চলে গেলেন বর্ষীয়ান আলেমেদ্বীন
মাওলানা মুমিনুল্লাহ রাহ.
বাংলাদেশে যে কয়জন প্রথিতযশা বুযুর্গ মানুষের আত্মার সংশোধন ও আধ্যাত্মিক সাধনার কাজে নীরবে-নিভৃতে নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন- মাওলানা মুমিনুল্লাহ হুজুর ছিলেন তাঁদের অন্যতম।
মাওলানা মোহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর অন্যতম প্রধান খলীফা এই মহান বুযুর্গ বিগত ৮ই মার্চ ২০২১ নোয়াখালী সোনাইমুড়িতে মেয়ের বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ১০০ বছর। তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে, তিন মেয়ে, নাতি-নাতনী এবং অসংখ্য অনুসারী, ছাত্র ও ভক্ত-মুরিদ রেখে গেছেন।
পরদিন বেলা ২টায় তাঁর নামাযে জানাযায় বিপুলসংখ্যক আলেম, মাদরাসা ছাত্র ও সাধারণ মুসল্লি অংশগ্রহণ করেন। নামায শেষে বিকাল ৪টায় নিজ নিবাস মান্দারীতে পারিবারিক কবরস্থানে মায়ের কবরের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। তাঁর ইন্তেকালের সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর বাংলাদেশের উলামা মহল ও কওমী মাদরাসাসমূহে গভীর শোকের ছায়া নেমে আসে। মাওলানা মুমিনুল্লাহ হুজুর ১৯২১ সালের জানুয়ারি মাসে নোয়াখালী জেলার মান্দারীতে মোহাম্মাদুল্লাহ পাটোয়ারী বাড়িতে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা হাজ্বী আব্দুল মজিদ ছিলেন এলাকার সর্বজন শ্রদ্ধেয় বুযুর্গ ব্যক্তিত্ব। হাজ্বী আব্দুল মজিদ সাহেব হজ্বের সফরে সৌদি আরবে ইন্তেকাল করেন এবং তাকে জেদ্দায় দাফন করা হয়।
মাওলানা মুমিনুল্লাহ হুজুর প্রাইমারি ও মক্তবের শিক্ষা নিজ এলাকাতেই সম্পন্ন করেন। পরে নোয়াখালী টুমচর সরকারি মাদরাসা হতে দাখিল পাশ করার পর নোয়াখালী ইসলামিয়া আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন এবং সেখানে জামাতে উলা সম্পন্ন করার পর ২২ বছর বয়সে উচ্চতর শিক্ষার উদ্দেশ্যে ভারতের দেওবন্দ মাদরাসায় গমন করেন। তিনি সেখানে ধর্মীয় শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদীস অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে সম্পন্ন করেন। তিনি বিশ্ববরেণ্য আলেম মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী রাহ.-এর শাগরিদ ছিলেন। ১৯৪৭ সালে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি বর্তমান চাঁদপুর জেলার অন্তর্গত ওয়ারুক সরকারি মাদরাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। এখানে ১ বছর শিক্ষকতা করার পর তিনি বাংলাদেশের প্রখ্যাত দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উজানী মাদরাসায় সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। পরে তিনি উজানীর পীর মাওলানা মোবারক করীম সাহেবের বোনের সঙ্গে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন। এর কিছুদিন পরই তিনি মাওলানা মোহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুরের খেলাফত লাভ করেন। হাফেজ্জী হুজুরের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী রায়পুরের লুধুয়া গ্রামে প্রতিষ্ঠিত এশাআতুল উলুম মাদরাসায় তিনি সুদীর্ঘকাল প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেছেন। হাফেজ্জী হুজুরের ইন্তেকাল অবধি তিনি হুজুরের অন্যতম সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন।
নোয়াখালী লুধুয়া মাদরাসার দায়িত্ব হতে অবসর গ্রহণের পর তিনি স্বাধীনভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে মাদরাসা-মক্তব ও মসজিদ স্থাপনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। সেমতে ঢাকার মীরের বাগ, কাপাসিয়া, নোয়াখালীর লক্ষ্মীপুর, চৌমুহনী, কুমিল্লা, সিলেট, বোয়ালমারী ও লালমনিরহাটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তিনি বেশ কয়েকটি কওমী মাদরাসা স্থাপন করেন। এছাড়াও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তিনি সত্তরটিরও অধিক নূরানী মক্তব ও কয়েকটি মসজিদ স্থাপন করেন। জীবনে তিনি বহুবার হজ্ব-ওমরা আদায় করেছেন।
বাংলার আধ্যাত্মিক জগতের নিভৃতচারী এই মহান বুযুর্গ সকলের নিকট ‘মুমিনুল্লাহ হুজুর’ নামেই খ্যাত ছিলেন। সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী তাঁর কোনো খানকাহ ছিল না এবং তিনি নির্দিষ্ট কোনো জায়গায় অবস্থানও করতেন না। নিজ বাড়িতেও তিনি খুব কম সময়ই অবস্থান করতেন। মক্তব-মাদরাসা প্রতিষ্ঠার কাজে সারা বছরই তিনি বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে সফর করতেন। এই কারণে মুরীদগণ নিজেদের ইচ্ছামত তাঁর সাক্ষাৎ পেত না। এ বিষয়ে একবার তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেছিলেন, আপনারা খোঁজ করলে আমাকে পাবেন না। প্রয়োজনের সময় দুআ করলে আল্লাহ পাক নিশ্চয়ই সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেবেন। বাস্তবেও এইরূপই ঘটতে দেখা গিয়েছে।
মুমিনুল্লাহ হুজুর অতি সাধারণ জীবনাচারে অভ্যস্ত ছিলেন। অর্থ-সম্পদের লোভ ও বিলাসিতা কখনো তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। ভক্ত মুরিদদের পক্ষ হতে আগত হাদিয়ার বিপুল অঙ্কের অর্থের প্রায় সবই তিনি বিভিন্ন মাদরাসা-মসজিদে দান করে দিতেন। এই ক্ষেত্রে তার একটি ব্যতিক্রমী স্বভাব ছিল- নিজের মুরিদদেরকে তিনি প্রচুর হাদিয়া দিতেন। তিনি বলতেন, দুনিয়া হল অস্থায়ী নিবাস। সুতরাং এখানে শুধু জরুরত-পরিমাণের উপরই তুষ্ট থাকবে। এই ক্ষেত্রে তাঁর নিজের অবস্থা ছিল- ২ টি লুঙ্গি, ২ টি পাঞ্জাবি এবং একটি গামছা- সর্বসাকুল্যে এই ছিল তার ব্যবহারের সামান। এ সামানেই তিনি আরব-আজম সফর করতেন। শীত-গ্রীষ্ম সকল মৌসুমেই তিনি দুই ফিতার সেন্ডেল ব্যবহার করতেন। তার বসবাসের জন্য ভালো কোনো ঘর ছিল না। তিনি একটি জীর্ণ কুটিরেই সারা জীবন বসবাস করেছেন এবং জীবনের শেষ দিকে সেটিও নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। একবার হুজুরের এক ধনাঢ্য মুরিদ হুযুরের জন্য একটি পাকা ভবন নির্মাণ করে দেয়ার অনুমতি চেয়েছিলেন; কিন্তু অনেক অনুরোধ করেও হুজুরকে সম্মত করানো যায়নি। পরে হুজুর ওই মুরিদকে বললেন, আপনি আমার বাড়ি করে দেওয়ার জন্য যেই অর্থ বরাদ্দ করেছেন, তা লুধুয়া মাদরাসায় দান করে দিন; তাতে আপনি এবং আমি উভয়ে চিরস্থায়ী লাভবান হব। পরে তিনি তাই করেছিলেন। ইন্তেকালের সময় তিনি স্থাবর-অস্থাবর বলতে বিশেষ কোনো সম্পদ রেখে যাননি। তিনি বলতেন, সম্পদ সঞ্চিত থাকলে এর প্রতি তোমার মন লেগে থাকবে এবং দিন দিন তুমি সম্পদের মোহে আক্রান্ত হতে থাকবে। নিজের জরুরত পরিমাণ সামানের জন্য চেষ্টা করতে থাকবে এবং দুআও করবে। একবার তিনি বলেছিলেন, আমার উপর আল্লাহর কত মেহেরবানি যে, আমার কোনো সম্পদ নাই; সুতরাং আমার কোনো হিসাবও নাই। অবশ্য সম্পদ দ্বারা যেইসব ইবাদত সম্পাদিত হয় যেমন হজ্ব-ওমরা ইত্যাদি, এগুলো তো বহুবারই আল্লাহ তাআলা আমার দ্বারা করিয়ে নিচ্ছেন। অর্থাৎ সম্পদ থাকে অন্যের মাথায় এবং হিসাবও তাদের জিম্মায় আর আল্লাহ শুধু সময় মত আমার দ্বারা ইবাদত করিয়ে নিচ্ছেন।
মোটকথা, মুমিনুল্লাহ হুজুর ব্যক্তিগতভাবে বিশেষ কোনো অর্থসম্পদের মালিক ছিলেন না বটে; তবে এর অর্থ এমন নয় যে, তার হাতে কোনো অর্থের সমাগম হত না; বরং মাঝেমাঝে মুরিদানদের পক্ষ হতে তার নিকট বিপুল পরিমাণ অর্থের সমাগম হত এবং এর সবই তিনি দ্বীনী কাজে ব্যয় করে তবে স্বস্তি লাভ করতেন, নিজের জন্য কিছুই রেখে দিতেন না। হুযুর সবসময় বলতেন, নিজের আত্মার সংশোধনের ফিকির করবে। আত্মার সংশোধন নিজে-নিজে করা যায় না; বরং এজন্য আবশ্যক হল কোনো আল্লাহওয়ালার সাহচর্য অবলম্বন। মনে রাখবে, পানির উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া এবং হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো এগুলো কোনো বুযুর্গীর লক্ষণ নয়; বরং যেই ব্যক্তি যত বেশি সুন্নতের উপর আমল করবে, তাকে তত বড় বুযুর্গ মনে করা হবে।
মুমিনুল্লাহ হুজুর সারা জীবন অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে সুন্নতের উপর আমল করেছেন। এমনকি মুস্তাহাব আমলগুলোও তিনি অতীব যত্নের সাথে সম্পাদন করতেন। জীবনের শেষ সময়টি তাঁর মূর্ছা ও চেতনের মাঝে অতিবাহিত হয়। ঠিক শেষ সময়টিতে তিনি চেতনা ফিরে পান এবং জিকির করতে করতে আল্লাহর সান্নিধ্যে গমন করেন। হ