বাকশক্তির ব্যবহার : শৈথিল্য ও সীমালংঘন
‘তুমি বড় বেশি কথা বল’, ‘অত কথা বলো না’, ‘অমুকে শুধু বকবক করে’ এবং এ জাতীয় নানা বাক্যের সাথে আমরা পরিচিত। অন্যদের এরকম বাক্য ব্যবহার করতে শুনি, নিজেরাও বলি। তার মানে অতিকথা। অহেতুক কথা বা প্রয়োজনের বেশি কথা আমরা পসন্দ করি না। কেউ পসন্দ করে না। যে ব্যক্তি নিজে বেশি কথা বলে অভ্যস্ত সেও অন্যের মুখে বেশি কথা শুনতে চায় না। সেও অন্য কেউ যখন বেশি কথা বলে অমনি মন্তব্য করে ‘তুমি বড় বেশি কথা বল’।
অর্থাৎ বেশি কথা বলাটা যে ভালো নয়, তা সকলেই জানে ও মানে, কিন্তু অধিকাংশেই নিজের বেলায় তা আমলে নেয় না। অন্যকে বেশি কথা না বলতে উপদেশ দেই, কিন্তু নিজে হামেশাই বলি। নিজে বেশি বলতে পসন্দ করি, বলতে পারাকে কৃতিত্ব মনে করি এবং বেশি বলে আনন্দ বোধ করি। আনন্দ বোধ করি বলে, সময়ের বাছ বিচার করি না, স্থান বিবেচনায় রাখি না এবং পাত্রেরও প্রভেদ লক্ষ রাখি না। অর্থাৎ স্থান-কাল-পাত্র নির্বিচারে আমরা কথা বলতে থাকি। যে স্থানে যে কথা খাটে না, বলা যায় না বা বলা উচিত নয়, সেখানে তা অবলীলায় বলি। যে কথা যে সময়ের নয়, সে কথা ওই অসময়ে ছাড়তে থাকি। যাকে যে কথা বলা যায় না বা বলা উচিত নয় তাকে লক্ষ করে সে কথা বলে ফেলি। ফলে সবটাই হয়ে যায় বেহুদা কথা ও অতিকথা। স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় রেখে যে কথা বলা হয়, তা হয় কাজের কথা আর তা বিবেচনায় না রাখলে দামী কথাও বেহুদা কথা হয়ে যায়। কারণ সে কথায় কেবল সময়ই নষ্ট করা হয়, কারও কিছু উপকার হয় না। সেই উপকারহীন কথা আমরা বলি বা শুনতে পাই যানবাহনে, সভা- সেমিনারে, মিটিংয়ে, এমনকি শ্রেণীকক্ষে।
এই নির্বিচার কথা, যা অনুপকারী কথা বা বেহুদা কথার নামান্তর, কারা বলছে? অজ্ঞ-অশিক্ষিত লোকে? না, বরং শিক্ষিতজন। অশিক্ষিতদের তো সভা-সেমিনারে কথা বলার সুযোগ নেই। বেহুদা কথা তারা বললেও সীমিত গণ্ডিতে বলে। যে-কোনো স্থানে তাদের কথা বলার সুযোগ ও ক্ষমতা নেই। সে সুযোগ ও ক্ষমতা শিক্ষিতদেরই আছে। যত্রতত্র নির্বিচার কথা তারাই বলে। সব কথায় তারা সর্বত্র মুখর।
এর উল্টাটাও আছে। অনেক সময়ই স্থান-কাল-পাত্রের দাবি- কথা বলা। যথোপযুক্ত কথা বলা। যা বলা না হলে ব্যক্তিবিশেষের বা সমষ্টির ক্ষতি হওয়ার আশংকা থাকে। বাস্তবে ক্ষতি হয়েও যায়। কিন্তু অনেকেই তা বলি না। বলার সুযোগ থাকে, ক্ষমতাও থাকে, তাও বলা হয় না। মুখর স্বভাবের লোককেও দেখা যায়, প্রয়োজনের সময় প্রয়োজনীয় কথাটি বলে না। হয়ত প্রতিবেশী ভদ্র লোকটি (?) বউ পেটাচ্ছে। আশপাশের সবাই শুনতে পাচ্ছে তার হিংস্র চিৎকার। শুনছে স্ত্রীর আর্তনাদও। কিন্তু কেউ তাকে বলছে না, ওহে! তুমি এসব কী করছ? শিক্ষিত সামাজিক লোকটি তার গৃহকর্মীকে মারছে। কিন্তু তাকে লক্ষ করে বলা হচ্ছে না ‘ওহে বীর! এর উপর তোমার যত ক্ষমতা, তোমার উপর আল্লাহর ক্ষমতা তারচে’ ঢের বেশি।’ রিক্শাচালকের গালে চড় বসিয়েছে শক্তি মদমত্ত যুবক। তাকে শাসানোর বা বোঝানোর ক্ষমতা যাদের আছে, সবাই নিরব-দর্শক। কেউ বলছে না, তুমি এটা কী করলে! দুই শিশু মারামারি করছে। হম্বি-তম্বিতে অভ্যস্ত গুরুজন তা দেখছে। কিন্তু নিজের কেউ না হওয়ায় যেন তার কোনও দায় নেই। একটি ধমকও সে তাদের উদ্দেশে খরচ করছে না। জালিমের জুলুম চোখে পড়ে ঘরে বাইরে সর্বত্র। অন্যায়-অনুচিত কাজ ঘটতে দেখা যায় অহর্নিশ। প্রকাশ্যে দিবালোকে নানা অনাচার চোখের সামনেই আমরা হতে দেখি। দু’কথা বলার অল্প বিস্তর ক্ষমতাও আছে। সব জায়গায় না থাকলেও অনেক জায়গায়ই সে ক্ষমতা আছে। কিন্তু সর্বত্র আমরা নীরব দর্শক হয়েই থাকছি। এ মহা মৌনতার কি কোনও জবাব আছে?
একদিকে অতিকথা, অন্যদিকে মহামৌনতা। যেখানে দরকার কথা বলার, সেখানে থাকছি নীরব, আর যে স্থানের দাবি নীরবতা, সেখানে বলার অদম্য উৎসাহ। বাকশক্তির ব্যবহারে এই দ্বিবিধ প্রান্তিকতার শিকার অধিকাংশ লোক। হয় অতিকথনের সীমালংঘন, নয়ত অনুচিত মৌনতার শৈথিল্য। উভয়টিই ক্ষতিকর, যেমন ব্যক্তির নিজের পক্ষে, তেমনি সমাজ ও সমষ্টির পক্ষেও।
বাকশক্তি আল্লাহ তাআলার একটি নিআমত ও মহা দান। বহুমুখী প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে তিনি এ নিআমত বান্দাকে দান করেছেন। বান্দার বহুবিধ কল্যাণ এর মধ্যে নিহিত। প্রয়োজনস্থলে এ শক্তির ব্যবহার দ্বারাই সেসব কল্যাণ লাভ হতে পারে। যেখানে প্রয়োজন নেই, সেখানে ব্যবহার দ্বারা শক্তির অপচয় ছাড়া কিছু হয় না। বরং যে কোনও শক্তির অপচয়ই সংশ্লিষ্ট সকলের পক্ষে ক্ষতিকর; তা অর্থশক্তি হোক, পেশিশক্তি হোক বা অন্য কোনও শক্তি। যেমন স্থান-কালের চাহিদা মোতাবেক তার ব্যবহার না করাটাও সমান ক্ষতি বয়ে আনে।
এ উভয়বিধ ক্ষতি থেকে বাঁচা ও এ শক্তির কাক্সিক্ষত সুফল লাভের জন্য দরকার এর ব্যবহারে ভারসাম্যমান হওয়া। অর্থাৎ প্রয়োজনস্থলে প্রয়োজনীয় মাত্রায় বলা এবং অপ্রয়োজনীয় কথা ও অতিকথন থেকে বিরত থাকা।
এর জন্য কুরআন-হাদীসে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। বাকশক্তির নিয়ন্ত্রণ ও তার কল্যাণকর ব্যবহারের জন্য সেসব নির্দেশনা মেনে চলা অবশ্যকর্তব্য।
এক হাদীসে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ.
যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাত দিবসে বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভালো কথা বলে, নয়ত চুপ থাকে -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬০১৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪৭
এ হাদীস জানাচ্ছে, কথা বলা ও না বলা (বা চুপ থাকা) উভয়টিই কাজ। আর দু’টো কাজই নিষ্পন্ন হতে হবে ঈমানের দৃষ্টিকোণ থেকে।
আল্লাহর প্রতি ঈমানের অর্থ আল্লাহ সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞ। তিনি সকলের সব কথা ও কাজ দেখেন ও শোনেন। তিনি কারও কোনও কাজ বৃথা যেতে দেবেন না। ভালোমন্দ কাজ অনুযায়ী অবশ্যই প্রতিফল দেবেন। আর আখিরাতে বিশ্বাসের মানে মৃত্যুর পর এমন এক জগতে আমাদের যেতে হবে, যেখানে ইহজগতে কৃত যাবতীয় কাজের প্রতিদান দেওয়া হবে। কাজ ভালো হলে তার পুরস্কারে জান্নাত লাভ হবে আর মন্দ হলে ভোগ করতে হবে জাহান্নামের শাস্তি।
কথা বলা ও নীরবতা অবলম্বন করা, উভয়টিই যখন কাজ তখন মুমিন ব্যক্তির কর্তব্য এই ঈমানের ভিত্তিতেই উভয়টিই সম্পাদন করা। অর্থাৎ সময়ের দাবি যদি হয় কথা বলা তবে অবশ্যই বলা। আর যদি দাবি হয় না বলা তবে বলা হতে বিরত থাকা।
যদি কথা বলা সময়ের দাবি হয়, আর তা না বলা হয়, তবে কেন বলা হল না, এর জবাব আখিরাতে আল্লাহর দরবারে দিতে হবে। অনুরূপ দাবি যদি হয় না বলার, তা সত্ত্বেও বলা হয়, সেক্ষেত্রেও অহেতুক কেন বলা হল সে জবাবও আল্লাহর আদালতে দিতে হবে।
যেক্ষেত্রে সময়ের দাবি কথা বলা, সেখানে এটাও বিচার্য যে, ওই দাবি পূরণে আমি কতটুকু সক্ষম। সক্ষমতা ছাড়া কথা বলতে গেলে অনেক সময়ই তা উপকারের স্থলে অপকারের কারণ হয়ে থাকে। বিভিন্ন মিটিং ও সভা সেমিনারে লক্ষ করা গেছে, অনুপযুক্ত লোক কথা বলতে গিয়ে সম্পূর্ণ মজলিসটাই মাটি করে ফেলেছে। এমনও দেখা গেছে যে, হকের পক্ষের লোক তার অযোগ্যতার কারণে না হক কথা বলে বাতিলপন্থীদের হাসির খোরাক জুগিয়েছে। এমন তো হামেশাই দেখা যায় যে, অতিউৎসাহীর অদম্য কথার কারণে যোগ্য লোকের কথা বলার সুযোগ হয় না। ফলে সভা-সেমিনার দ্বারা কাক্সিক্ষত সুফল লাভ থেকে মানুষ বঞ্চিত থেকে যায়।
যে মজলিসে কথা বলার যোগ্যতা আমার নেই, সেখানে কথা বলার কোনও অধিকার আমার থাকে কি? এমন লোকের কথা বলা মানেই অনধিকার চর্চা ও অন্যের অধিকার হরণ। সর্বোপরি কথা বলার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নস্যাৎ করা। এহেন কথা বলা কিছুতেই ভালো কথার মধ্যে পড়ে না। ফলে তা বলারও কোনও বৈধতা থাকে না। আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাসীর তা থেকে বিরত থাকাই বাঞ্ছনীয়।
ওই বাঞ্ছনীয় নীরবতা অনেক সময় আমরা অবলম্বন করতে পারি না আবেগের কারণে। হয়ত কথার বিষয়বস্তুটি দ্বীন ও ঈমান সম্পর্কিত। আমার আজন্ম লালিত বিশ্বাসের বিপরীতে কোনও আওয়াজ উঠেছে। তা নিয়ে চারদিকে শোরগোল। বিজ্ঞজনেরা তার উপযুক্ত জবাব দিচ্ছেন কিংবা যুৎসই জবাব তালাশ করছেন। কিন্তু আমার সেই দিকে নজর নেই। আমার আবেগ যারা যখম করেছে, নিজ জ্ঞান প্রজ্ঞার যতই অভাব থাকুক না কেন, তাদের এক হাত না দেখিয়ে ক্ষান্ত হতে আমি রাজি নই। এটা আবেগের তাড়না। এ তাড়নায় মাঠে নেমে পড়াটা হঠকারিতা। আমার যা প্রত্যাশা, তাই যখন আরও যোগ্য-বিজ্ঞ লোকদের দ্বারা সম্পন্ন হতে যাচ্ছে, তখন অযোগ্য হাতে তীর ছুড়ে সুযোগ্যদের ক্ষমতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলছি কেন? এই আবেগতাড়িত উচ্চবাচ্যের পরিণামে হাতের নাগালে এসে যাওয়া বিজয় যদি বেহাত হয়ে যায়, সেজন্য কি আমাকেই দায়ী থাকতে হবে না?
বস্তুত আবেগতাড়িত কথা কখনও সুফলদায়ী হয় না। সে কথা নিজ ঘরে হোক বা বাইরে। আপনজনদের উদ্দেশে হোক বা শত্রুর বিরুদ্ধে।
আবেগ খুবই ভালো জিনিস। কিন্তু তার তাড়নায় তাড়িত হওয়াটা বিপত্তিকর। দরকার বিচার ও বিবেচনাবোধকে কাজে লাগানো এবং জ্ঞান-প্রজ্ঞার পরিচয় দেওয়া। আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে যেমন আবেগ দিয়েছেন, তেমনি কিছু না কিছু বুদ্ধি-বিবেচনাও প্রত্যেককে দান করেছেন। আবেগের প্রকাশে সেই বুদ্ধি-বিবেচনা ব্যবহার করলেই সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত সুফল লাভ হতে পারে। অন্যথায় যা হয় তা কেবলই বাড়াবাড়ি। আর সে বাড়াবাড়ির বিস্তার ঘটতে পারে বহুদূর। সে রকম কিছু ঘটে গেলে তার প্রতিকারের কোনও রাস্তা থাকে না। কেবল আফসোসই করা যেতে পারে। আমরা আবেগের তাড়নাজনিত প্রতিকারহীন বাড়াবাড়ির বিভিন্ন ঘটনা হর-হামেশাই লক্ষ করে থাকি। বিশেষত বাকশক্তি প্রয়োগের বাড়াবাড়ি।
বাকশক্তির ক্ষমতা অমিত। এর কৌশলী ব্যবহার নির্জীব, নিরুদ্যম প্রাণে চেতনার আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারে, একটা ঘুমন্ত জাতিকে নবজাগরণের উদ্দীপনায় উদ্ধাবিত করতে পারে এবং এক পরাধীন জাতিকে স্বাধীনতার্জনের সংগ্রামে উন্মাতাল করে তুলতে পারে।
এহেন শক্তিকে বিচারবোধহীন আবেগের বশে ব্যবহার করা কিছুতেই সমীচীন নয়। তাতে প্রাণ যেতে পারে, ঘর ভাঙতে পারে, দাঙ্গা লেগে যেতে পারে, গৃহযুদ্ধ দেখা দিতে পারে এবং দেশও টুকরো-টুকরো হয়ে যেতে পারে। ব্যক্তির ক্ষমতা ও প্রভাবের বিস্তার অনুপাতে ছোট-বড় নানা অঘটনই এর ফলে ঘটতে পারে। সুতরাং এ শক্তির ব্যবহারে চিন্তা ও বিচক্ষণতা অতীব জরুরি। যাতে ব্যক্ত কথা ভালো কথা রূপে গণ্য হয়।
চিন্তা করলে দেখা যায়, ক্ষেত্রবিশেষে এ শক্তির ব্যবহার অপেক্ষা নীরবতাই বেশি সুফলদায়ী হয়। প্রভাব সৃষ্টিতে কথা বলার যেমন ক্ষমতা, না বলার ক্ষমতা তারচে’ কম নয়। অনেক সময় বেশিও হয়ে থাকে। ফলে মৌনতাবলম্বন দ্বারা এমন এমন কার্য ঘটিয়ে ফেলা যায় বিস্তর বাক্যব্যয়েও যা সম্ভব হয় না। কাজেই মৌনতার মহিমাও উপলব্ধি করা দরকার।
আসলে বিচারবুদ্ধি ব্যবহারের কোনও বিকল্প নেই। যে কোনও পরিস্থিতিতেই যদি চিন্তা করা যায় যে, কথা বলা উচিত হবে, না নীরব থাকা শ্রেয়, তবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাটি নিরূপণ সহজ হয়ে যায়, সে ব্যবস্থাটি মৌনতার হোক বা কথা বলার। চিন্তা করা হয় না বলেই সীমালংঘন বা শৈথিল্য হয়ে যায়।
এমন অনেক পরিস্থিতিই আসে, যার দাবি চুপ থাকা। কিন্তু বিবেচনাবোধকে কাজে না লাগানোর ফলে চুপ না থেকে কথা বলা হয় আর সেই কথাবলাটা অপূরণীয় ক্ষতি বয়ে আনে। এমন এক পরিস্থিতির নিশানদিহী করতে গিয়ে কুরআন মাজীদ বলছে-
وَ اِذَا خَاطَبَهُمُ الْجٰهِلُوْنَ قَالُوْا سَلٰمًا.
দয়াময় আল্লাহর বান্দা সেই সব লোক, যাদের লক্ষ করে অজ্ঞ-অসভ্য লোকেরা কিছু বললে, তারা উত্তরে বলে (ভাই) সালাম (আমি তোমার সাথে বাদানুবাদ করতে চাই না)। -সূরা ফুরকান (২৫) : ৬৩
অর্থাৎ তিরস্কারের জবাবে তিরস্কার করে না, গালির জবাবে গালি দেয় না ও মন্দ কথার জবাবে মন্দ কথা বলে না; বরং ক্ষমাপ্রবণ হয় ও উপেক্ষা করে।
জনৈক বিজ্ঞজনকে কেউ একজন গালমন্দ করে যাচ্ছিল, কিন্তু তিনি কোনও উত্তর করছিলেন না। তার এই উত্তর না করায় লোকটির মনে খুব চাপ বোধ হচ্ছিল এবং সে নিজেকে অপমানিত বোধ করছিল। শেষ পর্যন্ত তার এ উপেক্ষাভাব লক্ষ করে লোকটি বলেই ফেলল, কী, রা করছেন না যে! এসব তো আপনাকেই বলছি! এবার তিনি একটা ছোট্ট উত্তর দিলেন। বললেন, আমিও তো তোমাকেই আগ্রাহ্য করছি।
এ রকম আরও বহু ক্ষেত্র আছে, যেখানে নীরবতাই কাম্য। যেসব ক্ষেত্রে বলতে যাওয়াটা বিপত্তিকর। কখনও ব্যক্তির নিজের পক্ষে, কখনও সমাজ ও রাষ্ট্রের পক্ষে। তাই হাদীস হুকুম দিয়েছে, এরূপ ক্ষেত্রে যেন নীরবতা অবলম্বন করা হয়। নীরবতা অবলম্বন দ্বারাই সে বিপত্তি থেকে মুক্ত থাকা যায়। অন্য এক হাদীসে আছে- مَنْ صَمَتَ نَجَا ‘যে ব্যক্তি চুপ থাকে, সে নাজাত পায়।’
আবার যে স্থানের দাবি কিছু বলা, সেখানে তা না বলা ঈমানের পরিচায়ক নয়। জীবনকে কর্ম ও কীর্তিময় করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় স্থানে কথা বলা অবশ্যকর্তব্য। তা না বললে মানবজীবন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কুরআন মাজীদ ব্যর্থতা থেকে বাঁচার অপরিহার্য শর্ত হিসেবে যেসব গুণের উল্লেখ করেছে তার মধ্যে
‘ন্যায় ও ধৈর্যের উপদেশদান’-ও একটি। ইরশাদ হয়েছে-
وَ تَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَ تَوَاصَوْا بِالصَّبْ۠رِ
এবং একে অন্যকে উপদেশ দেয় ন্যায়ের এবং একে অন্যকে উপদেশ দেয় ধৈর্যের। [সূরা আছ্র (১০৩) : ৩] অর্থাৎ যেখানেই কোনও অন্যায় কাজ হতে দেখবে, সাহসিকতার সাথে প্রতিবাদ করবে এবং সত্য ও ন্যায় অবলম্বনের উপদেশ দেবে। এক হাদীসে জালিম শাসকের সামনে ন্যায় কথা বলাকে শ্রেষ্ঠ জিহাদ বলা হয়েছে। কুরআন-হাদীসে এর সপক্ষে প্রচুর প্রণোদনা বাণী রয়েছে। এমনিভাবে যেখানেই কারও দ্বারা ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে দেখা যাবে, তাকে ধৈর্য অবলম্বনে উৎসাহিত করবে।
কুরআন মাজীদ সৌভাগ্যবান ও সফলদের যেসব গুণের কথা বলেছে ধৈর্যের ও দয়া-মমতার উপদেশদান তার অন্যতম। যদি কাউকে কারও প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করতে দেখা যায়, তা মুসলিম-অমুসলিম, নারী-পুরুষ যার প্রতিই হোক না কেন, এমনকি জীব-জন্তুর প্রতিও যদি হয়, তবে সেই আচরণে বাধা দেওয়া ও সদয় আচরণে উৎসাহ প্রদান করা ঈমানের দাবি। ঈমানের এ দাবি পূরণে আমাদের শৈথিল্যের কি কোনও সীমা আছে? মানুষের প্রতি মানুষের কত নির্দয় আচরণ আমাদের চোখে পড়ে। আমরা তাতে মুখ খুলি ক’জন?
হাদীস বলছে- الدِّينُ النّصِيحَةُ-দ্বীন তো কল্যাণকামিতারই নাম। এ কল্যাণকামিতা ব্যক্তিবিশেষের প্রতি নয়। গোটা সৃষ্টির প্রতি। আমরা কি দ্বীনের এ বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলেছি? না হয় প্রতিনিয়ত হাজারও নিষ্ঠুরতার ঘটনা সামনে ঘটতে দেখেও কেন আমাদের মন কাঁদে না? সেক্ষেত্রে দু’কথা বলার গরজ বোধ করি না?
দিকে দিকে আজ কত বেহুদা শ্লোগান শুনি। নিজেরাও দেই। অথচ তা থেকে দূরে থাকাই বাঞ্ছনীয় ছিল। কত অযাচিত বয়ান-বক্তৃতা শুনি। নিজেরাও তা দিতে উৎসাহ বোধ করি। অথচ তা অনেকটাই এমন, যা না দিলে কারও কোনও ক্ষতি ছিল না। হয়ত বা নীরবতাই শ্রেয় ছিল। অথচ যেখানে দু’কথা বলা ছিল ঈমান ও মানবতার দাবি সেখানে আমরা ভয়ানক রকম মৌন। তবে কি কল্যাণকামী চেতনা আমাদের থেকে উধাও হয়ে গেছে? হয়ত বা এটা ওই অপ্রয়োজনীয় ও সীমাতিরিক্ত বাক-শক্তিক্ষয়েরই কুফল। কথার বাজে খরচার পরিণামে আমরা প্রয়োজনীয় খরচায় উদাসীন হয়ে পড়েছি। আর তারই অশুভ ফল ভোগ করতে হচ্ছে ঘরে-বাইরে সর্বত্র। এ দুর্গতি থেকে বাঁচার একই উপায়। নিজ বাকশক্তির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বাঁচতে হবে কথার সীমালংঘন থেকে এবং পরিহার করতে হবে শৈথিল্য। অর্থাৎ বাকশক্তির ব্যবহারে ই‘তিদাল ও মধ্যপন্থা আকড়ে ধরতে হবে।
মুক্তির উপায় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে তিনটি কাজ করতে হুকুম দিয়েছিলেন, তার সর্বপ্রথম এটিই-
বাকশক্তিকে নিজ নিয়ন্ত্রণে রাখ। অর্থাৎ যেখানে কথা বলা দরকার সেখানে বল, তা প্রয়োজন পরিমাণে বল এবং যেখানে কথা বলার প্রয়োজন নেই, সেখানে মৌনতা অবলম্বনে সক্ষম থাক। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন।