শাওয়াল ১৪৪২   ||   মে ২০২১

সিলেটের গণভোট ও মাওলানা সহূল উছমানী রাহ.

মাওলানা আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী

১৯১৯ সালের মার্চ মাসে সিলেট সফরে এসে আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসিবলে বাংলাদেশের প্রতি আবেগ প্রকাশকারী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সিলেট সম্পর্কে লিখেছিলেন :

মমতা বিহীন কালস্রোতে

বাংলার রাষ্ট্রসীমা হতে

নির্বাসিতা তুমি

সুন্দরী শ্রী ভূমি।

সেই পংক্তিমালায় বাংলা থেকে সিলেটকে বিচ্ছিন্ন করার ব্যথায় যে তিনি ব্যথিত হয়েছিলেন তাই বিধৃত হয়েছে। ১৮৭৪ সালে বৃটিশ শাসকরা এ জেলাটিকে ঢাকা বিভাগ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল। (সিলেটের মাটি ও মানুষ, ফজলুর রহমান, পৃ. ১৬৫, ঢাকা ১৯৮৩)

তার দীর্ঘ ৭৩ বছর পর আমরা সিলেটবাসী মুসলমানরা যখন প্রাণপণ লড়াই করে গণভোটের মাধ্যমে সিলেটকে পুনরায় বাংলাদেশের সাথে সংযুক্ত করলাম, তখন তাঁর স্বজাতীয় স্বধর্মীয়রা একদিকে যেমন সিলেট বিভাগকে আসাম সীমানাতেই ধরে রাখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন, এ পুণর্মিলনে বাধাসৃষ্টির জন্য আদাজল খেয়ে লেগেছিলেন, তেমনি তারাই পশ্চিমবঙ্গকে বাংলার মূল ভূখণ্ড বাংলাদেশ থেকে নানা কূটকৌশল প্রয়োগ করে বিচ্ছিন্ন করেছেন। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, ইতিহাসের কী নির্মম উদাহরণ! মাত্র একচল্লিশ বছর পূর্বে ১৯০৫ সালে বঙ্গ বিভাগকে যারা বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদবলে অভিহিত করে সারা ভারতবর্ষের হিন্দু সমাজকে নিয়ে একেবারে ধর্মযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে পড়েছিলেন- এবার তারাই আবার বঙ্গভঙ্গ করার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠলেন! ভাগ্যিসরবিঠাকুর তার কবছর পূর্বেই মারা গিয়েছিলেন । তাই সে কঠিন পরীক্ষায় তাঁকে পড়তে হয়নি। নতুবা তিনি যদি আবার আমাদের এ মুসলিম বাংলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালীন তাঁর  সেই নিন্দনীয় উৎকট  সাম্প্রদায়িক চেহারায় আত্মপ্রকাশ করতেন, নিন্দনীয় একচোখা নীতি অবলম্বন করতেনতাহলে বঙ্গভঙ্গ-দুঃখে রচিত তাঁর মর্সিয়াগীতটি আর আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের সম্মানটি লাভ করতে পারত না। 

পক্ষান্তরে কী সৌভাগ্য সেইসব ভারতীয় আলেমদের, যাঁরা নিজেরা উর্দুভাষী এবং ভারতের যুক্তপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ ও বিহারের অধিবাসী হয়েও আমাদের বাংলাদেশের মানচিত্রটাকে পূর্ণতা দানের সংগ্রামে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই সংগ্রামে আলেমদের মধ্যে রয়েছেন মাওলানা সহূল উছমানী ভাগলপুরী, মাওলানা যফর আহমদ উছমানী, মাওলানা রাগিব আহসান, মাওলানা আজাদ সুবহানী ও পশ্চিমবঙ্গের ফুরফুরার পীর মাওলানা আবুল হাসানাত আবদুল হাই -রহিমাহুমুল্লাহ- প্রমুখ। বাংলাদেশবাসীকে তাঁরা চিরঋণী করে গেছেন। এদিক থেকে তাঁরা ঐ ভারতীয় হিন্দু ও শিখ সৈন্যদের মতই কৃতিত্বের অধিকারী ও পুরস্কারযোগ্য, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের স্বপক্ষে লড়েছিল এবং বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে পুরস্কৃতও হয়েছিল। তবে আমরা উক্ত মহাপুরুষগণের কথা না স্মরণ রেখেছি, আর  না তাঁদেরকে পুরস্কৃত করেছি।

আর হাঁ, আরেকটি কথা উল্লেখের দাবি রাখে, সিলেটের ঐ গণভোটযুদ্ধে কেবল আমাদের বাঙালী নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, খাজা নাজিমুদ্দীন-শাহাবুদ্দীন ভ্রাতৃদ্বয়, মওলবী তমীযুদ্দীন খাঁ, মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী ও ছাত্রনেতা শাহ আযীযুর রহমান, সবুর খাঁ, ফজলুল কাদের চৌধুরী, শর্ষিনার পীর আবূ জাফর মুহাম্মাদ সালেহ ও মাওলানা আযীযুর রহমান নেছারাবাদী প্রমুখই নয়, পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর বন্ধু পরবর্তীতে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক, ওলী আহমদ প্রমুখ তদানীন্তন ছাত্রনেতাগণও উল্লেখ্যযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। পূর্বপাঞ্জাবের নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান (পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী), যুক্তপ্রদেশের চৌধুরী খালিকুয যামান, (পূর্বপাকিস্তানের প্রথম গভর্নর), সীমান্ত প্রদেশের সরদার আবদুর রব নিশতার ও আসামের প্রধানমন্ত্রী সৈয়দ সাদুল্লাহর মত সর্বভারতীয় জাঁদরেল মুসলিমলীগ নেতারাও এসে শামিল হয়েছিলেন। মুসলিমলীগ সভাপতি কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর অন্যতম ঘনিষ্ঠতম সহকর্মী সিলেটের আবদুল মতিন চৌধুরী, আসাম প্রাদেশিক মুসলিমলীগের জেনারেল সেক্রেটারী দেওয়ান আবদুল বাসিত, মন্ত্রী মওলবী আবদুল হামিদ ও মনোয়ার আলী, মাওলানা আবদুর রহমান সিংকাপনী, সিলেট জেলা মুসলিমলীগের সভাপতি মাাওলানা আবদুর রশিদ টুকেরবাজারী এবং মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ভার্থখলার হাজী মুনীরুদ্দীন চৌধুরী, মাওলানা আতহার আলী, মওলানা সখাওয়াতুল আম্বিয়া (পরবর্তীতে নির্বাচিত পরিষদ সদস্য) প্রমুখ সিলেটী নেতারা তো ছিলেনই। এ জাতি তাঁদের সকলের কাছেই চিরঋণী। বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেঅত্যন্ত গুরুত্বের সাথে এ ঘটনাটির উল্লেখ করেছেন। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বন্ধুবর দেওয়ান নূরুল আনোয়ার চৌধুরী লিখিত জালালাবাদের কথাএবং তাঁর সিলেট বিভাগের ইতিহাসএবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন ফজলুর রহমান তাঁর সিলেটের মাটি ও মানুষ’ (পৃ. ১২৪) ও শতাব্দীর দর্পণ (পৃ. ২১-২৩) গ্রন্থদ্বয়ে বিশেষ গুরুত্বসহকারে এ ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন। এছাড়া নুরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরী ও সিএম আবদুল ওয়াহেদ সিলেটে গণভোটশিরোনামে স্বতন্ত্র গ্রন্থও রচনা করেছেন।

এমন একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ও কর্মকাণ্ডের সাফল্যের প্রধান কৃতিত্বের অধিকারীরূপে মাওলানা মুফতী সহূল উছমানী ভাগলপুরী রাহ.-এর গুরুত্ব সর্বাধিক। তাঁর জীবনী আলোচনায় আমরা এ প্রসঙ্গে আরো বিস্তারিত বিবরণ দেখতে পাব।

আরেকটি কারণে মাওলানা মুফতী সহূল রাহ.-এর অবদান তাঁকে বিশেষ গুরুত্বের আসনে আসীন করেছে। আর তা হল, একটি ঐতিহাসিক বাস্তব সত্য হচ্ছে, যে পাকিস্তান আন্দোলন পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ গোটা ভারতবর্ষের মুসলিম সাধারণকে এমনি পাগলপারা করে তুলেছিল যে, যাদের প্রস্তাবিত পাকিস্তান সীমার মধ্যে পড়ার কোনই সম্ভাবনা ছিল না, সেসব এলাকার মুসলমানগণও প্রস্তাবিত পাকিস্তান সৃষ্টির সংগ্রামে সর্বস্ব ত্যাগে উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিলেন। শেখ মুজিবের অসমাপ্ত আত্মজীবনীর বহু স্থানে এ উপলব্ধির অভিব্যক্তি ঘটেছে যে, পাকিস্তান সৃষ্টি ছাড়া ভারতীয় মুসলমানদের আত্মরক্ষার, অস্তিত্ব রক্ষার আর কোনই উপায় নেই।  একপর্যায়ে প্রায় দু শবছর ধরে আজাদী সংগ্রামের জন্য সর্বস্ব ত্যাগকারী মুজাহিদদের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল দেওবন্দ দারুল উলুম মাদরাসা। ঐ মাদরাসার প্রাণপুরুষ শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমূদ হাসানকে কেন্দ্র করেই ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালিত হচ্ছিল। ভারতবর্ষে বসেই তিনি তুরস্কের তথা গোটা মুসলিমজাহানের খলীফা ও আফগানিস্তান প্রভৃতি রাষ্ট্রের সাথে এ বিষয়ে যোগাযোগ রক্ষা করেছিলেন। তাঁরই দূতরূপে মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী কাবুল হয়ে সুদূর সোভিয়েত রাশিয়ায় গিয়ে অবস্থান করেছিলেন। তাঁর ঐতিহাসিক রেশমী রুমাল আন্দোলনও মাল্টাদ্বীপে বন্দীজীবন যাপন আমাদের ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের দুটি উজ্জ্বল অধ্যায়। তাঁরই শিষ্যরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরেই কাবুলে সর্বপ্রথম ভারতীয় প্রবাসী সরকার গঠন করেছিলেন। ১৯২০-২১ সালের যে খিলাফত আন্দোলন ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের পর ভারতবাসীর মধ্যে সর্বাধিক সাড়া জাগিয়েছিল তার প্রাণপুরুষও ছিলেন তিনিই। মাওলানা মুহাম্মদ আলী শওকত আলী ও মাওলানা আবুল কালাম আজাদকে তিনিই এ আন্দোলনে উদ্দীপ্ত করেছিলেন- যাতে আমাদের মাওলানা আকরাম খাঁ ও মাওলানা মুনীরুজ্জামান ইসলামাবাদীসহ অসংখ্য বাঙ্গালী  আলেম উল্লেখ্যযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। এই খিলাফত আন্দোলনের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মোহনচাঁদ করমচাঁদ গান্ধী  ভারতীয় জাতির বাপুজী হতে সমর্থ হয়েছিলেন। ইতিপূর্বে বাল-লাল-পাল (লালা লাজপৎরায়, বালগঙ্গাধর তিলক ও আমাদের সিলেটের বিপিনচন্দ্র পাল) ব্রাহ্মণ নেতৃত্রয়ের একক আধিপত্য ছিল ভারতীয় রাজনীতিতে। বানিয়া জাতি থেকে উদ্ভুত গুজরাটী গান্ধীর কার্যত সেখানে প্রবেশাধিকারই ছিল না। উক্ত শায়খুল হিন্দ মাহমূদ হাসানের মাল্টার বন্দী জীবনের ঘনিষ্ঠতম সহচর মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী ও মুফতীয়ে আযম মুফতী কিফায়াতুল্লাহসহ তাঁর অধিকাংশ শিষ্য-শাগরিদ ছিলেন অতি আত্মবিশ্বাসী। তাঁরা প্রায় সবাই জমিয়তে  উলামায়ে-হিন্দের পতাকাতলে সমবেত ছিলেন এবং তাঁরা পাকিস্তান আন্দোলনকে ভারতীয় মুসলমানদের জন্যে ক্ষতিকর ও সর্বনাশা পরিকল্পনা বলে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। তাঁদের মতে, এটা দুর্বল ঈমানের অধিকারী আত্মবিশ্বাসহীনদের চিন্তাধারা। এটি ব্রিটিশ শাসকদের বহুল আচরিত ও কুখ্যাত ভেদনীতি    ‘Divide & Rule’ -এরই ফসল। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বিশাল হিন্দুসমাজ সংখ্যার দিক থেকে তাদের এক চতুর্থাংশ মুসলমানদের প্রতাপ ও শক্তির কোনো ক্ষতিই করতে পারবে না। মাওলানা মাদানীর ভাষায় : ত্রিশ কোটি তৃণভোজী ছাগল দশ কোটি মাংসভোজী ব্যাঘ্রকে গ্রাস করে ফেলবে- এরূপ ধারণা নেহাৎ অলীক।বরং দেশ বিভাগের ফলে ভারতবর্ষের মুসলমানদের দীর্ঘ আট শবছরের শাসনামলে গড়া কৃষ্টিকালচার ও প্রতিষ্ঠানাদি ধ্বংস হবে। হিন্দুস্তান মুসলমানদের জন্যে ও পাকিস্তান খোদ ইসলামের জন্যে খতরা হয়ে দাঁড়াবে। মুসলিমলীগ নেতৃত্ব কোনোদিনই পাকিস্তানে ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করবে না। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ বলতেন, ২৪ বছরের বেশিকাল পাকিস্তান টিকবে না। কেননা, বাঙালী জাতি একটি  সংগ্রামী জাতি। তারা দীর্ঘকাল বাইরের লোকদের শাসন বরদাশত করবে না। (দেখুন ইন্ডিয়া উইন্স ফ্রিডম ও তার মৎকৃত  অনুবাদ ও ভাষ্যগ্রন্থ ভারত যখন স্বাধীন হচ্ছিলনিউ বুক সোসাইটি বাংলাদেশ ঢাকা থেকে প্রকাশিত ১৯৭৪)

এই যেখানে অবস্থা ছিল সেখানে মাওলানা মাদানীর সুদীর্ঘকালের চারণক্ষেত্র সিলেট বিভাগের মুসলমান ভোটারদের পাকিস্তানের স্বপক্ষে আনয়ন ছিল একটি সুকঠিন ব্যাপার। এটা কেবল দেওবন্দেরই কোনো স্বীকৃত ও ব্যক্তিত্বশীল প্রভাবশালী আলেমের পক্ষেই মোকাবেলা করা সম্ভব ছিল। ব্যাপারটি কেবল সিলেট বা সীমান্ত প্রদেশের জন্যই নয়, গোটা পাকিস্তান আন্দোলনের ব্যাপারেই সমান সত্য ছিল। সৌভাগ্যক্রমে মুসলিমলীগ ভারতবর্ষের একজন শ্রেষ্ঠ আলেম হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রাহ.-কে (১৮৬১-১৯৪৩ঈ.) স্বপক্ষে পেয়েছিল- যাঁর সম্পর্কে জিন্নাহ সাহেব বলতেন, ‘গোটা ভারতবর্ষের আলেম সমাজকে এক পাল্লায় এবং মাওলানা থানবীকে অন্য পাল্লায় রাখলে থানবী সাহেবের পাল্লাই ভারী হবে।জিন্নাহর এ বক্তব্যটি অমূলক ছিল না। পাকিস্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শীর্ষস্থানীয় আলেমগণ-আল্লামা শাব্বীর আহমদ উছমানী (১৮৮৭-১৯৪৯ঈ.), আল্লামা যফর আহমদ উছমানী (১৮৯২-১৯৭৪ঈ.), আল্লামা সায়্যিদ সুলায়মান নদভী (১৮৮৪-১৯৫৩ঈ.), আল্লামা মুফতী সহূল উছমানী ভাগলপুরী (১৮৭৬-১৯৪৯ঈ.), হাফেয মওলানা আতহার আলী (১৮৯১-১৯৭৬ঈ.), মওলানা আবদুর রশীদ টুকেরবাজারী (১৮৯৬-১৯৮৭ঈ.) প্রমুখ উলামায়ে কেরামের সকলেই ছিলেন হযরত থানবী রাহ.-এর শিষ্য-শাগরেদ। এঁদের প্রাণান্তকর সংগ্রাম-সাধনা ব্যতিরেকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা ছিল এক অসম্ভব ব্যাপার। কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও মুসলিমলীগ-নেতৃত্ব এরই স্বীকৃতিস্বরূপ পাকিস্তানের প্রথম প্রভাতে ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট তারিখের ঐতিহাসিক শুভলগ্নে পাকিস্তানের রাজধানী করাচীতে প্রথমোক্ত আল্লামা শাব্বীর আহমদ উছমানীকে দিয়ে এবং পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় আল্লামা যফর আহমদ উছমানীকে দিয়ে এবং গণভোট-বিজয়ী সিলেট জেলা-মুসলিমলীগের সভাপতি মওলানা আবদুর রশীদ টুকেরবাজারীকে দিয়ে সিলেটে সর্বপ্রথম পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলনের আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। উক্ত আলেমগণের প্রভাবেই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বে দুই শতাধিকবার প্রকাশ্য জনসভাসমূহে ঘোষণা করেছিলেন যে, পাকিস্তানের শাসন-সংবিধান হচ্ছে আলকুরআন, যা চৌদ্দশ বছর পূর্ব থেকেই ধরাপৃষ্ঠে বর্তমান রয়েছে।

মূল পাকিস্তান প্রস্তাব অনুসারে পশ্চিমবঙ্গসহ গোটা বাংলাদেশ এবং গোটা আসাম প্রদেশ (যা বর্তমানে সাতটি রাজ্য হয়ে সপ্তকন্যারূপে বিখ্যাত) পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা ছিল। কেননা, সংখ্যার দিক থেকে এ গোটা ভূখণ্ডটি ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। আর মুসলিমলীগের দাবি ছিল ভারতবর্ষের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিমাঞ্চলের প্রদেশগুলি (ভারতের দখলকৃত জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যসহ) এবং পূর্বাঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাসমূহ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হবে। সমকালীন বিশ্বের সর্বাধিক তীক্ষ্মদর্শী আইনজীবী মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর শাণিত যুক্তির কাছে মাথা নত করে বৃটিশ সরকার ও হিন্দু নেতৃত্ব যা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু বৃটিশ শেষ ভাইসরয় মাউন্ট ব্যাটন ও কংগ্রেসী হিন্দু নেতৃত্ব ষড়যন্ত্র করে মুসলিমপ্রধান পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে পূর্ব পাঞ্জাবকে (মুসলিম প্রধান গুরুদাসপুর জেলাসহ) এবং বাংলাদেশ তথা পূর্বপাকিস্তান থেকে পশ্চিমবঙ্গকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে সমর্থ হয়। আসামে লীগরাজনীতির প্রভাব থাকা সত্ত্বেও (স্যার সাদুল্লাহ ছিলেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী) গান্ধী প্যাটেলের ধমকে কংগ্রেসী হিন্দু নেতারা প্রদেশটিকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার আন্দোলন করতে বাধ্য হন। উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ (বর্তমান খায়বার পাখতুনখা) মুসলিমপ্রধান হওয়া সত্ত্বেও সীমান্তগান্ধী বলে পরিচিত আবদুল গাফফার খানের কংগ্রেসী রাজনীতির প্রভাবে গণভোট করার প্রয়োজন দেখা দেয়। ওদিকে হিন্দুপ্রধান পূর্বপাঞ্জাবের মুসলিমপ্রধান গুরুদাসপুর জেলায় গণভোটের দাবি স্বীকৃত না হলেও আসামের সিলেট জেলায় গণভোট দাবি স্বীকৃত হয় এবং সে মতে ১৯৪৬ সালের ৭ ও ৮জুন তারিখে গোটা সিলেট জেলাব্যাপী (বর্তমানে বিভাগ) প্রতিদ্বন্দি¦তাপূর্ণ গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। বৃহত্তর সিলেট জেলা তথা বর্তমান সিলেট বিভাগে মুসলিমপ্রাধান্য ছিল অনেকটা মার্জিন্যাল। অনুপাতে হিন্দু-মুসলিম জনসংখ্যা ছিল ৪৬:৫৪। আবার মাওলানা মাদানীর দীর্ঘকালের চারণক্ষেত্র হওয়ায় মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ ছিল কংগ্রেস তথা অবিভক্ত ভারতের পক্ষপাতী জমিয়তে উলামায়ে-হিন্দের সমর্থক। করীমগঞ্জ বদরপুরের প্রভাবশালী পীর মাওলানা ইয়াকুব উরফে হাতেম আলী পীর সাহেব, মোগলাবাজারের মাওলানা আবদুল জলীল (পরবর্তীতে আসামে হিজরতকারী এবং আসাম রাজ্যসভার প্রায় আজীবন সদস্য) জৈন্তার মাওলানা ইবরাহীম চতুলী (আসাম রাজ্যসভার সদস্য) প্রমুখ অনেক জাঁদরেল প্রভাবশালী আলেম ঐ গোষ্ঠীতে সক্রিয় ছিলেন। ফলে সিলেট জেলার গণভোটে পাকিস্তানভুক্তির সম্ভাবনাটা ছিল ক্ষীণ। এ সময় গোটা ভারতবর্ষের মুসলিমলীগ-নেতৃত্বের সহায়তায় যদি খোদ দেওবন্দেরই কিছু প্রভাবশালী আলেম এগিয়ে না আসতেন তাহলে এ গণভোটে মুসলিম লীগপন্থীদের বিজয় লাভ এবং পাকিস্তানভুক্তি ছিল একটি অসম্ভব ব্যাপার। কেননা, ধর্মীয় আচার-আচরণে মুসলিমলীগপন্থীদের ঘাটতিটা ছিল সুবিদিত।

এমতাবস্থায় মুসলিম ধর্মপ্রাণ জনগণের পক্ষে তাদের প্রতি আস্থাশীল হওয়াটা  ছিল একটি কঠিন ব্যাপার। এটি পাকিস্তান অর্জনের পথে সর্বত্রই একটি বাস্তব প্রতিবন্ধক ছিল- যা গণজোয়ার সৃষ্টির মাধ্যমে মুসলিমলীগ মোকাবেলা করতে পেরেছিল।

পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে যে, সৌভাগ্যক্রমে মুসলিমলীগ হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রাহ-কে তার সমর্থকরূপে পেয়ে গিয়েছিল, যিনি বিশ্বাস করতেন যে, ভারতীয় উগ্র সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী হিন্দুদের উপর ভরসা করে অবিভক্ত ভারত গড়ার পরিবর্তে মুসলমানদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী ও সচেষ্ট হওয়াটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। মুসলিম লীগের নেতাদের মতো তাঁর মনেও গভীর অবিশ্বাস ছিল যে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতির দোহাই দিয়ে অবিভক্ত ভারতীয় ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হলেও শেষ পর্যন্ত হিন্দুরা মুসলমানদের প্রতি সুবিচার করবে না। আর একটি অমুসলিমপ্রধান রাষ্ট্রে ইসলামের রাজনৈতিক আদর্শ বাস্তবায়নও কোনোক্রমেই সম্ভব হবে না। তাই তিনি তানযীমুল মুসলিমীন নামে একটি ফতোয়া রচনা করে মুসলমানদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের স্বপক্ষে জোরদার বক্তব্য দিয়েছিলেন। ঐ রচনাটি আসলে ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের রাজনৈতিক দিকদর্শন প্রদানকারী রচনা। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও মুসলিমলীগ নেতারা দীর্ঘকাল কংগ্রেসী রাজনীতি করার পর বাস্তবক্ষেত্রে যে তিক্ত অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন, খানকাবাসী বিজ্ঞ আলেম মাওলানা থানবী রাহ. তাঁর খোদাপ্রদত্ত তীক্ষè দৃষ্টি দিয়ে তা অনুধাবন করলেন এবং তার স্বপক্ষে শাস্ত্রীয় ও তাত্ত্বিক  যুক্তিপ্রমাণ উপস্থাপন করলেন। ফলে ভারতবর্ষের বৃহত্তর আলেম সমাজ ও তাদের সংগঠন জামিয়তে উলামায়ে হিন্দের যুক্তিপ্রমাণ ও অবিভক্ত ভারতের স্বপক্ষের আহ্বান বৃহত্তর মুসলিম সমাজের কাছে তার প্রভাব হারিয়ে বসে।

কিন্তু একটি বাস্তব সত্যকে উপেক্ষা করা যায় না। মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী রাহ.-এর জ্ঞানবত্তা, তাসাউফ সাধনা এবং চারিত্রিক মহানুভবতার গভীর প্রভাব পড়েছিল সিলেট বিভাগের মুসলিম সমাজে। এ অঞ্চলে তিনি দীর্ঘকাল কাটিয়েছেন। তাঁর কয়েক ডজন খলীফা কেবল সিলেট জেলায়ই রয়েছেন- যাঁদের অনেকেই বরেণ্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী এবং বিশিষ্ট আলেম। ফলে তাঁদের প্রভাব সিলেটের গণভোটে মুসলিমলীগ তথা পাকিস্তানপন্থীদের পথে ছিল বিরাট প্রতিবন্ধক। মাওলানা আতহার আলীর মতো একজন বরেণ্য আলেম হযরত থানবীর খলীফা হওয়া সত্ত্বেও তিনি তাঁর মুর্শিদের আদেশে জেলার বাইরে কিশোরগঞ্জকে তার কর্মস্থলরূপে বেছে নিয়েছিলেন। তাই মাওলানা মাদানীর মোকাবেলায় সিলেটে তাঁর প্রভাব তেমন কার্যকরী ছিল না। সিলেটের মুসলিমলীগ-নেতৃত্ব এ অভাবটি হাড়ে হাড়ে অনুভব করছিলেন। তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতেই তাঁদের বিশিষ্ট কয়েকজন নেতা আসামের চারজন মন্ত্রী পাঠানটোলার মওলবী আবদুল হামিদ, ভাদেশ্বরের আবদুল মতিন চৌধুরী, সুনামগঞ্জের মুনাওয়ার আলী ও মোদাব্বির আহমদ সিলেট শহরের উপকণ্ঠে টুকের বাজারে অবস্থিত মাওলানা আবদুর রশীদ মরহুমের বাড়ীতে গিয়ে উপস্থিত হলেন এবং তাঁকে তাঁর মুর্শিদ মাওলানা থানবীর ফতোয়ার দোহাই দিয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানালেন। মাওলানা আবদুর রশীদ পাঠ্যাবস্থায় দেওবন্দ গেলে থানাভবনে গিয়ে হযরত থানবীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তিনি দীর্ঘ বার বছর পর্যন্ত নির্জন খানকাহজীবন অতিবাহিত করছিলেন। বাইরের জগতের সাথে তাঁর কোনো সম্পর্কই ছিল না। মুসলিমলীগ নেতারা তাঁকে বুঝিয়েসুজিয়ে উত্তর সিলেট জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি পদ গ্রহণে সম্মত করলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, উত্তর সিলেট (বর্তমান সিলেট জেলা) তখন সিলেট জেলার (বর্তমানে বিভাগ) চারটি মহকুমার একটি ছিল, জেলা ছিল না। কিন্তু নিখিল ভারত মুসলিমলীগ ঐ দুটি এলাকার বিশেষ গুরুত্ব বিবেচনায় কোলকাতা মহানগরী মুসলিম লীগ এবং উত্তর সিলেট মহকুমা মুসলিম লীগকে একটি পূর্ণ জেলা মুসলিমলীগের মর্যাদাদানের বিশেষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। সে মতে মাওলানা আবদুর রশীদ সিলেট জেলা মুসলিমলীগের সভাপতি হলেন। এ তথ্যটি আমি আমার চাচা উক্ত মাওলানা আবদুর রশীদ সাহেবের মুখেই শুনেছিলাম।

১৯৪৬ সালে যখন গণভোটের মাধ্যমে সিলেটের ভাগ্য নির্ধারণের সরকারি সিদ্ধান্ত বৃটিশ সরকার ঘোষণা করল, তখন এ গণভোটের দায়িত্বটি মুসলিম লীগের নেতাদের উপরই বর্তিয়েছিল।  দারুল উলূম দেওবন্দের একজন প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে মওলানা আবদুর রশীদের উক্ত দারুল উলূমের প্রধান মুহাদ্দিস ও শিক্ষা সচিব মাওলানা মাদানীর বিপক্ষে শক্ত অবস্থান গ্রহণ ছিল একটি সুকঠিন ব্যাপার। অথচ এই গণভোটের বিজয় অর্জন ছাড়া সিলেটের পাকিস্তানভুক্তি কোনরূপেই সম্ভব ছিল না। অথচ মুসলিমলীগের সাংগঠনিক প্রধান (সভাপতি) হিসাবে তাঁর দায়ভাগই ছিল সর্বাধিক। এ গণভোট বিজয়ের জন্যে তিনি যে দুটি মোক্ষম কৌশল গ্রহণ করেন সে দুটি হল :

১. মাওলানা সহূল উছমানীর নেতৃত্বে আলেম সমাজকে সক্রিয় করণ।

২. সিলেট বিভাগের সুসংগঠিত মুসলিম মৎস্যজীবী সম্প্রদায়কে স্বপক্ষে সক্রিয়করণ। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, খাসিয়া জয়ন্তিয়া পাহাড় ও পার্বত্য ত্রিপুরার পাহাড়-পর্বত-নিঃসৃত জলরাশির দ্বারা সৃষ্ট হাওর-বাওরসমৃদ্ধ সিলেট বিভাগে মৎস্যজীবী সম্প্রদায় ভোটের ব্যাপারে ছিল একটি বড় ফ্যাক্টর।

আমাদের সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তাঁর আত্মজীবনীতে   তৎকালীন সমাজ ও রাজনীতি শীর্ষক দীর্ঘ কুড়ি পৃষ্ঠাব্যাপী (পৃ. ৪২-৬১) প্রবন্ধে সিলেটের গণভোট সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে লেখেন :

গণভোটের দায়িত্বে নিযুক্ত হয়েছেন বিদ্বেষী কর্মকর্তা লীগেল এডমিনেস্ট্রেশনের সিনিয়র স্টাফ এবং সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্বে আছেন শিখ অফিসার লে. কর্ণেল মহিন্দর সিং। সরকারী সমর্থন ছাড়াও কংগ্রেসের আছে অর্থবল। মুসলমানদের মধ্যে আছেন কংগ্রেসসমর্থক জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ও  তাদের বিখ্যাত নেতা হোসেন আহমদ মাদানী কংগ্রেসের পক্ষে নির্বাচনী অভিযানে তৎপর। মাওলানা মাদানীর শিষ্যরা কঠিন সমস্যার সৃষ্টি করল। তারা স্লোগান তুলল, ঘরের ছেলে ঘরে থাকো, ঘরের বাক্সে ভোট দাও।” (উল্লেখ্য, গণভোটকালে কংগ্রেসের ভোটের মার্কা ছিল ঘর) মাওলানা সহূল উছমানী ছিলেন আরেক প্রভাবশালী ধর্মনেতা। তিনি সিলেট আলিয়া মাদরাসায় অনেকদিন ছিলেন এবং তাঁর অনুসারীও ছিল প্রচুর। তিনি তখন বিহারে এবং বয়সে প্রায় অশীতিপর। তাঁকে অনুরোধ করে নিয়ে আসা হল এবং তিনি ফতোয়া দিলেন যে, কুড়ালের (মুসলিম লীগ প্রতীক) জন্য ভোট দান বায়তুল-ইসলামের জন্য ভোট। তিনি তাঁর বয়সের বিবেচনা না করে জেলার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত চষে বেড়ালেন।” (পৃ. ৫৫-৫৭)

১৯৪৬ সালের ৬ ও ৭ই জুন তারিখে অনুষ্ঠিত উক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ গণভোট মুসলিমলীগ তথা পাকিস্তানপক্ষ ৫৬,০০০ ভোটে জয়যুক্ত হয়ে সিলেটের পাকিস্তানভুক্তির সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। যে সিদ্ধান্ত কার্যকরীকরণে অনেক ফাঁক ফোঁকড় ও ছলচাতুরী ছিল।

এ গণভোট যেমন সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের প্রায় সবাই সিলেটে এসেছিলেন তেমনি একজন কর্মী হিসাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও বিশাল কার্যবাহিনীসহ বেশ কয়েকদিন সিলেটে  অবস্থান করেছিলেন। এ গণভোটের পূর্ণ আলোচনা এবং মাওলানা সহূল উছমানীর অবদান সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনার অবকাশ রয়েছে, যা পরবর্তীতে বিস্তারিত আলোচনা করার আশা রইল।”          

পূর্বেই উল্লেখ করে এসেছি যে, দারুল উলূম দেওবন্দের শিক্ষাসচিব উপরন্তু জমিয়তে উলামায়ে-হিন্দের প্রধান মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানীর বিশাল ব্যক্তিত্বের প্রভাব বিশেষত তাঁর আধ্যাত্মিক কর্মতৎপরতার কেন্দ্র সিলেটে ছিল ব্যাপক। গোটা ভারতবর্ষের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা শিষ্য-শাগরেদগণ রমযান মাসে সিলেটে এসে তাঁর সাথে এতেকাফ করে তাঁর খিলাফত তথা আধ্যাত্মিক পূর্ণতার সনদ হাসিল করতেন। এমতাবস্থায় তাঁর শিষ্যপর্যায়ের ব্যক্তিত্ব সিলেট মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আবদুর রশীদের পক্ষে তাঁর মোকাবেলা করা ছিল একটা অসম্ভব ব্যাপার। অন্য কেউ বুঝুক বা নাই বুঝুক নিজে তিনি তা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেন যে, মুসলিমলীগের সভাপতিরূপে এ গুরুদায়িত্বটি পালনের দয়ভাগ তাঁরই উপর সর্বাধিক বর্তায়। তিনি উপলব্ধি করলেন যে, মাওলানা মাদানীর মোকাবেলা করতে হলে তাঁর বিপক্ষে মুসলিমলীগের স্বপক্ষে একজন প্রবীণ আলেমের বিশেষত দেওবন্দী মহলে স্বীকৃত কোনো বিশাল ব্যক্তিত্বের সমর্থন ও সহযোগিতা অপরিহার্য। সৌভাগ্যক্রমে তিনি তেমনি একজন ব্যক্তিত্বের সন্ধানও দিলেন তাঁর সহকর্মী মুসলিম লীগ নেতাদেরকে। তিনি ছিলেন দারুল উলূম দেওবন্দেরই সাবেক মুফতীয়ে আযম মাওলানা সহূল উছমানী ভাগলপুরী রাহ.। সৌভাগ্যক্রমে তিনি ছিলেন মাওলানা মাদানীর চাইতেও বয়োজ্যেষ্ঠ এবং তিনি ও মাদানী সাহেব যে উস্তাযের গদীনশীন ও প্রতিনিধিরূপে দেশব্যাপী খ্যাতি ও গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছিলেন সেই শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমূদ হাসান রাহ.-এর অত্যন্ত প্রিয়ভাজন শিষ্য এবং ততোধিক খ্যাতিমান ও স্বীকৃত আলেম মাওলানা রশিদ আহমদ গঙ্গোহী রাহ.-এর খলীফা। তাঁর গ্রহণযোগ্যতা সাধারণ্যে হযরত মাদানীর মতো না হলেও আলেম সমাজের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ও খ্যাতি কোনো অংশেই কম ছিল না। সৌভাগ্যক্রমে তিনিও সিলেটের জনজীবনে একজন পরিচিত ও স্বীকৃত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ১৯১৮ সালে প্রথমবার তিনি সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসার শিক্ষকরূপে সিলেট এসেছিলেন। তখন স্বল্পকাল তাঁর সিলেট অবস্থানের পরই তাঁর মাতৃভূমি পাটনার শামসুল হুদা মাদরাসায় প্রিন্সিপালরূপে তাঁর ডাক পড়ে এবং তিনি দীর্ঘকাল সেখানে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু ১৯৩৭ সালে সিলেট মাদরাসায় টাইটেল ও হাদীস ক্লাস চালু হলে প্রধান মুহাদ্দিসরূপে আবার তাঁরই ডাক পড়ে। কেননা, গোটা ভারতবর্ষে সরকারি মাদরাসা হিসাবে এ মাদরাসাটি ছিল ১৭৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত কোলকাতা আলিয়া মাদরাসারই সমপর্যায়ের। তাই আসামসরকার গোটা ভারতবর্ষের খ্যাতিমান কোনো আলেমকে দিয়েই সিলেট আলিয়া মাদরাসার হাদীস ক্লাস শুরু করতে আগ্রহী ছিল। তাঁর এই সর্বভারতীয় খ্যাতির জন্যেই  নিখিলভারত মুসলিমলীগের স্বপক্ষে ১৯৪৫ সালে কোলকাতায় জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের মোকাবেলায় জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠার সর্বভারতীয় আয়োজন করেন তখন এই মাওলানা সহূল উছমানীকেই তাঁরা সংগঠনটির সভাপতিরূপে পাওয়ার আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করেন। কিন্তু বয়সের ভারে ন্যুব্জ মাওলানা মুফতী সহূল উছমানী সে গুরুদায়িত্ব নিজ স্কন্ধে তুলে নিতে অপারগতা জ্ঞাপন করেন। অগত্যা তার বিকল্পরূপে আল্লামা শাব্বীর আহমদ উছমানীকে সে সংগঠনের সভাপতিরূপে তাঁরা মনোনীত করেন- যিনি ছিলেন জ্যেষ্ঠতায় তাঁর দ্বিতীয়স্থানীয়।

সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসায় দীর্ঘ সাত বছর পর্যন্ত প্রধান মুহাদ্দিসরূপে কর্মরত থাকার পর তাঁর কর্মকাল সমাপ্তির পরও আসাম সরকার বর্ধিত মেয়াদে সেই পদে থাকার অনুরোধ করা সত্ত্বেও বয়সের ভারে ন্যুব্জ মাওলানা উছমানী ১৯৪৪ সালের ১লা মে তারিখ সেখান থেকে বিদায় নিয়ে ভাগলপুরের পৈত্রিক নিবাসে চলে যান।

সিলেট বিভাগের জনজীবনে মাওলানা সহূল উছমানীর যে কী বিপুল প্রভাব ছিল তার প্রমাণ হচ্ছে ১৯১৯ সালে আওরঙ্গপুরের জমিদার ভ্রাতৃদ্বয় সৈয়দ আফরোজ হাসান মজুমদার ও সৈয়দ ইয়াওর হাসান মজুমদারের পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের খসরুপুর মাঠে অনুষ্ঠিত উলামা সম্মেলনে তিনিই সভাপতিত্ব করেছিলেন। সে সম্মেলনের প্রধান বক্তা ছিলেন কোলকাতা থেকে আগত বাগ্মী বক্তা সৈয়দ ইসমাঈল হোসেন শিরাজী। ঐ সম্মেলনেই সর্বপ্রথম আসাম প্রাদেশিক উলামা সমিতি গঠিত হয়েছিল। মাওলানা আবদুল হক চৌধুরী মুখতারপুরী, মাাওলানা সাখাওয়াতুল আম্বিয়া বফীপুরী, মাওলানা নযীরুদ্দীন বালিকান্দী, ডাক্তার মর্তুজা চৌধুরী গাভুরটেকী ও মাওলানা আবদুর রহমান সিংকাপনী প্রমুখ এ সম্মেলন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। সিলেট বিভাগে এটি ছিল অভূতপূর্ব সফল সম্মেলন। উক্ত সম্মেলনের ভাষণে তাঁরই প্রস্তাবে সিলেটের নয়াসড়কে ঐতিহাসিক খিলাফত বিল্ডিং-এ একটি কওমী মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়, যা সুদীর্ঘকাল পর্যন্ত বেদখল থাকার পর  শায়খে কাতিয়া মরহূম মাওলানা আমীনুদ্দীন কর্তৃক পুনরায় চালু হয়ে এখনো বিদ্যমান রয়েছে। মাওলানা মাদানী রাহ. এ মাদরাসায় দীর্ঘকাল হাদীসের দরস দিয়েছেন।

১৯২৪ সনের সেপ্টেম্বর মাসে নিখিল ভারত জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের মহাসচিব দিল্লির মাওলানা আহমদ সাঈদের সভাপতিত্বে আসাম প্রাদেশিক জমিয়তে উলামার ৪র্থ সম্মেলনে মাওলানা সহূল উছমানী পাটনা থেকে এসে শরীক হয়েছিলেন। তিনিই যে জমিয়তে উলামায়ে আসাম প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন সম্মেলনের উদ্যোক্তাগণ তা কোনোক্রমেই ভুলতে পারেননি এবং তিনিও তাতে সাড়া দিতে কার্পণ্য করেননি। সিলেট বিভাগের সর্বত্র তাঁর শাগরেদ ও খলীফাগণ ছড়িয়ে  রয়েছেন।

১৯৪৭ সালের গণভোটকালের সংকটে তাঁকে পাশে পাওয়া যে কত জরুরি ছিল তা ইতিপূর্বেও উল্লেখ করেছি। সংগঠন হিসাবে মুসলিম লীগই ছিল এ প্রয়োজন পূরণের সবচাইতে বড় দায়িত্বশীল এবং তাদের গরজই ছিল সর্বাধিক। কিন্তু জীবনের অন্তিম পর্যায়ে মাওলানা সহূল উছমানী রাহ. একাকী সিলেটে আসতে কোনমতেই রাজী হচ্ছিলেন না। বিশেষত ঐ সময়ে বিহারে প্রচণ্ড মুসলিম-বিরোধী দাঙ্গা হচ্ছিল। সিলেটে তাঁর পাকিস্তানের স্বপক্ষে তৎপরতার সংবাদে উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি তাঁর পরিবার-পরিজনের সর্বাধিক ক্ষতি করবে, এমনকি তাদেরকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়াও বিচিত্র  ছিল না। অথচ গোটা পরিবারকে এতদূর থেকে সিলেট স্থানান্তরিত করাটা ছিল বেশ ব্যয়সাপেক্ষ। তাঁকে সিলেটে নিয়ে আসা অপরিহার্য বলে সকলে একমত হলেও বিশাল ব্যয়ভার বহনে মুসলিমলীগের দায়িত্বশীল জমিদার শ্রেণীর লোকজন ছিলেন দ্বিধাগ্রস্ত। মাওলানা সাহেবকে পাটনা থেকে নিয়ে আসার দায়িত্বশীল এবং তাঁরই একান্ত খাদেম মাওলানা সৈয়দ তাফাজ্জল হোসাইন এ ব্যাপারে সিলেটের ব্যবসায়ী মহলের কয়েকজনের দানের কথা উল্লেখ করেছেন বটে; কিন্তু মুসলিম লীগ নেতৃত্বের অভ্যন্তরীণ অবস্থা তো তাঁর জানার কথা নয়। সৈয়দ নবীব আলী ও প্রিন্সিপাল মাজদুদ্দীন সাহেবের পরম আগ্রহ ও তাঁদের অবদানের কথাও তাঁর জানামতে তিনি উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ভিতরের খবর তো তাঁর জানা ছিল না! তাই সেই অকথিত কথাটি আমাকে এখানে উল্লেখ করতে হচ্ছে। আমার তথ্যসূত্র খুবই প্রামাণ্য, কেননা সিলেট জেলা মুসলিম লীগের তদানীন্তন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক আমাকে এ তথ্য দিয়েছেন। সিলেট-বিশেষজ্ঞ গবেষক বন্ধুবর দেওয়ান নুরুল আনোয়ার হোসাইন চৌধুরীর সিলেটের গণভোটগ্রন্থে এবং মাওলানা সহূল উছমানীর খলীফা ও জীবনী লেখক মাওলানা সৈয়দ তাফাজ্জুল হোসাইনের গ্রন্থেও সেদিকে ইংগিত রয়েছে।

সিলেট মুসলিমলীগের তদানীন্তন সভাপতি মাওলানা আবদুর রশীদ মরহুম ছিলেন আমার চাচা-দাদার আপন ভাতিজা। বাংলাদেশ হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি ও নির্বাচন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মাসঊদ চৌধুরী আমাকে বলেছেন, “আমরা ছিলাম মুসলিমলীগের ছাত্র ও যুবকর্মীরূপে মাওলানা আবদুর রশীদ সাহেবের যুবকর্মী। অনেকসময় তাঁর পক্ষ থেকে পত্রিকায় বিবৃতির মুসাবিদা লেখার কাজটি তিনি আমাকে দিয়ে করাতেন।”  আবদুস সামাদ (পরবর্তীতে আজাদ), এডভোকেট জসীমুদ্দীন, (পরবর্তীতে প্রায় আজীবন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং সর্বশেষে ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন গভর্নর মালিকের মন্ত্রীসভার সদস্য), সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদ হোসেন, দেওয়ান ফরিদ গাজী, ক্যাপ্টেন ফজলুর রহমান, আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রমুখও ছিলেন এই কাতারেই। সিলেটের গণভোটের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শাহ আজীজুর রহমান, ফজলুল কাদের চৌধুরী প্রমুখও ছাত্রকর্মীরূপে সিলেটে তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। গণভোট উপলক্ষে গোটা ভারতবর্ষের মুসলিমলীগ নেতাদের সাথে স্পীকার তমীযুদ্দীন খানও সিলেটে গিয়েছিলেন এবং তিনি শহরের কোলাহলপূর্ণ পরিবেশের চাইতে মাওলানা আবদুর রশীদের টুকেরবাজারের বাড়িতে গিয়ে রাত্রি যাপনকেই আরামদায়ক বিবেচনা করতেন। ঐসময় তিনি বেশ কয়েকদিন আমাদের বাড়িতেই ছিলেন।

সত্যিকথা  বলতে কী, মাওলানা আবদুর রশিদের ঐ বিশাল কর্মযজ্ঞের দিনগুলোতে আমি ছিলাম ছোট একটি শিশুমাত্র। জিন্নাহ সাহেবের ইন্তেকালের দিন (১৯৪৮ সালে) মন্ত্রী আবদুল হামিদ সাহেবকে তার সাথে দেখা করতে যেতে দেখেছি, স্মরণ আছে। আমি কেন তাঁর একটি জীবনী লিখি না- এরূপ অনুযোগ সিলেটের ইতিহাস-লেখক ক্যাপ্টেন ফজলুর রহমান ও কবি মাহমুদ লস্করের মত প্রাজ্ঞজন আমাকে অভিযুক্ত করেন। কিন্তু আমি তার কী লিখব, আমি যে তখন তাঁর কর্মযজ্ঞের মূল্যায়ন করার অবস্থানে ছিলাম না!

মাওলানা আবদুর রশিদের জীবনের অন্তিম পর্যায়ে বিগত শতকের আশির দশকে একদিন আমার প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন-

হযরত মাওলানা সহূল উছমানীকে সিলেটে আনা গণভোটের জন্য অত্যন্ত জরুরি ছিল। এর গুরুত্ব মুসলিমলীগ নেতৃবৃন্দের সকলেই বুঝতেন এবং স্বীকারও করতেন। কিন্তু তিনি যখন তাঁর পরিবারবর্গকে অরক্ষিত অবস্থায় বিহারে ছেড়ে রেখে একা সিলেটে  আসতে কোনমতেই রাজী হলেন না, তখন বিরাট খরচের কথা ভেবে সকলেই পিছিয়ে গেলেন। তখন আমি বললাম, তাঁকে সপরিবারে বিহার থেকে আনতে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হবে তার অর্ধেক আমি একা দেব, বাকিটা আপনারা সকলে মিলে দিন; তখন এভাবেই তাঁকে আনার ব্যবস্থা হল।

ইসলামের জন্যে, জাতির জন্যে নিবেদিতপ্রাণ নিঃস্বার্থ ও প্রচারবিমুখ মাওলানা আবদুর রশীদ মরহুমের এ বক্তব্যটি লিখিতভাবে প্রচারিত বা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়নি।

গণভোট বিজয়ে বিশিষ্ট ভূমিকা পালনকারী সিলেট জেলা মুসলিমলীগের তদানীন্তন সাধারণ সম্পাদক ভার্থখলার হাজ্বী মুনীরুদ্দীন চৌধুরী (কবি দিলাওয়ায়ের পিতৃব্য)-এর কথা আবুল মাল আবদুল মুহিতসহ অনেকেই উল্লেখ করেছেন বটে, কিন্তু তাঁর ভূমিকার গুরুত্ব তাতে ফুটে ওঠেনি। তিনি তাঁর পিতা আবদুল হাফিয সাহেবের বাড়ীতেই গণভোট তথা মুসলিমলীগের অফিস থাকার সুবাদে তাঁকেই গণভোট যুদ্ধের প্রধান নায়করূপে চিত্রিত করার প্রয়াস পেয়েছেন এবং সে অফিসে অহরহ যাতায়াতকারীদের তালিকায় হাজ্বী মুনীরুদ্দীন ও মাওলানা রশিদের (আসলে আবদুর রশিদ) নাম উল্লেখ করেছেন মাত্র। অথচ সাংগঠনিক কারণেই মুসলিমলীগের সাধারণ সম্পাদক ও প্রেসিডেন্টরূপে পূর্বোক্ত দুজনের ভূমিকাই ছিল সর্বাগ্রগণ্য।

মাওলানা সৈয়দ তাফাজ্জুল হোসাইন তাঁর  উস্তায ও মুর্শিদের জীবনী  লিখেছেন বটে, কিন্তু রাজনীতির ময়দানে বা আসল কর্মক্ষেত্রে কার কতটুকু গুরুত্ব তা তাঁর কাছে অজ্ঞাতই রয়ে গেছে। তবে তিনি তার গ্রন্থটিতে যাঁদের বাণী সংযোজিত করেছেন; বরং যাদেরকে দিয়ে তিনি পুস্তকটির পরিচিতি লিখিয়েছেন সেই গুরুত্বপূর্ণ মনীষীগণের মধ্যে সর্বপ্রথম মাওলানা আবদুর রশীদকেই স্থান দিয়েছেন। তারপর তাঁরই শাগরেদ ও চাচাতো ভাই মাওলানা সিরাজুদ্দীন আহমদকে। এমনটি করতে তাঁকে কে বাধ্য করেছিল? পুস্তকটি প্রকাশে অগ্রণী সাহয্যকারী ডিসি নবীব আলী প্রমুখগণই বা তাতে সম্মতি দিলেন কেমন করে?

হাজ্বী মুনীরুদ্দীন চৌধুরী সাহেবকে আমি সত্তরের দশকেই তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে কৌতুহলভরে জিজ্ঞেস করলাম, গণভোট ও মুসলিমলীগের বিশাল কর্মযজ্ঞে সবচাইতে বড় ভূমিকাটি কার ছিল?

মুহূর্ত বিলম্ব না করেই তিনি জবাব দিলেন, নিঃসন্দেহে মুসলিমলীগের তদানীন্তন সভাপতি মাওলানা আবদুর রশীদের। এজন্যেই তো তাঁকেই এ গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত করা হয়েছিল এবং এজন্যেই তাঁকে দিয়েই পাকিস্তানের প্রথম প্রভাতে ব্রিটিশ পতাকা ইউনিয়ন জ্যাক অপসারণ করে আনুষ্ঠানিকভাবে সিলেট জেলা আদালত-শীর্ষে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করানো  হয়েছিল।

আমি তাঁকে পুনরায় কৌতুহলভরে প্রশ্ন করলাম, চাচাজান! দেশে এত দেওয়ান ও চৌধুরী শ্রেণীর হর্তাকর্তা ব্যক্তিত্ব থাকতে এমন একজন মাওলানাকেই কেন বেছে নেয়া হল, যিনি বংশে তালুকদার হলেও (এর দালীলিক প্রমাণ আমার কাছে মওজুদ রয়েছে) মৎস্যজীবী সমাজের নেতা বলেই যিনি পরিচিত ছিলেন? মাওলানা আবদুর রশীদের বিশ্বস্ত সহকর্মী ও নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক হাজ্বী মুনীরুদ্দীন অকপটে জবাব দিলেন, “বাবা! মুসলিমলীগের প্রয়োজনে অর্থব্যয়ে তো চৌধুরী-জমিদাররা অত্যন্ত কুণ্ঠিত ছিলেন। সেখানে মাওলানা আবদুর রশীদ ও মুসলিম মৎস্যজীবী সমাজ অকুণ্ঠে নানা ত্যাগ স্বীকার করেছেন!

এ-ই ছিল মাওলানা আবদুর রশীদের মুসলিমলীগের সভাপতি এবং স্বাধীন পাকিস্তানের প্রথম ভোরে সিলেটের আদালত-শীর্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন দেশের পতাকা উত্তোলনের জন্যে প্রাধান্যলাভের গূঢ় রহস্য। তিনি মাওলানা সহূল উছমানীকে তাঁর উস্তাযরূপে উল্লেখ করে গণভোট বিজয়ের প্রধান উপাদান ছিল তাঁর দুআ ও অক্লান্ত পরিশ্রমবলে উল্লেখ করেছেন। বন্ধুবর দেওয়ান নুরুল আনোয়ার চৌধুরী তাঁর সিলেটে গণভোট প্রবন্ধে লিখেন, “উত্তর সিলেট মুসলিমলীগের সভাপতি কর্তৃক অনূদিত (অনুবাদক ও প্রকাশকের নাম তিনি ঐ প্রবন্ধে উল্লেখ করেননি) মাওলানা থানবীর তানযীমুল মুসলিমীন-এর অনুবাদ তাহকীমুল মুসলিমীনগোটা সিলেট জেলায় অভূতপূর্ব জাগরণ সৃষ্টি করে। তাঁর এ প্রবন্ধটি প্রথমে ইফা প্রকাশিত সাপ্তাহিক অগ্রপথিকে (এখন তা মাসিক) এবং পরে স্বতন্ত্র পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়।

সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসার সাবেক প্রিন্সিপাল বাহরুল উলূম মাওলানা মোহাম্মদ হোসেন লেখেন- সিলেটের গণভোটে আমার উস্তায হযরত সাহূল উছমানী রাহ.-এর অবদান ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লিখিত থাকবে। ঐ প্রয়োজনীয় মুহূর্তে তিনি সিলেটে না আসলে গণভোটে বিজয় লাভ ও পাকিস্তান অর্জন যে ছিল অসম্ভব ব্যাপার সকলেই এ সত্যটি অকপটে স্বীকার করে থাকেন।

১৯৬২ সালে সিলেট থেকে নির্বাচিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য জননেত্রী বেগম সিরাজুননেসা রশীদ (স্পীকার হুমায়ুন রশীদের আম্মা) বলেন, মাওলানা সহূল উছমানীর সিলেট আগমন ও প্রচেষ্টা ছাড়া সিলেটের গণভোট বিজয় কোনক্রমেই সম্ভব ছিল না। মুসলিমলীগ ও পাকিস্তানের পক্ষে তাঁর ফতোয়ার বিশাল ভূমিকা রয়েছে।

স্বাধীনতার পূর্বে তদানীন্তন বৃহত্তম আসাম প্রদেশের রাজধানী শিলং-এর এবং তারপর সিলেট জেলার ডেপুটি কমিশনার সৈয়দ নবীব আলী চৌধুরীর অনুরূপ সাক্ষ্যও বিদ্যমান রয়েছে। সর্বমহলে স্বীকৃত তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সিলেট শহরের রিকাবী বাজার থেকে দক্ষিণগামী সড়কটির নামকরণ করা হয়েছিল মাওলানা সহূল উছমানী রোডনামে। ইদানীং ইতিহাসবিমুখ কে বা কারা নাকি সে সাইনবোর্ডটি উঠিয়ে দেয়ার মত জঘন্য মনোবৃত্তির পরিচয় দিয়েছে। এটি যেমন আমাদের পূর্বসূরীদের তেমনি বঙ্গবন্ধুর জন্যেও অবমাননাকর। কেননা, ¦য়ং বঙ্গবন্ধু বিরাট কর্মিবাহিনী নিয়ে সিলেটের গণভোট উপলক্ষে যাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাঁর পবিত্র স্মৃতির অবমাননা সংশ্লিষ্ট সকল জাতীয় নেতারই অবমাননার নামান্তর। এরূপ অর্বাচীনতাকে আজ আমরা যদি প্রশ্রয় দেই তাহলে কাল আমরা যেসব স্মৃতি নিয়ে এখন  মাতামাতি করছি, সেগুলোও কেউ না কেউ সমূলে ধ্বংস করে দেবে। সেটি কি কাম্য হতে পারে?

মাওলানা সহূল উছমানীর জীবনী সংক্রান্ত কয়েকটি জরুরি তথ্য

যেহেতু এ প্রবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে সিলেটের গণভোটে মাওলানা সহূল উছমানীর অবদান। তাই তাঁর জীবনী সংক্রান্ত তথ্যগুলো সেভাবে আসেনি। অথচ এমন একজন গুরুত্বপূর্ণ মহাপুরুষের জীবনের সেসব দিক সম্পর্কে পাঠকদের কৌতূহল থাকাটাও খুবই স্বাভাবিক। তাই সে তথ্যগুলোও সংক্ষেপে নিম্নে দিয়ে দেয়া হল।

 

জন্ম :

বিহারের  পাটনা জেলার ভাগলপুরস্থ পুরীণীগ্রামে ১২৯৫ হিজরী সনে।

বংশ পরিচিতি :

তিনি ইসলামের তৃতীয় খলীফা হযরত উছমান রা.-এর ২৬তম অধঃস্তন বংশধর। তাঁর ১১তম পূর্বপুরুষ শায়েখ আফকাহুদ্দীন ১০৫৭ হিজরীতে বাগদাদ থেকে ভারতে এসে বিহারে বসবাস শুরু করেন। তাঁর প্রপিতামহ সম্রাট আওরঙ্গজেবের প্রিয়পাত্র বিজ্ঞ আলেম ও কৃতী সিপাহসালার ছিলেন। তিনি বিখ্যাত ফতোয়া আলমগীরীর অন্যতম  প্রণেতা ও স্বাক্ষরকারী ছিলেন।

শিক্ষা :  

তিনি মাতৃভূমি ভাগলপুর, কানপুর, হায়দ্রাবাদ দক্ষিণ ও দেওবন্দ দারুল উলূমে লেখাপড়া করেন।

জ্ঞানপিপাসা :   

দীর্ঘ দুই মাস পায়ে হেঁটে মওলানা ইয়াহ্ইয়া সাহ্সারামী প্রমুখ ৫জন সঙ্গীসহ দক্ষিণাত্যে পৌঁছে নিযাম হায়দ্রাবাদের মাদরাসায় গিয়ে ভর্তি হয়ে বিদ্যাভ্যাস করেন।

বিশিষ্ট উস্তাযবর্গ :

মাওলানা ইসহাক বর্ধমানী, মাওলানা মুহাম্মদ ফারূক চিড়িয়াকোটী আজমগড়ী (যাঁর শিষ্যরূপে আল্লামা শিবলী নুমানী গর্ব প্রকাশ করতেন।), মাওলানা আবদুল ওয়াহ্হাব বিহারী, মাওলানা লুতফুল্লাহ আলীগড়ী, শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমূদ হাসান প্রমুখ।

কর্মক্ষেত্র :       

প্রখর মেধা ও যোগ্যতাবলে  ফারিগ হওয়ামাত্র শাহজাহানপুর মাদরাসার সদরুল মুদাররিসীন পদে নিযুক্ত হন। তারপর ভারতবর্ষের শীর্ষস্থানীয় তিনটি ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোলকাতা আলিয়া মাদরাসা, দারুল উলূম দেওবন্দ ও সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসায় এবং মাঝখানে ১৬ বছর পাটনা ইসলামিয়া শামসুল হুদা মাদরাসায় প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেন। দারুল উলূম দেওবন্দে ৮ বছর শিক্ষকতা এবং ৩ বছর মুফতীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৩৫০ হিজরী থেকে ১৩৬২ হিজরী পর্যন্ত ১২ বছর তিনি উক্ত মাদরাসার মজলিসে শূরার সদস্য ছিলেন। ১৯১৩ সালে  হযরত শায়খূল হিন্দ তাঁর হজে¦র সফরে তাঁর যে বিশিষ্ট ও সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য ১০ জন শাগরেদকে সফরসঙ্গীরূপে নির্বাচন করেছিলেন, তিনি ছিলেন তাঁদের শীর্ষস্থানীয়। শায়খুল হিন্দ বন্দী হয়ে মাল্টার নির্বাসনে যাওয়ার প্রাক্কালে যাদেরকে দেওবন্দে ফিরে তাঁর মিশন চালিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব দিয়ে মদীনা থেকে দেওবন্দে ফেরত পাঠিয়েছিলেন, তাঁদেরও অন্যতম তিনি।

তাঁর শিষ্য শাগরেদদের মধ্যে দেওবন্দের শায়খুল আদব ওয়াল ফিক্হ্ মাওলানা এজায আলী ও সিলেটের বাহরুল উলূম মাওলানা মুহাম্মাদ হোসাইন নিজপাটী জয়ন্তিয়াপুরীও রয়েছেন, যিনি কোলকাতা আলিয়া মাদরাসার মুহাদ্দিস ও পরবর্তীতে সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসার প্রিন্সিপালরূপে প্রভূত সম্মান ও  যশখ্যাতির অধিকারী হয়েছিলেন।

তাযকিয়া-তাসাওউফ :

১৩২৩ হিজরীর শাওয়াল মাসে হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গঙ্গুহীর নিকট থেকে খেলাফত লাভ করেন। কিন্তু তিনি নিজে তা গোপন রাখেন। পরবর্তীতে হযরত শায়খুল হিন্দের খলীফারূপে যখন তাঁর নাম প্রকাশিত হয়, তখন জানা যায় যে, ইতিপূর্বেই তিনি গঙ্গুহী রাহ.-এর খিলাফত লাভ করেছিলেন।

খলীফাবৃন্দ :

তাঁর কাছে মুরীদ হওয়ার উদ্দেশ্যে আগতদেরকে তিনি হয় হযরত থানভী রাহ., না হয় মাওলানা মাদানী রাহ.-এর খেদমতে পাঠিয়ে দিতেন। কেবল নাছোড় বান্দাদেরকেই মুরীদ করতেন। তাঁর খলীফা হওয়ার জন্যে আলেম হওয়া জরুরি ছিল। তিনি বলতেন, আমার খলীফাদের সকলেই এলহামী খলীফা। অর্থাৎ আল্লাহর তরফ থেকে কারো ব্যাপারে আধ্যাত্মিকভাবে নির্দেশিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে তিনি খিলাফত দিতেন না। তাই তাঁর খলীফার সংখ্যা খুবই কম।  তাঁদের সংখ্যা মাত্র এগার জন। নিম্নে তাঁদের নামঠিকানা দেয়া হল।

১. মাওলানা হাফিয দিয়ানত আহমদ, মৌজা ডহরপুর, ভাগলপুর

২. মাওলানা কারী মুহাম্মদ ইবরাহীম আহমদাবাদী, জুনাগড়

৩. মাওলানা কারী সায়্যিদ আহমদ মুঙ্গেরী, বিহার

৪. মওলভী সায়্যিদ শাহ নাজমুদ্দীন দরিয়াপুর, বাঁকীপুর, পাটনা

৫. মাওলানা সায়্যিদ শাহ্ জামীলুল হক, সৈয়দপুর, জগন্নাথপুর, সিলেট

৬. মাওলানা সায়্যিদ কারী আবদুর রঊফ, সৈয়দপুর, জগন্নাথপুর, সিলেট

৭. মাওলানা সায়্যিদ আহমদ, জগন্নাথপুর, সিলেট 

৮. মাওলানা কারী সায়্যিদ হাবীবুর রহমান, জগন্নাথপুর, সিলেট

৯. মাওলানা আবদুল ওয়াহ্হাব সাহেব, জগন্নাথপুর, সিলেট

১০. মাওলানা আবদুল হাসিব, পঞ্চগ্রাম, সদরপুর, কাছাড়, আসাম

১১. মাওলানা সায়্যিদ তাফাজ্জুল হোসাইন, সিলেট সরকারি মাদরাসা

[দ্র. মুফতী সহূল উছমানী লিখিত রূহুত তাসাওউফ’-এর উপসংহাররূপে তাঁরই পুত্র উস্তাযপ্রবর মাওলানা আহমদ উছমানীর হাকীকাতুল উসূল’-এর বরাতে করাচী থেকে সদ্য প্রকাশিত মাহমূদুল-ফাতাওয়া’ (ফাতাওয়া সাহূলিয়্যা), পৃ. ৭১] হ

 

 

advertisement