সা ম্প্র দা য়ি ক তা
অন্যায় মদদ
সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি তার দেশ থেকে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বের করে দিবেন। এছাড়া ভারতীয় বিভিন্ন সেনা-প্রতিষ্ঠানে মিয়ানমারের নৌসেনাদের প্রশিক্ষণ এবং মিয়ানমারের কাছে অস্ত্র বিক্রির বিষয়েও আলোচনা চলছে বলে সংবাদমাধ্যমগুলোতে খবর প্রকাশিত হয়েছে। ঘোষণাগুলো এমন এক সময়ে আসছে যখন আরাকানের মুসলমানদের উপর ভয়াবহ জুলুম চালাচ্ছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক বিশ্লেষকগণ এসব বিষয়ের তাৎপর্য সঠিকভাবে বুঝবেন। আমরা এখানে অন্য ধরনের একটি কথা বলতে চাই।
ভারত যখন রোহিঙ্গা মুসলিমদের বহিষ্কারের ঘোষণা দিচ্ছে ঠিক ঐ মুহূর্তে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছেন লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা। দেশের সরকার ও আম মুসলিম জনতা ব্যাপকভাবে এদের সাহায্য-সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছেন। উল্লেখ্য যে, এই লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গার মধ্যে কয়েক হাজার হিন্দুও রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ও মুসলিম জনতা এই বিপদগ্রস্ত মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য করছে না। তারা দুস্থ মুসলমানদের প্রতি যেমন সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তেমনি বিপদগ্রস্ত হিন্দুদের প্রতিও। এর বড় কারণ, ইসলামের মানবিক শিক্ষা। দুস্থ-বিপদগ্রস্তের পাশে দাঁড়ানো ইসলামে অতি বড় সওয়াবের কাজ, এমনকি সে দুস্থ লোকটি অমুসলিম হলেও। নানা ক্ষেত্রে ইসলামী শিক্ষা ও আদর্শ থেকে দূরে সরে যাওয়ার পরও এর গভীর প্রভাব মুসলিমসমাজে রয়েছে।
আজকের ভারত ও মিয়ানমারই নয়, যুগে যুগে বিভিন্ন ভূখণ্ডে এই দ্বিবিধ আচরণ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। মুসলমানদের সাথে অমুসলিম জাতি-গোষ্ঠীর সাম্প্রদায়িক আচরণ আর অমুসলিমদের প্রতি মুসলিম জনতার উদার মানবিক ব্যবহার। এই বাস্তবতা এমনকি মুসলিমসমাজের প্রচার-প্রচারণাতেও অনুপস্থিত। আপন ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং বাস্তবতার সঠিক উপলদ্ধির স্বার্থে এই বিষয়গুলো আলোচনায় আসা উচিত। ন্যায় ও মানবতার বিস্তারেও তা সহায়ক হতে পারে বলে আমরা মনে করি।
ইসলামের একেবারে শুরুতে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ইসলাম গ্রহণকারীদের উপর মক্কার মুশরিকদের সীমাহীন জুলুম-অত্যাচার আর মক্কা বিজয়ের পর এই জালিম জনগোষ্ঠীর প্রতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাধারণ ক্ষমার ইতিহাস তো সর্বজনবিদিত। এছাড়া নানা দুর্যোগে তাদের মানবিক সহায়তা দেয়ার ঘটনাও পবিত্র সীরাতে রয়েছে। ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান রাহ. বর্ণনা করেছেন যে, একবার মক্কার অধিবাসীরা দুর্ভিক্ষপীড়িত হলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের জন্য দ্রব্যসামগ্রী, (বর্তমানের পরিভাষায় ত্রাণ সামগ্রী) পাঠিয়েছেন মক্কার দুস্থ লোকদের মাঝে বিতরণ করার জন্য। -শরহুস সিয়ারিল কাবীর ১/১৪৪
হযরত ওমর রা.-এর শাহাদতের ঘটনা কারো অজানা নয়। এক অমুসলিম যিম্মী আবু লু’লুআ মাজূসী তাঁকে খঞ্জর দ্বারা আক্রমণ করেছিল, যে আক্রমণে মারাত্মক আহত হয়ে তিনি শাহাদত বরণ করেন। কিন্তু এ অবস্থায়ও মৃত্যুশয্যায় অমুসলিম যিম্মিদের ব্যাপারে তাঁর ওসীয়ত ছিল নিম্নরূপ :
أُوصِي الْخَلِيفَةَ مِنْ بَعْدِي بِأَهْلِ الذِّمّةِ خَيْرًا، أَنْ يُوفِيَ لَهُمْ بِعَهْدِهِمْ،وَأَنْ يُقَاتِلَ مِنْ وَرَائِهِمْ، وَأَنْ لَا يُكَلّفُوا فَوْقَ طَاقَتِهِمْ.
আমি আমার পরের খলীফাকে যিম্মী জনগণের বিষয়ে সদাচরণের ওসীয়ত করছি। তাদের সাথে কৃত অঙ্গিকার যেন তিনি পূরণ করেন, তাদেরকে আগ্রাসী শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য লড়াই করেন এবং তাদের উপর তাদের সাধ্যাতীত কিছুর ভার অর্পণ না করেন। -সুনানে কুবরা, বায়হাকী, হাদীস ১৮৭৪১; সহীহ বুখারী, হাদীস ১৩৯২
এটা ন্যায়পরায়ণতারও এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এক যিম্মীর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার কারণে অন্য নিরপরাধ যিম্মীদের উপর না তিনি নিজে প্রতিশোধ নিয়েছেন, না মুসলিম জনগণ; বরং পরবর্তী খলীফাকে যিম্মীদের সাথে সদাচরণের অসীয়ত করে গেছেন।
এটা ঐ ইসলামী শিক্ষারই প্রায়োগিক রূপ, যাতে সর্বাবস্থায় ইনসাফ রক্ষার আদেশ করা হয়েছে-
وَلَا يَجْرِمَنّكُمْ شَنَئَانُ قَوْمٍ عَلَى أَلَّا تَعْدِلُوا اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتّقْوَى.
এই ন্যায়পরায়ণতা ও মানবিকতার অসংখ্য উদাহরণ পেশ করা যায়। এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে এর অবকাশ নেই। এখানে শুধু একজন অমুসলিম লেখকের একটি সাক্ষ্য উদ্ধৃত করছি।
ফরাসী ঐতিহাসিক ও দার্শনিক গুস্তাফ লোবোন মুসলিম বিজেতাগণের উদারতা ও ন্যায়পরায়ণতা বর্ণনা করে লিখেছেন, ‘আরব জাতির প্রথম যুগের বিজয়গুলো তাদের মদমত্ত করতে পারত, তারাও অন্যান্য বিজয়ীর মতো বিজিত মুলুকের অধিবাসীদের উপর নিপীড়ন চালাতে পারত, এমনকি যে ধর্মের বিস্তারে তারা উৎসাহী ছিলেন তা গ্রহণেও বাধ্য করতে পারত... কিন্তু আরবেরা এসব থেকে বিরত থেকেছে। পূর্ববর্তী খলীফাগণ, যারা ছিলেন অনন্যসাধারণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী, যা নতুন ধর্মমতের দায়ীদের মাঝে খুবই দুর্লভ, এই সত্য উপলদ্ধি করেছিলেন যে, ধর্ম ও জীবনব্যবস্থা এমন বস্তু নয়, যা কারো উপর জোর করে চাপানো যায়। এ কারণে যেমনটা আমরা দেখেছি, তারা সিরিয়া, মিসর, স্পেন ও অন্য সকল বিজিত অঞ্চলের অধিবাসীদের সাথে অসাধারণ উদারতা প্রদর্শন করেছেন। তাদের ধর্মবিশ্বাস, আইন-কানুন, ও জীবনব্যবস্থায় কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করেননি এবং অল্প কিছু ‘জিয্য়া’ ছাড়া সাধারণত আর কিছুই আরোপ করেননি, যা এদের ইতিপূর্বেকার প্রদেয় কর ইত্যাদির তুলনায় পরিমাণে ছিল একেবারেই নগণ্য। এটুকুও আরোপ করা হয়েছিল তাদের সুরক্ষার দায়িত্ব গ্রহণের বিপরীতে। তো সত্য কথা হল, আরব জাতির মতো উদার বিজেতা এবং তাদের ধর্মের মতো উদার ধর্ম পৃথিবীর মানবসম্প্রদায় আর দেখেনি।-হাদারাতুল আরব, পৃ. ৬০৫- আলআকাল্লিয়াতুদ দ্বীনীয়্যাহ, ড. ইউসুফ কারযাভী, পৃ. ৫৪
এ তো ছিল অমুসলিমদের সাথে মুসলমানের ব্যবহার, কিন্তু মুসলমানের সাথে যুগে যুগে অমুসলিম ক্ষমতাশালীদের আচরণ কীরূপ ছিল? স্পেন, বাগদাদ, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, ইরাক-আফগানিস্তান আর এখন মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে তা দেখা যাচ্ছে।
তো যুগে যুগে মানবভূখণ্ডগুলোতে এই দুইটি ধারা সর্বদা জারি ছিল। একটি উদারতা ও মানবতার ধারা আরেকটি সংকীর্ণতা ও সাম্প্রদায়িকতার ধারা । মুসলিমদের এই চরম দুর্দিনে অসহনীয় বেদনার মাঝেও এইটুকু সুখ আমাদের রয়েছে যে, আমরা বাংলাদেশী মুসলমানেরাও উদারতা ও মানবতার ধারার সাথেই নিজেদের যুক্ত রাখতে পেরেছি। সকল প্রশংসা আল্লাহ তাআলার। তবে একইসাথে এটাও মনে রাখতে হবে যে, উদারতার অর্থ নির্বুদ্ধিতা নয়। উদারতা ও সতর্কতার মাঝে কোনো সংঘর্ষ নেই। আরাকানের মুসলিমদের এভাবে ব্যাপকভাবে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য করার পিছনে সীমান্তবর্তী আঞ্চলটিতে বৌদ্ধ উগ্রবাদীদের পুর্নবাসন এবং এর দ্বারা সুদূর প্রসারী কোনো সামরিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চিন্তা কার্যকর রয়েছে কি না তা-ও গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার।