একটি ঈমান বিধ্বংসী কথা
‘আমি দাড়ি-টুপিওয়ালা মানুষ দেখতে পারি না’!
কোনো কোনো মুসলিমকেও কখনো কখনো সগর্বে বলতে শোনা যায়- ‘আমি দাড়ি-টুপিওয়ালা মানুষ দেখতে পারি না’! একে তো এটি একটি ঔদ্ধত্যপূর্ণ বাক্য, সাথেসাথে তা ব্যক্তির কূটিল মানসিকতারও প্রকাশ। দ্বিতীয়ত সে এর প্রকাশ করছে-সকলের সামনে, উঁচু গলায়। আল্লাহ্র পানাহ-তার এ বাক্য থেকে, তার এ মানসিকতা থেকে!
এমন কথা বলার কয়েকটি কারণ থাকতে পারে। এক হল, কোনো দাড়ি-টুপিওয়ালা মানুষ তার সাথে খারাপ আচরণ বা প্রতারণা করেছে, একারণে সে তাকে অপছন্দ করে; সেখান থেকেই এমন কথা বলেছে। এমন যদি হয় তাহলে তো বিষয়টি শোধরানো সম্ভব, তাকে বোঝানো সম্ভব-কোনো একজনের অন্যায়ের কারণে তার মতো লেবাস-সুরতের সকল মানুষকে খারাপ বলাটা সমীচীন নয়।
আর নবীজীর সুন্নত হিসেবে দাড়ি রাখা, টুপি পরিধান করা, দ্বীনদারদের লেবাস গ্রহণ করা প্রশংসনীয় কাজ; কিন্তু কারো সাথে খারাপ আচরণ করা বা প্রতারণা করা কারো জন্যই সমীচীন নয়; তার জন্য আরো সতর্ক থাকা উচিত; কারণ, তার বাহ্যিক সুরত বলে-সে এমন কাজ করবে না।
এ তো গেল একদিক। এটি শোধরানো কঠিন কিছু নয়। কিন্তু যদি অন্য কোনো কারণে সে এমনটি বলে থাকে-যেমন, দ্বীনদার মানুষের প্রতি অবজ্ঞা, দাড়ি-টুপির প্রতি অবজ্ঞা, তাহলে তো ঈমানের খতরা! এ অবস্থা হলে নিজের ঈমানের খবর নেওয়া দরকার-
আমার মাঝে নেফাক-মুনাফেকী নেই তো! কারণ আমার নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ভালবাসা তো আমার ঈমান; তাঁর তো দাড়ি ছিল, তিনি তো টুপি পরিধান করতেন। আমার মাঝে যদি সত্যিকারের ঈমান থেকে থাকে তাহলে দাড়ি-টুপির প্রতিও আমার ভালবাসা-ভালোলাগা থাকবে!
নবীজীর পর সাহাবা-তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন, পীর-আউলিয়া থেকে নিয়ে উম্মাহ্র আলেমগণ দাড়ি-টুপিওয়ালা ছিলেন। তাঁদের অনুসরণেই সাধারণ দ্বীনদার মুমিন-মুসলিমরাও দাড়ি-টুপি গ্রহণ করেছে। কারণ যে যাকে পছন্দ করে, তার সাথে তার হাশর হবে। ফলে মুমিনরা চায়-সীরাতে-সুরতে নবী-সাহাবীদের মতো হতে; তাঁদের আদর্শ গ্রহণ করতে। লেবাস-সুরতে তাদের সাদৃশ্য অবলম্বন করতে। কারণ, তারা নবী-সাহাবীদের দলভুক্ত হওয়ার প্রত্যাশী; অখেরাতে তাঁদের সঙ্গলাভের প্রত্যাশী। ফলে দাড়ি-টুপি দ্বীন-ঈমানেরই একটি নিদর্শন।
এখন দ্বীন-ঈমানের একটি নিদর্শন দাড়ি যদি আমি দেখতে না পারি, নবী-রাসূলগণের সাদৃশ্য যদি আমার চোখের কাঁটা হয়; কাফেরদের সাদৃশ্য যদি আমার ভালো লাগে, আমি তাহলে নবীজীর ঐ বাণী স্মরণ করি-
مَنْ تَشَبّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ.
কোনো সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য যে গ্রহণ করে সে তাদেরই একজন। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪০৩১
হাদীস শরীফে দাড়িকে ‘ফিতরাত’ বা আল্লাহপ্রদত্ত সৃষ্টিগত স্বভাব-এর অন্তর্ভুক্ত বলা হয়েছে। এই স্বভাবের উপরই আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-
عَشْرٌ مِنَ الْفِطْرَةِ: قَصّ الشّارِبِ، وَإِعْفَاءُ اللِّحْيَةِ...
দশটি বিষয় ‘ফিতরাতে’র অন্তর্ভুক্ত : মোচ কাটা, দাড়ি লম্বা রাখা,...। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬১
আরবীতে ‘ফিতরাত’ শব্দের অর্থ স্বভাব। আল্লাহ তাআলা যে উত্তম মানবীয় স্বভাব সৃষ্টি করেছেন তার সর্বোত্তম নিদর্শন নবী ও রাসূলগণ। এ কারণে ‘ফিতরাত’ শব্দটির অর্থ করা হয়, আদর্শ ও অনুকরণীয় স্বভাব, তথা নবী ও রাসূলগণের স্বভাব। (দ্রষ্টব্য : ফাতহুল বারী, হাদীস ৫৮৮৯-এর অধীনে)
সকল নবী এ ফিতরাতের উপর ছিলেন। সুতরাং দাড়ি হল ‘ফিতরাত’ ও মুমিনের স্বভাবজাত বিষয় এবং সকল নবীর সুন্নত। এখন বলুন, কেউ যদি নবীদের সুন্নত ও মুমিনের ‘ফিতরাত’-এর অন্তর্ভুক্ত বিষয়টি দেখতে না পারে তাহলে...! অথচ খোঁজ করলে দেখা যাবে, এ ব্যক্তির পিতা বা দাদাও দাড়ি-টুপিওয়ালা ছিলেন। তাহলে সে কেন এমন কথা বলছে? নিশ্চয় তার মাঝে কোনো রোগ সুপ্ত আছে, যার প্রকাশ ঘটেছে এ বাক্যে! আল্লাহ হেফাজত করুন!
হাদীস ও সুন্নাহ্র বিধান অনুযায়ী দাড়ি রাখা ওয়াজিব। আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাড়ি রাখার আদেশ করেছেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন-
أَنّهُ أَمَرَ بِإِحْفَاءِ الشّوَارِبِ، وَإِعْفَاءِ اللِّحْيَة.
আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মোচ ছাঁটার ও দাড়ি লম্বা করার আদেশ করেছেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৯
শুধু তাই নয়; দাড়ির ক্ষেত্রে মুশরিক, অগ্নিপূজারীদের বিরোধিতা করতে বলা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-
خَالِفُوا المُشْرِكِينَ: وَفِّرُوا اللّحى، وَأَحْفُوا الشّوَارِبَ.
মুশরিকদের বিরোধিতা কর। দাড়ি বড় কর ও মোচ ছাঁটো। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৮৯২
আরেক হাদীসে ইরশাদ হয়েছে-
جُزّوا الشّوَارِبَ، وَأَرْخُوا اللّحى خَالِفُوا الْمَجُوسَ.
মোচ ছাঁটো এবং দাড়ি বড় কর; অগ্নিপূজারীদের বিরোধিতা কর। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬০
যাইহোক দাড়ি বিষয়ে নবীজীর এমন স্পষ্ট নির্দেশ থাকার পরও কোনো মুসলিম দাড়ি নিয়ে এভাবে বলতে পারে না। আল্লাহ্ই রক্ষাকারী!
তেমনিভাবে টুপিও মুসলিম উম্মাহ্র ‘শিআর’-জাতীয় নিদর্শন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন ও তাবে তাবেয়ীনের যুগ থেকে প্রতি যুগে এর উপর ব্যাপকভাবে আমল রয়েছে। সুতরাং কোনো মুসলিম কেবল টুপিওয়ালা হওয়ার কারণে তাকে অপছন্দ করা কীসের আলামত-ব্যক্তি নিজেই ভেবে দেখুক।
এছাড়া অনেক নারীকেও এমন বলতে শোনা যায়, আমি দাড়ি-টুপিওয়ালা ছেলে পছন্দ করি না। এটা সকলের ক্ষেত্রে এমন নয় যে, অবজ্ঞাবশত বলছে; বরং তার সমাজ ও চারপাশের দাড়িবিহীন মানুষগুলোকে দেখতে দেখতে তার মাঝে ভালো লাগার বা পছন্দ-অপছন্দের ভিন্ন একটি মানদণ্ড দাঁড়িয়ে গেছে। এটিও সংশোধনযোগ্য। কারণ একটি ছেলের সকল যোগ্যতা রয়েছে; সাথে তার উল্লেখযোগ্য একটি ভালো গুণ-সে নবীজীর সুন্নতকে গ্রহণ করেছে, দাড়ি রেখেছে; (আল্লাহ ও রাসূলের কাছে পছন্দনীয়) তার এই ভালো গুণকে আমি অপছন্দের মানদণ্ড বানাচ্ছি, একারণে আমি তাকে অপছন্দ করছি!
একজন মুসলিম নারী হিসেবে স্বাধীনভাবে একটু ভেবে দেখি, আমার চারপাশ আমার মাঝে পছন্দ-অপছন্দের যে মানসিকতা তৈরি করে দিয়েছে তা কি গ্রহণযোগ্য? আমি মুসলিম; সে হিসেবে আমার পছন্দ-অপছন্দের এ নীতি উল্টো নয় কী?
আরেকটি বিষয় হল-আমাদের সমাজে এমনও শোনা যায় যে, মুসলিম মালিকের কোম্পানিতে চাকরিপ্রার্থী যোগ্য মুসলিম ব্যক্তিকে সকল যোগ্যতার বিচারে সেরা হওয়া সত্ত্বেও কেবল দাড়ির কারণে চাকরি দেওয়া হয় না; এর চেয়ে অমানবিকতা ও জুলুম আর কী হতে পারে? এটি মানুষকে আল্লাহ্র পথ হতে বাধাদানের একটি জঘন্য মাধ্যম! একে মানসিক বিকার ছাড়া আর কী অভিধায় ব্যক্ত করা যেতে পারে?! আল্লাহ আমাদের এ অবস্থার সংশোধন করে দিন।
সবশেষে মাসিক আলকাউসারে প্রকাশিত ‘ঈমান সবার আগে’ প্রবন্ধে (৩য় কিস্তি, রজব ১৪৩৪/মে ২০১৩ সংখ্যা, পৃ. ১০-১১) এ বিষয়ে যা লেখা হয়েছিল, তা আমরা আবার স্মরণ করি (প্রবন্ধটি বই আকারেও প্রকাশিত হয়েছে। পুরো প্রবন্ধটিই সকলের পড়া প্রয়োজন।)-
“(শিরোনাম) ঙ. পছন্দ-অপছন্দের ক্ষেত্রে আমার নীতি উল্টা না তো?
জগতে পছন্দ-অপছন্দের অনেক মানদণ্ড আছে। মানুষের স্বভাবটাই এমন যে, এতে সৃষ্টিগতভাবেই কিছু বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ রয়েছে আর কিছু বিষয়ে অনাগ্রহ ও বিমুখতা বরং ঘৃণা ও বিদ্বেষ। কিন্তু কেউ যখন ইসলাম কবুল করে এবং ঈমানের সম্পদ লাভ করে তখন তার হাতে এসে যায় পছন্দ-অপছন্দের প্রকৃত মানদণ্ড। সে মানদণ্ড হচ্ছে আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর প্রদত্ত শরীয়ত। সুতরাং যা কিছু আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কাছে পছন্দনীয় এবং শরীয়তে কাম্য তা মুমিনের কাছে অবশ্যই পছন্দনীয় হবে, যদিও অন্য কোনো মানদণ্ডে লোকেরা তা পছন্দ না করুক, কিংবা স্বয়ং তার কাছেই তা স্বভাবগতভাবে পছন্দের না হোক। আর যা কিছু আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কাছে অপছন্দের এবং শরীয়তে নিষিদ্ধ, তা তার কাছে অবশ্যই অপছন্দনীয় হবে, যদিও অন্য কোনো মানদণ্ডে লোকেরা তা পছন্দনীয় মনে করে, কিংবা স্বভাবগতভাবে তার নিজেরও ঐ বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ থাকে। মুমিন সর্বদা নিজের পছন্দ-অপছন্দকে দ্বীন ও ঈমানের দাবির অধীন রাখে। সে তার স্বভাবের আকর্ষণকে আল্লাহ তাআলার রেযামন্দির উপর কোরবান করে।
এজন্য ঈমান যাচাইয়ের এক গুরুত্বপূর্ণ উপায় হল, নিজের অন্তরকে পরীক্ষা করা-তাতে পছন্দ-অপছন্দের মানদণ্ড কী। আল্লাহ, তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও শরীয়তের পছন্দ-অপছন্দ, না প্রবৃত্তির চাহিদা; নিজের গোত্র, দল, দলনেতা, পার্থিব বিচারে মর্যাদাবান শ্রেণী, শুধু শক্তির জোরে প্রবল জাতিসমূহের সংস্কৃতি, সাধারণের মতামত, পার্থিব জীবনের চাকচিক্য কিংবা এ ধরনের আরো কোনো কিছু?
যদি তার কাছে মানদণ্ড হয় প্রথম বিষয়টি তাহলে আল্লাহ্র শোকগোযারী করবে আর যদি মানদণ্ড হয় দ্বিতীয় বিষয়গুলো তাহেল খালিস দিলে তওবা করবে। নিজের পছন্দকে আল্লাহ ও তাঁর বিধানের অধীন করবে, আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর উসওয়ায়ে হাসানার (শরীয়ত ও সুন্নতের) অনুগামী করবে এবং ঈমানের তাজদীদ ও নবায়ন করবে।...”
আল্লাহ আমাদের ঈমানের হেফাজত করুন এবং মুসলিমদেরকে এজাতীয় বিষয়ে সচেতন হওয়ার তাওফীক দান করুন-আমীন। হ