মুহাররম ১৪৩৯   ||   অক্টোবর ২০১৭

আসুন বিগত বর্ষের হিসাব মেলাই

মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আব্দুল্লাহ

চলে গেল ১৪৩৮। হিজরী ক্যালেন্ডারের হিসাবে আরো একটি বছর আমাদের জীবন থেকে গত হল। জীবন থেকে একটি বছরের বিদায় ছোটখাটো ঘটনা নয়। এখন দরকার কিছু হিসাব মেলানো। বিগত সময়ে আমাদের ঈমান-আমলের কতদূর উন্নতি হয়েছে এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে আমরা কতদূর সক্ষম হয়েছি তা ভেবে দেখা দরকার।

আমাদের জীবনে কর্তব্যের পরিধি অনেক বিস্তৃত। ইবাদত-বন্দেগী থেকে শুরু করে মা-বাবার সেবা, পরিবার-পরিজনের ভরণ-পোষণ, কর্মস্থলের দায়-দায়িত্ব, সংশ্লিষ্টদের প্রাপ্য আদায় ইত্যাদি বহুবিধ দায়িত্ব আমাদের রয়েছে। এ কর্তব্যসমূহের আদায়-অনাদায়ের হিসাব-নিকাশ প্রয়োজন।

আমরা একটি একটি বিষয় নিয়ে হিসাব করতে পারি যেমন প্রথমেই ঈমান-আমল। ঈমান সম্পর্কে জানা ও ঈমানী গুণাবলী অর্জন করা, ঈমান পরিপন্থী বিষয়াদি সম্পর্কে সচেতনতা ও সেসব বর্জন করা, ফরয নামায, ফরয রোযা, হজ¦ ও যাকাত আদায় করা, ওয়াজিব ও সুন্নাতে মুয়াক্কাদাসমূহ আদায় করা, কুরআন তিলাওয়াত, দুআ, যিকির, তাসবীহের পাবন্দী ইত্যাদি বিষয়ে নিজের অবস্থা যাচাই করা প্রয়োজন।

একান্ত চিন্তায় সংকোচের কিছু নেই। সাহসিকতার সাথে আপন কর্মের মুখোমুখি হতে পারলে ভবিষ্যতের জন্য কর্মপরিকল্পনা সহজ হবে। দোষ-ত্রুটি যদি হয়ে থাকে, কম  হোক বা বেশি, যতদিন আল্লাহ বাঁচিয়ে রেখেছেন ক্ষতিপূরণের সুযোগ আছে।

এরপর আমাদের কর্তব্যের তালিকায় আছে, মা-বাবার সেবা, স্ত্রী-সন্তানের সাথে সদাচার, পরিবার-পরিজনের দ্বীনী ও দুনিয়াবী হকসমূহ আদায়, তাদের জীবনযাত্রা যথাসাধ্য সহজ ও শান্তিময় করার চেষ্টা এবং তাদের দ্বীনী ও ঈমানী অবস্থার তদারকি। এগুলোও চিন্তা-ভাবনার বিষয়।

কর্মস্থলের দায় দায়িত্ব সম্পর্কেও চিন্তা করা চাই। চাকুরি-বাকুরির ক্ষেত্রে চুক্তিকৃত সময় দেয়া, অর্পিত দায়িত্ব আমানতদারির সাথে পালন করা, ব্যবসা-বাণিজ্যে হালাল উপায় অবলম্বন করা, কেনাকাটায় অপচয় থেকে বেঁচে থাকা এগুলোও হিসাব-নিকাশের বিষয়।

এরপর চারপাশের মুসলিম ও বিশ্ব মুসলিমের প্রতি, বিশেষত মজলুম মানবতা ও মুসলিম ভ্রাতৃত্বের প্রতি আমাদের কী দায়িত্ব- তারও হিসাব মেলানো উচিত।

বলাই বাহুল্য, এই হিসাব-নিকাশ সাধারণত সুখকর হয় না। আর তাই আমরা মুহাসাবা ও আত্মসমালোচনা এড়িয়ে যেতে পছন্দ করি। তবে কথা হচ্ছে, এই এড়িয়ে যাওয়াটা সুখকর হলেও কল্যাণকর নয়। আর মুহাসাবা সুখকর না হলেও কল্যাণকর।

মুহাসাবা সৎসাহসের পরিচায়ক আর উদাসীনতা পরিচায়ক ভীরুতার। যেহেতু ভীরুতা ও পলায়নপরতার দ্বারা সমস্যার সমাধান হয় না তাই সাহসিকতার সাথে মুহাসাবার পথ অবলম্বন করাই শ্রেয়।

মুহাসাবা ছাড়া জীবন উন্নত হয় না, কর্ম ও আচরণ অর্থপূর্ণ হয় না। মুহাসাবা এই বাস্তব-জ্ঞানের ফল যে, কোনো রকম ভালো থাকা ও মানুষের কাছে ভালো থাকাই প্রকৃত ভালো থাকা নয়। এটা তো একপ্রকারের আত্মপ্রবঞ্চনা, বাস্তবে ভালো না হলে একসময় না একসময় তা প্রকাশ হয়েই পড়ে। কখনো প্রকাশিত না হলেও নিজেকে তো আর ফাঁকি দেওয়া যায় না। সর্বোপরি আল্লাহকে ফাঁকি দেওয়া তো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কাজেই বিবেকের দংশন ও আল্লাহর নারাজি থেকে বাঁচতে হলে আমাদের সত্যি সত্যি ভালো হয়ে যেতে হবে।

দায়িত্ব ও কর্তব্য যেমন মুহাসাবার একটি ক্ষেত্র তেমনি নিজের উন্নতি-অগ্রগতিও। মুমিনকে অবশ্যই উত্তরোত্তর উন্নতি করতে হবে। যার গতকাল ও আজ সমান সে তো ক্ষতিগ্রস্ত। কাজেই ঈমান-আমল, ইলম-আখলাক ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদের উন্নতির ধারায় থাকতে হবে।

আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে জ্ঞান, তাঁর সিফাত ও গুণাবলীর পরিচয়, তাঁর প্রতি ভয় ও ভালবাসা, তাঁর হুকুম-আহকামের জ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে ক্রমোন্নতি কাম্য। আল্লাহর বিধি বিধান জানাই যদি না থাকে তাহলে পালন করব কীভাবে?

ইসলামী আদব-আখলাকও শিক্ষা ও চর্চার বিষয়। ইসলামী শিক্ষায় আখলাক যেমন কিছু বাহ্যিক আচরণ-উচ্চারণের পরিশীলনে সীমাবদ্ধ নয়, তেমনি তা ব্যক্তির নিজস্ব রুচি ও চিন্তা দ্বারাই আয়ত্ব করে ফেলার মতো বিষয় নয়। ইসলামে আখলাক একই সাথে আচার-আচরণের পরিশীলনও, স্বভাব-চরিত্রের পরিশুদ্ধিও। আর এ সংক্রান্ত বিস্তৃত ইসলামী শিক্ষা এবং যুগে যুগে উম্মাহর মনীষী ও বিচক্ষণ ব্যক্তিবর্গের বিপুল অভিজ্ঞতার সারনির্যাস শুধু ব্যক্তিগত রুচি ও চিন্তার দ্বারাই অর্জিত হয়ে যাবে এমন চিন্তা বাতুলতা মাত্র। অর্থাৎ বিষয়টি আলাদা শিক্ষা, অনুশীলন ও প্রশিক্ষণের দাবি রাখে। তো এক্ষেত্রে উন্নতি-অগ্রগতি পরিমাপ করাও মুহাসাবার ক্ষেত্র। এককথায় একজন অভিজ্ঞ ব্যবসায়ীর মতো জীবনের কেটে যাওয়া সময় আর নিজের উন্নতি-অগ্রগতির হিসাব আমাদের পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে মিলিয়ে দেখতে হবে।

জীবনের সময়টুকুই মানুষের পুঁজি। এই পুঁজিই আমরা বিনিয়োগ করে চলেছি আমাদের নিত্যদিনের কাজ-কর্মে। তাহলে আমাদের কি হিসাব মেলাতে হবে না যে, আমার কর্মফল কী? পুঁজির পরিণাম কী?

আরো কথা হল জীবন নামক এ পুঁজি তো আমাদের নিজস্ব নয়, এটা বরং ঋণ। জগৎসমূহের স্রষ্টা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রদত্ত ঋণ। এর দায়ে বন্ধক রাখা আছে আমাদের সত্তা। এখন আল্লাহ তাআলার আদেশ পালনই ঐ উপায়, যার দ্বারা আমরা আমাদের বন্দী-সত্তাকে মুক্ত করতে পারি। এক হাদীসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

كُلّ النّاسِ يَغْدُو فَبَايِعٌ نَفْسَهُ فَمُعْتِقُهَا أَوْ مُوبِقُهَا

প্রত্যেকে সকালে উপনীত হয়ে নিজেকে বিক্রয় করে, এরপর তাকে মুক্ত করে অথবা হালাক করে...। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২২৩

তো মানবজীবনের প্রতিটি দিবসই মানুষের জন্য নিয়ে আসে মুক্তি কিংবা ধ্বংসের বার্তা। দিবসের কর্ম তাকে মুক্তির দিকে এগিয়ে নেয় অথবা ধ্বংসের দিকে। প্রতিটি সপ্তাহ, মাস, বছরও দেয় একই বার্তা- মানুষ মুক্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কিংবা ধ্বংসের দিকে।

মাসের শুরুতে চাঁদ দেখে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে দুআ পড়েছেন তা কত চেতনাউদ্দীপক-

اللّهُمّ أَهِلّهُ عَلَيْنَا بِالْأَمْنِ وَالْإِيمَانِ، وَالسّلَامَةِ وَالْإِسْلَامِ، رَبِّي وَرَبّك اللّهُ.

ইয়া আল্লাহ! এই চাঁদকে আমাদের উপর উদিত করুন আমান ও ঈমানের সাথে, সালামত ও ইসলামের সাথে।  (হে চাঁদ) আমার ও তোমার উভয়ের রব আল্লাহ। -মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ৭৭৬৭; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৮৮৮

চাঁদকে আল্লাহ করেছেন সময়-নির্ধারক। মাসের শুরুতে নবচন্দ্রের উদয় মানুষকে দান করে একটি মাসের গমন এবং একটি নতুন মাসের আগমনের বার্তা। আগত মাসটি যেন হয় ঈমান ও ইসলামে সমুজ্জ্বল, মুক্তি ও নিরাপত্তায় ভাস্বর- এটাই তো হবে একজন মুমিনের প্রার্থনা। এই শিক্ষা হাদীসে বর্ণিত ঐ দুআয় রয়েছে।

ঈমান ও ইসলামশব্দ দুটি বিশ্বাস ও কর্মগত সকল শিক্ষাকে ধারণ করে। কাজেই মাসের শুরুতেই মুমিনের ইচ্ছা ও প্রার্থনা, এই গোটা মাস আমার যেন কাটে মুমিন হিসেবে, মুসলিম হিসেবে। বান্দা যখন আল্লাহর হুকুমকে জানার এবং সে অনুযায়ী জীবন পরিচালনার চেষ্টা করবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাকে তাওফীক দান করবেন। তার জীবন হবে ঈমান ও ইসলামের জ্যোতিতে জ্যোতির্ময়। আর যখন সকল মুসলিমের ইচ্ছা ও প্রার্থনা এই হবে এবং তাদের কর্ম তাদের প্রার্থনাকে সত্যায়ন করবে তো সমাজও হয়ে উঠবে ঈমান ও ইসলামের আলোয় সমুজ্জ্বল। বলাই বাহুল্য, এই সমাজ মুক্ত ও পবিত্র থাকবে মিথ্যা ও জুলুম থেকে, দুর্নীতি ও সন্ত্রাস থেকে, মজুদদারি ও আড়ৎদারি থেকে, পণ্যে ভেজাল মেশানো ও মাপে কম দেওয়া থেকে। এই সমাজ নিরাপদ থাকবে হত্যা-রক্তপাত, লুণ্ঠন ও হানাহানি থেকে। আল্লাহর হুকুমের ফরমাবরদারির বদৌলতে এই সমাজে বিরাজ করবে জান মাল ইজ্জত আব্রুর নিরাপত্তা, বিরাজ করবে শান্তি ও প্রশান্তি।

আমাদের ব্যক্তিজীবনের অতৃপ্তি ও অশান্তি, সমাজজীবনের অন্যায়-অবিচার এর সবই আমাদেরই কৃতকর্ম। মানুষ তার স্বভাব ও কর্মের দ্বারা নিজের ও অন্যের শান্তি হরণকারী। লোভ ও হিংসার আগুনে সে নিজেও দগ্ধ হয়, অন্যকেও দগ্ধ করে। অপরের হক লুণ্ঠন, ক্ষমতার অপব্যবহার, দায়িত্বে অবহেলা এবং অন্যায়-অবিচার দ্বারা নষ্ট হয় সমাজের ভারসাম্য, বিদুরিত হয় শান্তি ও স্বস্তি। এককথায় ব্যক্তি ও সমাজের শান্তি-অশান্তি নির্ণিত হয় মানবেরই নিজের বিশ্বাস ও কর্মের দ্বারা । আর একারণেই স্বভাব ও কর্মের শুদ্ধিই হচ্ছে শান্তি ও কল্যাণের প্রধান শর্ত। এরপর এই কর্ম ও স্বভাবের উপরই নির্ভর করছে চিরস্থায়ী জীবনের মুক্তি ও সফলতা। কাজেই এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন কর্ম ও চরিত্রগঠন। প্রয়োজন নিজের দিকে চোখ ফেরানো। নিজ স্বভাব ও কর্মের পর্যালোচনা। দিন-রাতের গমনাগমন এবং মাস-বছরের আবর্তন আমাদের দিচ্ছে এই হিসাব-নিকাশের বার্তা।

১৪৩৯ হিজরীর শুরুতে আসুন আমরা একটু নিজের দিকে তাকাই। নিজের স্বভাব ও কর্মের হিসাব নেই এবং জীবনের বাকি সময়টুকুকে পিছনের ক্ষতি পূরণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার উপায় হিসেবে গ্রহণ করি। হিজরী নতুন বছরটি আমাদের জীবনে নিয়ে আসুক এক ইতিবাচক পরিবর্তন। ঈমান ও ইসলাম এবং শান্তি ও নিরাপত্তায় উদ্ভাসিত হোক আমাদের সবার জীবন- আমীন।

 

 

advertisement