে তিনি দাস-দাসী ও কাজের মানুষের হকের বিষয়ে উম্মতকে সতর্ক করেছেন। আজ আমাদের অনেকের অধীনেই কাজের মানুষ থাকে। বিশেষভাবে মা-বোনদের সহযোগিতার জন্য ঘরে ছোট মেয়ে, কিশোরী বা নারী সহযোগী থাকে, যাদেরকে সমাজ কাজের বুয়া, কাজের মেয়ে ইত্যাদি বলে সম্বোধন করে থাকে। যদিও এ ধরনের শব্দ এড়িয়ে চলা ভালো।
আসলে ধনসম্পদের ক্ষেত্রে কেউ অর্থবান, কেউ দরিদ্র বা নিঃস্ব। এ তফাৎ স্বয়ং আল্লাহ্ই করেছেন। এতে হেকমত রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
...نَحْنُ قَسَمْنَا بَیْنَهُمْ مَّعِیْشَتَهُمْ فِی الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا وَ رَفَعْنَا بَعْضَهُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجٰتٍ لِّیَتَّخِذَ بَعْضُهُمْ بَعْضًا سُخْرِیًّا ...
...আমিই তাদের মধ্যে তাদের জীবিকা বণ্টন করেছি পার্থিব জীবনে এবং একজনকে অপরজনের উপর মর্যাদায় উন্নত করেছি; যাতে তারা একে অপরের দ্বারা কাজ করিয়ে নিতে পারে। -সূরা যুখরুফ (৪৩) : ৩২
অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা কাউকে অর্থ দিয়েছেন আবার কাউকে দেননি। যেন অর্থশালী দরিদ্র ব্যক্তি থেকে শ্রম নিতে পারে আর দরিদ্র ব্যক্তি অর্থশালী থেকে অর্থ গ্রহণ করতে পারে। এভাবে একে অপরের উপকার করার মাধ্যমে পুরো সমাজ যেন মিলেমিশে বাস করতে পারে।
প্রতিটি মানুষ অন্যের মুখাপেক্ষী। এটি আল্লাহ তাআলার হেকমত। তাই আল্লাহ তাআলা যদি কাউকে কোনো মর্যাদা দান করেন তার কর্তব্য হল শোকর করা। অর্থাৎ বিনম্রচিত্তে সর্বদা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতার অনুভূতি জাগ্রত রাখা। আল্লাহর শোকর করা যে, হে আল্লাহ! এটা তোমারই দান। তুমি না দিলে আমার পাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। তুমি চাইলে আমাকে নাও দিতে পারতে। তাই শোকর তোমার। আর তুমি চাইলে মুহূর্তে ছিনিয়েও নিতে পারো। তাই প্রার্থনা, তা ছিনিয়ে নিয়ো না।
আর নিআমতের বড় শোকর হল, উক্ত নিআমতের বিষয়ে বিনয়ী হওয়া; অহংকার থেকে বেঁচে থাকা। ব্যক্তি যখন বিনয়ী হবে তখন অন্যকে ছোট ভাবা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা থেকে বিরত থাকবে।
***
বর্তমান শহরে তো বটেই গ্রামেও অনেকের ঘরে কাজের সহযোগী হিসেবে ছোট ছেলে-মেয়ে বা বয়স্ক মহিলা থাকে। তাকে আল্লাহ আমার অধীন করে দিয়েছেন। সুতরাং আমার উচিত তার সাথে কোমল ও দয়ার আচরণ করা; কোনো রূঢ় আচরণ না করা। সে দুর্বল, তার অভিভাবক দুর্বল; কিন্তু তার রব- মহাপরক্রমশালী; তিনিই সকল দুর্বলের শক্তিমান অভিভাবক। তার অভাবের কারণে হয়ত সে আজ আমার অধীন; হতে পারত তার স্থানে আমি হতাম। তখন আমি যে আচরণ প্রত্যাশা করতাম তার সাথেও সে আচরণ করব।
আমার মাতা-পিতা, ভাই-বোন যেমন আছে তারও তো তেমন আছে। আমার কষ্টে আমার মাতা-পিতা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তানেরা যেমন কষ্ট পান তার ক্ষেত্রেও তো তেমন। আমার বাবা-মা যেমন আমাকে আদর করেন তাকেও তার বাবা-মা আদর করেন। আমি যেমন আমার সন্তানকে সর্বদা আমার কাছে রাখতে চাই তার বাবা-মাও তো তাকে কাছে রাখতে চান। কিন্তু হয়তো অভাবের তাড়নায় এ ছোট বয়সেই দূর দূরান্তে, পরবাসে পাঠিয়ে দিয়েছে। আমার সন্তান যেমন, সেও তেমন; তফাৎ শুধু- সে অভাবী, অভাবীর সন্তান।
ঈদের দিন আমার সন্তান আমার ঘরে থাকবে না- তা কল্পনা করতেও আমাদের কষ্ট হয়। সুতরাং তার বিষয়টাও খেয়াল রাখব; এক ঈদ থাকল তো আরেক ঈদে ঈদের জামাসহ তাকে তার মা-বাবার সাথে ঈদ করার ব্যবস্থা করব। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বাস্তবতাকেই উপলব্ধি করার জোর তাগিদ দিয়েছেন। তিনি বলেন-
إِخْوَانُكُمْ أَحْسِنُوا إِلَيْهِمْ.
দাস-দাসী (কাজের মানুষ) তোমাদেরই ভাই। তাদের প্রতি ‘ইহসান’ কর, সদাচারী হও। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৩১৪৮
আরেক হাদীসে নবীজী বলেন-
هُمْ إِخْوَانُكُمْ، جَعَلَهُمُ اللهُ تَحْتَ أَيْدِيكُمْ.
তারা তো তোমাদেরই ভাই(-বোন)। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬০৫০
এ বিষয়ে আরো অনেক হাদীস রয়েছে। তবে চিন্তার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট।
এখানে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুটি বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন :
এক. তারা আমাদের ভাই।
দুই. আল্লাহ তাদেরকে আমাদের অধীন করে দিয়েছেন।
অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা চাইলে আমাকে তার অধীন করে দিতে পারতেন; যেমনিভাবে তাকে আমার অধীন করেছেন। আর মনে রাখতে হবে- সে আমার ভাই। আমি আমার ভাইয়ের ক্ষেত্রে যে আচরণ আশা করি তার সাথেও আমার তেমন আচরণই করা চাই।
এ বিষয়টি যখন মানুষ ভুলে যায় তখন সে স্বেচ্ছাচারে লিপ্ত হয়, জুলুমের আচরণ করে। এজন্য নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে এ বিষয়ে সতর্ক করেছেন। তাঁর সারা জীবনের কর্ম ও নির্দেশনার মাধ্যমে তো করেছেনই; এমনকি ইন্তেকালের সময় তাঁর শেষ ওসিয়ত ছিল-
الصّلَاةَ الصّلَاةَ، اتّقُوا اللهَ فِيمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ.
নামায, নামায! (নামাযের প্রতি যত্নবান হও!) আর দাস-দাসীদের (অধীনস্থ কাজের মানুষের) বিষয়ে তোমরা আল্লাহকে ভয় কর!
আলী রা. উপরের কথাটি এভাবে বর্ণনা করেন-
كَانَ آخِرُ كَلَامِ رَسُولِ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ...
ইন্তেকালের পূর্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাসাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শেষ ওসিয়ত ছিল,...। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫১৫৬
বিদায় হজ্বের খুতবাতেও নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-
أَرِقّاءَكُمْ أَرِقّاءَكُمْ أَرِقّاءَكُمْ، أَطْعِمُوهُمْ مِمّا تَأْكُلُونَ، وَاكْسُوهُمْ مِمّا تَلْبَسُونَ، فَإِنْ جَاءُوا بِذَنْبٍ لَا تُرِيدُونَ أَنْ تَغْفِرُوهُ فَبِيعُوا عِبَادَ اللهِ وَلَا تُعَذِّبُوهُمْ.
তোমাদের দাস-দাসীদের ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলাকে ভয় কর (একথা নবীজী তিনবার বলেন,); তোমরা যা খাও তাদেরকেও তা খাওয়াও। যা পরিধান কর তাদেরকেও তা পরাও। যদি তারা এমন কোনো অপরাধ করে, যা তোমরা ক্ষমা করতে চাও না, তাহলে আল্লাহর বান্দাদেরকে বিক্রি করে দাও, তবুও তাদেরকে কষ্ট দিও না। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৬৪০৯
কিন্তু এসব বাণী ও বাস্তবতা ভুলে গিয়ে আমার কাজের সহকারী লোকটির সাথে অনেক সময়ই বৈষম্যের আচরণ করে ফেলি। ক্ষেত্র বিশেষে আমাদের আচরণকে ‘জুলুম’ই বলতে হয়।
***
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কত তাকিদ করে বলেছেন, তোমরা যা পর তাদেরকেও তা পরাও। আর সাহাবায়ে কেরাম রা. সে তাকিদ কত গুরুত্বের সাথে আমলে নিয়েছেন।
তাবিয়ী উবাদা ইবনুল ওয়ালীদ রাহ. বলেন, আমি ও আমার পিতা ইলম অর্জনের জন্য আনসারদের গ্রামে যাই। উদ্দেশ্য, তাদের মৃত্যুর পূর্বেই যেন আমরা তাদের ইলম লিখে নিতে পারি। তো সর্বপ্রথম আমাদের সাক্ষাৎ হয় সাহাবী আবুল ইউসর-এর সাথে। তার সঙ্গে তার গোলামও ছিল। আবুল ইউসর-এর সাথে ছিল একটি মাআফেরী চাদর।১ তখন আমি বললাম, হে চাচা! যদি আপনি আপনার মাআফেরীটি গোলামকে দিতেন আর তার সাধারণ চাদরটি আপনি নিতেন। অথবা গোলামের মাআফেরীটি আপনি নিতেন আর আপনার চাদরটি তাকে দিতেন তাহলে উভয়ের জোড়া মিলতো। একজনের জোড়া মাআফেরী হত আর আরেকজনেরটি (সাধারণ) চাদরের। (এখন তো কারোর জোড়ায় মিল নেই) তখন আমাকে কাছে নিয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন এবং বললেন, আল্লাহ তাআলা তোমার মাঝে বরকত দান করুন।
ভাতিজা! আমি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যা আমার এ দুই চোখ প্রত্যক্ষ করেছে, আমার দুই কান শুনেছে এবং আমার অন্তর সংরক্ষণ করেছে। তিনি বলেছেন-
أَطْعِمُوهُمْ مِمّا تَأْكُلُونَ، وَاكْسُوهُمْ مِمّا تَلْبَسُونَ.
তোমরা যা খাও তাদেরও তা খাওয়াও। তোমরা যা পর তাদেরও তা পরাও। -আলআদাবুল মুফরাদ, হাদীস ১৮৭
খেয়াল করি, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- ‘তোমরা যা পরো তাদেরও তা পরাও’। আর সাহাবীও তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন।
এরপর সাহাবী যা বললেন, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও তাতে একজন মুমিনের জন্য চিন্তার বেশ খোরাক রয়েছে। তিনি বললেন-
وَكَانَ أَنْ أَعْطَيْتُهُ مِنْ مَتَاعِ الدّنْيَا أَهْوَنَ عَلَيّ مِنْ أَنْ يَأْخُذَ مِنْ حَسَنَاتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ.
(আজকের কোনো জুলুমের কারণে) কিয়ামতের দিন আমার পুণ্যরাশি থেকে সে কিছু নিয়ে নেবে এর চেয়ে তো এটাই সহজ ও উত্তম- আমি তাকে দুনিয়াতেই (তার প্রাপ্য) কিছু ভোগসামগ্রী দিয়ে দিই! -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩০০৭
দুনিয়ার কোনো ভোগসামগ্রী দিতে যদিও একটু কষ্ট মনে হয় কিন্তু অন্যের হক যথাযথ না দেওয়ার কারণে কিয়ামতের সেই কঠিন দিনে, বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে সে তো একমাত্র সম্বল ‘নেকী’ নিয়ে নেবে! এখন বলুন, কোনো বুদ্ধিমান কি এমনটি করতে রাজি হবে?
মুমিন তো নবীজীর এই বাণী শুনেছে-
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন বললেন, তোমরা কি জানো, ‘মুফলিস’-নিঃস্ব কে? সাহাবীগণ উত্তরে বললেন, আমাদের হিসাবে নিঃস্ব তো সেই, যার টাকা-পয়সা ও প্রয়োজনীয় জীবনোপকরণ নেই। তখন নবীজী বললেন-
إِنّ الْمُفْلِسَ مِنْ أُمّتِي يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِصَلَاةٍ، وَصِيَامٍ، وَزَكَاةٍ، وَيَأْتِي قَدْ شَتَمَ هَذَا، وَقَذَفَ هَذَا، وَأَكَلَ مَالَ هَذَا، وَسَفَكَ دَمَ هَذَا، وَضَرَبَ هَذَا، فَيُعْطَى هَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ، وَهَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ، فَإِنْ فَنِيَتْ حَسَنَاتُهُ قَبْلَ أَنْ يُقْضَى مَا عَلَيْهِ أُخِذَ مِنْ خَطَايَاهُمْ فَطُرِحَتْ عَلَيْهِ، ثُمّ طُرِحَ فِي النّارِ.
আমার উম্মতের ‘মুফলিস’ বা নিঃস্ব হল, যে কিয়ামতের দিন নামায-রোযা-যাকাতসহ অনেক নেক আমল নিয়ে উঠবে; কিন্তু দুনিয়াতে সে কাউকে গালি দিয়েছিল, কারো ব্যাপারে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিল, কারো সম্পদ আত্মসাৎ করেছিল, অন্যায়ভাবে কারো রক্ত ঝরিয়েছিল বা কাউকে আঘাত করেছিল; এসব কারণে এদেরকে তার নেকীর মাধ্যমে ওগুলোর বদলা দেওয়া হবে। দিতে দিতে পাওনাদারের পাওনা শেষ হওয়ার পূর্বেই যদি নেকী ফুরিয়ে যায়। তখন পাওনাদারদের গোনাহ তার ঘাড়ে চাপানো হবে এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে- (এ-ই হল আমার উম্মতের সবচেয়ে নিঃস্ব)। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৮১
সুতরাং কখনো কোনো দিক থেকেই যেন কারো উপর কোনো জুলুম না হয়ে যায়!
অধীনস্তদের সাথে সদাচরণের এমন ঘটনা কেবল এক সাহাবীর নয় অন্যান্য সাহাবীগণও নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হুকুম বাস্তবায়নে এমন করেছেন। মারুর ইবনে সুআইদ বলেন, আমি একদিন সাহাবী আবু যর রা.-এর নিকট যাই। তখন তার গায়ে যে ধরনের কাপড় ছিল তার গোলামের গায়ে হুবহু তেমন কাপড় দেখি। আমি এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, একবার আমি আমার এক গোলামকে গালমন্দ করি। তখন সে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লামের নিকট অভিযোগ করে। তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কি তাকে তার মায়ের নাম ধরে কিছু বলেছ? জবাবে আমি বললাম, হাঁ। তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এরা তোমাদের ভাই, তোমাদের পরিজন, আল্লাহ তাআলা এদেরকে তোমাদের অধীন করেছেন। সুতরাং কারো অধীনে যদি এমন কেউ থাকে তাহলে সে যেন নিজে যা খায় ও পরে তাকেও তা খাওয়ায় ও পরিধান করায়। আর তাদেরকে তাদের সামর্থ্যরে বাইরে ভারি কাজ দিবে না। যদি দেওয়া হয় তাহলে অবশ্যই তাদের কাজে সাহায্য করবে। -আলআদাবুল মুফরাদ, হাদীস ১৮৯
***
আমাদের সমাজে কাজের মানুষের সাথে পোশাকের ক্ষেত্রে যেমন বিশাল বৈষম্য লক্ষ করা যায়, খাবারের ক্ষেত্রেও তেমনই। ভালো ও সুস্বাদু খাবারের প্রতি মানুষের চাহিদা ও আকর্ষণ পোশাকের চেয়ে অনেক বেশি। পোশাকের চেয়ে খাবারের কষ্ট বেশি অনুভূত হয়। আমারই সামনে একজন অনেক সুস্বাদু খাবার খাবে কিন্তু আমাকে তা দেওয়া হবে না বা আমাকে দেওয়া হবে তার চেয়ে কম স্বাদের বা নিম্নমানের খাবার- এটা বরদাশত করা অনেক কঠিন। আমাদের সমাজে কাজের মানুষের সঙ্গে এমনটি ঘটে। অথচ এ মজার খাবার রান্না করতে গিয়ে সে কতই না কষ্ট সহ্য করেছে।
দেখুন নবীজী কত সুন্দর করে উম্মতকে বুঝিয়েছেন। তিনি বলেছেন-
إِذَا صَنَعَ لِأَحَدِكُمْ خَادِمُهُ طَعَامَهُ، ثُمّ جَاءَهُ بِهِ، فَلْيُقْعِدْهُ مَعَهُ، فَلْيَأْكُلْ، فَإِنْ كَانَ الطّعَامُ مَشْفُوهًا قَلِيلًا، فَلْيَضَعْ فِي يَدِهِ مِنْهُ أُكْلَةً أَوْ أُكْلَتَيْنِ.
যখন তোমাদের খাদেম তোমাদের জন্য কোনো খাবার প্রস্তুত করে তাহলে তাকেও তোমাদের সাথে বসাও। যদি খাবারের পরিমাণ কম হয় তাহলে এক-দু লোকমা হলেও তার হাতে দাও। (আরেক হাদীসে তো এমন আছে যে, তারা খেতে না চাইলেও জোর করে কিছু খাওয়াও।) -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৬৬৩
এরপর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও ভাববার বিষয়। তিনি বললেন-
وَقَدْ وَلِيَ حَرّهُ وَدُخَانَهُ.
কেননা এ খাবার প্রস্তুত করতে গিয়ে এর ধোঁয়া ও তাপ তো সে সয়েছে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৬৬৩
আরেক বর্ণনায় এসেছে-
قَدْ أَغْنَى عَنْكُمْ عَنَاءَ حَرِّهِ وَدُخَانِهِ.
(এ খাবার প্রস্তুত করতে গিয়ে) সেই তো তোমাদের পক্ষ থেকে তাপ ও ধোঁয়া সহ্য করেছে (এবং তোমাদেরকে সে কষ্ট থেকে বাঁচিয়েছে)। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৮১৯৬
যদি আমরা উম্মতীরা নবীজীর এ দরদপূর্ণ নির্দেশনাটি গ্রহণ করতাম!
এমন ঘটনাও শোনা যায়, কাজের সহযোগী ছোট মেয়েটি সকালে সবার আগে ঘুম থেকে ওঠে। এরপর সে নাস্তা তৈরিতে লেগে যায় তখন ঘরের সবাই বেঘোর ঘুমে। নাস্তা তৈরি হলে ধীরে ধীরে এক-একজন করে আড়মোড়া দিতে দিতে ওঠে। এরপর নাস্তা পরিবেশন হয় একে-একে সবাই নাস্তা খেলেও এখনও ঘরের ছোট মেয়েটি ওঠেনি। তাই তাকে আরো অপেক্ষা করতে হয়। ছোট মেয়েটি উঠে নাস্তা সারলে তারপর নিজের নাস্তা! অথচ সে সকালে উঠেছে এবং এপর্যন্ত সবার জন্য রুটি বানিয়েছে। কিন্তু সবার শেষ হওয়া পর্যন্ত তার খাওয়া নিষেধ। তাহলে বলুন, কোথায় নবীজীর শিক্ষা আর কোথায় আমাদের আচরণ!
***
বাড়ির ছেলে-মেয়েরা অবসর সময়ে হাসি-কৌতুক, গল্প ও খেলাধুলা করে। এটি একটি শিশুর স্বাভাবিক চাহিদা। কিন্তু শিশু হওয়া স্বত্ত্বেও কাজের মেয়ের জন্য খেলাধুলার কল্পনাও নিষিদ্ধ। এটি যেন সমাজে অলিখিত আইন। এমনটি হওয়া উচিত নয়। মেয়েটি বাড়িতে ছিল; সেখানে যে কোনো সময় সে যে কারো সাথে খেলাধুলা করতে পারতো। এখন সে আমার বাসার কাজের মেয়ে; কিন্তু সেও তো আমার সন্তানের মত ছোট শিশু। তারও তো খেলতে মন চায়। সুতরাং আমি তাকে সময় বের করে খেলার সুযোগ করে দিব।
***
আমি আমার সন্তানসহ কারো বাড়িতে বেড়াতে যাই। সাথে কাজের মেয়েকেও নিই। জানা কথা, বেড়ানো ছোট-বড় সবার জন্যই আনন্দের। সেখানে গিয়ে সবাই অন্যদের মেহমান। কিন্তু কাজের মেয়ের মেহমান হওয়ার অধিকারই নেই। সেখানেও সে কাজের মেয়ে। অর্থাৎ যাদের কাজের মেয়ে তাদের তো কাজের মেয়েই, এমনকি যাদের বাড়িতে মেহমান হয়েছে তারাও তাকে কাজের মেয়ে মনে করে। ফলে কাজের মেয়ের মতই তাকে দিয়ে কাজ করায়। খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রেও তার সাথে মেহমান নয়; বরং কাজের মেয়ের মতই আচরণ করে। খাবারও পায় সে সবার পরে। এসব ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করা চাই।
***
প্রায়ই অধীনস্ত কাজের লোকদের উপর অত্যাচারের বিভিন্ন ঘটনা শোনা যায়। সারা দিন সারা রাত ইবাদত-বন্দেগীতে কাটানো নারী শুধু একটি বিড়ালকে খাবার না দিয়ে আটকে রাখার কারণে তার ঠিকানা হয়েছে জাহান্নাম। আর আরেক দুশ্চরিত্রা নারী একটি পিপাসার্ত কুকুরকে পানি পান করানোর ফলে জান্নাতে গিয়েছে- হাদীসে বর্ণিত এ ঘটনা আমরা অনেকেই শুনেছি। তাহলে একজন মানুষকে কষ্ট দেওয়ার শাস্তি কী হবে- নিজেই ভেবে দেখি।
কাজের মানুষ তো স্বাধীন; একজন কৃতদাসকেও যদি প্রহার করা হয় তার শাস্তিও ভয়াবহ। নবীজী সাল্লøাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
لَا يَضْرِبُ أَحَدٌ عَبْدًا لَهُ - وَهُوَ ظَالِمٌ لَهُ - إِلّا أُقِيدَ مِنْهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ.
যদি কেউ তার দাস-দাসীকে অন্যায়ভাবে প্রহার করে কিয়ামত দিবসে তাকেও এভাবে প্রহার করে তার থেকে কেসাস বা বদলা নেয়া হবে। -আলআদাবুল মুফরাদ, হাদীস ১৮১
যেসব ক্ষেত্রে আমরা নিজেদের সন্তানদের শাসন করি; যেমন, যদি নামায না পড়ে, রোযা না রাখে ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমার অধীনস্ত কাজের মানুষকে শাসন করা যাবে। কিন্তু ঝাড়ু দিতে দেরি হয়ে গেছে বা দরজার কোণায় একটু ময়লা রয়ে গেছে বা ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে বা আমার মেয়ের সাথে একটু জোরে কথা বলেছে ইত্যাদি এসব কারণে তাকে প্রহার করা বা অন্যান্য পন্থায় জুলুম করা, যা এখানে উল্লেখ করাটাও অনুচিত- কিয়ামতের দিন সবকিছুর বদলা নেওয়া হবে।
মুআবিয়া ইবনে সুয়াইদ বলেন, একদিন আমি আমাদের এক দাসের গালে চড় মারি। তখন আমার পিতা দাসকে বলেন, তুমিও এর কেসাস বা বদলা নাও। অর্থাৎ তুমিও চড় মারো। এরপর তিনি বলেন, ইসলামের শুরু যুগে অভাব অনটন ছিল। আমরা সাত ভাই ছিলাম। সবার জন্য কেবল একজন খাদেম ছিল। একদিন আমাদের এক ভাই খাদেমের গালে চড় মারে। বিষয়টি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কানে যায়। তখন তিনি আমাদেরকে গোলামটি আযাদ করে দিতে নির্দেশ দেন। আমরা নিবেদন করলাম, আমাদের আর কোনো খাদেম নেই। আমরা খুব কষ্টে পড়ে যাবো। অবশেষে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এতটুকুতে রাজী হয়ে বলেন যে, ঠিক আছে, এখন রাখতে পার, তবে পরবর্তীতে আযাদ করে দিতে হবে।
আরেক হাদীসে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
مَنْ لَطَمَ عَبْدَهُ أَوْ ضَرَبَهُ حَدّا لَمْ يَأْتِهِ، فَكَفّارَتُهُ عِتْقُهُ.
যে তার গোলামকে চড় মারে... তার কাফফারা বা প্রায়শ্চিত্ত হল তাকে আযাদ করে দেয়া। -আলআদাবুল মুফরাদ, হাদীস ১৭৭
যাযান রাহ. বলেন, একদিন আমি সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা.-এর নিকট গেলাম। দেখলাম, তিনি তার এক গোলামকে আযাদ করলেন। এরপর তিনি মাটি থেকে একটি কাঠি বা কুটো তুলে বললেন, আমি যে একে আযাদ করলাম এজন্য এ কাঠি পরিমাণ সওয়াবও পাব না। কেননা আমি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুখে শুনেছি, কেউ যদি তার গোলামকে চড় মারে বা প্রহার করে তাহলে এর কাফফারা হল তাকে আযাদ (স্বাধীন) করে দেওয়া। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৬৫৭
***
মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি বৈচিত্র্যপূর্ণ। একটি কাজ আমি যেভাবে চাই অন্যজনের পক্ষে তা সেভাবে করা সম্ভব নাও হতে পারে। সুতরাং এজাতীয় বিষয়কে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখব। আর যদি কাজের মানুষটির বয়স কম হয় তাহলে তার বুদ্ধিও হবে অপরিপক্ব। তার ভুল ত্রুটি হওয়াটাই স্বাভাবিক। যেমন আমার সন্তানের হয়। এসব ক্ষেত্রে শরীয়তের নির্দেশনা হল, তার প্রতি সহমর্মি হওয়া এবং তাকে শুধরে দেওয়া। ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা, এড়িয়ে যাওয়া। শুনুন নবীজীর দীর্ঘ নয়-দশ বছরের খাদেম আনাস রা. কী বলেন-
خَدَمْتُهُ فِي السّفَرِ وَالحَضَرِ، مَا قَالَ لِي لِشَيْءٍ صَنَعْتُهُ لِمَ صَنَعْتَ هَذَا هَكَذَا؟ وَلاَ لِشَيْءٍ لَمْ أَصْنَعْهُ لِمَ لَمْ تَصْنَعْ هَذَا هَكَذَا؟
আমি সফরে-বাড়িতে সব অবস্থায় নবীজীর খেদমত করেছি। তিনি কোনো কাজের ব্যাপারে কখনো বলেননি- এ কাজটি কেন এভাবে করলে। তেমনি কোনো কাজ না করলেও বলেননি- এ কাজটি কেন করলে না বা কেন এভাবে করলে না। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৭৬৮
সুতরাং আমরাও আমাদের সেবকদের সাথে ক্ষমা ও ছাড়ের আচরণ করব।
ভুলত্রুটি তো হবেই; কতবার ক্ষমা করব? সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন, এক ব্যক্তি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের নিকট এসে জিজ্ঞেস করেন- ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমরা খাদেমকে কতবার ক্ষমা করব? নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চুপ থাকলেন। লোকটি আবার জিজ্ঞেস করল, আমরা খাদেমকে কতবার ক্ষমা করব। তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
اعْفُ عَنْهُ كُلّ يَوْمٍ سَبْعِينَ مَرّةً.
দিনে সত্তরবার হলেও ক্ষমা করবে। -সুনানে কুবরা, বায়হাকী, হাদীস ১৫৭৯৯
আর প্রত্যেকের কর্ম-ক্ষমতা যেহেতু একরকম নয়, সুতরাং সেদিকেও খেয়াল রাখব। সে কতটুকু পারে, কত সময়ে পারে- সেটি বিবেচনায় রাখব। বাস্তব জীবনে আমরা দেখি, একটি কাজ আরেকজন এক ঘণ্টায় পারে অথচ সে কাজটিই আমি করতে গেলে দেড় ঘণ্টা লাগে। সুতরাং বিষয়টি খেয়াল রাখব; সাধ্যের উপরে চাপাবো না, চাপাচাপি করব না। সাধ্যের উপরে কাজ দিলে আমি তাকে সহায়তা করব। তার বোঝা কমিয়ে দিব। এর ফযীলত শুনুন নবীজীর পাক যবানে-
مَا خَفّفْتَ عَنْ خَادِمِكَ مِنْ عَمَلِهِ، فَإِنّ أَجْرَهُ فِي مَوَازِينِكَ.
(নবীজী বলেছেন,) তুমি তোমার খাদেমের উপর আরোপিত কোনো কাজের বোঝা হালকা করলে এর প্রতিদান তোমার নেকীর পাল্লাতেই যাবে। (তা তোমার নেকীর পাল্লা ভারী করবে) -মুসনাদে আবী ইয়ালা, হাদীস ১৪৭২; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৪৩১৪; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৮২২৬
আর যদি কাজের মানুষের সাথে আমার বনিবনা না হয়; তার কাজ আমার পছন্দ না হয়। তার ত্রুটি দূর না হয় তাহলেও তার সাথে অন্যায় আচরণ করব না; বরং তার পরিবর্তে ভিন্ন চিন্তা করব। নবীজী কৃতদাসীর ব্যাপারেও একথা বলেছেন-
مَنْ لَاءَمَكُمْ مِنْ خَدَمِكُمْ فَأَطْعِمُوهُمْ مِمّا تَأْكُلُونَ، وَاكْسُوهُمْ مِمّا تَلْبَسُونَ، وَمَنْ لَا يُلَائِمُكُمْ مِنْ خَدَمِكُمْ، فَبِيعُوا، وَلَا تُعَذِّبُوا خَلْقَ اللهِ.
দাস-দাসীদের সাথে যদি তোমাদের বনিবনা হয় তাহলে তোমরা যা খাও তাদেরকেও তা খাওয়াও। তোমরা যা পরিধান কর তাদেরকেও তা পরিধান করাও। আর যদি বনিবনা না হয় তাহলে তাদেরকে বিক্রি করে দাও। কিন্তু আল্লাহর বান্দাদের কষ্ট দিও না। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২১৫১৫
***
একটি মেয়ে বা ছেলেকে তার মাতা-পিতা অভাবের তাড়নায় অন্যের ঘরে কাজে পাঠিয়ে দেয়। অথচ এ মেয়ে বা ছেলেটিরও একটি জীবন আছে, ভবিষ্যৎ আছে। এ বিশাল পৃথিবীতে তারও মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার অধিকার আছে। তাই তারও শিক্ষাদীক্ষার প্রয়োজন আছে। তারও আখেরাতের প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে, দ্বীনী ইলমের প্রয়োজন আছে। আমি আমার সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে কত চিন্তিত। অথচ অধীনস্ত ব্যক্তিটির ক্ষেত্রে আমার ভাবনা কতটুকু!
একবার সিলেটে চা বাগান দেখতে যাই। তখন চা শ্রমিকদের আবাসেও যাই। দেখি একটি ভাঙাচোরা স্কুল। গাইডকে জিজ্ঞেস করলে বলেন, এদের সন্তানদের জন্য মানসম্মত পড়ার সুযোগ রাখা হয় না। তেমনি এ এলাকা থেকে বাইরের স্কুলেও যেতে দেয়া হয় না। পাছে আবার তারা শিক্ষিত হয়ে যাবে এবং এ কাজ আর করবে না। এটা তো সিলেটের চা বাগানের কথা। কিন্তু এমন ‘চা শ্রমিক’ হাজারো ঘরে রয়েছে।
প্রতিটি নেক কাজে একটি সওয়াব, কিন্তু দাস-দাসী, কাজের মানুষকে দ্বীনী তালীম দিলে দ্বিগুণ সওয়াব। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
ثَلاَثَةٌ لَهُمْ أَجْرَانِ: ... وَرَجُلٌ كَانَتْ عِنْدَهُ أَمَةٌ فَأَدّبَهَا فَأَحْسَنَ تَأْدِيبَهَا، وَعَلّمَهَا فَأَحْسَنَ تَعْلِيمَهَا، ثُمّ أَعْتَقَهَا فَتَزَوّجَهَا فَلَهُ أَجْرَانِ.
তিন ব্যক্তির জন্য ‘দ্বিগুণ প্রতিদান’ রয়েছে, ... ঐ ব্যক্তি, যার নিকট কোনো দাসী আছে আর সে তাকে ইসলামী শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়েছেন এবং খুব সুন্দরভাবে দ্বীন শিক্ষা দিয়েছে। অতঃপর তাকে স্বাধীন করে দিয়েছে এবং তাকে বিবাহ করেছে। এ ব্যক্তি দ্বিগুণ সওয়াবের অধিকারী হবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৯৭
সাহাবা-তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীনসহ মুসলিম ইতিহাসে হাজারও আলেম তাদের গোলাম-বাদীদের শিক্ষা দিয়ে এমন আলেম বানিয়েছেন, যারা ফিকহ্, হাদীস, তাফসীর ইত্যাদি শাস্ত্রে উজ্জ্বল নক্ষত্ররূপে বরিত হয়েছেন।
একজন মুমিন, চাই সে মালিক হোক বা শ্রমিক, মুনিব হোক বা ভৃত্য, গৃহকর্ত্রী হোক বা কাজের মানুষ, তাকে কবরে যেতেই হবে, আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে। সুতরাং আমাদের কাজের মানুষেরও দ্বীন শেখা প্রয়োজন। তাকে দ্বীন-ঈমান শেখাতে হবে। অযু নামায রোযা কুরআন শেখাতে হবে। তার আখেরাতের নাজাতের বিষয়ে ভাবা আমার দায়িত্ব। কারণ সে আমার অধীন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
كُلّكُمْ رَاعٍ، وَكُلّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيّتِهِ.
প্রত্যেকেই তোমরা দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককেই তার অধীনস্তদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৮৯৩
সুতরাং আমাদের কাজের মানুষের দ্বীন শেখার ব্যাপারে আমরা ফিকির করব। যে যেভাবে পারি তার দ্বীন শেখার ব্যবস্থা করব।
***
অনেকে আছে হয়তো কাজের মানুষকে প্রহার করে না, কিন্তু সারাদিন বকাঝকা করে। পান থেকে চুন খসলেই কাজের মেয়েকে ধমকা ধমকি করে। দশটা মিনিটের জন্যও তার সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করা হয় না। অধীনস্তদের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
حُسْنُ الملَكَةِ نَمَاءٌ.
দাস-দাসী (ও কাজের মানুষের) সাথে সদাচার প্রবৃদ্ধি ও বরকতের কারণ -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫১৬২
পক্ষান্তরে এর বিপরীত করলে অন্যসবও বিপরীত হবে। সাথে সাথে একটি হাদীসে তো এসেছে-
لَا يَدْخُلُ الْجَنّةَ سَيِّءُ الْمَلَكَةِ.
দাস-দাসী শ্রমিকদের সাথে অসদাচারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না। -শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৮২১৬; আলমুজামুল আওসাত, তবারানী, হাদীস ৯৩১২; মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৪/২৩৬
আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন এবং হেফাযত করুন- আমীন।
সবশেষে আরেকটি হাদীসের প্রতি আমরা বিশেষ দৃষ্টি দিই। এর বার্তাকে যদি আমরা হৃদয়ঙ্গম করতে পারি, তাহলে আশা করা যায়, আলোচ্য ক্ষেত্রে আমাদের ভুল চিন্তা ও অযাচিত আচরণগুলো ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
সাহাবী আবু মাসঊদ আলবদরী রা. বলেন, একদিন আমি আমার এক গোলামকে প্রহার করছিলাম। তখন আমার পেছন থেকে আওয়াজ শুনি-
اعْلَمْ أَبَا مَسْعُودٍ! لله أَقْدَرُ عَلَيْكَ مِنْكَ عَلَيْهِ.
হে আবু মাসউদ! জেনে রেখো, এ গোলামের উপর তোমার যতটুকু ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব তোমার উপর আল্লাহ তাআলার ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব এর চেয়ে বহু গুণে বেশি।
আমি পেছনে তাকিয়ে দেখি, একথা বলছেন স্বয়ং নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আমি সাথে সাথে বললাম, হাঁ, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সে আযাদ। তাকে আমি মুক্ত করে দিলাম। নবীজী বললেন, হাঁ, (ঠিক কাজ করেছ।) যদি তুমি তাকে আযাদ না করতে তাহলে জাহান্নামের আগুন তোমাকে গ্রাস করত। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৬৫৯
জামে তিরমিযীর বর্ণনায় রয়েছে। আবু মাসউদ রা. বলেন-
فَمَا ضَرَبْتُ مَمْلُوكًا لِي بَعْدَ ذَلِكَ.
এর পর থেকে আমি কোনোদিন আর কোনো গোলামকে প্রহার করিনি। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯৪৮
একটু ভাবুন, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কীভাবে সাহাবীকে বুঝিয়েছেন এবং পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। আর সাহাবীও তা বুঝে সাথে সাথে নিজেকে শুধরে নিয়েছেন এবং গোলামকে মুক্ত করে দিয়েছেন। আমরাও এ হাদীসের বার্তা ও শিক্ষাকে জীবনে গ্রহণ করব এবং সর্বদা মনে রাখব।
তো শুরুতে যে হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে- ‘তারা তো তোমাদেরই ভাই, পরিজন। আল্লাহ্ই তাদেরকে তোমাদের অনুগত করে দিয়েছেন’। আর শেষ হাদীস, যা মাত্রই উল্লেখ কা হল, হাদীসদুটির বার্তা ও শিক্ষা স্মরণ রাখব। এ দুটি হাদীসের শিক্ষা যদি সর্বদা সামনে রাখি তাহলে এক্ষেত্রে আমাদের আচরণ পরিশীলিত, সুন্দর ও সুচিন্তিত হবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলা আমাদের আমল করার তাওফীক দান করুন- আমীন। হ