শাবান-রমযান ১৪৪২   ||   মার্চ-এপ্রিল ২০২১

রমযানুল মুবারকের তোহফা
গ্রহণ করি ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে

সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ.

আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে ইরশাদ করেনÑ

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ.

হে ঈমানদারগণ! তোমাদের প্রতি রোযা ফরয করা হয়েছে, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের প্রতি, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বনকারী (মুত্তাকী) হতে পার। Ñসূরা বাকারা (২) : ১৮৩

রমযানুল মুবারক যেহেতু প্রতি বছরই আসে, সেজন্য এটা অনেকের জন্য পরীক্ষার বিষয় হয়ে যায়। কারণ যে কাজ বারবার করা হয় তাতে ইখলাস ধরে রাখা এবং সে কাজের মাধ্যমে শুধু আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি কামনা ও সওয়াবের প্রত্যাশা তথা ইহতিসাবঅনেক ক্ষেত্রেই কঠিন হয়ে পড়ে। তখন অনেকেই এজাতীয় কাজগুলো করে অভ্যাসবশত। ফলে সে কাজের গুরুত্ব ও মর্যাদা বজায় থাকে না। তার বিনিময়ে আল্লাহ তাআলার যে ওয়াদা সেটা স্মরণ থাকে না। কিংবা সেই ওয়াদার উপর ইয়াকীন ও বিশ্বাস যথাযথভাবে উপস্থিত থাকে না। কারণ কোনো কাজ স্বভাবজাত বা অভ্যাসজাত হয়ে গেলে অনেকটা অভ্যাসের তাগিদেই করা হয়। তাতে অন্য কোনো বিষয় খেয়াল করা হয় না। অথচ হাদীস শরীফে এসেছেÑ

مَنْ صَامَ رَمَضَانَ، إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدّمَ مِنْ ذَنْبِهِ.

যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে (তথা ঈমান ও ইখলাসের সাথে সওয়াবের আশায়) রমযানের রোযা রাখবে, তার অতীত গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ৩৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৬০

এখানে ঈমানের সাথেসাথে সওয়াবের প্রত্যাশা নিয়ে রোযা রাখার কথা বলা হয়েছে। এখান থেকে খুব খেয়াল করে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত এবং পুরো রমযান মাস সেই শিক্ষা মনে রাখা উচিত।

একথা নিশ্চিত যে, এখানের এই বক্তব্য আল্লাহর রাসূল ছাড়া অন্য কারও পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। দুনিয়ার বড় কোনো পণ্ডিত, সফল কোনো দূরদর্শী, সচেতন কোনো মনোবিজ্ঞানী, নাড়িচেনা দক্ষ কোনো হাকিম Ñকেউ একথা বলতে পারবে না। কেউ এমন ঘোষণা দিতে পারবে না যে, কোনো ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাবতথা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনে আজর ও সওয়াবের আশায় রমযানের রোযা রাখলে তার অতীত জীবনের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে! এটা একান্ত নবীর পক্ষেই সম্ভব এবং তিনিই এই সংবাদ দিয়েছেন।

আসলে মানুষ কেন রোযা রাখে? কেন সে পানাহার ত্যাগ করে? প্রচÐ গরমেও সে পানি পান করে না! তীব্র ক্ষুধায়ও খাবার খায় না। অথচ সবকিছুর ব্যবস্থা আছে। চাইলেই সে যে কোনোকিছু গ্রহণ করতে পারে। এমনিভাবে সে আরও অনেক ধরনের কষ্ট করে। অনেক কিছু সয়ে নেয়। এসব কেন করে?

উত্তর পরিষ্কার। এগুলো করে Ñশুধু আল্লাহ তাআলার হুকুম পালনের উদ্দেশ্যে। তাঁর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে। তাঁর কাছ থেকে আজর ও সওয়াব পাবার আশায়।

কিন্তু যারা মনোবিজ্ঞান সম্পর্কে অভিজ্ঞতা রাখেন এবং মানবীয় দুর্বলতা সম্পর্কে খবর রাখেন, তারা জানেনযখন কোনো বিষয় ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয় এবং নির্ধারিত রুটিনের আওতাভুক্ত হয়, তখন সেটা অনেকসময়ই উদাসীনভাবে পালন করা হয় এবং অবচেতন মনে আদায় করা হয়।

রমযান মাসের দাবি

প্রত্যেক জিনিসের মৌসুম থাকে। গরমের মওসুম। শীতের মৌসুম। বৃষ্টির মৌসুম। এমনিভাবে রমযান মাস হল ইবাদতের মৌসুম। এই মৌসুমের দাবি হল, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে রোযা রাখা এবং বেশি পরিমাণে নফল ইবাদত করা।

রমযানের এই মৌসুম এলে সবাই আমোদিত হয়। সবাই রোযা রাখে এবং বেশি পরিমাণে নফল ইবাদত শুরু করে। তবে তাদের খেয়াল থাকে নাকেন তারা রোযা রাখে?

নিঃসন্দেহে তারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে রোযা রাখে। আল্লাহর হুকুম পালনার্থে দিবসে পানাহার ছেড়ে দেয়। এর মাধ্যমে শুধু আল্লাহ তাআলারই সন্তুষ্টি তারা কামনা করে।

মানুষ কী বলবে, কী বলবে নাসেদিকে তাকায় না। একথাও ভাবে না যে, রোযা রাখলে মানুষ আমাকে ভালো বলবে। মানুষ আমার প্রশংসা করবে। না রাখলে মন্দ বলবে এবং আমার সমালোচনা করবে।

তবে আল্লাহর সন্তুষ্টির সেই নিয়ত তাদের হৃদয়ে সবসময় জাগ্রত থাকে না। এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তাদের স্মরণ থাকে না। অথচ সেটা খুবই জরুরি। নিয়তের খবর নেওয়া, আমলের হিসাব নেওয়া, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের প্রতি মনোযোগী হওয়াগুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবুও মানুষ সেদিকে মনোযোগী হয় না। খেয়াল করে নাÑ কেন সে রোযা রাখছে? কেন সে পানাহার ত্যাগ করছে? চাহিদা ও চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা থাকার পরও সে কেন তা থেকে বিরত থাকছে?

রোযার যেসব ফায়েদা বর্ণিত হয়েছে এবং রোযার মাধ্যমে যেসব বিষয় অর্জনের কথা বলা হয়েছে তন্মধ্যে একটি হল তাকওয়া। সরাসরি কুরআন মাজীদে এই ফায়েদার কথা এসেছে।

সেইসাথে রোযার ওসিলায় কামাই রোজগারে বরকত হয়। মানব হৃদয় আলোকিত হয়। গোনাহ থেকে বাঁচার শক্তি অর্জন হয়। আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা সহজ হয়ে যায়। সর্বোপরি তাতে আল্লাহ তাআলার নির্দেশ পালন ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করা হয়।

আমরা পানাহারে সক্ষম হওয়া সত্তে¡ও যখন শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় তা পরিত্যাগ করি, তখন প্রতিটি মুহর্তে আমাদের সওয়াব হতে থাকে। প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের দারাজাত বুলন্দ হতে থাকে। কারণ সামান্য এই ত্যাগ আল্লাহ তাআলার কাছে খুবই দামি। এতে আল্লাহ তাআলা খুব খুশি হন। বান্দা যখন তাঁর হুকুম পালনার্থে এবং তাঁকে খুশি করার উদ্দেশ্যে ক্ষুৎপিপাসার কষ্ট সহ্য করছেএর মর্যাদা তাঁর কাছে অনেক বেশি।

কিন্তু আফসোসের বিষয় হল, আমাদের অধিকাংশেরই সেসব কথা মনে থাকে না। রোযাদারের মর্যাদা কত, তার জন্য আল্লাহ তাআলা কী পুরস্কার নির্ধারণ করেছেন, আল্লাহ তাআলা তাকে কত ভালোবাসেন ইত্যাদি বিষয়ের দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ হয় না। অথচ সেটা খুবই জরুরি। আল্লাহর হুকুমের কথা মনে করা জরুরি। তাঁর সন্তুষ্টি লাভের নিয়ত হাজির রাখা জরুরি। যখন একটা বিষয় নির্ধারিত সময়ে শুরু হয়, নির্ধারিত সময়ে সমাপ্ত হয় এবং সবাই তাতে অংশগ্রহণ করে তখন কে কী নিয়তে অংশগ্রহণ করে সেটা স্পষ্ট থাকা জরুরি। প্রত্যেকের মূল্যায়ন হবে তার নিয়তের ভিত্তিতে।

কিন্তু রমযানের রোযার ক্ষেত্রে দেখা যায়, যেন একধরনের বাতাস আসে এবং সেইসঙ্গে একটি মৌসুম আসে। তাতে চারপাশে নতুন আবহ ছড়িয়ে পড়ে। সবাই সে আবহে প্রভাবিত হয় এবং সে অনুযায়ী আমল শুরু করে। অথচ আসল মাকসাদ ও নিয়তের কথা সবার মনে থাকে না।

এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা বলছি। লখনৌতে যখন প্রথম রেডিও স্টেশন স্থাপন করা হয়, তখনকার কথা। আমাকে বলা হলরমযান মাস তো ঘনিয়ে এসেছে। আপনি এ সম্পর্কে কিছু লিখে দিন, সেটা স¤প্রচার করা হবে। আমি লিখে দিলাম।

এর পরপরই আমাকে কোয়েটাসফর করতে হল। এরপর আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে একটা প্রোগ্রাম হল। সেখানে গেলাম। সেখানেই শুরু হল রমযানের প্রথম রাত। যে রাতে চাঁদ দেখা গেল, সেই রাতে মৌলভী আবু বকর হাসানী সাহেব (যিনি আজ এখানে উপস্থিত আছেন) আমার সেই লেখাটি রেডিওতে পড়লেন।

সফরে একজন মুসলিম সেনা অফিসারের ওখানে আমাদের দাওয়াত ছিল। মাওলানা মনযূর নুমানী ছাহেবও সেখানে ছিলেন। সেই অফিসার আমাদের প্রতি সম্মান ও মহব্বতের প্রকাশ করে দাওয়াত দিয়েছিলেন। তখন সেখানে আরেকজন সেনা কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি বললেন, মাওলানা সাহেব! লখনৌ থেকে আপনার একটি বয়ান স¤প্রচার করা হয়েছে। আমি সেটা শুনেছি। খুবই চমৎকার এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তবে মাওলানা সাহেব! রমযান মাসে ইফতারের সময় যে আনন্দ ও স্বাদ অনুভত হয় সেই কথাটুকু বলেননি। আমি তো কেবল ইফতারের স্বাদ পাওয়ার জন্যই রোযা রাখি!

তো ভাই, আমাদের নামায রোযার অবস্থাই যদি এমন হয়, তাহলে অন্য আমলগুলোর কী অবস্থা?

তাই বলি, দ্বীনের সকল কাজে, সকল আমলে, এমনকি মানবীয় স্বভাবজাত বিষয়গুলোর ক্ষেত্রেও নিয়ত খুব জরুরি। বিয়ে-শাদী, লেনদেন, খাওয়া-দাওয়া, মেহমানদারি করা, কারো সঙ্গে সাক্ষাৎ করা, কাউকে সাহায্য করা, কাউকে মহব্বত করা, এই সব বিষয়েই নিয়ত খুব জরুরি; যাকে উপরের হাদীসে ঈমানান ওয়াহতিসাবানবলে ব্যক্ত করা হয়েছে। এসব কাজে যদি নিয়ত ঠিক করা হয়, তাহলে এগুলোও নেকীতে পরিণত হবে। অন্যথায় নিত্যনৈমিত্তিক সাধারণ কাজ হিসাবেই থাকবে। আন্যরা যেমন এসব কাজ করে আমরাও তেমনি করছি। ব্যস। এরচেয়ে বেশি কিছুই না।

আমি বলছি না যে, মুসলিম এবং অমুসলিমের আমলে কোনো পার্থক্য নেই। তবে দুঃখজনক এই মিল দেখা যায় যে, তারাও সওয়াবের নিয়ত ছাড়া কাজ করে। আমরাও নিয়ত ছাড়া করি! অথচ হাদীসে বলা হয়েছে, ‘ঈমানান ওয়াহতিসাবান’—ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায়...।

বর্তমান সময়ে পুরো উম্মতের মাঝে সবচেয়ে বেশি যে রোগের সংক্রমণ দেখা যায়, সেটা হল এই নিয়তহীনতা। বদ নিয়ত বা খারাপ নিয়ত থাকে খুব কম। নিয়তহীনতা অনেক বেশি। এটা গাফলত ও উদাসীনতার পরিণাম।

মানুষ বড় থেকে বড় কাজ নিয়ত ছাড়া করে ফেলে! ইদানীং তো এই অভিজ্ঞতাও হল এবং সরাসরি দেখতে পেলাম যে, হজ্বের মতো মহান একটি ইবাদতেও আল্লাহর নৈকট্য লাভের নিয়ত থাকছে না। ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হিসেবে সেটা করা হচ্ছে না; বরং তাতেও দুনিয়াবী কিছু পাওয়া-না পাওয়ার হিসাব! প্রসিদ্ধি, সুখ্যাতি ইত্যাদি!

হজ্বের মধ্যেও চিন্তা করছে, মানুষ বলবেঅমুক দশম বার হজ্ব করছে! অমুক পনেরতম! কাউকে কাউকে তো নিজ মুখেই নিজের সম্পর্কে এমন কথা বলতে শোনা যায়এটা আমার দশম হজ্ব! এটা পনেরতম! দেখুন, হজ্বের মতো ইবাদতের ক্ষেত্রেও এখন এই অবস্থা!

অথচ আল্লাহ তাআলার নেক বান্দাদের কোনো কাজই নিয়ত ছাড়া হয় না। প্রতিটি কাজে তাঁরা উত্তম থেকে উত্তম নিয়ত করেন।

যেখানে বসে আমি এখন কথা বলছি, সেই অঞ্চল তো মুজাহিদে আযম হযরত সায়্যিদ আহমদ শহীদ রাহ.-এর জন্মভমি। এখানে তাঁর নামে মাদরাসাও আছে। তিনি বালাকোটে শহীদ হয়েছেন। তিনি বলেছেন, যখন থেকে আমার বুঝ-বুদ্ধি হয়েছে তখন থেকে আজ পর্যন্ত দৈনন্দিন জীবনের কোনো কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কোনো নিয়তে করিনি। ইসতিনজায় গিয়েছি, সেখানেও নিয়ত করেছি, আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পবিত্র হচ্ছি। কারো সঙ্গে হেসে কথা বলেছি, কাউকে হাসিয়েছি, খাবার খেয়েছি, এমনসব কাজেও সেই একই নিয়ত। আল্লাহর হুকুম পালনের মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি লাভ করা।

তিনি এতটাই দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন—‘বুঝ হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত কোনো কাজ আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কোনো নিয়তে আমি করিনি।

আজ যদি আমরা আমাদের খোঁজ নিই, তাহলে বুঝা যাবে, আমরা আমাদের কয়টি ইবাদত আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করছি! কয়টি কাজ আখেরাতে সওয়াব পাওয়ার নিয়তে করছি! আসলে ইবাদত আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ফলে একরকম অবচেতন মনেই এসব আদায় করি।

ক্ষুধা লাগলে খাবার খাই, তাতে আল্লাহ তাআলার আজর ও সওয়াবের ওয়াদার কথা মনে থাকে না। আল্লাহ তাআলার পছন্দের কোনো আমল করি, কিন্তু আল্লাহর পছন্দের কথা অনুভতিতেও থাকে না। কারো মেহমানদারি করি, তাতেও আল্লাহর আজর ও সওয়াবের নিয়ত থাকে না। তাতে থাকে, খ্যাতি ও লোক দেখানো মনোভাব! এই খ্যাতির লোভ ও লোক দেখানো মনোভাব খুব খারাপ জিনিস। এটা আমাদের সবাইকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ছাড়ে।

তবে আমাদের অধিকাংশের অবস্থা হল, অনুভতিহীনতা এবং নিয়তহীনতা। মন্দ নিয়ত কিংবা মন্দ চিন্তা কম। নিয়তহীনতাই বেশি!

তো আমাদের হাসি-কান্না, কথাবার্তা, খাওয়া-দাওয়া, মেহমানদারি, কোথাও যাওয়া-আসা, সবকিছুই নিয়তের উপস্থিতিসহ করা উচিত। দ্বীনের খেলাফ যেসব বিষয় আমরা পরিত্যাগ করি, তাতেও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের নিয়ত থাকা জরুরি। এটা খুবই সহজ কাজ। ব্যাপক সওয়াব লাভের কাজ। এর চেয়ে ব্যাপক কোনো সওয়াবের কাজ পাওয়া মুশকিল। এর জন্য তো কিছুই করতে হয় না। শুধু আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির কথা মনে রাখতে হয়। হাসতে গিয়ে, কথা বলতে গিয়ে এবং এজাতীয় ছোট ছোট কাজ করতে গিয়েও আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির কথা মনে রাখা। এভাবে সকল কাজে যখন নিয়ত ও আল্লাহর হুকুমের অনুভতি এসে যাবে, তখন পুরোটা জীবন শরীয়তের ছকে চলতে শুরু করবে। জীবন তখন সুখের হবে। আনন্দের হবে। শান্তি ও প্রশান্তির হবে।

নামাজ পড়ব, তো আল্লাহর জন্য পড়ব। কোথাও যাব, তো আল্লাহর সন্তুষ্টির কথা মনে রেখে যাব। কারো সঙ্গে সম্পর্ক ও মহব্বত করব, এই নিয়তে করব। এভাবে সকল কাজে যখন এই অনুভতি জাগরূক থাকবে, ‘ঈমান ও ইহতিসাবজাগ্রত থাকবে, জীবন ও ভাবনা তখন শরীয়তের ছাঁচে আবর্তিত হবে।

এখান থেকে আপনি কেবল এই একটি জিনিসই নিয়ে যান যে, প্রতিটি কাজ একমাত্র আল্লাহর জন্য হবে। প্রতিটি বিষয় আল্লাহর সন্তুষ্টি মোতাবেক হবে। আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিকে লক্ষ্য বানিয়ে সব কাজ করতে হবে। তাঁর সন্তুষ্টির নিয়তকে সকল কাজে হাজির রাখতে হবে। একথাই বলা হয়েছে উপরের হাদীসে

مَنْ صَامَ رَمَضَانَ، إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدّمَ مِنْ ذَنْبِهِ.

(যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে তথা ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রমযানের রোযা রাখবে, তার অতীত গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।)

আমি হয়তো কখনো ক্লান্ত কিংবা পেরেশান। এমন সময় একজন মেহমান এল। তার সঙ্গে আমি হাসিমুখে সাক্ষাৎ করব। কারণ মেহমানের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলা নেক আমল। তার ইকরাম ও আপ্যায়ন আল্লাহর সন্তুষ্টির মাধ্যম। যেহেতু আমার সকল কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, তাই মন প্রস্তুত হচ্ছে না, তবুও তার সঙ্গে হেসে কথা বলার চেষ্টা করতে হবে। তার ইকরাম ও আপ্যায়ন করতে হবে। নিঃসন্দেহে সেই আমল আল্লাহ তাআলার খুব পছন্দ হবে। এবং সেটা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতের অনুসরণ হবে।

জীবনের সকল কাজে এই ঈমান ও ইহতিসাবযদি আমাদের অর্জন হয়ে যায়, তাহলে পুরোটা জীবন নূরের চাদরে আবৃত হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলার রহমত ও করুণার বারিধারায় স্নাত হব আমরা, দুনিয়া ও আখেরাতে। এর প্রকৃত ফায়দা দেখা যাবে কিয়ামতের দিন। যখন সবাই আল্লাহ তাআলার সামনে দাঁড়াবে, তখন বুঝে আসবে ঈমান ও ইহতিসাব’-এর মূল্য। ছোট ছোট এই আমলগুলোও দেখা যাবেকত বড় আকারে সামনে আসছে!

কারো কোনো কাজ করে দিয়েছিলাম, কারো সঙ্গে একটু হেসে কথা বলেছিলাম, সেগুলোই দেখা যাবে অনেক সওয়াবের মাধ্যম হয়ে গেছে।

এটাই রমযানুল মুবারকের প্রথম ও সবচে বড় তোহফা। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির নিয়তের গুণ অর্জন করুন। এটাই আপনার জীবনের জন্য বরকতময় এ মাসের পয়গাম ও বার্তা। হ

[খুতুবাতে শাবান ও রমযান,

সংকলন : মুহাম্মাদ ইসহাক মুলতানী, পৃ. ১৫৪-১৫৮

অনুবাদ : মুহাম্মাদ তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব

 

 

 

advertisement