শাবান-রমযান ১৪৪২   ||   মার্চ-এপ্রিল ২০২১

উৎসবের নামে ...
একটি বিদেশি পত্রিকার দৃষ্টিতে ঢাকার পয়লা বৈশাখ
‘ঢাকার পয়লা যেন অষ্টমীর একডালিয়া’
—আনন্দবাজার পত্রিকা

মুহাম্মাদ ফজলুল বারী

গত ১৪২৫-এর বৈশাখে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে এ শিরোনামে-ঢাকার পয়লা যেন অষ্টমীর একডালিয়া। অর্থাৎ রমনা বটমূলের বৃন্দগান আর পেঁচা-ময়ূর, সিংহ-হাতি, সূর্য দেবতা১  ইত্যাদি নানা মূর্তি-ভাস্কর্য-প্রতিকৃতিবাহী মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে ঢাকার পয়লা বৈশাখ উদযাপন যেন অষ্টমীতে কলকাতা একডালিয়ার পূজা মণ্ডপের উৎসব-উদযাপনের মতই! তাদের ভাষায়-পুজো, বসন্ত উৎসবের মিলমিশে একাকার ঢাকার নববর্ষের সকাল।এটি হল, আমাদের দেশের পয়লা বৈশাখ উদযাপনের ব্যাপারে তাদের মূল্যায়ন।

এদেশের সচেতন দ্বীনদার শ্রেণি ও আলেম-উলামা এ উদযাপন সম্বন্ধে এতদিন যে বিষয়ে সতর্ক করতেন বা এ উদযাপনের গতি-প্রকৃতি ও উদযাপন-উপাদান দেখে যে আশঙ্কা ব্যক্ত করতেন তা একজন হিন্দু লেখকের মন্তব্যে!

যাইহোক, ঐ প্রতিবেদনের শুরুঅংশ দিয়েই শুরু করা যাক-

(দেবদূত ঘোষঠাকুর লিখেছেন-) “কার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে! কখনও মনে হচ্ছিল কলকাতার কলেজ স্কোয়ার বা একডালিয়ার পুজো মণ্ডপ। কখনও বা শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসবের চেহারা। তা সে রমনার বটমূলের বৃন্দগানই হোক কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাজপথে মঙ্গল শোভাযাত্রা। পুজো, বসন্ত উৎসবের মিলমিশে একাকার ঢাকার নববর্ষের সকাল।” [আনন্দবাজার পত্রিকা (অনলাইন সংস্করণ) ১৫ এপ্রিল ২০১৮, লিংক :

https://www.anandabazar.com/bangladesh-news/poila-baisakh-in-dhaka-celebrated-almost-like-durga-puja-in-kolkata-1.787102 (লিংকে দেওয়া ইংরেজিও লক্ষ করুন)

প্রতিবেদনটির লেখকের নাম দেখেই বুঝা যাচ্ছে- তিনি কোন্ ধর্মের লোক। তারই মূল্যায়ন এটা!

এখন আমরা ভেবে দেখি, কোথায় নিয়ে পৌঁছানো হয়েছে বাঙালির হালখাতার পয়লা বৈশাখকে! বা বলি, কোনো এক গোষ্ঠী কোথায় পৌঁছাবার মানসে কাজ করে যাচ্ছে এবং কতদূর এগিয়ে গেছে যে, একটি বিদেশি পত্রিকায় একজন লেখক অষ্টমীর একডালিয়া পূজা মণ্ডপের উদযাপনের সাথে এ উদযাপনের মিল দেখছেন বা এ উদযাপন ঐ উদযাপনের মতই বলে স্বীকৃতি দিচ্ছেন!

বাংলাদেশের তথাকথিত অসাম্প্রদায়িক’, ‘ধর্মনিরপেক্ষসর্বজনীনবর্ষবরণ উৎসব বা বাঙালীর হাজার বছরের সংস্কৃতি-ঐতিহ্যকে একজন হিন্দু প্রতিবেদক নিজ সম্প্রদায়ের ধর্মের প্রধান অনুষঙ্গ পূজার সাথে মিল দেখছেন। বাংলাদেশের একটি দৈনিকেও এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে-

বাংলাদেশের ইসলামী দলগুলো দীর্ঘদিন ধরেই পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ভিনদেশী হিন্দুত্ববাদি সংস্কৃতি হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং এটি দেশের ৯০ ভাগ মুসলমানের বিশ্বাস বা ঈমানবিরোধী বলে এর প্রতিবাদ করে আসছে। অবশেষে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকাও মঙ্গল শোভাযাত্রাকে হিন্দুত্ববাদি সংস্কৃতি হিসেবেই উপস্থাপন করলো। এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় রীতিমতো ঝড় বইছে।

ভারতীয় মিডিয়া আনন্দবাজারের প্রতিবেদনটির শিরোনাম-ঢাকার পয়লা যেন অষ্টমীর একডালিয়া। একডালিয়া হলো কলকাতার একটি স্থান বা বসতি। যেখানে একডালিয়া এভারগ্রীন ক্লাব নামে কলকাতার সবচেয়ে বড় ও জাঁকজমকপূর্ণ পূজা মণ্ডপ রয়েছে। অষ্টমী হচ্ছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শারদীয় দুর্গাপূজার সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং জাঁকজমকপূর্ণ দিন। দেবীর সন্ধ্যাপূজা আর কুমারী পূজার মধ্য দিয়ে দিনটি পালন করে তারা। বাংলাদেশের পহেলা বৈশাখ উদযাপনকে কলকাতার হিন্দুদের সেই একডালিয়ার পুজো মণ্ডপের অষ্টমী উদযাপনের সাথেই তুলনা করেছে আনন্দবাজার (পত্রিকা)।

মঙ্গল শোভাযাত্রায় বাঘ-ভাল্লুক, সাপ, বিচ্ছু, কুমির ও বিভিন্ন দেব-দেবীর বড় বড় মূর্তি, ছবি ও মুখোশ নিয়ে র‌্যালি বের করা হয়। বলা হয়, এর মাধ্যমে মঙ্গল কামনা করা হয়। ঠিক যেভাবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা পুজোর মত তাদের ধর্মীয় উৎসবগুলোতে বিভিন্ন মূর্তি তৈরি করে তাদের কাছে মঙ্গল কামনা করে। আনন্দবাজার এজন্যই বাংলাদেশের মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ পহেলা বৈশাখের অন্যান্য কার্যকলাপকে পূজা মণ্ডপের উৎসবের সাথে তুলনা করেছে।” [দৈনিক ইনকিলাব (অনলাইন সংস্করণ) ২১ এপ্রিল ২০১৯]

দেবদূত ঘোষঠাকুর ঢাকার পয়লা বৈশাখের সাথে আরো মিল দেখছেন, বসন্ত উৎসবের। সেটিও হিন্দুদের একটি ধর্মীয় উৎসব এবং ইদানীং এ উৎসবকেও বাঙালীর সর্বজনীন উৎসবের রূপ দেওয়া হয়েছে। দৈনিক যুগান্তরে (৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮) ফাল্গুনে এবার রাঙাবো মনশিরোনামে মেহেদী হাসান রোমান লিখেছেন-

প্রাচীন আমল থেকেই বাংলার এই অঞ্চলে বসন্ত উৎসব পালিত হচ্ছে। এই বিষয়ে ইতিহাসবিদ [ইতিহাসবিৎ] ও গবেষকগণের মতামত এই যে- ভারতবর্ষে বসন্ত উৎসবের ইতিহাস বেশ পুরনো। হিন্দুদের পৌরাণিক উপাখ্যান ও লোককথাগুলোতেও এই উৎসবের উল্লেখ পাওয়া যায়। হিন্দু বৈষ্ণবরা এ উৎসব বেশ আয়োজন করে পালন করে থাকেন। আর এই উৎসব বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন- দোল, দোলপূর্ণিমা, হোলি। বৈষ্ণব বিশ্বাস অনুযায়ী, ফাল্গুনি পূর্ণিমা বা দোলপূর্ণিমার দিন বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ আবির ও গুলাল নিয়ে রাধিকা ও অন্যান্য গোপীদের সঙ্গে রং খেলায় মেতেছিলেন। সেই ঘটনা থেকেই দোল খেলার উৎপত্তি হয়। অবশ্য শান্তি নিকেতনে বিশেষ নৃত্যগীতের মাধ্যমে বসন্ত উৎসব পালনের রীতি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়কাল থেকেই চলে আসছে।

এ উৎসবের আরেক নাম দোলযাত্রা, যেমনটি উপরের উদ্ধৃতিতে আলোচিত হয়েছে। বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে-

দোলযাত্রা হিন্দুদের একটি ধর্মীয় উৎসব। এটি শুধু দোলনামেও পরিচিত। উত্তর ভারতে এর নাম হোলি, কোথাও কোথাও একে হোরি-ও বলা হয়। ফাল্গুন মাসের শুক্লা চতুর্দশীতে বুড়ির ঘরবা মেড়া পুড়িয়ে পরের দিন রাধাকৃষ্ণকে পূজা করা হয় এবং তাঁদের মূর্তি দোলায় রেখে আবির কুসুমে রাঙানো হয়। পরে পরস্পরকে রং বা আবির মাখিয়ে সকলে আনন্দ করে। পশ্চিমবঙ্গের অঞ্চল বিশেষে এর পরের দিন রং খেলা হয়। ...

বাংলাদেশে ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে এ উৎসব পালিত হয়। নিকট অতীতে সাড়ম্বরে দোলযাত্রা উদযাপিত হতো। এদিন তরুণরা দল বেঁধে বাড়ি বাড়ি গিয়ে রং খেলতো। বয়ঃকনিষ্ঠরা শ্রদ্ধার সঙ্গে বয়স্কদের রং দিত এবং তাঁরা ছোটদের আশীর্বাদ করতেন।” (বাংলাপিডিয়া, ‘দোলযাত্রাশিরোনামে)

এ উৎসব কোন্ জাতীগোষ্ঠী পালন করে সে ব্যাপারে উইকিপিডিয়ায় বলা হয়েছে-

পালনকারী :       ভারতীয় (হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ ও জৈন) নেপালি (প্রধানত হিন্দু এবং বহুসংখ্যক বৌদ্ধ) এবং বাংলাদেশ (প্রধানত হিন্দু এবং বহুসংখ্যক বৌদ্ধ)” [উইকিপিডিয়া, ‘দোলযাত্রাশিরোনামে]

হাঁ, এখানের বর্ষবরণেও রং-আবির আছে এবং আছে রাধিকা-গোপী। আর নৃত্য-গীত এর প্রধান উপাদান। তবে উপরের তথ্য অনুযায়ী বসন্ত-উৎসব পালন করে- হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন আর আমাদের দেশের পয়লা বৈশাখ উদ্যাপনের আধুনিক সংস্করণে যুক্ত হয়েছে প্রগতিবাদী মুসলিমএই যা!

সুতরাং এগুলো মুসলিমদের জন্য চিন্তারই বিষয়। ঠিক কী কারণে, কী উদ্দেশ্যে একটি ধর্মের (হিন্দু ধর্মের) ধর্মীয় বিষয়গুলোকে বাঙালী সংস্কৃতি, সর্বজনীন উৎসব ইত্যাদি শিরোনামে মুসলিমদের মাঝে প্রচার-প্রসার ঘটানো হচ্ছে? এমনকি শাসকগোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায় তা পালন করা হচ্ছে?

পয়লা বৈশাখ ও বর্ষবরণের সাথে পৌত্তলিক জাতি-গোষ্ঠী ও তাদের পূজা-পার্বণের সম্পর্ক

যাইহোক, এবার ফিরে আসি পূর্বের কথায়- পয়লা বৈশাখের উদযাপনকে দেবদূত ঘোষঠাকুর কেন পুজোর সাথে তুলনা করলেন। আসলে বর্ষবরণের বহু অনুষঙ্গ পুজোর সাথে মেলে বলেই তিনি এ তুলনা করেছেন।

মূলত বর্ষবরণ ধারণাটা এসেছেই বিভিন্ন পৌত্তলিক জাতি-গোষ্ঠী থেকে এবং এর যে চেতনা-পুরনো বছরের কালিমা আর জীর্ণতাকে ধুয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়া- এটাও পৌত্তলিক বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর বর্ষবরণের চেতনাজাত। নতুন পোশাক, ফুল দিয়ে নিজেকে ও ঘরদোর সাজানো, পুষ্পপূজা, বিভিন্ন ধরনের পূজা ইত্যাদির মাধ্যমে তারা বর্ষবরণ উদযাপন করে।

১লা বৈশাখে হিন্দুদের অনেক পূজা রয়েছে।  আনন্দবাজার পত্রিকা ১লা বৈশাখে হিন্দুদের যেসব পূজা-পার্বণ অনুষ্ঠিত হয় পূজা ও বিশেষ দিনক্ষণশিরোনামে তার একটা তালিকা প্রকাশ করেছে-১ বৈশাখ ১৪২৬, সোমবার, ১৫/০৪/২০১৯, বাংলা নববর্ষ ১৪২৬ বঙ্গাব্দ আরম্ভ। পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ উৎসব। নববর্ষারম্ভে হালখাতা মহরতাদি ও ধ্বজারোপণম্। শ্রীশ্রী গণেশ পূজা। পূর্বাহ্নে দক্ষিণবঙ্গে প্রচলিত শ্রীশ্রীভগবতী পূজা। মাসব্যাপী শ্রীকেশব ব্রতারম্ভ। সকাল ঘ ৭/৮ মিনিট মধ্যে কিন্তু বারবেলানুরোধে ৬/৫৬ মিনিট মধ্যে শ্রীশ্রীবাসন্তী দুর্গাদেবীর দশমী বিহিত পূজা সামপন ও বিসর্জন প্রশস্ত। (শ্রীশ্রীদেবীর গজে গমন। ফলম- গজে চ জলদা দেবী শস্যপূর্ণ্যা বসুন্ধরা।) দিবা ঘ ৭/৮ মিনিট মধ্যে শ্রীশ্রীরামনবমী ব্রতের পারণ(https://www. anandabazar.com/ auspicious -days/all-puja-dates)

যাইহোক এবার আদিবাসীদের বর্ষবরণ-বৈসাবিউৎসব লক্ষ করুন-

বৈসাবি : বৈসাবি  বাংলাদেশে তিন আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব। বৈসু, সাংগ্রাই, বিজু এই তিন নামের আদ্যাক্ষর নিয়ে বৈসাবি নামের উৎপত্তি। তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পালন করে বাংলা নববর্ষ। পুরনো বছরের কালিমা আর জীর্ণতাকে ধুয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নেয় তারা। আদিবাসীরা বর্ষবরণ উৎসব পালন করে বিভিন্ন নামে। কেউ বৈসু, কেউ সাংগ্রাই আবার কেউ বিজু। বর্ষবরণ উৎসবকে ত্রিপুরারা বৈসু, মারমারা সাংগ্রাই ও চাকমারা বিজু বলে অভিহিত করে এবং এগুলি বৈসাবি নামে পরিচিত। সাধারণত বছরের শেষ দুই দিন এবং নতুন বছরের প্রথম দিন বর্ষবরণ উৎসব বৈসাবি পালিত হয় বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায়।

চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাদের (বর্ষবরণ) বৈসাবি উৎসব : ত্রিপুরাদের বর্ষবরণ উৎসবের নাম বৈসু। বৈসু উৎসব এদের জীবনের সবচেয়ে বড় উৎসব। বৈসু উৎসব একটানা তিন দিন পালন করা হয়। এই তিন দিনের অনুষ্ঠানগুলির নাম হলো হারি বৈসু, বিসুমা বৈসু ও বিসিকাতাল বা আতাদাং বৈসু। ...তরুণ-তরুণীরা প্রিয়জনকে ফুল উপহার দেয়। দেবতার নামে নদীতে বা ঝর্ণায় ফুল ছিটিয়ে খুমকামীং পূজা দেওয়া হয়। কেউ কেউ পুষ্পপূজা করে। ...হারি বৈসু উৎসবের দিন থেকে এরা গরয়া নৃত্য পরিবেশন শুরু করে। নাচ শেষে গরয়া পূজার ব্যবস্থা করা হয়।

উৎসবের দ্বিতীয় দিন বিসুমাতে ত্রিপুরারা নববর্ষকে স্বাগত জানায়, ধূপ, চন্দন ও প্রদীপ জ্বেলে পূজা দেয় ও উপাসনা করে। ...এদিনও ফুল দেওয়া হয় ও উপাসনা করা হয়। তারা বয়োজ্যেষ্ঠদের গোসল করিয়ে পায়ের কাছে পূজার নৈবেদ্য হিসেবে ফুল রাখে এবং প্রণাম করে। ...

মারমারা পুরাতন বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে বরণ করার উৎসবকে সাংগ্রাই উৎসব বলে। তারা বৈশাখের প্রথম দিনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে পালন করে বাংলা নববর্ষ। ...সববয়সের নারীপুরুষ সম্মিলিতভাবে নাচ আর গানে মেতে উঠে। মারমা বৃদ্ধরা অষ্টশীল পালনের জন্য মন্দিরে যায়। এদিন বুদ্ধ মূর্তিকে চন্দন জলে স্নান করানোর পর বৃদ্ধবৃদ্ধারাও স্নান করে এবং নতুন পোশাক পরিধান করে। বয়স্করা মন্দিরে ধর্ম অনুশীলনে রত হয়। ...

চাকমাদের বর্ষবরণ উৎসব হলো বিজু। এরা তিন ভাগে ভাগ করে বিজু উৎসব পালন করে। চৈত্র মাসের ২৯ তারিখে ফুল বিজু, ৩০ তারিখে মূল বিজু এবং বৈশাখের প্রথম দিনে গজ্যাপজ্যা বিজু নামে অনুষ্ঠান পালন করে।...এই দিনে চাকমারা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করে র‌্যালিতে যোগ দেয়, অবালবৃদ্ধবনিতা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায় এবং শিশুকিশোর তরুণতরুণীরা খেলাধুলায় মেতে উঠে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িঘর, উঠান ও গোশালায় প্রদীপ জ্বালিয়ে সবার মঙ্গল কামনা করা হয়। মন্দিরে গিয়ে মোম জ্বালিয়ে ফুল দিয়ে বুদ্ধের পূজা করা হয়। [এ.এস.এম এনায়েত করিম]” (বাংলাপিডিয়া, ‘বৈসাবিশিরোনাম দ্রষ্টব্য)

এ বৈসাবি আসলে পূজা-পার্বণের মাধ্যমে পুরনো বছরকে বিদায় জানানো এবং নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর উপজাতি-উৎসব ও পূজা। তেমনি চৈত্র সংক্রান্তি ও পয়লা বৈশাখ উদযাপন হল হিন্দুদের উৎসব ও পূজা।

পৌত্তলিকদের চৈত্র সংক্রান্তিএবং এর সাথে পয়লা বৈশাখ উদযাপনের সম্পর্ক

চৈত্র হল বাংলা সনের শেষ মাস। সে হিসেবে চৈত্র মাসের শেষ দিন হল, বাংলা সনের শেষ দিন। বছরের শেষ দিনকে সংক্রান্তি বলে; ফলে চৈত্র মাসের শেষ দিনকে চৈত্র সংক্রান্তিবলে। চৈত্র সংক্রান্তি উদযাপনের সাথে পয়লা বৈশাখ উদযাপনের সম্পর্ক রয়েছে; যেমনটি সামনের উদ্ধৃতিতে রয়েছে-কথিত আছে, চৈত্র সংক্রান্তিকে অনুসরণ করেই পহেলা বৈশাখ উদযাপনের এত আয়োজন। তাই চৈত্র সংক্রান্তি হচ্ছে বাঙালির আরেক বড় উৎসব।” 

আসলে চৈত্র সংক্রান্তি হল, সূর্য দেবতাকে খুশি রাখার জন্য বছরের শেষ সূর্যকে বিদায় জানানো আর বর্ষবরণ করা হয় বছরের প্রথম সূর্যকে স্বাগত জানানোর জন্য। এদিক দিয়েই চৈত্র সংক্রান্তির সাথে বর্ষবরণের সম্পর্ক।

একেও বাঙালীর উৎসব’, ‘বাংলার চিরায়ত উৎসব’, ‘অসাম্প্রদায়িক বাঙালি লোক উৎসববলে মুসলিমকে যুক্ত করা হয়েছে এ উৎসবে এবং এখন এটিও হয়েছে, ‘বাঙালীর সর্বজনীন উৎসবঅর্থাৎ পৌত্তলিকদের সাথেসাথে মুসলিমদেরও!

আনন্দবাজার পত্রিকা ৩০ চৈত্র হিন্দুদের যেসব পূজা-পার্বণ অনুষ্ঠিত হয় পূজা ও বিশেষ দিনক্ষণশিরোনামে ২০১৯-এ তার একটা তালিকা প্রকাশ করেছেÑ৩০ চৈত্র ১৪২৫, রবিবার, ১৪ এপ্রিল ২০১৯, শ্রীশ্রী রামনবমী, শ্রীশ্রী রামজন্মজয়ন্তী, শ্রীশ্রী তারকেশ্বর ধামে গাজনমেলা সমাপন, শ্রীশ্রী চড়ক পূজা, মহাবিষ্ণুব সংক্রান্তি, চৈত্র সংক্রান্তি।(https:// www.anandabazar.com/ auspicious-days/all-puja-dates)

আমরা দেখতে পাচ্ছি, চৈত্র সংক্রান্তি পৌত্তলিকদের একটি উৎসব। বাংলাপিডিয়ায় (চৈত্র সংক্রান্তি মেলাশিরোনামে) লেখা হয়েছে-চৈত্রসংক্রান্তি মেলা লোকউৎসব বিশেষ। প্রধানত হিন্দু স¤প্রদায়ের উৎসব এটি। বাংলা সনের শেষ দিনটিকে বলা হয় সংক্রান্তি। শাস্ত্র ও লোকাচার অনুসারে এই দিনে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস প্রভৃতি ক্রিয়াকর্মকে পুণ্যজনক বলে মনে করা হয়।

এবার দেখা যাক, পৌত্তলিকদের এ উৎসবকে কীভাবে বাঙালীর উৎসব’-এ রূপ দেওয়া হয়েছে। দৈনিক ইত্তেফাকে (১২ এপ্রিল ২০২০) বাংলার চিরায়ত উৎসব চৈত্র সংক্রান্তি সোমবারশিরোনামে লেখা হয়েছে-বাংলার চিরায়ত উৎসব চৈত্র সংক্রান্তি সোমবার। চৈত্র মাসের শেষ দিন চৈত্র সংক্রান্তি। আবার এদিন বাংলা বর্ষেরও শেষ দিন।

পরের দিন মঙ্গলবার পয়লা বৈশাখ-নতুন বাংলা বর্ষ ১৪২৭। জীর্ণ পুরাতন সবকিছু ভেসে যাক, ‘মুছে যাক গ্লানিএভাবে বিদায়ী সূর্যের কাছে এই আহ্বান জানাবে বাঙালি।

আবহমান বাংলার চিরায়ত নানা ঐতিহ্যকে ধারণ করে আসছে এই চৈত্র সংক্রান্তি। বছরের শেষ দিন হিসেবে পুরাতনকে বিদায় ও নতুন বর্ষকে বরণ করার জন্য প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তিকে ঘিরে থাকে নানা অনুষ্ঠান-উৎসবের আয়োজন।

কথিত আছে চৈত্র সংক্রান্তিকে অনুসরণ করেই পহেলা বৈশাখ উদযাপনের এত আয়োজন। তাই চৈত্র সংক্রান্তি হচ্ছে বাঙালির আরেক বড় উৎসব।

বড়ই আশ্চর্যের বিষয়- পৌত্তলিকদের একটি ধর্মীয় উৎসব কীভাবে হয়ে গেল, ‘বাঙালির আরেক বড় উৎসব। এবং প্রকৃতিপূজার অনুষঙ্গসহ। দেখুন-

দৈনিক ইত্তেফাকেই (১৬ এপ্রিল ২০১৪) চৈত্র সংক্রান্তি উৎসবশিরোনামে লিপটন কুমার দেবদাস লিখেছেন- “ ‘নব আনন্দ বাজুক প্রাণে- এ মঙ্গল কামনায় বিগত বছরের গ্লানি মুছে, নতুন বছরের আগমনী বার্তা নিয়ে বাঙালি মেতে ওঠে চৈত্র সংক্রান্তির উৎসবে। চৈত্রের শেষদিনকেই বলা হয় চৈত্র সংক্রান্তি। বসন্তকে বরণ করতে যেমন বসন্ত উৎসব, তেমনি চৈত্র সংক্রান্তি হল বসন্তকে বিদায় জানানোর উৎসব, পুরাতন বছরকে বিদায় জানানোর উৎসব।

চৈত্র সংক্রান্তি উৎসব বাংলাদেশের মানুষের নিজস্ব ধর্মীয় ও সমাজবদ্ধ আচার-অনুষ্ঠান। এদেশের বাঙালি জনগোষ্ঠী চৈত্রের শেষ দিনটিতে বেশকিছু লোকাচারমূলক অনুষ্ঠান পালন করে। যেমন গাজন, নীল পূজা বা চড়ক পূজা, চৈত্র সংক্রান্তির মেলা। প্রায় একই ধরনের আচার পালন করতে দেখা যায় আমাদের আদিবাসী স¤প্রদায়ের মধ্যেও। তারা এই সময়ে পালন করে বর্ষবিদায়-বর্ষবরণ অনুষ্ঠান বৈসাবি।

...মঙ্গল প্রত্যাশা আর পুরাতনকে পেছনে ফেলে নতুন উদ্যমে, নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে বিগত বছরকে বিদায় জানানো হয় চৈত্র সংক্রান্তিতে। চৈত্র সংক্রান্তি প্রধানত হিন্দু স¤প্রদায়ের উৎসব হলেও অসাম্প্রদায়িক বাঙালির কাছে এক বৃহত্তর লোক উৎসবে পরিণত হয়েছে। ফলে এখন আর চৈত্র সংক্রান্তি কোনো একক স¤প্রদায়ের অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। চৈত্র সংক্রান্তি হয়ে উঠেছে অসা¤প্রদায়িক বাঙালি লোকউৎসব।

হাঁ, দেবদাসের মত আমরাও বলছি, নির্দিষ্ট একটি বাঙালি সম্প্রদায়ের পূজা-পার্বণের উৎসবকে বাস্তবেই বাঙালি অসাম্প্রদায়িকাতার নামে প্রকৃতিপূজা ও অন্যান্য অনুষঙ্গসহ অসা¤প্রদায়িক বাঙালি লোকউৎসববানিয়ে দেওয়া হয়েছে! এবং তথাকথিত (নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ভিত্তিক) অসাম্প্রদায়িক চেতনার নামে অনেক বাঙালি মুসলিম তা গলাধঃকরণও করেছে!

পয়লা বৈশাখ উদযাপন : কখন থেকে শুরু? কী থেকে কী?

বাংলাপিডিয়ায় পহেলা বৈশাখশিরোনামে লেখা হয়েছে-পহেলা বৈশাখ : বাংলা সনের প্রথম দিন। এ দিনটি বাংলাদেশে নববর্ষ হিসেবে পালিত হয়। এটি বাঙালির একটি সর্বজনীন  লোকউৎসব। এদিন আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে। কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক হল নববর্ষ। অতীতের ভুলত্রæটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদযাপিত হয় নববর্ষ। এদিন সরকারি বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে।

একসময় নববর্ষ পালিত হতো আর্তব উৎসব বা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে। তখন এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল কৃষির, কারণ কৃষিকাজ ছিল ঋতুনির্ভর। এই কৃষিকাজের সুবিধার্থেই মুগল সম্রাট  আকবর ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০/১১ মার্চ বাংলা সন প্রবর্তন করেন এবং তা কার্যকর হয় তাঁর সিংহাসন-আরোহণের সময় থেকে (৫ নভেম্বর ১৫৫৬)। হিজরি চান্দ্রসন ও বাংলা সৌরসনকে ভিত্তি করে বাংলা সন প্রবর্তিত হয়। নতুন সনটি প্রথমে ফসলি সননামে পরিচিত ছিল, পরে তা  বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত হয়।

বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনা হয় মূলত আকবরের সময় থেকেই। সে সময় বাংলার কৃষকরা চৈত্রমাসের শেষদিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার এবং অন্যান্য ভূ-স্বামীর খাজনা পরিশোধ করত। পরদিন নববর্ষে ভূস্বামীরা তাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। এ উপলক্ষে তখন মেলা এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। ক্রমান্বয়ে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে পহেলা বৈশাখ আনন্দময় ও উৎসবমুখী হয়ে ওঠে এবং বাংলা নববর্ষ শুভদিন হিসেবে পালিত হতে থাকে।

পয়লা বৈশাখের বর্তমান রূপ...

আর হালখাতার পয়লা বৈশাখ কীভাবে পৌত্তলিক উৎসবে পরিণত হল, সে বিষয়ে বাংলাপিডিয়ায় লেখা হয়েছে-

অতীতে বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিল  হালখাতা। এটি পুরোপুরিই একটি অর্থনৈতিক ব্যাপার। গ্রামে-গঞ্জে-নগরে ব্যবসায়ীরা নববর্ষের প্রারম্ভে তাঁদের পুরানো হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন করে হিসাবের নতুন খাতা খুলতেন। এ উপলক্ষে তাঁরা নতুন-পুরাতন খদ্দেরদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি বিতরণ করতেন এবং নতুনভাবে তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগসূত্র স্থাপন করতেন। চিরাচরিত এ অনুষ্ঠানটি আজও পালিত হয়।

নববর্ষের উৎসব বাংলার গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, ফলে গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সাধারণত নববর্ষে তারা বাড়িঘর পরিষ্কার রাখে, ব্যবহার্য সামগ্রী ধোয়ামোছা করে এবং সকালে স্নানাদি সেরে পূত-পবিত্র হয়। এ দিনটিতে ভালো খাওয়া, ভালো থাকা এবং ভালো পরতে পারাকে তারা ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলজনক বলে মনে করে।

...কালের বিবর্তনে নববর্ষের সঙ্গে সম্পর্কিত অনেক পুরানো উৎসবের বিলুপ্তি ঘটেছে, আবার সংযোগ ঘটেছে অনেক নতুন উৎসবের। ...

বর্তমানে নগরজীবনে নগর-সংস্কৃতির আদলে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে নববর্ষ উদযাপিত হয়। পহেলা বৈশাখের প্রভাতে উদীয়মান সূর্যকে স্বাগত জানানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় নববর্ষের উৎসব। এ সময় নতুন সূর্যকে প্রত্যক্ষ করতে উদ্যানের কোনো বৃহৎ বৃক্ষমূলে বা লেকের ধারে অতি প্রত্যুষে নগরবাসীরা সমবেত হয়। নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে শিল্পীরা  সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এদিন সাধারণত সব শ্রেণীর এবং সব বয়সের মানুষ ঐতিহ্যবাহী বাঙালি পোশাক পরিধান করে। নববর্ষকে স্বাগত জানাতে তরুণীরা লালপেড়ে সাদা শাড়ি, হাতে চুড়ি, খোপায় ফুল, গলায় ফুলের মালা এবং কপালে টিপ পরে; আর ছেলেরা পরে পাজামা ও পাঞ্জাবি। কেউ কেউ ধুতি-পাঞ্জাবিও পরে।২ এদিন সকালবেলা পানতা ভাত খাওয়া একটি ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। সঙ্গে থাকে ইলিশ মাছ ভাজা। এভাবে লোকজ বর্ষবরণ প্রথাগুলির কোনো কোনোটির অনুসরণের মাধ্যমে গ্রামীণ ঐতিহ্য অনেকটা সংরক্ষিত হচ্ছে।

বর্ষবরণের চমকপ্রদ ও জমজমাট আয়োজন ঘটে রাজধানী ঢাকায়। এখানে বৈশাখী উৎসবের অনুষ্ঠানমালা এক মিলন মেলার সৃষ্টি করে। নববর্ষের প্রথম প্রভাতে রমনা উদ্যান ও এর চারপাশের এলাকায় উচ্ছল জনস্রোতের সৃষ্টি হয় জাতীয় বন্ধন। ছায়ানটের উদ্যোগে জনাকীর্ণ রমনার বটমূলে রবীন্দ্রনাথের আগমনী গান এসো হে বৈশাখ এসো এসো’-এর মাধ্যমে নতুন বর্ষকে বরণ করা হয়। ১৩৭২ বঙ্গাব্দে (১৯৬৫)  ছায়ানট প্রথম এ উৎসব শুরু করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের বকুলতলার প্রভাতী অনুষ্ঠানেও নববর্ষকে সম্ভাষণ জানানো হয়। এখানকার চারুশিল্পীদের বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা নববর্ষের আহ্বানকে করে তোলে নয়নমনোহর এবং গভীর আবেদনময়। এ শোভাযাত্রা উপভোগ করে সব শ্রেণীর আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। এদিন  শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ, টি.এস.সি এবং চারুকলাসহ সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পরিণত হয় এক বিশাল জনসমুদ্রে।” (বাংলাপিডিয়ায় পহেলা বৈশাখশিরোনাম দ্রষ্টব্য)

বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রাকীভাবে মঙ্গল শোভাযাত্রায় রূপান্তরিত হল?

প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়। এটা অনেকটা ঐতিহ্য হয়ে গেছে। ঢাক-ঢোলসহ নানা বাদ্যযন্ত্র ও বিচিত্র চারুকর্মে সুসজ্জিত এই শোভাযাত্রার ইতিহাস খুব একটা পুরনো নয়। ১৯৮৬ সালে যশোরে চারুপীঠ নামের একটি সংগঠন প্রথমবারের মতো বর্ষবরণ করতে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করে। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার উদ্যোগে ১৯৮৯ সালে প্রথম আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। ১৯৯৫ সালের পর থেকে এই আনন্দ শোভাযাত্রাই মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে পরিচিতি পায়।” (দৈনিক ইত্তেফাক, ১৪ এপ্রিল ২০১৪, অনলাইন সংস্করণ)

রফিকুন নবী বৈশাখী শোভাযাত্রাশিরোনামে (দৈনিক প্রথম আলোর বিশেষ সংখ্যায়, অনলাইন সংস্করণ, ১৪ এপ্রিল ২০২০) লেখেন-মঙ্গল শোভাযাত্রা ঢাকার আগেই শুরু হয়েছিল যশোরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে পাস করে যশোর ফিরে গিয়ে মাহবুব জামাল শামীম, হিরণ্ময় চন্দ শুরু করেছিলেন চারুপীঠ নামের আর্টের স্কুল। যশোরের মতো রাজধানী শহরেও এমন একটা আয়োজন হওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করি আমরা। ১৯৮৯ সালে চারুশিল্পী সংসদে বসে ঢাকায় পয়লা বৈশাখে বর্ষবরণের শোভাযাত্রা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আমি তখন চারুশিল্পী সংসদের সভাপতি। চারুকলা থেকে পাস করা শিল্পীরা চারুশিল্পী সংসদের সদস্য ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে তৎকালীন ছাত্ররাও যুক্ত হন এই আয়োজনে। আমাদের সঙ্গে যুক্ত করলাম সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি ফয়েজ আহমদকে। ফয়েজ আহমদের সঙ্গে অনেক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগ ছিল। তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে কিছু অর্থ জোগাড় করে দিলেন। 

এই আয়োজনের পুরো পরিকল্পনা ছিল শিল্পী ইমদাদ হোসেনের। প্রথমে কিন্তু এর নামকরণের কথা ছিল বৈশাখী শোভাযাত্রা। আলাপ-আলোচনার পর আমরা যশোরের মঙ্গল শোভাযাত্রা নামটিই ঠিক রাখলাম।

যশোরের শোভাযাত্রার নাম কিন্তু মঙ্গল শোভাযাত্রা ছিল না। ঠিক কী কারণে, কোন্ উদ্দেশ্যে আনন্দ শোভাযাত্রানাম পরিবর্তন করে মঙ্গল প্রদীপ ও মঙ্গল দেবতার সাথে মিল রেখে নাম দেয়া হল-মঙ্গল শোভাযাত্রাআমাদের জন্য তা অজানা রহস্য। যদিও তা ঘটেছে পরিকল্পিতভাবেই এবং প্রতি বছর শোভাযাত্রায় এক একটি দেব-দেবীর বাহনকে প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়টিও পরিকল্পিত বলেই অনুমিত হয়।

পয়লা বৈশাখ উদযাপনের উপাদানগুলো কী কী?

যে কোনো বস্তু তার উপাদান দিয়ে বিবেচিত হয়। নাম বা দাবির দ্বারা নয়।

এক গ্লাসস পানীয়সম্বন্ধে বলা হল, এটি শরবত; কিন্তু এর উপাদান বিবেচনা করে দেখা গেল এটি শরবতনয় শরাব। নাম দেয়া হল, ‘দ্বীনে ইলাহী’; উপাদান বিবেচনা করে দেখা গেল তা দ্বীন নয়, বরং একটি কুফরি মতবাদ। ঠিক তেমনিভাবে বর্ষবরণের উপাদানগুলো দিয়ে বিবেচনা করা হবে- এটি সর্বজনীনকি না? এটি মুসলিম-অমুসলিম সকল বাঙালীর জন্য সর্বজনীন, নাকি কেবল সকল অমুসলিমদের জন্য সর্বজনীন! কারণ আমরা দেখছি, সর্বজনীন উৎসবের উপকরণগুলো কেবলই একটি ধর্ম-গোষ্ঠীর সাথে মেলে!

শিরকের বিভিন্ন উপাদানসর্বস্ব হওয়ার পরও যদি সর্বজনীন থাকে, তাহলে মুসলিমদের তাওহীদের বিভিন্ন উপাদান য্ক্তু হলে কি তা সর্বজনীন থাকবে? বা সকলে একে সর্বজনীনহিসেবে গ্রহণ করবে? আর বাস্তবে কি শিরক ও তাওহীদের সংমিশ্রণে কোনো বিষয়কে সর্বজনীন করা সম্ভব?!

যাইহোক, আমরা এবার দেখতে চেষ্টা করব, কী কী উপাদানের কারণে তা সর্বজনীনহতে পারে না। বা বলি, এই সর্বজনীনতার মধ্যে মুসলিম নিজেকে গণ্য করতে পারে না।

ঢাকার পয়লা বৈশাখ উদ্যাপন-বর্ষবরণের শুরু হয় সূর্যোদয়ের সাথে সাথে রমনা বটমূলে একজন হিন্দু ঠাকুরের লেখা বৃন্দগানের মাধ্যমে। যে গানে বলা হয়-অগ্নিস্নানে সূচি হোক ধরা। তেমনি পৌত্তলিকতার আরো বহু অনুষঙ্গের আধার ঢাকার পয়লা বৈশাখ উদযাপন। যেকারণে দেবদূত ঘোষ ঠাকুর বলেছেন-পুজো, বসন্ত উৎসবের মিলমিশে একাকার ঢাকার নববর্ষের সকাল।

এখন আমরা এ উদযাপনের উপাদানগুলো একটু দেখে নিই :

১. সূর্যকে স্বাগত জানানো। ২. সূর্যোদয়ের সাথে সাথে শুরু করা। ৩. একজন ঠাকুর কর্তৃক রচিত বৃন্দগান। ৪. বৃন্দগানের ভাষা। ৫. হিন্দু ঠাকুর রবিন্দ্রনাথ যেভাবে শান্তিনিকেতনে হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব দোলযাত্রা বা বসন্ত-উৎসব পালন করতেন সেভাবে পয়লা বৈশাখ উদযাপন করা। ৬. মঙ্গল শোভাযাত্রা। ৭. মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে মঙ্গল কামনা। ৮. মঙ্গল শোভাযাত্রায় বহনকৃত সূর্য দেবতার প্রতিকৃতিসহ অন্যান্য দেবতার বাহন বহন। ৯. মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে শোভাযাত্রা উদ্বোধন করা। ১০. বিশেষ আলপনা দেওয়া। ১১. এসো হে বৈশাখ এসো এসো!বলে প্রকৃতিকে আহ্বান করা (প্রকৃতিপূজা) ইত্যাদি। এ বিষয়গুলো নিয়ে মুসলিমদের ভাবতে হবে এবং উপলব্ধি করতে হবে এর পেছনের উদ্দেশ্য-রহস্য।

এক. মঙ্গল শোভাযাত্রায় বহনকৃত সূর্য দেবতা এবং অন্যান্য দেবতার বাহন

এপর্যায়ে আমরা মঙ্গল শোভাযাত্রায় বহনকৃত সূর্য দেবতা ও অন্যান্য দেবতার বাহন নিয়ে আলোচনা করব।

শোভাযাত্রায় কী কী প্রতীক/প্রতিকৃতি বহন করা হয়- প্রথম আলোর (১৪ এপ্রিল ২০১৭ অনলাইন, ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকেমঙ্গল শোভাযাত্রা শিরোনামে) রিপোর্ট-প্রতিবারের মতো এবারও মঙ্গল শোভাযাত্রায় হরেক রঙের মুখোশ, হাতি, বাঘ, ফুল, পাখির প্রতিকৃতি ছিল। সমৃদ্ধির প্রতীক কালো হাতি সবার সামনে।৩  এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রায় রাখা হয় সূর্য। সেটি পেছনে ঘোরালে দেখা যায়- একটি কালো মুখ।

চারুপীঠ যশোরের সাধারণ সম্পাদক মামুনুর রশিদ বলেন, শোভাযাত্রাকে বর্ণিল ও আকর্ষণীয় করতে আমরা করেছি বিশাল আকৃতির ময়ূর, পুতুল, লোকজ নৌকা, হাতি, ঘোড়া, কচ্ছপ, ফড়িং, ইঁদুর।” (সূত্র : বাংলাট্রিবিউন, লিংক : https://www.banglatribune.com/196729)

২০১৪ সালের শোভাযাত্রায় ব্যবহৃত নানা প্রতীক ও প্রতিকৃতির বিষয়ে ইত্তেফাকের এক রিপোর্টে বলা হয়, “আয়োজনের সঙ্গে থাকা চারুকলার ছাত্র ওবায়দুল ইসলাম মিঠু জানান, এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রায় হাঁসকে প্রাধান্য দেয়া হলেও বরাবরের মতো বাংলা সংস্কৃতির সবকিছুই থাকবে। অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে থাকছে সরাচিত্র, খেলনা, মা ও শিশু, মাছের ঝাঁক, লক্ষ্মী পেঁচাসহ আরও নানান শিল্পকর্ম।” (দৈনিক ইত্তেফাক ১৪ এপ্রিল ২০১৪, অনলাইন সংস্করণ)

সার্বিকভাবে যে কয়টি প্রাণী বা বস্তুর প্রতিকৃতি বানানো হয় তার মধ্যে নিচেরগুলো উল্লেখযোগ্য-

লক্ষ্মী পেঁচা, ময়ূর, হাঁস, সিংহ, বাঘ, হাতি, ইঁদুর, ষাঁড়, প্রজাপতি, ঘোড়া, কচ্ছপ, ফড়িং, ঈগল, পুতুল, সূর্যদেবতা, লোকজ নৌকা, কোলা ইত্যাদি।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, একেক বছর একেক ধরনের প্রতিকৃতির প্রাধান্য থাকে। উপরের রিপোর্টগুলো থেকেও আমরা জানতে পারছিÑ কোনো বছর প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, সূর্য দেবতাকে, কোনো বছর ময়ূরকে, কোনো বছর হাঁস, কোনো বছর হাতি ইত্যাদি। এমনিতেই কি মানুষ কোনো কিছুকে প্রাধান্য দেয়? না, এগুলোকে প্রাধান্য দেওয়ার অর্থ আছে! এসবকে প্রাধান্য দেওয়ার পেছনে কাজ করছে কোনো গোষ্ঠী আর আমরা মুসলিমরা ছুটছি তার পিছে; না জেনে, না বুঝে!

কোনো কোনো শোভাযাত্রায় এমন বস্তুর ছবিও দেখা গেছে, যার নাম বের করাই মুশকিল। তা যে কী- আল্লাহই ভালো জানেন। রথের মত চার কোণা একটি বস্তু, তার উপর একটি গোল পিলার। তার গায়ে আবার পানটিক্কার মত চিহ্ন। পিলারে দুই পাশে তিনটা করে লাঠির মত; ঠিক হিন্দুদের অনেক হাতবিশিষ্ট দেবতা যেমন দেখা যায়। তার কোনো কোনোটার আগায় আবার পানটিক্কার মত।  https://www.jamuna.tv/news/77435 অথবা  https:// m.dailyinqilab.com/article/199924 লিখে গুগুল ইমেজে সার্চ দিলে চিত্রটি আসে। এসব ছাড়াও কিম্ভূতকিমাকার কিছু মুখাবয়বের প্রতিকৃতি বহন করা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রায়- এগুলোরই বা কী অর্থ? বাঙালী সংস্কৃতির সাথেই বা এর কী সম্পর্ক আর মঙ্গল কামনার সাথেই বা কী সম্পর্ক?

এগুলো বলার দ্বারা আমি আসলে ঐসকল মুসলিমের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, যারা শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করে উদ্দেশ্যহীনভাবে এগুলোর পিছে পিছে ছুটছেন! তাদের মনে কি প্রশ্ন আসে না- কীসের পিছে ছুটছি, কী উদ্দেশ্যে ছুটছি? কেনই বা আমাদের এ অর্থহীন বিষয়ের পেছনে ছোটানো হচ্ছে?

সাথে সাথে ঐসকল মুসলিমেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, যারা এসকল বিষয় দেখা বা বোঝার পরও মঙ্গল শোভাযাত্রার সমর্থন করছেন!

যাই হোক, এবার আমরা দেখতে চেষ্টা করি, মঙ্গল শোভাযাত্রায় বহনকৃত এসব প্রতিকৃতি কী? কীসের সাথে সম্পর্ক এর? কয়েকটি তুলে ধরা হল:

সূর্য  দেবতা

সূর্য (সংস্কৃত: lw;Z  Sūryaসর্বোচ্চ আলোক’) হিন্দুধর্মের প্রধান সৌর দেবতা। তিনি আদিত্যগণের অন্যতম এবং কশ্যপ ও তাঁর অন্যতমা পত্নী অদিতির পুত্র। কোনো কোনো মতে তিনি ইন্দ্রের পুত্র। সূর্যের কেশ ও বাহু সোনার। তিনি সপ্তাশ্ববাহিত রথে আকাশপথে পরিভ্রমণ করেন। তাঁর রথের ঘোড়াগুলি সাতটি পৃথক পৃথক রঙের, যা রঙধনুর সাত রঙের প্রতীক। তিনি রবিবারের অধিপতি।

হিন্দু ধর্মীয় সাহিত্যে সূর্যকে যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। কারণ তিনিই একমাত্র দেবতা, যাঁকে মানুষ প্রত্যহ প্রত্যক্ষ করতে পারেন। এছাড়াও, শৈব ও বৈষ্ণবেরা সূর্যকে যথাক্রমে শিব ও বিষ্ণুর রূপভেদ মনে করেন। উদাহরণস্বরূপ, বৈষ্ণবেরা সূর্যকে সূর্যনারায়ণ বলে থাকেন। শৈব ধর্মতত্তে¡, শিবের অষ্টমূর্তি রূপের অন্যতম হলেন সূর্য। [https://bn.wikipedia.org/wiki সূর্য (দেবতা)শিরোনামে]

গুগল ইমেজে গিয়ে সার্চ দিন- সূর্য দেবতা, surya devta, surya lord, surya dev, sun lord, sun god (এগুলো লিখে সার্চ দিন) দেখবেন, পয়লা বৈশাখে বহনকৃত সেই সূর্য দেবতার প্রতিকৃতির প্রায় হুবহু প্রতিকৃতির ছবি পেয়ে যাবেন।

আর সূর্য ওঠার সাথে সাথে যে সূর্যকে স্বাগত জানিয়ে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান শুরু হয়- এরও রহস্য রয়েছে। হিন্দুরা সুখ-সমৃদ্ধির জন্য সূর্যের পূজা করে সূর্যকে খুশি করে। এজন্যই বোধহয় মঙ্গল কামনার মঙ্গল শোভাযাত্রায় সূর্য দেবতাকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে রাখা হয়; কখনো সবার সামনে রাখা হয়। যাতে সুখ-সমৃদ্ধি কামনা যথাযথ হয়। হিন্দুস্তান টাইমস (বাংলা)-এ একটি প্রতিবেদন দেখুন-সূর্যের উপাসনা সরকারি চাকরি পেতে সহায়ক, বলছেন জ্যোতিষীরা : ধন, বৈভব, যশের কামনা করে থাকলে রবিবারের দিন প্রত্যক্ষ দেবতা সূর্যের সাধনা করতে ভুলবেন না। ধর্মীয় শাস্ত্র অনুযায়ী সূর্যদেবের পুজো করলে অক্ষয় ফল পাওয়া যায়। এর ফলে সুখ-সমৃদ্ধি, মান-সম্মান, পদ-প্রতিষ্ঠা, সরকারি চাকরি এবং উন্নত স্বাস্থ্যের অধিকারী হন উপাসক। যাঁরা সরকারি চাকরি পেতে চান, তাঁদের অবশ্যই সূর্যের উপাসনা করা উচিত।” [হিন্দুস্তান টাইমস (বাংলা), ২৮ জুন ২০২০]

এছাড়াও উক্ত মঙ্গল শোভাযাত্রায় সাড়ম্বরে বিভিন্ন দেব-দেবীর বাহন বহন করা হয়। সামনে তার কয়েকটি তুলে ধরা হল।

মঙ্গল শোভাযাত্রায় বহনকৃত বিভিন্ন দেব-দেবীর বাহন

১. পেঁচা : লক্ষ্মী দেবীর বাহন

লক্ষ্মী ধন ও ঐশ্বর্যের দেবী। তাঁর গায়ের বর্ণ গৌরবর্ণ। বাহন পেঁচা। তাঁর এক হাতে থাকে ধনভাণ্ডার, অন্য হাতে থাকে বরাভয়। (একারণেই হয়ত পেঁচাকে লক্ষ্মী পেঁচা বলা হয়।)

২. ময়ূর : কার্ত্তিক দেবীর বাহন

কার্ত্তিক দেবতাদের সেনাপতি। তাঁর গায়ের বর্ণ স্বর্ণের ন্যায় উজ্জ্বল। তাঁর বাম হাতে থাকে ধনুক। ডান হাতে তীর। তাঁর বাহন ময়ূর।

৩. হাঁস : সরস্বতী দেবীর বাহন

সরস্বতী জ্ঞান ও বিদ্যার দেবী। তাঁর গায়ের বর্ণ শুভ্র। শ্বেত হংস তাঁর বাহন। তাঁর এক হাতে থাকে বীণা। অন্য হাতে থাকে পুস্তক। তিনি জ্ঞান ও বিদ্যা দান করেন।

৪. ইঁদুর : গণেশ দেবতার বাহন

গণেশ সিদ্ধিদাতা। গণেশের চারটি হাত। গায়ের রং রক্তবর্ণ। তাঁর বাহন ইঁদুর।

৫. সিংহ : দেবী দুর্গার বাহন

দেবী দুর্গা দুর্গতিনাশিনী। তাঁর গায়ের রং স্বর্ণ বর্ণ। দশ হাত। দশ হাতে দশটি অস্ত্র ধারণ করেন। তাঁর বাহন সিংহ। (দ্র. দেব-দেবীর বাহন সংক্রান্ত আলোচনা নেওয়া হয়েছে, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত শিক্ষক সংস্করণ-হিন্দুধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’, প্রথম শ্রেণি, লেখক ও সম্পাদক : ড. নারায়ণচন্দ্র বিশ্বাস, ড. ধীরেন্দ্রনাথ তরফদার, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ৬৯-৭০, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ কর্তৃক প্রকাশিত, প্রথম মুদ্রণ : ২০১৬, পৃ. ৫-১২)

এখন চিন্তা করুন, তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী মুসলিম কি সূর্য দেবতা ও দেব-দেবীর বাহন বহন করে মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে মঙ্গল কামনা করতে পারে?!

দুই. মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রার উদ্বোধন!

এছাড়া মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বালন করেই সাধারণত মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু করা হয়। কারণ মঙ্গল প্রদীপ জ্বেলে শুভ অনুষ্ঠান শুরু করা হিন্দুদের একটি বিশেষ রীতি। ১৪২৪ বঙ্গাব্দের বর্ষবরণে তৎকালীন ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমানও মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়েই ময়মনসিংহের শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন।

“...শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন, ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান। মঙ্গল প্রদীপ ও শোভাযাত্রার মাধ্যমে ময়মনসিংহে বাংলা নববর্ষ শুরু হয়। ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট বর্ষবরণ উদযাপন পর্ষদের উদ্যোগে মুকুল নিকেতন থেকে সকাল সাড়ে ৮টায় মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়।” (সূত্র : ইত্তেফাক, ১৪ এপ্রিল ২০১৭, অনলাইন সংস্করণ, ‘ময়মনসিংহে নববর্ষ শোভাযাত্রায় ধর্মমন্ত্রীশিরোনামে)

বাংলাপিডিয়ায় লোকসংস্কৃতিশিরোনামের অধীনে লেখা হয়েছে-শুভ অনুষ্ঠানে মঙ্গলঘট স্থাপন ও মঙ্গল প্রদীপ জ্বালানো আগে শুধু হিন্দু সমাজেই প্রচলিত ছিল, এখন মুসলমানের অনুষ্ঠানেও মঙ্গল কামনায় ওইরূপ করা হয়।

মঙ্গল প্রদীপ হল হিন্দুদের পূজার একটি বাহন। মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে তারা পূজা করে। বাংলা ট্রিবিউন (০৯ জুন ২০২০)-এর প্রতিবেদন- “(শিরোনাম) করোনা থেকে বাঁচতে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে পূজা! করোনা থেকে রক্ষা পেতে নওগাঁয় মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে পূজা করা হয়েছে। সোমবার (৮ জুন) সকালে শহরের নওযোয়ান মাঠে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে পূজা করেন হিন্দু নারীরা। তাদের বিশ্বাস, এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে পূজা করলে (তা) এ মহামারির হাত থেকে দেশ ও দেশের মানুষকে রক্ষা করবে।

উপরে বলা হল, ‘এখন মুসলমানের অনুষ্ঠানেও মঙ্গল কামনায় ওইরূপ করা হয়। তাহলে শুধু কর্মে নয়, বিশ্বাসেও মুসলিমেরা পৌত্তলিকতা ও শিরককে গ্রহণ করছে!

দৈনিক ইত্তেফাক ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১-এর প্রতিবেদন- “ (শিরোনাম) ভাষা শহীদদের স্মরণে এক লাখ মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বলন [প্রজ্বালন] অন্ধকার থেকে মুক্ত করুক একুশের আলোএই শ্লোগান নিয়ে প্রতি বছরের ন্যায় এবারো নড়াইলের সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের কুড়িরডোব মাঠে ভাষা শহীদদের স্মরণে প্রজ্বালন করা হয়েছে এক লাখ মঙ্গল প্রদীপ।

সূর্যাস্তের সাথে সাথে ২১শের সন্ধ্যায় শুরু হয় এক লাখ মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বালন। সন্ধ্যা ঠিক ৬টার সময় নড়াইলের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের শিল্পীরা আমার ভায়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারিএই গান পরিবেশনের সাথে সাথে মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বালনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন নড়াইলের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান। ... ১৯৯৮ সাল থেকে নড়াইলে একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করছে মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বালনের মাধ্যমে।

মঙ্গল প্রদীপ কেন জ্বালানো হয়, কোত্থেকে এল এ প্রদীপ জ্বালানোর মাধ্যমে মঙ্গল কামনা-বিপদ-আপদ আর রোগ-ব্যাধি থেকে রক্ষা পেতে কার্তিক মাসে উপবাস পালন আর প্রদীপ জ্বালাতে বলেছিলেন শ্রী শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী। প্রিয়জনের মঙ্গল কামনায় সেই থেকে কার্তিক মাসের শেষ ১৫ দিনের শনি ও মঙ্গলবার উপবাস পালন শেষে প্রদীপ আর ধুপ জ্বেলে প্রার্থনায় শামিল হন লোকনাথ ভক্ত অগুনতি সনাতন ধর্মাবলম্বী।” (বিডি নিউজ২৪.কম, ‘মঙ্গল কামনায় কার্তিকের উপবাসশিরোনামে, ১১ নভেম্বর ২০২০)

এখন বলুন, এক লাখ মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বালনের মাধ্যমে ভাষাশহীদদের মঙ্গলকামনাকারী সকলে কি লোকনাথ ভক্ত সনাতন ধর্মাবলম্বী’, নাকি এদের অধিকাংশই মুসলিম?! আর ভাষা শহীদরা তো সকলেই মুসলিম!

তাহলে এই প্রদীপ প্রজ্বালন কার জন্য, কী উদ্দেশ্যে? এক লাখ প্রদীপের মূল্য কয় লাখ টাকা? ইবাদতে অর্থ খরচ যাদের কাছে অপচয়মনে হয় তারা কি এগুলো দেখেন?!

তিন. পয়লা বৈশাখ : আল্পনা ও প্রদীপ

উপরে আমরা মঙ্গল প্রদীপ বা প্রদীপের সাথে পৌত্তলিকদের সম্পর্কের বিষয়ে জেনেছি। এখন আমরা দেখব, আল্পনার সাথে তাদের সম্পর্ক কী? কীভাবে একটি ধর্মের বিশেষ অনুষঙ্গকে অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতিবলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং মুসলিমদের মাঝে তার প্রচলন দেওয়া হয়েছে শৈল্পিক আবরণে।

দেবদূত ঘোষঠাকুর তার ঐ প্রতিবেদনে বলেছেন-

শুক্রবার রাতে দেখছিলাম রাস্তায় ছেলেমেয়েরা ভিড় করে আলপনা দিচ্ছেন। গাড়ি ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যেমনটা এখন পুজোর সময়ে কোনও কোনও রাস্তায় হয়, বাংলাদেশের নববর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানের ঢঙে।

আল্পনা। এটি হিন্দু ধর্মেরই একটি অনুষঙ্গ। বাংলাপিডিয়ায় আল্পনাশিরোনামের অধীনে লেখা হয়েছে-আল্পনা একধরনের লোকশিল্প এবং বলা যায় মানুষের সহজাত অভিব্যক্তি।...

বাংলায় হিন্দু মহিলারা বেশ কয়েকটি ব্রত পালন করে। এ ব্রত পালনে কাদামাটির প্রতিকৃতি ও আল্পনা একটি প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ হিসেবে চলে আসে। পূর্বসূরিদের কাছ থেকে শেখা নকশায় তারা অলংকৃত করে তোলে তাদের গৃহ, রাঙায় ঘরের দেয়াল।...

...সাধারণত মেঝের উপরই আল্পনা করা হয়। এটি অজন্তার গুহাচিত্রের ন্যায় দেয়াল অথবা সিলিং-এ আঁকা হয় না। স্মরণাতীতকাল থেকেই বাংলার মহিলারা ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানাদির উদ্দেশ্যেই এ নকশার অনুশীলন করে আসছেন।

...গোলাকৃতির আল্পনা দেবীর পূজায়, বিশেষ করে লক্ষ্মীপূজায়, পবিত্র বেদি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আল্পনায় ব্যবহৃত মোটিফগুলি হলো সূর্য, ধান গাছ, পেঁচা, মই, লাঙল, লক্ষীর পা, মাছ, পান, পদ্ম, শঙ্খলতা, সিঁদুরকৌটা ইত্যাদি।

আধুনিক যুগে আল্পনা শান্তিনিকেতনি শৈলী দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। এ শান্তিনিকেতনি শৈলীর আল্পনার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিমূর্ত, আলংকারিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সামঞ্জস্যপূর্ণ। বর্তমান যুগে মুসলমানরাও বিবাহ ও অন্যান্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আল্পনা অংকন করে থাকেন। একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও মিনারসংলগ্ন সড়কগুলিতে প্রচুর আল্পনা করা হয়। এটা সত্যি যে, আধুনিক বাংলাদেশে আল্পনা একটি অসা¤প্রদায়িক চরিত্র পরিগ্রহ করেছে। [এম. রফিকুল আলম]

হাঁ, বাস্তবই বলেছেন, পৌত্তলিক সম্প্রদায়ের সংস্কৃতির বিশেষ অনুষঙ্গ বর্তমানে অসাম্প্রদায়িকরূপই লাভ করেছে বটে!

এ বাস্তবতা সামনে আসার পর এখন মুসলিমদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা কি আল্পনা নামক পূজার পবিত্র বেদিনিজেদের বিবাহ অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে ব্যবহার করবেন! এতে কি আল্লাহ খুশি হবেন?

উল্লেখ্য, পয়লা বৈশাখের পোশাক, দোকান ডেকোরেশন ও শোভাযাত্রা উদযাপনের লোগো ইত্যাদিতেও এ শাস্ত্রীয় আলপনার যথেষ্ট দখল লক্ষ করা যায়।

চার. মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে মঙ্গল কামনা!

এটি তথাকথিত প্রগতিশীলদের দ্বারা চর্চিত আধুনিক কুসংস্কারগুলোর একটি। মঙ্গল প্রদীপ জ্বেলে সভা-অনুষ্ঠান উদ্বোধন, বছরের শেষ সূর্যকে অনুষ্ঠানিক বিদায় জানানো, নতুন বছরের সূর্যকে আনুষ্ঠানিক স্বাগত জানানো, প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, বিভিন্ন ঋতুকে স্বাগত বা বিদায় জানানোর উদ্দেশ্যে বসন্তোৎসব’, ‘চৈত্র সংক্রান্তিইত্যাদি, ভ্যালেন্টাইন ডে নামক পশ্চিমাদের উৎসব উদযাপ, মোমবাতি প্রজ্বালনের মাধ্যমে হৃদয়ের আলোকামনা, কারো মৃত্যুতে এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন ইত্যাদি আধুনিক কুসংস্কারের মত এটিও এক আধুনিক কুসংস্কার। এগুলো কোনো না কোনো প্রাচীন জাতি-ধর্মের কুসংস্কারের আধুনিক চর্চা। যা তথাকথিত প্রগতিশীল, প্রগতিবাদী নামক ‘...’ দ্বারা আমাদের সমাজে নবরূপে চর্চিত হচ্ছে; এমনকি কিছু মুসলিমের মাঝেও!

আমরা লক্ষ করছি, বাঙালী মুসলিম সন্তান মঙ্গল শোভাযাত্রা করছে। হিন্দুদের সূর্য দেবতার প্রতিকৃতি বহন করছে। তাদের দেবতার বিভিন্ন বাহনÑ পেঁচা, হাঁস, ময়ূর ইত্যাদির মূর্তি-প্রতিকৃতি বহন করে মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে মঙ্গল কামনা করছে! যারা করছে তারা আবার নিজেদের প্রগতিবাদী আধুনিক মুসলিম মনে করে; তাই তো বলি, এটি একটি প্রগতিশীল আধুনিক কুসংস্কার!

এসবের মাধ্যমে কার কাছে মঙ্গল কামনা করা হচ্ছে? মুসলিম কার কাছে মঙ্গল কামনা করে? কী পদ্ধতিতে করা হচ্ছে? মুসলিমের মঙ্গল ও কল্যাণ প্রার্থনার পদ্ধতি কি এটা?

আচ্ছা, যদি এটার সাথে অন্য কোনো ধর্মের কোনো সংঘর্ষ না থাকে, ইসলামের তো আছে। মুসলিম কি এভাবে মঙ্গল কামনা করতে পারে? বা এ পদ্ধতিতে মঙ্গল কামনার একটি মজমায় কি মুসলিম অংশগ্রহণ করতে পারে?

এখানে যে পন্থায়ই মঙ্গল কামনা করা হোক, সেখানে সূর্য দেবতার প্রতিকৃতি আর দেব-দেবীর বাহন থাক বা না থাক, একথা কি কেউ স্পষ্ট করে বলবেন, এখানে মঙ্গলটা কামনা করা হচ্ছে কার কাছে?

আল্লাহর কাছে যে নয়, এটা তো স্পষ্ট! এখন মুসলিম কি আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে সাহায্য ও মঙ্গল কামনা করতে পারে?

মুসলিম প্রতিদিনের, প্রতি ওয়াক্তে, প্রতি রাকাত নামাযে কী বলে?

اِیَّاكَ نَعْبُدُ وَ اِیَّاكَ نَسْتَعِیْنُ.

(তরজমা) আমরা তোমারই ইবাদত করি এবং তোমারই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি। (সূরা ফাতিহা, আয়াত : ৪)

তাহলে কেন মুসলিমকে এ পথে মঙ্গল কামনা করতে আহ্বান করা হচ্ছে?! কেন, কী উদ্দেশ্যে?

এর উত্তর খোঁজা দরকার। আমার ঈমান হেফাজতের জন্য, আমার সন্তানদের ঈমান-আকীদা হেফাজতের জন্য।

মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে মঙ্গল কামনা করা তো পৌত্তলিক জাতি-গোষ্ঠীর ধর্মীয় রীতি। সুতরাং কীভাবে একত্ববাদে বিশ্বাসী মুসলিম হয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে মঙ্গল কামনা করতে পারি! দৈনিক কালের কণ্ঠ ৩০ মার্চ ২০১৭ (আঞ্চলিক প্রতিনিধি, পিরোজপুর-এর রিপোর্টে) ভাণ্ডারিয়ায় শ্রীগুরু সংঘের ৫৫তম ধর্মীয় উৎসবে মঙ্গল শোভাযাত্রাশিরোনামে  লেখা হয়েছে-

হিন্দু ধর্মীয় শ্রীগুরু সংঘের উদ্যোগে সংঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী শ্রীমদ দুর্গাপ্রসন্ন

পরমহংসদেবের স্মরণে ৫ দিনব্যাপী ৫৫তম ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে আজ বৃহস্পতিবার মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সকালে ভাণ্ডারিয়া কেন্দ্রীয় মন্দির প্রাঙ্গণে প্রাতঃকালীন প্রার্থণা ও শ্রীগুরু বন্ধনা, গীতাপাঠ, সংঘ পতাকা  পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে এ ধর্মীয় অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা করা হয়।

শ্রীগুরু সংঘের ভক্তরা বাদ্যযন্ত্র, জাতীয় ও সংঘ পতাকা হাতে এবং তাদের গুরুদেবের বিগ্রহ সহকারে শহরে একটি বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করে। শোভাযাত্রাটি পৌর শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে।

এখানে স্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে, ‘৫ দিনব্যাপী ৫৫তম ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে আজ বৃহস্পতিবার মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়েছে। অর্থাৎ মঙ্গল শোভাযাত্রার সাথে পৌত্তলিকদের ধর্মের সম্পর্ক। তারপরও কীভাবে একজন মুসলিম...!

মুসলিম শিক্ষার্থীদের প্রতিও পৌত্তলিক শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণের নির্দেশ!

প্রশ্ন হচ্ছে, এমন বিতর্কিত’ (বিতর্কিত নয়; বরং সুপ্রমাণিত পৌত্তলিক শোভাযাত্রা) পৌত্তলিক শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণের জন্য কি মুসলিম শিক্ষার্থীদের নির্দেশ দেওয়া যায়? বাংলা ট্রিবিউনের রিপোর্ট- “(শিরোনাম) বর্ষবরণে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মঙ্গল শোভাযাত্রার নির্দেশ’,  বাংলা ট্রিবিউন রিপোর্ট, ২৮ মার্চ ২০১৭, ০২:৩৯ : আগামী ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষ শুরু হচ্ছে। এদিন সারা দেশে চলবে বর্ষবরণ উৎসব। তবে এবার অন্যান্যবারের চেয়ে ভিন্নমাত্রায় বর্ষবরণ  আয়োজন করা হচ্ছে। মঙ্গল শোভাযাত্রা বিশ্বঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় চলতি বছর বর্ষবরণের আয়োজনে এ শোভাযাত্রা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের আতওতাধীন সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ নববর্ষ পালন করতে হবে। ফলে দিনটি অন্য যে কোনও বছরের চেয়ে এ বছর বেশি গুরুত্ব পাবে। 

এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতের পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক মো. এলিয়াছ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের আওতাধীন দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এ বছর আড়ম্বরের সঙ্গে বাংলা নববর্ষ পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।দেশের স্কুল-কলেজগুলোতে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

নির্দেশ হোক আর নির্দেশনা; তাওহীদ ও একত্ববাদে বিশ্বাসী মুসলিম শিক্ষার্থীকে এমন পৌত্তলিক শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণের কথা শিক্ষা মন্ত্রণালয় তো দূরের কথা, কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কি বলতে পারে?

ছবি দেখে বলুনÑ এ শোভাযাত্রা-র‌্যালিতে কি কোনো মুসলিম আছে!

এতক্ষণ মঙ্গলশোভাযাত্রার যে চিত্র আমাদের সামনে এল; বা বলি, পত্র-পত্রিকায় মঙ্গল শোভাযাত্রার যে ছবি আমরা দেখি, কোনো বিদেশি বন্ধুকে, যার এসব সম্বন্ধে কিছুই জানা নেই, এ ছবি দেখিয়ে  জিজ্ঞেস করুন-এ র‌্যালিতে কি কোনো মুসলিম আছে? বা থাকতে পারে?’ বা তাকে জিজ্ঞেস করুন- এটি কোন্ সম্প্রদায়ের শোভাযাত্রা? উত্তর যা আসবে, তা নিয়ে ভাবুন এবং নিজেকে রক্ষা করুন। কারণ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

مَنْ تَشَبّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ.

যে ব্যক্তি কোনো স¤প্রদায়ের সাথে সাদৃশ্য রাখবে সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪০৩১

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

فَاجْتَنِبُوا الرِّجْسَ مِنَ الْاَوْثَانِ وَ اجْتَنِبُوْا قَوْلَ الزُّوْرِ.

তোমরা মূর্তির অপবিত্রতা থেকে বেঁচে থাক এবং বেঁচে থাক মিথ্যা কথা বলা থেকে। -সূরা হজ্ব (২২) : ৩০

প্রতিটি দিবস অতিবাহিত হোক ফিরিশতার পতাকাতলে

আমাদের জীবনের প্রতিটি দিন গুরুত্বপূর্ণ। তা বছরের প্রথম দিন হোক বা শেষ দিন। আর দিবসটির ভালো-মন্দ বিবেচিত হবে আমার কর্মের মাধ্যমে; কোনো র‌্যালি-শোভাযাত্রার মাধ্যমে নয়। আমি ভালো কাজ করলে কল্যাণ লাভ হবে আর মন্দ করলে আমি নিজেরই ক্ষতি সাধন করলাম। আর ব্যক্তি যখন ভালো কাজের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হয় তখন একজন ফিরিশতা পতাকা নিয়ে তাকে অনুসরণ করে। ভালো কাজের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার ফলে ঘরে ফেরা পর্যন্ত সে ফিরিশতার পতাকাতলে অবস্থান করে। আর -আল্লাহ না করুন- ব্যক্তি যদি মন্দ কাজের উদ্দেশ্যে বের হয়; যে কাজ আল্লাহ পছন্দ করেন না- এমন কাজের উদ্দেশ্যে বের হয় তখন একজন শয়তান পতাকা নিয়ে তাকে অনুসরণ করে; ঘরে ফেরা পর্যন্ত সে শয়তানের পতাকাতলে অবস্থান করে। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

مَا مِنْ خَارِجٍ يَخْرُجُ - يَعْنِي مِنْ بَيْتِهِ - إِلَّا بِبَابِهِ  رَايَتَانِ: رَايَةٌ بِيَدِ مَلَكٍ، وَرَايَةٌ بِيَدِ شَيْطَانٍ، فَإِنْ خَرَجَ لِمَا يُحِبُّ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ، اتَّبَعَهُ الْمَلَكُ بِرَايَتِهِ، فَلَمْ يَزَلْ تَحْتَ رَايَةِ الْمَلَكِ حَتَّى يَرْجِعَ إِلَى بَيْتِهِ، وَإِنْ خَرَجَ لِمَا يُسْخِطُ اللهَ، اتَّبَعَهُ الشَّيْطَانُ بِرَايَتِهِ، فَلَمْ يَزَلْ تَحْتَ رَايَةِ الشَّيْطَانِ، حَتَّى يَرْجِعَ إِلَى بَيْتِهِ.

কোনো ব্যক্তি যখন ঘর থেকে বের হয় তার দরজায় দুটি পতাকা থাকে; ফিরিশতার হাতে একটি পতাকা, শয়তানের হাতে একটি। ব্যক্তি যদি ভালো কাজের উদ্দেশ্যে বের হয় তাহলে ফিরিশতা নিজ পতাকা নিয়ে তার অনুগামী হয় এবং ঘরে ফেরা পর্যন্ত সে ফিরিশতার পতাকাতলে থাকে। আর যদি আল্লাহর অপছন্দনীয় কোনো কাজের উদ্দেশ্যে বের হয় তাহলে শয়তান নিজ পতাকাসহ তাকে সঙ্গ দেয় এবং বাড়ি ফেরা পর্যন্ত সে শয়তানের পতাকাতলে থাকে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৮২৮৬; আলমুজামুল আওসাত, তবারানী, হাদীস ৪৭৮৬; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস ৫৫৬

পৌত্তলিকতার পতাকাকে কার পতাকা বলা হবে- ফিরিশতার, নাকি শয়তানের? বছরের প্রথম সকাল যদি আমার শয়তানের পতাকাতলে অতিবাহিত হয় তখন! আল্লাহ আমাদের প্রতিটি দিবস ফিরিশতার পতাকাতলে অতিবাহিত করার তাওফীক দান করুন- আমীন।

এটা কি সর্বজনীন বাঙালী সংস্কৃতি?

(শব্দটি হবে, ‘সর্বজনীন’, সার্বজনীন নয়) এটাকে সর্বজনীন বাঙালী সংস্কৃতি বলে একটা গ্রহণযোগ্যতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। সর্বজনীন বলতে কী বুঝায়? সর্বজনীন হল, (অভিধানের ভাষায়) সর্বসাধারণের জন্য অনুষ্ঠিত, সকলের জন্য মঙ্গলকর বা কল্যাণকর। অর্থাৎ যা সকলে গ্রহণ করতে পারে, সকলের কল্যাণ বয়ে আনে। আর বাঙালীরা যে সংস্কৃতি ধারণ করে আছে সেটাই হল বাঙালী সংস্কৃতি

বাঙালী বলতে প্রধানত দুটি ধর্মের লোকদের বোঝানো হয়- মুসলিম ও হিন্দু। প্রত্যেকের আলাদা আকীদা-বিশ্বাস আছে, আলাদা আচার-অনুষ্ঠান আছে। আর এ দুটি ধর্ম এমন, যার একটির আকীদা-বিশ্বাস অপরটির ঠিক উল্টো। একটির বিশ্বাস তাওহীদ বা একত্ববাদ অপরটির শিরক তথা বহুত্ববাদ। উভয় ধর্মের প্রতিটি কর্মেই এ তাওহীদ বা শিরক প্রতিফলিত হয়। এখন চিন্তা করে দেখি, এ দুই ধর্মের অনুসারী বাঙালীদের সংস্কৃতির সংমিশ্রণে যদি বাঙালী সংস্কৃতিনামক তৃতীয় কোনো বিষয় আবিষ্কৃত হয়, তা কি তাওহীদ বা শিরকমুক্ত হতে পারবে?

তাওহীদের মৌলিক একটি বিষয় যেহেতু আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী হওয়া আর শিরক তথা বহুত্ববাদকে অস্বীকার করা; এখন বাঙালী সংস্কৃতি নামে কোনো আচার-অনুষ্ঠান যদি এমন হয়, যার মূল প্রতিপাদ্যই হল, শিরক বা বহুত্ববাদ অস্বীকার ও বর্জন- তাহলে হিন্দু বাঙালীরা কি বাঙালী সংস্কৃতিনামে তা গ্রহণ করবে?

তেমনি বাঙালী সংস্কৃতির কোনো আচার-অনুষ্ঠান যদি সরাসরি শিরক বা শিরক মিশ্রিত হয় তা গ্রহণ করা কি মুসলিমের পক্ষে সম্ভব?

আজকের মূল প্রতিপাদ্যই এটা যে, বাঙালী-প্রধান দুই ধর্মের একটি ধর্মের অনুসারী স্পষ্ট উচ্চারণেই বলছেন যে, ‘বাঙালী সংস্কৃতিনামে যা পয়লা বৈশাখে উদযাপন করা হচ্ছে, তা আর কিছু নয়; পূজা ও বসন্ত বরণের মিশেল এক সংস্কৃতি!

দেবদূত ঘোষঠাকুর বলছেন, এর সম্পর্ক হিন্দু ধর্মের সাথে; কিন্তু আমাদের দেশের তথাকথিত সেক্যুলাররা বলছে, এর সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন-

“...কিন্তু মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজকেরা বলছেন, মঙ্গল শোভাযাত্রার সাথে কোন ধর্মীয় বিষয়ের সম্পর্ক নেই এবং যেকোনো ধর্মের উৎসবের বাইরে বাঙ্গালি হিসেবে সর্বজনীন একটি উৎসব হিসেবেই সূচনা হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রার।

অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, বাংলাদেশে ধর্মীয় বিভিন্ন শোভাযাত্রা অনেক আগে থেকেই হচ্ছে। আমাদের মহররমের সময় একটা শোভাযাত্রা হয়। জন্মাষ্টমীতে একটি শোভাযাত্রা হয়। কিন্তু যেহেতু সেগুলো ধর্মভিত্তিক শোভাযাত্রা, সেখানে ধর্মীয় বিষয়গুলোই থাকে। শোভাযাত্রার প্রথাটা বহু প্রাচীন। কিন্তু সব ধর্মের মানুষকে মেলানো যাচ্ছিল না। শোভাযাত্রার বিষয়টা এখানে নতুন না, নতুন হচ্ছে সর্বজনীনতা

শিল্পী মনিরুজ্জামানও বলেন, বিশ্বের অনেক দেশেই নানা নামে আরো বড় শোভাযাত্রা আছে। কিন্তু মঙ্গল শোভাযাত্রার বিশেষত্বই হচ্ছে এর সর্বজনীনতা।” (বাংলা নববর্ষে মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে আপত্তি কেন?, মীর সাব্বির, বিবিসি বাংলা, ১৩ এপ্রিল ২০১৭)

সম্পর্ক আছে কি নেই- তা বুঝেছেন দেবদূত ঘোষ ঠাকুর; বুঝতে পারছেন না কেবল আমাদের প্রগতিশীল মুসলিমেরা!

ডয়চে ভেলের প্রতিবেদনে উদ্ধৃত করা হয়েছে আল্লামা শাহ আহমদ শফী রাহ.-এর বক্তব্য-

হেফাজতে ইসলামের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফী শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘পহেলা বৈশাখ উদযাপনের অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে মঙ্গল শোভাযাত্রার যে আয়োজন করা হয় তা ইসলামী শরিয়ত সমর্থন করে না। কোন ঈমানদার মুসলমান মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করতে পারে না।

তিনি আরো বলেন, “মানুষের জীবনের কল্যাণ ও মঙ্গল-অমঙ্গল সবকিছুই আমাদের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ তাআলার হুকুমে হয়। পৃথিবীর সব বিশ্বাসী এটাই বিশ্বাস করেন। কোন মূর্তি, ভাস্কর্য, পোস্টার, ফেস্টুন ও মুখোশে মঙ্গল-অমঙ্গল থাকতে পারে না। বাঘ, কুমির, বানর, পেঁচা, কাকাতুয়া, ময়ূর, দোয়েলসহ বিভিন্ন পশুপাখি মঙ্গল আনতে পারে না। এসব বিশ্বাস যেমন ইসলামি শরীয়তবিরোধী চেতনা, তেমনি বর্তমান আধুনিক সময়ে মূর্তি-ভাস্কর্য ও জীবজন্তুর ছবি নিয়ে মঙ্গল-অমঙ্গল কামনা করা একটি কুসংস্কারচ্ছন্ন ধ্যান-ধারণা। (নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে পহেলা বৈশাখ https://www.dw.com/bn)

সুতরাং তথাকথিত সুশীল ও সেক্যুলাররা যতই বলুক, এটা সর্বজনীন বাঙালী সংস্কৃতি বা অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি, তা আর ধোপে টিকবে না। যে মুসলিম শিরক থেকে বাঁচতে চায়, নিজের ঈমানের হেফাজত করতে চায় তাদেরকে আর সর্বজনীন, সর্বজনীনবলে এটা গেলানো সম্ভব হবে না।

মুসলিমরা যখন দেখছে, এটি হিন্দুয়ানী সংস্কৃতির ভিন্ন রূপ; হিন্দুরাও এ উৎসব-উদ্যাপনকে পূজার সাথে তুলনা করছে, তখন কীভাবে সর্বজনীন বাঙালী সংস্কৃতিনামে সে তা গ্রহণ করতে পারে? বরং এসব থেকে তার কাছে আরো স্পষ্ট হয় যে, সর্বজনীন ও বাঙালী সংস্কৃতি বলে মুসলিমদের পৌত্তলিক সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত করার এ এক দূরভিসন্ধি!

হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-

لَا تَقُومُ السّاعَةُ حَتّى تَلْحَقَ قَبَائِلُ مِنْ أُمّتِي بِالمُشْرِكِينَ، وَحَتّى يَعْبُدُوا الأَوْثَانَ.

ততক্ষণ কিয়ামত কায়েম হবে না, যতক্ষণ না আমার উম্মতের কিছু গোষ্ঠী মুশরিকদের সাথে গিয়ে মিলিত হয়; এমনকি তারা মূর্তির পূজা করবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২২১৯

আমরা ভেবে দেখি, তাদের ভাষায়ই আমাদের বর্ষবরণ উদযাপন তাদের ধর্মের প্রধান অনুষঙ্গ পূজার সাথে মেলে। তাহলে বাকিটা আমি বিবেচনা করি। কোনো মুসলমানই তাওহীদ-বিরোধী, পৌত্তলিক ও শিরকমুখী কোনো কাজ করতে পারে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

مَنْ تَشَبّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ.

যে ব্যক্তি কোনো স¤প্রদায়ের সাথে সাদৃশ্য রাখবে সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। Ñসুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪০৩১

পৌত্তলিকতা ও শিরক মুসলিমের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক ও স্পর্শকাতর কবীরা গুনাহ। যাতে লিপ্ত হওয়া, তা যে কোনো পন্থায় হোক বা যে কোনো মাত্রায়- মুসলিমের জন্য আত্মহননের শামিল। এ গুনাহ মুসলিমের সকল আমলকে বরবাদ করে দেয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

وَ لَقَدْ اُوْحِیَ اِلَیْكَ وَ اِلَی الَّذِیْنَ مِنْ قَبْلِكَ لَىِٕنْ اَشْرَكْتَ لَیَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَ لَتَكُوْنَنَّ مِنَ الْخٰسِرِیْنَ .

আর (হে নবী) অবশ্যই তোমার কাছে এবং তোমার পূর্ববর্তীদের  কাছে ওহী পাঠানো হয়েছে যে, যদি তুমি শিরক কর তাহলে তোমার কর্ম নিষ্ফল হয়ে যাবে আর অবশ্যই তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। -সূরা যুমার (৩৯) : ৬৫

ফলে পৌত্তলিকতা ও শিরকের বিষয়ে মুসলিম সবচেয়ে বেশি সতর্ক থাকে। কারণ আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

اِنَّ اللهَ لَا یَغْفِرُ اَنْ یُّشْرَكَ بِهٖ وَ یَغْفِرُ مَا دُوْنَ ذٰلِكَ لِمَنْ یَّشَآءُ...

নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না, যে লোক তাঁর সাথে শরীক করে। তিনি ক্ষমা করেন এর নি¤œ পর্যায়ের পাপ, যার জন্য তিনি ইচ্ছা করেন। ... -সূরা নিসা (৪) : ৪৮

আমরা ভেবে দেখি, বৃহত্তর বাঙালী মুসলিম জনগণের মুসলিম-পরিচিতি বিলুপ্ত করার ও তাদেরকে পৌত্তলিকতায় লিপ্ত করার কাজ কত দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। কাজটি হচ্ছে অতি সূ², সুচিন্তিত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায়। পরিকল্পনাটি বহুমাত্রিক, যাতে রয়েছে শিক্ষাকেন্দ্রিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নানা দিক।

হাঁ, ধর্মের সাথে পয়লা বৈশাখের কোনো বিরোধ নেই!

দেবদূত ঘোষঠাকুর বলছেন, এর সম্পর্ক হিন্দু ধর্মের সাথে কিন্তু আমাদের দেশের তথাকথিত প্রগতিবাদীরা বলছেন, এর সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন-

“...কিন্তু মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজকেরা বলছেন, মঙ্গল শোভাযাত্রার সাথে কোন ধর্মীয় বিষয়ের সম্পর্ক নেই এবং যেকোন ধর্মের উৎসবের বাইরে বাঙ্গালি হিসেবে সর্বজনীন একটি উৎসব হিসেবেই সূচনা হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রার।” (বাংলা নববর্ষে মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে আপত্তি কেন?, মীর সাব্বির, বিবিসি বাংলা, ১৩ এপ্রিল ২০১৭)

হাঁ, আমরাও বলি, ধর্মের সাথে পয়লা বৈশাখের কোনো বিরোধ নেই! বিরোধ হল, পয়লা বৈশাখে উদযাপিত নানা আয়োজন-অনুষ্ঠানের সাথে, তার নানা অনুষঙ্গের সাথে, তার পৌত্তলিকতার সাথে, তার মঙ্গল শোভাযাত্রা ও তার মূর্তি-ভাস্কর্যসহ অন্যান্য উপাদানের সাথে। বিরোধ হল, সূর্য দেবতা ও অন্যান্য দেবতার বাহন বহনের সাথে। বিরোধ হল, প্রকৃতিপূজা কুসংস্কারের আধুনিক সংস্করণের সাথে। বিরোধ হল, পৌত্তলিক র‌্যালির মাধ্যমে মঙ্গল কামনার কুসংস্কারের সাথে।

এটি ভর দুপুরে তেজদীপ্ত সূর্যের অস্তিত্ব অস্বীকার’-এর নামান্তর। এটা কেন ঘটে? তাহলে ওরা কি অন্ধ? আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

فَاِنَّهَا لَا تَعْمَی الْاَبْصَارُ وَ لٰكِنْ تَعْمَی الْقُلُوْبُ الَّتِیْ فِی الصُّدُوْرِ.

প্রকৃতপক্ষে চোখ অন্ধ হয় না, বরং অন্ধ হয় বক্ষস্থিত হৃদয়। -সূরা হজ্ব (২২) : ৪৬

বাঙালিয়ানার নামেই হোক বা যে নামেই হোক- একজন মুসলিম এসব গ্রহণ করবে কীভাবে? সে তো তার ঈমান হেফাজতে সদা সচেষ্ট থাকে এবং আল্লাহর কাছে দুআ করতে থাকে-

رَبَّنَا لا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ.

হে আমাদের রব! তুমি আমাদের যে হেদায়েত দান করেছ তারপর আর আমাদের অন্তরকে বক্র ও সত্যলংঘনপ্রবণ করো না। এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাদেরকে বিশেষ রহমত দান কর। নিশ্চয় তুমিই মহাদাতা। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ৮

উৎসবশিরোনাম হলেই কি তা সর্বজনীন হয়ে যায় এবং মুসলিমও তাতে অংশগ্রহণ করতে পারে?

মুসলিমের ঈদ-উৎসবের স্বরূপ-প্রকৃতি ও পদ্ধতি সকল বিষয় অন্যান্য জাতির পর্ব-উৎসব থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। কেবল উৎসবশিরোনাম হলেই মুসলিম তাতে অংশগ্রহণ করতে পারে না। উৎসবের প্রকৃতি-বৈশিষ্ট্যই নির্ধারণ করে দেয়Ñ মুসলিম তাতে অংশগ্রহণ করতে পারে কি না। আর জানা কথা, ইসলাম তাওহীদের ধর্ম। সুতরাং শিরক ও শিরকের অনুষঙ্গয্ক্তু কোনো উৎসবের সাথে মুসলিমের আদৌ কোনো সম্পর্ক গ্রহণযোগ্য নয়। যতই তা সর্বজনীন উৎসবশিরোনামে হোক।

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদীনায় এলেন তখন মদীনাবাসীরও দুটি উৎসব ছিল। কেবল উৎসব শিরোনামের কারণেই নবীজী বলেননি- মুসলিমরাও তাতে অংশগ্রহণ করবে। কারণ, অন্যান্য জাতি-ধর্মের অনুষ্ঠানে তাদের সংস্কৃতি অবশ্যই প্রতিফলিত হবে। মুশরিক হলে শিরকের সংস্কৃতি, অগ্নিপূজারী হলে তাদের সংস্কৃতি। এজন্যই নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের উৎসবে আমাদের অংশগ্রহণের অনুমতি দেননি; সেখানের দেশজ সংস্কৃতির শিরোনামেও নয়; বরং এর পরিবর্তে আমাদেরকে দুই ঈদ দেওয়া হয়েছে। আর আমাদেরকে দুই ঈদ দেয়াই হয়েছে আমাদের উৎসব পৌত্তলিকতা ও অন্যান্য জাতি-ধর্মের সংস্কৃতি মুক্ত হওয়ার জন্য। হাদীসে এসেছে-

عَنْ أَنَسٍ، قَالَ: قَدِمَ رَسُولُ اللّهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ الْمَدِينَةَ وَلَهُمْ يَوْمَانِ يَلْعَبُونَ فِيهِمَا، فَقَالَ: مَا هَذَانِ الْيَوْمَانِ؟ قَالُوا: كُنّا نَلْعَبُ فِيهِمَا فِي الْجَاهِلِيّةِ، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: إِنّ اللهَ قَدْ أَبْدَلَكُمْ بِهِمَا خَيْرًا مِنْهُمَا: يَوْمَ الْأَضْحَى، وَيَوْمَ الْفِطْرِ.

আনাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় এলেন। সেসময় মদীনার অধিবাসীর দুটি (উৎসবের) দিন ছিল, যাতে তারা আনন্দ-ফর্তি করত। তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এ দুটি দিবস কীসের? তারা বললেন, জাহেলি যুগে আমরা এ দুটি দিনে আনন্দ-ফর্তি করতাম। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহ তাআলা এ দুটি দিনের পরিবর্তে তোমাদেরকে উত্তম দুটি দিন দান করেছেন। সে দিন দুটি হল : ইয়াওমুল আযহাইয়াওমুল ফিতর’ (অর্থাৎ ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতরের দুই দিন)।-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১১৩৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১২০০৬

এ উৎসব কি অসাম্প্রদায়িক?

এসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হওয়া দরকার। এখানে শুধু তাদের দৃষ্টিতেই যে এটা অসাম্প্রদায়িক বা সর্বজনীন নয়- এটা দেখানো উদ্দেশ্য। আর সে উদ্দেশ্যেই আনন্দবাজারের এ প্রদিবেদন একটি নমুনা হিসেবে সামনে আনা।

যে উৎসবকে একটি সম্প্রদায়ের লোকেরা নিজেদের উৎসবের সাথে তুলনা করছেন, তা কীভাবে অসাম্প্রদায়িক ও সর্বজনীন হতে পারে?

যাইহোক, আমাদের আলোচ্য প্রতিবেদনটি যখন আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে পড়লাম তখন দেখলাম, এ প্রতিবেদনের মাঝে আরেকটি প্রতিবেদনের শিরোনাম-

মৌলবাদকে পথে নেমে মোকাবিলা বাংলাদেশে। এ লেখায় ঢুকে দেখলাম সেখানেও লেখার মাঝে পূর্বের লেখার শিরোনাম দেওয়া হয়েছে-ঢাকার পয়লা যেন অষ্টমীর একডালিয়া। অর্থাৎ আপনাকে দুটো লেখা-ই পড়তে আহ্বান করা হচ্ছে; একটি যেন আরেকটির পরিপূরক। অর্থাৎ বসন্তবরণ ও পুজোর মিলমিশে একাকার হওয়া উৎসব দিয়ে মূলত মৌলবাদকে মোকাবেলা করা হচ্ছে; দুটি লেখা একসাথে না পড়লে পাঠক বিষয়টি বুঝতে পারবেন না। তাই দুটোই পড়ার দাওয়াত!

আমাদের প্রগতিশীল নিজেদের মৌলবাদীশব্দটি উচ্চারণকে যা দ্বারাই ব্যাখ্যা করুন, একজন অমুসলিম যখন মৌলবাদীশব্দটি উচ্চারণ করেন তখন এর সোজাসাপ্টা তরজমা দাঁড়ায় মুসলিম। অর্থাৎ, তাদের দৃষ্টিতে এ আয়োজন দ্বারা মুসলিমদের মোকাবেলা করা হচ্ছে। আবার এ কাজে মুসলিমদেরই ব্যবহার করা হচ্ছে চতুরতার সাথে। এর পেছনে তাদের হয়ে যারা কাজ করছেন তারাও জন্মসূত্রে  মুসলিম। এমন একজনের  মোকাবিলার দৃপ্তকণ্ঠ উচ্চারণ (এর অডিও-ও রয়েছে) শুনুন- ডয়চে ভেলে মিডিয়া সেন্টারের প্রতিবেদন-

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন এবং পহেলা বৈশাখ মঙ্গল শোভাযাত্রার সদস্য সচিব অধ্যাপক নিসার হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, “ওরা মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে যত বলে আমাদের আগ্রহ তত বেড়ে যায়। আমাদের কাছে মনে হয় আমরা ভালো কিছু একটা করছি। কারণ তারা ধর্মনিরপেক্ষ, মানবিক এবং বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে।” (নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে পহেলা বৈশাখ https://www.dw.com/bn; দৈনিক আমাদের সময়, অনলাইন সংস্করণ, ১৪ এপ্রিল ২০১৯ লিংক : https://www.amadershomoy.com/bn/2019/04/14/853123.htm)

যে কাজ করলে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন, এদেশের সচেতন মুসলিম জনসাধারণ, আলেম-উলামা অসন্তুষ্ট হন সে কাজে নিশ্চয় শয়তান খুশি হয় এবং অমুসলিম ও ইসলাম বিদ্বেষীরা বাহবা দেয়! সেটির যতই বিশেষণ যুক্ত করা হোক ধর্মনিরপেক্ষ’ ‘মানবিক’, ‘বাঙালি সংস্কৃতি’; আল্লাহর কাছে এবং আল্লাহর ওহীর ইলমে আলোকিত মুসলিমের কাছে শব্দ-বিশেষণের কোনো মূল্য নেই; মূল্য হাকীকতের। তাই শব্দ-বিশেষণ ধোঁকায় মুসলিম প্রতাড়িত হয় না!

আনন্দবাজার পত্রিকায় ঠিক এক বছর পর (১৫ এপ্রিল ২০১৯) পরের বছরের বৈশাখ উদযাপন বিষয়ে প্রতিবেদন পেশ করেছে এ শিরোনামে-

ফতোয়া উড়িয়ে বাংলাদেশ জুড়ে বর্ণময় বর্ষবরণ

একজন হিন্দুও বলছে মৌলবাদ মোকাবেলা, একজন মুসলিম নামের ব্যক্তিও বলছে। একজন হিন্দুও বলছে ফতোয়া উড়িয়ে, একজন নামধারী মুসলিমও বলছে। একজন হিন্দুও যা মোকাবেলা করে খুশি, একজন তথাকথিত প্রগতিশীল ও মুসলিম নামধারিও! এতে মুসলিমদের জন্য রয়েছে উপলব্ধির বহু উপকরণ।

আমি মুমিন-মুসলিম হিসেবে সবশেষে স্মরণ করি; নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী-

لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتّى يَكُونَ هَوَاهُ تَبَعًا لِمَا جِئْتُ بِهِ .

কোনো ব্যক্তি পূর্ণ মুমিন হতে পারবে না, যে পর্যন্ত না তার প্রবৃত্তি আমার আনীত দ্বীনের অধীন বা অনুগত হয়। -আসসুন্নাহ, ইবনে আবী আছেম, হাদীস ১৫

এসবকিছুই বাস্তব। এ বাস্তব বিষয়গুলো মুসলিমদের সামনে পেশ করা হল আদ দ্বীনু আননাসীহা’ (দ্বীন হল কল্যাণকামনা) হিসেবে। এসব থেকে একজন মুসলিম অবশ্যই ভাবনার খোরাক পাবেন-

فَاعْتَبِرُوا يا أُولِي الْأَبْصارِ.

অতএব হে চক্ষুষ্মান ব্যক্তিগণ! তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর। -সূরা হাশর (৫৯) : ২

وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين، وما علينا إلا البلاغ.

পুনশ্চ : এবারের পয়লা বৈশাখ এবং পয়লা রমযান একই দিনে হতে পারে। মুসলিম কখনো আত্মহননের পথ বেছে নেয় না। উপরের নিবন্ধ থেকে আশা করা যায় আমরা উপলব্ধি করতে পেরেছি, উৎসব শিরোনামের এসব পৌত্তলিক পর্ব-উৎসব মুসলিমের জন্য আত্মহননের শামিল। এ হল পৌত্তলিকতা ও পশ্চাৎপদতা; ইসলামপূর্ব শিরকের জাহিলিয়াতে ফিরে যাওয়া, যা থেকে আল্লাহ মুসলিমকে মুক্তি দিয়েছেন।

রমযান হল, নেকী ও কল্যাণের পথে অগ্রসর হওয়ার মাস; পশ্চাৎপদতার নয়। রমযান মাসের শুরুতে আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন ঘোষক ঘোষণা করতে থাকে-

يَا بَاغِيَ الْخَيْرِ أَقْبِلْ، وَيَا بَاغِيَ الشّرِّ أَقْصِرْ.

হে কল্যাণের প্রত্যাশী! অগ্রসর হও। হে অকল্যাণের যাত্রী! থেমে যাও। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৮৭৯৪, সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস-১৬৪২ হ

টীকা

১. আমরা এখানে সূর্য দেবতালিখেছি। অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ উদযাপনে মঙ্গল শোভাযাত্রায় সূর্যের মত যে প্রতিকৃতি দেখা যায় তা সূর্য দেবতার প্রতিকৃতি। মঙ্গল শোভাযাত্রায় বহনকৃত সূর্য দেবতার এ প্রতিকৃতি সম্বন্ধে অন্য অনেকের মত আমারও ধারণা ছিল- এটা নিছক সূর্যের প্রতিকৃতি, তার মাঝে মানব আকৃতির একটা চেহারা উদ্দেশ্যহীনভাবে এঁকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু না, আপনি গুগল ইমেজে গিয়ে সার্চ দিন- সূর্য দেবতা, surya devta, surya lord, surya dev, sun lord, sun god (এগুলো লিখে সার্চ দিন) দেখবেন, পয়লা বৈশাখে বহনকৃত সেই সূর্য দেবতার প্রতিকৃতির প্রায় হুবহু প্রতিকৃতির ছবি পেয়ে যাবেন। অর্থাৎ এটা মঙ্গল শোভাযাত্রায় বহনকৃত শোভাবর্ধক কোনো ফুলনয়; স্বয়ং সূর্য দেবতার প্রতিকৃতি, যা কোনো কোনো বছর শোভাযাত্রার সবচেয়ে সামনে রাখা হয়েছে।

আর কেবল সূর্য-ই নয় আরো বিভিন্ন গ্রহ-নক্ষত্রও পৌত্তলিকদের দেবতা। যেমন, শনি গ্রহ, শনি দেবতা, মঙ্গল গ্রহ, মঙ্গল দেবতা ইত্যাদি।

২. নারীদের বিশেষ শাড়ি আর ফুলের সাজ ইত্যাদি এবং পুরুষ ও শিশুদের সিদুঁর-লাল রংয়ের আল্পনা আঁকা সাদা পোশাকও কিন্তু পৌত্তলিক সম্প্রদায়ের বসন্ত-উৎসবের চেতনাজাত। বসন্তে রং লাগালে বনে বনেশিরোনামে (১ মার্চ ২০১৫) আনন্দবাজার পত্রিকায় হিন্দু ঠাকুর কবি রবিন্দ্রনাথের শান্তি নিকেতনের বসন্ত উৎসবের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। সেখানে রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ প্রতিমাদেবী দোলপূর্ণিমায় নারীদের বিশেষ সাজের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা পয়লা বৈশাখে নারীদের বর্তমান সাজ-পোশাকের মতই। দেবদূত ঘোষঠাকুর বর্ষবরণ উৎসবকে বসন্ত-উৎসবের সাথে মিল দেখার এটিও একটি কারণ। বসন্ত উৎসব, হোলি ইত্যাদি বিষয়ে আগামীতে কিছু লেখা যেতে পারে।

৩. হাতিকে ঠিক কেন সমৃদ্ধির প্রতীক বলা হচ্ছে এবং শোভাযাত্রার সবচেয়ে সামনে রাখা হচ্ছে তা বোধগম্য নয়; তবে হাতির মুখবিশিষ্ট পৌত্তলিকদের গণেশ দেবতাকে মঙ্গল ও সিদ্ধির দেবতা মনে করে তারা। বাংলাপিডিয়ায় লেখা হয়েছে-গণেশ  হিন্দু দেবতা।  শিব ও পার্বতীর পুত্র গণেশ সিদ্ধিদাতা হিসেবে বিশেষভাবে পূজিত হন। তিনি খর্বাকৃতি, ত্রিনয়ন, চতুর্ভুজ এবং হস্তিমস্তক। শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী গণেশের বাহন হচ্ছে ইঁদুর। গণেশ মঙ্গল ও সিদ্ধির জনক বলে সব দেবতার আগে পূজিত হন।” (বাংলাপিডিয়া, ‘গণেশশিরোনামে) আবার ১লা বৈশাখ গণেশ পূজার দিনও বটে!

 

 

advertisement